নির্মলেন্দু গুণ এর কবিতা সংগ্রহ

 

যাত্রাভঙ্গ

নির্মলেন্দু গুন


হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে

মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না

এক কে করি দুই।


হেমের মাঝে শুই না যবে,

প্রেমের মাঝে শুই

তুই কেমন কর যাবি?

পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া

আমাকেই তুই পাবি।


তবুও তুই বলিস যদি যাই,

দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।


তখন আমি একটু ছোঁব

হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর

বিদায় দুটি পায়ে,

তুই উঠবি আমার নায়ে,

আমার বৈতরণী নায়ে।


নায়ের মাঝে বসবো বটে,

না-এর মাঝে শোবো,

হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ

দুঃখ দিয়ে ছোঁব।




তোমার চোখ এতো লাল কেন

--নির্মলেন্দু গুণ


আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই

কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,

শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।

বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।


আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে

কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,

আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ

নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।

আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :

আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,

পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা

তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।

এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।


আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা

খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।

কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে

জিজ্ঞেস করুক : 'তোমার চোখ এতো লাল কেন ?'




শুধু তোমার জন্য

--নির্মলেন্দু গুণ



কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে

গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।

তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও

কতবার যে আমি সে কথা বলিনি

সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য

দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম

আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ

‘এই ওঠো,

আমি, আ…মি…।‘

আর অমি এ-কী শুনলাম

এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে

কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে

কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,

আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,

আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।

তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,

আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।




ওটা কিছু নয়

--নির্মলেন্দু গুণ


এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।

এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,--না, না, না,

-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর

মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি--আমার যৌবন ।


সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ--প্রেমিক,

ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;

রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,

নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,--এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে

হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।


অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;

অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।




যুদ্ধ

--নির্মলেন্দু গুণ


যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,

যুদ্ধ মানেই

আমার প্রতি তোমার অবহেলা।




মাছি

--নির্মলেন্দু গুণ


একটি মাছি বুকের 'পরে

একটি মাছি নাকে,

একটি মাছি আমাকে চেনে

একটি চেনে তাকে।


আমাকে চেনে,তাকেও চেনে

সেই মাছিটি কই?

নাকেও নেই, বুকেও নেই

চোখের জলে ঐ।




আসমানী প্রেম

--নির্মলেন্দু গুণ


নেই তবু যা আছের মতো দেখায়

আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি,

সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায়

তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি !


জেনেও ভালোবেসেছিলাম তারে ,

ধৈর্য ধরে বিরহ ভার স'বো ;

দিনের আলোয় দেখাবো নিষ্প্রভ

জ্বলবো বলে রাতের অন্ধকারে ।


আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে

মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ?

আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে

গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে !


মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে

বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে !

মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে ,

ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে !




তুলনামূলক হাত

--নির্মলেন্দু গুণ


তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর

তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই

খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে

আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর

চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে

তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই

তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে

খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার

সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল

তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন

তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷

আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো

তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই

ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই

তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে

আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি

তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো

আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই

হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন