রণদৌড়ের ঘোড়া
❑❑
তুমি সুন্দর, তুমি শারীরিক
বসন্তের কাম আলুথালু
ফুলদের পাশে শুয়ে শুয়ে
দেখে যাচ্ছি।
কথা কমছে, শ্বাস বাড়ছেই
মাথাভর্তি যেন চুল নয়,
কচি ধানক্ষেত
আঙুল ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে খুব হচ্ছে।
রণদৌড়ের ঘোড়া যেন এক
এসে সামনেই নত, বলছে—
আর কিছু নয়, দিগ্বিজয় নয়
চাই তোমাকেই, হৃদয় টলছে।
ধরছ না, হায়, এমন তপ্ত
গলিত লোহা এ
আগ্নেয়মুখে অগ্নিস্নানে লাল…
প্রেম নাকি পাপ
কটেজের রাত মুছে দিচ্ছে এ সমস্তই।
মনে পড়ছে না সেই ব্যথাদেরও যারা
প্রশমিত হতে পারে নাই।
ওই বাহুডাল যেন রাস্তাই,
দুর্ঘটনার নেই শঙ্কাও।
ফোঁটা বৃষ্টির মতো রোমকূপ জুড়ে কম্পন,
তুমি কাঁপছ, কী যে টের পাই!
স্তনবৃন্ত এত ভালো লাগে যেন সমতলে
অমসৃণ গোল ভূমি আর সামান্য ঝোপঝাড়
নাকে ঘষছি।
- আরো পড়ুনঃ সজল আহমেদ এর দীর্ঘ কবিতা সংগ্রহ
তির্যক চোখ
তৃষ্ণার বনোভূমিতেই পথ হারিয়েছে,
তাতে ঝরাপাতা ঝ’রে পাতার উপর,
মৃদু ঝরে পড়ার শব্দ।
শীৎকারও এই সুনসানে এক সাইলেন্ট রূপমাত্র,
অধীর ঝর্না পাথর-খাঁজে ছড়ার চলন বুঝে নিচ্ছে।
এত তীব্র যেন সূর্য—
ঝুমসন্ধ্যায়
সাগর-জলে ঢুকে যাচ্ছ।
এই দৃশ্যও
যত সত্য তত মিথ্যে,
জানি অন্য আরেক দেশে
তুমি সকালের রোদ হচ্ছ।
পরিসংখ্যান
***********
যেকোনো যুদ্ধ শেষে হাড়গোড় খুঁটে নিই,
কররেখার বদ্ধ ঘরে তুলে রাখি
মানুষের মৃত সন্তান ৷
যেকোনো মগ্ন রাতে হাতের পৃষ্ঠা মেলে
সাঁতরানো রক্তের দাগ মোছা কিছু নয় ৷
এখানে নয়টি মাস ৷
এখানে হাড়ের সাথে বাবার কপাল মোছা বিবর্ণ গামছার ঘ্রাণ ৷
খুলির কোটরে পাওয়া নোলকটি কার শ্বাসে
ঘাসফুল হয়ে কাঁপতো ! শাড়ির টুকরোয় দুধের গন্ধ,
খোকাটি কোথায় ?
ছিন্ন যে ডানহাত
অভিমানি বোনটির ভাঙা লাল চুড়িদের পাশে শুয়ে আছে,
তার ভাইটি যুদ্ধে গেছে ৷
উড়ে যাওয়া ব্রীজের পাশেই ধানখেত,
এবড়োখেবড়ো নদীপাড় , জলের গভীর থেকে
না ফেরা ছেলের মুখ
মায়া_ হাহাকার
আর বন্দিশালার ঘন অন্ধকারের কোলে
ঝরে যাওয়া মৃত্যুমুখী যোনিফুল
কুড়োতে কুড়োতে
দাঁড়াতে পারছি না যেন ৷ কান্নাপোকা চোখে ঢুকে কামড়ে দিচ্ছে খুব, তাকাতেই দিচ্ছে না আর।
জন্মদিনে
^^^^^^^^^^
তেমন বিষাদ কই প্রথম শ্বাসের মতো
তেমন আনন্দ কই প্রথম কান্নার মতো!
বয়স বাড়ার দিনে
জীবনের গাঢ়তম রেখাটিকে খুব মনে পড়ে
আর কিছু অমিমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে
শরীর ঘনায়ে আসে শরীরের আত্মার কাছে।
সকাল, উত্তরহীন আসে
দুপুর শুকায়ে আসে
আবার রাতের কাছে ফিরবার আগে, সন্ধ্যায়।
আনন্দ-জোনাকীরা ছুটে যাক উৎসবের দিকে
জীবনের পূর্ণতা কামনার পেয়ালাও জানে
পূর্ণতা বলে জীবনের কিছুই থাকে না কখনোই।
কেবল আনন্দ থাকে,
আনন্দের স্মৃতিধারা বইতেই থাকে।
অথচ নিকটতম ফুল থেকে বিচ্ছেদের দিনে
মহাকাশে, ইথারে ইথারে
অনেক প্রস্ফুটন ঝলমল করে।
আতশবাজির মতো উদযাপনের জন্মফুল থেকে
হঠাৎ একলা হওয়া আলো, জন্মদিনে
নিজের ভেতরে চেয়ে
বলো তো, কেমন আছো?
প্রিয়মুখ
স্তব্ধতার গায়ে লেগে ফিরে আসা দীর্ঘশ্বাস
আমি গোপনে জমাই ৷ এই আসি আসি শীতে
কিভাবে প্রেমের থেকে ঘুম আর অন্ধকারে
ডুবে যাচ্ছে প্রিয়মুখ,— মরে যাচ্ছি দেখতে দেখতে ৷
এ দেশ প্রসন্ন করতলে শিশিরের ঘ্রাণ
মেখেছিল,রৌদ্রময় রেখেছিল শৈশবের
প্রজাপতি-ডানা ,আজ ভুলে যাওয়া শিখে নিচ্ছি
মুছতে মুছতে ক্ষতচিহ্ন,প্রিয়মুখ বন্ধুদের ৷
চোখ খুলতেই হেমন্ত লাল দেখি নেমে আসা
রক্তের ধারায় ৷ রক্ত ঝরছে , সেও তো কাঁদছেই
প্রিয়দেশ ,মা আমার _কান্নাজলে ডুবতে ডুবতে
মরে যাচ্ছো_ মরে যাচ্ছি রক্তে ভেসে একত্রেই ৷
কে কার খবর নেয় , শকুনেরা ডানা মেলে
আলো ঢেকে ভোজে নেমে গেছে _ নবান্নের স্বাদ ৷
অস্ফুট সন্ধ্যার খোপে মৃত আর জীবিতরা
কিসের উষ্ণতা খোঁজো ? নিভে যাচ্ছে বালুচরে
অগ্নি ও উন্মাদ ৷
(প্রিয়মুখ, ২০১৬)
সিন্দুক
গেরস্থালির সিন্দুকে আছে 'কিছু না' নামের চিম্বুকস্মৃতি,
সঙ্গোপনে সে ডালা খুলতেই
হুড়মুড় মেঘ...
দস্যুতাপ্রিয় প্রেমিকের মতো ঝড়ো হাওয়ারা ভাঁটফুল ঝোঁপে ৷
চুমুবৃষ্টির স্নানে যে শরীর পুন্য হয়েছে , সেই তো বুঝেছে
ওষ্ঠফলের মধু কত বেশি আস্বাদপ্রিয় ৷
গেরস্থালির সিন্দুক ভরা গোপন নামের সুবাস,
উষ্ণ হাতের ওম ঘিরে নামা ঘন কুয়াশার সন্ধ্যা ...
(সিন্দুক)
রঙ
❑❑
বিচূর্ণ হওয়ার রাত
আরো ধীর, নম্র হয়ে আসি।
ঘৃণামেঘ সরে না গেলেই
শহর তলায় ঝড়ে,
চোখের উত্তাপসম রৌদ্রভাসিত মুখ
কাঁপে, মুছে যেতে থাকে।
জাহাজ ডুবানো হাওয়া
বাড়ি খায় দালানে দালানে
‘ফিরে আসব’ বলে
না ফেরা সে মৃত নাবিকের আকাঙ্ক্ষাসমেত।
এই ছলোছলো ঘুম
নত অন্ধকারটিকে
যে রঙে ডুবিয়ে দিতে চায়
সে জানে না
মেরুন কি রঙ নাকি রঙের চিৎকার।
সাতটি স্বর্গ পুড়ে ছাই
সহস্র বকুলঝরা ভোর!
অনুকম্পার মতো যে বৃষ্টি নেমে এলো
হঠাৎ বিদীর্ণ তার ঘোর
এবং সে আর্তনাদে সাতটি স্বর্গ পুড়ে ছাই!
হায়েনা-উৎসব দেশে
নারী তবু কাকে ডাকে ‘ভাই’।
অন্ধকার ছেয়ে এল, লকলকে শিশ্নের ছুরি
ক্ষমতার ওমে খুব তাতে বাহাদুরি।
ভেজালি হায়েনা-ঠোঁট
লাল লাল রক্তবৃষ্টি, ক্ষত ও কান্নায়।
আমার শরীর আমি তোকে দেবো কেটে কেটে—
কষানো রান্নায়?
ওয়াইন গ্লাসভরা ঋতুস্রাব,
নে রক্তশরাব।
খা না, খা...
ভাংতে পারবি মন,
তবু ভেঙে-পড়া ডাল নই
বা উপড়ানো তরু।
খাদ্য নই, বস্তু নই, ফুল নই, মাংস নই —‘নারী’
যোনির গভীর থেকে মানুষকে জন্ম দিতে পারি।
যতই থামিয়ে দিবি
প্রতিবার ধ্বংস থেকে শুরু...
———(সাতটি স্বর্গ পুড়ে ছাই )
কান্নার আলো
*
ফিরে ফিরে আসি অবসাদের পাশে বসে থাকা অবসন্ন বালিয়াড়ির কাছে ৷ ঝুমসন্ধ্যায় পারাপারের একমাত্র সাঁকোটি ডুবিয়ে এখানেই পুঁতে গিয়েছিলে কুটুম্ব চুক্তির ছিন্ন টুকরোগুলো, দ্বিধাহীন—প্রকৃত রাত্রির বুকে জন্মেছে অবিন্যস্ত ভাঁটফুল ৷ ঘুমন্ত আয়নার বিভ্রান্ত ঘোর ভেঙে তাদেরকে ছুঁতে ছুটে আসা, হয়তো কীর্তনীয়, হয়তো কীর্তনীয় নয়।
প্রকাশ্য হওয়ার আগে
যেকোনো উন্মুখতার ভেতরে একটি বাতিঘর থাকে ৷ আমার আলোহীন বাতিঘরে হেঁটে চলা হাওয়াতেই কেঁপে ওঠা ভাঙা হারিকেন : বোবা সমাধির বিষণ্ন চোখ ৷ তার কান্নার আলোতে ভাঁটফুল গাছে ফোটে বর্ণহীন ফুল—চুক্তিহীন , যুক্তিহীন তোমাকে চাওয়া...
*
প্রকাশ্য হওয়ার আগে [২০১৭]
রক্তফুল
(যাকে জন্ম দিতে পারিনি)
ক.
সত্যি তখন উড়ছিলাম,
উড়তে উড়তে ভাসছিলাম
ভাসতে ভাসতে দেখছিলাম --
স্ক্রিনজুড়ে এক বিন্দু--
আমার জমাট মেঘের কণা।
এক ফোঁটা আমি, এক ফোঁটা প্রেম
অথচ ফুটেছে একটি হৃদয়, --
কাঁপা কাঁপা উন্মনা।
খ.
হাজার গুঞ্জরন ছেঁকে ছেঁকে আলতো করে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখি 'মা'।
এ ডাকে জাগতে চাই,
ঘুমই হাওয়া...
গ.
আমার জমাট মেঘের কণা,
এ কেমন ঘুম ঢুকে যাচ্ছে
শিরায় শিরায়
এ কেমন জেগে ওঠা আবার!
ও প্লাস্টিকের বাতাস,জ্ঞান ফেরা চাহনি,ক্লিনিকের সাদা
কোথায় মেঘের রঙ
মেঝেয় ভাসছে কেউ
রক্তফুল, রক্তফুল...
| শহর ||
কোনো তাড়া ছিল না, বারান্দায় ইজিচেয়ারের পাশেই বসে ছিল অন্ধকার ভোর অবধি। রেলিংয়ে মানিপ্ল্যান্ট দুলছিল--ভাবতে পারো ইসাবেলার রোমান্টিক স্কার্ফ। তারপর দিগন্তে চেয়ে কোনো কোনো বেডরুমের আলো নিভে যেতে থাকলেই ভ্রম-- এ শহর আরশিতে প্রতিচ্ছবি নক্ষত্রের, আকাশের।
কাছে দূরে উৎসব-- মুখ আর মুখোশে পিছলে পড়ে আলো,সুর শব্দ। ছিটকে আসে কিছু শব্দ এখানেও--নৈঃশব্দ্যের গায়ে লেগে ঝরে পড়ে, বিব্রত।
কখন যে মৃত্যু এল, আর চলেও গেল। মৃত একা
অপেক্ষা করছে জীবিতের।