ভাষা
হাতজোড় বসে থাকা এই রাতভর
ভোরবেলা বাক্য হয়ে যদি ঝরে পড়ে
যদিবা তাতেই পাখি পায় শস্যদানা
পায় ফুল ফোটার ইন্ধন, তবে আর
তুমুল উৎপ্রেক্ষা কই, কোথায় উপমা—
কেন চাও এই সফলতা? কেন ডাকো
ফণীমনসার ঝোপ?—যদি না চুম্বন
সিল্কবৃষ্টি, স্নিগ্ধ কাঁটা; যদি না এ ঠোঁট
রক্তাপ্লুত গান। ক্ষত নিয়ে, দ্বিধা নিয়ে
এতদিন পরও, ভাষা, তুমি নতজানু।
এতদিন পরও দেখি মাছের সাঁতার
নভতলে। অথচ তুমিই দিলে ডুব।
ভাসালে হৃদয়। টেনে তুলে তারপর
ছুটেছ কোথায় কার পায়ে বেঁধে মল?
লাটিম
দড়িবাঁধা খেলনা গাড়িটিকে শুধু আজ ভালো লাগে,
শিশুদের পিছে তাই গাড়িটির বেগে ছুটে যাই।
যেতে যেতে চলে যাই আমতলা নদীর কিনারে,
ঝাঁপ দিয়ে পড়ি আর বটফল তুলে কামড়াই—
এত রঙ, তবু কেন পানিতে লাগে না! এত ঢঙ
পৃথিবীতে! তার কিছু হয়তোবা জানে শিশুরাই।
কত দিকে কত পথ চলে গেছে নির্জন দুপুরে—
এক-ঘরে ক’রে যেন ফেলে গেছে এই ধামরাই।
দেখি সুতো কেটে গেছে, ঘুড়ি তবু উড়ছে আকাশে—
দীর্ঘ হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে ধান, ভুট্টাপাতার পরতে।
সরে যাচ্ছে দৃশ্য থেকে। তাকে আর টেনে ধরছে না
এসে কেউ। পারছি না আমিও ধরতে কোনো মতে।
এ লাটিম যে তুরীয়ানন্দে ঘূর্ণি খেয়ে নেচেছিল
একদিন, তার চেয়ে অবসন্ন পড়ে আছে পথে…
আফিমের দেশে
জলার্ত পাত্রের মধ্যে এক ফোঁটা রঙের মতন
কেবল একটি কথা ছুঁতে পারে সহস্র রজনী—
স্বপ্নের মুকুট-পরা আফিমের দেশে বসে তা কি
ভেবেছিল বাগদাদি শাহ, সুলতান গজনীর?
একবার গান ধরে, জাগিয়ে সে বিষণ্ন রবাবে—
তারপর থেমে গেলে, সরে গেলে দৃষ্টির জবাবে।
যে বনের পথে হেঁটে তোমার পোশাকে লেগে গেল
চোর-কাঁটা, সে পথ কে জানে কার ছিল না ঈপ্সিত।
জনান্তিকে পড়ে থাক ভ্রান্তি—দুটির নিস্বর ঝিল্লির;
তবুও বলো না : আমি রাত্রির পেখম খুলি নি তো।
হাওয়ার উচ্ছ্বাস নয়, ধূম্রনীল মাধব-মুহূর্ত
ঘিরেছিল পৃথিবীর চারপাশ—একটি সন্ধ্যায়—
প্রতিটি পাতার শীর্ষে ঝরে পড়ে যতটা সূর্যাস্ত
ততটা পালক থাকবে কি জমা ঘাসের কব্জায়?
লেখা
‘চুম্বন’ শব্দটি লিখে রেখে, কবি, তুমি চলে গেছ সেই কবে!
আজকে যে মেয়েটি তা পাঠ করে, ঘরে বসে একা, মৃদু স্বরে,
সেও কি চুম্বিত হবে ওই শব্দে থেমে গিয়ে? এ হেম-প্রত্যাশা
ক্ষয়ে না যেতেই বুঝি, ঠিক পেয়ে গেছ প্রত্যুত্তর—সে উত্তর
নির্জন ব্যালকনি জুড়ে বেলি ফুল, তারামৗনহাসি পার হয়ে
স্বপ্নের ভিতর—শুধু কয়েকটি নাম—হয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস—
গোঙানি ও আর্তনাদ—যেন পরাধীন পৃথিবীর ক্ষুদিরাম—
অখিল এ কারাগারে বন্দি—সক্রেটিস, যিশু, ব্রুনো—যেন কেউ
কোনোদিনও পাবে না, মরে না গিয়ে তার বিজয়ের বরমাল্য।
যন্ত্রণার রিলে-রেস বালুতীর্থে। হবে স্নান তরমুজ-লালায়।
গাছের খোড়ল থেকে তার হৃদয়ের কথা নিয়ে উড়ে গেল
যে পাখিটি, সেও পড়ে যাবে ঢিল খেয়ে, কোনো দুষ্টু বালকের।
আমি সব গাছের বাকলে লিখে রাখি নিজেকেই ক্ষত ক’রে।
আর কেউ এসে দিয়ে যাক তার নাম এই দুঃখ-তালিকায়।
তাল-নিশি
কার নিজ হাতে বুনে রেখে যাওয়া তালগাছ তার অগোচরে
বড় হলো দিনে দিনে। এসো বন্ধু, তমোরস সোমরস সব
ঢোকে ঢোকে করি পান। মদিরামাতাল হয়ে যাই গোরস্থানে।
‘মিটেছে পিপাসা?’—পূর্বপুরুষের নাম ধরে ডাক দিয়ে বলি :
‘যদি মিটে থাকে, তবে সাড়া দাও ওই আতাফুলের নিশ্বাসে,
দাও অভিষেক তার ডালে মউমাছিদের। যদি থাকে কোনো
অচরিতার্থতা, তৃষ্ণা—সে মন্ত্র শেখাও, যার মৌন উচ্চারণে
জীবিতের ওষ্ঠ হয়ে যায় মৃতদের ঠোঁট।’ এসো বন্ধু, ভাই,
পুঁতে রেখে যাই কয়েকটি গাছ আমাদের কবরের পাশে।
শাখার চূড়ায় উঠে তার, যেন চেয়ে দেখা যায় অনায়াসে
এ গাঁয়ের ভিটেবাড়ি—ওই হাঁড়ি-কলসের ভিড়, ঠেলাঠেলি।
কখন বাতাস কেটে পড়েছে! অথচ দ্যাখো, তালপাতাগুলো
শূন্যে হাওয়া দেয় রাতভর, চুপচাপ, চাঁদ-তারা লক্ষ ক’রে।
আমরা ঘুমাব আজ তালতলা, জ্যোৎস্নার কোমল গোরস্থানে।
Tags
সোহেল হাসান গালিব