হুমায়ুন আজাদের ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ১২টি উপন্যাস ও ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক, ৮টি কিশোরসাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধসংকলন মিলিয়ে ৬০টিরও অধিক গ্রন্থ তার ...সন্তান: মৌলি আজাদ; স্মিতা আজাদ; অনন্য আজাদসক্রিয় বছর: ১৯৭৩, ১৯৮০ - ২০০৪ মৃত্যু: ১২ আগস্ট ২০০৪ (বয়স ৫৭
আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।
যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।
আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।
না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।
তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।
শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।
আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য – হুমায়ুন আজাদ
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।
আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি- হুমায়ুন আজাদ
রয়েছে ধারালো ছোরা স্লিপিং টেবলেট
কালো রিভলবার
মধ্যরাতে ছাদ
ভোরবেলাকার রেলগাড়ি
সারিসারি বৈদ্যুতিক তার।
স্লিপিং টেবলেট খেয়ে অনায়াসে ম’রে যেতে পারি
বক্ষে ঢোকানো যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল তরবারি
কপাল লক্ষ্য ক’রে টানা যায় অব্যর্থ ট্রিগার
ছুঁয়ে ফেলা যায় প্রাণবাণ বৈদ্যুতিক তার
ছাদ থেকে লাফ দেয়া যায়
ধরা যায় ভোরবেলাকার রেলগাড়ি
অজস্র অস্ত্র আছে
যে-কোনো একটি দিয়ে আত্মহত্যা ক’রে যেতে পারি
এবং রয়েছো তুমি
সবচেয়ে বিষাক্ত অস্ত্র প্রিয়তমা মৃত্যুর ভগিনী
তোমাকে ছুঁলে
দেখলে এমনকি তোমার নাম শুনলে
আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি।
আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য – হুমায়ুন আজাদ
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর – হুমায়ুন আজাদ
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল,
তা নয়। তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর। কারো কষ্টের
কথা এখানে চাপা থাকে না। শুনেছি আমাকে
ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে
তোমার। পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা
তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম।
যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি কি জানো না গাধারা কখনো
অগ্নিগিরিতে চড়ে না?
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যূৎ আছে, তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যূতে
দপ ক’রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যূৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলে সে নাকি ভাবে
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না। আমি জানি তোমার কতোটা দরকার
শারীরিক তাপ। গাধারা জানে না।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু’টি ভয়ংকর ত্রিভুজ। সে-খবর
পায় নি গাধাটা। গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম
জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।
তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক। তুমি যেখানে
নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না। গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!
তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে? ভেবেছিলে গাড়ি, আর
পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে, আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?
শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্ত কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।
আমার অশ্রু- হুমায়ুন আজাদ
মূলঃ হেনরিক হাইনে
আমার অশ্রু এবং কষ্টরাশি থেকে
ফুটে উঠে ফুল থরে থরে অফুরান,
এবং আমার দীর্ঘশ্বাসে
বিকশিত হয় নাইটিংগেলের গান ।
বালিকা, আমাকে যদি তুমি ভালোবাসো,
তোমার জন্য সে ফুল আনবো আমি—
এবং এখানে তোমার দ্বারের কাছে
নাইটিংগেলেরা গান গাবে দিবাযামি ।
আমাদের মা- হুমায়ুন আজাদ
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।
সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে-হুমায়ুন আজাদ
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমার কুঁড়েঘরে __হুমায়ুন আজাদ
আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক
আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই
আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক
আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই
একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে
আগুন জ্ব’লে ওঠে তীব্র লেলিহান
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক’রে
আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক
আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়
সে-তাপে গ’লে পড়ে আমার দশদিক
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে
বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক
আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক।
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় __হুমায়ুন আজাদ
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখি না এ লাশ
আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে __হুমায়ুন আজাদ
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারন করতে চেয়েছিলাম আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতো করেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে বলতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবত গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।
আমি মাংসের টুকরা থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্য পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্য নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সবকিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছে তাকে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জরিয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম
অন্যদের সময়ে।