নিসর্গের বুকে
আমি এত বয়সে গাছকে বলছি
তোমরা ভাঙা ডালে সূর্য বসাও
হাঃ হাঃ আমি গাছকে বলছি
অন্ধকার হয়েছে আর আমি নদীকে বলছি
তোমার মরা খাতে পরী নাচাও
হাঃ হাঃ আমি নদীকে বলছি
থরায় মাটি ফেটে পড়ছে
আর আমি হাঁটছি রক্তপায়ে
যদি দু-একটা বীজ ভিজে ওঠে
হাঃ হাঃ যদি দু-একটা
নিসর্গের বুকে আমি হাড় বাজাচ্ছি
আর মাদারির মতো হেঁকে বলছি
এই আওয়াজ হয়ে যাবে একমাঠ ধান
ঝিঁ ঝিঁ হুতোম প্যাঁচা শেয়াল
আস্থায়ী আর অন্তরায় রাত ধুনছে
আমি বলছি একমাঠ ধান
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
খুঁজে আনো
ভোরগুলো সব বেমালুম হাওয়া,
নিরেট অন্ধকার থেকে জেগে
একেবারে দাউদাউ দুপুরে।
হাত বাড়িয়ে দিলেই ঝরা পাতা মরা পাতা
আর ইটভাঁটার মুঠোমুঠো ছাই।
কোথায় যে ফুটে আছে ঘুমছোঁয়া শিশিরচোখ
এলিয়ে আছে ভেজা নীলের আকাশ।
খুঁজে আনো ভোরগুলোকে, খোঁজো।
টিটিপাখি
টিটিপাখি ডানা মেলেছে
এই বুঝি উধাও হল দিগন্তে
হয়তো দিগন্তেরও পারে।
তুমি উড়োনা টিটি,
এইখানে বসে তুমি গান গাও
আর গান যদি না আসে তবে কাঁদো
আমাদের এই হাসিকান্নার সংসারে,
সেই তো আমাদের বাঁচা
সত্যিকারের বাঁচা।
তুমি উড়ে পালিও না টিটি।
বাগান
এক বাগান ধুতরো নিয়ে বসে আছি
পোস্টারও লাগিয়ে দিয়েছি
অক্ষরগুলো জোর গলায় হাঁকছে;
‘যদি মরন চাও এসো যদি স্মরন চাও এসো’।
অনেকেই আসছে, আসবেই তো,
বাঁচার হ্যাপা কি কম?
খিদেতেষ্টা আছে প্রেমপীরিত আছে
ধুতরো খেলে সব জ্বালাযন্ত্রনা জুড়োবে,
অবিশ্যি তার আগে একটু ছটফটানি আছে
তবে সে আর কতক্ষনই বা
জীবনের চক্কর তার চেয়ে ভীষনরকম বড়।
কিন্তু ধুতরো বাগানে অনেকে আবার আসছেও না
তারা চলে যাচ্ছে অপরাজিতার কাছে
বিড়বিড় করে বলতে বলতে
‘ও বড় মধুর মরণ’।
তা যদি মনে করো, তবে অমনভাবেই মরো
তোমরা মধুরে মরো অপরাজিতায় মরো।
কিন্তু একবার ধুতরো বাগানে এলে পারতে
রূপলাবণ্য নেই বটে, তবে ধুতরো খেলে
সোজাসাপটা মরণ আছে
ধিকিধিকি জ্বলা নয় রূপসুবাসের জ্বালা নয়
দেখতে দেখতে ঢলে পড়া,
মরণ এবং বাঞ্ছা থাকলেও স্মরনও।
কামিলার সময়ের ভিতরে
সকাল হতেই দেখি গরল ফেনিয়ে উঠছে,
তাহলে শিশির মাড়ায়নি আমা কামিলা,
ওর কপালই এমন।
কোনো চাপা গোঙানিও আমাকে পাঠায়নি,
যেমন ছিল রাত তেমন ভোর।
আমাকে এখন অপেক্ষা করে থাকতে হবে,
কিন্তু কোথায়, কবে পর্যন্ত?
আমার চারদিকে আওয়াজ শুরু হয়েছে
আমি টের পাচ্ছি হাড় ভাঙছে কলযে ছিঁড়ছে
আর মেশিনের জোড়দাঁত খুলছে বন্ধ হচ্ছে
ঠিক আমার সামনে।
এ হল কামিলার সময়
আমাকে উপহার দেওয়া আমার নেওয়া।
ও যখন ফিরবে তখন কি ধুলো হয়ে ফিরবে
আর-এক ধূলোয়?
একজন নিশ্চয় দাঁড়িয়ে
ট্রামবাসের ঝড় এইরকমই বয়,
ভোররাতের কুঁড়িটা মরে
আর আমি টলতে টলতে
তারস্বরে ঘন্টি লাগাই,
থামো,
বুঝি থামলেই আমি জমি পাব।
ওলটপালট হুহু পথ,
দোকানঘরের আগুন
দুই ধারে ছড়িয়ে যায়,
রাস্তার কোণগুলো গনগন করে।
আমার শিরার সব ঢেউ
চোরা পাথরে লাগে
আর আমাকে অস্থির করে,
এই থামো,
আমি এখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ব
যেখানে রাশ রাশ মানুষ ঘুরপাক খায়।
একসঙ্গে অন্ধকারে যাব
মাটির উপর দিয়ে হেঁটে
কখনকার সেই কথা আমি আঁকড়ে আছি।
আমার জন্যে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চৌরাস্তার কাছে
যেখানে ভীষন এলোমেলো টান
যেখানে সমস্ত মুখ ঘুরেযায়
আর অপেক্ষা করার জায়গাগুলো
হলকার ভিতরে কাঁপতে থাকে,
কাউকে ঠাওর করতে পারি না,
থামো, আমি এখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ি,
আমার জন্যে একজন নিশ্চয় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
==========
আরেক আরম্ভের জন্য
আমি বিষের পাত্র ঠেলে দিয়েছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি হাসি আর কান্নার পেছনে আমার প্রথম স্বপ্নকে ছুঁয়েছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি অরণ্যের কাছে গিয়ে ঘাসের ফুলের উপর নত হয়েছি
অবাক হয়ে পুবের দিকে তাকিয়েছি
অবাক হ’য়ে ঝর্ণায় সোনার রং দেখেছি
আমার আশ্চর্য হওয়ার উপহার তুলে ধরেছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি সূর্যের নিচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছি
প্রত্যেক রোমকূপ দিয়ে শুষে নিয়েছি রোদের বিন্দু
আর চৈত্র থেকে আষাঢ়ে আমাকে এগিয়ে দিয়েছি
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি হাটে হাটে ভেসে এসে থেমেছি
মাটিতে পা গেড়ে দিয়েছি
ফুসফুসে ভ’রে নিয়েছি মহুয়ার আর ধানের বাতাস
আমের বোলের বাতাস
মনের মধ্যে এঁকে রেখেছি অঙ্কুর আর কিছু নয়
তুমি প্রসন্ন হও।
আমি জনতার মধ্যে শিশুর কণ্ঠ শুনতে পেয়েছি
আমি কোলাহলের খরজে আমাকে বেঁধে নিয়েছি
এই তো নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো উচ্চারণ করেছি মানুষ
আমি তোমার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে পেরেছি
তুমি প্রসন্ন হও।
==========
গোপণতা
নানা গোপনতার মধ্যে আমি বাস করি,
আমার পায়ের আঙুলে লেগে নুড়ি বাজলে আমি শুনি ঝর্ণা
সে-আওয়াজ কি আর কারো কাছে পৌঁছয়?
একটা ঝিঁঝির ডাক যেই ওঠে সারা বন অন্ধকারে দুলতে থাকে
আর সারা শূণ্য গাছপালার কথা চালাচালিতে ভরে যায়,
ছড়িয়ে পড়ে অরণ্যের ছায়া তারপর কাঁকরমাটির সবুজ
পাহাড় আঁকড়ে-ধরা শেকড়ের খবর আসে,
আমি তা বুকে চেপে রাখি। কেউ কি তা জানে?
কেই-বা জানে আমার রাজ্য-সমাচার?
অনেক গোপনতা ধরে রাখার ফন্দিও আমার অনেক,
যখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে শিরাতন্তু থেকে
আমি হোহো হাসিতে চমকে দিচ্ছি আকাশ,
দ্যাখো দ্যাখো কী ফুর্তিবাজ বলে কত হাততালি জোটে
তখন আমি যেন জয়গর্বে আরো ফুর্তিবাজ হয়ে উঠি,
আমি যে সময়ের চকচকে ধারের উপর পা রেখে হাঁটছি
আমি যে এগিয়ে যাচ্ছি প্রকাণ্ড পাথরচাঙের ফাঁকে
সে-কথা কাওকে আমি জানতে দিই না। কেন দেব?
আমি তো জীবনমরণ খেলায় কাওকে আমার শরিক করিনি।
আমার গোপনতা নিয়ে আমি আছি
সবাই দেখছে চিকচিক চোখের কোণ ঠোঁটের বাঁকা টান
আর আমি দেখছি মুহুর্মুহু মেঘবিদ্যুৎ
বুকের মধ্যে শুনছি সমস্ত ওলটপালটের বাজনা,
গোপনতায় আমি বুঁদ হয়ে আছি।
===========
মধুবন্তী
আমাকে ছিঁড়ছে
কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলছে মধুমন্তী,
আমি শব্দ করতে পারছি না
আমার সব শব্দ গ্রাস করছে মধুমন্তী,
শব্দের যন্ত্রনা এক সুখ থেকে আরেক সুখে লুটিয়ে পড়ছে।
আমি কান পেতে শুনছি
কিন্তু কোথায় আমার কান,
কোন টুকরোয় জ্যোৎস্না হাসছে কোন টুকরোয় রোদের চিৎকার?
আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কুরে কুরে ছড়িয়ে দিচ্ছে মধুবন্তী,
আমার লোমকূপগুলো খুলে যাচ্ছে ঘুরণস্রোতে
ধুয়ে যাচ্ছে তছনছ মুখ কপাল
থুতনির ঢাল বেয়ে অমৃতফোঁটা
ঝরে পড়ছে আমার জামাকাপড়,
আমি জিব বাড়িয়ে চাটব কিন্তু জিব কই?
আমি টেরও পাচ্ছি না কোন রন্ধ্রে আমার নিঃশ্বাস,
আমার ধুকধুক মীড়ে হলকতানে এলিয়ে পড়ে লাফিয়ে উঠে লণ্ডভণ্ড ।
এই মরণ, অথচ আশ্চর্য শোনো শোনো
মধুবন্তীর তুরপুন জড়িয়ে
গান গাইছে গুঁড়ো গুঁড়ো অরুণ
আমাকে নিয়ে কী জাদুগিরিতে যে মেতেছ তুমি মধুবন্তী!
==========
পরিস্থিতি
তোমার পলাশ-গোধূলির রাজ্য
আমি এক ঝলক দেখেছিলাম।
সে কি মায়া না মতিভ্রম?
যাইহোক, তখন থেকেই আমার ছটফটানি :
কবে যাব কবে যাব।
কিন্তু কী করে যাই?
আমাকে যখন তখন ঘিরে ফেলে
আগুন-চোখ বরফ-চোখ
মাঝেমাঝে আড় চাউনির বেড়াজাল,
ঘিরে ফেলে গাড়ি-জট বাড়ি-জট
গলিতে মোড়ে ছোরাছুরির আফসানি।
কী আর বলব, যাওয়া বড় শক্ত।
আমার প্রাণ তো আমি সঁপেই দিয়েছি তোমাকে,
কিন্তু তা যদি টুপ করে ঝরে পড়ে রাস্তায় …
রাস্তা খুঁজতে … তবে?
আমার রক্ত আর তোমার পলাশ-গোধূলি
এমন মিলত,
তখন না হয় যেত সবই ঝরে যেত একসঙ্গে।
এখানে তো আমি হারজিতের পালায়,
আমার হাড়মাংসে হাওয়ার তাত
কী আর করি,
আমি ঘেরাটোপে নিঃশ্বাস নিতে নিতে
ভালোবেসে এক-একবার আঁকড়ে ধরি
তোমার মায়া নাকি আমার মতিভ্রম।
===========
বাসে
সব আশ্চর্য বিষয় থেকে আমি সরে আসি
সরে আসতে বাধ্য হই।
কারণ?
সে তো এক অনন্ত সংখ্যা,
আপাতত দুটোই প্রত্যক্ষ;
একটা বাজারের খোকাথলি
আমা এক হাত আঁকড়ে,
আরেকটা বাসের হাতল হয়ে
আমার অন্য হাতে ধরা।
খোকা যদি হাতে পিছলে পড়ে যায়,
সর্বনাশ;
ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্না এবং তাদের
ছোট ছোট ভাইবোনেরা ডুকরে উঠবে,
হাহাকারে ভরিয়ে তুলবে
আমার মগজের একশ লক্ষ কোষ।
আর হাতল যদি শত্রু হয়ে
অন্য হাতকে ঠেলা দেয়
ঠেলতে ঠেলতে চাকার রহস্যে নিয়ে যায়
তাহলে বাস আর গুমটিঘর
বাজার শাকপাতা রূপোলি আঁশ
আমার জন্যে ঘুরতে ঘুরতে
পৃথিবীর অপরিমিত অন্ধকার হয়ে যাবে।
সাধে কি আমি ঝকঝকে দিনটার মধ্যে
খুব একলা নিবিড় নিবিষ্ট রয়েছি
বাসে?
==========
আর একটু থাকো
তোমাকে এই স্বরব্যঞ্জনে রেখেছি,
তুমি তো মাঠের মেয়ে
খঞ্জনার নাচের মেয়ে,
তুমি ডানা ঝাপটাচ্ছ অনবরত।
আর কতক্ষনই-বা তুমি থাকবে এখানে
আমার এই কলমের নীচে?
তোমাকে ডাকছে রোদের আকাশ
ঝরন্ত ঘামের মাঠ,
এত ভালোবাসতেও তুমি পারো তাদের!
তবু বলছি তুমি আমার আঙুলের ডগায়
এই লাল বিন্দুতে একটু থাকো
আমাকে একটু শেখাও
কী করে রক্তলিপি লিখতে হয়
তারপর সেই ছাপ মাঠময়,
ভরা রোদের আকাশে
তোমার সঙ্গে জ্বলন্ত নাচের বর্ণমালা
আর আমাদের ওড়া একসঙ্গে।
==========
রাস্তা
রাস্তার কথা ছাড়া কী আছে আর?
ঘরগুলোই তো রাস্তায়
উনুনের ধোঁয়ায় কচি আওয়াজ ঘুরছে,
জাদুখেলা চলছে
পুঁতির মালা পুতুল আর রঙিন ছবির,
ছাইগাদার স্বপ্নের চারা
ছোট ছোট পাতা নাড়ছে
খুকীর হাতের লাল রুলি
খোকার ধরা ঘাড়বাঁকানো ঘোড়া
বাতাস মজিয়ে দেখছে,
ক্ষুদে ক্ষুদে পাগুলোর শব্দ ঠিক গানের মতো।
অনন্ত নীল থেকে অনন্তপ্রসাদের গলা;
হেই রাত্রি হেই দিন
পাহাড় থেকে নদী বইয়ে দাও,
জলছপছপ ঘাসের ওপর দিয়ে খোকাখুকুরা
বড়োদের নিয়ে যাক গেরস্থালিতে,
রাস্তারা পড়ে থাকুক রাস্তায়।
==========
ঘাসফড়িং
একটা ঘাসফড়িং এর সঙ্গে আমার গলায় গলায় ভাব হয়েছে,
ভাব না করে পারতামই না আমরা।
ঝিরঝির বৃষ্টির পর আমি ভিজে ঘাসে পা দিয়েছি
অমনি শুরু হয়ে গেল আমাদের নতুন আত্মীয়তা।
সবুজ মাথা তুলে কত খেলা দেখাল ঘাসফড়িং,
তার কাছ থেকে চলে আসার সময় আমার কী মনখারাপ
বলে এলাম আমি আবার আসব,
আমার ঘরের দরজা এখন সবুজে সবুজ।
এই আবার ঝিরঝির বৃষ্টি
আমি কথা দিয়ে এসেছি
ভিজে ঘাসের ওপর আমাকে যেতেই হবে আবার।
==========
এখন খোলা আকাশ
চাঁদোয়ার লতাফুল গলে গিয়েছে
এখন খোলা আকাশ,
চাঁদ তারা সূর্য মেঘ ধ্বনির একই নীলে ভাসে,
এই নতুন শূন্যে আমি তাদের কাছাকাছি
বিলম্বিত লয়ে আমার স্বপ্ন অন্য সংসারে,
মহাজগতের কোনো ঘর
অসীম প্রান্তরের মর্মরে উদ্ভাসিত,
আমি দিনরাতের সীমানা পার হয়ে চলি।
কিন্তু বৃষ্টি নামে ।
হালকা সাদা মেঘ এমন ঘনঘোর হবে কে জানত?
আষাঢ় শ্রাবণ কলস্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমার চোখে মুখে চেতনায়,
ঘুমন্ত উপকূল ভাসিয়ে সমুদ্রও এসে যায়
আর বাতাসে ভরে পঞ্চমুখী শাঁখ;
গুরুগুরু মেঘ সমুদ্র হৃৎপিণ্ড
ধমনির বিদ্যুৎ গমক
উতরোল নির্জনতা।
বৃষ্টি থামে।
ঘাসের ডগায় কচুপাতায় টলটলে ফোঁটা,
সুস্থির নিশ্বাসে তাদের ধরে রাখতে হয়;
আলোর দিকে অন্ধকারের দিকে মিড়
আমাদের চিরকালের আপন বসুন্ধরা
ললিত রঙের ছটা পুবে
পটদীপে সাজানো সন্ধ্যা
গম্ভীর রাত্রি যোগে আবিষ্ট প্রাণ ।
কখন আমি চোখ বন্ধ করেছি জানি না,
উত্তরঙ্গ পথের ওপর শান্তির আভা ফুটছে দেখি।
পাশ থেকে কে একজন জিজ্ঞেস করে কটা বাজল;
কী করে বলব?
আমি তো সময়ের আরম্ভে রয়েছি।
==========
একটি সূর্যাস্ত
সোনার রোদে অস্ত্রগুলো ফুটে উঠেছে
রক্তস্রোতেও আহামরি আভা।
আমি একেবারে বিভোর হয়ে গিয়েছি,
দৃশ্যের এমন বদল আমি কি ভাবতেও পেরেছিলাম কখনও?
আমার সামনে ছিল ধানক্ষেত সোহাগি মাটি
দৃষ্টির সীমায় নদীর রহস্য।
সেখানে অন্ধকার ফেটে বেরিয়ে চারাগুলো বাড়ছিল,
জোয়ান জোয়ান হাত
আকাশটাকে খুব উঁচু করে তুলে ধরেছিল
এবং ছেলেমেয়েরা প্রজাপতিদের সঙ্গে ঘুরঘুর করছিল।
এ যাবৎ কোনো দিনান্তই আমাকে নাড়া দেয়নি,
কিন্তু আমার সাধ ছিল বলবার মতো একটা সূর্যাস্ত দেখব।
তা, দেখা গেল শেষ পর্যন্ত,
অতঃপর বারান্দাটা যদি ভেঙ্গে পড়ে পড়ুক।
এই মুহূর্তে বিখ্যাত সূর্য ঝুলে পড়েছে
এবং ইস্পাতের পঙ্গপালের ওপর শোভা ঢ়ালছে,
আমি যাদের দেখেছিলাম তারা কেউ আর স্পষ্ট নেই
কেন না তারা শস্যের গলা জড়িয়ে মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে,
আমি বারান্দায় স্তব্ধ দাঁড়িয়ে,
তীক্ষ্ন উজ্জ্বল ফলক থেকে
আমার ওপর রক্তের রং ঠিকরে পড়ছে।
আমি এক অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখছি।
==========
যেখানে উত্তাপ নেই
আমি বন্ধু হতে চেয়েছি
তাই দেয়ালে ঘা দিয়ে কথা বলেছি,
আড়ালের ওধারে
সংকেত করেছি
প্রান্তর আকাশ আর শস্যের
মোহনার,
আমার কথার মধ্যে নিয়ে এসেছি কত ঢেউ
ঘরের যে-অল্প আলোয় কেউ আমার মুখ দেখতে পায় না
আমি তাকে নিবে যেতে দিইনি
আমার সমস্ত আশার মধ্যে তাকে ধরে রেখেছি
মনে মনে সূর্যের মতো বাড়িয়েছি,
নিথর বাতাস
আমার ফুসফুসের আবেগে কাঁপিয়েছি।
তাই তো অবশেষে মৃত্যুকে বন্ধুর মতো বললাম
তুমি আমার উত্তাপ নাও
তুমি আমার দৃষ্টি নাও
পৃথিবীকে ধরে রাখবার আগ্রহ
তুমি আমার এই হাতে থেকে টেনে নাও।
কিন্তু মৃত্যু সে কথা শোনেনি।
শস্যের সীমানা থেকে আমি এখন কতদূরে
তার কোন হদিশ পাই না
আমার পায়ের শব্দ সরে এসেছে এক গহ্বরের ধারে
তার মধ্যে তাকালে আমি অন্ধ হয়ে যাই ।
যেখানে সব উষ্ণতা উবে গেল
সেখানে আমাকে এখন স্মৃতির মতো কারা রাখবে,
আমাকে নতুন বন্ধুত্ব দেবে?
আমি ঘুরেছি পাথর পোড়ামাটির দিকে
কাঁটাবনে রাত্তিরের দিকে
বলছি আমাকে পাথর আর পোড়ামাটিতে গড়ো
আমাকে কাঁটাবন আর রাত্তিরের মধ্যে ধরো।
===========
আহ্বান
কখনো-কখনো
মাথা তুলি পিপাসার গহ্বর ছাড়িয়ে ;
তোমার অমৃত-চোখ কী দেখে তখন
কী দেখে আমার মুখে?
হয়তো মহিম্ন স্তোত্র পাঠ করো বিধ্বস্ত কপালে,
প্রথম পাখির ঊষা বুঝি জেগে ওঠে বন্য চুলে
কিংবা কোনো জ্যোতিষ্মান কথার ঝংকার তুমি শোনো দুই ঠোঁটের পেষণে।
তোমার উদবেল বাহু তরঙ্গের জোয়ারে ভাসায়
দিগবলয় অন্ধ পথ সূর্যাস্ত বাসনা;
আমি কি অবাধ্য নৌকা
আলেয়ার তীর ঘেঁষে ডুবে যাব উচ্ছ্বাসের ফুঁয়ে?
হয়তো তা জানো তাই বননীল জাদু
ভুলে গিয়ে কাঁপো তুমি
শীতের গাছের মতো কখনো-কখনো।
এর চেয়ে ভালো তুমি
নেমে এসো পিপাসার গহ্বরে আমার,
তোমার অমৃত-চোখ খুঁজে পাঁক দিশা
অঙ্গের জ্বলন্ত রোদে,
জ্বলুক নিখুঁত মিলে আমাদের সহমর তৃষা…
==========
বর্ষমান
থমথমে বাড়ির সারিকে
অসহায় করে
বৃষ্টি এল।
এক বন থেকে অন্য বনে বিচ্ছুরিত সঘন গমক
এসে জোটে চৌকাঠের ধারে
মাথা কোটে বিষাক্ত গরজে,
সর্বাঙ্গে আপন করে তাকে ঘুম পাড়াবার
আমার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল,
কয়লার ধোঁয়ার কুয়াশার
গ্রন্থিল স্পর্শের নীচে ধমনি কাতর।
পাঁচিলে গুলির দাগ স্ফীত হয়
জলে ভিজে,
দৈত্যের প্রকাণ্ড লুব্ধ মুঠির আকারে
স্ফীত হয় স্তম্ভিত প্রদোষে,
খরশান হাজার বল্লমে
পর্দাগুলো ছিঁড়ে কুচিকুচি
অলিন্দ চত্বর অসহায়।
আমার এ-শহরের মাঝখানে নির্জন নদীর
ঘাস-মোড়া পাড়ে
পায়ে পায়ে মরা পথ বেয়ে
জাহাজঘাটায় আজ যদি যাওয়া যায়
দেখা যাবে সমস্তই অস্পষ্ট কাঠামো।
ঝাপসা ওড়না ছিঁড়ে
জাগল মন্থর
সংকীর্ণ কপাল সাদা,
সাদা ঠোঁট হিম গাল
স্তনভাঙা নিমীলিত ত্বক ।
করুণ আশ্রয়প্রার্থী অবয়বে দ্বিধা
আমাকে পীড়িত করে,
সায়াহ্ন দুঃস্বপ্ন আসে জলে ভেজা পাঁচিলের কূলে।
দ্বিধা ছাড়ো
তুমি দ্বিধা ছাড়ো
অন্ধ গলিমুখে
নিঃশব্দ কী হাসির বিদ্রুপ তোমাকে বিশ্লিষ্ট করে
তুমি জানো আমিও তা অনুভব করি।
বিভক্ত প্রতীক্ষা কেন
আর কেন?
হে সাথি
বৃষ্টি এল।
==========
শিশু
ছন্দ গেঁথে দেওয়া যেতে পারে
চোখ ফিরিয়ে দুলে বা না দুলে
অন্ত-মিল দেওয়া–তাও যায়
বন্ধ চোখে মন যা আওড়ায়
এই যেমন দিলাম এখন।
কিন্তু সে আমাকে এরকম করতে দেয় না যখন তখন নাটমঞ্চ ছরকুট করে চোখের দুই পাতার মধ্যে চলে আসে আদুড়-গা বাচ্চা। দিনরাত্তির বলে কথা নেই আস্তাকুঁড়ের পাশে বা ফুটপাথে বা ধসা দাওয়ায় রাত্তিরটা খুব ছোটো আর দিন তো জ্বলে ওই জায়গাগুলোর বুকে, ওইখান থেকে আসে। ওইখানে এইখানে অক্ষরের ছড়াছড়ি শহরের কাগজে কাগজে দেওয়াল জুড়ে ছয়লাপ শব্দের নকশা ঢাকঢোল চোঙে গেরামভর। কী করবে সে? মস্ত হাঁ করে কিন্তু অক্ষর সে খেতে পারে না শব্দ সে খেতে পারে না। খিদে খিদে খিদে। তখন হাপর থেকে ছিটকে পড়ে জ্বলুনি সমেত একেবারে আমার চোখের গোড়ায়। শীত গ্রীষ্ম বলে কথা নেই খোলা চামড়ায় বেজায় তাত লাগে। রাস্তা পুড়ে ছাই-ছাই অথচ তাত ঘষে তার ফুলকি ছিটোতে ছিটোতে এইখানে। ঠাণ্ডায় গরমে এমন। আহা নিষ্পাপ শিশু! কিন্তু সে কী করবে? আহা নিষ্পাপ–কিন্তু সহানুভূতি সে খেতে পারে না দরদ সে খেতে পারে না। খিদে খিদে খিদে। এত শব্দ আর অক্ষরের ফাঁকে তাঁর চিৎকার এইখানে আগুনে।
==========