নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেরা কবিতা সংগ্রহ



নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯ অক্টোবর ১৯২৪) একজন ভারতীয় বাঙ্গালি কবি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভুত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম। উলঙ্গ রাজা তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্হ। এই কাব্যগ্রন্হ লেখার জন্য তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি পশ্চিমবঙ্গে বাংলা আকাদেমির সাথে দীর্ঘকাল যুক্ত। ২০১৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷ 




বাবুর বাগান


যে যেখানে পারে, সেইখানে থোয়
কেড়েকুড়ে আনে যা সে,
কিছু থাকে তার হাতের মুঠোয়,
কিছু ঝরে যায় ঘাসে।
যে সে রেখেছিল লোহার খাঁচায়,
হয়েছে পাখির দানা
কিছুটা মোরগে ঠুকরিয়ে খায়,
কিছু শালিখের ছানা।

সিঁদকাঠি হাতে গর্ত খুঁড়ছে
এই রাত্রে যে, তার
জানা নেই তারই পিছনে ঘুরছে
তিন জোড়া বাটপার।
যে সেখানে পারে, রাখে সেইখানে
কেড়ে-আনা টাকাকড়ি,
তাই দেখে হাসে বাবুর বাগানে
শ্বেতপাথরের পরি।



যেখানেই যাই

যেখানেই যাই, যে-বাড়িতে কড়া নাড়ি,
কেউই দেয় না সাড়া,
সব রাস্তাই ফাঁকা, সাত-তাড়াতাড়ি
ঘুমিয়ে পড়েছে পাড়া।

সেখানেই যাই, ঘুমিয়ে রয়েছে আজ
সবার কাছে ও দূরে,
অথচ আমার কড়া নাড়বারই কাজ
পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে।


ভরদুপুরে


হরেক রাস্তা ঘুরতে-ঘুরতে
ভরদুপুরে পুড়তে-পুড়তে
কোথার থেকে কোথায় যাওয়া।

আকাশ থেকে জলের ঝাড়ি
হয়নি উপুড়, গুমোট ভারী,
কোত্থাও নেই কিচ্ছু হাওয়া।

এই, তোরা সব চুপ কেন রে?
আয় না হাসিঠাট্টা করে
পথের কষ্ট খানিক ভুলি।

কেউ হাসে না। ভরদুপুরে
আমরা দেখি আকাশ জুড়ে
উড়ছে সাদা পায়রাগুলি।



হাসপাতালে–১


অষ্টপ্রহর কাছাকছি
ভনভনাচ্ছে হাজার মাছি,
তোর সেদিকে না-দিয়ে কান
সব সময়ে সিধে-সটান
দাঁড়িয়ে এখন থাকতে হবে।
তেমনভাবে দাঁড়িয়ে আমি থাকলুম কই।

পাল্লা যখন যে-দিক ঝোঁকে
সেইদিকে ব্যাঙ-লাফায় লোকে।
লাফাক গে, তুই শক্ত থাকিস
সব সময়ে মনে রাখিস
নিজের শপথ রাখতে হবে।
কিন্তু আমি সকল শপথ রাখলুম কই।

বর্ষা কাটছে, এখন আকাশ
বলছে, আসছে আশ্বিন মাস।
হিসেবপত্র ফেলে রেখে
ফিরছে সবাই বিদেশ থেকে–
এই ছবিটাই আঁকতে হবে।
কিন্তু আমি এমন ছবি আঁকলুম কই।



থাকা মানে


থাকা মানে কিছু বই, থাকা মানে লেখার টেবিল,
থাকা মানে আকাশের নীল,
পুকুর পড়েছে রোদ, গাছের সবুজ
ছাতের কার্নিসে দুটি পাখি,
জলের ভিতর কিছু চোরা টান, সায়ংকালীন
স্তব্ধতার মধ্যে ধীরে-ধীরে
একা-নৌকাটির ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া।

ভাদ্রের গুমট ভেঙে বৃষ্টির খবর নিয়ে ছুটে আসে হাওয়া,
যা এসে বুকের মধ্যে লাগে।
থাকা মানে মানুষের মুখ, ঘাম, ক্লান্তি ও বিষাদ,
যা নিয়ে সংসার, তার সবই।
থাকে মানে দুঃখ-সুখে, সংরাগে-বিরাগে
সবকিছুকে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা।

থাকা মানে আলোতে-কালোতে আঁকা ছবি,
যে-ছবি তাৎপর্যে ভরা, অথচ সম্পূর্ণ অর্থহীন।
থাকা মানে তারই মধ্যে বেঁচেবর্তে থাকা।





ভোরের ভিমরুল


রাগী ভিমরুলের মতো কয়েকটি বালক ওই দৌড়ে চলে যায়।
কাল সারা রাত খুব বৃষ্টি হয়েছিল।
এখন আকাশে মেঘমুক্ত, তার কোত্থাও দেখি না
কোনো কলঙ্কের দাগ, চিল
অনেকটা উঁচুর নীলে ফিরে গিয়ে ডানা ছড়িয়েছে।
এমন সুন্দর ভোর শ্রাবণে ও ভাদ্রে মাঝে-মাঝে
অলীক দৃশ্যের মতো দেখা দেয়।
দেখা দিলে আবার নতুন করে নিজস্ব নিয়মে
বাঁচতে সাধ জাগে।
সকলে ডেকে-ডেকে বলতে ইচ্ছা করে:
ভাল থাকো।
আদিত্যবর্ণের ছোঁয়া লাগুক সমস্ত বাসনায়।

তবু তারই মধ্যে ছন্দ-পতনের মতো
রাগী ভিমরুলের ঝাঁক দৌড়ে চলে যায়।

এত যে বয়স হল, তবু আজও এমন যাওয়ার
তাৎপর্য বুঝি না।
বুঝতে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে ভিতরে তাকাই।
দেখি যে, সেখানে আজও মেঘমুক্ত আকাশের মতো
আরও একটা সকাল হয়েছে।


সত্য সেলুকাস


মন্দির না মসজিদ না বিতর্কিত কাঠামো, এই
ধুন্ধুমার তর্কের ভিতর থেকে
কানা-উঁচু পিতলের থালা বাজাতে-বাজাতে
বেরিয়ে এল
পেটে-পিঠে এক হয়ে যাওয়া, হাড়-জিরজিরে দুটি
নেংটি-পরা মানুষ।
তাদের পাথার উপরে দাউদাউ করে জ্বলছে মধ্যদিনের সূর্য।
তবে পরপর কয়েকটা দিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, তাই
তাদের ফুটিফাটা পায়ের তলায়
আর্যাবর্তের ঘাস এখনও হল্‌দে হয়ে যায়নি।

ভিড়ের মধ্যেই ছিল বটে, আর মাঝেমধ্যে তালিও বটে
বাজিয়েছিল, তবে
ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা লোকগুলোর এই
তর্কটা যে ঠিক কী নিয়ে,
তার বিন্দুবিসর্গও তারা জানে না।
সভাস্থলের একটু দূরে
ঝাঁকড়ামাথা একটা তেঁতুলগাছের তলায় বসে
পিতলের থালায় এক চিমটি নুন ছিটিয়ে
ছাতু ঠাসতে-ঠাসতে
তবুও যে তারা হাসছে, তার কারণ, তাদের
একজনের নাম হতেই পারত সিকান্দর শাহ্‌ আর
অন্যজনের সেলুকাস

ভিড়ের ভিতর থেকে
পিতলের থালা বাজাতে-বাজাতে বেরিয়ে এসেছে দুই
লেংটি-পরা ঐতিহাসিক পুরুষ।
তাদের মাথায় উপরে জ্বলছে অনাদি ভারতবর্ষের আকাশ, আর
ইতিমধ্যে কয়েকটা দিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, তাই তাদের
ফুটিফাটা পায়ের তলায়
আর্যাবর্তের ঘাস এখনও হল্‌দে হয়ে যায়নি।



অন্ধকারে, একলা মানুষ

 
ঠাট্টা, হাসি, গান, কলরব
যেই থেমেছে, দূরে কাছে
দেখছি পথের সঙ্গীরা সব
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ব্যাপার কী, আর গল্প কি নেই?
রাস্তাটা যে অনেক বাকি।
চোখ তুলে কালপুরুষ দেখেই
ফুরিয়ে গেল সব কথা কি?

সত্যি ছিল সঙ্গীরা? ধুস্‌।
মধ্যরাতে পথের ধারে
এই তো আমি একলা মানুষ
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে।




গল্পের বিষয়


আমার তিন বন্ধু অমিতাভ, হরদয়াল আর পরমেশের সঙ্গে
আজকাল একটু
ঘনঘনই আমার দেখা হয়ে যাচ্ছে।
কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে
কখনও বালিগঞ্জের লেকে,
কখনও বা
উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কের সেই
দেহাতি চা’ওয়ালার দোকানে,
গরম জলে চায়ের বদলে যে রোজ
হোগলা আর শালপাতার সঙ্গে এক-টুকরো
আদাও ফুটিয়ে নেয়।

ভিক্টোরিয়ার বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের
গল্প হয়।
বালিগঞ্জের লেকের ধারে ছন্নমতি
বালক-বালিকাদের কাণ্ডকারখানা দেখতে-দেখতে আমাদের গল্প হয়।
দেশবন্ধু পার্কের ঘাসের উপরে উবু হয়ে বসে
ভাঁড়ের চা খেতে-খেতে আমাদের
গল্প হয়।
তবে যে-সব বিষয়বস্তু নিয়ে আমাদের গল্প হয়,
তার তাৎপর্য এখনকার মানুষরা ঠিক
বুঝবে না।

আমাদের গল্প হয়
মধ্য-কলকাতার সেই গলিটাকে নিয়ে,
গ্যাসের বাতির সবুজ আলোর মধ্যে
সাঁতার কাটতে-কাটতে
রাত বারোটায় যে হরেক রকম স্বপ্ন দেখত।
আমাদের গল্প হয়
এই শহরের অঘ্রাণের সেই ঘোলাটে আকাশটাকে নিয়ে,
শীলেদের বাড়ির মেঝো-তরফের বড় ছেলের
বিয়ের রাত্তিরে
চিনে কারিগর ডাকিয়ে যাবে
মস্ত-মস্ত আলোর নেকলেস পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের গল্প হয়
কাঞ্চন থিয়েটারের প্রম্‌টারের সেই মেয়েটিকে নিয়েও,
আমরা প্রত্যেকেই যাকে একদিন
একটি করে গোড়ের মালা উপহার দিয়েছিলুম।

শেষের এই গল্পটা চলবার সময়ে আমরা
কেউই যে কিছুমাত্র
ঈর্ষার জ্বালায় জলিনা, বরং চারজনেই চার
উজবুকের মতো
হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকি,
তার কারণ আর কিছুই নয়, আমরা প্রত্যেকেই খুব
বুড়িয়ে গেছে।




ঘরে চন্দ্রমা


বুঝতে পারিনি আমি তার কথা
সে তবু রয়েছে দাঁড়িয়ে।
যেন-বা মূর্ত্তিময়ী সরলতা
চেনা ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে
স্বপ্নে অন্য জগতে দিয়েছে পাড়ি,
যেখানে ভিন্ন রকমের ঘরবাড়ি,
ভিন্ন বর্ণ-গন্ধের কাড়াকাড়ি
দেয় মানবিক নানা বৃত্তি ও
নানা বিশ্বাস নাড়িয়ে,
যেখানে চল্‌তি অর্থগুলিও
অনর্থে যায় হারিয়ে।
চিত্রার্পিত ভঙ্গিটি তার,
সে আছে দাঁড়িয়ে দরজায়,
যেন ছোঁয়া লাগে চিরায়মানার
অচির জীবনচর্যায়।
এত যে বয়স, তবু এই সংসারে
যা আমাকে আজও হাড়ে-মজ্জায় মারে,
কে তাকে ডোবাল জ্যোৎস্নার পারাবারে।
শেষের পরিচ্ছেদে আরবার
শুরু হল কোন্‌ পর্যায়।
ঘরে চন্দ্রমা, বাহিরে আঁধার
আক্রোশে ওই গর্জায়।



জ্যোৎস্নারাতে


আমি বললুম, সুন্দর।
এই আশ্বিন মাসে
রহস্য তার লেগেছে অপার
বিমুক্ত নীলাকাশে।
আমি বললুম, এসো।
সে তবু আসে না কাছে।
মায়া দিয়ে গড়া
জ্যোৎস্না অধরা
দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি ভাবি, এ কি বিভ্রম?
দাঁতে ঠোঁট চেপে হেসে
তখুনি সে ঘরে
ধুলোর উপরে
ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে।



এই অবেলায়


ওই যে গোলাপ দুলছে, ও কি
ফুল না আগুন, ঠিক বুঝি না।
এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে আসি,
ভাবতে থাকি ধরব কি না।

ভাবতে থাকি, ঠিক কতবার
ফুলের বনে ভুল দেখেছি।
ভরদুপুরে গোলাপ ভেবে
অগ্নিশিখায় হাত রেখেছি।

গোলাপ, তুমি গোলাপ তো ঠিক?
হও যদি সেই আগুন, তবে
এই অবেলায় ফুলের খেলায়
ফের যে আমায় পুড়তে হবে।




নদী কিছু চায়


নদী গ্রাস করে নিচ্ছে সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি।
নিকোনো উঠোন থেকে ঠাকুরদালানে,
ঘরে, বারান্দায়, সবখানে
এখন দিনে ও রাত্রে শুনে যাই তারই
তরঙ্গের ছলোচ্ছল শব্দ। আমি ঘুমের ভিতরে
ডুবে গিয়ে যে-শব্দ শুনেছি চিরকাল,
বিনিদ্র প্রহরে আজ উথালপাথাল
সেই শব্দ চতুর্দিকে ঘোরে।

নদী কিছু চেয়েছিল, চেয়েও পায়নি, তাই তার
জল উঠে এসেছিল সীমানা ছাড়িয়ে।
সবকিছু ভেঙেচুরে পেটের ভিতরে টেনে নিয়ে
সে তাই আবার
ফিরে গেছে নিজের নির্দিষ্ট সীমানায়।

শুধুই দেয় না নদী, কিছু চায়, চিরকাল চায়।




মনে পড়ে


ভুলে গেলে ভাল হত, তবু ভোলা গেল না এখনও।
পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, তবু কোনো-কোনো
মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে।
স্রোতের গোপন টানে ভেসে যায় পিতলের ঘড়া।
অথচ বেদনা তার থেকে যায়। তাই বসুন্ধরা
কেঁপে ওঠে ফাল্গুনের ঝড়ে।
মনে পড়ে, মনে পড়ে, এখনও তোমাকে মনে পড়ে।




হেলং


এ যেন আরণ্য প্রেত-রাত্রির শিয়রে এক মুঠো
জ্যোৎস্নার অভয়।
অন্তত তখন তা-ই মনে হয়েছিল
সুন্দরী হেলং, সেই পাহাড়িয়া বৃষ্টির তিমিরে।
সকাল থেকেই সূর্য নিখোঁজ। দক্ষিণে
স্পর্ধিত পাহাড়। বাঁয়ে অতল গড়খাই
উন্মাদ হাওয়ার মাতামাতি
শীর্ণ গিরিপথে।
যেন কোনো রূপকথার হৃতমণি অন্ধ অজগর
প্রচণ্ড আক্রোশে তার গুহা থেকে আথালি-পাথালি
ছুটে আসে; শত্রু তার পলাতক জেনে
নিজেকে দংশন হানে, আর
মৃত্যুর পাখসাট খায় পাথরে-পাথরে।

উপরে চক্রান্ত চলে ক্রূর দেবতার। ত্রস্ত পায়ে
নীচে নেমে আর-এক বিস্ময়।
এ কেমন অলৌকিক নিয়মে নিষ্ঠুর
ঝঞ্চা প্রতিহত, হাওয়া নিশ্চুপ এখানে।
নিত্যকার মতোই দোকানি
সাজায় পসরা, চাষি মাঠে যায়, গৃহস্থ-বাড়ির
দেয়ালে চিত্রিত পট, শান্ত গাঁওবুড়া
গল্প বলে চায়ের মসলিসে।
দুঃখের নেপথ্যে স্থির, আনন্দের পরম আশ্রয়
প্রাণের গভীরে মগ্ন, ক্ষমায় সহাস্য গিরিদরি–
সুন্দরী হেলং।

অন্তত তখন তা-ই মনে হয়েছিল
তোমাকে, হেলং, সেই পাহাড়িয়া বৃষ্টির তিমিরে।
এবং এখনও মনে হয়,
তীব্রতম যন্ত্রণার গভীরে কোথাও
নিত্য প্রবাহিত হয় সেই আনন্দের স্রোতস্বিনী
যে জাগায় দারুণ ভয়ের
মর্মকষে শান্ত বরাভয়।।
মনে হয়, রক্তরং এই রঙ্গমঞ্চের আড়ালে
রয়েছে কোথাও
নেপথ্য-নাটকে স্থির নির্বিকার নায়ক-নায়িকা,
দাঁড়ে টিয়াপাখি, শান্তি টবের অর্কিডে।



অমলকান্তি

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।




হেমলতা

কিছু কথা অন্ধকারে বিদেশে ঘুরছে,
কিছু কথা বাতাসে উড়ছে,
কিছু কথা আটকে আছে পাথরের তলে,
কিছু কথা ভেসে যাচ্ছে কাঁসাইয়ের জলে,
পুড়তে-পড়তে শুদ্ধ হয়ে উঠছে কিছু কথা।

হেমলতা,
তুমি কথা দিয়েছিলে, আমি দিতে এখনও পারিনি,
তাই বলে ছাড়িনি
আজও হাল।

বাতাসে আগুনে জলে উদয়াস্ত আজও মায়াজাল
টেনে যাচ্ছি, জোড়-মেলানো কথা
যদি পাই, তোমাকেই দেব। হেমলতা,
এক্ষুনি ভেঙে না তুমি ঘর।
ধৈর্য ধরো, ভিক্ষা দাও আর মাত্র কয়েকটি বছর।


উলঙ্গ রাজা

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।
গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।
নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন