প্রয়াত কবি আক্তারুজ্জামান লেবুর কয়েকটি কবিতা


নিজের বই নিয়ে লেবুর শেষ লেখা

দুটো কথাঃ

প্রথমত, 
আপনাদের সহযোগিতা, ভালোবাসা ও দোয়ায় আল্লাহর রহমতে আমার দ্বিতীয় টার্ম কেমোথেরাপি সম্পূর্ণ হলো।। শারীরিক অবস্থা ভালো নয় যদিও, এখন ডাক্তার বলেছেন, সিটি স্ক্যান করে দেখতে হবে কতোটুকু ইমপ্রুভ হলো, নাকি হলো না, অথবা আরো কতো সাইকেল কেমোথেরাপি দিতে হবে।। এটা নির্ভর করবে রিপোর্টের ওপর। জানিনা রিপোর্ট কেমন আসবে, তবে খারাপ আসলে এবারের অর্থনৈতিক ধাক্কা আর সামলাতে পারব বলে মনে হয় না। দোয়া করবেন আমার জন্য।

দ্বিতীয়ত,
আমার জীবনের শেষ কবিতার বই বের হচ্ছে এবার। এর পর আর কোন বই করার সময় বা সৌভাগ্য আমার হবে না, এটাই বাস্তব।  বইটা প্রেসে গেছে।
এবারের বইটি আমার নিজ হাতে সাজানো। কিছু কবিতা লেখা হয়ে যাবার পর অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করে, প্রশান্তি অনুভব হয়,  পাঁচ ফর্মার এই বইয়ের সব কবিতাই আমার প্রশান্তি জন্ম দেয়া কবিতা দিয়ে সাজানো। বলতে দ্বিধা নেই, বইটি করার ইচ্ছে ছিল না, অর্থনৈতিক বিষয়টা চিন্তা করেই করা। আগের বইটি আপনার অনেকে শুভেচ্ছা মূল্য কিনে আমার যে উপকারটা করেছিলেন তা ভোলার নয়।
আপনাদের প্রতি সেই আশা ও ভরসা আমার এখনো টিকে আছে বিধায় জীবনের শেষ বইটি যত্ন নিয়ে করলাম।
দোয়া করবেন, শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধটা যেন চালিয়ে যেতে পারি।
আপনাদের ভালোবাসা ছাড়া আমার জীবনে কোন অর্জন নেই।
চিরতরে চলে যাবার আগ পর্যন্ত এটুকু আমি পেতে চাই।

বইঃ দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ
প্রচ্ছদঃ কিংশুক ভট্টাচার্য 
নামলিপিঃ শিবলী মোকতাদির 
প্রকাশনীঃ সবুজ স্বর্গ
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা অথবা শুভেচ্ছা মূল্য । ( কুরিয়ার খরচ দিতেও পারেন,  না দিতেও পারেন)

ইনবক্সে ফোন নাম্বার সহ নাম ঠিকানা দিয়ে রাখলে বইটি হাতে পেলেই আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিব। মূল্য আপনার সুবিধামত সময়ে পরিশোধ করবেন।








লেবু ভাইয়ের ইচ্ছা ছিলো তার সুন্দর একখানা বই হবে।যে বইয়ের প্রচ্ছদ, ছাপা, কালার, প্রিন্ট, বাঁধাই সুন্দর হবে। আমাকে ডেকে বললেন, হিরণ্য সুন্দর একটা বই করবা, একেবারে মনের মত, টাকা যা লাগে আমি দিব।

তারপর ❛দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ❜ বইটি ছাপা হলো। তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন ঠিক তেমনভাবে বইটি ছাপানোর চেষ্টা করেছি আমি।

কবি কিংশুক ভট্টাচার্য ও কবি শিবলী মোকতাদির যথেষ্ট সাহায্য করেছেন বইটি নির্ভুল করার জন্য।

ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে রাত ৯ টায় আমি ৫০০ কপি বই নিয়ে হাজির হই উনার বাসায়।

বই দেখবেন বলে উনি তখন পর্যন্ত জেগেই ছিলেন।

আমি এসেছি বই নিয়ে, নিশ্চিত হয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

পরেরদিন বই দেখলেন, বুঝলাম অসন্তুষ্ট হননি।

আমাকে বললেন, ৫০০ কপি বই যদি সব বিক্রি হত, ১ লাখ টাকা তো আসবে। দু'টো কেমো হলে আর কয়টা দিন বেশি বেঁচে থাকতাম।

প্রথম বই 'না জল না অনল' ব্যাপক সাড়া ফেলছিলো।

দুই ধাপে ৫৩০ কপি বই করেছিলাম।

সব বিক্রি হয়ে গেছে।

আমার কাছে থাকা শেষ বইটিও বিক্রি করেছি।

কিন্তু দুঃখের কথা ❛দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ❜ কবিতাগ্রন্থটি আশানুরূপ বিক্রি হয়নি।

লেবু ভাই দুঃখ করে বলতেন বইগুলো তাহলে থেকে গেলো।

আমি ব্যথিত কণ্ঠে বলতাম, সব বই বিক্রি হয়ে যাবে, মেলা আসুক।

তারপর তাক থেকে কিছু বই নিয়ে বগুড়াতে চলে আসতাম।


ফেব্রুআরি'র ২২ তারিখে হঠাৎ লেবু ভাই বললেন, মেলায় বই পাঠাইছো?

আমি বললাম, না।

─'মেলা শেষ হলে বই বেচবা কখন'।

মেলা তো মার্চের ১৮ তারিখ থেকে।

─'ওহ্, আচ্ছা'।


এখনো বইয়ের অনেক কপি আছে।

আমাকে (Hiranya Harun) অথবা কিংশুক দার (কবি কিংশুক ভট্টাচার্য) ইনবক্সে যোগাযোগ করতে পারেন। বইটি আমরা পৌঁছে দিব আপনার ঠিকানায়।

কবিতা ক্যাফে থেকেও সংগ্রহ করতে পারবেন।


অথবা

বইমেলায় জলধি'র স্টলে পাওয়া যাবে।


"জলধি"

স্টল নং ৬৬

লিটল ম্যাগ চত্বর।


দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ : আক্তারুজ্জামান লেবু ॥ প্রচ্ছদ : কিংশুক ভট্টাচার্য ॥ প্রকাশনী : সবুজ স্বর্গ ॥ মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা।।

পরিবেশক: জলধি।


হিরণ্য হারুন 

২২ মার্চ ২০২১






কবিতা সমূহ 


টাকা চাই
কতো টাকা?
জানা নাই

প্রতিদিন মৃত্যুর সাথে আলাপ হয়

কি গভীর সে আলাপ!

এক সময় টাকা ফুরিয়ে আসে

আলাপ বন্ধ হয়ে যায় 

মৃত্যু বসে থাকে বারান্দায় 

আলাপের অপেক্ষায় 

টাকা চাই 
কতো টাকা? 
জানা নাই।



আমার জীবন ও স্বপ্নগুলো

মাচার ওপর পড়ে থাকা 

গোড়া কেটে দেওয়া লাউগাছের মতো হয়ে আছে।


হেমন্তের মিষ্টি রোদেও শুকিয়ে যাচ্ছে শাখা-প্রশাখা


শিশির এসে যতোই সতেজ রাখার চেষ্টা করুক

মরে যাচ্ছে,  কেবল মরে যায়... 

নতুন অবলম্বন ধরতে চাওয়া  লতাগুলো,

দু'চারটা মাতৃফুল...


আমার দুঃসময়ে যাঁরা পাশে আছেন, তাঁর হলেন সেই শিশির।




তোমাকে বিব্রত করি


®

ভালোবাসার প্রশ্নে

তোমাকে কাছে পাবার প্রশ্নে বিব্রত করি


তীব্র স্রোতে আমার সব ভেসে  গেছে জানি

তবুও একটা অবলম্বনের জন্য

কিছুটা আশ্রয় পাবার আশায়

তোমাকে বিব্রত করি


দুটো চোখের ওপর দুটো চোখ 

হাতের ওপর হাত টুকু 

রাখার জন্য

তোমাকে বিব্রত করি


পড়ন্ত একটা বিকেলের জন্য

একমুঠো শিউলি হাতে ধরিয়ে দেবার জন্য 

তোমাকে বিব্রত করি


তোমার নির্ভেজাল হাসি দেখার জন্য

গোপনে বাড়ির পাশে  দাঁড়াবার 

মৌন সম্মতির জন্য বিব্রত করি


অন্তত একটিবার 

তোমার নিঃশাস ছুঁয়ে দেখার জন্য

বুকের খুব নিকটে দাঁড়াবার জন্য বিব্রত করি


একটি নাঘুমানো রাতের জন্য

ভেজা চুল সকালের জন্য বিব্রত করি


একটু অবহেলার জন্য

এক সাগর দুঃখের জন্য 

অবশেষ দীর্ঘশ্বাসের জন্য বিব্রত করি।


কোন একদিন

🎗


মরে গেলে 

লোকে কিছুদিন সদ্যপ্রয়াত বলে

তারপর আর কিছু বলে না, ভুলে যায়

হয়তো  মৃত ব্যক্তি যাপন করতে থাকে অনন্ত অন্ধকার 


কিছু লতাগুল্ম,  ঘাসফুল

কবরের ওপর কিছু দিনের সংসার পাতে

একটা সময়

কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে 

ঘাসফুলের সংসার ভেঙে যায়

লতাগুল্মের শেকর আর বাঁচে না


আর কবরের  ওপর গড়ে ওঠে জীবিত মানুষের ঘর।


শিক্ষার্থী

ভাটীর সুর শিখতে এসেছি

জানা থাকলে শেখাও


না হলে পৌঁষের শেষ লাইনে দাঁড়াব

ফাল্গুনের সামনে দিয়ে যেই হেঁটে যাবে

তার কাছেই শিখে নেব শ্রাবণ....




প্রেমের কবিতা

🎗

তোমার চোখ তো আগুন ছাড়া কিছু দেখে না

আমি যতোই ফুল নিয়ে দাঁড়াই


ঘাসফুলের শরীরময় যতো দীর্ঘশ্বাসই আঁকি না কেন

শিশিরের সংসার ভেঙে 

আমার চোখে যতো নদীই হোক দৃশ্যমান 

তোমার চোখে তো কেবল আগুন ভেসে ওঠে 


আমাকে সেই আগুন আঁকড়ে ধরে বলতে হয়

পৃথিবীতে তবু দুঃখের কিছুটা স্থায়ীত্ব আছে 

 কতো ঘাসফুলের সংসার হয় না সে হিসেব 

কার কাছে থাকে। অন্ধকারে ডুবে থাকা আগুন 

কার চোখে পড়ে। এমন আগুন কে আর আঁচল 

দিয়ে ঢাকে সারা জীবন । কার এতো সময় 

কে হায় অদৃশ্যের বুক ফুরে 

তুলে আনে বেদনা বৃক্ষের ফল 

কোন এক দূর নক্ষত্রের জল...


প্রেম

🎗


কুমড়ো ফুল

তুমি বড় হও

ভোরের শিশিরের কাছে,  রোদের কাছে 

ঋণী হয়ে বেঁচে থাকো


আর

পতঙ্গের কাছে যেটুকু প্রেম

 ভুলে যাও, ভুলে যাও...



অভিমান


প্রতিদিন আমার কবিতা ছাপা হচ্ছে 


অগণিত পাঠকের সামনে কবিতা দাঁড়াচ্ছে 

কিন্তু আমার পত্রিকার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না

অবলীলায় মাড়িয়ে যাচ্ছে পা

ছিঁড়ে ফেলছে শাখা-প্রশাখা


প্রিয় ঘাসফুল 

আমার কবিতা আর ছাপায়োনা তুমি

প্রিয় বৃক্ষ 

তোমার সাময়িকীতে রেখো না আমার কবিতা




অযোগ্যতা


🎗


পৃথিবীতে আমি আর কারো যোগ্য নই।


এখন ফুল এগিয়ে দিলে

লোকজন উপহাস ফিরিয়ে দেয়


গভীরভাবে কারো চোখে আর রাখি না চোখ

অযোগ্যতার প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে


কারো মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস নেই

এতো সব প্রশ্নবিদ্ধ মুখ


যতো বড় দুঃখ 

চোখ ততো বেশি শুকায়

একদিন চোখ হয়ে যায় পাথর


তোমরা উপহাস ফিরিয়ে দিলেও

পাথর চোখ আর কাঁদতে পারে না

আসলে পাথরের কান্না বোঝা যায় না


এ ভাবেই,  একদিন 

আমার ফুল ফুরিয়ে গেলে মনে পড়ে 

পৃথিবীতে আমি  আর কারো যোগ্য নই


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন