ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ


  ভারতের ভাগ্য-বিপ্লব – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত


পূর্বকার দেশাচার কিছুমাত্র নাহি আর


অনাচারে অবিরত রত।

কোথা পূর্ব রীতি নীতি, অধর্মের প্রতি প্রীতি,

শ্রুতি হয় শ্রুতিপথহত।।

দেশের দারুণ দুখ দেখিয়া বিদরে বুক,

চিন্তায় চঞ্চল হয় মন।

লিখিতে লেখনী কাঁদে ম্লানমুখ মসীছাঁদে

শোক-অশ্রু করে বরিষণ।।

কি ছিল কি হ’ল, আহা, আর কি হইবে তাহা,

ভারতের ভবভরা যশ।

ঘুচিবে সকল রিষ্টি হবে সদা সুখ-বৃষ্টি,

সর্বাধারে সঞ্চারিবে রস।।

সুরব সৌরভ হয়ে দশদিকে যশ লয়ে,

প্রকাশিবে শুভ সমাচার।

স্বাধীনতা মাতৃস্নেহে ভারতের জরা-দেহে

করিবেন শোভার সঞ্চার।।

দুর হবে সব ক্লান্তি পলাবে প্রবলা ভ্রান্তি,

শান্তিজল হবে বরিষণ।

পুণ্যভূমি পুনর্বার পূর্বসুখ সহকার,

প্রাপ্ত হবে জীবন যৌবন।।

প্রবীণা নবীনা হয়ে সন্তানসমূহ লয়ে

কোলে করি করিবে পালন।

সুধাসম স্তন্যপানে জননীর মুখপানে

একদৃষ্টে করিবে ঈক্ষণ।।

এরূপ স্বপনমত, কত হয় মনোগত,

মনোমত ভাবের সঞ্চার।

ফলে তাহা কবে হবে প্রসূতির হাহারবে,

সূত সবে করে হাহাকার।।







তপসে মাছ – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত


কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়।

গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়॥

মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।

মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে॥

পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।

সমধুর মিষ্ট রস সব-অঙ্গে মাখা॥

একবার রসনায় যে পেয়েছে তার।

আর কিছু মুখে নাহি ভাল লাগে তার॥

দৃশ্য মাত্র সর্বগাত্র প্রফুল্লিত হয়।

সৌরভে আমোদ করে ত্রিভুবনময়॥

প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা।

ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিই কাঁচা॥

অপরূপ হেরে রূপ পুত্রশোক হরে।

মুখে দেওয়া দূরে থাক গন্ধে পেট ভরে॥

কুড়ি দরে কিনে লই দেখে তাজা তাজা।

টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকাতেলে ভাজা॥

না করে উদর যেই তোমায় গ্রহণ।

বৃথায় জীবন তার বৃথায় জীবন॥

নগরের লোক সব এই কয় মাস।

তোমার কৃপায় করে মহা সুখে বাস॥




মাতৃভাষা – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

মায়ের কোলেতে শুয়ে ঊরুতে মস্তক থুয়ে
খল খল সহাস্য বদন।
অধরে অমৃত ক্ষরে আধ আধ মৃদু স্বরে
আধ আধ বচনরচন।।
কহিতে অন্তরে আশা মুখে নাহি কটু ভাষা
ব্যাকুল হয়েছে কত তায়।
মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা-বা-বা আবো আবো আবা আবা
সমুদয় দেববাণী প্রায়।।
ক্রমেতে ফুটিল মুখ উঠিল মনের সুখ
একে একে দেখিলে সকল।
মেসো, পিসে, খুড়ো, বাপ জুজু, ভুত, ছুঁচো, সাপ
স্থল জল আকাশ অনল।।
ভাল মন্দ জানিতে না, মল মুত্র মানিতে না,
উপদেশ শিক্ষা হল যত।
পঞ্চমেতে হাতে খড়ি, খাইয়া গুরুর ছড়ি,
পাঠশালে পড়িয়াছ কত।।
যৌবনের আগমনে, জ্ঞানের প্রতিভা সনে,
বস্তুবোধ হইল তোমার।
পুস্তক করিয়া পাঠ, দেখিয়া ভবের নাট,
হিতাহিত করিছ বিচার।।
যে ভাষায় হয়ে প্রীত পরমেশ-গুণ-গীত
বৃদ্ধকালে গান কর মুখে।
মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা
তুমি তার সেবা কর সুখে।।



কৌলীন্য – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

মিছা কেন কুল নিয়া কর আঁটাআঁটি।
এ যে কুল কুল নয় সার মাত্র আঁটি।।
কুলের গৌরব কর কোন্ অভিমানে।
মূলের হইলে দোষ কেবা তারে মানে।।
ঘটকের মুখে সুধু কুলীনের চোপা।
রস নাই যশ কিসে কুল হল টোপা।।
আদর হইত তবে ভাঙ্গিলে অরুচি।
পোকাধরা সোঁকা ভার দেখে যায় রুচি।।
অতএব বৃথা এই কুলের আচার।
ইথে নাহি রক্ষা পায় কুলের আচার।।
কুলের সম্ভ্রম বল করিব কেমনে।
শতেক বিধবা হয় একেক মরণে।।
বগলেতে বৃষকাষ্ঠ শক্তিহীন যেই।
কোলের কুমারী লয়ে বিয়ে করে সেই।।
দুধে দাঁত ভাঙ্গে নাই শিশু নাম যার।
পিতামহী সম নারী দারা হয় তার।।
নরনারী তুল্য বিনা কিসে মন তোষে।
ব্যভিচার হয় শুদ্ধ এই সব দোষে।।
কুলকল্পে নয় রূপ সুলক্ষণ যাহা।
অবশ্য প্রামাণ্য করি শিরোধার্য তাহা।।
নচেৎ যে কুল তাহা দোষের কারণ।
পাপের গৌরব কেন করিব ধারণ।।
হে বিভু করুণাময় বিনয় আমার।
এ দেশের কুলধর্ম করহ সংহার।।





মানুষ কে? – ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত


নিয়ত মানসধামে একরূপ ভাব।
জগতের সুখ-দুখে সুখ দুখ লাভ।।
পরপীড়া পরিহার, পূর্ণ পরিতোষ।
সদানন্দে পরিপূর্ণ স্বভাবের কোষ।।
নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ।
রাজ্যের কুশলকার্যে সদা হাস্যমুখ।।
কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

নাহি চায় রাজ্যপদ নাহি চায় ধন।
স্বর্গের সমান দেখে বন উপবন।।
পৃথিবীর সমুদয় নিজ পরিজন।
সন্তোষের সিংহাসনে বাস করে মন।।
আত্মার সহিত সব সমতুল্য গণে।
মাতাপিতা জ্ঞাতি ভাই ভেদ নাহি মনে।।
সকলে সমান মিত্র শত্রু নাহি যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী।
সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী।।
ভুবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে।
পর্বত সলিল হয় রসনার রসে।।
মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে।
অঙ্গীকার অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে।।
অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

চেষ্টা যত্ন অনুরাগ মনের বান্ধব।
আলস্য তাদের কাছে রণে পরাভব।।
ভক্তিমতে কুশলগণে আয় আয় ডাকে।।
পরিশ্রম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে জীবনের আশা।
যতনে হৃদয়েতে সমুদয় বাসা।।
স্মরণ স্মরণ মাত্রে আজ্ঞাকারী যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন