মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেরা কবিতা সংগ্রহ

 

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ – ২৯ জুন ১৮৭৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি ও নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা।তাকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত।



ধুনিক বাংলা কবিতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্তের দশটি জনপ্রিয় কবিতা—



১. বঙ্গভাষা (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
``ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!''
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥

২. কপোতাক্ষ নদ (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে |
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ;
সতত ( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!---
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!
আর কি হে হবে দেখা?---যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!


৩. কবি (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

কে কবি--- কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে;
নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে;
মরুভূমে--- তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!

৪. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু !-- উজ্জল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।
কিন্তু ভাগ্য-বলে পেয়ে সে মহা পর্বতে,
যে জন আশ্রয় লয় সুবর্ণ চরণে,
সেই জানে কত গুণ ধরে কত মতে
গিরীশ। কি সেবা তার সে সুখ সদনে !
দানে বারি নদীরূপ বিমলা কিঙ্করী।
যোগায় অমৃত ফল পরম আদরে
দীর্ঘ-শিরঃ তরু-দল, দাসরূপ ধরি।
পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে,
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।

৫. কমলে কামিনী (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে
কালিদহে | বসি বামা শতদল-দলে
( নিশীথে চন্দ্রিমা যথা সরসীর জলে
মনোহরা|)  বাম করে সাপটি হেলনে
গজেশে, গ্রাসিছে তারে উগরি সঘনে |
গুঞ্জরিছে অলিপুঞ্জ অন্ধ পরিমলে,
বহিছে দহের বারি মৃদু কলকলে|---
কার না ভোলে রে মনঃ, এ হেন ছলনে!
কবিতা-পঙ্কজ-রবি, শ্রীকবিকঙ্কণ,
ধন্য তুমি বঙ্গভূমে!যশঃ-সুধাদানে
অমর করিলা তোমা অমরকারিণী
বাগ্ দেবী!ভোগিলা দুখ জীবনে, ব্রাহ্মণ,
এবে কে না পূজে তোমা, মজি তব গানে?----
বঙ্গ-হৃদ-হ্রদে চণ্ডী কমলে কামিনী||

৬. অন্নপূর্ণার ঝাঁপি (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

মোহিনী-রূপসী-বেশে ঝাঁপি কাঁখে করি,
পশিছেন, ভবানন্দ, দেখ তব ঘরে
অন্নদা!বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী,
অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে|----
দেবীর প্রসাদে তোমা রাজপদে বরি,
রাজাসন, রাজছত্র, দেবেন সত্বরে
রাজলক্ষ্মী; ধন-স্রোতে তব ভাগ্যতরি
ভাসিবে অনেক দিন, জননীর বরে|
কিন্তু চিরস্থায়ী অর্থ নহে এ সংসারে;
চঞ্চলা ধনদা রমা, ধনও চঞ্চল;
তবু কি সংশয় তব, জিজ্ঞাসি তোমারে?
তব বংশ-যশঃ-ঝাঁপি---- অন্নদামঙ্গল---
যতনে রাখিবে বঙ্গ মনের ভাণ্ডারে,
রাখে যথা সুধামৃতে চন্দ্রের মণ্ডলে||


৭. রসাল ও স্বর্ণ-লতিকা

রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;--
“শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে!
নিদারূণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে|
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর-ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠে শির আকাশ ভেদিয়া!
কালাগ্নির মত তপ্ত তপন তাপন,---
আমি কি লো ডরাই কখন?
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,--
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন|
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায়
এ রাজ চরণে|
শীতলিয়া মোর ডরে
সদা আসি সেবা করে
মোর অতিথির হেথা আপনি পবন!
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভুবনে!
তুমি কি তা জান না, ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখী বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুখ দেখি নিত্য আমি দুখী;
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখি!”
যুদ্ধার্থ গম্ঙীরতার বাণী তব পানে!
সুধা-আশে আসে অলি,
দিলে সুধা যায় চলি,---
কে কোথা কবে গো দুখী সখার মিলনে?
“ক্ষুদ্র-মতি তুমি অতি”
রাগি কহে তরুপতি,
“নাহি কিছু অভিমান? ধিক্ চন্দ্রাননে!”
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
আইলেন প্রভঞ্জন,
সিংহনাদ করি ঘন,
যথা ভীম ভীমসেন কৌরব-সমরে|
আইল খাইতে মেঘ দৈত্যকুল রড়ে:
ঐরাবত পিঠে চড়ি
রাগে দাঁত কড়মড়ি,
ছাড়িলেন বজ্র ইন্দ্র কড় কড় কড়ে!
ঊরু ভাঙ্গি কুরুরাজে বধিলা যেমতি
ভীম যোধপতি;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি,
হায়, বায়ুবলে
হারাইলা আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্দ্দ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নীচশির জনে!
এই উপদেশ কবি দিলা এ কৌশলে||


৮. সমাধি-লিপি     

দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী!

[স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিন দিন পরেই কলকাতা জেনারেল হাসপাতালে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পরলোক গমন করেন। তাঁকে কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড ক্রিশ্চিয়ান সেমেটারিতে সমাহিত করা হয়।তাঁর বিখ্যাত সমাধি-লিপি তিনি নিজেই লিখে গিয়েছিলেন।]


৯. ঈশ্বরী পাটনী (চতুর্দশপদী কবিতাবলী)

“সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী |”
                 -অন্নদামঙ্গল |

কে তোর তরিতে বসি, ঈশ্বরী পাটনি?
ছলিতে তোরে রে যদি কামিনী কমলে,---
কোথা করী, বাম করে ধরি যারে বলে,
উগরি, গ্রাসিল পুনঃ পূর্ব্বে সুবদনী?
রূপের খনিতে আর আছে কি রে মণি
এর সম? চেয়ে দেখ, পদ-ছায়া-ছলে,--
কনক কমল ফুল্ল এ নদীর জলে---
কোন্ দেবতারে পূজি, পেলি এ রমণী?
কাঠের সেঁউতি তোর, পদ-পরশনে
হইতেছে স্বর্ণময়!এ নব যুবতী---
নহে রে সামান্যা নারী, এই লাগে মনে;
বলে বেয়ে নদী-পারে যা রে শীঘ্রগতি|
মেগে নিস্, পার করে, বর-রূপ ধরে
দেখায়ে ভকতি, শোন্, এ মোর যুকতি!


১০. মেঘনাদ ও বিভিষণ (মেঘনাদবধ কাব্য থেকে, ষষ্ঠ সর্গের অংশবিশেষ)

"এতক্ষণে"--অরিন্দম কহিলা বিষাদে
"জানিনা কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ?--শূলী-শম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ?ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য|ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে|"
   উত্তরিলা বিভীষণ;--"বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্!রাঘবদাস আমি; কি প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?" উত্তরিলা কাতরে রাবণি;--
"হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে ও কথা, তাত, কহ তা দাসেরে!
স্থপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধুলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন্ মহাকুলে?
কেবা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে ফেলি রাজ হংস পঙ্কজ কাননে;
যায় কি সে কভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী
কবে, হে বীর-কেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে|
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথি, একি মহারথিপ্রথা?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কি দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে প্রগল্ ভে  পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে|
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্রফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ, তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,--ভ্রাতৃ পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?"
   মহামন্ত্রবলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;--
"নহি দোষী আমি, বত্স; বৃথা ভর্ত্স মোরে
তুমি! নিজ কর্ম দোষে হায় মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কা পুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কাল-সলিলে!
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি! পরদোষে কে চাহে মজিতে?"
  রুষিলা বাসবত্রাস! গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী;--"ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি;--কোন্ ধর্মমতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,--এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরত কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি|"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন