নারীমেধ – অমিতাভ দাশগুপ্ত
এক
‘মেয়েমানুষের মাংস এমনিতেই খেতে খুব স্বাদু,
আর যদি দিশি মদে ভিজিয়ে ভিজিয়ে
হায় হায় ভাবাই যায় না…..
তাছাড়া এখন খুব পড়েছে মরশুম,
ছয় মাসে ছ-ডজন নারীকে কিডন্যাপ করে চাকুমচুকুম
ঢাউস ঢেঁকুর তুলে
‘ক্যায়সা খুশি কি রাত’…..গেয়ে নেচে চলে গেল ঘোর দেশপ্রেম,
দ্যাখো, কি এলেম !!’
দুই
‘তুই কি আমার বোন ?
তুমি আমার মা ?
মুখে নখের আঁচড় কেন—-উদলা কেন গা ?
গিয়েছিলাম বনে,
বনে ছিল কালকেউটে কামড়াল নির্জনে।
পুতের মত ভায়ের মত পাঁচটি সোনার ছা
আশ মিটিয়ে মাস খেয়েছে উদলা করে গা ।’
তিন
—- মা কোথায় যাস ?
—- পার্কে।
— সাথে যাবে তোর আর কে ?
— শ্যামের বিধবা বোন।
দরজা ভেজিয়ে পথে নামে মেয়ে,
ডুকরে ওঠে মা — শোন……..
শিস দিয়ে দিয়ে ছিনাল বাতাস বহে যায় শন শন।।’
চার
‘গাঁ থেকে এসেছে চাষার ঝিয়ারি
ফুটপাতে পাল পাল,
জানে না কোথায় কার পাশে শুলে
হাত ভরে মেলে চাল।’
পাঁচ
‘মেয়েকে বসিয়ে ফাঁকা মাঠে
বাপ দূরে দাঁতে ঘাস কাটে।
দরের ব্যাপারে টনটনে
কোলাকুলি সেয়ানে সেয়ানে।
দিন রাত বছরে বছরে
তবে না উনুনে হাড়ি চড়ে !’
ছয়
‘তখন ধূ- ধূ রাত।
ছিটে বেড়ার ঘরের পাশে
সাপের শিসের শব্দ।
বোনের ঘরে গিয়েছিলাম।
বোনের ঘর ফাঁকা।
দিদির ঘরে গিয়েছিলাম।
দিদির ঘর ফাঁকা।
বাপের ঘরে ঢুকেই দেখি,
প্যারালিটিক দুহাতে তাঁর
আঁজলা -ভরা টাকা !’
সাত
.
‘তুমি তো নও যাজ্ঞসেনী,
বাঁধবে, বেণী বাঁধবে।
অশ্রু মুছে বাপের ভায়ের
পোয়ের অন্ন রাঁধবে।
কে খায়, তোমায় কে খায়,
রাক্ষসদের মরণ আছে
যজ্ঞিডালের মাথায়।
রাবণবধের তলোয়ারের
দু-কষ বেয়ে মর্চে
অনেক প্রায়শ্চিত্তের পর
ঝরছে—-একটু ঝরছে !’
আহা চাল – অমিতাভ দাশগুপ্ত
কাঁড়া না আকাড়া?
এ-প্রশ্ন বিলাসিতা—
খরার উপোশে ভিক্ষার চাল তুমি।
ওই চাল থেকে ছুটেছে রমনী, ভিক্ষু ও ভিক্ষুক
খুনখারাবির মরীয়া লাল দু চোখে,
বাঁধের কোমরবন্ধ ফাটানো গতির তুমুল বন্যায়
আহা চাল,আহা একমুঠো শাদা চাল
কোথায় লুকোবে বলো,
অন্ধ কয়েদি
সে-ও তো তোমার জন্মের মাটি চেনে।
সারারাত ধরে নিখাক শিশুকে ভুলিয়ে
যে-নারী হাড়িতে সেদ্ধ করেছে ভাতের বদলে নুড়ি,
সে তোমাকে চেনে নিজের তালুর মতন।
না খেতে পাওয়ার চিল-চিতকার সইতে না পেরে
যে মরদ কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে দুধের বাচ্চা
সে তোমাকে চেনে তাঁর রক্তের মতন।
আহা চাল,
তুমি কত মানুষের দীর্ঘশ্বাসে শাপে,
এত তিতকুটে, কালো।
তোমাকে জ্বালিয়ে ভাত করে খাবে বলে
ভাঁটার মতন গনগনে রাগে
যেদিকে তাকাও ছুটেছে লুঠেরা করতল,
কোথায় লুকোবে তুমি?
অন্ধ কয়েদি – সে-ও যে তোমার জন্মের মাটি চেনে।
গঙ্গা আমার মা – অমিতাভ দাশগুপ্ত
কবি আজকাল ভোরবেলা ওঠে
বাগবাজারের গঙ্গার ঘাঁটে যায়
পাশে বাঁ হাতের মতো স্ত্রী
কবির সারা শরীরে সার সার পিনিশ সালতি নৌকো
লঞ্চের ছুঁচলো সিটি
সমুদ্রগামী জাহাজের সুগ্মভীর ডাক
অথচ
পিত্তপ্রধান পায়ের পাতা সিঁড়ির প্রথম ধাপে পেতে
সে চুপচাপ বসে থাকে
আর
সমস্ত গঙ্গা যখন একটি আভূমিপ্রণতা নারী হয়ে
তাঁর রোগা পা ছুঁয়ে প্রণাম করে—
রাগী বাবার মতো সে গোড়ালি সরিয়ে নেয়।
সে জানে
তাঁর রাতজাগা পিঠে বর্শা হয়ে বিঁধে আছে
নিখাকি কলকাতার নিঃশ্বাস
কাজল, মদ আর রুপোর গঁদের ভেতর
আকন্ঠ ডুকে আছে মড়াপোড়ানো কলের চিমনি
জোব চার্নকের থ্যাঁৎলানো অহঙ্কার।
ওপারে বেলুড় মঠ দেখা যায়
কবির পাশে সারদামণির মতো বসে থাকে কবির স্ত্রী
কবির চোখের সামনে প্রতিদিন গলায় কলসি বেঁধে
গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বারুইপুর হরিনাভি ভাটপাড়া
জলে মিশে একাকার
জোড়াসাঁকো হাড়কাটা
বাজে বলিবাদ্য বানফোঁড়ার বাজনা জয়জোকার
ডবকা দক্ষিণ থেকে হাজামজা উত্তরে
উড়ে আসে কালো নোটের বান্ডিল
কাগজের নৌকো
স্ফুরিত পরিসংখ্যান
অল-ক্লিয়ারের বিপ বিপ
আর কাশী মিত্তির নিমতলা রতনবাবুর ঘাটে ঘাটে
শেষবারের মতো
হাওয়ায় হাওয়ায় ডুক্রে ওঠে ভূপেন হাজারিকা—
গঙ্গা আমার মা…
গঙ্গা আমার মা… ।
আমার নাম ভারতবর্ষ – কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত
স্টেন গানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের উপরে ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার প্রতিটি রক্তের ফোঁটা দিয়ে
চা-বাগিচায় কফি খেতে,
কয়লা-খাদানে, পাহাড়ে-অরণ্যে
লেখা হয়েছে যে ভালোবাসা—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার অশ্রুর জলসেচে আর হাড়ের ফসফেট-এ
খুনীর চেয়েও রুক্ষ কঠোর মাটিতে
বোনা হয়েছে যে-অন্তহীন ধান ও গানের স্বপ্ন—
তার নাম ভারতবর্ষ।
আমার ঠাণ্ডা মুখের ওপর
এখন গাঢ় হয়ে জমে আছে
ভাক্ রা নাঙ্গালের পাথুরে বাঁধের গম্ভীর ছায়া।
ডিগবয়ের বুক থেকে
মায়ের দুধের মত উঠে আসা তোলো ভেসে যাচ্ছে
আমার সারা শরীর।
কপাল থেকে দাঙ্গার রক্ত মুছে ফেলে
আমাকে বুকে ক’রে তুলে নিতে এসেছে
আমেদাবাদের সুতোকলের জঙ্গী মজুর।
আমার মৃতদেহের পাহারাদার আজ
প্রতিটি হাল বহনকারী বলরাম।
প্রতিটি ধর্ষিতা আদিবাসী যুবতীর
শোক নয় ক্রোধের আগুনে
দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে আমার শেষ শয্যা।
ভরাট গর্ভের মত
আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।
বৃষ্টি আসবে।
ঘাতকের স্টেনগান আর আমার মাঝবরাবর
ঝরে যাবে বরফ-গলা গঙ্গোত্রী।
আর একটু পরেই প্রতিটি মরা খাল-বিল-পুকুর
কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার মায়ের চোখের মত।
প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুদ চুম্বনে।
ওড়িশির ছন্দে ভারতনাট্যমের মুদ্রায়
সাঁওতালী মাদলে আর ভাঙরার আলোড়নে
জেগে উঠবে তুমুল উৎসবের রাত।
সেই রাতে
সেই তারায় ফেটে পরা মেহফিলের রাতে
তোমরা ভুলে যেও না আমাকে
যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আনা কল্ জে,
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম
মাইল-মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম
. স্বদেশ
. স্বাধীনতা
. ভারতবর্ষ॥
খো খো – অমিতাভ দাশগুপ্ত
মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়.,
বিকেলে খেলে খো খো,
বনগাঁ থেকে বার্লিনে যায়,
সাধ্যি থাকে রোখো।
মেয়ের বাবা সকাল-সন্ধে
চৌমাথাতে হকার,
ছোট বোনটি ফাইভে পড়ে,
এখনও দাদা বেকার।
তবুও খো খো খেলুড়ে মেয়ে
লড়ছে এমন লড়াই
তাকে নিয়েই দেশসুদ্ধ
আমজনতার বড়াই।
হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম
সিয়ারামের খেলা
খেলতে খেলতে সাঁঝের কোলে
গড়িয়ে আসে বেলা,
ভাতের গন্ধে লাফিয়ে ওঠে
খিদের নাড়িভুঁড়ি
বালিকা তবু উজানভরা
স্বপ্ন করে চুরি,
মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়,
বিকেলে খেলে খো-খো
খেলার পাতায় সেই মেয়েটির
স্বপ্ন ছেপে রেখো।
কবি সম্বন্ধে