রনজ জামানের কবিতা সংগ্রহ

 পাথর

 

এক টুকরো পাথর, 

ভেতরে ঈশ্বরের ভাস্কর্য নিয়ে

পড়ে আছে পথের উপর।

 

 

 

সন্ধ্যাকালীন

 

সন্ধ্যাকালীন। ধরো, পথের দুইপাশে সহস্র বইয়ের দোকান

 

তুমি, বিরল বইয়ের মতো। তোমাকে খুঁজছিলাম।

 

হালকা শীত বৃষ্টি

 

তুমি শেলফ থেকে—বই থেকে—পাতা থেকে—অক্ষর

 

ঝেড়ে মুছে আবার গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?

 

অদ্ভুত

 

আবহাওয়া আজ। দুটো

 

বৃষ্টিফোঁটার ব্যবধানে, ঝরতেছে রাশি রাশি শুকনো পাতা।

 

 

 

বাবা

 

মাতৃগর্ভে থাকাকালে আমার খুব বাবাকে দেখতে

ইচ্ছে হতো। বাবার তখন আমাকে

দেখতে ইচ্ছে হতো কিনা, বলতে পারি না।

বাবা দেখতে কেমন, কীভাবে হাসেন, কথা বলেন—

একেকবার মনে হতো তিনি ফেরেশতার মতো।

অথচ যতবার মাকে কাঁদতে শুনেছি

বাবাকে জগতের নিষ্ঠুরতম লোক বলে মনে হতো।

ঘৃণা হতো। তার মুখ না দেখার ইচ্ছেরা

চেপে বসতো তখন। মা কাঁদতে কাঁদতে নানাবাড়ি

চলে যেত। কিন্তু পৃথিবী ছাড়া

আমার আর কোথাও যাবার ছিল না।

 

 

 

বৃষ্টি

       

মেয়েটির মাথাভর্তি অসংখ্য যুবক।

 

কোত্থেকে তবু আরেকটি লম্বা তরুণ—ছয় ফিট তিন—এলো, ছাতা হাতে

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করা গেল না কিছুতেই।

ওরা হেঁটে চলে গেল কোনদিকে।

আর সমস্ত দিনজুড়ে বৃষ্টি ঝরল খুব।

বৃষ্টির দুপ্রান্তে আমরা দুজন।

মাঝখানে তোমার বাবার মতো, কয়েকশো বছর হলো—বৃষ্টি ঝরছে আর

বুড়িয়ে যাচ্ছি আমরা।


পাঠ

   

যে কোনো কাগজই একেকটি মৃত গাছ।

 

সোফার টেবিলে রাখা আধখোলা ডায়রি তোমার

সামান্য বাতাসেই পাতাগুলো

পাখির ডানার মতো জীবন্ত ঝাপটে ওঠে।

সে ডানায় তোমার দিনলিপি গোটা অক্ষরে

 

ওপাশেই, বিস্তৃত

দীর্ঘ তুমি—একই ভঙ্গিতে, আধখোলা এবং

জীবন্ত, শরীরে কাগুজে ঘ্রাণ, অক্ষরের পর অক্ষর,

অচেনা ভাষা।

 

 

আমলকী

 

কোনো বিবর্ণ বটবৃক্ষের প্রতিবিম্বের মতো, আকাশে ঝুলে আছে একখণ্ড মেঘ। কিন্নরী, তোমাদের বাগানের আমলকী গাছটিও আরেক আকাশ। একেকটি আমলকী, মাঝে মাঝে মনে হয়, নক্ষত্রের মতো বিস্তারিত। কখনো বিকেলবেলা তুমি—চাঁদ হয়ে মগডালে ওঠো, আর আমলকী টুপটাপ ঝরতে থাকে। অর্ধেক পৃথিবী আমলকী কুড়ায় তখন। বাকি অর্ধেক—খসে যাওয়া নক্ষত্রের কাছে চোখ বুজে প্রার্থনা করে।

 

 

সংসার, একটি বংশগত রোগ

 

এরচেয়ে মৃত্যু ভালো, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বাবা বলতেন। অর্ধেক কবি, অর্ধেক গৃহস্থ তিনি। পুরোদমে সংসার করেছেন, কবিতা লিখেননি একটিও। বলতেন মৃত্যু কোনো রোগ নয়, মৃত্যুর প্রয়োজনে বাঁধানো যেতে পারে দু’একটি ইয়ে—সংসার কিংবা কবিতা। বাবার পোষা এক খরগোশ ছিল; যার দুঃস্বপ্নে এখনো দৌড়ে ফেরে একটি কাছিম। মা খোঁচা মেরে বলত, মানিয়েছে বাবার পাশে। উদাস ভঙ্গিতে খরগোশের নরম পশমে আঙুল বুলাতে বুলাতে বাবা বলতেন, একবার জেতানো দরকার খরগোশটাকে। মা কিছু বলত না আর। সে ছিল কল্পনাপ্রেমী; নিজের মৃত্যুর দিনকে বিভিন্ন উপায়ে ভেবে কান্না করত। নিজের মৃত্যুতে এভাবে কাউকে আমি কোনদিন কাঁদতে দেখিনি।

 

 

বিকেলের বিপরীতে

 

একটি এরোপ্লেন, খুব রোদ্দুরে

একফালি মেঘের মতন আমাকে ছায়া দিয়ে যায়।

ভাবি আসন্ন বিকেলে, হলদেটে রোদের ভূমিকা

সে যে কোনো বিকেলবেলা

নিজেরই ছায়ার সম্মুখে আরো অসহায় হয়ে পড়ি

যে ছায়া ক্রমশ দীর্ঘতর হয়  

আর আমি অল্প অল্প করে গুটিয়ে যেতে থাকি  

আমার ভেতরে;

ভাবি সে ছায়া

অতিকায় হতে হতে মাথা তুলে দাঁড়াবে একদিন

আর আমাকে শু’য়ে পড়তে হবে

বরাবর—ভূমির সাথে, মেঝের সাথে 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন