জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা
- শামসুর রাহমান
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, অবসন্ন হাটুরের মতো বসে আছি
হাঁটু মুড়ে নগর ভেলায়।
এ এক প্রকৃত খেলা, এই ভেসে-যাওয়া তীরবর্তী শোভা দেখে,
জ্যোৎস্নার মাধ্যমে গড়ে তোলা মধুর সম্পর্ক কোনো
মহিলার সাথে।
বাতিল প্রেমিক যদি ফের খুঁজে পায় বেলাবেলি সম্প্রীতির ডেরা,
তাহ’লে সে নীলিমাকে জানিয়ে অভিবাদন, প্রায়
ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে অপরাহ্নে
ঘাসের অম্লান সবুজকে চুমু খেয়ে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, হাত রেখে
খরগোশ অথবা কাঠবিড়ালীর পিঠে, দেয়ালের শ্যাওলায়
মগ্ন হবে গৃহপ্রবেশের সূরে এক লহমায়। কয়েক শতাব্দী তার
আঙুলে উঠবে নেচে, দেশলাই জ্বালালে আঁধারে
প্রাচীন দেয়ালচিত্র অকস্মাৎ হবে উন্মোচিত, বুঝিবা আহত হবে
কাতর হৃদয় তার অতীতের অসামাজিকতা হেতু আর
রাখবে সে চোখ টিকটিকি কিংবা বাতির ওপর।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, ঢাকাও মরাল হতে জানে
পূর্ণিমায়, দেখে নিই। যেন দরদালান সমেত যাচ্ছে উড়ে
দুলিয়ে বিপুল ডানা মগজের জ্যোৎস্নায় আমার।
ওলোট-পালোট কত স্মৃতি গোলাপের মতো ঝরে
এখন আমাকে ঘিরে, ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে পড়ি।
শৈশব কাঠের ঘোড়া চেপে আসে, যৌবনের খর দিনগুলি,
রাত্রিগুলি খুব মেশামেশি করে রক্ত কণিকায়,
চামর দোলায় কোন, অব্যক্ত তরুণী, তবু কিছু স্বেদচিহ্ন
থেকে যায় আমার এ শরীর-পেরুনো অন্য এক অবয়বে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা, আমিও ভাসছি ক্রমাগত।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে, ঢাকা ওরা মৃত, ওরা পূর্বগামী পরিজন,
বুঝি ওরা বারংবার মরীচিকার চিৎকার শুনে
ছুটে গেছে, কোথায় যে মরুদ্যান প্রস্রবণ নিয়ে
আমন্ত্রণে উন্মুখর বেলা শেষে, করেনি খেয়াল। ওরা মৃত,
ভ্রান্তির গহ্বরে ওরা হারিয়ে ফেলেছে কণ্ঠস্বর।
দেখি প্লেগ-কবলিত শহরের মতো
ক্রুর অমাবস্যার এলাকা-
ছিন্নভিন্ন জামা, জীর্ণ জুতো পড়ে আছে ইতস্ততঃ
কাঁটাগুল্ম, পাথরের মধ্যে, ফুলের কেয়ারিগুলি ভরে ওঠে
পচা নাড়িভুড়ি আর হাড়গোড়ে। দেখি কতিপয়
ন্যাংটো লোক পথে
করছে বপন মৃত্যু,-আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছি তাহ’লে?
আমার অসুখ বলে ঢাকা মন খারাপ করেছে।
ওর চোখে-মুখে বিষণ্নতা জেগে থাকে সারাক্ষণ,
যত বলি ফুল্ল স্বরে, ভেবোনা লক্ষ্মীটি, আমি খুব
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবো, দেখে নিও,
তত সে খারাপ করে মন, চোখে জমে অশ্রুকণা,
আমার শিয়রে বসে থাকে ঠিক নার্সের ধরনে।
জ্যোৎস্নায় ভাসছো তুমি ঢাকা বেসামাল পূর্ণিমায়।
যাবো না স্বাস্থ্যের লোভে কোনো শৈলাবাসে,
তুমি আছি থেকো তুমি আমার অসুখ সেরে যাবে।
জ্বরদগ্ধ চোখে দেখি জ্যোৎস্না-ধোয়া স্নেহজাত পথ্য
তার হাতে নাচ আর রোজ নিয়ে আসে কিছু ফুল
রোগীর টেবিলে সুখ ফোটানোর অমল উদ্দেশ্যে।
আমার অস্তিত্ব থেকে অসুখের ছায়া সরে যাচ্ছে, দেখে যাও।
হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল
- শামসুর রাহমান
হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল হয়ে কেঁদেছে ক’দিন তার
খবর রাখেনি কেউ। শূন্যতায় বেড়িয়েছি ভেসে,
যেন আমি কাটা ঘুড়ি, অনেক কষ্টেও মৃদু হেসে
সহজে নিয়েছি মেনে সামাজিকতার অত্যাচার।
আমাকে নিষণ্ন পেয়ে গৌরী প্রশ্ন করে, ‘কবি তুমি
এমন নিষ্পৃহ কেন আজকাল, এমন শীতল
উচ্চারণে, আচরণে? আমি কি ঢেলেছি ঠাণ্ডা জল
তোমার উদ্দীপনায়? ভাবাচ্ছে সন্ত্রন্ত জন্মভূমি?
কী দেবো উত্তর আমি? নিজেই জানি না, শুধু জানি
অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরি দিনরাত কেঁপে
উঠি ঘন ঘন একা ঘরে, ছায়াচ্ছন্ন এক প্রাণী
শিঙ নাড়ে, কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে, আসে ব্যেপে
কুঞ্জটিকা হৃদয়ে আমার, তবু তোমাকেই খুঁজি
প্রতিক্ষণ, এদিকে ফুরায় দ্রুত পরমায়ু-পুঁজি।
তোমার নালিশের পরে
- শামসুর রাহমান
আজকাল মাঝে মাঝে সকালে কি সাঁঝে আমাকে ঘিরে
বেহাগের করুণ সুরের মতো বাজে তোমার নালিশ। আমার
কথা না কি এখন আগেকার মতো তোমার হৃদয়ে সরোবর
তৈরি করতে পারে না, পারে না লাল নীল পদ্ম ফোটাতে
হাওয়ায় ঈষৎ দুলে-ওঠা মানস সরোবরে আমার কথার
মুখ এখন তোমাকে লতাগুল্ম, ফুল, ফলমূল, আর
রঙ বেরঙের পাখির গানে গুঞ্জরিত দ্বীপে পৌঁছে দিতে না
পারার ব্যর্থতার কালি মেখে নিশ্চুপ থাকে প্রায়শ,
এইটুকু তুমি স্পষ্টতই উচ্চারণ করেছ। কস্মিনকালেও বাকপটু
নই আমি, প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারিনি কোনও চারুবাকের।
এই দড় কথা গুছিয়ে বলার খেলায়। তুমি যথার্থই বলেছি আমি
লোকটা ঘোর স্বার্থপর। স্বীকার করি, অনেক কথাই সযত্নে
সঞ্চিত রাখি কবিতার জন্যে। কথোপকথনের মুহূর্তে কথা পাখির
কোন্ পালক কখন ছোঁব, বুঝতেই পারি না। পরিণামে কিছু
অনাবশ্যক, বেসুরো কথা অথবা দীর্ঘ নীরবতা।
থাক এসব বকুনি। এই যে আমি আমার ভালোবাসার
মঞ্জরী সাজিয়ে রাখি তোমাকে বুকে, তোমার কালো
চুলের ঢালে, তোমার আসা-যাওয়ার পথে, সেগুলো
তুমি কুড়িয়ে নাও না কেন?
১৩৩৩
- জীবনানন্দ দাশ
তোমার শরীর —
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন
চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে
কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে!
কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
বসে আছি — সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!
তোমার শরীর —
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্দিকে — ফলে গেছে কতবার,
ঝরে গেছে তৃণ!
*
আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;
তোমার শরীর ছানি
মিটায় পিপাসা
কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা
দিয়েছ কাহারে!
কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে
বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে
আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে
চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ!
উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস
ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ
ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন
কেটে যায়!
উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!
*
জানি আমি — আমি যাব চলে
তোমার অনেক আগে;
তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন —
আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে
নক্ষত্র অনেক রাত আরো,
নক্ষত্র অনেক রাত আরো,
(যদিও তোমারও
রাত্রি আর দিন শেষ হবে
একদিন কবে!)
আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা
রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা
ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ
রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন
রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর,
আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।
*
আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন —
কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন
করেছিলে তুমি! —
জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি
আকাশের তারার মতন
ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন
তার আগে!
এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে
মুছে যায় পৃথিবীর পর,
একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর!
আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি —
জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি
আকাশের তারার মতন
ফলিয়া ওঠে না রোজ —
দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!
*
আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ —
তার আগে এই রাত্রি — দিন
পড়িতেছে ঝরে!
এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে
তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি!
কখন গিয়েছে তবু থামি
সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে
সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে!
আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ —
তবু সেই রাত্রি আর দিন
পড়ে গেল ঝ’রে।
সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!
*
জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে
তুমি আর; নক্ষত্রের পারে
যদি আমি চলে যাই,
পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই
যদি আমি —
আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;
তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি
আমার এ নক্ষত্রের তলে! —
জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে —
তোমার শরীর আজ ঝরে
রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে!
যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই
যদি আমি চলে যাই
নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!
*
তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!
নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে
হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —
একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।
আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —
কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি
রয়েছি দাঁড়ায়ে!
নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে
হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!
একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!
*
চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন
আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন।
জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই।
তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই
আমার এখানে তুমি আর!
একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার
সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার
আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা —
কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন;
আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই;
তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!
*
তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে।
আলো অন্ধকারে
তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি!
নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন —
আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি
এই দূর সমুদ্রের জলে!
যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে,
নক্ষত্রের তলে!
রাত্রে, অন্ধকারে!
তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!
*
তোমার শরীর —
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন।
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন
চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে
কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে
কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!
অকরুণ পিয়া
- কাজী নজরুল ইসলাম
আমার পিয়াল বনের শ্যামল পিয়ার ওই বাজে গো বিদায়বাঁশি,
পথ-ঘুরানো সুর হেনে সে আবার হাসে নিদয় হাসি।
পথিক বলে পথের গেহ
বিলিয়েছিল একটু স্নেহ,
তাই দেখে তার ঈর্ষাভরা কান্নাতে চোখ গেল ভাসি।
তখন মোদের কিশোর বয়স যেদিন হঠাৎ টুটল বাঁধন,
সেই হতে কার বিদায়-বেণুর জগৎ জুড়ে শুনছি কাঁদন।
সেই কিশোরীর হারা মায়া
ভুবন ভরে নিল কায়া,
দুলে আজও তারই ছায়া আমার সকল পথে আসি।
অগ্ন্যুৎসব
- হেলাল হাফিজ
ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,
তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো ।
আজকে আবার জীবন আমার ভিন্ন স্বপ্নে অংকুরিত অগ্ন্যুৎসবে
তোমাকে চায় শুধুই তোমায় ।
রঙিন শাড়ির হলুদ পাড়ে ঋতুর প্লাবন নষ্ট করে
ভর দুপুরে শুধুই কেন হাত বেঁধেছো বুক ঢেকেছো
যুঁই চামেলী বেলীর মালায়,
আমার বুকে সেদিন যেমন আগুন ছিলো
ভিন্নভাবে জ্বলছে আজও,
তবু সবই ব্যর্থ হবে
তুমি কেবল যুঁই চামেলী বেলী ফুলেই মগ্ন হলে ।
তার চেয়ে আজ এসো দু'জন জাহিদুরের গানের মতন
হৃদয় দিয়ে বোশেখ ডাকি, দু'জীবনেই বোশেখ আনি ।
জানো হেলেন, আগুন দিয়ে হোলি খেলায় দারুণ আরাম
খেলবো দু'জন এই শপথে
এসো স্ব-কাল শুদ্ধ করি দুর্বিনীত যৌবনেরে ।
রচনাকাল - ০৮/১২/১৯৭২ ইং
বই - যে জলে আগুন জ্বলে
অঘ্রাণ প্রান্তরে
- জীবনানন্দ দাশ
‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে-
বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে
শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে
হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায়
ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়;
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা
ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ …… হেঁটে চলি….. আজ কোনো কথা
নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল
পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে,
সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে;
পতঙ্গ পালক্ জল-চারি দিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;
আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ
হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা
ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা
সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে
প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে
যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব।
অপ্রেমে বা প্রেমে নয়- নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।