অনির্বাণ দাস এর কবিতা


মন
অনেকটা ঝিঁঝি পোকার মতো
দেখা যায় না
ডাক শোনা যায়


ধর্ম
খুচরো–ও আছে,নোট-ও আছে
আর মাসের শেষে
ট্রেনের কিছু ফুরিয়ে যাওয়া মান্থলি
দুটো একটা ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া চিঠি
আর হয়তো একটা শুকনো জুঁই ফুল
একটা কোনো ভিজিটিং কার্ড, পাসপোর্ট সাইজ ফটো
—এই সব
ঈশ্বরেরই আর এক নাম মানিব্যাগ
তিনি সকলের
জানে বলেই তো
গোপন সাধনে তাঁকে খুঁজে ফেরে পকেটমারের নিঃশব্দ হাত…


ব্যাডমিন্টন
কোর্ট থেকে কোর্টে
রেকেট থেকে রেকেটে
নেটের উপর দিয়ে বারবার শুধু এদিক ওদিক এদিক ওদিক
করতে করতেই
একজনকে হারিয়ে আরেক জনকে জিতিয়ে দিয়ে
নেটের গায়ে আটকে যাওয়া ফেদারটিরই
ডাকনাম মন
খেলতে খেলতে খেলতে খেলতে
ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই
কর্কের পালকগুলো কখন যেন আলগা হয়ে গেছে…


তুমিও
বিষাদ আসলে এক ধরনের হলুদ রঙের লিফলেট,
মাঝরাস্তায় সারা দুপুর পড়ে থাকে,এদিকে ওদিকে
ছড়িয়ে থাকে,ওড়ে মাঝে মাঝে
মানুষজন,গাড়ি ঘোড়ার অনন্ত ব্যস্ততার পিছন পিছন
খানিকটা যায় কখনো কখনো, কখনোবা লেপ্টে থাকে
ঝড় জলে,ছিঁড়েও যায়
আমি ছোটবেলায় নানা রঙের লিফলেট জমাতাম।
সিঙ্গল্ লাইন
দুমুখো দুইজনেই আমরা
পরস্পর মুখে ঘুরিয়ে দাঁড়াই এখন
এই স্টেশানে
তোমার ভিতরে যে আছে
সে শুধু ভাবে-
আমি চলে যাচ্ছি
আমিই সরে সরে যাচ্ছি
তাকে তুমি স্তিতি গতির পদার্বিথদ্যা বুঝিও না
শুধু এটুকুই বোলো-
মুখোমুখি দেখা হওয়াটা ভালো নয় দুটো ট্রেনের


করুনাময়
চার আনা আট আনা দেয় কেউ কেউ
চলে যেতে যেতে
কেউবা দু’টাকা এক টাকা,কপালে ছুঁয়ে
এভাবেই সারাদিন একটু একটু করে
জমা হয়
নোট ও কয়েন
দিনান্তে প্রনামীবাক্স উপুড় করে ঢালেন
ছদ্মবেশী পূজারী-
দেবতার উঠানে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ধ্যান
উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে
লোভ, পাপ, ভয়, ভক্তি, ঘুষ…


একা
এখনও শেষ হয়নি পরীক্ষা
জানিনা আরো কতো উওর দেওয়া বাকি
ঘন্টা পড়লেই জমা দিয়ে যেতে হবে
এই না-লিখতে পারা খাতা
সাদা সাদা পাতা গুলোর সামনে
আমি শুধু বসে আছি একা এখন
আর ছুঁয়ে ছঁয়ে দেখছি প্রশ্নপত্র
আমর নিরুপায় কলম
ওয়ার্নিং বেল অসহ্য বাজছে
ভিতরের কোনো বারান্দায়
দৃষ্টিহীন পরীক্ষার্থী আমি, বুঝতেও পারিনি
আমাকে কখন ছেড়ে চলে গেছে আমার রাইটার


ধরা
কাকে যেন কবে ভালো বেসেফেলেছিল
আর তার পর থেকেই
অনন্ত অন্ধকারের ভিতর
এই ঘুরে মরা
ঘুরতে ঘুরতে দিন
ঘুরতে ঘুরতে রাত
ঘুরতে ঘুরতেই গ্রীষ্ম বর্ষা শীত
তুমি ঘোরো একজনের জন্য
তোমার জন্য ঘোরে আরেক জন…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবটুকু কলঙ্ক নিয়েই


অবৈজ্ঞানিক
চুম্বক থেকে
একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে
শান্তি পায় লোহা
আকর্ষণ অথবা বিকর্ষণ
কোথাও কিছু নেই
লোহার ভিতরে একটা চুম্বক শুধু
গুমরে গুমরে মরে…


স্বধর্মের গান
গাছের ধর্ম পুষ্পে পত্রে , মেঘের ধর্ম জলে
পাখির ধর্ম দুইটি ডানায় , ঢেউয়ের ছলাতছলে
ব্লেড-ই ধর্ম পকেটমারের , সূঁচের ধর্ম সুতো
রেনটাক অম্বলের ধর্ম পাঁউরুটিসম্ভূত
ধোঁয়ার ধর্ম উর্ধ্ব পানে , ঘুঁটের ধর্ম পোড়া
ফোস্কা সোনাই পায়ের ধর্ম জুতোটি


 আনকোরা
এনগেজ আর এনগেজ শুধু , এত কথা কার সাথে
প্রেমের ধর্ম ফোন চেক করা , প্রহরীর পাহারাতে
সাপের ধর্ম একেবেঁকে যায় কাঠের ধর্ম ঘূণে
পানের ধর্ম সুপুরি খয়ের বোঁটার আগায় চুনে
শরীর-ই ধর্ম নি:স্ব শরীরে করাতের কাঠ চেরা
থানার ধর্ম ধর্ষিতাকেই সবার সামনে জেরা
মাটির ধর্ম শিকড়ের গানে , মাথার ধর্ম ধরা
হারিয়ে যাওয়াই ছাতার ধর্ম , তাকানোর ধরা পড়া
নিজের-ই ধর্মে চলেছে জগত্ প্রস্তর থেকে প্রাণ
অসুখ সারে না , ভালোবাসা ছাড়া ওষুধ আছে


মেরি জান
সার্জারি
ভাঙা হাড়
জোড়া লেগে ঠিক হয়ে গেছে কবে
এখন একদম নর্মাল সব
হাঁটা চলা শোওয়া বসা-
নো প্রবলেম
বোকা এক্স-রে প্লেট শুধু
ভাঙা পাঁজরের ছবিটা
বুকে আঁকড়ে পড়ে আছে আজও
ড্রয়িং
একটা গোল্লা দাও প্রথমে
বড় করে
তারপর তার ভিতর আবার
ছোট ছোট দুটো
এই হল চোখ
এ’বার একটা দাগ দিয়ে নাক
তারপর ঠোঁট
তারপর কান
মাথায় কিরিকিরি করে কয়েকটা দাগ দিয়ে চুল….
মানুষ আঁকতে গেলে এখনো আমি
প্রথমে শূন্য লিখি


ট্যুর
এই যে এত চড়াই উতরাই এখানে
এই যে এত কুয়াশা
বন্ধুর পথ,অদ্ভুত শীতলতা
যতদূর যাব
পাশে পাশে যাবে খাদ
একটা রেলিং,মৌখিক ভদ্রতার মতো
তবু মেঘ এসে ধরা দেয় নিজে থেকে
আর ঘুম একটা স্টেশনের নাম
আজকাল মনে হয় শুধু-
বেড়াতে এসেছি


চাওয়া
অথচ হাত তুলে তাকে বলছে না – আলবিদা
বলছে না-ভালো থেকো
দেখা হবে – বলছে না
এতদিনের একটা আকাশ থেকে
খসেপড়া তারাটির কাছেও
হাত পেতে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বার্থ
বলছে –
এটা দাও, ওটা দাও, সেটা দাও


ইলেকট্রনিক
সবিনয়ে আজ স্বীকার করে নিই
কাগজপত্র নেই, ছিলনা কখনো
এভাবেই এতদিন ধরে
এই যে এত চলছি,ঘুরছি,জ্বলছি
সবই কিন্তু হুক করে
অথচ সাপ্লাই অফিস
বুঝতে চাইছে না কিছুতেই
যতবার ‘মিটারবক্স্’-এর সঙ্গে
‘আমার’ কথাটা জুড়তে গেছি
ততবারই এখানে লোডশেডিং নেমে এসেছে….


অচিন
খিস্তি খাচ্ছি স্বাভাবিক ভাবেই
পদে পদে হোঁচট
পরে ঢুকেছি আমি
শো শুরু হয়ে গেছে আগেই
এই অন্ধকার হলের ভিতর
আমাকে আমার সিট দেখিয়ে দেবে বলেছিল
একটা টর্চ


ছল
এখানে ফোটানোর মতো সূচ
যথেষ্টই আছে
এখানে আছে যথেষ্ট খানাপিনা
রংবেরঙের ছোট বড়
আছে লাগানোর জিনিসও
টিউব থেকে টিউবে
খাও মাখো লাগাও আর আশ্চর্য হয়ে দ্যাখো
সেই ম্যাজিক-
সেরে যাচ্ছে…সেরে যাচ্ছে সব…
আমাদের মজাদার এই চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিতর
একটা স্টেথোস্কোপ শুধু সেই কবে থেকে
কাকে যেন খুঁজে পাচ্ছে না


নেপথ্য
বাইরে থেকে বোঝা যায় না
ভিতরে কত কাটাছেঁড়া ছিল
কতবার কত পেরেক কত
ক্ষতচিহ্ন এঁকে রেখে গেছে
স্বীকার করো আর না করো
টায়ারের জীবনে এভাবেই কিন্তু
থেকে যায় একেকটি টিউব
অর্থনৈতিক
আমরা এই
খুচরো পয়সার
চারআনা আটআনা জীবনে
তাহলে কী শিখলাম ?
শিখলাম
একশো,পাঁচশো,হাজার
যে যত বড় নোট
সে কিন্তু তত বেশি সন্দেহজনক


ব্যালেন্স
টাকার অঙ্কে
যার যত শূন্য বাড়তে থাকে
সে তত বড়লোক
বড়লোক আর ধনী কিন্তু এক নয়
একজনের অনেক শূন্য
অন্যজনের শূন্যতা
মহাবিদ্যা
যত টানবে
ভিতর থেকে পরতে পরতে
খুলে যাবে আমার ভাঁজ
কত যে অজানা কথা গুড়ি গুড়ি, গোপন
কত উওর
অবৈধ সে সব?
ধরা পড়লে যে কোনো সময় রাস্টিকেট জানি
তীক্ষ্ণ চোখে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রৌঢ় ইনভিজিলেটর
জানে না, তাকেও যে কেউ
ঠিকঠাক নজরে রেখেছে
পাহারা ক্লান্ত হলে
শিল্প শুরু হয়ে যাবে
এখন শুধুই অপেক্ষা, শুধুই টের পাওয়া

 স্পর্শ
জীবন খারাপ ছাত্র
আমি তার চোরা পকেটে আছি
নিরুপায়
কখনো কখনো আটকে যাচ্ছি
আবর্জনার মধ্যে লাট খাচ্ছি
তারপর আবার ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে
এই ঘোলা জলে ভেসে যাওয়া একা
কী জানি কোথায়…
জুটি ভেঙে গেলে এভাবেই
বুকে চরণচিহ্ন নিয়ে
শহরের হাইড্রেনে ভেসে যায় একেকটি চপ্পল
সানাই
বিয়ে-শাদির ধুম লেগে যায় প্রতিবার
বেজে ওঠে সানাই
শীতের রাতে শব্দ বহুদূর চলে যায়
খুঁজে বেড়ায় কুয়াশার ভিতর, আর
ফিরবার আগে অন্ধকারের কানে কানে
বলে যায় –
সে নাই… সে নাই…
মহাজাগতিক
গ্রহ আর নক্ষত্রের পার্থক্য বলছি ক্লাস থ্রি-তে, বলছি
কার নিজস্ব আলো আছে কার নেই, বলছি কে কার
কক্ষপথে ঘোরে আর কে স্থির হয়ে থাকে … বলছি
ছায়াপথের ধারে কিন্তু কোনও দোকানবাজার নেই …
ওরা হাঁ করে শোনে … নোনাধরা ইশকুলবাড়ির
দেয়াল একটা একটা করে কখন যেন ভ্যানিশ হয়ে
গেছে সেই হাঁ দেখে … মাথার উপর থেকে উড়ে গেছে
ছাদ … আর ওরা শুধু বলে – স্যার, অনেকগুলো
পৃথিবী আছে? বলে – যে তারাটা এখন দেখতে পাচ্ছি
ওটা কী করে মারা গেলো? বড় হয়ে তোরা আমায়
বলে যাস উত্তরটা … আমি বলি … অসহায় মাস্টার …
তারপর কখন যেন ছুটি হয়ে গেছে
দেখি মাঠের মাঝখান দিয়ে পিঠে ব্যাগ কাঁধে ওয়াটার বটল, …
মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে আকাশ …
হালুম
ঠাকুর বলেছেন –
বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়
আজকাল মাঝে মাঝে ভাবি কথাটা
ইশকুলের বারান্দায় বসে
ওদের জিজ্ঞাসা করলাম
হ্যাঁরে, তোরা তো দেখেছিস?
ওরা তো আর বড় হয়ে যায় নি
তাই সত্যি কথাই বলে, আর আমিও বিশ্বাস করি
সবাই সমস্বরে বলে – হ্যাঁ …
বাঘ কী খায় রে?
কেন, মানুষ খায়।
আর?
আর ধনেপাতা দিয়ে মাছের ঝোলভাত
আর?
আর জিলাপি খায়
আমার দিকে তাকিয়ে
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে ডোরাকাটা সংসার,
বিশ্বাস করি বলে …

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন