জয় গোস্বামী |
ফুটকড়াই – জয় গোস্বামী
পরির পাশে পরির বোন,
দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ।
জ্বর থেকে তো উঠল কাল,
রোদের তাপে মুখটি লাল।
লম্বা লাইন ইস্কুলের,
দাও দারোয়ান গেট খুলে।
পরির পাশে পরির মা-ও,
বলছে, ঠাকুর রোদ কমাও,
আবার অসুখ করবে ওর
নষ্ট হবে একবছর।
বয়স কত ? বয়ঃক্রম ?
সেসব ভাবার সময় কম।
ভর্তি হবার জন্য আজ,
টেষ্টে বসাই পরির কাজ।
পরি তো নয়, পরির বোন,
পাঁচ বছরের কম এখন।
এদিক তাকায়, ওদিক চায়;
গোরু বসছে গাছতলায়
একটা কুকুর দৌড়ে যায়,
ট্যাক্সি গাড়ি পাশ কাটায়
গাড়ি থামায় নীল পুলিশ…
কী ভাবছিস রে ? কী ভাবছিস ?
এ বি সি ডি, ওয়ান টু আর
ভুল করিস না, খবরদার !
ভুল করিস না লক্ষ্মীটি,
‘ছি’ দেবে কাকপক্ষিটি।
ভুল করিস না, ধরছি পা’য়
মা কী করে মুখ দেখায়।
না যদি পাস অ্যাডমিশন,
কোন চুলোতে যাই তখন।
পাশের বাড়ির বাপটুও,
দেখবি কেমন দেয় দুয়ো।
চায় না তো মা আর কিছুই,
নম্বর চায়-আনবি তুই।
নাম হবে তোর খুব বড়,
নামের পাশে নম্বরও
বাড়তে বাড়তে সাতশো মন,
না হবে তোর যতক্ষণ
দাঁড়িয়ে থাকবি, দাঁড়িয়ে থাক,
লাল সাদা আর নীল পোশাক।
পরির দিদি, পরির বোন
কতক্ষণ আর কতক্ষণ
ওই খুলেছে, ওই তো, চল,
রোদ পোড়া সব পরির দল
টুম্পি, টিমা, মম, টোকাই
মাথায় মাথায় পিন ঢোকাই।
ফুটকড়াই, ফুটকড়াই,
ঠিক ডাটা ঠিক ফিড করাই।
ব্যস, হয়েছে প্রোগ্রামিং,
তিড়িং বিড়িং তিড়িং বিং
বন্ধ এখন, জোর সে চল,
কোর্সে কোর্সে এগিয়ে চল
ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল
মাথার ওপর যাঁতার কল
ফুটফুটে সব ছাত্রীদল
ছাত্রদল
চল রে চল
এই তো চাই, ফুটকড়াই।
স্পর্শ – জয় গোস্বামী
এতই অসাড় আমি, চুম্বনও বুঝিনি ।
মনে মনে দিয়েছিলে, তাও তো সে না-বোঝার নয়-
ঘরে কত লোক ছিল, তাই ঋণ স্বীকার করিনি ।
ভয়, যদি কোন ক্ষতি হয় ।
কী হয়? কী হতে পারতো? এসবে কী কিছু এসে যায়?
চোখে চোখ পড়ামাত্র ছোঁয়া লাগলো চোখের পাতায়-
সেই তো যথেষ্ট স্বর্গ- সেই স্পর্শ ভাবি আজ; সেই যে অবাক করা গলা
অন্ধকারে তাও ফিরে আসে…
স্বর্গ থেকে আরো স্বর্গে উড়ে যাও আর্ত রিনিঝিনি
প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ’রে ধ’রে
ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি
একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?
আমরা পথিক – জয় গোস্বামী
গাছেদের নাম গাছ
ধুলোদের নাম ধুলো
নদীদের নাম বলতে পারবে গ্রামবাসীরা
কিন্তু ঘরের নাম ঘর দাওয়ার নাম দাওয়া
দাওয়ার ধারে মেয়েটির নাম কী?
তা জানতে হলে তোমাকে নৌকো বাইতে হবে
গুন টানতে হবে
কাঠ কাটতে যেতে হবে বনে
ডাকাতের হাতে পড়তে হবে
বেড়া ডিঙিয়ে পৌঁছতে হবে দাওয়ায়
দাওয়া ডিঙিয়ে ঘরে
ঘরের মধ্যে সে যখন আঁকড়ে নেবে তোমায়
তার ঘূর্ণির মধ্যে তলিয়ে যাওয়া সেই সময়টায়
গাছের উপর আছড়ে পড়বে গাছ
ধূলোর ভেতর থেকে পাকিয়ে উঠবে ধুলিস্তম্ভ
গ্রামের উপর আছড়ে পরবে নদী
তোমার মনে থাকবে না তোমার নাম ছিল পথিক…
১০ নভেম্বর – জয় গোস্বামী
যে-লেখা পড়ে তোমাদের শুকনো চোখে জল আসবে
সেই লেখা আমার হাত থেকে বেরিয়ে
উড়ে ওই ডালে গিয়ে বসল।
এখন থেকে তাকে পড়তে শুরু করবে পাখিরা।
শুনে-শুনে মুখস্থ হয়ে যাবে গাছেদেরও।
কিন্তু গাছেরা তো কথা বলতে পারে না! কী হবে?
কী আবার হবে!
আমি আর বকুন, দিনে রাতে, কত গাছের গুঁড়িতে
কান রেখে শুনেছি
গাছ, মনে-মনে কবিতা বলছে…
অভিসার – জয় গোস্বামী
প্রেম হবে বলে আজ এখানে এসেছি গাছে নতুন দোয়েল পাখি ডাকে
পুরনো দোয়েল শ্যামা নয়নে নয়ন রেখে কটুবাক্য বলে দিতে চায়
জলে দিতে চায় ওরা আমাকে হৃদয় আমি একলা শ্যামল মেয়ে হায়
পথ ভুলে এ-কোথায় এসে পড়লাম আজ শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়
ওলো ও তরুণগাছ সঙ্গ দেবে বলে শুধু পাতাভরা ডালখানি এনে
মাথায় বুলিয়ে কেন দিলে কেন দিলে আমি কোনো জন্ম দেখলাম না এমন পুষ্কর
গা ধুতে পারলাম না আমি জল ভরতেও নয় একী গো তোমার বিবেচনা
কী ঘরে ঘরের কাজ করি আমি কী প্রকারে মন রাখি পাঠে আজ
আমার যে গা ভরতি সোনা
খুলে খুলে পড়ে গেল বনমাঝে দস্যুদল আছোলা চালিয়ে দিলো বাঁশ–
পুলিশে উদ্ধার করল অজ্ঞান উপায়ে বলো হে প্রিয় পুলিশ
আমি তো সমস্ত ছেড়ে চলেই এসেছি আমি পা পিছলে পড়েছি
তোমার প্রণয়ে জল হাড়গোড় ভেঙেছি ওরে যত আছ হাড়গোড়
ভাঙা সব এসো পাছে পাছে
আসন গ্রহণ করো, প্রেম হবে প্রেম হবে, হরিনাম খাবলা খাবলা
হবে বলে নদীয়াসমাজে
ডাকো রে সকলে মিলি, খোঁড়া অন্ধ কানা ডাকো, যে আছ ক্ষুধার্ত পাখি
সব শালা ডাকো গাছে গাছে…
পাখিটি আমাকে ডেকে – জয় গোস্বামী
পাখিটি আমাকে ডেকে বলল তার ডানার জখম
বলল যে কীভাবে তার পালকে সংসার পোড়া ছ্যাঁকা
কীভাবে পায়ের মধ্যে ফুটো করে ঢুকে এল চেন
ঠোঁট দিয়ে খাঁচার শিক কাটতে গিয়ে ঠোঁটের জখম
দ্যাখালো, বাইরে থেকে আমি নিজ ওষ্ঠ থেকে ওম
দিলাম, খাঁচার দরজা খুলে তাকে “বাঁচবিযদি আয়’,
বলে বার করে এনে রাখলাম আর একটা খাঁচায়
সেখানে দুজনে বন্দি পরস্পর দোষারোপ করি,
দোষারোপ করতে করতে বৃষ্টি আসে, সন্ধে হয়ে যায় …
টিউটোরিয়াল – জয় গোস্বামী
”তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম
তার বদলে মাত্র পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?
এই জন্য আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?
এই জন্যে তোমার মা কাক ভোরে উঠে সব কাজকর্ম সেরে
ছোটবেলা থেকে যেতো তোমাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিতে?
এই জন্য কাঠফাটা রোদ্দুরে কি প্যাচপ্যাচে বর্ষায়
সারাদিন বসে থাকতো বাড়ির রোয়াকে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে?
তারপর ছুটি হতে, ভিড় বাঁচাতে মিনিবাস ছেড়ে
অটো-অলাদের ঐ খারাপ মেজাজ সহ্য করে
বাড়ি এসে, না হাঁপিয়ে, আবার তোমার পড়া নিয়ে
বসে পড়তো, যতক্ষণ না আমি বাড়ি ফিরে
তোমার হোমটাস্ক দেখছি, তারপরে আঁচলে মুখ মুছে
ঢুলতো গিয়ে ভ্যাপসা রান্নাঘরে?
এই জন্যে? এই জন্যে হাড়ভাঙা ওভারটাইম করে
তোমার জন্য আন্টি রাখতাম?
মোটা মাইনে, ভদ্রতার চা-জলখাবার
হপ্তায় তিনদিন, তাতে কত খরচা হয় রে রাস্কেল?
বুদ্ধি আছে সে হিসেব করবার?
শুধু ছোটকালে নয়, এখনো যে টিউটোরিয়ালে
পাঠিয়েছি, জানিস না, কিরকম খরচাপাতি তার?
ওখানে একবার ঢুকলে সবাই প্রথম হয়। প্রথম, প্রথম!
কারো অধিকার নেই দ্বিতীয় হওয়ার।
রোজ যে যাস, দেখিস না কত সব বড় বড়
বাড়ি ও পাড়ায়
কত সব গাড়ি আসে, কত বড় গাড়ি করে
বাবা মা-রা ছেলেমেয়েদের নিতে যায়?
আর ঐ গাড়ির পাশে, পাশে না পিছনে-
ঐ অন্ধকারটায়
রোজ দাঁড়াতে দেখিস না নিজের বাবাকে?
হাতে অফিসের ব্যাগ, গোপন টিফিন বাক্স, ঘেমো জামা, ভাঙা মুখ –
দেখতে পাসনা? মন কোথায় থাকে?
ঐ মেয়েগুলোর দিকে? যারা তোর সঙ্গে পড়তে আসে?
ওরা তোকে পাত্তা দেবে? ভুলেও ভাবিস না!
ওরা কত বড়লোক!
তোকে পাত্তা পেতে হলে থাকতে হবে বিদেশে, ফরেনে
এন আর আই হতে হবে! এন আর আই, এন আর আই!
তবেই ম্যাজিক দেখবি
কবিসাহিত্যিক থেকে মন্ত্রী অব্দি একডাকে চেনে
আমাদেরও নিয়ে যাবি, তোর মাকে, আমাকে
মাঝে মাঝে রাখবি নিজের কাছে এনে
তার জন্য প্রথম হওয়া দরকার প্রথমে
তাহলেই ছবি ছাপবে খবর কাগজ
আরো দরজা খুলে যাবে, আরো পাঁচ আরো পাঁচ
আরো আরো পাঁচ
পাঁচ পাঁচ করেই বাড়বে, অন্য দিকে মন দিস না,
বাঁচবি তো বাঁচার মত বাঁচ!
না বাপী না, না না বাপী, আমি মন দিই না কোনোদিকে
না বাপী না, না না আমি তাকাই না মেয়েদের দিকে
ওরা তো পাশেই বসে, কেমন সুগন্ধ আসে, কথা বলে, না না বাপী পড়ার কথাই
দেখি না, উত্তর দিই, নোট দিই নোট নিই
যেতে আসতে পথে ঘাটে
কত ছেলে মেয়ে গল্প করে
না বাপী না, আমি মেয়েদের সঙ্গে মিশতে যাই না কখোনো
যেতে আসতে দেখতে পাই কাদা মেখে কত ছেলে বল খেলছে মাঠে
কত সব দুষ্টু ছেলে পার্কে প্রজাপতি ধরছে
চাকা বা ডাঙ্গুলি খেলছে কত ছোটোলোক
না, আমি খেলতে যাই না কখোনো
খেলতে যাইনি। না আমার বন্ধু নেই
না বাপী না, একজন আছে, অপু, একক্লাসে পড়ে
ও বলে যে ওর বাবাও বলেছে প্রথম হতে
বলেছে, কাগজে ছবি, ওর বাবা, ওকে ….
হ্যাঁ বাপী হ্যা, না না বাপী, অপু বলেছে পড়াশোনা হয়নি একদম
বলেছে ও ব্যাক পাবে, ব্যাক পেলে ও বলেছে, বাড়িতে কোথায়
বাথরুম সাফ করার অ্যাসিড আছে ও জানে,
হ্যাঁ বাপী হ্যা, ও বলেছে,
উঠে যাবে কাগজের প্রথম পাতায় …..”
আমরা তো অল্পে খুশি – জয় গোস্বামী
আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।
চলে যায় দিন আমাদের
অসুখে ধারদেনাতে
রাত্তিরে দুভায়ে মিলে
টান দিই গঞ্জিকাতে।
সবদিন হয়না বাজার,
হলে হয় মাত্রাছাড়া –
বাড়িতে ফেরার পথে
কিনে আনি গোলাপচারা।
কিন্তু পুঁতব কোথায়?
ফুল কি হবেই তাতে?
সে অনেক পরের কথা
টান দিই গঞ্জিকাতে।
আমরা তো অল্পে খুশি,
কী হবে দুঃখ করে?
আমাদের দিন চলে যায়
সাধারণ ভাতকাপড়ে।
মাঝে মাঝে চলেও না দিন
বাড়ি ফিরি দুপুররাতে ;
খেতে বসে রাগ চড়ে যায়
নুন নেই ঠান্ডা ভাতে।
রা.গ চড়ে মাথায় আমার
আমি তার মাথায় চড়ি,
বাপব্যাটা দুভায়ে মিলে
সারা পাড়া মাথায় করি।
করি তো কার তাতে কী?
আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।
বিবাহিতাকে – জয় গোস্বামী
কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, তুমি আমার সামনে দাড়ালেই আমি
তোমার ভিতরে একটা বুনো ঝোপ দেখতে পাই।
ওই ঝোপে একটা মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া আছে।
অনেকদিন ধ’রে আছে। কিন্তু আশ্চর্য যে
এই মৃতদেহ জল, বাতাস, রৌদ্র ও সকলপ্রকার
কীট-বীজাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। এর পচন নেই।
বন্য প্রাণীরাও এর কাছে ঘেঁষে না।
রাতে আলো বেরোয় এর গা থেকে।
আমি জানি, মৃতদেহটা আমার।
কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, এই জারিজুরি এবার ফাঁস হওয়া প্রয়োজন।
আর তা হবেও, যেদিন চার পায়ে গুঁড়ি মেরে গিয়ে
পা কামড়ে ধ’রে, ওটাকে, ঝোপ থেকে
টেনে বার করব আমি।
বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে – জয় গোস্বামী
১
বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে,
রক্ত
গড়িয়ে পড়ছে…
কেউ ছুটে গেল খালের ওদিকে
বুক ফাটা গলায় কার মা ডাকল : “রবি রে…”
উত্তরের পরিবর্তে, অনেকের স্বর মিলে একটি প্রকাণ্ড হাহাকার
ঘুরে উঠল…
কে রবি? কে পুষ্পেন্দু? ভরত?
কাকে খুঁজে পাওয়া গেছে? কাকে আর পাওয়া যায় নি?
কাকে শেশ দেখা গেছে
ঠেলাঠেলি জনতাগভীরে?
রবি তো পাচার হচ্ছে লাশ হয়ে আরও সর লাশেদের ভিড়ে…
২
…বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে
রক্ত
গড়িয়ে পড়েছে
রক্ত
গড়িয়ে পড়েছে…
পিছনে কুকুর ছুটছে
ধর্, ধর্…
পিছনে শেয়াল
তার পিছু পিছু আসছে ভাণ্ড হাতে
রাজ অনুচর
এই রক্ত ধরে রাখতে হবে
এই রক্ত মাখা হবে সিমেন্টে বালিতে
গড়ে উঠবে সারি সারি
কারখানা ঘর
তারপর
চারবেলা ভোঁ লাগিয়ে সাইরেন বাজবে
এ কাজ না যদি পার, রাজা
তাহলে
বণিক এসে তোমার গা থেকে
শেষ লজ্জাবস্ত্রটুকু খুলে নিয়ে যাবে
৩
আমার গুরুত্ব ছিল মেঘে
প্রাণচিহ্নময় জনপদে
আমার গুরুত্ব ছিল…
গা ভরা নতুন শস্য নিয়ে
রাস্তার দুপশ থেকে চেয়ে থাকা আদিগন্ত ক্ষেতে আর
মাঠে
আমার গুরুত্ব ছিল…
আজ
আমার গুরুত্ব শুধু রক্তস্নানরত
হাড়িকাঠে!
৪
অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে
সূর্য উঠে আসে
বন্ধ থাকা ইশ্কুলের গায়ে ও মাথায়
রোদ পড়ে
রোদ পড়ে মাটি খুড়ে চলা
কোদালে, বেলচায়
রোদ পড়ে নিখোঁজ বাচ্চার
রক্তমাখা স্কুলের পোশাকে…
৫
…না, না, না, না, না—
না বলে চিত্কার করছে গাছ
না বলে চিত্কার করছে এই গ্রীষ্ম দুপুরের হাওয়া
না বলে চিত্কার করছে পিঠে লাশ বয়ে নিয়ে চলা
ভ্যান গাড়ি
আর আমরা শহরের কয়েকজন গম্ভীর মানুষ
ভেবে দেখছি না বলার ভাষারীতি ঠিক ছিল কিনা তাই নিয়ে
আমরা কি বিচারে বসতে পারি?
৬
তুমি কি খেজুরি? তুমি ভাঙাবেড়া?
সোনাচূড়া তুমি?
বার বার প্রশ্ন করি । শেষে মুখে রক্ত উঠে আসে ।
আমার প্রেমের মতো ছাড়খার হয়ে আছে আজ গোটা দেশ
ঘোর লালবর্ণ অবিশ্বাসে ।
৭
আমরা পালিয়ে আছি
আমরা লুকিয়ে আছি দল বেঁধে এই
ইটভাটায়
মাথায় কাপড় ঢেকে সন্ধ্যেয় বেরোই
মন্টুর আড়তে—
মল্লিকের
বাইকের পিছন-সিটে বসে
আমরা এক জেলা থেকে অপর জেলায়
চলে যাই,
যখন যেখানে যাই কাজ তো একটাই ।
লোক মারতে হবে ।
আপাতত ইটভাঁটায়
লুকিয়ে রয়েছি…
অস্ত্র নিয়ে…
কখন অর্ডার আসে, দেখি ।
৮
পিছু ফিরে দেখেছি পতাকা ।
সেখানে রক্তের চিহ্ন, লাল ।
ক’বছর আগে যারা তোমাকে সাহায্য করবে বলে
ক’বছর আগে যারা তোমার সাহায্য পাবে বলে
রক্তিম পতাকটিকে নিজের পতাকা ভেবে কাঁধে নিয়েছিল
তাঁদের সবাইকে মুচড়ে দলে পিষে ভেঙে
দখল করেছ মুক্তাঞ্চল
পতাকাটি সেই রক্তবক্ষ পেতে ধারণ করলেন ।
তোমার কি মনে পড়ছে রাজা
শেষ রাত্রে ট্যাঙ্কের আওয়াজ?
মনে পড়ছে আঠারো বছর আগে তিয়েন-আন-মেন?
৯
ভাসছে উপুর হয়ে । মুণ্ডু নেই । গেঞ্জি পড়া কালো প্যান্ট ।
কোন বাড়ির ছেলে?
নব জানে । যারা ওকে কাল বিকেলে বাজারে ধরেছে
তার মধ্যে নবই তো মাথা ।
একদিন নব-র মাথাও
গড়াবে খালের জলে,
ডাঙায় কাদার মধ্যে উলটে পড়ে থাকবে স্কন্ধকাটা
এ এক পুরনো চক্র ।
এই চক্র চালাচ্ছেন যে-সেনাপতিরা
তাঁদের কি হবে?
উজ্জ্বল আসনে বসে মালা ও মুকুট পরবে
সেসব গর্দান আর মাথা
এও তো পুরনো চক্র । কিন্তু তুমি ফিরে দেখ আজ
সে চক্র ভাঙার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে গ্রাম—
ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে কলকাতা ।
১০
অপূর্ব বিকেল নামছে ।
রোদ্দুর নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা মাঠে ।
রোদ্দুর, আমগাছের ফাঁক দিয়ে নেমেছে দাওয়ায় ।
শোকাহত বাড়িটিতে
শুধু এক কাক এসে বসে ।
ডাকতে সাহস হয় না তারও ।
অনেক কান্নার পর পুত্রহারা মা বুঝি এক্ষুনি
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন ।
যদি ঘুম ভেভে যায় তাঁর!