অচলা বুড়ি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ছড়ার ছবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (page 62 crop).jpg

অচলা বুড়ি

অচলবুড়ি, মুখখানি তার হাসির রসে ভরা,
স্নেহের রসে পরিপক্ক অতিমধুর জরা।
ফুলে ফুলাে দুই চোখে তার দুই গালে আর ঠোঁটে
উছলে-পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে।
পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা,
কপালে দুই ভুরুর মাঝে উলকি-আঁকা ফোঁটা।
গাড়ি-চাপা কুকুর একটা মরতেছিল পথে,
সেবা ক’রে বাঁচিয়ে তারে তুলল কোনােমতে।
খােড়া কুকুর সেই ছিল তার নিত্যসহচর;
আধপাগলি ঝি ছিল এক, রাড়ি বালেশ্বর।
দাদাঠাকুর বলত, ‘বুড়ি, জমল কত টাকা,
সঙ্গে ওটা যাবে না তাে, বাক্সে রইল ঢাকা-
ব্রাহ্মণে দান করতে না চাও নাহয় দাও-না ধার ।
জানােই তাে এই অসময়ে টাকার কী দরকার।’
বুডি হেসে বলে, ‘ঠাকুর, দরকার তাে আছেই,
সেইজন্যে ধার না দিয়ে রাখি টাকা কাছেই।’


সাঁৎরাপাড়ার কায়েতবাড়ির বিধবা এক মেয়ে,
এক কালে সে সুখে ছিল বাপের আদর পেয়ে।
বাপ মরেছে, স্বামী গেছে, ভাইরা না দেয় ঠাঁই
দিন চালাবে এমনতরো উপায় কিছু নাই।
শেষকালে সে ক্ষুধার দায়ে, দৈন্যদশার লাজে,
চলে গেল হাঁসপাতালে রােগীসেবার কাজে।

 ছড়ার ছবি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (page 64 crop).jpg

এর পিছনে বুড়ি ছিল আর ছিল লােক তার
কংসারি শীল বেনের ছেলে মুকুন্দ মােক্তার।

গ্রামের লােকে ছি-ছি করে, জাতে ঠেলল তাকে—
একলা কেবল অচল বুড়ি আদর করে ডাকে।
সে বলে, ‘তুই বেশ করেছিস যা বলুক-না যেবা,
ভিক্ষা মাগার চেয়ে ভালাে দুঃখী দেহের সেবা।’


জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধ, বেগার খাটার ডাক—
রাই ডোম্নির ছেলে বললে, কাজের যে নেই ফাঁক,
পারবে না আজ যেতে। শুনে কোতলপুরের রাজা
বললে, ওকে যে ক’রে হােক দিতেই হবে সাজা।
মিশনরির স্কুলে পড়ে, কম্পােজিটরের
কাজ শিখে সে শহরেতে আয় করেছে ঢের—
তাই হবে কি ছােটোলােকের ঘাড়-বাঁকানাে চাল!
সাক্ষ্য দিল হরিশ মৈত্র, দিল মাখনলাল—
ডাক-লুঠের এক মােকদ্দমায় মিথ্যে জড়িয়ে ফেলে
গােষ্ঠকে তাে চালান দিল সাত বছরের জেলে।
ছেলের নামের অপমানে আপন পাড়া ছাড়ি
ডােম্‌নি গেল ভিন গাঁয়েতে পাততে নতুন বাড়ি।
প্রতি মাসে অচলবুড়ি দামােদরের পারে
মাস-কাবারের জিনিস নিয়ে দেখে আসত তারে।
যখন তাকে খোঁটা দিল গ্রামের শম্ভু পিসে
‘রাই ডোম্নির ’পরে তােমার এত দরদ কিসে’
বুড়ি বললে, ‘যারা ওকে দিল দুঃখরাশি
তাদের পাপের বােঝা আমি হালকা করে আসি।’


পাতানাে এক নাৎনি বুড়ির একজ্বরি জ্বরে
ভুগতেছিল স্বরূপগঞ্জে আপন শ্বশুরঘরে।

মেয়েটাকে বাঁচিয়ে তুলল দিন রাত্রি জেগে,
ফিরে এসে আপনি পড়ল রােগের ধাক্কা লেগে।
দিন ফুরলাে, দেব্তা শেষে ডেকে নিল তাকে-
এক আঘাতে মারল যেন সকল পল্লীটাকে।
অবাক হল দাদাঠাকুর, অবাক স্বরূপকাকা—
ডােমনিকে সব দিয়ে গেছে বুড়ির জমা টাকা।
জিনিসপত্র আর যা ছিল দিল পাগল ঝিকে,
সঁপে দিল তারই হাতে খোঁড়া কুকুরটিকে।
ঠাকুর বললে মাথা নেড়ে, ‘অপাত্রে এই দান!
পরলােকের হারালাে পথ, ইহলােকের মান।

[? আষাঢ়] ১৩৪৪
শান্তিনিকেতন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন