শ্রীজাত এর কবিতা সংগ্রহ

 


আয়না – শ্রীজাত

এই যুদ্ধের দিনগুলো পেরিয়ে যেতে
তুমি বন্ধুর মতো কিছু সাহস দিও
ওই সঞ্চয় ফলে আছে সময়ক্ষেতে
সেই শস্যের রং আজও অতুলনীয়

কিছু সাহস দিও

এই অন্ধকারের রাত সহ্য হলে
জেনো পৌঁছে যাবই, শুধু হাতটা ধোরো
হাওয়া উথালপাথাল, পথে নিশান দোলে
দ্যাখো মিলে যাবে বন্দর-গ্রাম-শহরও

শুধু হাতটা ধোরো

ওই পশ্চিমে ডোবে দিন শেষ প্রহরের
তুমি শান্ত কোলের কাছে থাকবে, বলো?
ভাঙে কাজের ডানার ছায়া তেপান্তরে…
নামে একলা চোখের মতো অস্তাচলও

কাছে থাকবে বলো

আছে শেষটা কোথায় সেটা কেউ জানে না
দেবো ভুলের মাশুল, তবু যেও না ভুলে
হবে নতুন মশাল হাতে দুনিয়া চেনা
যদি পোড়াও এ হাত, রেখো ছাই আঙুলে…

তবু যেও না ভুলে

এই যুদ্ধের দিনগুলো পেরিয়ে গেলে
যারা থাকবে, আবার জেনো গড়বে প্রিয়,
তুমি অন্ধকারের রাতে ইচ্ছে জ্বেলে
কিছু সাহস দিও… কিছু সাহস দিও…


রোদ আর খড়কুটো – শ্রীজাত

সকালে এনেছি রোদ আর খড়কুটো।
আমার খাতায় সকাল যেভাবে হয়।
সময়ের কাছে হেরে গেছি খুব দ্রুত…
তুমি তো আমার কবিতায় পাওয়া জয়।

তোমার ঘরেও একফালি রোদ ঢোকে,
লেখার দু’পাশে সরে যায় উল্কারা…
তুমি বোঝাচ্ছ ভেঙে ফেলা। ছন্দকে।
কুড়িয়ে নিচ্ছে, কাছে বসে আছে যারা।

আমি দূর থেকে এই সমস্ত দেখি।
একা হেঁটে যায় জন্মদিনের শীত…
স্পর্শে এ-লেখা একবারও জাগবে কি?
জলে যেরকম ফিরে আসে সম্বিৎ?

সকালে এনেছি খড়কুটো আর রোদ।
আমার খাতায় সকাল যেটুকু হয়।
পথে পথে আজ উঠে যাক অবরোধ…
তুমি তো আমার কবিতায় পাওয়া জয়!




মানুষটা – শ্রীজাত

মানুষটাকে দেখিনি, তবু জানতে পারি স্বপ্নে
কাঙাল ছিল অনেকখানি, কিছুটা রক্তাক্ত

বহ্নি ছিল পোষ মানানো, ঝড়ের মুঠি আলগা
বাজারগামী রাস্তা জুড়ে একলা বসে থাকত।

মানুষটাকে দেখিনি, শুধু শূন্যে রাখি আন্দাজ –
স্বভাব ছিল রুপোলি তার, বাতাসে চুল পাকত

কেমন যেন বিরহী লোক। অলীক, নাকি উন্মাদ?
তলিয়ে যাবে জেনেও, জলে বাড়ির ছবি আঁকত।

মানুষটাকে দেখিনি, আজও গল্পে পড়ি বারবার –
ঘুম পাড়াত অগ্নি তাকে, শব্দ পিছু ডাকত

ভ্রমণ বড় অসাবধানী, কোথায় নিয়ে ফেলবে…
সমুদ্রে সে নিরুদ্দেশী। অরণ্যে শনাক্ত।

মানুষটাকে দেখিনি, শুনি দরজা খুলে রাখত।

দেখিনি, তাই ধর্ম মানি। দেখিনি, তাই ঈশ্বর।
আমার মতো নাস্তিকেও হৃদয় থেকে শাক্ত।



সময় নাও – শ্রীজাত

মৃত্যু নিয়ে লিখতে গিয়ে অসাড় হওয়া হাত
বাড়িয়ে দেব তোমায়। তুমি পাওনি সাক্ষাৎ
পীড়াবরণ ফুলের। তাই মুখে অমন ঋণ
জাগিয়ে রাখা সম্ভবও, যে মুহূর্তে রঙিন
তাকে চেনাও। তাকে চেনাও। বিফলে রঙ্গিত
যেমন ডানা চিনিয়ে দেয় পরিযায়ীর শীত,
মৃত্যু নিয়ে লিখতে গিয়ে অসাড় হলো হাত
কেমন অসময়ের, এই অশনিসম্পাত…

ফিরে আসার কথাই ছিল। ফিরিয়ে দিলে মন।
পর্ণমোচী শরীর, তার চিরহরিৎ মন…

সময় নাও। বলেছিলেন অলোকরঞ্জন।


দহন – শ্রীজাত

সন্ধে নামছে তখন তোমার মুখে,
আকাশে দূরের তারা চেনাচ্ছ তুমি…
আমরা দেখছি আগুনের বন্ধুকে।
জীবন ধ্রুবক। মৃত্যুই মরসুমি।

একজীবনের এতগুলো সংলাপ
সব ঠিকঠাক আদায়ের পর ছুটি।
আমরা দেখছি শ্রান্ত পায়ের ছাপ,
ভালবাসা তবু দেখায়নি বিচ্যুতি।

সন্ধে নামছে আবার তোমার কাছে।
এবার তোমাকে নিয়ে যাবে ব’লে আসা।
ক’জন মানুষ প্রবাহের মতো বাঁচে?
চিনিয়ে দিচ্ছ দূরের তারার ভাষা।

দাহ মুছে যাক। দহন জাগুক দাগে।
মহীরুহ গেলে নতজানু হয় ঝড়ও।
ছাই উড়ে যেতে এক মুহূর্ত লাগে।
তোমার আগুন, আকাশের চেয়ে বড়…



একদিন – শ্রীজাত

একদিন যেই আমি বাসে চেপে দূরে যাব
কালো আকাশের নীচে বুঝি কোনও চা-দোকানে
কথা হবে মানুষের। দু’জন থাকিবে চুপ।
দেহাতি ধরণ।

কে যাবে অচেনা ছাতে শাড়িজামা তুলে নিতে –
গতমাসে এই দিনে ছোটকাকা চলে গেছে।
একটি আলেয়াগাছ আলো করে আছে মেঘে
দোহারা গড়ন

মিশেছে আকাশ পিচে পিষেছে মরিচদানা
কোথাকার জোলো হাওয়া এলোমেলো হল সবই
এমন বিকেল জানি ফেরাবে অলীক হাতে,
নেবে না স্মরণ…

যে-শহর থেকে গেল পিছনে বা পিছুটানে,
সেখানে খবর কোনও রেডিওয় শোনাবে না।
কেবল ট্রামের গায়ে হঠাৎ জলের ধারা –
অলংকরণ

এ ডাকেও সাড়া দিলে অভিসারই বলে তাকে
ধূপের কিনারে ছাই কখন যে খসে যাবে…
চেপে রাখা বৃষ্টিতে ফিনকি ছোটালে বোলো
পানিয়া ভরন

একদিন চলে যাব দূরে কোনও বাসে চেপে
যে-কোনও লোকের পাশে যে-কোনও মানুষ হয়ে।
জলই কি দেখেছ শুধু? তুমি কি দ্যাখোনি তার
রক্তক্ষরণ?



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন