পৃথক পাহাড় – হেলাল হাফিজ
আমি আর কতোটুকু পারি ?
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।
আমি আর কতোটুকু পারি ?
এর বেশি পারেনি মানুষ।
তুই কি আমার দুঃখ হবি – আনিসুল হক
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি।
তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
নিজের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি।
তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?
খতিয়ান – রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ
হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় ঋণে
অথচ আমার শস্যের মাঠ ভরা।
রোদ্দুর খুঁজে পাই না কখনো দিনে,
আলোতে ভাসায় রাতের বসুন্ধরা।
টোকা দিলে ঝরে পচা আঙুলের ঘাম,
ধস্ত তখন মগজের মাস্তুল
নাবিকেরা ভোলে নিজেদের ডাক নাম
চোখ জুড়ে ফোটে রক্তজবার ফুল।
ডেকে ওঠো যদি স্মৃতিভেজা ম্লান স্বরে,
উড়াও নীরবে নিভৃত রুমালখানা
পাখিরা ফিরবে পথ চিনে চিনে ঘরে
আমারি কেবল থাকবে না পথ জানা–
টোকা দিলে ঝরে পড়বে পুরনো ধুলো
চোখের কোণায় জমা একফোঁটা জল।
কার্পাস ফেটে বাতাসে ভাসবে তুলো
থাকবে না শুধু নিবেদিত তরুতল
জাগবে না বনভূমির সিথানে চাঁদ
বালির শরীরে সফেদ ফেনার ছোঁয়া
পড়বে না মনে অমীমাংসিত ফাঁদ
অবিকল রবে রয়েছে যেমন শোয়া
হাত বাড়ালেই মুঠো ভরে যায় প্রেমে
অথচ আমার ব্যাপক বিরহভূমি
ছুটে যেতে চাই– পথ যায় পায়ে থেমে
ঢেকে দাও চোখ আঙুলের নখে তুমি।
বৃষ্টি সোনা তোকে – রুদ্র গোস্বামী
বৃষ্টি বৃষ্টি
জলে জলে জোনাকি
আমি সুখ যার মনে
তার নাম জানো কী ?
মেঘ মেঘ চুল তার
অভ্রের গয়না
নদী পাতা জল চোখ
ফুলসাজ আয়না।
বৃষ্টি বৃষ্টি
কঁচুপাতা কাঁচ নথ
মন ভার জানালায়
রাতদিন দিনরাত।
ঘুম নেই ঘুম নেই
ছাপজল বালিশে
হাঁটুভাঙা নোনা ঝিল
দুচোখের নালিশে।
বৃষ্টি বৃষ্টি
জলেদের চাঁদনি
দে সোনা এনে দে
মন সুখ রোশনি।
অপেক্ষা – শ্রীজাত
ভ্রু পল্লবে ডাক দিয়েছ, বেশ।
আমার কিন্তু পুরনো অভ্যেস
মিনিট দশেক দেরীতে পৌঁছনো
তোমার ঘড়ি একটু জোরেই ছোটে
আস্তে করে কামড় দিচ্ছ ঠোঁটে
ঠোঁটের নীচে থমকে আছে ব্রণ
কুড়ি মিনিট? বড্ড বাড়াবাড়ি!
দৌড়ে ধরছ ফিরতিপথের গাড়ি
ফিরতিপথেই ভুল হল সময়—
আমারও সব বন্ধুরা গোলমেলে
বুঝিয়েদেবে তোমায় কাছে পেলে
কেমন করে গল্প শুরু হয়!
খোলাচুলের সংজ্ঞা দিতে দিতে
সন্ধে নেমে আসবে বস্তিতে
ভাবছ তোমার অপেক্ষা সার্থক?
জানবেও না আমি ততক্ষনে
অন্ধকার চন্দনের বনে
ঘুরে মরছি, কলকাতার লোক…
আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।
যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।
শীতে ভালোবাসা পদ্ধতি – আবুল হাসান
কনক তুমি শীতে এবার কার্ডিগানটা পরো কেমন?
আমাকে তুমি শিখিয়ে দিও লালঝুটো সেই পাখির নামটি?
কনক আমরা এবার শীতে নদীর তীরে হো হো হাসবো
সন্ধেবেলা তোমার চুলে শিশির ভরে রাখবো লক্ষ্মী
তোমার অনামিকায় কামড় দিয়ে আমি হঠাৎ আবার
‘যাহ-কী-দুষ্ট’ ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠ ছোঁবো সকাল বেলায়
সূর্যোদয়ের কাছে কেবল শান্তি চাইবো, বুঝলে কনক
তোমার মাথাধরাও আমি এক চুমোতে সারিয়ে দেবো!
নিঃশেষ চুমুকে চুমুকে - সজল আহমেদ
কেন সমগ্র বিদায় বিরহ আনে
কেন নির্জন নিরালা মনে মনে
একা একা কাঁদতে হয় সবের
বিরহ জল লুকিয়ে লুকিয়ে গোপনে?
কেন হৃদয় ব্যথাতুর হয় প্রিয়
আহ্হারে তোমার বিদায় বেলা হায়
যেন খসে পরে যায় হৃদয়
আকাশ হতে, একটি নক্ষত্র অবেলায়।
তুমি আমাকে কাঁদতে দেখোনা সখি?
উপলব্ধ হয়নি কী কখনো একাকী?
হ্যাঁ এখানেই থেমে যায় সময়
যেখানে সংকীর্ণ আমি মেয়াদোর্ত্তীর্ণ মদ
একই কামড়ায় দুজন-দুজনার খুব কাছাকাছি
আমার মস্তকতলে একটি পৃথিবী ঘোরে
ঘোরো তুমি ঠিক সৌরের আবর্তে
যেন সহজ কোন এক ধাঁধাঁ
বারবার প্যাঁচ খেলে যায় হায়
ও ধাঁধাঁয় জড়িয়ে যাও তুমি
নিঃশেষ চুমুকে চুমুকে প্রিয় মোর
কোন এক নির্জন গোপনো কামড়ায়!