শঙ্খ ঘোষের সেরা কবিতা সংগ্রহ

 

পালক – শঙ্খ ঘোষ

সবকিছু মুছে নেওয়া এই রাত্রি তোমার সমান।

সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি পড়ে। কখনো-কখনো

কাছে দূরে জ্বলে ওঠে ফসফরাস। কিছুরই কোথাও

ক্ষান্তি নেই। প্রবাহ চলেছে শুধু তোমারই মতন

একা একা, তোমারই মতন এত বিকারবিহীন।

যখনই তোমার কথা ভাবি তবু, সমস্ত আঘাত

পালকের মতো এসে বুকের ওপরে হাত রাখে

যদিও জানি যে তুমি কোনোদিনই চাওনি আমাকে।




ভবিতব্য – শঙ্খ ঘোষ

আগুন লেগেছে শূন্যে, আমোদে মেতেছে তটভূমি ।

হাড়পোড়া শব্দগন্ধ জড়িয়েছে গভীর আশ্লেষে

ঘুমন্ত মনেরও বোধ । মনে হয় একদিন তুমি

জলাধার হয়ে তবু দাঁড়াবে আমারই সামনে এসে ।

কতজনে জানতে চায় বেঁচে আছি আজও কি তেমনই —

অথবা কীভাবে আজও তোমাকেই ভেবেছি প্রবাহ !

তোমার সঞ্চয় তবে মিথ্যে থেকে মিথ্যে হয়ে এল ?

আমারও প্রতীক্ষা তবে শেষ থেকে হয়ে এল শেষ ?


আগুন ছড়ায় আরও, কোথাও কিছুই নেই বাকি

পুড়ে যায় চক্ষুতারা, পুড়ে যায় দূরে বনস্থলী —

তবুও কীভাবে আজও তোমাকেই ভবিতব্য ভাবি !

যে-কথা কারোরই কাছে বলা যায় না — কীভাবে তা বলি !




ত্রিতাল – শঙ্খ ঘোষ

তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু

শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া

তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু

বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া

পাতালমুখ হঠাত্ খুলে গেলে

দুধারে হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া

তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই

শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।

শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে

তোমারই ঐ টুকরো-করা-শরীর

দু:সময়ে তখন তুমি জানো

হলকা নয়, জীবন বোনে জরি।

তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন

প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা-

মদ খেয়ে তো মাতাল হত সবাই

কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল !




মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে – শঙ্খ ঘোষ

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

… তোমার জন্যে গলির কোণে

ভাবি আমার মুখ দেখাব

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।


একটা দুটো সহজ কথা

….বলব ভাবি চোখের আড়ে

জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে

বিজ্ঞাপনে,রংবাহারে।


কে কাকে ঠিক কেমন দেখে

…. বুঝতে পারা শক্ত খুবই

হা রে আমার বাড়িয়ে বলা

হা রে আমার জন্ম ভূমি।


বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া

…. তোমার সাথে ওতপ্রত

নিয়ন আলোয় পণ্য হলো

যা কিছু আজ ব্যাক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে

…. রইলো পড়ে গলির কোণে

ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু

ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।





চুপ করো, শব্দহীন হও – শঙ্খ ঘোষ

এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো

শব্দহীন হও

শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর


লেখো আয়ু লেখো আয়ু


ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়

তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর

ওঠে জেগে


স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ

আয়ু

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

চুপ করো, শব্দহীন হও




ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু – শঙ্খ ঘোষ

১.

নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়।

ছিলো, নেই- মাত্র এই; ইটের পাঁজায়

আগুন জ্বালায় রাত্রে দারুণ জ্বালায়

আর সব ধ্যান ধান নষ্ট হয়ে যায়।


২.

নষ্ট হয়ে যাবার পথে গিয়েছিলুম, প্রভু আমার!

তুমি আমার

নষ্ট হবার সমস্ত ঋণ

কোটর ভরে রেখেছিলে।


কিন্তু আমার অমোঘ মুঠি ধরে বুকের মোরগঝুঁটি

সন্ধ্যাবেলা শুধু আমার

মুখের রঙে

ঝরে পড়ার ঝরে পড়ার

ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু!


৩.

সকল প্রতাপ হলো প্রায় অবসিত

জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে

কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,

শুধু এই-

কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো

পৃথিবীকে।

মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,

শুধু এই-

ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,

জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,

বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।




সবিনয় নিবেদন – শঙ্খ ঘোষ

আমি তো আমার শপথ রেখেছি

অক্ষরে অক্ষরে

যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন

দিয়েছি নরক করে।

দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল

অন্যে কবে না কথা

বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে

সেটাই স্বাভাবিকতা ।

গুলির জন্য সমস্ত রাত

সমস্ত দিন খোলা

বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই

শান্তি শৃঙ্খলা ।

যে মরে মরুক, অথবা জীবন

কেটে যাক শোক করে—

আমি আজ জয়ী, সবার জীবন

দিয়েছি নরক করে ।




যমুনাবতী – শঙ্খ ঘোষ

নিভন্ত এই চুল্লীতে মা

একটু আগুন দে

আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি

বাঁচার আনন্দে।

নোটন নোটন পায়রাগুলি

খাঁচাতে বন্দী

দু’এক মুঠো ভাত পেলে তা

ওড়াতে মন দি’।


হায় তোকে ভাত দিই কী করে যে ভাত দিই হায়

হায় তোকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়


নিভন্ত এই চুল্লী তবে

একটু আগুন দে –

হাড়ের শিরায় শিখার মাতন

মরার আনন্দে।

দু’পারে দুই রুই কাৎলার

মারণী ফন্দী

বাঁচার আশায় হাত-হাতিয়ার

মৃত্যুতে মন দি’।


বর্গী না টর্গী না, যমকে কে সামলায়!

ধার-চকচকে থাবা দেখছ না হামলায়?

যাস্ নে ও-হামলায়, যাস্ নে।।


কান্না কন্যার মায়ের ধমনীতে আকুল ঢেউ তোলে, জ্বলে না-

মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না-

চলল মেয়ে রণে চলল।

বাজে না ডম্বরু, অস্ত্র ঝন্ ঝন্ করে না, জানল না কেউ তা

চলল মেয়ে রণে চলল।

পেশীর দৃঢ় ব্যথা, মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা সঙ্গে

চলল মেয়ে রণে চলল।


নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল

মৃত্যুরই গান গা-

মায়ের চোখে বাপের চোখে

দু-তিনটে গঙ্গা।

দূর্বাতে তার রক্ত লেগে

সহস্র সঙ্গী

জাগে ধক্ ধক্, যজ্ঞে ঢালে

সহস্র মণ ঘি।


যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে

যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে

বিষের টোপর নিয়ে।

যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে

দিয়েছে পথ, গিয়ে।


নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন