কাজী নজরুল ইসলাম এর বাছাই করা সেরা কবিতা সংগ্রহ

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালি মনীষার এক তুঙ্গীয় নিদর্শন নজরুল। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে – কাজেই "বিদ্রোহী কবি", তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।



আমার কৈফিয়ৎ – কাজী নজরুল ইসলাম

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,

কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!

কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!

গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!

মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!

নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী,
দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!

কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?

বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!

আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।

বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!

ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!

পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!




চৈতী হাওয়া – কাজী নজরুল ইসলাম

হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর,
আজ্‌কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!
আজ্‌কে তোমার জন্মদিন-
স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন
হাত্‌ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার!
এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার!

শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল,
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?
আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ,
নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,-
কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল
ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল?

অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’
আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ
ঘাটে আমি রই ব’সে
আমার মাণিক কই গো সে?
পারাবারের ঢেউ-দোলানী হান্‌ছে বুকে ঘা!
আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা!

বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ
পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন,
ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!

প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই,
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই।
হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল,
গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল
থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই!
বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই!

চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব,
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর!
ভুঁই- তারকা সুন্দরী
সজনে ফুলের দল ঝরি’
থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর।
ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর!

পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ!
খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ!
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই,
বলতে, ‘আমি অমনি চাই!
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ!
হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”

ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল
হঠাৎ জলে রাখত্‌ে পা,
কাজলা দীঘির শিউরে গা-
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল!
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল!

উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়,
ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়!
শঙ্খ বাজে মন্দিরে,
সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে,
ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায়!
মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অ

বাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে!
আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে?
ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে?
প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে?

বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম,
রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম!
কামরাঙারা রাঙল ফের
পীড়ন পেতে ঐ মুখের,
স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম-
জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম!

ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,
ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর!
সেই চাহনি নীল-কমল
ভ’রল আমার মানস-জল,
কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর!
বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর!

তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল,
স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল!
পাহাড়তলীর শালবনায়
বিষের মত নীল ঘনায়!
সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল!
হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল!

কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই!
কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর-
কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর?
তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই?
কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!

পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’,
এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা!
আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায়
আকুল দোলা লাগবে না’য়,
এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।


বিদায়-বেলায় – কাজী নজরুল ইসলাম

তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।
হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,
আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ
দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।
চলার তোমার বাকী পথটুকু-
পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক-
হায়, অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,
ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।।

দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি
তব ব্যথা কেউ বোঝে না,
তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,
পথে ফেরে যারা পথ-হারা,
কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না,
বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি?
দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে?
এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে!
তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়
কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-
পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!
কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো
মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না,
ওগো যাবে যাও, তুমি বুকে ব্যথা নিয়ে যেয়ো না।।



মানুষ – কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
‘পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ’ল!’
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’
সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্
বলে ‘বাবা, আমি ভুকা-ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!’
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা – ‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল – ‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
কোথা চেঙ্গিস্‌, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্‌ জাগিছেন দিবা-রাতি!
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্‌ উচ্চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে!

ও কে? চন্ডাল? চম্‌কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!
ওই হ’তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ।
রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!
চাষা ব’লে কর ঘৃণা!
দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র’বে চিরকাল।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,
দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।
সে মার রহিল জমা-
কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!
বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা,
তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্‌খানে!
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি’।




লিচু চোর – কাজী নজরুল ইসলাম

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,

ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।

আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!
ও বাবা শেয়াল কোথা
ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জাড়লে ছোটা!
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই করবে সাবাড়!

‘বাবা গো মা গো’ বলে
পাঁচিলের ফোঁকল গলে
ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!

যাব ফের? কান মলি ভাই,
চুরিতে আর যদি যাই!
তবে মোর নামই মিছা!
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস? ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা!



সাম্যবাদী – কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।



আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে – কাজী নজরুল ইসলাম

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে –
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে –
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;

আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!



পথহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহারে চাবে।
উদাস পথিক ভাবে।

বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে,
ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

হঠাৎ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে
উদাস পথিক ভাবে।



কান্ডারী হুশিয়ার – কাজী নজরুল ইসলাম

দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!

কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।

ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!



গোপন প্রিয়া – কাজী নজরুল ইসলাম

পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি,
মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি!
আমি এ-পার, তুমি ও-পার,
মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার
ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্‌ছানি,
আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি।

নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়!
আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়!
এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে
আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে,
আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়,
কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়!

চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর।
গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর।
গান ফুরালো যাব যবে
গানের কথাই মনে রবে,
পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর ঘর,
উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর!

তোমার পারে বাজল কখন আমার পারের ঢেউ,
অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ।
উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে
একটি পালক প’ড়লে পথে
ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও!
ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও!

বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি
ঝুরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী?
মনের মনে নিশীথ-রাতে
চুমু দেবে কি কল্পনাতে?
স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি!
মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী!

দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!
কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল!
তোমায় পেলে থামত বাঁশী,
আসত মরণ সর্বনাশী।
পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল।
বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।

বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও,
দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও।
থাকবে তুমি ছায়ার সাথে
মায়ার মত চাঁদনী রাতে!
যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও!
শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও!

ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর!
তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর।
কোথায় আছ কেমনে রাণি
কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি!
ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর!
চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!

রাত্রে যখন এক্‌লা শোব-চাইবে তোমার বুক,
নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ,
দুখের সুরায় মস্ত্‌ হ’য়ে
থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে,
কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ!
ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ!

গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান।
থামবে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান!
শিল্পী আমি, আমি কবি,
তুমি আমার আঁকা ছবি,
আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান।
চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান।

তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর,
কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির।
গোপন তুমি আসলে নেমে
কাব্যে আমার, আমার প্রেমে,
এই-সে সুখে থাকবে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর?
দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়!

বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান,
মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান!
যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে
করবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে
ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ!
নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান!




কুলি-মজুর – কাজী নজরুল ইসলাম

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!

আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!
সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে
এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!
তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,
সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!
আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,
লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!
আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,
রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!
আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,
মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!
সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,
মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।
একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,
উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!



আনন্দময়ীর আগমনে – কাজী নজরুল ইসলাম

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?

মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..

‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!


অভিশাপ – কাজী নজরুল ইসলাম

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
যেদিন আমায় খুঁজবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোওয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে, –
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদনাতে চোখ বুজবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
ব’লবে সবাই – “সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?”
আসবে ভেঙে কান্না!
প’ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ –
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!
বুকের মালা ক’রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!




নারী – কাজী নজরুল ইসলাম

সাম্যের গান গাই –
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে – শয়তান যে – নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী,
সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে।

স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,
রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।

পুরুষ হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব।
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা।
লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা।
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ।

তিনি নর-অবতার –
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর –
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।

সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!

যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।

শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্‌ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্‌টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!

ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।

সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!


বিদ্রোহী – কাজী নজরুল ইসলাম

বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!

মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির!

আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর –
চির-উন্নত মম শির!
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর –
চির – উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ –
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না –
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন