হাসান রোবায়েত এর কবিতা সংগ্রহ

 

মোহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

(হুজাইফা মাহমুদকে)

এখানে কতদিন হিংসায়

গভীর ঢালুপারে নদীটির

জমেছে নীলাক্ষি কুয়াশায়

আমরা শুনি রাত মায়াবীর

আলো ও ছায়াময় নিয়রের

খেলেছে স্বেদবীজ সন্ধ্যায়

চোখের বুলবুলি উড়ে ফের

বসেছে মগডালে, নীলিমায়

ফলের ত্বকধোয়া আলো আর

ধানের দুধভরা রাত্রিতে

দিঘিতে কতদূর জোছনার

বাজছে বিউগল সরণীতে—


তবুও বালিহাঁস ঠোঁটে তার

রোদের সায়োনারা মারে ঝিম

পাথরে বাতাসের মাছরাঙা

নিভৃতে আকাশের নিচে দিন—


ডাকছি তোমাকেই, হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


ফসল চক জুড়ে, বিকালের

আলোয় মুছে গেছে আয়ুরেখা

পাতাই পথ ছিল অন্ধের

ভূয়সী ইতিহাস, হাওয়ালেখা

ছুঁয়েছে সময়ের যোনিমুখ—

শস্য-উড্ডীন এই মাঠে

তারায় অশ্বেরা উন্মুখ

একাকী মহুয়ার আলো চাটে

সময় শুয়ে আছে যেন কুঁজ

যেন সে পাহাড়ের সানুতল

এ গান বিষণ্ন বহুভুজ

শরীরে ভাঙনের হাওয়াকল


এশিয়া বুদবুদ অনায়াসে

মজ্জা পচে গেছে বাতাসের

কণ্ঠে নীল হয় ইয়োরোপ

দুনিয়া এইখানে কী মলিন—


ভাঙছে শূন্যতা হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


তুমি কি আসবে না এই খেতে

যেখানে বৃষ্টি ও পৃথিবীর

কাদায় শুয়ে মেঘ-সঙ্কেতে

মাটিতে ভিজে যায় আশরীর

বটের কষ ভরা এই বাঁক

যেখানে একা পাখি মরে যায়

যেখানে পানিকাউরের ঝাঁক

বিলের স্বেদ ফেলে হতাশায়

কোথাও ওড়ে ঘ্রাণ মৃত্যুর

ফাঁদের বিবমীষা, নোনা ঢাল

ভাবছে সে মরণ কতদূর

কোথায় সতীর্থ, সে বিকাল—!


তাদের তনুভরা কালো রঙ

হঠাৎ ছুড়ে দেয় ভরা চাঁদে

তুষার ঝরে যায় বাঙ্ময়ে

মহা সে সময়ের মেলানিন—


ডাকছে বহুকাল, হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


অশোক-পাতাটির স্বেদ হিম

দুঠোঁটে মেখে নিয়ে সন্ধেরা

শনের আর্দ্রতা, ভেজে ডিম

ডানায় উড়ে আসে ঘরফেরা

যেন সে কিষানির কবুতর

রঙের ধনু হয়ে উড়ে যেত

সুগোল নেমে এসে তারপর

জীবন এইখানে সমবেত

তাদের কথা ভাসে হু হু রাতে

অতীতকাল সেই ঘননীল

কাঁপছে তিরতির আঙিনাতে

মেঘের আলো ঘেঁষে গাঙচিল


একদা গোধূলির নাইলনে

কোথাও ঝুলে আছে হারিকেন

টুপছে নিভু নিভু আলো তার

সূর্য ডুব যায় ধুলালীন—


ডাকছি দিনশেষে হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


সাক্ষ্য গাঙপাড়ে কুঁজা গাছ

সাক্ষ্য ডাহুকের চোখা ঠোঁট

সাক্ষ্য শিশুদের গোল জিভে

মায়ের দুধ ভরা কালো বোঁট

সাক্ষ্য মাধুডাঙা নদীতীর

সাক্ষ্য সজনার ঋজু ফুল

সাক্ষ্য মায়াঢেউ শঙ্খের

মহররম মাসে দুলদুল

সাক্ষ্য দারুচিনি গাছটির

সাক্ষ্য চেলামাছ দওজোড়া

সাক্ষ্য হরিণের চরটিতে

একলা বেঁধে রাখা কাবু ঘোড়া—


কখনো মুদি সেই দোকানীর

পণ্য বেচবার ফাঁকে ফাঁকে

দেখার চোখ নিয়ে কী স্থির

ভালোও বেসেছিল হিংসাকে

অথবা গুল্মেরা দেবে ঋণ

হাওয়া ও মেশিনের ন্যুব্জতা

আকাশে ছড়িয়েছে সারাদিন

যেন এ কারাগার: সফলতা—

মৃতের পৌরুষ ভাবে চোখে

ব্যাকুল জাহাজির নৌপথ

ডুবছে সৈকতে, মীনলোকে

ভাসছে কতদূর দ্বৈরথ—!


ধাতুর শীত জুড়ে চলে যায়

নীরবে ট্রেনভরা হুইসেল

কাছিম শুয়ে আছে রোদপাশে

বাতাসে আলোছায়া কাঁপে ক্ষীণ—!


আত্মজীবনীতে এসো আজ

রাহমাতাললিল আলামিন—


যখন বনতলে দুটো চাঁদ

পাতার নদী ঝরে একাকিনী

বিষাদ এইখানে সারারাত

ছোট সে খাঁড়িটিও দুঃখিনী

স্রোতের মায়াঢেউয়ে মহিষেরা

রাতের ডুবোলীন জলাশয়ে

শুনছে দূরাগত অন্ধেরা

ঘোড়াকে ডেকে ওঠে সংশয়ে

তাদের খুর লেগে আলো ক্ষয়ে

হাওয়ায় পাক খায় সরলতা

আলোর যোনিমুখ সুর হয়ে

বেরিয়ে আসে গান, শূন্যতা—


দূরের খাঁড়িটিও বহমান

সাঁতারে আধোডোবা মহিষের

হাওয়ার অশ্রুতে কিশোরেরা

শুনছে অশরীরী কালো দিন—


তোমাকে ডাকে তারা, হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


এখানে জীবনের বিবমিষা

খিন্ন আহ্লাদে কতদিন

শুনেছে নিখিলের বহু তৃষা

যুদ্ধ ভালোবেসে সীমাহীন

এশিয়া ইয়োরোপ আফ্রিকা

ব্যথায় ঘুমিয়েছে শূককীট

ফসলে মায়াবীর বিভীষিকা

সারাটা হাওয়া জুড়ে মর্বিড

মাথার খুলি ঘোরে সবিনয়ে

অন্ধকার এসে কত কাল

অক্ষিকোটরের ফুটা হয়ে

দেখছে চাঁদ সুইসাইডাল—


মৃত্যু টুপটাপ ঝরে যায়

অন্ধ এস্রাজে দিনমান

কোথাও বোধ নেই হাওয়াতেও

আলোর গন্ধতে কেরোসিন—


তোমাকে ডাকতেছে, হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


আত্মহত্যার এইসব

অনেক আয়োজন এইখানে

সূর্যে হেঁটে গেছে হাওয়ামব

অপার হিলিয়াম সন্ধানে

ভাঙছে জুলকারনাইনের

সিসার তরলিত বিস্ময়

সময় ফুরিয়েছে দেয়ালের

উড়ছে শ্বাপদের কনভয়—

তবুও ফসলের সরণীতে

শান্ত পাকুড়ের ছায়াতীর

নদীর পাড়ঘেঁষা মসজিদে

তুমি সে নীরবতা মায়াবীর


কৃষির ঘাম চুয়ে শস্যতা

দুপুরে শিউলির ঝরা বুকে

ভাতের দানা ঘুম ফেলে গেছে

ঝাউয়ের বনানীতে যে কামিন—


তোমাকে ডাকে তারা, হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


সাক্ষ্য শালিকের ফাটা ডিম

সাক্ষ্য জঙ ধরা এঁটো তালা

সাক্ষ্য কাপড়ের শত ভাঁজে

মায়ের তুলে রাখা হাতবালা

সাক্ষ্য দওপাড়ে বটগাছ

সাক্ষ্য মাতামহী, যত শ্লোক

সাক্ষ্য ঘাসবনে বেঁধে রাখা

গাভিন গরুটির দুই চোখ

সাক্ষ্য বাতাসের জোড়া মোষ

সাক্ষ্য আসরের মোনাজাত

সাক্ষ্য কবরের নিমফুলে

ছড়িয়ে থাকা মাটি, তৃণখাত

সাক্ষ্য দুবলার চরে কাশ

সাক্ষ্য বতুয়ার ঘন রঙ

সাক্ষ্য মসজিদে ঘড়িটির

পুরনো ঘন্টার ঢং ঢং


কিছুই ফেরে নাই, ভেসে যায়

নদীতে শালবন, নির্বাণ

প্রতিধ্বনিময় এ হাওয়ায়

নৌকা বয়ে যায় দিনমান

তাদের দেশ যেন নীলিমায়

তাদের দেশ যেন লুব্ধকে

নদীর ফেনাভূমি বৃথা যায়

অধ্যুষিত জলে কার শোকে

নৌকা যায় ভেসে একা একা

দরজা খুলে ধরে হাওয়ামন

পাথরে প্যাপিরাসে কাল-লেখা

হঠাৎ ভেসে ওঠে তুঁতবন—


কোথাও ঝুলে আছে সারা পথ

ময়লা রবিবার একা তারে

হেমন্তের স্বেদ ডুবে যায়

সুতার কৃষকেরা মাকুহীন—


সে মাঝি, তুঁতবন ডাকতেছে

রাহমাতাললিল আলামিন—


এ মাঠ বহুকাল দণ্ডিত

এ নদী বহুকাল শাপে লীন

এখানে চারু নিশিথিনী মৃত

গুল্মশাসিতেরা মনোহীন

মোহাম্মাদ প্রিয় দরদিয়া

মগজে হো হো হাসে লাল ট্রেন

আগুনে পোড়া জিভে ডাকে হিয়া

বাতাসে শুয়ে আছে অহিফেন

আমার চিরব্যথা আত্মায়

চূর্ণ ক্রমাগত গম্বুজ

সমুদ্রের মদে দিন যায়

নিখিল বিশ্ব কি মহাপুঁজ—!


মোহাম্মাদ প্রিয়, দরদিয়া

সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি

আমাকে তুলে নাও মারী থেকে

প্রতিধ্বনি থেকে উড্ডীন—


দরুদ বর্ষিত হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


কুয়াশাক্লান্ত এ ফ্যাসিবাদে

প্রেতের উড়ে যাওয়া সন্ধ্যায়

পালঙবনে কার পাখি কাঁদে

গোধূলি বেজে ছিল মনীষায়

ডিমের আধোভাঙা নীল সুর

বাতাসে, তৃণখেতে গোল হয়ে

পানির আলোছায়া যতদূর

সেখানে ঢেউলীন সংশয়ে

লাইট হাউজের ক্ষীণ আলো

পড়ছে রাত্রির ঘটনায়

হঠাৎ শুশুকের মিশকালো

শরীরে ডুবো চাঁদ মিশে যায়—


একটি মদ আসে ফেননিভ

সূর্য, বাতাসের মন্দিরে

ঝাউয়ের বন আর সৈকতে

রোদেরা কথা বলে ভূ-মুখিন


ডাকছে বালিয়াড়ি, ম্লান ঢেউ

রাহমাতাললিল আলামিন—


ভুবন চিলটির মিঠা ডাকে

সঘন হয়ে আসে এ দুপুর

তারার ঘ্রাণ ছুঁয়ে বিশাখাকে

বাজায় সারারাত সন্তুর

মৃতেরা কোনদিকে চলে যায়!

বনের সন্ধ্যায় থামে ঘোড়া—?

সূর্য-পারাপার নৌকায়

সে দেশ কতদূর, আনকোরা—!

সে দেশে বনেঘেরা তরমুজ

বাতাসে নীল মদ নহরের

উটের ক্রীড়াময় হাওয়া-কুঁজ

চলছে সারি সারি বণিকের


আমার আত্মা কি সেইসব

কুঁজের সঙ্কেত বঙ্কিম

পাহাড়ে আড়ালের ফাটা দাগে

বেগানা চাঁদ যেন প্যারাফিন


জ্বলছে বিস্ময়ে—হৃদয়ের

রাহমাতাললিল আলামিন—


কীর্ণ হয়ে আসে গোলাঘর

পরাঙ্মুখ রেলকলোনির

ছিন্ন টিকিটের মর্মর

আমরা শুনি নি কি ঝরা মিড়!

চন্দনের বনে রাজহাঁস

একলা ডেকে গেছে তনুমন

মিথুন-উদ্বাহু চারপাশ

উঠছে জেগে দূরে তুঁতবন

কাউকে মনে পড়ে দিনমান

শ্রাবণ-বৃষ্টিতে রেডিয়োয়

বাজছে সুরা আলে ইমরান

নিভৃত ঘুমিয়েছে মৃন্ময়


কাউকে মনে পড়ে এইখানে

অথবা দ্রুতগামী মর্মের

বিদায়গ্রস্ততা, অবসাদে

পাতার ঝরা পথে চিরদিন


মোহাম্মাদ, প্রিয় দরদিয়া

রাহমাতাললিল আলামিন


সাক্ষ্য দুপুরের মালিদও

সাক্ষ্য ঘুঘুভরা মেঠো তারা

সাক্ষ্য ভোরশীতে মায়ারোদ

নানির হাতে মাখা আস্বাদ

সাক্ষ্য কঞ্চিতে মাছরাঙা

সাক্ষ্য জেলেদের কালো গাও

সাক্ষ্য এক ডুবে ধরা মাছ

বাঁশের ফুলে ফোটা সন্ধ্যাও

সাক্ষ্য বেনেবউ পাখিটার

সাক্ষ্য হাতে বোনা ছোট ডালা

সাক্ষ্য বাতাসের রন্ধ্রতে

কাঁদছে হুসেনের কারবালা

সাক্ষ্য ভেড়াদের ঝুনঝুনি

সাক্ষ্য বন্ধুর কাছে ঋণ

মোহাম্মাদ, প্রিয় দরদিয়া

রাহমাতাললিল আলামিন—


*

এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে [২০১৮]



হাইদা... হাইদা...হে আমার উট

উঁচু পর্বতের ধারে বসে আছেন আমেনা—যেন আড়তের মৃত মাছের মতন তাকিয়ে আছেন একাকী জলপাই বাগানের দিকে—কোথাও বাতাস থেকে উড়ে আসছে উটনীর ধুলা—আর সেই গান—


‘হাইদা ... হাইদা...’


আব্দুল্লার সান্দ্র ঘোড়া হারিয়ে যাচ্ছে মরুভূমি-বনে—

আমেনা, তার সমস্ত গানের ভাষায় বুনে দিচ্ছেন গমের হাওয়া—যেন হলুদ হলুদ ওই প্রান্তরে নেমে আসে চিরপাখিদের শিস—


‘সিরিয়া যাওয়ার সেই পথগুলো কেমন? ওইসব পথেও কি ঘুমিয়ে আছে ইঁদারার জল? সিরিয়ার জলপাইবন কি আঙুরখেতের মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া হেমন্তের থেকেও বেশি দূর—?’


প্রতি রাতেই আমেনার ঘুমের মধ্যে দল ধরে হেঁটে যায় উট—আর তারারা গান গায়—


হাইদা ... হাইদা... 


হে আমার উট—




দুঃখপরবর্তী ব্রিজ

কে তবে মাকাল ফুলের কাছে রেখে আসে 

বোবাদের তাক করা হাসি 

দুই একটা গমক্ষেত রিপ্লে করছে রোদ— 


দুঃখপরবর্তী ব্রিজ, হাতিকে মউসুম দিলে

হাওয়ারও বাচ্চা হয়

গাছকে বখশিস দেয় চাঁদ 

যেন ব্লেড শোনার পরেও শিরা ছিড়ে 

লাফিয়ে পড়ছে না বাঘ

রক্তও হাঁপিয়ে উঠছে আস্ত শরীর জুড়ে—

কে তাকে বলবে:

পাওনা টাকার চেয়েও ভারি হয়ে আছে

দুপুরের রোদ—


চলে তো যাওয়াই হলো

তবু কি যাওয়া গেল পুরাটা—! 


ও চোখ, ও দুঃখপরবর্তী ব্রিজ 

আমি পার হই জবালণ্ঠনের গান 

ও বিরহী মাহুত,

ফুলেদের মুয়াজ্জিন হলো চাঁদ 

তাকে বোঁটাতে এখন 

কে আর দিতে পারে ঘ্রাণের আজান—!


এখানে, মলিন গৃহত্যাগ পড়ে আছে বহুদিন—



তুমি কি আসবে না

শ্রাবণ মাসের দিকে তাকিয়ে 

একটা দোপাটি ফুল 

ম ম করছে সারাদিন—


তুমি কি আসবে না তার

আত্মজীবন ভরা ঘাঁয়

সুইসাইডের নদীতীরে

কারো বায়োডাটা ভিজে যায়— 


তুমি কি ফলের বীজে ঢেউ!

বাড়ি বাড়ি মুষ্ঠির চাল! 

দানের বাক্সে ফেলা কয়েন

ঘুমে, উড়ছে চিরকাল


শিমুল ফুটছে দ্বিধাহীন

কুকুরের হাঁ-জিহ্বায়

জুতার ভেতরে মুচিটার  

ক্লান্ত সেলাই ছিঁড়ে যায়


শ্রাবণ মাসের দিকে তাকিয়ে 

একটা দোপাটি ফুল 

ম ম করছে সারাদিন—


শূন্য ফুলের বোঁটাটিতে 

থোকা থোকা ঝুলছে বিদায়— 

তুমি কি আসবে না তার

আত্মজীবন ভরা ঘাঁয়—!




নিদ্রার স্মৃতি

ইঞ্জিনের শব্দে 

চূর্ণ হয়ে কেটে যায় রাত 

একটা ঘাসের বন

পড়ে থাকে 

ট্রেনরুটের ভেতর— 

কারো নিদ্রার স্মৃতি

উড়ে যাচ্ছে 

সমুদ্রের পথে


উইন্ডমিলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে শহরের রোদ—


তবুও কোথাও

পাতার নিরর্থ থেকে 

কেউ কেউ লোকাল বাসের চাকায়

দেখে নেয় 

হাওয়ার পূর্বাভাস—

ভালো লাগে 

নিজেদের ইগো—কত কত সৌজন্য 

ঘিরে থাকে সোশাল ভ্যালু!  

চাকরিগ্রস্ত প্রেম

আচ্ছন্ন করে আমাদের! 

একেকটা বিফল প্রত্যয় 

গভীর ফেনার মধ্যে 

ডুবে যায়—


তবুও কোথাও, আঙুর ফুলের পাশে 

পেকে ওঠা রোদে

কারা যেন 

বুদবুদ করছে মোহাম্মাদ—




রসুল, রসুল

সারাটা হাওড় জুড়ে তিলফুল 

বাতাসে ভেড়ারা দূরে গেছে ঘুম 

দুপুরে রোদের ছায়া পড়ে জলে 

ফুটছে নদীর ঢেউয়ে কুমকুম


নিধুয়া ধানের খেতে ডাকে চিল

বকরি হারিয়ে গেছে মেয়েটার

বাতাসে উড়ছে তার রুখা চুল

যেন সে কন্যা ফণিমনসার—


যে স্বামী বিদেশে থাকে একা একা

বউয়ের কথাটা ভাবে সন্ধ্যায় 

না হওয়া দেখায় তার কতদিন

হাজার হাজার পপি ঝরে যায়—


আমার শিশিরে ভেজা ভেড়াগুলো

খুঁজে কি পেয়েছে শেষে তৃণখাত?

ভাষার বাইরে ভিজে বৃষ্টিতে 

রসুল রসুল ডাকি সারারাত—






নবীজির ছায়া কাঁপে বাংলা ভাষায়

খোড়া গরু খোড়া মোষ

খোড়া নদীনালা

আশিনে বাতাস কাঁপে 

যেন ধূপশালা

অন্ধ ধানের হাওয়া 

চিটা কুটিকুটি

ডুবে গেছে ছায়া গাছ

অন্ন ও রুটি

ধীবরের জালে ধরা

আমি সেই মীন

আমারে কৃপায় রেখো

হাশরের দিন

আউলবাউল হয়ে 

ঘুরি পথে ম্লান

নদীস্রোতে মিঠা হয়

আমার জবান 

এই জল সুর হয় 

কীর্তিনাশায়

নবীজির ছায়া কাঁপে 

বাংলা ভাষায়—



চিরদূরহাওয়া

তোমার ঋণের টাকা বেড়ে গেছে চক্রবৃদ্ধি হারে

বাড়িতে টিনের চাল খুলে নিতে চায় সুদখোর

বিকাশে কিস্তির টাকা শোধ করো প্রতি বুধবারে

দু হাতে সে লোন নিয়ে হেঁটে যাও কাঁটার ওপর,

ডালিম ফুলের রঙে ভিজে যায় বহুদূরমাঠ—

এখানে পেতল-দিন চকচক করতেছে ঘাসে

হরিণের রক্তে যেন ভিজে যায় বিকাল হঠাৎ

বামন সমুদ্রে গেলে যেমন দেখাবে চারপাশে

তেমন বেহুলা তুমি ঘিরে আছো ঋণের বাসর 

ভাঁটের ফুলের মতো আকাশে ফুটছে সেই রাত

নিম সব বিষণ্নতা চন্দ্রালোকে ভাসে তারপর

কোথাও চিলের ডাকে খুঁজে নাও বাঁচার আয়াত

রজনীল অন্ধকারে বুদবুদ করে ওঠে ঋণ 

তোমার গলার দড়ি মহাশূন্যে ঝোলে প্রতিদিন—



সূর্যাস্তের রঙ

বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অ্যাকাশিয়া বনের উপর দিয়ে তারা চলে যাচ্ছে কোথাও। দূরে, গড়ের ঢাল বেয়ে একজন মানুষ গরুর খুঁটিতে আঘাত করতে করতে ভাবছে—একদিন হুট করে  অপঘাতে মরে গেলে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রজাপতির রঙও হবে না মলিন, গোর-ফেরত যাত্রীদের পায়ে লেগে থাকা ধুলা সন্ধ্যার রজতাভ আলোয় ছড়িয়ে পড়বে হলদি ফুলের শিশিরে। মেয়েটা কাঁদবে কি—! 


বঙ্কু মাঝির শেষ না হওয়া গল্প হয়তো একদিন অ্যাকাশিয়ার বক্রহলুদ ফুলে ঝরে থাকবে সারা মাঠ—! 


সন্ধ্যা হচ্ছে। আকাশমণি গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যাস্তের রঙ কাটা মুরগির মতো লাফিয়ে উঠছে মুহুর্মুহু—


সন্ধ্যা

আমাদের কেউই ছিল না কোনোদিন—ঝিনুক কুড়ানো ছোট মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ছে বালির বিস্রস্ত ঢালে, জিপসিদের স্তনকল্পনায়, টাকায় কেনা মেয়েদের কোমরের নিচে হে নারিকেলবীথি ওরিয়নের চিরআলোটুকু তাদেরকে দিও—


সন্ধ্যায় পশুরা অরণ্যের থেকে ফিরতেছে বাড়ি—সমুদ্র, মেয়েটার দুঃখিনী বালাটির সাথেও কথা বলে গোল হয়ে আজানু বসে তার পাশে—


ঘুম ভেঙে গেলে, নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে একটা সন্ধ্যা বিষণ্ন হয়ে উঠছে রোগা ঘোড়াটার উড্ডীন হা-এর ভেতর—


আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব

শরৎকাল এলে দুনিয়া বহুদূর

অহেতু নিয়ে আসে শূন্য বুধবার 

নানিকে দেখি একা হাঁসের বন ধরে

কোথায় হেঁটে যায়—সে দেশে-দ্রাঘিমার  

মাঠের সন্ধ্যা কি কখনো ব্যথা ঘিরে 

পুরনো চকিটাতে ঘুমায় সহজিয়া

সে দেশ মিদরাসে—? আনোখা নদীতীরে—?

যেখানে আয়াতুল কুরসি লেখা পাতা

জামের নয়া ফুলে ছড়িয়ে পড়ে আয়ু 

রঙীন হাঁসিনীরা তারার শিস গুনে 

পেরিয়ে ধুলাপথ সান্দ্র হেমবায়ু 

কোথায় চলে গেছে, নানিও নিশ্চুপ— 


আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব—


নানাকে দেখি নাই মামাও মরে গেছে

এমনি শরতের বৃহস্পতিবার 

কসকো সাবানের গন্ধ উড়তেছে

নিমের ফুল ঝরে সফেদ জানাজার

তামাটে সন্ধ্যায় নানির ছোট ঘরে 

টেবিলে হারিকেন বিষাদে আলোহীন 

একটা শিশি ঝোলে স্মৃতির মতো করে

আকাশে জ্বল ওঠে বাকির কেরোসিন 

জামের নিধু বনে সেসব হাঁসেরাও 

লালের পায়ে পায়ে বাজছে সন্তুর 

সে দেশ মায়ারোদে—? কেনানে ছোট গাঁও—? 

খালারা আসে নাই তাদের বাড়ি দূর—

 

আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব—


একটা ছোট তাক যেখানে ছিল হাঁস

মার্কা নারিকেল তেলের কৌটাটা 

অতীতকালে এক ভোটের ব্যবহৃত 

ধূসর পোস্টার রয়েছে ঘরে সাঁটা 

মাটির চুলা খাঁ খাঁ আমাকে ডাকবে না

তারার খুলি থেকে একলা হয়রান 

হাঁসের বনে কেউ সুদূরে চলে গেছে

সে দেশ পারথিয়া—? ন্যুব্জ খোরাসান—? 

আম্মা বসে আছে লাউয়ের পাতা বুঁটে 

আকাশমণি ফুলে হীরার শিশিরেরা

কাঁপছে রাতভর অমরাবতী যেন 

এ মাঠে শুয়ে আছে নানির গন্ধেরা—


আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব—


*

আনোখা নদী

তবুও প্রয়াস (২০১৮, ভারত)



রাত

বিস্রস্ত রাত। কাঠের জেটির উপর শুয়ে শুয়ে আমরা শুনতে থাকি সমুদ্রের শান্ত ধ্বনি, ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস—পতঙ্গেরা সারাদিন যাদের লুকিয়ে রেখেছিল কেয়াবনের বিস্তীর্ণতায়—কে যেন কার্পেটের মতো হেমন্ত গোটাতে গোটাতে ছড়িয়ে দেয় বেলাভূমি পর্যন্ত—নুনের ক্লান্তিহীন আকাঙ্ক্ষা আমাদেরকে নিয়ে যায় সেসব জোয়ার-ভাঁটার কাছে যেখানে জেলে রমণীর কালো শরীরে ধেয়ে আসছে জলোচ্ছ্বাস—


পর্যটকদের কল্পনার মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। ঝিনুক কুড়াতে কুড়াতে কয়েকটা মেয়ে কথা বলছে:—একজন ধর্ষিতার প্রেম কেউই পারে না ছুঁতে, এমন কি কোথাও তৈরি হয় না পাতাঝরা বনে ঝিমধরা ঘন্টাধ্বনি—


শূন্য চেয়ারগুলোতে উড়ে আসছে অতিব্যবহৃত চোখ, ডাব বিক্রেতাদের ঘুম, সাম্পানের বঙ্কিম মর্মতা—সমুদ্র তার নিঃসঙ্গ ঢেউগুলোকে শেকলে আটকে রাখে মুহুর্মুহু, যেন বিষণ্ন একদল পশু যেতে চাচ্ছে শান্ত নীলের দিকে, যেখানে দিগন্ত আমাদের সমস্ত কথোপকথন পোঁছে দেয় সাঁতারুর কাছে—


আমরা ফিরে যাই শঙ্খবেচা মেয়েটার কাছে আর আমাদের নৈঃসঙ্গ্যের মধ্যে তৈরি হতে থাকে অশ্রুত পথ যে তার শেষ সীমানায় সাজিয়ে রাখে রমণীর দীর্ঘ ধূসর শিস—




উৎ যোগ নয়ন

হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে

উন্নয়নের থ্রিলার

চাঁদের ভেতর উঁকি মারছে 

ভাঙ্গা সেতুর পিলার


ফুলের পাশে মিটিং করে

মুরগি নিয়ে শেয়াল

কী আর হবে দুয়ার এঁটে

ঘরের মধ্যে দেয়াল


চাঁদ উঠেছে ওভারব্রিজে

হাজার মেগাওয়াটে

দিল্লি থেকে বিল্লি এসে 

নৌকাতে গাল চাটে



আইন

আইন হলো পাইন গাছে

ফুটতে হবে গোলাপ ফুল

নাইন ক্লাসে পড়তে হলে 

কাটতে হবে বেবাক চুল


আকাশপথে রেল যাবে তাই

করতে হবে গাছ সাবাড় 

শেয়ালকে খুব খেয়াল করে

দিতেই হবে সব খাবার


ইঁদুর এলে সিঁদুর মুছে 

করতে হবে নমস্কার 

ফুলগুলো ভুল রৌদ্রে শুকাও

ঘ্রাণের আবার কী দরকার



ইলেকশন

খোকা যাবে ভোট দেখতে

হাইস্কুলের মাঠে

ছড়াও নেই পড়াও নেই 

ইস্তফা তাই পাঠে


রোদ উঠেছে ফুল ফুটেছে

মানুষ ঘুমায় জেগে

বাইরে যাওয়ার কী প্রয়োজন

মা বললো রেগে


একলা থাকো অন্ধকারে

বন্ধ নিজের ঘরেই 

সবগুলো ভোট শেষ হয়েছে 

তাহাজ্জুদের পরেই



সইঘ্রাণ এর বিভাব কবিতা


বিনা জল মেটে না কি

চাতকের তৃষা

তুমি মদ তুমি গান

ঘাতকের সীসা

কাচবনে ফিরে যাই

অন্ধ জোছনায়

অক্ষ নাই বলে পাখি

ডানা ঝাপটায়

টাল খায় ঘুরে মাথা

ভবিতব্যে ত্রুটি

কৌতূহলে ফিরি পাশ

দেখি ফল দুটি

পেকে আছে বোঁটাসহ

কালো চারিধার

আতাবনে খুঁজি পথ

কসম আল্লার

গুনে দেখি ডাক নাম

শত ছিল প্রায়

হারিয়েছি, কৃপা করো

এখন আমায়—



মুসলমানের ছেলে


কিভাবে যে আসতে পারি ঘরে 

সমস্ত পথ অন্ধ, ম্রিয়মাণ 

ভাঙলো বাতাস খোঁপায় মূর্চ্ছাহত

আঙুল ভরে ফুটলো অভিমান


কার তালাকের শব্দ হলো দূরে 

নতুন বউয়ের ছিঁড়লো শাড়ির পাড় 

বাদামগাছের পাতাও যেন কাঁদে

শূন্য হাওয়ায় কিসের অধিকার—?


ভেজা ছাতার সেলাই খুলে গিয়ে

তোমার মুখের উঠলো মায়া কেঁপে

হঠাৎ যেন বন্ধ হলো গান 

বৃষ্টি এলো সারা জীবনব্যেপে 


হাওয়াই মিঠাই রঙ করা সেই জামা

রিক্সা করে রাস্তা পারাপার 

গ্রিলের লোহা জাপটে ধরে দেখি 

সিঁদুরমাখা পড়ন্ত সংসার—


তোমার হাতে ঘুমায় সেলাইমেশিন

আমার শার্টে শূন্য বোতাম পাতা

বৃষ্টি এলে স্মরণ করে দিও 

স্বামীর হাতে নতুন কেনা ছাতা




বৃষ্টি 

বৃষ্টি পড়ছে বায়োডাটার উপর

বৃষ্টি পড়ছে কারোর ক্ষুদ্র লোনে 

বাতাস এসে রিনরিনিয়ে কাঁপে 

ফ্লেক্সিলোডের ময়লা বিজ্ঞাপনে


রিক্সাওলা কড়ুই গাছের নিচে

মেঘের সঙ্গে করতেছে বাতচিত

খুচরা টাকার মতন ঠান্ডা হাওয়া

ছড়িয়ে দিল আগুন তাপার শীত


সরলিয়ার মোহিনী সেই বউ 

প্রবাসী যার স্বামীর কথা ওঠে

পরকীয়ার সমস্ত মাঠ জুড়ে 

মেস্তাপাটের অজস্র ফুল ফোটে


বৃষ্টি পড়ছে তালাকের পাতা ভিজে 

বৃষ্টি পড়ছে দ্বিতীয় বিয়ের পাশে

বৃষ্টি পড়ছে বহুদিন আগে পাওয়া

কোনো বেকারের চাকরির আশ্বাসে




শতরঞ্চি

 

তোমার কটি শীতল ঠিলার পানি

মাধুডাঙার বাঁক-ই যেন গ্রীবা 

সাটি মাছের পিছলে চোখা মাথা 

নিমরাজিতে রাখতে তুমি দিবা?


শীৎকারে যে ধুধুল নাভিমূল 

মিঠাই লাগে দারুচিনির মতো

পাহাড়ে কাঁপে পাকা বেতের গোল

বোঁটার কালো ছায়া ইতস্তত


তোমার ডাকা এড়ানো মুশকিল

উতল করে মাংস আর ভাঁজ 

বুকে জমজ তাকিয়ে কিশমিশ 

ইফতারিতে বসেও বেলেহাজ


তোমার চালে আটকে গেল রাজা 

মন্ত্রী, বড়ে পেলো না আর সাঁকো 

দেমাগিনী, বললে তারপরে  

‘পুরুষ, তুমি আড়াই ঘরেই থাকো—’





নাইওর

মেঘের বনের বরজ থেকে 

পানের খিলি বৌ খায়

মহেশপাড়া বাপের বাড়ি

যাচ্ছে গাঙের নৌকায় 


ঢাকা থেকে টাকা পাঠায় 

নতুন স্বামী বিকাশে 

হাঁসের বাচ্চা হাই তোলে তার 

প্রতি হিশাব-নিকাশে 


জলশরি ফুল ছলাৎ ছলাৎ

মন ভেসে যায় কোন দূরে

মাঝির ফোনে বাজছে কোথাও

‘ও সোনা বন্ধু রে’


ছোট ছোট রোদের হাওয়ায়

কাঁচা ধানের শিষ দুলে 

মোন্নাপাড়ার মেয়েরা যায়

হরিখালীর ইশকুলে


পানের পাতায় রোদের দরদ

চুন লাগিয়ে বৌ খায়

ঝিকমিকমিক ভাসছে তারা

আকাশগাঙের নৌকায়



দিনের মধ্যে

একটা দিনের মধ্যে ঢুকে আমরা দেখি—বসন্ত গুটিয়ে নিচ্ছে হার্পুন, ছোট দোকানের পাশে জেলেদের দরদাম, আবহাওয়ার খবরের মতো মাছের ফ্যাকাশে চোখ, কোথাও মেয়েদের ঠান্ডা মোজা জোয়ার ও ভাঁটায় দুলে উঠছে তারে—এখানে অরণ্য নাই—মৃত প্রবালের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, ঘড়িগুলো হেমন্তকে ঠিক সময়েই জানিয়ে দিচ্ছে খয়েরি রঙের বিষণ্ন মালহার ধীরে ধীরে ডুবে যাবে নীলের কেন্দ্রস্থলে—


ভাষার বাইরেও একটা মেয়েকে বলার থাকতে পারে—‘বৃষ্টি তার পথ হারানোর উৎকণ্ঠা নিয়ে ঝরে যাচ্ছে জেটির উপর, যেখানে গ্রীষ্মকালকে ধর্ষিতার মনে হয়েছিল: সব ঋতুরই থাকে নিজস্ব শোকের পোশাক।বিস্মরণের যারা আগেই হাজির হয় তুঁতফল পাকার মৌসুমে—


হোটেলের নষ্ট বেসিনের উপর আমরা লিখে রাখি:—


—বেলাভূমির লাল কাঁকড়াগুলোই মনে হয় এপ্রিল মাস

—সমুদ্রশিসের পরে মদ একটা ফুলকাটা অর্কিডের খেত

—মেয়েটার বিয়ে হতে পারতো এমন সব সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে যারা বাজাতে পারে দীর্ঘ ক্যানেস্তারা

—টমেটো ফুলের সঙ্গে কথা বলতেই মূলত জোয়ার ফুলে ওঠে সমুদ্রে


কাকাতুয়া পাখিরা ফিরে এলে আমাদের নীরবতায় শুরু হয় সমুদ্রের গর্জন। একটা ছোট মেশিন জেটির হাওয়ার দূরে জ্বালাতে পারে আলো। আর, আমরা দাঁড়িয়ে থাকি পরস্পর গাদা গাদা নৈঃসঙ্গ্যের ভেতর—


মুসলমানের ছেলে


কোথাও মাঠের মধ্যে একাকী ট্রেন

কতকাল ধরে ভিজতেছে বৃষ্টিতে

জানালায় লেখা শিশুদের ডাকনাম

মরে গেছে যারা পয়তাল্লিশ-শীতে—

 

তবু ফ্লেমিঙ্গো উড়ে যায় পূরবীতে—

 

বরফে আচ্ছাদিত পাইনের গাছ

ঘুম-সুমসাম দুপুরের হিম-দূরে

আকাশে নিভছে রোদ্রের পাখোয়াজ

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির পাতা উড়ে—

 

তবু যায় দিন উইন্ডমিল ঘুরে ঘুরে—

 

বেগুন ফুলের মতো হাওয়া এসে কাঁপে

বনপথজুড়ে হার্ট অব ডার্কনেসে

কেন ভুলে যাও, সিরিয়ার শিশুটারও

ছিল বাদামের বন তার গ্রামদেশে—

 

পানি কেটে কেটে চলে প্রপেলার শেষে—

 

আজো যে ভূগোল লাশবাহী বেদনার

ভূমিজরিপের কম্পাসকাঁটালীন

গ্রেনেডের খোলে গভীর জোৎস্না পড়ে

জলপাইফুলে ফুটছে ফিলিস্তিন—

 

তবু ঝিনাইয়ে যায় ভেসে যায় দিন—


হাওয়া চেনে নাই ঘুমন্ত ডালগুলো

এলিয়ে পড়ছে ইহুদি পাতার পাশে

পশ্চিম মেঘে অরণ্য পুড়ে যায়

কারো দেশ ছিল পপির শিশিরে, ঘাসে—

 

ফাঁকা ডাকঘর আজো তবু চিঠি আসে—

 

তারা সমুদ্রে ভেসে গেছে একদিন

তার চলে গেছে মার রুটি পিছে ফেলে

তাদের মাতৃভূমি ছিল শুধু, পা—

আজও হাঁটতেছে, মুসলমানের ছেলে

 

আজো বেল বাজে আব্বার সাইকেলে—

 

 

আজো কুয়াশায় ঝিলমের থেকে দূরে

সেই ট্রেন আর হুইসেল থেমে আছে

হলোকাস্টের বদলেছে পরিচয়

বৃষ্টি পড়ছে কতকাল ওক গাছে—

 

তবু গমখেত পেকে ওঠে এস্রাজে—

 

আজো পশ্চিমে টারবাইনের রোদে

ঘোরে সালফার মেঘে ফিশানের ভঙ্গি

ফেলে নিউট্রন আমেরিকা ইয়োরোপ

নারঙ্গী-হাওয়া ভীত কাঁপে, শোনো, সঙ্গী

 

আমাকেই শুধু বলবে তুমিও জঙ্গি—?



মুসলমানের ছেলে 


ভালো যে বাসো নি কখনও

তা বুঝতেই

লেগে গেল কমলালেবুর যুগ—


তারপর হাঁটুপানিতে নেমে সূর্যাস্তে কতকাল

গোপনে করেছি ঠিক

কপারের কম্পাস, সে কথা জানে নি নাবিক

দক্ষিণ বাতাসের ঢেউ

শুধু তোমার মায়ার লণ্ঠন আজো

নিভে যায় বিমমতায়


ক্যালেন্ডার উল্টে দিলেই থেমে যায় শীত—


হীরা খুঁজে খুঁজে বেরিয়েছো আত্মপক্ষ-জঙ্গলে

আমাকে বাসো নি ভালো

মুসলমানের ছেলে বলে—


সংসার ভেঙে গেলে

কে কোনদিকে চলে যায়

হাওয়ারাও রাখে না হদিস—


অথচ, সন্ধ্যা হলে মাগরিবের আজান

লেগে থাকে কুর্চির নিস্তব্ধ ফুলে

আর কারো শাড়ির আঁচল

গ্রীষ্মের রোদের মতো

কেঁপে উঠতো বনফসলের শেষে


আমাকে নাও নি তুমি

মুসলমানের ছেলে বলে—


পাখিরা তাকিয়ে ছিল

দুপুরের রোদের দিকে


বাউলেরা অন্ন পেয়েছে কি না!



মুসলমানের ছেলে বলে

আমাকে কখনো দাও নাই

তোমার হ্রদের উপকূল,

ঝরাপাতা, নিধুয়া হাওয়াই


তোমাকে দেখতে গেলে, শোনো

পূজার বাড়িতে লোকজন

আলো নিভে এলে খুব ধীরে

একলা জ্বালিও লণ্ঠন


আমিও কুড়িয়ে দিতে চাই

ভরা চুলে কাঁটা খসে গেলে

গোধূলির রঙ ভেসে যায়

আতার বনের আলো জ্বেলে—



দিনগুলো খুলে খুলে দেখি

কেবল অন্ধকার—

খালি মাঝে মাঝে তারা জ্বলে ওঠে

আর চাঁদ হোঁচট খায় মাধুডাঙার পানিতে—



তোমার বাড়িটা কত দূরে

কত দূর তুলশির রাত

নিয়র ঝরেছে সারাদিন

কী করে তুলছো কাড়াভাত—!

 

আমার হাওয়ারা গিয়ে থামে

তোমাদের খোলা মণ্ডপে

অপরাজিতার লতাগুলো

বেয়ে ওঠে আঙিনার টবে


পিয়নেরা ঘুমিয়েছে দূরে

সারারাত ঝরে নিমফুল

ওপারে তোমার সংসার

ভেঙে গেছে মাটির দু কূল



আমাকে পড়ে না মনে—


রাতের দুপুর হলে

কোন বন থেকে উড়ে আসে সান্দ্র ঘণ্টাধ্বনি

পোস্টম্যান ঘুমিয়ে পড়েছে

তবু তুমি চিঠি লেখো কাকে?

আত্নার ফুলগুলো

গোটা রাত্রিকে শাদা করে ঝরে পড়ছে উঠানে—


আত্মগোপনের পরাগ চেয়েছো বাজুক

অন্ধকারে, হাওয়ায়


তোমারও সংসার হলো, হলো ছেলেমেয়ে

সূর্যাস্তে ছড়িয়ে ধুলা কখনো কি কাঁদো চাপকলে

দাও নি আমাকে তুমি

খোঁপাবাঁধা প্রেম

মুসলমানের ছেলে বলে—



তোমাকে হলো না পাওয়া

নিরলে ছোঁয়ার অনুমতি

হঠাৎ পুড়লে ভাত

কারোরই হবে না কোনো ক্ষতি


শার্টের কলার ঠিক

করে দেবে স্বামীর যখন

তাকে বোলো, ‘চুল খুলে

একবারই পড়ে গিয়েছিল মন


তখন আষাঢ় মাস

বৃষ্টিতে ভিজেছিল হ্রদ

বাড়িতে ফেরার পরে

কাউকেই বলি নি বিশদ’


‘শুধু চুনকালি একা

লাগিয়েছিলাম নিজ গায়ে’

নদীতীরে কার জামা

ভেসে গিয়ে ছিল অন্যায়ে—


বোতাম লাগাতে গিয়ে

বলে দিও সবটা যা বাকি

‘মুসলমানের ছেলে

কবিতা লিখতে পারে নাকি—!’



তোমাকে পাওয়ার পরে


কেমন হতো সংসার


আমি বকরি চরাতে পারি—


মাঠের মধ্যের জবাগাছটাকে


বলতে পারি


ফুলে ফুটো, ছলনা করো না—!


১০


আধো সকাল। একটা আচ্ছন্ন দুপুরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে শান্ত কণ্ঠির বন। অনেক কালের ঝরে যাওয়া পাতা ঈষৎ পাখির ডাকে উড়তে থাকে জঙ্গলে হতাশা ও বিমমতায়—গণ্ডগ্রাম। তার হিংসার সারথীকে এইমাত্র নামিয়ে দিল উনুনবীথির ছায়ায়। মধ্যাহ্নের নীল স্তব্ধতার ভেতর স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে কেন এলে শেষতক—?


—কে আর কমলাবনের মতো অপেক্ষা করে দূরের বৃষ্টির দিনের! এই যে শাঁখা, নিঃসঙ্গ বর্মের মতো সিঁদুর অনতিক্রম্য যে পুনর্লিখন তাকে আমি এড়িয়ে যাই কী করে!


—তোমার সংসার হলো, আর আমি ঝরা পাতার ক্রম মর্মতার মধ্যে ডুব দিয়ে দেখে আসি বিলীয়মান শেষ বিকালের হাওয়া থম মেরে বসে আছে ডালে ডালে। স্বামীর আড়ালে শুয়ে এখনো কেন কাঁদো! একজন বাউল আকাশের নিচেই এগিয়ে দিয়েছে ভিক্ষাপাত্র তার দুই মুঠ পুর্ণ করে দিয়ে দিও পাখির শিস, কলপাড়ে একলা কান্নার ধ্বনি।


—যে হ্রদে নামতে পারবে না কোনোদিন সেখানে ঘোড়া থামিয়ে কখনো চেয়ো না তৃষ্ণায় মিঠাপানি।


—তোমারও সংসার হলো, আর আমি দূরের তুষারে দাঁড়িয়ে গথিক গির্জার বাতি। সন্ধ্যা শেষ প্রায়। স্কিমের ঘর থেকে কে যেন মেশিন পুড়ছে ডিজেলে, ধূমাভ আলোর মধ্যে বসে আছি মনোলীন


মুসলমানের ছেলে—


১১


লেবুর ফুলে একলা হাওয়া

মার্কারি-দিন যায়

জীবনব্যাপী দূরের তুমি

বিষণ্নতা প্রায়


বৃষ্টি পড়ে, একটা চড়ুই

রেলিঙে এক ফাঁকে

দেখেছে কার চুলের কাঁটা

ঘুমায় বইয়ের তাকে


যোগাযোগের হাওয়ায় কাঁপে

সাঁকোটা উত্তরে

তোমার বাড়ির বাদাম গাছও

আমার লেখা পড়ে—!


কেটলিপোড়া বাষ্পতে ঘ্রাণ

মরীচিকায়, জ্বলো

বাকির টাকার চায়ের মতো

দ্বিধায় টলমলো


অহেতু এই জংশনে কেউ

থামে নি একবার

মানুষ সে তার দূরের ছায়া

সরোদ-পারাপার!


১২ 


হঠাৎ ছোঁয়ার পরে মনে হলো

তোমার তো আছে স্বামী, সংসার

আমি সামান্য কেরানীর চিঠি

হাতে হাতে বিলি হই বহুবার—


দুপুরের পাশে নীল সাইকেল

ঝাঁকে ঝাঁকে থেমে আছে কত সালে!

‘যদি কেউ দেখে ফেলে’, কাঁদতেছ

টের পাও কথোপকথনকালে—


তোমার শাঁখার ঘ্রাণে ভাঙে রাত

হরিণেরা নৈঃশব্দ্যে নামে

এ হাওয়া কাদের ছিল আগে আর

বেজেছে সরোদ বন-বিশ্রামে—








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন