সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সংগ্রহ



ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা

ভালোবাসা মানেই কেবলই যাওয়া
যেখানেই থাকি না কেন
উঠে পড়া
পেয়ে গেলে নিকটতম যান

কলকাতা কিছুতেই ফুরতে চায় না
কোনো রাস্তা ফুরতে চায় না
কখনও তুমি মিনিবাস ধরে নেবে
আমি ঝংকার দেওয়া ট্রাম—
তারপর থেকে কেবলই যাওয়া
কাছ থেকে অনেক দূরে
কিংবা সময় ঠিক করা থাকলে কাছে আসা
ক্যাথিড্রালের দুর্লভ ঘণ্টা বাজছে
সখ্যতায় ভরে উঠেছে ময়দান
মাঘের বিকেলে।
এক চিলতে গলি তারই নাম সুখ
তারই অন্ধকারে
আমি স্পর্শ করেছিলাম তোমার দিব্য চিবুক—

 সঙ্গে সঙ্গে শৈলসানু আঁধার হয়ে এল
গোলপাতা ছাউনির ঘর
শীতরাত্রির স্বপ্ন ক’টি মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে গেছে
শীলাতল
ব্যগ্র হয়ে কেড়ে নিচ্ছে উত্তাপ কোমল
দু’জনের থেকে—
তোমার চিবুক স্পর্শ ক’রে কতদূর আমরা যেতে পারি
এক চিলতে গলি তারই নাম সুখ
তারই অন্ধকারে
স্বপ্ন থেকে স্বপ্নে প্রস্থান আলবৎ সম্ভব
অথবা দুঃখের ভিতর থেকে আরো দুঃখের ভিতর
নিয়ে যেতে পারে
ভালোবাসা

 
ভালোবাসা মানে কেবলই যাওয়া
কোলকাতা রোল করা গালিচার মত কেবলই খুলে
যাচ্ছে কেবলই
আমাদের পায়ের নিচে
ফুরোচ্ছে না।

 
তবু ভালোবাসা ফুরায়ে গেলে
আমি অপ্রেম থেকে চলে যাব ব’লে
অভিমানে বাসস্টপে এসে হাত নেড়ে ডাকি

ভালোবাসা কখনও কখনও চলে যাওয়া
ঘর গ’ড়ে ঘর ভেঙে ফেলা
তারপর উঠে পড়া
পেয়ে গেলে নিকটতম ট্রাম
পড়ে থাক রাজবংশ বৈভব যা কিছু
সব ছেড়ে চলে যেতে পারে শুধু ভালোবাসাই—

সেই কোনোদিন
ফিরে এসে তাকাতে পারে অকপটে অনিমেষ
ক্যাথিড্রালে ঘণ্টা বাজলেই
কিনতে থাকবে মুহূর্ত এন্তার
একরাশ ব্যক্তিগত নীল নক্ষত্রমালা।




পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে

পেছন থেকে কে চিৎকার করে উঠতেই
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম

ঝিলের মধ্যে আকাশ গা ডুবিয়ে রয়েছে
অতিকায় নিমবাস মেঘ
স্তম্ভিত প্রতিবিম্বে
বনপথে শরৎ ছিল বা
বিবশ গন্ধের মধ্যে মনে পড়ে।

কটা বাজে কে জানে
ঘড়ির একটা দাগও স্পষ্ট নেই এতদিনে
কোথায় কোথায় আয়েস পরিতৃপ্তি লিপ্সা ছিল
সব কটি দাগ মুছে গেছে
আন্দাজে কিছু বলা ঠিক হবে না তো,
কৈফিয়ত আফসোস
এই মুহূর্তে এসবের কোনো দাম নেই।

ভারী, দামী পাথরের টুকরোর মত সময়কে
ঢালু জমির ওপর গড়িয়ে যেতে দেখছি
জলের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে,
অনতিপ্রদোষের মধ্যে
সব ছবিগুলো ডুবে যাবে
ঝিল, জলের ভিতরে ছায়া আকাশনিমের।
কার মুখ দেখা যাবে
আততায়ী অত্যাচারী কিনা
এই সবই পড়ন্ত ছায়ার মধ্যে সন্ধান করেছিলাম
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যে সামনে এসে দাঁড়াল
সে আমার এতগুলি বছরের নিঃসঙ্গতা
হাস্যকর ভাঁড়ের পোশাকে।





 এক এক দিন 


এক এক দিন
একটা নদী জেগে ওঠে এই দেহটার মধ্যে 
কূল ভেঙে দেয় 
নিরাপদ যা কিছু ছিল খরস্রোতে ভাসে 

এক এক দিন 
ভালোবাসার জন্যে মনে এত ঢেউ ওঠে 
সেই সুনামিতে 
হাট বাজার কাছারি দপ্তর সব ভেসে যায় 

এক এক দিন 
সুন্দরের জন্যে হাহাকার 
আকাশ বাতাস বসন্তের  ভরিয়ে দেয় 

এক এক দিন 
নদী জেগে ওঠে ডমরু বাজিয়ে 
তোমারও ঘুম ভাঙাতে চায় 
বসন্তের গানও সেদিন বুঝি বলতে চায় 
যেদিন থাকবো না সেদিনও ভালোবেসো 

স্মৃতি ও এক এক দিন সত্যি হয়ে ওঠে।




সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা


ঢের প্রেম করা হয়ে গেছে, দুচোখের আরশিতে
ঘুরে ফিরে দেখা আত্মপ্রতিকৃতি বিভিন্ন ভঙ্গিতে,
তারপর অনিবার্য ক্লান্তি অবসিত সুধা। সারি
দিয়ে যেখানে বৃক্ষেরা সেইখানে হব বনচারী
ভেবে ছুটে গেছি বনে, তবু হ'তে পারি নি তাপস।

জনারণ্যে ফিরে এসে শিকড় নাবিয়ে খুঁজি রস
জীবনের, আর প্রেম অপ্রেম চাই না প্রেমিকা না,
চাই নারী একজন যে হবে দোসর, যার জানা
কেন এইখানে আসা কেন শুরু হয়েছে ভ্রমণ,
শেখাবে রহস্য এই বাঁচবার, চাই না রমণ।





ভালোবাসা কি?


যদি রূপ দেখে কাউকে ভালোবাস সেটা
ভালোবাসার নয়----সেটা বেছে নেওয়া।

যদি কারো দেহ দেখে ভালবাসো সেটা
সেটা ভালবাসা নয়--- সেটা লালসা। 

যদি কারো টাকা দেখে ভালবাসো সেটা
ভালোবাসার ন‌য়---সেটা লোভ।

তাহলে ভালোবাসা কাকে বলে?

যদি কারো মন দেখে ভালবাসো তাহলে--
সেটা ভালবাসা।

যদি তুমি এক নজর দেখার জন্য ছটফট করতে
থাকো তাহলে-----সেটাই ভালবাসা।



সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা


"শব ছুঁয়ে বসে আছে কেউ
চলে গেছে শ্মশানের মিতা,
আগুনের ভালোবাসা চেয়ে
পড়ে আছে চন্দনের চিতা।

কতকাল এই রূপে যাবে
শবের উপরে রেখে জানু,
অহল্যা পাথর কবে পাবে
বারুদের ক্রুদ্ধ পরমাণু?"




আরো কিছু সংগ্রহ 












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন