জয় গোস্বামীর ৫টি কবিতা

 

জয় গোস্বামী
জয় গোস্বামী (নভেম্বর ১০, ১৯৫৪) বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত একজন আধুনিক বাঙ্গালী কবি।ভারতীয় পশ্চিম বাংলার এই কবি বাংলা ভাষার উত্তর-জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসাবে পরিগণিত। তাঁর কবিতা চমৎকার চিত্রকল্পে, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ। তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন। বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর কবিতার একটি বিখ্যাত পংক্তি ‘‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে / হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে'’’। জয় গোস্বামীর প্রথাগত লেখা পড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে একাদশ শ্রেণীতে থাকার সময়। সত্তরের দশকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। সাময়িকী ও সাহিত্য পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। এভাবে অনেক দিন কাটার পর দেশ পত্রিকায়য তাঁর কবিতা ছাপা হয়। এর পরপরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন পরে তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি পাগলী তোমার সঙ্গে কাব্য সংকলনের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।

ঝাউ গাছের পাতা – জয় গোস্বামী

মিত্রা দিদি, তোমাকে নিয়ে কাব্য

লেখেনি কোন পুরুষ কোন দিন।
গলির মোড়ে বাজেনি সম্মিলিত
শীৎকার, বখাটে ছেলেদের।
তোমাকে দেখতে আসেনি পাত্রপক্ষ,
এসেছিল শুধু মেপে নিতে,
তোমার বুক, চুল, নিতম্ব
যাবতীয় সব শারিরিক।
কত বার গেছ তুমি কামরূপ-কামাক্ষা ?
কত বার ছুঁয়েছ তুমি কাম পীঠে সিঁদুর ?
কত বার পাল্টেছ জ্যোতিষি তুমি ?
কত বার করিয়েছ জাদুটোনা ?
কত যুগ উপবাসী তুমি ঢেলেছ দুগ্ধ,
সুগঠিত শিবলিঙ্গে ?
সে খবর জানে শুধু,
একলা রাতের পাশ বালিশ।


কলঙ্ক, আমি কাজলের – জয় গোস্বামী


কলঙ্ক, আমি কাজলের ঘরে থাকি
কাজল আমাকে বলে সমস্ত কথা
কলঙ্ক, আমি চোট লেগে যাওয়া পাখি—
বুঝি না অবৈধতা।
কলঙ্ক, আমি বন্ধুর বিশ্বাসে
রাখি একমুঠো ছাই, নিরুপায় ছাই
আমি অন্যের নিঃশ্বাস চুরি ক’রে
সে-নিঃশ্বাসে কি নিজেকে বাঁচাতে চাই?
কলঙ্ক, আমি রামধনু জুড়ে জুড়ে
দিন কাটাতাম, তাই রাত কাটতো না
আজ দিন রাত একাকার মিশে গিয়ে
চিরজ্বলন্ত সোনা
কলঙ্ক, তুমি প্রদীপ দেখেছো? আর প্রদীপের বাটি?
জানো টলটল করে সে আমার বন্ধুর দুই চোখে?
আমি ও কাজল সন্তান তার, বন্ধুরা জল মাটি
ফিরেও দেখি না পথে পড়ে থাকা
বৈধ-অবৈধকে—
যে যার মতন রোদবৃষ্টিতে হাঁটি…




একটি বৃষ্টির সন্ধ্যা – জয় গোস্বামী

চোখ, চলে গিয়েছিল, অন্যের প্রেমিকা, তার পায়ে।
যখন, অসাবধানে, সামান্যই উঠে গেছে শাড়ি—
বাইরে নেমেছে বৃষ্টি। লন্ঠন নামানো আছে টেবিলের নীচে, অন্ধকারে
মাঝে মাঝে ভেসে উঠেছে লুকোনো পায়ের ফর্সা আভা…

অন্যায় চোখের নয়। না তাকিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না।
সত্যিই ছিল না? কেন?—হুহু করে বৃষ্টিছাট ঢুকে আসে ঘরে
সত্যিই ছিল না? কেন?—কাঁটাতারে ঝাঁপায় ফুলগাছ
সত্যিই ছিল না? কেন?—অনধিকারীর সামনে থেকে

সমস্ত লুকিয়ে নেয় নকশা-কাটা লেসের ঝালর…
এখন থেমেছে বৃষ্টি। এখন এ-ঘর থেকে উঠে গেছে সেও।
শুধু, ফিরে আসছে হাওয়া। শুধু, এক অক্ষমের চোখের মতন
মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে টেবিলের তলার লন্ঠন।



অজাতক – জয় গোস্বামী

—- ‘ভিতরে না…ভিতরে না… দেখো সাবধানে…’
—- ‘হ্যাঁ জানি। খেয়াল আছে। দেব না। দিচ্ছি না। ভয় নেই’
দাম্ভিক মেয়েটি ঠিক ওই সময় কত অসহায়
আমাকে বিশ্বাস করেছিল।

নিজের আনন্দ রাখতে মারের সাবধান রইল না।
—- ‘যদি কিছু হয়ে যায়’
—- ‘ও কিছু হবে না।’ —- ‘ঠিক তো?’—- ‘না কিছু হবে না।’
শিকড় উপড়ে তুলতে দেরি হয়েছিল।

ভাঙা গর্ভ থেকে টেনে বার করা অসমাপ্ত ফল
নার্সিংহোমের নীচে নর্দমার পাশে
ব্যান্ডেজ প্লাস্টারভাঙা তুলো রক্ত পলিথিনে
মিশে রইল জঞ্জালের মতো…

আমার সাহস থাকলে ওর আজকে দশ বছর হত!


ঢেউগুচ্ছ – জয় গোস্বামী

আমাদের নীল মৃত্যুকাল
আমাদের সাদা সন্তরণ
আমাদের ঢেউগুচ্ছ

আমাদের এই নিচু জীবন
জলে ফেলে দেওয়া শান্ত ঢিল
ক্ষমাশীল ঢেউগুচ্ছ

গায়ে গায়ে ঘষা কালো জীবন
হাতে মুখে হাতে মেখে নেওয়া
ঈর্ষার কাঁচা রক্ত

আমাদের এই আলোজীবন
কারো কাছে কিছু নেবে না আর
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শান্তি

আমাদের এই ভাঙা জীবন
পড়োশীর ঘর আলো করা
কচিকাঁচাদের দঙ্গল

আমাদের এই নীল মৃত্যুযান
আমাদের সাদা সন্তরণ
টেনে নেয় ঢেউগুচ্ছ

আমাদের এই চিরজীবন
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনা
বন্ধুর মতো বন্ধু



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন