জীবনানন্দ দাশের সেরা কবিতা সংগ্রহ

জীবনানন্দ দাশ এর সেরা কবিতা সংগ্রহ 




সূর্য নক্ষত্র নারী


তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো

সব চেয়ে আগে; জানি আমি।

সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।

তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো।

আমাকে বলেনি কেউ।

কোথাও জলকে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল

র’য়ে গেছে;-

যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চ’লে

শিয়রে নিয়ত স্ফীত সুর্যকে চেনে তারা;

আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর

কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?

তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;-

আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত

সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।

 

স’রে যেতো; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে।

নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে

ছেড়ে দেয়; কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের

চেয়ে তবু বড়ো

স্থিরতর প্রিয় তুমি;- নিঃসূর্য নির্জন

ক’রে দিতে এলে।

মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম

তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো

বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম।

তুমি তা জানো না, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি;-

পিছনের পটভূমিকায় সময়ের

শেষনাগ ছিলো, নেই;- বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা

নিভে যায়;- মানুষ অপরিজ্ঞাত সে-অমায়; তবুও তাদের একজন

গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!

আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,

অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!

 

দুই

চারিদিকে সৃজনের অন্ধকার র’য়ে গেছে, নারী,

অবতীর্ণ শরীরের অনুভূতি ছাড়া আরো ভালো

কোথাও দ্বিতীয় সূর্য নেই, যা জ্বালালে

তোমার শরীর সব অলোকিত ক’রে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে দেবে কোনো কালে

শরীরে যা র’য়ে গেছে।

এই সব ঐশী কাল ভেঙে ফেলে দিয়ে

নতুন সময় গ’ড়ে নিজেকে না গ’ড়ে তবু তুমি

ব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকারে একবার জন্মাবার হেতু

অনুভব করেছিলে;-

জন্ম-জন্মান্তের মৃত স্মরণের সাঁকো

তোমার হৃদয় স্পর্শ করে ব’লে আজ

আমাকে ইসারাপাত ক’রে গেলে তারি;-

অপার কালের স্রোত না পেলে কী ক’রে তবু, নারি,

তুচ্ছ, খন্ড, অল্প সময়ের স্বত্ব কাটায়ে অঋণী তোমাকে কাছে পাবে-

তোমার নিবিড় নিজ চোখ এসে নিজের বিষয় নিয়ে যাবে?

সময়ের কক্ষ থেকে দূর কক্ষে চাবি

খুলে ফেলে তুমি অন্য সব মেয়েদের

আত্মঅন্তরঙ্গতার দান

দেখায়ে অনন্তকাল ভেঙ্গে গেলে পরে,

যে-দেশে নক্ষত্র নেই- কোথাও সময় নেই আর-

আমারো হৃদয়ে নেই বিভা-

দেখাবো নিজের হাতে- অবশেষে কী মকরকেতনে প্রতিভা।

 

তিন

তুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে-অতীত আর

যেই শীত ক্লান্তিহীন কাটায়েছিলাম;

তাই শুধু কাটায়েছি।

কাটায়ে জানেছি এই-ই শূন্যে, তবু হৃদয়ের কাছে ছিল অন্য-কোন নাম।

অন্তহীন অপেক্ষার চেয়ে তবে ভালো

দ্বীপাতীত লক্ষ্যে অবিরাম চ’লে যাওয়া

শোককে স্বীকার ক’রে অবশেষে তবে

নিমেষের শরীরের উজ্জলতায়-অনন্তের জ্ঞানপাপ মুছে দিতে হবে।

আজ এই ধ্বংসমত্ত অন্ধকার ভেদ ক’রে বিদ্যুতের মতো

তুমি যে শরীর নিয়ে র’য়ে গেছো, সেই কথা সময়ের মনে

জানাবার আশার কি একজন পুরুষের নির্জন শরীরে

একটি পলক শুধু- হৃদয়বিহীন সব অপার আলোকবর্ষ ঘিরে?

অধঃপতিত এই অসময়ে কে-বা সেই উপচার পুরুষ মানুষ?-

ভাবি আমি;- জানি আমি,তবু

সে-কথা আমাকে জানাবার

হৃদয় আমার নেই;-

যে-কোনো প্রেমিক আজ এখন আমার

দেহের প্রতিভূ হয়ে নিজের নারীকে নিয়ে পৃথিবীর পথে

একটি মুহূর্তে যদি আমার অনন্ত হয় মহিলার জ্যোতিষ্কজগতে।




আমারই চেতনার রঙে

যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।

 

আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে; পাখিডাকা ছায়াঢাকা গ্রাম যাকে বলে। আর ছেলেবেলা বলতে দশ বছর বয়েস পর্যন্ত। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা ঠিক সেভাবে চোখে পড়ে নি সে বয়েসে। তাই যখন শহরে গেলাম পড়তে, গ্রামের সবুজ নয়, বরং গ্রামের মানুষগুলো আর অলস দুপুরের জন্য মন খারাপ হতো। আমার সব সময়েই মনে হয় অলস দুপুর ব্যাপারটা একেবারে গ্রামের নিজের জিনিস। গ্রামের সকাল শুরু হয় শহুরে সকালের অনেক আগে; ঘড়ির কাটায় নয়, মোরগের ডাকে। তাই গ্রামের দিনগুলো হয় লম্বা। শহুরে বাবুরা যতক্ষণে বাস-ট্যাক্সি ঠেঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে পৌঁচ্ছুচ্ছেন, ততক্ষণে গ্রামের কর্মঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। তাই দুপুরের আগেই একপ্রস্থ কাজ শেষ করে জিরিয়ে নেয়া যায়। গ্রামের কাজ দু’বেলা: সকালে আর বিকেলে। আর দুপুরবেলা শুধুই দুপুরবেলা: গোসল, খাওয়া, তারপর গাছের ছায়ায় আড্ডা বা পাটি বিছিয়ে ঘুম। গ্রামে কাউকে বলতে শুনি নিঃ রেখে দে, এ কাজটা দুপুরে করবো। গ্রামের দুপুর মানেই আমার কাছে অলস দুপুর।।

পল্লীর কোল থেকে আলো ঝলমলে শহরে সরে আসা (প্রচলিত অর্থে) একটু ভালো করে বাঁচবার জন্য। অল্প কয়েকজন হয়তোবা আসে জীবনকে আরেকটু ভালো করে বুঝবার জন্য। দশ বছর বয়েসে বেরিয়ে শহরে শহরে কাটিয়ে দিলাম গত বিশটা বছর। যতই সময় পেরুচ্ছে, ততই গ্রামে ফিরে যাবার ইচ্ছে তীব্রতর হচ্ছে: আমার চিরচেনা মল্লিকাবনে। শহরে পূজির মেলা পকেট ভারি করার একটা আশ্বাস দেয় বটে, কিন্তু শহর মনকেও ভারি করে দেয় বড়ো। পূজি নিয়ে কাড়াকাড়ির মধ্যে একটু অলস দুপুর খুঁজে নিয়ে মনের ভেতরে ঘুরে আসার অবসরটুকু শহরে মেলে না। অথচ আমি বিশ্বাস করি সেই মানসিক ভ্রমণেই সুখের নিবাস।।

আমার সবসময়েই মনে হয়েছে সুখের বিস্তার একমুখী: অন্দর থেকে বাহিরে। “পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে”। বৈষয়িক বৈভব, সম্মান, এমনকি একের পর এক সাফল্যও মনে সুখ আনতে পারে না যদি না সে নিজেকে সুখী মনে করেঃ সুখী হবার সিদ্ধান্ত না নেয়। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সুখ আসলে একটা মানসিক সিদ্ধান্ত। জাগতিক অর্জনের সাথে আকাঙ্ক্ষা যদি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাহলে সুখ হয়ে থাকে কুহকিনী। আমাদের কী আছে তার উপর সুখের মাত্রা নির্ভর করে না, নির্ভর করে আমরা আরো কতটা চাই তার উপর। তাই যে মুহুর্তে মনের সাথে “আমি সুখী” এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপোষ করা যায়…সেই মুহুর্তেই দশদিকে সুখের বাতাস বইতে শুরু করে। অন্তত আমার অহর্নিশি এমন হয়।

পড়ছিলাম জীবনানন্দের  কবিতা “বলিল অশ্বথ সেই”। কবিতাটি এক অর্থে সাদামাটা; খুব সহজ চিত্রকল্প; অন্তত মহাপৃথিবী পর্যায়ে জীবনানন্দের অন্যান্য কবিতা থেকে বেশ সহজ মনে হয় প্রথম পড়ায়। প্রথম স্তবকটা এরকমঃ

“বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;

এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের

তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!

বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;

আবার কোথায় যেতে চাও?”

সুতরং, শুরুটা একটি অশ্বত্থ গাছের সাথে কথোপকথন দিয়ে।  জীবনানন্দীয় বিচারে খুব একটা অভিনব কিছু নয়। পেঁচা, নক্ষত্র এবং আকাশের সাথে কবির কথোপকথনে আমরা অভ্যস্ত। মনে পড়ে নিরালোক কবিতার কথা

“অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে সন্ধ্যার আকাশ– এই রাতের আকাশ;

এইখানে ফাল্গুনের ছায়া মাখা ঘাসে শুয়ে আছি;

এখন মরণ ভাল,– শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস;

অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।

কে যেন উঠিল হেঁচে,– হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি!

সারা দিন গাড়ি টানা হল ঢের,– ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে খেয়ে যায় ঘাস;

যেন কোনো ব্যথা নাই পৃথিবীতে,– আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি?

‘কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?’– চাপা ঠোঁটে বলে কৌতুকী আকাশ।”

সত্যি বলতে বলিল অশ্বত্থ সেই কবিতার সাথে নিরালোক কবিতার বেশ ভাবগত মিল আছে। দু’টি কবিতাই বলছে নিজের ভেতরের আকংখার আরো গভীর নিশানা বের করতে। অশ্বত্থ গাছটি যেমন প্রশ্ন করছে, “আবার কোথায় যেতে চাও?” আকাশ তেমনি চাপা ঠোঁটে প্রশ্ন করছে, “কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?”

সুতরাং ব্যাপারটা এখানে প্রকৃতির সদা শান্ত-তৃপ্ত বনাম মানবিক সদা অত্রৃপ্ত ্মন্ত্রের। পথপ্রান্তে মহাকালের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি  দেখেছে ঢের…সে জানে মানবের চিরন্তন নিরূপম  যাত্রার আদ্যেপান্ত…

‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন

তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়

-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-

এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে

এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে

জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্খার বেদনার শুধেছিল ঋণ;

দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!

‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?

সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?

আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?

তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্খার ঘর!”

শেষের কয়েকটি পংক্তিতে বিদগ্ধ অশ্বত্থ ঘোষণা করে, এই চলে যাওয়া নিষ্ফল: স্থানাঙ্ক পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষা, জীবনের পিপাসা মিটবে না।

“যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।”


জীবনের চিরায়ত যে বিপণ্ণ বিস্ময় তার সাথে ভৌগলিক সীমারেখা বা আর্থিক প্রাচুর্যের সম্পর্ক সামান্যই। অশ্বত্থের কাছ থেকে আমরা এর চেয়ে বেশি জ্ঞান কিছু পাই না। তবে নিরালোকের আকাশ আর নক্ষত্র কিন্তু আরো উদার…তারা সমাধান বাতলে দিচ্ছে…


“ঝাউফুলে ঘাস ভরে– এখানে ঝাউয়ের নীচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;

কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।

সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে কোন্‌ ঘরে যাব!

কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই,- চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে শান্তি আমি পাব?

রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে যাব ?

‘তোমারই নিজের ঘরে চলে যাও’– বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে–

‘অথবা ঘাসের ‘পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালবেসে;”



সুতরাং সে-ই আবার নিজের কাছে ফিরে আসা। নিজের কাছে, প্রকৃতির কাছে। এদিক দিয়ে মহাপৃথিবীর জীবনানন্দ রাবীন্দ্রিক দর্শনের থেকে হয়ত খুব দূরে ননঃ 

“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিষের উপরে

একটি শিশিরবিন্দু।”

সপ্তাহান্তের বিরল অবসরে মহাপৃথিবী আর রূপসী বাংলার পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হয়, বরিশাল ছেড়ে কলকাতাতে চাকরি খুঁজে বেড়ানো মধ্যবয়েসী জীবনানন্দকে ছেলেবেলার জীবনানন্দ বড্ড উৎপাত করতো। সেই উৎপাতের সারাৎসারে জীবনানন্দের যে উচ্চারণ তা প্রায়শ আমারই মর্মযাতনার  বর্ণরূপ হয়ে কানে বাজে।। 


বলিল অশ্বত্থ সেই

বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-
তোমরা কোথায় যেতে চাও?
এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:
ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;
এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের
তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!
বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;
আবার কোথায় যেতে চাও?
‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন
তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়
-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-
এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে
এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে
জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাক্সক্ষার বেদনার শুধেছিল ঋণ;
দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!
‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?
আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাক্সক্ষার ঘর!..
যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাক্সক্ষার ঘর!’
-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।



আজ তারা কই সব

আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক — পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, — চলে গেল কবে যে নীরবে,
তাও আর জানি নাকো; ঠোট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে
রোজ ভোরে দেখা দিত — অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে
তারে আর দেখি নাকো — কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে,
জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল — হৃদয়ের গভীর উৎসবে
খেলা করে গেছে তারা কত দিন — ফড়িঙ কীটের দিন যত দিন চলে

তাহারা নিকটে ছিলো — রোদের আনন্দে মেতে — অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে
বহুদিন কাছে ছিলো; — অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে
তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ — মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে;
কোথায় গিয়েছে তারা? ওই দূর আকাশেল নীল লাল তারার ভিতরে
অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু — ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে?
শুধালাম — উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে।


পরস্পর

মনে পড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,
কহিলাম, শোনো তবে —
শুনিতে লাগিল সবে,
শুনিল কুমার;
কহিলাম, দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,
ঘুমানো সে এক মেয়ে — নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে:
সেইখানে আর নাই কেহ —
এক ঘরে পালঙ্কের ‘পরে শুধু একখানা দেহ
পড়ে আছে — পৃথিবীর পথে পথে রূপ খুঁজে খুঁজে
তারপর — তারে আমি দেখেছি গো — সেও চোখ বুজে
পড়ে ছিল — মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাতদুটি
বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি!
আসিবে না গতি যেন কোনোদিন তাহার দু — পায়ে,
পাথরের মতো শাদা গায়ে
এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় —
কিংবা ছিল — আমার জন্য তা নয়!
আমি গিয়ে তাই তারে পারি নি জাগাতে,
পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে
রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে;
তবুও, হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে
তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার!
ফুরালাম রূপকথা, শুনিল কুমার।
তারপর, কহিল কুমার,
আমিও দেখেছি তারে — বসন্তসেনার
মতো সেইজন নয়, কিংবা হবে তাই —
ঘুমন্ত দেশের সেও বসন্তসেনাই!

মনে পড়ে,শোনো,মনে পড়ে
নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে —
(পদ্ম — ভাগীরথী — মেঘনা — কোন্‌ নদী যে সে –
সে সব জানি কি আমি! — হয়তো বা তোমাদের দেশ
সেই নদী আজ আর নাই,
আমি তবু তার পারে আজও তো দাড়াই!)
সেদিন তারার আলো — আর নিবু-নিবু জোছনায়
পথ দেখে, যেইখানে নদী ভেসে যায়
কান দিয়ে তার শব্দ শুনে,
দাড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে, কিংবা ফাল্গুনে।
দেশ ছেড়ে শীত যায় চলে
সে সময়, প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে বলে
রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়,
আমারও চোখের ঘুম খসেছিল হায় —
বসন্তের দেশে
জীবনের — যৌবনের! — আমি জেগে, ঘুমন্ত শুয়ে সে!
জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে
নদীর কিনারে!
হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন
শুয়ে আছে — শুয়ে আছে — শাদা হাতে ধব্‌ধবে স্তন
রেখেছে সে ঢেকে!
বাকিটুকু — থাক্‌ — আহা, একজনে দেখে শুধু — দেখে না অনেকে
এই ছবি!
দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবই! —
আজও তবু খুঁজি
কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছ বুজি!
কুমারের শেষ হলে পরে —
আর — এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর — একজন,
কহিল সে উত্তর — সাগরে
আর নাই কেউ! —
জোছনা আর সাগরের ঢেউ
উচুনিচু পাথরের পরে
হাতে হাত ধরে
সেইখানে; কখন জেগেছে তারা — তারপর ঘুমাল কখন!
ফেনার মতন তারা ঠান্ডা — শাদা
আর তারা ঢেউয়ের মতন
জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে!
ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে।
সেই জলমেয়েদের স্তন
ঠান্ডা, শাদা, বরফের কুঁচির মতন!
তাহাদের মুখ চোখ ভিজে,
ফেনার শেমিজে
তাহাদের শরীর পিছল!
কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল
চাঁদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে!
পায়ে — চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরের গায়ে —
কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে!
রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিক্‌মিক্‌ করে
উত্তর সাগরে
বরফের কুঁচির মতন
সেই জলমেয়েদের স্তন
মুখ বুক ভিজে
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!
কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল
চাদের বুকের থেকে ঝরে
উত্তর সাগরে!
উত্তর সাগরে!

সবাই থামিলে পরে মনে হল — এক দিন আমি যাব চলে
কল্পনার গল্প সব বলে;
তারপর, শীত — হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন
আবার তো এসে যাবে;
এক কবি — তন্ময়, শৌখিন,
আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে!
আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা — পরীর মতন এক ঘুমোনো মেয়ে সে
হীরের ছুরির
মতো গায়ে
আরো ধার লবে সে শানায়ে!
সেইদিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ —
মেঘের মতন চুল — তার সে চুলের ঢেউ
এমনি পড়িয়া রবে পাল্‌ঙ্েকর পর —
ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর।
চার পাশে তার
রাজ — যুবরাজ — জেতা — যোদ্ধাদের হাড়
গড়েছে পাহাড়!
এ রূপকার এই রূপসীর ছবি
তুমি দেখিবে এসে,
তুমিও দেখিবে এসে কবি!
পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত —
শরীরে ননীর ছবি ছুয়ে দেখো চোখা ছুরি — ধারালো হাতির দাঁত!
হাড়েরই কাঠামো শুধু — তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা
ছিল কই! — তবু, সে কি জেগে যাবে? কবে সে কি কথা
তোমার রক্তের তাপ পেয়ে? —
আমার কথায় এই মেয়ে, এই মেয়ে!
কে যেন উঠিল ব’লে, তোমরা তো বলো রূপকথা —
তেপান্তরে গল্প সব, ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা!
হয়তো অমনি হবে, দেখি নিকো তাহা;
কিন্তু, শোনো — স্বপ্ন নয় — আমাদেরই দেশে কবে, আহা! —
যেখানে মায়াবী নাই — জাদু নাই কোনো —
এ দেশের — গাল নয়, গল্প নয়, দু — একটা শাদা কথা শোনো!
সেও এক রোদে লাল দিন,
রোদে লাল — সবজির গানে গানে সহজ স্বাধীন
একদিন, সেই একদিন!
ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চোখে,
ছেড়া করবীর মতো মেঘের আলোকে
চেয়ে দেখি রূপসী কে পড়ে আছে খাটের উপরে!
মায়াবীর ঘরে
ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি, দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর মানুষের দেশের মতন;
রূপ ঝরে যায় — তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন —
যে যৌবন ছিড়ে ফেঁড়ে যায়,
যারা ভয় পায়
আয়নায় তার ছবি দেখে! —
শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে
ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে,
দিন যায় যাহাদের অসাধে, অসুখে! —
দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ,
চোখে ঠোঁটে অসুবিধা — ভিতরে অসুখ!
কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে! —
এ ঘুমোনো মেয়ে
পৃথিবীর ফোপরার মতো করে এরে লয়ে শুষে
দেবতা গর্ন্ধব নাগ পশু মানুষ!..
সবাই উঠিল বলে — ঠিক — ঠিক — ঠিক!
আবার বলিল সেই সৌন্দর্য তান্ত্রিক,
আমায় বলেছে সে কী শোনো —
আর একজন এই —
পরী নয়, মানুষও সে হয় নি এখনও;
বলেছে সে, কাল সাঁঝরাতে
আবার তোমার সাথে
দেখা হবে? — আসিবে তো? — তুমি আসিবে তো!
দেখা যদি পেত!
নিকটে বসায়ে
কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে —
কী কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে
ফিক্‌ করে হেসে!
তবু আরো কথা
বলিতে আসিতে — তবু, সব প্রগল্‌ভতা
থেকে যেত!
খোঁপা বেঁধে, ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে —
সরে যেত, দেয়ালের গায়ে
রহিত দাঁড়ায়ে!
রাত ঢের — বাড়িবে আরো কি
এই রাত! — বেড়ে যায়, তবু, চোখোচোখি
হয় নাই দেখা
আমাদের দুজনার! দুইজন, একা! —
বারবার চোখ তবু কেন ওর ভরে আসে জলে!
কেন বা এমন করে বলে,
কাল সাঁঝরাতে
আমার তোমার সাথে
দেখা হবে? — আসিবে তো? তুমি আসিবে তো! —
আমি না কাঁদিতে কাঁদে.. দেখা যদি পেত!..
দেখা দিয়ে বলিলাম, কে গো তুমি? — বলিল সে তোমার বকুল,
মনে আছে? — এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে’, — ভালোবাসো?’ — হাসি পেল — হাসি!
ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’
আচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে
নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে
চলে এল কাছে —
জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে —
আজও এত চুল!
চেয়ে দেখি — দুটো হাত, ক — খানা আঙুল
একবার চুপে তুলে ধরি;
চোখদুটো চুন — চুন — মুখ খড়ি — খড়ি!
থুত্‌নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি —
সব বাসি, সব বাসি — একবারে মেকি!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন