রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা সংগ্রহ

 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৮ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।



পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল; ওরে যাত্রী।
     তোমার পথের 'পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান
              রুদ্রের ভৈরব গান।
                  দূর হতে দূরে
          বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে,
                  যেন পথহারা
              কোন্‌ বৈরাগীর একতারা।
 
              ওরে যাত্রী,
     ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী;
চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে আবরি
         ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি
              দিগন্তের পারে দিগন্তরে।
     ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,
          নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,
          নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ।
পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ,
          শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ।
     পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা,
     পথে পথে গুপ্তসর্প গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।
          নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।
 
     ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার।
          চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার--
     সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম,
          নহে শান্তি, নহে সে আরাম।
          মৃত্যু তোরে দিবে হানা,
          দ্বারে দ্বারে পাবি মানা,
     এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ,
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ
          ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী।
     ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষ্মী তোমার বরদাত্রী।
 
     পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী।
              এসেছে নিষ্ঠুর,
          হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর,
          হোক রে মদের পাত্র চুর।
     নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি,
          ধরো তার পাণি;
     ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী।
          ওরে যাত্রী
     গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি।
 
 
কলিকাতা, ৯ বৈশাখ, ১৩২৩


যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে।
     তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের 'পরে
                    পুচ্ছ নাচাতে।
     তুই পথহীন সাগরপারের পান্থ,
     তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,
          অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে
              অবাধ যে তোর ধাওয়া;
          ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে
              তোর যে দাবিদাওয়া।
 
যৌবন রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী।
     মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে
                    তুই যে শিকারি।
     মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে
     অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;
          বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া
              মরণ-ঘোমটা টানি।
          সেই আবরণ দেখ্‌ রে উতারিয়া
              মুগ্ধ সে মুখখানি।
 
যৌবন রে, রয়েছ কোন্‌ তানের সাধনে।
     তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা
                     পুঁথির বাঁধনে।
     তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়
     অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,
          তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে
              ঝড়ের ঝংকারে;
     ঢেউয়ের 'পরে বাজিয়ে চলে বেগে
          বিজয়-ডঙ্কা রে।
 
যৌবন রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে।
     বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে
          হবে খণ্ডিতে।
     খড়গসম তোমার দীপ্ত শিখা
     ছিন্ন করুক জরার কুজ্‌ঝটিকা,
     জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক ক'রে
              অমর পুষ্প তব
     আলোকপানে লোকে লোকান্তরে
              ফুটুক নিত্য নব।
 
যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত।
     আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে
                         রইবি কুণ্ঠিত?
     প্রভাত যে তার সোনার মুকুটখানি
     তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,
          আগুন আছে ঊর্ধ্ব শিখা জ্বেলে
              তোমার সে যে কবি।
          সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে
              দেখে আপন ছবি।
 
 
শান্তিনিকেতন, ৪ চৈত্র, ১৩২২





ভাবনা নিয়ে মরিস কেন খেপে

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভাবনা নিয়ে মরিস কেন খেপে।
          দুঃখ-সুখের লীলা
     ভাবিস এ কি রইবে বক্ষে চেপে
          জগদ্দলন-শিলা।
     চলেছিস রে চলাচলের পথে
     কোন্‌ সারথির উধাও মনোরথে?
     নিমেষতরে যুগে যুগান্তরে
          দিবে না রাশ-ঢিলা।
 
     শিশু হয়ে এলি মায়ের কোলে,
          সেদিন গেল ভেসে।
     যৌবনেরি বিষম দোলার দোলে
          কাটল কেঁদে হেসে।
     রাত্রে যখন হচ্ছিল দীপ জ্বালা
     কোথায় ছিল আজকে দিনের পালা।
     আবার কবে কী সুর বাঁধা হবে
          আজকে পালার শেষে।
 
     চলতে যাদের হবে চিরকালই
          নাইকো তাদের ভার।
     কোথা তাদের রইবে থলি-থালি,
          কোথা বা সংসার।
     দেহযাত্রা মেঘের খেয়া বাওয়া,
     মন তাহাদের ঘূর্ণা-পাকের হাওয়া;
     বেঁকে বেঁকে আকার এঁকে এঁকে
          চলছে নিরাকার।
 
     ওরে পথিক, ধর্‌-না চলার গান,
          বাজা রে একতারা।
     এই খুশিতেই মেতে উঠুক প্রাণ--
          নাইকো কূল-কিনারা।
     পায়ে পায়ে পথের ধারে ধারে
     কান্না-হাসির ফুল ফুটিয়ে যা রে,
     প্রাণ-বসন্তে তুই-যে দখিন হাওয়া
          গৃহ-বাঁধন-হারা!
 
     এই জনমের এই রূপের এই খেলা
          এবার করি শেষ;
     সন্ধ্যা হল, ফুরিয়ে এল বেলা,
          বদল করি বেশ।
     যাবার কালে মুখ ফিরিয়ে পিছু
     কান্না আমার ছড়িয়ে যাব কিছু,
     সামনে সে-ও প্রেমের কাঁদন ভরা
          চির-নিরুদ্দেশ।
 
     বঁধুর চিঠি মধুর হয়ে আছে
          সেই অজানার দেশে।
     প্রাণের ঢেউ সে এমনি করেই নাচে
          এমনি ভালোবেসে।
     সেখানেতে আবার সে কোন্‌ দূরে
     আলোর বাঁশি বাজবে গো এই সুরে
     কোন্‌ মুখেতে সেই অচেনা ফুল
          ফুটবে আবার হেসে।
 
     এইখানে এক শিশির-ভরা প্রাতে
          মেলেছিলেম প্রাণ।
     এইখানে এক বীণা নিয়ে হাতে
          সেধেছিলেম তান।
     এতকালের সে মোর বীণাখানি
     এইখানেতেই ফেলে যাব জানি,
     কিন্তু ওরে হিয়ার মধ্যে ভরি
          নেব যে তার গান।
 
     সে-গান আমি শোনাব যার কাছে
          নূতন আলোর তীরে,
     চিরদিন সে সাথে সাথে আছে
          আমার ভুবন ঘিরে।
     শরতে সে শিউলি-বনের তলে
     ফুলের গন্ধে ঘোমটা টেনে চলে,
     ফাল্গুনে তার বরণমালাখানি
          পরাল মোর শিরে।
 
     পথের বাঁকে হঠাৎ দেয় সে দেখা
          শুধু নিমেষতরে।
     সন্ধ্যা-আলোয় রয় সে বসে একা
          উদাস প্রান্তরে।
     এমনি করেই তার সে আসা-যাওয়া,
     এমনি করেই বেদন-ভরা হাওয়া
     হৃদয়-বনে বইয়ে সে যায় চলে
          মর্মরে মর্মরে।
 
     জোয়ার-ভাঁটার নিত্য চলাচলে
          তার এই আনাগোনা।
     আধেক হাসি আধেক চোখের জলে
          মোদের চেনাশোনা।
     তারে নিয়ে হল না ঘর বাঁধা,
     পথে পথেই নিত্য তারে সাধা
     এমনি করেই আসা-যাওয়ার ডোরে
          প্রেমেরি জাল-বোনা।
 
 
শান্তিনিকেতন, ২৯ ফাল্গুন, ১৩২২


তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান।
          এসেছিলে গেয়ে গান
              ভোরবেলা;
    ঘুম ভাঙাইলে ব'লে মেরেছিনু ঢেলা
              বাতায়ন হতে,
    পরক্ষণে কোথা তুমি লুকাইলে জনতার স্রোতে।
              ক্ষুধিত দরিদ্রসম
          মধ্যাহ্নে, এসেছে দ্বারে মম।
          ভেবেছিনু, এ কী দায়,
কাজের ব্যাঘাত এ-যে।' দূর হতে করেছি বিদায়।
 
     সন্ধ্যাবেলা এসেছিলে যেন মৃত্যুদূত
          জ্বালায়ে মশাল-আলো, অস্পষ্ট অদ্ভুত
              দুঃস্বপ্নের মতো।
     দস্যু ব'লে শত্রু ব'লে ঘরে দ্বার যত
          দিনু রোধ করি।
     গেলে চলি, অন্ধকার উঠিল শিহরি।
এরি লাগি এসেছিলে, হে বন্ধু অজানা--
          তোমারে করিব মানা,
    তোমারে ফিরায়ে দিব, তোমারে মারিব,
       তোমা-কাছে যত ধার সকলি ধারিব,
              না করিয়া শোধ
              দুয়ার করিব রোধ।
 
              তার পরে অর্ধরাতে
          দীপ-নেবা অন্ধকারে বসিয়া ধুলাতে
              মনে হবে আমি বড়ো একা
          যাহারে ফিরায়ে দিনু বিনা তারি দেখা।
              এ দীর্ঘ জীবন ধরি
          বহুমানে যাহাদের নিয়েছিনু বরি
              একাগ্র উৎসুক,
          আঁধারে মিলায়ে যাবে তাহাদের মুখ।
              যে আসিল ছিনু অন্যমনে,
          যাহারে দেখি নি চেয়ে নয়নের কোণে,
              যারে নাহি চিনি,
          যার ভাষা বুঝিতে পারি নি,
অর্ধরাতে দেখা দিবে বারেবারে তারি মুখ নিদ্রাহীন চোখে
          রজনীগন্ধার গন্ধে তারার আলোকে।
     বারেবারে ফিরে-যাওয়া অন্ধকারে বাজিবে হৃদয়ে
          বারেবারে-ফিরে-আসা হয়ে।
 
 
শিলাইদা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২




যে-কথা বলিতে চাই

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যে-কথা বলিতে চাই,
         বলা হয় নাই,
             সে কেবল এই--
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই
             দেখিনু সহস্রবার
             দুয়ারে আমার।
     অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
     সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
          আমি নাহি জানি।
 
শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
     নদীর এপারে ঢালু তটে
          চাষি করিতেছে চাষ;
     উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
          চলে কি না চলে
        ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
          আধো-জাগা নয়নের মতো।
          পথখানি বাঁকা
     বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
     নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।
 
ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
              ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
      নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
          যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি
              কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
     এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
     ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
     অকস্মাৎ নদীস্রোতে
          ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
          হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।
 
 
পদ্মা, ৮ ফাল্গুন, ১৩২২


এইক্ষণে

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এইক্ষণে
মোর হৃদয়ের প্রান্তে আমার নয়ন-বাতায়নে
     যে-তুমি রয়েছ চেয়ে প্রভাত-আলোতে
সে-তোমার দৃষ্টি যেন নানা দিন নানা রাত্রি হতে
                রহিয়া রহিয়া
          চিত্তে মোর আনিছে বহিয়া
             নীলিমার অপার সংগীত,
             নিঃশব্দের উদার ইঙ্গিত।
 
          আজি মনে হয় বারে বারে
     যে মোর স্মরণের দূর পরপারে
              দেখিয়াছ কত দেখা
কত যুগে, কত লোকে, কত জনতায়, কত একা।
সেই-সব দেখা আজি শিহরিছে দিকে দিকে
          ঘাসে ঘাসে নিমিখে নিমিখে,
বেণুবনে ঝিলিমিলি পাতার ঝলক-ঝিকিমিকে।
     কত নব নব অবগুণ্ঠনের তলে
              দেখিয়াছ কত ছলে
                 চুপে চুপে
     এক প্রেয়সীর মুখ কত রূপে রূপে
জন্মে জন্মে, নামহারা নক্ষত্রের গোধূলি-লগনে।
          তাই আজি নিখিল গগনে
        অনাদি মিলন তব অনন্ত বিরহ
    এক পূর্ণ বেদনায় ঝংকারি উঠিছে অহরহ।
 
     তাই যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়
         যাহা দেখিছ না তারি ভিড়।
              তাই আজি দক্ষিণ পবনে
ফাল্গুনের ফুলগন্ধে ভরিয়া উঠিছে বনে বনে
          ব্যাপ্ত ব্যাকুলতা,
বহুশত জনমের চোখে-চোখে কানে-কানে কথা।
 
 
  শিলাইদা, ৭ ফাল্গুন, ১৩২২



যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে,
ইংলণ্ডে দিকপ্রান্ত পেয়েছিল সেদিন তোমারে
আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি
কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তব চুমি
রেখেছিল কিছুকাল অরণ্যশাখার বাহুজালে,
ঢেকেছিল কিছুকাল কুয়াশা-অঞ্চল-অন্তরালে
বনপুষ্প-বিকশিত তৃণঘন শিশির-উজ্জ্বল
পরীদের খেলার প্রাঙ্গণে। দ্বীপের নিকুঞ্জতল
তখনো ওঠে নি জেগে কবিসূর্য-বন্দনাসংগীতে।
তার পরে ধীরে ধীরে অনন্তের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে
দিগন্তের কোল ছাড়ি শতাব্দীর প্রহরে প্রহরে
উঠিয়াছ দীপ্তজ্যোতি মাধ্যাহ্নের গগনের 'পরে;
নিয়েছ আসন তব সকল দিকের কেন্দ্রদেশে
বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া; তাই হেরো যুগান্তর-শেষে
ভারতসমুদ্রতীরে কম্পমান শাখাপুঞ্জে আজি
নারিকেলকুঞ্জবনে জয়ধ্বনি উঠিতেছে বাজি।
 
 
  শিলাইদহ, ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩২২



সর্বদেহের ব্যাকুলতা কী বলতে চায় বাণী

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সর্বদেহের ব্যাকুলতা কী বলতে চায় বাণী,
     তাই আমার এই নূতন বসনখানি।
নূতন সে মোর হিয়ার মধ্যে দেখতে কি পায় কেউ।
              সেই নূতনের ঢেউ
অঙ্গ বেয়ে পড়ল ছেয়ে নূতন বসনখানি।
দেহ-গানের তান যেন এই নিলেম বুকে টানি।
 
আপনাকে তো দিলেম তারে, তবু হাজার বার
     নূতন করে দিই যে উপহার।
চোখের কালোয় নূতন আলো ঝলক দিয়ে ওঠে,
              নূতন হাসি ফোটে,
তারি সঙ্গে, যতনভরা নূতন বসনখানি
অঙ্গ আমার নূতন করে দেয়-যে তারি আনি।
 
চাঁদের আলো চাইবে রাতে বনছায়ার পানে
     বেদনভরা শুধু চোখের গানে।
মিলব তখন বিশ্বমাঝে আমরা দোঁহে একা,
              যেন নূতন দেখা।
তখন আমার অঙ্গ ভরি নূতন বসনখানি।
পাড়ে পাড়ে ভাঁজে ভাঁজে করবে কানাকানি।
 
ওগো, আমার হৃদয় যেন সন্ধ্যারি আকাশ,
     রঙের নেশায় মেটে না তার আশ,
তাই তো বসন রাঙিয়ে পরি কখনো বা ধানী,
              কখনো জাফরানী,
আজ তোরা দেখ্‌ চেয়ে আমার নূতন বসনখানি
বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশ যেন নবীন আসমানী।
 
অকূলের এই বর্ণ, এ-যে দিশাহারার নীল,
     অন্য পারের বনের সাথে মিল।
আজকে আমার সকল দেহে বইছে দূরের হাওয়া
              সাগরপানে ধাওয়া।
আজকে আমার অঙ্গে আনে নূতন কাপড়খানি
বৃষ্টিভরা ঈশান কোণের নব মেঘের বাণী।
 
 
  পদ্মা, ১২ অগ্রহায়ণ, ১৩২২




দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন,
              ওরে উদাসীন--
          ওই ক্রন্দনের কলরোল,
     লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল।
          বহ্নিবন্যা-তরঙ্গের বেগ,
          বিষশ্বাস-ঝটিকার মেঘ,
              ভূতল গগন
     মূর্ছিত বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন;
          ওরি মাঝে পথ চিরে চিরে
              নূতন সমুদ্রতীরে
          তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি,
              ডাকিছে কাণ্ডারী
              এসেছে আদেশ--
    বন্দরে বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ,
পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা
              আর চলিবে না।
  বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি,
          কাণ্ডারী ডাকিছে তাই বুঝি--
          "তুফানের মাঝখানে
          নূতন সমুদ্রতীরপানে
              দিতে হবে পাড়ি।"
              তাড়াতাড়ি
          তাই ঘর ছাড়ি
চারি দিক হতে ওই দাঁড়-হাতে ছুটে আসে দাঁড়ী।
 
          "নূতন উষার স্বর্ণদ্বার
     খুলিতে বিলম্ব কত আর।"
          এ কথা শুধায় সবে
            ভীত আর্তরবে
     ঘুম হতে অকস্মাৎ জেগে।
          ঝড়ের পুঞ্জিত মেঘে
     কালোয় ঢেকেছে আলো--জানে না তো কেউ
রাত্রি আছে কি না আছে; দিগন্তে ফেনায়ে উঠে ঢেউ--
     তারি মাঝে ফুকারে কাণ্ডারী--
"নূতন সমুদ্রতীরে তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি।"
     বাহিরিয়া এল কা'রা। মা কাঁদিছে পিছে,
          প্রেয়সী দাঁড়ায়ে দ্বারে নয়ন মুদিছে।
              ঝড়ের গর্জনমাঝে
          বিচ্ছেদের হাহাকার বাজে;
     ঘরে ঘরে শূন্য হল আরামের শয্যাতল;
          "যাত্রা করো, যাত্রীদল"
              উঠেছে আদেশ,
          "বন্দরের কাল হল শেষ।"
 
              মৃত্য ভেদ করি
          দুলিয়া চলেছে তরী।
    কোথায় পৌঁছিবে ঘাটে, কবে হবে পার,
          সময় তো নাই শুধাবার।
          এই শুধু জানিয়াছে সার
               তরঙ্গের সাথে লড়ি
          বাহিয়া চলিতে হবে তরী।
          টানিয়া রাখিতে হবে পাল,
     আঁকড়ি ধরিতে হবে হাল;
              বাঁচি আর মরি
          বাহিয়া চলিতে হবে তরী।
              এসেছে আদেশ--
     বন্দরের কাল হল শেষ।
 
          অজানা সমুদ্রতীর, অজানা সে-দেশ--
              সেথাকার লাগি
              উঠিয়াছে জাগি
ঝটিকার কণ্ঠে কণ্ঠে শূন্যে শূন্যে প্রচণ্ড আহ্বান।
              মরণের গান
     উঠেছে ধ্বনিয়া পথে নবজীবনের অভিসারে
              ঘোর অন্ধকারে।
     যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল,
              যত অশ্রুজল,
          যত হিংসা হলাহল,
          সমস্ত উঠিছে তরঙ্গিয়া,
              কূল উল্লঙ্ঘিয়া,
     ঊর্ধ্ব আকাশেরে ব্যঙ্গ করি।
              তবু বেয়ে তরী
        সব ঠেলে হতে হবে পার,
কানে নিয়ে নিখিলের হাহাকার,
     শিরে লয়ে উন্মত্ত দুর্দিন,
     চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন,
     হে নির্ভীক, দুঃখ অভিহত।
ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি। মাথা করো নত।
     এ আমার এ তোমার পাপ।
     বিধাতার বক্ষে এই তাপ
বহু যুগ হতে জমি বায়ুকোণে আজিকে ঘনায়--
     ভীরুর ভীরুতাপুঞ্জ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়,
              লোভীর নিষ্ঠুর লোভ,
          বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ,
                  জাতি-অভিমান,
মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার বহু অসম্মান,
     বিধাতার বক্ষ আজি বিদীরিয়া
ঝটিকার দীর্ঘশ্বাসে জলে স্থলে বেড়ায় ফিরিয়া।
          ভাঙিয়া পড়ুক ঝড়, জাগুক তুফান,
নিঃশেষ হইয়া যাক নিখিলের যত বজ্রবাণ।
রাখো নিন্দাবাণী, রাখো আপন সাধুত্ব আভিমান,
              শুধু একমনে হও পার
                    এ প্রলয়-পারাবার
              নূতন সৃষ্টির উপকূলে
              নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে।
 
দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানা ছলে;
অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে;
              মৃত্যু করে লুকোচুরি
              সমস্ত পৃথিবী জুড়ি।
           ভেসে যায় তারা সরে যায়
              জীবনেরে করে যায়
                ক্ষণিক বিদ্রূপ।
আজ দেখো তাহাদের অভ্রভেদী বিরাট স্বরূপ।
          তার পরে দাঁড়াও সম্মুখে,
              বলো অকম্পিত বুকে--
              "তোরে নাহি করি ভয়,
     এ সংসারে প্রতিদিন তোরে করিয়াছি জয়।
তোর চেয়ে আমি সত্য, এ বিশ্বাসে প্রাণ দিব, দেখ্‌।
  শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক।"
 
     মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে,
         সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে,
              পাপ যদি নাহি মরে যায়
              আপনার প্রকাশ-লজ্জায়,
   অহংকার ভেঙে নাহি পড়ে আপনার অসহ্য সজ্জায়,
                 তবে ঘরছাড়া সবে
               অন্তরের  কী আশ্বাস-রবে
     মরিতে ছুটিছে শত শত
প্রভাত-আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো।
     বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।
          স্বর্গ কি হবে না কেনা।
          বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না
              এত ঋণ?
     রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন।
          নিদারুণ দুঃখরাতে
              মৃত্যুঘাতে
     মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?
 
 
  কলিকাতা, ২৩ কার্তিক, ১৩২২




সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
     আঁধারে মলিন হল--যেন খাপে-ঢাকা
              বাঁকা তলোয়ার;
     দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার
এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে;
              অন্ধকার গিরিতটতলে
                     দেওদার তরু সারে সারে;
মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
              বলিতে না পারে স্পষ্ট করি,
অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।
 
              সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে
                      সন্ধ্যার গগনে
     শব্দের বিদ্যুৎছটা শূন্যের প্রান্তরে
মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে দূরে দূরান্তরে।
              হে হংস-বলাকা,
     ঝঞ্ঝা-মদরসে মত্ত তোমাদের পাখা
          রাশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে
বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে।
              ওই পক্ষধ্বনি,
          শব্দময়ী অপ্সর-রমণী
     গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি।
          উঠিল শিহরি
     গিরিশ্রেণী তিমির-মগন
     শিহরিল দেওদার-বন।
 
          মনে হল এ পাখার বাণী
              দিল আনি
          শুধু পলকের তরে
     পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
              বেগের আবেগ।
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;
              তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি
              মাটির বন্ধন ফেলি
     ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,
          আকাশের খুঁজিতে কিনারা।
     এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
                            সুদূরের লাগি,
                       হে পাখা বিবাগী।
     বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে--
     "হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোন্‌খানে।"
 
              হে হংস-বলাকা,
আজ রাত্রে মোর কাছে খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা।
     শুনিতেছি আমি এই নিঃশব্দের তলে
              শূন্যে জলে স্থলে
     অমনি পাখার শব্দ উদ্দাম চঞ্চল।
                            তৃণদল
     মাটির আকাশ-'পরে ঝাপটিছে ডানা,
     মাটির আঁধার-নীচে কে জানে ঠিকানা
              মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
              লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।
              দেখিতেছি আমি আজি
                       এই গিরিরাজি,
          এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
     দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।
              নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে
          চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে।
             শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে
              অলক্ষিত পথে উড়ে চলে
          অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফষ্ট সুদূর যুগান্তরে!
              শুনিলাম আপন অন্তরে
              অসংখ্য পাখির সাথে
              দিনেরাতে
          এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে
              কোন্‌ পার হতে কোন্‌ পারে।
          ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে--
          "হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে।"
 
 
  শ্রীনগর, কার্তিক, ১৩২২


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন