১৩টি রবীন্দ্র সঙ্গীত
(০১)
পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কি রে হায়
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা,
সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা,
প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব,
প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি,
দুলেছি দোলায়--
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি
বকুলের তলায়।
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি,
গেলেম কে কোথায়--
আবার দেখা যদি হল,সখা,
প্রাণের মাঝে আয়॥
(০২)
বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল
বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান ।
মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে রেখেছি ঢেকে তারে
এই-যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান ।।
আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল-
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল ।
এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিস্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বাহি তব সম্মান ।।
( ০৩)
বড় আশা করে
বড় আশা করে এসেছি গো
কাছে ডেকে লও
ফিরাইও না জননী।
দিনহীনে কেহ চাহে না
তুমি তারে রাখিবে জানি গো।
আর আমি যে কিছু চাহিনে
চরণও তলে বসে থাকিব,
আর আমি যে কিছু চাহিনে
জননী বলে শুধু ডাকিব ।
তুমি না রাখিলে গৃহ আর পাইব কোথায়
কেঁদে কেঁদে কোথা বেড়াব
ঐ যে হেরী
তমশ ঘন ঘরা
গহন রজনী ।
( ০৪)
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি, ভালোবাসি -
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি।।
আকাশে কার বুকের মাঝে
ব্যথা বাজে,
দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় ভাসি।।
সেই সুরে সাগরকূলে
বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে
অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি।।
( ০৫)
ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি
ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি
নিয়ে যাবি কে আমারে (ও বন্ধু আমার)!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা
দিন যে আমার কাটে না রে ।।
বুঝি গো রাত পোহালো, বুঝি ঐ রবির আলো
আভাসে দেখা দিলো গগন-পারে-
সমুখে ঐ হেরি পথ তোমার কি রথ
পৌঁছবে না মোর দূয়ারে ।।
আকাশের যত তারা চেয়ে হয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে ।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে
ডুববে আলোক-পারাবারে ।।
প্রভাতের পথিক সবে এল কি কলরবে-
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে !
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে
অরুণবীণার তারে তারে ।।
( ০৬)
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ–
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥
( ০৭)
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে,
যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখখানি--
কী কথা ছিল যে মনে॥
তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে--
আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি,
তুমি আছ দূর ভুবনে॥
আকাশে উড়িছে বকপাঁতি,
বেদনা আমার তারি সাথি।
বারেক তোমায় শুধাবারে চাই বিদায়কালে কী বল নাই,
সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যূথীর গন্ধবেদনে॥
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে
রসের ধারা বরষে॥
তাহারে দেখি না যে দেখি না,
শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়
বাজে অলখিত তারি চরণে
রুনুরুনু রুনুরুনু নূপুরধ্বনি॥
গোপন স্বপনে ছাইল
অপরশ আঁচলের নব নীলিমা।
উড়ে যায় বাদলের এই বাতাসে
তার ছায়াময় এলো কেশ আকাশে।
সে যে মন মোর দিল আকুলি
জল-ভেজা কেতকীর দূর সুবাসে॥
(০৮)
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,বাদল গেছে টুটি।
আহা,হাহা,হা।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই,আজ আমাদের ছুটি।
আহা,হাহা,হা ॥
কী করি আজ ভেবে না পাই,পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই,
কোন্ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি।
আহা,হাহা,হা ॥
কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে--
তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব,চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু,
মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি।
আহা,হাহা,হা ॥
(০৯)
মনে রবে কি না রবে আমারে
মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই।
ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই॥
চলে যায় দিন, যতক্ষন আছি পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি
তোমার মুখের চকিত সুখের হাসি দেখিতে যে চাই—
তাই অকারণে গান গাই॥
ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া ফাগুনের অবসানে—
ক্ষণিকের মুঠি দেয় ভরিয়া, আর কিছু নাহি জানে।
ফুরাইবে দিন, আলো হবে ক্ষীণ, গান সারা হবে, থেমে যাবে বীন,
যতখন থাকি ভরে দিবে নাকি এ খেলারই ভেলাটাই—
তাই অকারণে গান গাই॥
(১০)
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে -তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো,একলা চলো, একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা-একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায়,ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে-একলা দলো রে॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে-একলা জ্বলো রে॥
(১১)
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো,মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে--
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।
যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,আহা,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়--
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।
তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে দিন কাটবে,
কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে, আহা,
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী-এমনি সে দিন উঠবে ভরি--
চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।
তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি-- আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে,বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে॥
(১২)
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা ।
সেই স্মৃতিটুকু কভু ক্ষণে ক্ষণে যেন জাগে মনে ভুলোনা ।
সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জান- আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো,
আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা ।।
যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে ।
দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কি জানি কি মহালগনে ।
এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার-
বাঁধিনু যে রাখী পরানে তোমার সে রাখী খুলো না, খুলো না।
(১৩)
হারে রে রে রে রে
হারে রে রে রে রে,আমায় ছেড়ে দে রে,দে রে--
যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে॥
ঘনশ্রাবণধারা যেমন বাঁধনহারা,
বাদল-বাতাস যেমন ডাকাত আকাশ লুটে ফেরে॥
হারে রে রে রে রে,আমায় রাখবে ধ'রে কে রে--
দাবানলের নাচন যেমন সকল কানন ঘেরে,
বজ্র যেমন বেগে গর্জে ঝড়ের মেঘে,
অট্টহাস্যে সকল বিঘ্ন-বাধার বক্ষ চেরে॥
ক্ষণিকের অতিথি
হে ক্ষণিকের অতিথি,
এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া
ঝরা শেফালির পথ চাহিয়া ॥
কোন্ অমরার বিরহিণীরে চাহ নি ফিরে,
কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া ॥
ওগো অকরুণ,কী মায়া জানো,
মিলনছলে বিরহ আনো।
চলেছ পথিক আলোকযানে আঁধার-পানে
মনভুলানো মোহনতানে গান গাহিয়া ॥