আল মাহমুদ এর কবিতা সংগ্রহ




কবিতা এমন – আল মাহমুদ

কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!

কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।

কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।

কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।


ঊনসত্তরের ছড়া-১ – আল মাহমুদ

ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা
তুলবো কেন খিল ?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।
ট্রাক ! ট্রাক ! ট্রাক !
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।
কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে !
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।



কবির অভাবে দেশ – আল মাহমুদ

হয়তো-বা স্বপ্ন ছিলো। ঘুমঘোরে মিথ্যার ম্যাজিক
আমাকে দেখিয়ে ছিলো বাষ্পরুদ্ধ চেহারা তোমার।
পাখির বিলাপে ভরা ঘোরলাগা গ্র‍ামের কুটিরে
একটি বালক শুধু শুনেছিলো নদীর রোদন।
এখন সে পাড়ি দেয় সপ্তসিন্ধু, দশদিকে চোখ
মায়ার কাজলে ভেজা দৃষ্টি তার ক্লান্তির রুমালে
মুছে নিয়ে ঘরে এসে দেখে কেউই অপেক্ষায় নেই।

তার কোন দেশ নেই। নিরুপায় ভিসার বিপাকে
কালেভদ্র‍ে উড়ে আসা শুষ্ক এক নদীর কিনারে।
দাঁড়াও পথিক বর, পত্র‍হীন অশ্বথের শাখা
নড়ে উঠে বোঝায় সে অতিথির অনাত্নীয় নয়।
যদিও চুড়োয় বসে নিঃস্ব এক শুকুনী নিজেই
নিজের পালক ছিঁড়ে উদরের অনল নিভায়।

একটি সমাধি তাকে বাশঝাঁড়ে ইশারায় ডাকে
আকস্মাৎ দৃষ্টি তার মর্মভেদী। মাটির অতলে
দেখে সে চেহারা সেই বাষ্পরুদ্ধ বেদনার নদী
মৃদু শব্দে ভরে গিয়ে — এতদিন কোথায় যে ছিলে
শেষ অনুযোগ নিয়ে মুখে যায় মাটির মায়ায়।

হয়তো-বা স্বপ্ন নয়। নয় কোন মিথ্যার ম্যাজিক
একদা আমারও ছিলো দেশ, দশ, নারীর নয়ন।
দেহের ভিতরে ছিলো প্র‍েম,স্বপ্ন, আত্নার আদেশ।
কিন্তু আজ ভিসার বিপাকে পড়ে ফিরে আসা পাখি।
খুঁজে ফেরে পত্র‍পুষ্প ভরা কোন উদ্যানের ডাল।
আমার বিহনে দ্যাখো নদী শুষ্ক, গুল্মহীন মাটি
কেবল উঁইয়ের ঢিবি। বৃষ্টিহীন পরাজিত মেঘ
ব্র‍জ্র‍ের আওয়াজ তুলে ফিরে যায় দিগন্তের দিকে।



আমি আর আসবো না বলে – আল মাহমুদ

আর আসবো না বলে দুধের ওপরে ভাসা সর
চামোচে নিংড়ে নিয়ে চেয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া
যেন সাদা স্বপ্নের চাদর
বিছিয়েছে পৃথিবীতে।
কেন এতো বুক দোলে? আমি আর আসবো না বলে?
যদিও কাঁপছে হাত তবু ঠিক অভ্যেসের বশে
লিখছি অসংখ্য নাম চেনাজানা
সমস্ত কিছুর।
প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না।
পাখি, আমি আসবো না।
নদী আমি আসবো না।
নারী, আর আসবো না, বোন।
আর আসবো না বলে মিছিলের প্রথম পতাকা
তুলে নিই হাতে।
আর আসবো না বলে
সংগঠিত করে তুলি মানুষের ভিতরে মানুষ।
কথার ভেতরে কথা গেঁথে দেওয়া, কেন?
আসবো না বলেই।
বুকের মধ্যে বুক ধরে রাখা, কেন?
আর আসবো না বলেই।
আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে
কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’
সুখ, আমি আসবো না।
দুঃখ, আমি আসবো না।
প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার
তোমরা কি মাইল পোস্ট না ফেরার পথের ওপর?


কাক ও কোকিল – আল মাহমুদ

একবার এক শহুরে কাকের দলে
মিশে গিয়েছিলো গানের কোকিল পাখি
মনে ছিলো তার কোন মতে কোনো ছলে
শেখা যায় যদি জীবিকার নানা ফাঁকি।

শুধু গান ছাড়া বুদ্ধির নানা খেলা
শিখবে সে এই চালাক কাকের ভিড়ে,
পার হয়ে মহানগরীর অবহেলা
কন্ঠ সাধবে প্র‍ভাতের বুক চিরে।

কিন্তু বাতাসে ফিরে এলো ওর গান
জন জীবনের কোলাহলে ভয় পেয়ে
ধুলোয় হাওয়ায় কেবলি যে অপমান
কাকের কলহ আকাশের মন্দিরে।
কাকেরা যে বোঝেনা গানের ভাষা
রুক্ষ পালকে তীব্র‍ কন্ঠে হাসে
গানের পাখির নিভে যায় কত আশা
সবুজ পাহাড়ে একদিন ফিরে আসে।

মহুয়ার গাছে দুঃখের নানা শ্লোক
তারপর থেকে শোনা যায় রোজ রোজ
কার সঙ্গীতে কাঁপে অরণ্যলোক
কোন্ পক্ষীর হৃদয়ের নির্যাসে??


ডাক – আল মাহমুদ

তোমাকে ডেকেছি বলে আমি
নড়ে ওঠে জগত জঙ্গম
পর্বতও পাঠায় সেলামি
নদী ফেলে সাগরে কদম।

ঝাক বেঁধে পাখি উড়ে যায়
চঞ্চুতে আহার্যের স্তব
কথা বলো, হাওয়ার ভাষায়
সীমাহীন নীলিমা নীরব।
আমিও ক্ষুধার্ত বটে আজ
ওষ্ঠে জমা ব্যার্থতার নুন,
জীবন কি ডানারই আওয়াজ
কিংবা কোন উড়ন্ত শকুন?
আজ একটু ঠাঁই দাও মেঘে
সাঁকো বাঁধো শূন্যের ওপর
বুকে টানো মাংসের আবেগে
যেন নিজ সন্তানের জ্বর।

আর নয় প্র‍েম, দাও দয়া
আরোগ্যের গন্ধে ভরা হাত
নিঃসীম আকাশে শ্বেত বয়া
ছোঁয় যেন আমার বরাত।
ভাগ্যেরও অদৃশ্যে বসে যিনি
ঠিক রাখে আত্নার বাদাম।
আমি ঠিক চিনি বা না চিনি
তারই প্র‍তি অজস্র‍ সালাম।


বিষয়ী দর্পণে আমি – আল মাহমুদ

ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে
আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে
তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায়
নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহূর্তেমুকুরে।

ভয়াবহ ভূতের আর্শিতে
আমাকে পশুর মতো মনে হতে থাকে। ধূসর হাওয়ায়
পাশব কেশর ওড়ে, অনাচারী বিষয়ী নখর
নষ্ট করে গাছপালা নারীশিশু জনতা শহর!

কখনো অসৎ থাবা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে
দেখি সেই বিম্বিত পশুর
দর্পিত হিংস্র‍ চোখ আমাকেই লক্ষ করে জ্বলে;
চিবুক লেহন করে, সে অলীক মহূর্তের ক্র‍োধ
জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে এক
শিশু আর পশুর বিরোধ।


কদম ফুলের ইতিবৃত্ত – আল মাহমুদ

আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই
তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ
আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব
কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও
হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা
বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে কেঁদে
উঠেছে রাধারা
আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে এসো
আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে
         সিক্ত অঙ্গে কদমতলায় মিলিত হও ?
আমি তো বলিনি লাজ লজ্জা সংসার সম্পর্ক যমুনার জলে
                                 ভাসিয়ে দাও
আমি তো নদীর স্বভাব জানি স্রোত বুঝি কূল ভাঙা বুঝি
কিন্তু তোমাকে বুঝতে বাঁশিতে দেখ কতগুলো ছিদ্র
সব ছিদ্র থেকেই ফুঁ বেরোয়
আর আমার বুক থেকে রক্ত।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন