‘যেটুকু পথ পেরোতে বন্ধুদের তিন মিনিট লাগত—তা অতিক্রম করতেই
আমার লাগত কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট—এভাবেই একদিন আমি খুব
পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম—পেছনে তাকালে আমাকে দেখতে পেত
না কেউ—পেছনে কেবল ঝরাপাতার ওড়াউড়ি, ফেল করা বালকের
মুখচ্ছবি... ’ [ দৌড়]
কবির মৃত্যুর পর তার কোনো কোনো কবিতার মানে যেন পাঠকের উপলব্ধিতে নতুনভাবে ধরা দেয়। ওপরের এই কবিতাটিও তেমনি ভিন্ন এক মানে নিয়ে হাজির হয় আমার কাছে। কবিতাটি আপন মাহমুদের। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভোরে আচমকা মৃতের দেশে চলে গেছে সে। আপন আমার বন্ধু, আমাদের বন্ধু। তাকে নিয়ে লিখতে এত বছর পরও হাত কাঁপে! অবাক লাগে, দেখতে দেখতে আট বছর হয়ে গেল আপনের চলে যাওয়ার! বিশ্বাস হতে চায় না, যে নিজেকে সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকার কথা বলে, সে-ই চলে গেল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে।
ওর জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার বই মাত্র একটি ‘সকালের দাঁড়িকমা’, যেখানে ‘মা ও প্রজাপতি সিরিজ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিতাসহ বেশ কিছু চৌকস কবিতা রয়েছে। যা তরুণ কবিদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। মৃত্যুর মাস তিনেক আগে আপন আমাকে বলেছিল, ‘হাত তুলেছি সাব এডিটর’ নামে একটি কবিতার বই করবে। ওই কবিতাগুলোতে তুলে আনার চেষ্টা করা হবে দীর্ঘদিন মফস্বল ডেস্কে কাজ করতে গিয়ে আপনকে যেসব মফস্বল সংবাদ সম্পাদনা করতে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা। ওই বইয়ের জন্য লেখা কিছু কবিতাও তখন শুনিয়েছিল সে। কয়েক বছর আগে আপনের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে ‘আপন মাহমুদ সমগ্র’বের হয়েছে। সেখানে আছে কবিতাগুলো। আপনের কবিতাসমগ্র হাতে নিয়ে ভাবছিলাম, কে লিখবে আপনের না লেখা কবিতাগুলো!
‘যেটুকু পথ পেরোতে বন্ধুদের তিন মিনিট লাগত—তা অতিক্রম করতেই
আমার লাগত কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট—এভাবেই একদিন আমি খুব
পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম—পেছনে তাকালে আমাকে দেখতে পেত
না কেউ—পেছনে কেবল ঝরাপাতার ওড়াউড়ি, ফেল করা বালকের
মুখচ্ছবি... ’ [ দৌড়]
কবির মৃত্যুর পর তার কোনো কোনো কবিতার মানে যেন পাঠকের উপলব্ধিতে নতুনভাবে ধরা দেয়। ওপরের এই কবিতাটিও তেমনি ভিন্ন এক মানে নিয়ে হাজির হয় আমার কাছে। কবিতাটি আপন মাহমুদের। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভোরে আচমকা মৃতের দেশে চলে গেছে সে। আপন আমার বন্ধু, আমাদের বন্ধু। তাকে নিয়ে লিখতে এত বছর পরও হাত কাঁপে! অবাক লাগে, দেখতে দেখতে আট বছর হয়ে গেল আপনের চলে যাওয়ার! বিশ্বাস হতে চায় না, যে নিজেকে সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকার কথা বলে, সে-ই চলে গেল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে।
ওর জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার বই মাত্র একটি ‘সকালের দাঁড়িকমা’, যেখানে ‘মা ও প্রজাপতি সিরিজ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিতাসহ বেশ কিছু চৌকস কবিতা রয়েছে। যা তরুণ কবিদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। মৃত্যুর মাস তিনেক আগে আপন আমাকে বলেছিল, ‘হাত তুলেছি সাব এডিটর’ নামে একটি কবিতার বই করবে। ওই কবিতাগুলোতে তুলে আনার চেষ্টা করা হবে দীর্ঘদিন মফস্বল ডেস্কে কাজ করতে গিয়ে আপনকে যেসব মফস্বল সংবাদ সম্পাদনা করতে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা। ওই বইয়ের জন্য লেখা কিছু কবিতাও তখন শুনিয়েছিল সে। কয়েক বছর আগে আপনের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে ‘আপন মাহমুদ সমগ্র’বের হয়েছে। সেখানে আছে কবিতাগুলো। আপনের কবিতাসমগ্র হাতে নিয়ে ভাবছিলাম, কে লিখবে আপনের না লেখা কবিতাগুলো!
বটগাছ
আমার মাথায় শেকড় রেখে একটা বটগাছের বেড়ে উঠবার কথা
ছিল — কথা ছিল নিদাঘ দুপুরে পাতা নেড়ে নেড়ে সে সবুজের নেতৃত্ব
দেবে, ছায়াদের অভিভাবক হবে, হবে পাখিদের আশ্রম — তার কিছুই
হলো না — আমার ফলাকাঙ্ক্ষি মা-বাবা বটগাছের পরিবর্তে আমার
মাথায় মধ্যবিত্তীয় একটা ফলের বীজ বপন করে দিয়েছেন — আর
কতটা পরিচর্যা করলে গাছটি সামাজিক হবে, ধার্মিক হবে, সুস্বাদু
ফল দেবে — তারই দেখভাল করছিলেন আমার শিক্ষক-শিক্ষিকারা
তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমি এখন একটা সুশীল ফলগাছ — নিয়মিত
অফিসে যাই — বাড়িতেও টাকা পাঠাই
আমার আর বটগাছ হওয়া হলো না।
দৌড়
যেটুকু পথ পেরোতে বন্ধুদের তিন মিনিট লাগতো — তা অতিক্রম করতেই
আমার লাগতো কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট — এভাবেই একদিন আমি খুব
পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম — পেছনে তাকালে আমাকে দেখতে পেতো
না কেউ — পেছনে কেবল ঝরাপাতার ওড়াউড়ি, ফেল করা বালকের মুখচ্ছবি …
ইজিপশিয়ান সেই কচ্ছপের মতো এখন আমি তোমার কাছে পৌঁছে
গেছি! কেউ নেই চারপাশে — চল, আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা
নতুন করে নিজেদের উচ্চতা মাপি — আর সবচে দ্রুতগতিসম্পন্ন
বন্ধুটিকে প্রশ্ন করি, ‘তোমার খোঁড়া বন্ধুটি কেমন আছে’
দৌড় ভালোবেসে যারা আজন্ম হতে চেয়েছিলো প্রথম — দ্যাখো, তাদের
কেউ কেউ এখনো নিজেদের কাছেই পৌঁছাতে পারেনি! অথচ,
বকুলপাড়ার পঙ্গু ছেলেটিই একগুচ্ছ ঘাসফুল নিয়ে এসে নিজেকে
জয়ী ঘোষণা করলো!
সাঁতার
এক-একটি নদী পেরোনোর চে এক-একটি নারী পেরোনো অনেক ভয়ের
কেননা এক-একটি আহত পাখি এক-একটি মৃত পাখির চেয়ে অনেক
বেশি বেদনা বহন করে — তবু আমাদের পেরোতে হয়, পেরোতে হয়
সুদীর্ঘ ঝড়ের আর্তনাদ…
এক-একজন নারীর সঙ্গে পরিচয় হওয়া মানে এক-একটা
অচেনা নদীর দেখা পাওয়া — এক-একটা নারীর চলে যাওয়া
মানে এক-একটি নদীর মরে যাওয়া…
বস্তুত, কতগুলো মৃত নদীতেই আজন্ম সাঁতরায় মানুষ, কতগুলো
ভুল মানুষ আর ভুল সম্পর্কের যোগফলই মানুষের প্রাপ্তি
এক-একটি নদী পেরোনোর চে এক-একটি নারী পেরোনো অনেক
ভয়ের — কেননা, সাঁতার জানলেই সব নদী পেরোনো যায় না।
বিকেল, মনে মুনিয়া
বিকেলের আগেই ঘুরে আসা ভালো ভোরের শিশির,
নামমাত্র বন্ধুত্ব — চোখের পর্দা থেকে ঝেড়ে নেওয়া
ভালো রাত্রির ঘুম, অন্ধকার — দেখে নেওয়া ভালো
সকালের দাঁড়ি-কমা, গানের দুপুর — বুঝে নেওয়া
ভালো বকুলের বাকিখাতা
বিকেলের খোলা মাঠে শুধু ছায়াই দীর্ঘ হয় না — মনেও
ওড়ে মুনিয়া পাখি — তাই তো বিকেল হলেই গড়াগড়ি
শুরু করে শৈশবের বল — কেঁপে ওঠে সপ্তম শ্রেণী —
প্রাইভেটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে চৌধুরীবাড়ির মেয়েরাও
বিকেলে আমি না-ও থাকতে পারি, নিজের ভেতর থেকে
বেরিয়ে পড়তে পারি অযথাই — ঘোষণা ছাড়াই ছড়িয়ে
পড়তে পারি দূরে, অতীতে…
সত্য-মিথ্যা
আমার শৈশবের বড় বড় মিথ্যেগুলো ক্রমেই ছোট
হয়ে আসছে — কোনো কোনো মিথ্যে এখন সত্যের মতো
সামনে এসে দাঁড়ায়! কোনোটা তো দূরে দাঁড়িয়েই ক্রমাগত
কুয়াশা ছড়ায় — কোনোটার সামনে পড়লে আবার
আমিই ছোট হয়ে যাই!
আমার শৈশবের বড় বড় সত্যগুলোও ক্রমে ছোট হয়ে
আসছে — কোনো কোনো সত্য এখন মিথ্যের কাঁধেই হাত
রেখে চলে — কোনোটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো…
কোনোটা তো আজ আর ঘরেই ফেরে না!
সত্য-মিথ্যের প্রসঙ্গ এলে এখন আমি আকাশের দিকে
তাকাই — কেননা, ওদিকে তাকানো ছাড়া আমার মন
ভালো হয় না — খারাপও হয় না।
ফুলসঙ্কটের দিনে
যারা নদী ও পাহাড়ের গল্প বয়ে বেড়ায়
আর মাথায় নিয়ন আলোর অভিশাপ নিয়ে
অন্ধকারে কাটায় অবসর, আমি তাদেরও
বলবো না তোমার কথা — কেননা, ফুলসঙ্কটের
দিনে পৃথিবীতে ভ্রমরের সংখ্যা বেড়ে যায়!
আমি নিঃসঙ্গ দুপুরে হেঁটে যাওয়া মালির পদধ্বনির
সঙ্গে ফুলফোটার শব্দ মিলিয়ে যেতে দেখি, আর
এখানে ওখানে লিখি ‘অপেক্ষা’।
স্কাউটবালিকা
মুঠোভর্তি রোদ ঘরে আনতে পারেনি বলে যে বালক সারাটা দুপুর
অভিমানের ভেতর বসে আছে, আমি তার মুখচ্ছবি আঁকি — আঁকি
রোদ্দুরে হারিয়ে যাওয়া দূর মুনিয়া পাখি
বিষাদের ভাই হয়ে বসে থাকি, রাত্রির হাত ধরে বাঁশঝাড় কাছে
এসে বলে ‘জোনাকিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে বলো’; আমি তাদের
দুধমাখা ভাতের লোভ দেখাই — বলি, স্কাউটে ভর্তি হয়ে যাও
তোমরা সবাই…
স্কাউটের বেল্টবাঁধা সেই বালিকা — আজো কেন বুকের ভেতর
লেফট-রাইট করছে!
উল্টোপথ
যে মন্দিরে আর ঘণ্টা বাজে না আমি তার প্রতিবেশী, মসজিদও
খুব কাছে নয় — সন্ধ্যায়, প্রার্থনার হাওয়ায় মন রেখে আমি তাই
উল্টোপথে হাঁটি…
উল্টোপথে মসজিদ নেই, মন্দির নেই, কেবলই প্রশ্নের
বিড়ম্বনা — সেই প্রশ্ন, যার উত্তরে অনায়াসে বলে দেওয়া যায়
‘কুয়াশা-কুয়াশা’ কুয়াশা! যা কিনা পৃথিবীর যাবতীয় শিল্পকে
অবমাননার হাত থেকে রক্ষা করে
উল্টোপথেই হাঁটি, শুনেছি এ পথেই পাওয়া যায় ডোডোপাখির
বরফাচ্ছন্ন ডানা, আদিমতম গুহার ওম, আর ব্যক্তিগত
আকাশের খোঁড়াখুঁড়ি…
ঝরাপাতার উপহাস
আবার শীত এলে আমি সবটুকু আকাশ ছেড়ে দেবো
অতিথি পাখিদের, জলাশয়ের কাছে যাব না, বাজাবো
না সিটি, কেননা পাখিদের অবাধ ওড়াউড়ি পৃথিবীতে
যে গানের আবেশ ছড়ায়, আমি তার টুকিটাকি
জমিয়ে রাখি
আবার শীত এলে আমি ভাঁপা পিঠার ফেরিওয়ালা হবো,
কার্ডিগান বেচবো শহরের অলিগলি — কেননা, ভাঁপা পিঠার
ধোঁয়ার সঙ্গেই কেবল তনুশ্রীদের হাসির বিনিময় সঙ্গত
আবার শীত এলে আমি মরেও যেতে পারি
ছড়িয়ে ঝরাপাতার উপহাস…
কথা, পাহাড়ের সঙ্গে
পাহাড়, তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে — বিশেষত মনমরা বিকেলে
কী করো তুমি — কার কথা ভাবো — কে তোমার কান্নাকে প্রথম ঝরনা
বলেছিলো? আমি? আমি দু-চারটা সিগারেট বেশি খাই, চুপচাপ
ঘুরিফিরি — দাড়ি কেন কাটতে হবে, ভাবি…
মাঝেমাঝে নিজেকে শৈশবের হাতে তুলে দিয়ে ঘড়ি দেখি — ঘড়িতে
৩৪টা বাজে! ফুল পাখি নদী ওরা কেমন আছে?
পাহাড় তুমি কি জানো, রজনীগন্ধা সবজি নয় কেন!
টু রোকেয়া হল
আমাদের প্রায় সবারই কিছু-না-কিছু গল্প আছে — আছে শৈশব-মোমে জ্বলা
দু-একটি সিঁদুরে মুখ — দূরে, কাশবনের ভেতর থেকে বারবার বেরিয়ে আসা
ছেলেগুলো আমাদের বন্ধু — ভালোবাসার জন্য একদিন আমরা পকেটের গোপন
আধুলিটাও ভিক্ষুকের থালায় রেখেছি — অথচ, সাইমারা দেশছাড়া — শিরিনেরা
ঘোলাজলে দ্যাখে মুখ — আর লোপাদের মুখে কেবল সন্তানের দুষ্টুমি!
আমাদের কোনো কোনো বন্ধু স্বর্গে যাবে বলে মদের টেবিলেও মগজে টুপি
রাখতো — প্রায়ই আমরা বালিকাময় বিকেল ঘুরতে যেতাম — মাঠের মাঝখানে
বসে দেখতাম দূর্বাঘাসের চে অধিক নরম স্বপ্ন — অথচ, প্রিয় বন্ধুটির
কবরে মাটি না-দিতে পারার আক্ষেপটুকুও আজ আমাদের কারো নেই!
ঈশ্বর যেখানে আছে থাকুক, ওপথ আমার সরু মনে হয় — আমাদের চিয়ার্সের
শব্দ থেকেই শুরু হবে অনাগত গানের প্রবাহ — এই ভেবে এখনো আমরা
পানশালায় যাই, যদিও পুলিশ দেখলেই আজকাল মদের নেশা কেটে যায়!
আমাদের রয়েছে লিখতে না-পারার মতো দুর্যোগ আর ভালোবাসতে না-পারার
মতো অনটন — বন্ধুরা, আবহাওয়া ১৬ আগস্ট থেকেই খারাপ — সমুদ্রে লঘুচাপ,
নৌকা ভিড়ে আছে উপকূলে, উনুনে শূন্য হাঁড়ি — জানি, বুকের আগুনে একটা ডিমও
সেদ্ধ হয় না — তবু, স্বর্গ যদি থাকে, তোমরা যাও — আমি রোকেয়া হলের দিকেই…
ভাঙাশ্লেট
কতগুলো মৃতপাহাড় কচ্ছপের মতো বসে আছে বুকে
মালগাড়ি মনে করে যাদের পিঠে তুলে দি-ই আজো
সিগারেটের বাক্স, দেশলাই---তুলে দি-ই ডাক্তারের
নিষেধাঞ্জা, মায়ের অনুরোধ
আটালির মতো বসে থাকা অদ্ভূত মালগাড়িটা পুরনো স্টেশনের
কোনো এক মধ্যদুপুরের মতো ---আমাকে নি:সঙ্গতার গান গেয়ে শুনায়
মনেপড়ে একদিন কচ্ছপ মারতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছি
প্রিয়শ্লেট, খড়িমাটি
কে জানে সেই ভাঙাশ্লেটেই তোমার নাম লিখা ছিলো কি-না !
ও মেঘ, বউয়ের মতো মেঘ
ও মেঘ, বউয়ের মতো মেঘ; আমাকে প্রেমিকার
মতো ভেজাও--দ্যাখো, চিন্তার সোনালি আঁশ শুকিয়ে
যাচ্ছে। আমি তেমন প্রার্থনা জানি না-- বড়জোর
ছেলেব্যাঙ-মেয়েব্যাঙয়ে বিয়ে দিতে পারি--থু লেপে
ভিজিয়ে দিতে পারি নিজের শুকনো ঠোঁট
মেঘ, তুমিও কি অপচয়ের ভয়ে আর আগের মতো
ঝরো না--জলখরচের ভয়ে আমি যেমন কান্নাকে
... দূরে রাখি--থাক অতো হিসাব-নিকাশ--দ্যাখো,
চালতাফুল তাকিয়ে আছে অবিবাহিত খালাতো
বোনের মতো! যদি ভেজাও তুমি--হবো শাপলায়
ভরে যাওয়া মাঠ
শুনো; গল্পের উঠান কি একাই ভিজবে আমাদের
সর্দি-কাশির অজুহাতে! এসো, ছাতাহীন হাঁটুরের মতো
ভিজি--আরো কাছে গিয়ে দেখি আষাঢ়ের ভেজা বউদি
ও মেঘ, বউয়ের মতো মেঘ; আমাকে সাহারার হাত
থেকে বাঁচাও।
বেদনা জীবনানন্দের মতো
নিজের সঙ্গে খুব হাসাহাসি করে ফেলেছি আমি, কেঁদেছিও- এখন লাস্যময়ীদের অহেতুক হাসির
বাষ্প আমার চোখে লাগে না- জানি, নিজেকে কি করে একটি খোঁড়া পিঁপড়ার কাছে বসিয়ে
রাখতে হয়- লাইজুদের মুখ মনে রেখে কি করে ভুলে যেতে হয় বেনারসির 'লাল'।
নিজের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করতে গিয়ে দেখি, মৃতনদীদের বেদনাপ্রবাহ নিয়ে আমার বর্গাচাষি
পিতা কতটা নীল! সেই থেকে জল অথবা পানি খরচের ভয়ে আমি আর কাঁদি না- সেই থেকেই
নিজের কাঁধে হাত রেখে বলে আসছি, 'বেদনার চে' বড় হও, বেদনা জীবনানন্দের মতো'।
নিজের সঙ্গে খুব হাসাহাসি করে ফেলেছি আমি, এখন অভিমানের দেওয়াল ভেঙে নিজের ভেতর
নিজেই ঢুকতে পারি না।
লালপাড় শাদাশাড়ি বলে কিছু নেই
লালপাড় শাদাশাড়ি বলে কিছু নেই
সবই রঙের হুমকি-ধমকি, সবই রাত্রির চে' বড়।
পৃথিবীর তলপেটে ছুরি মেরে কী তুমি বোঝাও কৃষ্ণচূড়া!
কী তোমার গল্প পলাশ; দ্যাখো, বেলিফুলের মালা মাত্র দু'টাকা।
লালপাড় শাদাশাড়িতে কী এমন যায় আসে
যখন পৃথিবীর সব গান ফিরে আসে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে!
আলতা পায়ে কি তুমি বোঝাও নৈর্ব্যক্তিক বালিকা
আমি তো চলে গেছি সেই কবে, রেললাইন ধরে
তোমার হাসির মতো অযথাই হেঁটে হেঁটে...
লাল নীল শাদা দ্যাখো- রাত্রির মতো সুবিশাল শ্লেটে
সব কিছু কুয়াশা পর্যন্ত...
বিলবোর্ড
তোমাকেই ডাকতে চেয়েছিলাম পেছন থেকে, জানাতে চেয়েছিলাম
ফুল, পাখি আর প্রজাপতি রাত। অথচ কোলাহল এসে কেমন
আড়াল করে দিল সব, লোকাল বাস এসে বাজাল হর্ন!
তোমাকেই খুঁজতে গিয়েছিলাম বিকেল-বিকেল মাঠে। অথচ
সন্ধ্যা, সন্ধ্যারা সব ঘরে নিয়ে গেল! রাত্রি হাসল হা হা...
তোমাকেই জানাতে চেয়েছিলাম কেন ঘুম হয়নি সুদীর্ঘকাল। বলতে
চেয়েছিলাম মেঘ, বৃষ্টি ও নারী নূপুর হতে কুড়িয়ে পাওয়া গান। অথচ
শীতকাল এসে কবিতার দিকে তাকিয়ে বলল 'কুয়াশাই জয়ী'!
তোমাকেই ডাকতে চেয়েছিলাম পেছন থেকে, অথচ
বিলবোর্ড এসে দাঁড়াল!
মা প্রজাপতি ও অন্যান্য কবিতা- ১৮
মা, তোমার বেজার মুখের প্রতিবেশী আমি এক চুপচাপ বালক- নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি সেই কবে, নবম শ্রেণীতে- নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছি সেই কবে, জিল্লাল মিয়ার দীঘিতে- এখনো আনানসির মতো ঘুরছি দ্যাখো, বন্ধুর লোভে...
মা, তোমার প্রসববেদনা থেকে সেই কবে পথের শুরু- হাঁটতে হাঁটতে পৃথিবী দুপুর হয়ে গেছে- তবু বন্ধুর মতো কোনো ছায়া নেই চারপাশে- বটের ছায়াও কিনতে পাওয়া যায় না পুঁজির বাজারে...