রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর কয়েকটি কবিতা

ভালবাসার সময় তো নেই – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

Rudra_Muhammad_Shahidullah

ভালবাসার সময় তো নেই

ব্যস্ত ভীষন কাজে,

হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।

 

ঘামের জলে ভিজে সাবাড়

করাল রৌদ্দুরে,

কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

 

কাজের মাঝে দিন কেটে যায়

কাজের কোলাহল

তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।

 

নদী আমার বয় না পাশে

স্রোতের দেখা নেই,

আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

 

তোমার দিকে ফিরবো কখন

বন্দী আমার চোখ

পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।

 

 

 

অভিমানের খেয়া – রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

worried-girl-413690_1920.jpg

এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই,

পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত

পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

 

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,

নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-

এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!

কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যো ও প্রবোধ,

অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,

কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

 

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন- আর কতোদিন?

ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে?

কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম!

জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?

 

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,

এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ

কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।

তুমি জানো নাই- আমি তো জানি,

কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান,

এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।

 

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন,

এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

 

তুমি জানো নাই- আমি তো জানি।

মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে,

মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে,

যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,

করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।

 

পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,

চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক।

তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,

পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

 

বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ,

পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়-

ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন?

নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন?

কতোটা জীবন!!

 

 

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর – রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

girl-2026924__480

সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি

যে-রকম আকাশ পৃথিবী দ্যাখে, পৃথিবী আকাশ,

একবার অন্ধকারে, একবার আলোর ছায়ায়

একবার কুয়াশা-কাতর চোখে, একবার গোধুলির ক্লান্ত রোদে-

সারারাত স্বপ্ন দেখি-সারাদিন স্বপ্ন দেখি।

একখানি সুদূরের মুখ জ্ব’লে থাকে চেতনার নীলে,

কে যেন বাদক সেই স্বপ্নের ভেতরে তোলে বিষাদের ধ্বনি

আঁকে সেই প্রিয়মুখে-সুদূরের মুখে

বর্ণময় রঙিন বিষাদ।

 

ফিরে আয় বোলে ডাকি- সে বাদক উদাসিন থামে না তবুও…

সারারাত স্বপ্ন দেখি, সারাদিন স্বপ্ন দেখি-

স্বপ্নের ভেতরে তুমি হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

চোখের সমুখে আজ কেন এসে দাঁড়ালে নিঠুর!

কেন ওই রক্তে-মাংসে, কেন ওই নশ্বর ত্বকের আবরণে

এসে আজ শুধোলে কুশল?

 

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

হৃদয়ের কূল ভেঙে কেন আজ এতো জল ছড়ালো শরীরে

কেন আজ বাতাসে বসন্ত দিন ফিরে এলো কুয়াশার শীতে!

 

কে সেই বংশীবাদক স্বপ্নের শিয়রে বসে বাজাতেন বাঁশি

বেদনার ধ্বনি তুলে রাত্রি দিন, সে আজ হারালো কোথায়?

 

বেদনার রঙ দিয়ে আমি যারে আঁকি

হৃদয়ের রক্ত দিয়ে আমি যারে আঁকি

আমার কষ্ট দিয়ে, আমার স্বপ্ন দিয়ে যে আমার নিভৃত নির্মাণ

সেই তুমি- হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

মর্মমূল ছিঁড়ে এসে ঠাঁই নিলে কেন এই মাংসের বুকে!

কেন ওই বৃক্ষতলে, কেন ওই নদীর নিকটে এসে বোলে গেলে

তোমার ঠিকানা!

 

আমি তো প্রার্থনাগুলো শস্যের বীজের মতো দিয়েছি ছড়িয়ে

জল তাকে পুষ্টি দেবে, মাটি তাকে ভূমি দেবে, তুমি তার গভীর ফসল-

বাতাসে তুলোর মতো তুমি তবে উড়ে এলে কেন!

কেন আজ পোড়া তুষের গন্ধে শুধু জন্মের কথা মনে পড়ে!

শৈশব কৈশোর এসে মিশে থাকে ফাল্গুনের তুমুল হাওয়ায়

একটি রাত্রি কেন হয়ে ওঠে এতো দীর্ঘ দীর্ঘ রাত?

 

হে আমার বিষণ্ন সুন্দর

দু’চোখে ভাঙন নিয়ে কেন এই রুক্ষ দুঃসময়ে এলে

কেন সমস্ত আরতির শেষে আজ এলে শূন্য দুখানি হাত!

কেন এলে, বিষণ্ন সুন্দর, তুমি কেন এলে?

 

 

কথা ছিলো সুবিনয় – রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

images (12).jpg

কথা ছিলো রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্যক্ষেত,

রাখালেরা পুনর্বার বাশিঁতে আঙুল রেখে

রাখালিয়া বাজাবে বিশদ।

কথা ছিলো বৃক্ষের সমাজে কেউ কাঠের বিপনি খুলে বসবে না,

চিত্রল তরুণ হরিনেরা সহসাই হয়ে উঠবে না

রপ্তানিযোগ্য চামড়ার প্যাকেট।

 

কথা ছিলো, শিশু হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদের নাম।

নদীর চুলের রেখা ধ’রে হেঁটে হেঁটে যাবে এক মগ্ন ভগীরথ,

কথা ছিলো, কথা ছিলো আঙুর ছোঁবো না কোনোদিন।

 

অথচ দ্রাক্ষার রসে নিমজ্জিত আজ দেখি আরশিমহল,

রাখালের হাত দুটি বড় বেশি শীর্ণ আর ক্ষীণ,

বাঁশি কেনা জানি তার কখনোই হয়ে উঠে নাই-

 

কথা ছিলো, চিল-ডাকা নদীর কিনারে একদিন ফিরে যাবো।

একদিন বট বিরিক্ষির ছায়ার নিচে জড়ো হবে

সহজিয়া বাউলেরা,

তাদের মায়াবী আঙুলের টোকা ঢেউ তুলবে একতারায়-

একদিন সুবিনয় এসে জড়িয়ে ধ’রে বোলবে: উদ্ধার পেয়েছি।

 

কথা ছিলো, ভাষার কসম খেয়ে আমরা দাঁড়াবো ঘিরে

আমাদের মাতৃভূমি, জল, অরন্য, জমিন, আমাদের

পাহাড় ও সমুদ্রের আদিগন্ত উপকূল-

আজন্ম এ জলাভূমি খুঁজে পাবে প্রকৃত সীমানা তার।

 

কথা ছিলো, আর্য বা মোঘল নয়, এ জমিন অনার্যের হবে।

অথচ এখনো আদিবাসী পিতাদের শৃঙ্খলিত জীবনের

ধারাবাহিকতা

কৃষকের রন্ধ্রে রক্তে বুনে যায় বন্দিত্বের বীজ।

মাতৃভূমি-খন্ডিত দেহের ’পরে তার থাবা বসিয়েছে

আর্য বণিকের হাত।

 

আর কী অবাক! ইতিহাসে দেখি সব

লুটেরা দস্যুর জয়গানে ঠাঁসা,

প্রশস্তি, বহিরাগত তস্করের নামে নানারঙ পতাকা ওড়ায়।

কথা ছিলো, ‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন’,

আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।

অথচ পান্ডুর নগরের অপচ্ছায়া ক্রমশ বাড়ায় বাহু

অমলিন সবুজের দিকে, তরুদের সংসারের দিকে।

জলোচ্ছাসে ভেসে যায় আমাদের ধর্ম আর তীর্থভূমি,

আমাদের বেঁচে থাকা, ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন।

 

 

খুব কাছে এসো না – রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

Cute-doll-for-facebook-profile-pic-for-girl-6-704x1024.jpg

খুব কাছে এসো না কোন দিন

যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে

এ চোখ থেকে ঐ চোখের কাছে থাকা

এক পা বাড়ানো থেকে অন্য পায়ের সাথে চলা

কিংবা ধরো রেল লাইনের পাশাপাশি শুয়ে

অবিরাম বয়ে চলা ।

যে কাছাকাছির মাঝে বিন্দু খানেক দূরত্বও আছে

মেঘের মেয়ে অতো কাছে এসোনা কোন দিন

দিব্যি দিলাম মেঘের বাড়ীর, আকাশ কিংবা আলোর সারির।

 

তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো

যেমন দূরে থাকে ছোঁয়া, থেকে স্পর্শ

রোদ্দুরের বু্‌ক, থেকে উত্তাপ

শীতলতা, থেকে উষ্ণতা

প্রেমে্‌র, খুব গভীর ম্যাপে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা

তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও-

এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে না কেউ

কতটা কাছা কাছি এসেছিলে বলে দূরত্বের পরিমাপ দিতে পারেনি পৃথিবী।