শুধু একটি শব্দের জন্য
তুমি যখন রজনীগন্ধার ডাঁটার মত নত হয়ে
ঘরের মধ্যে পা রাখলে সারাঘরে খেলে গেল একটা স্পন্দন
হঠাৎ যেন বদ্ধ হওয়া শিউরে উঠল।
তুমি যখন বাঁকাচোরা হাত দুটো আলতোভাবে
কোলের উপর শুইয়ে রাখলে
অপার বাঙময় সে দুটো অপরূপ হাত
বীণার মত বেজে উঠতে চাইল।
তুমি যখন শরীরের বসন টেনে টুনে ঠিক করায়
হঠাৎ খুব মনোযোগী হয়ে উঠলে, মনে হল
শরীর ঢাকতে গিয়ে তুমি শরীর থেকে পালাতে চাইছ।
অমনি তোমার ভেতর থেকে একটা স্নিগ্ধ
বিদ্যুৎপ্রবাহ নির্গত হয়ে আমাকে তড়িতাহত করল।
তুমি যখন কার্পেটে বুড়ো আঙুল খুঁটে খুঁটে মেঝের
পানে তাকিয়ে খুউব নিচুস্বরে কথা বললে
মনে হয় ঘরে দেয়ালগুলো সন্তর্পণে কান পেতে আছে
যাতে তোমার প্রতিটি উচ্চারিত ধ্বনি দেয়ালের মর্মে বিধে থাকে।
যখন আমি তোমার কাছে গেলাম, মনে হল
একটা নির্জন ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি
জাগতিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে যার উৎসস্থল।
আর যে ঝর্ণা মৃদুস্বরে কেবল নিজের সঙ্গেই আলাপ করে।
আমি যখন তোমার ঘরের বাইরে পা রাখলাম
আমার রক্তে, আমার অনুভবে ফুটন্ত ঝর্ণার আবেগ;
একটা মৃদু মোহন প্রীতিবদ উত্তাপে আমার
ভেতরের পদার্থ সকল গলানো মোমের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যত দূরেই যাচ্ছি পথের পাশের সব কিছুর মধ্যে
যে ঝর্ণার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি,
সে অদৃশ্য ঝর্ণার ঝংকার শুনতে পাচ্ছি।
আমি গগনে মেঘ দেখামাত্র মেঘের অংশ
হয়ে গেলাম। বৃক্ষ দেখে বৃক্ষের আকার
ধারণ করলাম। যখন নদীর সান্নিধ্যে এলাম
ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়ার আবেগ আমার
বুকের ভেতর তরঙ্গ সৃষ্টি করল। তারপরে
যখন আকাশের অভিমুখে দৃকপাত করলাম,
দেখলাম ঘুঙুর পরা নক্ষত্ররা একে একে
আমার প্রাণে এসে প্রাণের চেরাগ জ্বালিয়ে তুলছে।
তুমি আমাকে চরাচরে প্রবাহিত হওয়ার
আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী করেছ।
তুমি আমার হাতে তুলে দিলে বিশ্বলোকে
বিহার করার টাটকা নতুন ছাড়পত্র।
হে নারী তোমাকে কি নামে ডাকব।
কোন নামে ডাকলে তোমার হৃৎকমল সুখসমীরে
আন্দোলিত হয়। কোন নামে ডাকলে আমার
নাভিপদ্মের মূল থেকে শৈলের
সোনালী পোনার মত যে অনুভবরাশি
ওপরে ভেসে উঠেছে তার বিশ্বস্ত প্রকাশ ঘটাতে পারি!
বেতারে খবর ঝরে
বেতারে খবর ঝরে,
তাজা খুন; কাঁচা প্রাণ ঝরে
ভিয়েৎনামে; পথে পথে
নগরে বন্দরে, বনে বনান্তরে
রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে
তপ্ত রক্ত ঝরে।
জিঘাংসার জটা মুক্ত সাগ্নিক নিঃশ্বাসে মূর্ত
মমচেরা কামনার বেশুমার নিহত মুহূর্ত
অকস্মাৎ আগ্নেয় ঝলকে
দুর্মর চেতনারশ্মি দুর্জয় প্রত্যয়ে ফুসে
তুলি লক্ষ গোখরার ফণা
দুরন্ত মাভৈঃ সুরে সবল দরাজ কণ্ঠে উদাত্ত ঘোষণা
মার্কিনির বর্বরতা ক্ষমা করিব না।
জন্মে জন্মে যুগে ক্ষমা করিব না
কোটি কণ্ঠে নৃশংস ঘোষণা।
আত্মারে গচ্ছিত রেখে পাপের হারেমে
জোব্বা পরা লম্পটেরা;
নারীর সতীত্ব লুটে বীরত্বের দর্প করে যারা
যারা দুনিয়ার লোভে সত্যসন্ধ মানুষের বেচাকেনা করে,
যাদের পাশব শৈর্যে মানবতা মাথা কুটে মরে,
যাদের নাপাং বোমা ফুলের ফাগুনভরা
সবুজ পোয়াতি ক্ষেতে আগুন লাগায়,
যাদের জীবানু অস্ত্রে শিশুরা মাছের মত ধুকে ধুকে মরে,
যাদের রকেট ঘাটি ঘুমন্ত চোখের কোণে
বিভীষিকা আনে,
যাদের হিংসার শরে নিগারেরা নিত্য বিদ্ধ হয়,
যাদের বেনিয়াবুদ্ধি পৃথিবীর উর্বরতা ক্ষুণœ হয়,
যারা রাখে জারজের রক্ত মাংসে
কলুষিত কামনার বীজ;
– সেই ঘৃণ্য দানবের নগ্ন বর্বরতা
ভিয়েতনাম সইবে না, সইবে না দুনিয়ার সংগ্রামী সেনানী।
আফ্রো’শিয়ার গহীন গহনবন, ফেনিল সমুদ্রতীরে।
মরুভর বুক কুঁড়ে অযুত নিযুত কণ্ঠ
বাতাসের হৃদপিণ্ড চিরে চিরে কয়,
– আদিম বর্বর তেজ বলদীপ্ত অহিংস হৃদয়
হিংসায় হিংসায় আজ নব পরিচয়।
তাই ধমনীর শেষে লালে, লিখে যাবো
সংগ্রামের রক্তাক্ত আখর।
শুধু একটি শব্দের জন্য
তুমি যখন রজনীগন্ধার ডাঁটার মত নত হয়ে
ঘরের মধ্যে পা রাখলে সারাঘরে খেলে গেল একটা স্পন্দন
হঠাৎ যেন বদ্ধ হওয়া শিউরে উঠল।
তুমি যখন বাঁকাচোরা হাত দুটো আলতোভাবে
কোলের উপর শুইয়ে রাখলে
অপার বাঙময় সে দুটো অপরূপ হাত
বীণার মত বেজে উঠতে চাইল।
তুমি যখন শরীরের বসন টেনে টুনে ঠিক করায়
হঠাৎ খুব মনোযোগী হয়ে উঠলে, মনে হল
শরীর ঢাকতে গিয়ে তুমি শরীর থেকে পালাতে চাইছ।
অমনি তোমার ভেতর থেকে একটা স্নিগ্ধ
বিদ্যুৎপ্রবাহ নির্গত হয়ে আমাকে তড়িতাহত করল।
তুমি যখন কার্পেটে বুড়ো আঙুল খুঁটে খুঁটে মেঝের
পানে তাকিয়ে খুউব নিচুস্বরে কথা বললে
মনে হয় ঘরে দেয়ালগুলো সন্তর্পণে কান পেতে আছে
যাতে তোমার প্রতিটি উচ্চারিত ধ্বনি দেয়ালের মর্মে বিধে থাকে।
যখন আমি তোমার কাছে গেলাম, মনে হল
একটা ন¤্র নির্জন ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি
জাগতিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে যার উৎসস্থল।
আর যে ঝর্ণা মৃদুস্বরে কেবল নিজের সঙ্গেই আলাপ করে।
আমি যখন তোমার ঘরের বাইরে পা রাখলাম
আমার রক্তে, আমার অনুভবে ফুটন্ত ঝর্ণার আবেগ;
একটা মৃদু মোহন প্রীতিবদ উত্তাপে আমার
ভেতরের পদার্থ সকল গলানো মোমের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যত দূরেই যাচ্ছি পথের পাশের সব কিছুর মধ্যে
যে ঝর্ণার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি,
সে অদৃশ্য ঝর্ণার ঝংকার শুনতে পাচ্ছি।
আমি গগনে মেঘ দেখামাত্র মেঘের অংশ
হয়ে গেলাম। বৃক্ষ দেখে বৃক্ষের আকার
ধারণ করলাম। যখন নদীর সান্নিধ্যে এলাম
ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়ার আবেগ আমার
বুকের ভেতর তরঙ্গ সৃষ্টি করল। তারপরে
যখন আকাশের অভিমুখে দৃকপাত করলাম,
দেখলাম ঘুঙুর পরা নক্ষত্ররা একে একে
আমার প্রাণে এসে প্রাণের চেরাগ জ্বালিয়ে তুলছে।
তুমি আমাকে চরাচরে প্রবাহিত হওয়ার
আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী করেছ।
তুমি আমার হাতে তুলে দিলে বিশ্বলোকে
বিহার করার টাটকা নতুন ছাড়পত্র।
হে নারী তোমাকে কি নামে ডাকব।
কোন নামে ডাকলে তোমার হৃৎকমল সুখসমীরে
আন্দোলিত হয়। কোন নামে ডাকলে আমার
নাভিপদ্মের মূল থেকে শৈলের
সোনালী পোনার মত যে অনুভবরাশি
ওপরে ভেসে উঠেছে তার বিশ্বস্ত প্রকাশ ঘটাতে পারি!
নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, আহমদ ছফা রচনাবলী, ৩য় খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮)
কবি ও সম্রাট: আহমদ ছফা
[মির তকি মির উর্দু সাহিত্যের একজন মশহুর কবি। মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের মতো একজন নাক-উঁচু স্বভাবের মানুষও তাঁকে অগ্রজের প্রাপ্য সম্মান দিতে কোনরকম কুণ্ঠা প্রদর্শন করেননি। মির ছিলেন খুবই প্রতিভাবান একজন কবি আর স্বভাবে ছিলেন উড়নচণ্ডী। তাঁর ছিল প্রখর আত্মসম্মানবোধ। তাঁর ব্যঙ্গাত্মক রসিকতা করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। এ নিয়ে অনেক গল্প চালু রয়েছে। আগ্রহী পাঠকের পক্ষে সেগুলো খুঁজে নেয়া খুব দুরূহ ব্যাপার হবে না।
আমাদের দেশে মির একেবারে অপরিচিত এ কথা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। বিখ্যাত গজল গায়ক মেহেদি হাসান, শামসাদ বেগম, গোলাম আলি প্রমুখের কণ্ঠে গীত হয়ে তাঁর বেশ কিছু গীতিকবিতা সঙ্গীতপিপাসু মানুষের মনে স্থান করে নিতে পেরেছে। মিরের সাহিত্যকর্মের উৎকর্ষ বিচার করে বাংলা ভাষায় বিশেষ কাজ হয়নি—এটা নিশ্চয়ই সুখের সংবাদ নয়।
এই নাট্য-সংলাপটিতে মিরের যে চরিত্র খাড়া করা হয়েছে, তার সঙ্গে মিরের যে ঐতিহাসিক চরিত্র তার মিল সন্ধান করতে গেলে খুঁটিনাটি তথ্যসন্ধানী পাঠককে অবশ্যই হতাশ হতে হবে। পৃথিবীতে জন্মানো রক্তমাংসের আসল মানুষের সঙ্গে কবির হৃদয়ে জন্মানো মানুষের ফারাক তো অবশ্যই থাকবে। পাঠ করার সময় এ বিষয়টি মনে রাখলে কবিকৃত অনেক অপরাধের মার্জনা মেলে।]
সম্রাট:
তাহলে এসেছো তুমি মির!
মির:
জাঁহাপনা, খোদাবন্দ ভারত ঈশ্বর
গোটা হিন্দুস্তানে কার আছে এমন হিম্মত
কার ঘাড়ে দুটি মাথা সজ্ঞানে অমান্য করে
বাদশার ফরমান!
সম্রাট:
বলছো যথার্থ মির, একটুও মিথ্যে নয়
শুধুমাত্র সম্রাটের ইচ্ছে আকর্ষণ জোর করে
টেনে আনে মনুষ্যমণ্ডলী।
মির:
জাঁহাপনা সুরুচিরক্ষক তাই পশুরা জঙ্গলে থাকে,
বিহঙ্গ আকাশে ওড়ে, নইলে পশু আর পাখিদের
মিলিত চিৎকারে জমকালো দরবার কক্ষে
কান পাতা দায় হতো। সম্রাটের দয়ার শরীর
জলকে দেন না কষ্ট তাই নদী নিম্নদিকে ধায়।
অন্তরে জন্মাতো যদি আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুর, স্বকীয়
স্বভাব ভুলে কল্লোলিত যমুনার ধারা উজানে
তরঙ্গ তুলে উর্ধ্বে ছুটে যেতো।
সম্রাট:
মির তকি মির, অনর্থক বাজে বকো
তথাপি কবুল করি, তোমার কথায় আছে
তীব্র সংবেদন, আকর্ষণ এড়ানো কঠিন বড়ো,
শুনে মনে হয় বনতলে সঙ্গোপনে ফেনিল ফোয়ারা,
প্রতি বাক্যবন্ধে যেন দিতেছে টঙ্কার,
তথাপি সম্রাট আমি—আমার কর্তব্য আছে।
মির:
জাঁহাপনা, এই দীন ধনপতি সেনাপতি নয়,
করযোগ্য ভূমি যার এখতিয়ারে নেই। একটি
পৈতৃক বীণা, খাগের লেখনী আর কিঞ্চিত সেহাই—
এই মাত্র পুঁজিপাট্টা। অন্ধকার চক্রান্তের পথে
যে ভুলেও বাড়ায়নি পা তার কি কসুর হতে পারে!
সম্রাট:
বেখবর মির, কি কসুর জান না এটা
আরেক কসুর। নগরের কোতোয়াল প্রত্যহ লেখে
তোমার খবর। অহরহ গাঁজাচণ্ডু খাও, শরাব
খানায় করো নরক গুলজার, রেণ্ডিবাড়ি করো
তুমি নিত্য গতায়াত। সবচেয়ে আপত্তির প্রত্যহ দিচ্ছো
ছেড়ে লাউডগা সাপের মতো অবাধ্য কবিতা।
হৃদয়ের বোঁটা ধরে টান দেয় এ রকম ফলাযুক্ত তীর।
তোমার শব্দের বিষ, উপমাঝঙ্কার, কেড়ে নিচ্ছে
যুবকের ধর্মকর্মে মতি। নারীরা নিষিদ্ধ চিজ
বেশি ভালবাসে, তাই সবাই আশঙ্কা করে
তাবত শরিফগৃহে অগ্নিকাণ্ড হবে। বলো,
এ সব কসুর নয়! কিংবা বলো কোতোয়াল
অসত্য লিখেছে?
মির:
জাঁহাপনা, কোতায়াল সম্রাটের নিমকহালাল বড়ো
সৎ কর্মচারী, যা দেখে সকল লেখে, একবর্ণ মিথ্যে
নয় তার। তবুও আমার ভাগে অনুগ্রহের ভার
কিঞ্চিত অধিক বলে মনে হয়।
সম্রাট:
কোতোয়াল পক্ষপাতী—এই চিন্তা কি কারণে
স্থান পেল মনে?
মির:
জাঁহাপনা, খাকসার নালায়েক নাচিজ বান্দা
জন্মগুনাহগার, সবিনয়ে শ্রীচরণে নিবেদন রাখি—
আমার সহজ বাক্যে না নিন গোস্তাকি।
সম্রাট:
মির তকি মির, শশকের মতো শুধু ডানেবামে হেলো
নিজস্ব বয়ানটুকু মুকতসর বলো।
মির:
যেহেতু সর্বশঙ্কা-হন্তারক সম্রাটের হুজুরে হাজির
দ্বিধাভয় দূরে গেল বাকরুদ্ধ কবির।
সিংহাসন সাক্ষী রেখে মুক্তকণ্ঠে বলি, সম্রাট
সূর্যের মতো—তবে সূর্য অস্ত যায়। কিন্তু সম্রাট-
দীপ্তি জেগে থাকে সর্বক্ষণ দিবসশর্বরী।
সম্রাটের দিব্যদৃষ্টি বিলাইছে আসমুদ্র হিমাচলে
নিত্য বরাভয়। নিরীহ কবির কর্ম কেন হবে
সম্রাটের চর্চার বিষয়? নাদানের কর্মকাণ্ড জানিনে
কি কারণে সম্রাটের মনোযোগ টানে।
সম্রাট:
মির তকি মির, বক্তব্যের প্রথমাংশ অতি চমৎকার—
অন্য অংশে অসঙ্গতি ঘটেছে বিস্তর। সম্রাটের
ভাবকল্প আর রক্তমাংসের আসল সম্রাট,
দুই বস্তু এক নয়। সে কথা থাকুক—অভিপ্রায় ব্যক্ত করো।
মির:
জাঁহাপনা, আপনার অদৃশ্য চোখ সর্ববস্তু দেখে,
গুপ্তকান সবকিছু শোনে। সম্রাট সকলজান্তা,
তাতে আমি যৎকিঞ্চিত সংযোজন করি।
যত মসজিদ আছে দিল্লি নগরীতে শুঁড়িখানা
কম নয় তার চেয়ে—ঢের ঢের বেশি। যত লোক মধ্যরাতে
করে ইবাদত তার চেয়ে মাতাল বেশি পাওয়া
যাবে শরাবখানায়। আমি তো খান্দানি নই
ধারকর্জ পেলে পান করি অথচ এমন বহু
এ শহরে আছে চৌদ্দপুরুষের অর্থ রসে করে ক্ষয়—
এমনকি তত্ত্ব নিলে সম্রাটের পরিবারে কতিপয়
পাওয়া যেতে পারে। অতি বেলেহাজ কথা ঠোঁট থেকে
ফসকে গেল, শাস্তি দিলে শাস্তি মেনে নেব,
তথাপি নসিব ভাল নিজ চোখে
দেখলাম সম্রাটের নুরানি সুরত।
সম্রাট:
মির তকি মির, তোমার জিবটি খুব
সুবিধের নয়, শাঁখের করাত যেন আসতে যেতে
দুইদিকে কাটে। তারিফের ছলে করো দিব্যি শেকায়েত।
আবার ঔদ্ধত্য মধুর করো বিনয়ের রসে—এও এক শিল্পকর্ম।
তোমার গোস্তাকি যত সম্রাটের ক্ষমাগুণ
ধৈর্যশক্তি তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি, সে কারণে না চাইতে
ক্ষমা পেয়ে গেছ, নইলে কালো মাথা মাটিতে লুটাতো।
মির:
বাদশাহ আলমপনা ঘাড়ে হাত দিয়ে যখন নিশ্চিত হই
ধড়েতে মস্তক আছে, টের পাই সবটাই সম্রাটের দয়া।
সম্রাট:
মির তকি মির, তুমি এক আজব লোক
তারের যন্ত্রের মতো টোকা দিলে বেজে ওঠো,
কিন্তু মনে রেখো সদাস্বতস্ফূর্ত ভাব
আসলে দুশমন, পলকে লঙ্ঘন করে বিপদসীমানা।
মির:
জাঁহাপনা, মজে থাকি সর্বক্ষণ অন্তর্গত ধুনে,
আপদবিপদ আসে কোথা দিয়ে—অন্ধচোখ রাখি—
কিছুই দেখিনে, কিছুই বুঝিনে আমি, কষ্ট পাই কষ্ট পেয়ে যাবো,
কষ্টের অমৃত দিয়ে জিন্দেগির পেয়ালা ভরাবো।
সম্রাট:
মির তকি মির, তুমি কবি
আশা করি অনুভবে বুঝে নিতে পারো।
তোমার তাবত কালো জ্বলে ওঠে আরো কালো হয়ে
উচ্চারিত কথার আলোকে। নারী ও পুরুষের
মনের গোপন ঘরে যে সব বিস্ফোরক দাহ্যবস্তু থাকে
চকিতে চকমকি ঠুকে লাগাও আগুন
যার তেজে আনন্দে কুমারী করে সতীত্বকে খুন।
তুমি স্থির হয়ে একদণ্ড থাকো না কোথাও,
নগরে বন্দরে তুলে তীব্র সংবেদন ছুটে যাও
দেশ থেকে দেশান্তরে অশান্ত ঘূর্ণির মতো
যেন এক জ্যান্ত মহামারী।
মির:
জাঁহাপনা, আপনার অন্তর্দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর
হা করলে দেখে ফেলে অন্তর্গত সমস্ত মানুষ।
সম্রাট:
ভেবে দেখো, আমাকে ফেলেছো তুমি কেমন মুশকিলে!
মোল্লারা তোমার নামে জুড়েছে চিৎকার,
কাটামুণ্ডু দাবি করে, তা নইলে ধর্ম নাকি
যাবে রসাতলে, সবকটা ধর্মস্থানে
বর্শার ফলার মতো ধারালো চকচকে প্রতিবাদ
উঠছে জেগে; সবাই সম্রাটের কাছে চায়
যোগ্য প্রতিকার—প্রজাদের ধর্মরক্ষা সম্রাটের
কাজ, অতয়েব সব দায় সম্রাটে বর্তায়।
তাই আমি মনে মনে দোলাচলে আছি—
আইনগ্রন্থে সায় নেই—কি করে এমন দণ্ড
করি উচ্চারণ।
মির:
জাঁহাপনা, সত্য ন্যায় সুবিচার স্বভাবে প্রোথিত,
অন্তরে বিরাজ করে অধরা সুন্দর, এমন সম্রাট
যিনি তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত গুরুদণ্ডভার
মেনে নেব প্রতিভার যোগ্য পুরস্কার, কিন্তু
তার আগে সবিনয়ে করি প্রণিপাত—
অক্ষমের সৃষ্টির প্রতি সম্রাটের হোক দৃষ্টিপাত।
সম্রাট:
মির তকি মির, কণ্ঠে কণ্ঠে ঘষা লেগে
ফুঁসে ওঠা জনমত নিচ্ছে গতিবেগ। সঠিক
উসকানি পেলে দাবানলে রূপ পেয়ে যাবে।
সম্রাটকে সবকিছু বিলক্ষণ জ্ঞাত থাকতে হয়—
তোমার কবিতা দিয়েছে হানা শয়নমন্দিরে
মাঝে মধ্যে ফাঁক পেলে বুলিয়েছি চোখ
মাটিঘেঁষা ভাষা আর মর্মভেদী সুর,
পুরাতন কবিদের ছন্দ অলঙ্কার তাজিম করোনি।
সবকিছু একযোগে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে
আলাদা জগত এক করেছ সৃজন—হতে পারে
সুন্দরের এও এক নব্য-নিদর্শন। একে কি কবিতা
বলা যায়! অনেক ভেবেছি আমি, কাটেনি সংশয়
তবে আমাদের রাজকবি ভিন্নকথা বলেন, তাঁর মতে
কবিতার সব শর্ত পূরণ হয়নি। কবিতা হয়েছে
কিনা আমার বিচার্য নয়, আমি অতি নিরীহ
পাঠক, পাঠ করে প্রীত হলে মনে করি লাভবান হলাম।
শোনো আরো এক সুসমৃদ্ধ
অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক মধ্যরাতে ঘুম
ভেঙ্গে গেলে তোমার কবিতা হয়েছে বিনিদ্র
রাতের সাথী, অবাক হয়ো না কিছু, সুনিদ্রা
সম্রাটভাগ্যে কদাচিত ঘটে; আতঙ্কেরও কিছু নেই
তাহলে তো সম্রাটকে বনে যেতে দীক্ষা নিতে হয়,
আপাতত সে সময় এখনো আসেনি। শোনো, তোমার
কবিতা আনন্দে হেসেছি পড়ে, ব্যথায় কেঁদেছি,
তালুতে মস্তক রেখে নীরবে ভেবেছি—মনে
হলো শিশুবেলা ফিরে পেয়ে গেছি।
কবিতা হয়েছে কিনা আমার বিচার্য নয়
তবু আমি বলতে পারি অকুণ্ঠ সাহসে, আশ্চর্য
ক্ষমতা এক অধিকারে এসেছে তোমার।
আমি হই হিন্দুস্থানে একচ্ছত্র ক্ষমতা-প্রতীক—তাই
ক্ষমতার চরিত্র জানি, সে কারণে
মুখ ফুটে না বলতে আমার হৃদয় আলিঙ্গনে
তোমা পানে ছুটে যেতে চায়।
মির:
জাঁহাপনা, গুণবন্ত বাদশাহ সালামত
তেজোদ্দীপ্ত মহিমার সাক্ষাত-প্রকাশ,
সবিনয়ে মস্তক নামায়ে আমি দণ্ডবত করি
আকাশে উড্ডীন থাক শ্বেতবর্ণ রাজছত্র যুগ যুগ ধরে।
সম্রাট:
মির তকি মির, অধিকন্তু বাক্যব্যয়
নেই প্রয়োজন। তোমাকে দাওয়াত করি
চলে এসো দরবারের শান্ত ছায়াতলে।
দরবারই প্রকৃষ্ট স্থান, সমস্ত গুণের ঘটে
সম্যক বিকাশ, পায় সমাদর, এই হিন্দুস্তানে
যেখানে যত ক্ষমতার বিস্ফোরণ ঘটে—
ধর্মতত্ত্ব শিল্পকলা অথবা বিজ্ঞান—
সম্রাটের উৎস থেকে সমস্ত সম্ভবে।
সম্রাটের মহিমাকে আনন্দে বেষ্টন করে
বিকশিত হয়, যেমন কল্লোলিত নদীধারা
সমুদ্রকে চায়, সম্রাট তো সমুদ্রেরই মতো—
দয়াময় নিরঞ্জন আল্লাহ রহমান—
সম্রাট আল্লাহর ছায়া করেন ধারণ,
চলে এসো দরবারের প্রশান্ত প্রশ্রয়ে।
মুক্ত করো তোমার লেখনী, আমি ধরি
রাজদণ্ড, তুমি তাকে ভবিষ্যতে করো স্থিতিবান,
সেই সঙ্গে সম্রাটের মৃত্যুঞ্জয় নাম।
রাজকবি:
(অস্ফুটে একজন দরবারির কানে কানে)
আদব লেহাজহীন এক আস্ত ভবঘুরে
দরবারে আসছে তবে, বুঝিবা সময় হলো
এইবার পাততাড়ি গোটানোর পালা।
দরবারি:
(নিম্নকণ্ঠে)
ভায়া, একে বলে কালের গরদিশ
সব খান্দানি শরিফজাদা ঠেকে গেছে ভীষণ মুশকিলে।
রাজকবি:
আখেরি জমানা তার দেখাইছে দিব্য-নিদর্শন;
বাদশাহর খানদান নেই শরিফগোষ্ঠীর প্রতি খড়্গহস্ত তাই
ফাঁক পেলে শরাফতে হাত দেয়া চাই।
দরবারি:
ভায়া, আস্তে কথা কও, কেউ যদি শুনে ফেলে
দানাপানি মারা যাবে, সেই সাথে মস্তক খোয়াবে।
রাজকবি:
পরোয়া করিনে ভায়া বাঁচি কিংবা মরি,
তিনকাল অতিক্রান্ত, এককাল আছে,
এ রকম সংসারের সম্মানে বঞ্চিত বেঁচে থেকে
কি-ইবা হবে! লাদিয়া কাফিয়া দুই ছন্দের ফারাক
বোঝে না যে আহম্মক দেহাতি বর্বর,
দেখলে আপন চোখে কত সমাদর!
বাঁচব কেন! বাঁচার কি মজা আছে!
দরবারি:
আমি ভায়া বাঁচতে চাই।
বাঁচার যে মজা আছে হাড়মাংসে করি অনুভব
সম্প্রতি চতুর্থবার সাঙ্গ হলো শাদির উৎসব।
নওজোয়ান খুবসুরত সুতনুকা নতুন বেগম
দৃষ্টির আড়ালে গেলে বন্ধ হয় দম।
(কবির কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে বসল)
মির:
জাঁহাপনা, জান্নাতুল ফিরদাউস হতে জনক-জননী
পাঠাচ্ছেন নিত্য শুভাশিস, করেন কামনা সম্রাটের
সর্বাঙ্গীণ কুশল-কল্যাণ। আয়ুষ্কাল সম্রাটের
দীর্ঘস্থায়ী হোক, সহস্র বছর হোক সাম্রাজ্যের আয়ু।
হাশরের মাঠে নবির শাফায়েতরাশি ঝরুক
বৃষ্টির মতো সম্রাটের শিরে। শেষবিচারের
দিনে আল্লাহর রহমত যেন হয়ে স্নিগ্ধ ছাতা
আদরে আবৃত করে লোকমান্য মাথা।
সম্রাট সন্তাপহন্তা জাগ্রত কল্যাণ, সার্বভৌম
সর্বশ্রেষ্ঠ, তুচ্ছতম সন্তোষসাধনে ইচ্ছা করে
দেহপ্রাণ করে দেই নিঃশেষে কুরবান।
জমকালো দরবার কক্ষে থরে থরে নক্ষত্রের মতো
দীপ্তিমান জ্ঞানীগুণী প্রতিভার বিচিত্র বিন্যাস,
দেখামাত্র অন্তরে ঘনিয়ে ওঠে প্রশংসার বেগ।
ধন্য ধন্য বলি বাদশাহ আলমপনা, সচক্ষে
দেখছি বটে তবু ভাবি সত্য নয়, স্বপ্ন কিংবা চলমান
দুর্দান্ত কল্পনা। আমি তো দেহাতি লোক
সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, এমন তৌফিক নেই
অক্ষমতা ঢাকি। বুলিতে মাটির গন্ধ, লেবাসে
মিসকিন, ভাঙ্গাচোরা মানুষের সঙ্গে কাটে দিন।
ঝলমলে দরবার কক্ষে যারা আসে যারা যায়
দিব্যকান্তি দিব্যদেহধারী, অশেষ আশিসপ্রাপ্ত
তেজবীর্য ঐশ্বর্যের অংশ অপহারী।
আমি তো সামান্য লোক ঘুরি পথেঘাটে
খুঁজে পাই আপনারে মানুষের হাটে।
যেন নবীন জান্নাতখণ্ড বাদশাহর দরবার
ধুলিমাখা দু’চরণস্পর্শে হবে কলঙ্কিত
রক্তবর্ণ গালিচার পাড়। মহামান্য বাদশাহ সালামত
ফিরে যাই নিজ বাসে—চাই এজাজত।
সম্রাট:
স্বেচ্ছায় আসোনি তুমি, এসেছো তলবে
যাই বললে যাওয়া হয়, এটা কেন হবে?
মির:
জাঁহাপনা, আমার উতলা প্রাণ বলে, ‘যাই যাই’।
আলিশান দরবার কক্ষ সুপ্রশস্ত, ঝাড়বাতি
মণিমুক্তো উজ্জ্বল গালিচা শিরোপরে শোভা পায়
স্বর্ণচন্দ্রাতপ, সুবেশ সুন্দর নর বসে সারি সারি
ফেরেশতার মতো নম্র সুশীল দরবারি—মনে হয়
জন্মেনি নারীর গর্ভে, সম্রাটের আকাঙ্ক্ষায়
স্বর্গ হতে নেমেছে সবাই। অনুভব করি,
অন্তস্থ শ্রবণে শুনি নীরব ধিক্কার, ‘কি
চাস এখানে তুই গাঁয়ের গোঁয়ার!’
রাজকবি:
আগন্তুক কবিবর, সূক্ষ্মতর মারপ্যাঁচ
কথার কৌশলে প্রচ্ছন্ন অহমিকা থাকেনি গোপন;
পরিষ্কার অতি পরিষ্কার, অবাধ্যতা অহঙ্কার
দারিদ্রের উদ্ধত বড়াই—এ সকল সারবস্তু
যেন মহামান্য সম্রাটের কোন মূল্য নেই।
মির:
রাজকবি ভাই, আমি সংকুচিত অস্তিত্বের কারণে অস্থির,
ব্যথিতকে ব্যথা দেয়া উচিত কবির! এও এক
অভিজ্ঞতা, আপনার জবানিতে উচ্চারিত
বয়ানের অর্থ পাল্টে যায়।
কোতোয়াল:
মির তকি মির, গাঁজা ভাঙ্গ নেশার অধীন
মধুর মৌতাতে কাটে আপনার দিন, সুখরাজ্যে
বসবাস, তাই কি করেন কি বলেন ঘটে বিস্মরণ;
অন্যেরা তেমন বটে ভাগ্যবান নন, শুনলে শ্রবণে
বাক্য গেঁথে রয় মনে। বলবেন কি স্পষ্ট করে
কি কারণে দরবারে বিরাগ? কেন চিত্তে সুখ খুঁজে পান
সম্রাটের আমন্ত্রণ করে প্রত্যাখ্যান?
মির:
শক্তিমন্ত কোতোয়াল, অতল রহস্যভেদী সুতীক্ষ্ণ
সন্ধানী দৃষ্টি—এই নয় আমাদের প্রথম সাক্ষাত।
নাজুক সময় গেছে বড্ড অসহায়—আপনার অগোচর নয়
গুটিকয় দুর্বলতা, কুপথ্যের রুচি, অনুকম্পাবলে
নগরীতে মুক্তভাবে করি বিচরণ, সওয়াল তো অর্থহীন
কেবল দর্শনমাত্র কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর,
যে মানুষ বেসামাল তারে অধিক জেরবারে ফেলা
পৌরুষের পরিচয় নয়।
সম্রাট:
মির তকি মির, নয় সবটুকু যুক্তিহীন তোমার ওজর।
একটুখানি শঙ্কা থাকা ভালো। সমুন্নত সম্মানিত
মহত্ত্বে উড্ডীন ঊর্ধ্বে, আল্লাহর আরশের নীচে
যোগ্যজন সম্মিলনী ঝুলন্ত দরবার
ধরে আছে দৃঢ়রূপে সুমহান সাম্রাজ্যের ভার।
সাহসী বিদ্বান, ধর্মশীল প্রজ্ঞাবান, অর্থশাস্ত্রে
পারদর্শী, যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ, যোগ্য বিচারক
ভালমতো চিকিৎসার অন্ধিসন্ধি জানে
নক্ষত্র-জ্যোতিষবিদ্যা-বিশারদ, কাব্যকলা শিল্পকলা
কিমিয়ার জ্ঞান, দর্শনে নতুন কিছু, বিজ্ঞানের
নয়া উদ্ভাবনা, জগত ও জীবনের নতুন ভাবনা
টেনে আনে যারা নাচিকেত প্রশ্নবাণে, দরবারে
হংসের মতো করে বিচরণ, বংশগত অভিজাত,
ভারে কাটে যারা তাহাদের সংখ্যাবৃদ্ধি যুক্তিযুক্ত নয়,
ষড়যন্ত্রে মত্ত থাকে সকল সময়। ফিতরাতে
ধনী যারা, নিসর্গ যাদের চিত্তে অন্তর্দৃষ্টিরেখা
এঁকেছে নিবিড় করে বিদ্যুৎলেখায়, বিরল
সে মনুষ্য প্রজাতি ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে সারা হিন্দুস্তান
আনন্দে সংগ্রহ করি উজ্জ্বল প্রতিভা। মনীষার
স্বর্ণদীপ্তি, বর্ণময় বিভাগ আলোকিত করে রাখে
দিগ-দিগন্তর। বড় সাধ সাম্রাজ্যের নয় শুধু,
জগতের নাভিকেন্দ্ররূপে দরবারের করি রূপায়ন।
নিছক খেয়ালে নয়—অতি প্রয়োজন—মেধা ও মনন বলে
নতুন জগত এক করবো সৃজন, নতুন মানুষ
চাই প্রাণরসে টগবগ জীবন্ত মননে
অন্তর্দৃষ্টি বিদ্ধ করে যুগের সীমানা।
মির তকি মির, তোমার খান্দান নেই—ক্ষতি কিবা তাতে—
সম্রাট স্বয়ং খান্দানস্রষ্টা, খান্দানের
ভারবাহী নন। যেহেতু তোমার প্রাণে প্রতিভার দ্যুতি
মিশে আছে, উচ্চারণে স্ফূর্তি পায় আশ্চর্য বিভূতি,
ধরে নাও পেয়ে গেছো নিসর্গের বর, তার সঙ্গে
যুক্ত হলে সম্রাটের সদিচ্ছার বেগ অনায়াসে
টপকে যাবে দরবারের সিঁড়ি। আদিযুগে ভাগ্য
ছিল নিয়ামক, মানুষ বিশ্বাসী ছিল ললাটলিখনে,
হালে রাজকীয় অনুগ্রহ ভাগ্যের স্থান করে
অধিকার সম্রাটের মহিমাকে করে সম্প্রচার,
সম্রাটের সুনজর পলকে ঘটাতে পারে জন্ম-জন্মান্তর।
মির তকি মির, সৌভাগ্য দুয়ারে এসে করে করাঘাত,
বাড়িয়ে দক্ষিণ হাত তুমি শুধু ডেকে নেবে ঘরে,
দেখো হৃদয়ে শ্রবণ পেতে শুনতে পাও কিনা
আয় আয়, দরবারের অন্তহীন মধুর আহ্বান,
অন্তরে ঝঙ্কারে কিনা আনন্দের গান।
মির:
মহামান্য বাদশাহ আলমপনা, সুপ্তপ্রাণে আনে সঞ্জীবন
এরকম শক্তিমন্ত প্রকাণ্ড কল্পনা, শুধুমাত্র কৃপা-
দৃষ্টিপাতে তুচ্ছবস্তু প্রাপ্ত হয় স্বর্ণের গরিমা।
মণিমুক্তো সুশোভিত, হীরকখচিত, পদ্মরাগ
নীলকান্তমণির ঝিলিক ঝুলন্ত চাঁদোয়াতলে,
স্বপ্নময় রত্নসিংহাসনবেষ্টিত দরবার।
সমুদ্রস্তনিত এই গোটা হিন্দুস্তান—তার অন্তরাত্মা
যেন স্ফটিকে গঠিত—স্ফটিকের স্তম্ভ সারি সারি
মর্ত্যবাসী মানুষের কামনার সার, পরাক্রান্ত
ভূমিস্বর্গ ঝলমলে দরবার যদি ডাকে
কার সাধ্য করে প্রত্যাখ্যান, ফিরায় দরবার
যারে এই বিশ্বভূমণ্ডলে তার কোথা স্থান?
সম্রাট স্বয়ং এক অয়ষ্কান্তমণি, ছোঁয়ামাত্র
ব্যক্তি হয় সার্বভৌমে লীন, থাকে না স্বতন্ত্র সত্তা
যে জন স্বাতন্ত্র্যবশে শিরদাঁড়া মেলে ভিন্ন হতে
চায় স্পর্ধায় সাক্ষাত-মরণ তার কোনজন ঠেকায়?
জাঁহাপনা, এই বেলা বোধগম্য হলো, কেন
বলে লোকে দিল্লির ঈশ্বর বটে জগত ঈশ্বর।
খাকসার স্বভাববদ্ধ তুচ্ছ শব্দদাস
তারও প্রাণে সম্রাটের তেজস্ক্রিয় চিন্তার
বাতাস সৃষ্টি করে ভূমিকম্প—এক অংশ
চায় সিঁড়ি টপকে স্বর্গলোকে করে আরোহণ
অন্য অংশ শুধু বলে পালাই পালাই। মনে মনে
দ্বিধান্বিত দ্বিখণ্ডিত আমি। এ পরম শুভক্ষণে
কেন জাগে মনোলোকে ভীষণ সংশয়!
সম্রাট:
মির তকি মির, অন্তরে হিম্মত রাখো,
ঘটে যাচ্ছে জন্মান্তর। নতুন জন্মের এই সুতীব্র
বেদনা, অন্তর্গত রক্তপাত, ক্ষণকাল সহ্য করো,
মনুষ্য জীবনমাত্র দ্বন্দ্বের অধীন—এইভাবে
কিছুকাল যাবে, তারপরে তুমি হবে নতুন মানুষ।
মির:
জাঁহাপনা, বুকে হাত দিয়ে আমি করি অনুভব
আমাকে আঁকড়ে আছে নানা বর্ণ দৃশ্যপট,
সপ্তস্তর শব্দের গুণ্ঠন, যদি চোখ রাখি টের পাই
বন্দী আমি ছাড়াতে পারিনে মায়া, অন্তরাত্মা বাঁধা
হাবিজাবি কতকিছু, তারই মধ্যে জীবনের ভালোবাসা
সাধা। আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় পাড়াগাঁর
শান্তসন্ধ্যা, বিহঙ্গকাকলি, দেহাতি হালটরেখা
লম্ফমান গোবৎসের স্নিগ্ধ হাম্বারব, কিষানের
কুঁড়েঘরে উৎসবের ধুম, মাঠে মাঠে পোয়াতি গমের শিষ
যেন দোলে প্রেয়সীর শাড়ির আঁচল,
নির্জন ঝরনার গান, গৃহে ফেরা পশুদের ধীরে পথ চলা,
গলায় ঘণ্টার ধ্বনি, আষাঢ়ের আকাশে ঘনায়
ঘন পনিরের মতো কৃষ্ণবর্ণ মেঘ, বর্ষণ উন্মুখ,
নবীন বৃষ্টির বেগে খেলে যায় সুখ, উৎফুল্ল
ধীবরপল্লী, মেঘের মতন কেশ মৎস্যগন্ধা নারী
কটাক্ষে হৃদয়ে হানে নির্মম কাটারি, প্রসারিত
শস্যক্ষেত্র, সুবঙ্কিম যমুনার তীর, কালের
গতির মতো রজতরেখার ধারা ধীরে ধীরে বয়,
নগরে প্রবেশদ্বারে হিজড়ের বাথান, গণিকাপাড়ার হল্লা
মাতালের আস্ফালন, বেলাবেলি মদ জুয়া গাঁজার আসর,
খসরুর মাজারে ওঠে স্বর্গসুখ জাগানিয়া কাওয়ালির সুর,
আল্লাহর করুণাধন্য কাকি বখতিয়ার, পবিত্র উরসরাতে
অনুরাগে নত হয়ে নেমে আসে আল্লাহর আরশ—
এই সব পরিচিত স্থান যেন মাতৃ অঙ্ক, বেঁধেছে হৃদয়-
মনে বন্ধনের ডোর, যতক্ষণ কাছাকাছি থাকি
অপূর্ব আনন্দ প্রাণে ভিড় করে, নিঃশ্বাস প্রবাহের মতো
বাক্যধারা সতত উজায়, উচ্চারিত শব্দে জাগে
ছন্দের ঝংকার, কখনো-সখনো মনে হয়
কবিতার জন্মভূমি আমার হৃদয় নয়, গভীর মাহাত্ম্যপূর্ণ
এইসব স্থান। শিশুকাল থেকে গণ্য করি বিধাতার
অকৃপণ দানে পরিপূর্ণ আমার ভাণ্ডার,
চঞ্চল বালক যেন অব্যক্ত পুলকে চয়নবয়ন করে
শব্দের মালিকা, ভরাই থালিকা ছন্দ মাত্রা
অলঙ্কার সহযোগে। পিপুল শাখায় বসে যে
কোকিল গান গায়—যে বুলবুল লেজ নেড়ে ছুটোছুটি করে
ভেবেছি তাদের সাথে জুটি বেঁধে এই জনপদে
মনের আনন্দে শুধু গান গেয়ে যাবো—
সুখ নয় স্বর্গ নয়—জগতপ্রাণের মাঝে ঢেলে দেবো প্রাণ।
আমি তো আমার নই, নেপথ্যে অদৃশ্যশক্তি
আমারে চালায়, ক্ষিপ্রবেগে অর্ধেক অস্তিত্ব যেন
কেড়ে নিয়ে যায়। সম্রাট সংকটত্রাতা—সবিনয়ে
রাখি নিবেদন, সমীচীন নয় পিঞ্জিরায়
বন্দী করা কাননের পাখি।
রাজকবি:
আগন্তুক কবিবর, প্রশ্ন রাখি, আপনার
বয়ানচাতুরি নিঃসন্দেহে চমৎকার। সত্যকথনের
ছলে অপকৃষ্ট রুচির প্রকাশ,
আদব ও লেহাজের কোন গন্ধ নেই, হিজড়েপল্লী
গণিকা-আলয় আপনার বর্ণনায় কেন স্থান পায়?
কোতোয়াল যে গোপন ফর্দ করেছে দাখিল
আপনার অপরাধ তার চেয়ে অধিক, সম্রাট
স্বয়ং এক দয়ার সাগর, হিংসে নিন্দে অপবাদে
নিশ্চেতন, আপন মহত্ত্বে স্থির, একটা
পরীক্ষা হলো, ক্ষেপা মোষের মতো ঢুস দিয়ে
দেখলেন অটল গম্ভীর যে পর্বত তারও যদি ধৈর্যচ্যুতি ঘটে!
প্রথম দরবারি:
রাজকবি পেশাগত ঈর্ষা থেকে মুক্ত নন
তবে মির তকি মির এক বাহাদুর কবি, খাসলতে
অপদার্থ, আত্ম কিংবা পর সকলের প্রতি তাঁর সম অবিচার।
দ্বিতীয় দরবারি:
কবি হলে কি-ইবা হলো, পাগল তো নয়
এরকম বেলেহাজ বেতমিজ ফাহেসা জবান
বাদশাহর উচিত তার যোগ্য দণ্ডদান।
তৃতীয় দরবারি:
কি রকম দণ্ড হলে ভাল শিক্ষা হয়?
প্রথম দরবারি:
মৃত্যুদণ্ড অঙ্গচ্ছেদ—অবশ্যই নয়।
দ্বিতীয় দরবারি:
তাহলে তো ভাড়া করে আনতে হয়
আরো এক কবি, স্বভাবে কবিতা লেখে, পেশায় কসাই
প্রতিবাক্যে হানে যেন মুগুরের ঘাই।
প্রথম দরবারি:
কারো যেতে হবে না কোথাও। রাজকবি
যোগ্য লোক, একটু বয়স বেশি, তথাপি দায়িত্ব দাও
দেখতে পাবে কি কঠিন কথার আঘাত
প্রতিবাক্যে দরদর ঘটে রক্তপাত।
প্রধান উজির:
(একটু কেশে)
জাঁহাপনা, দরবারের মান রক্ষা
সম্রাটের দায়। আপনার আমন্ত্রণ করে প্রত্যাখান
মির তকি খারাপ দৃষ্টান্ত এক করেছে স্থাপন,
পরিণাম ভয়াবহ, এই কথা রাষ্ট্র হলে ঢি ঢি
পড়ে যাবে, সার্বভৌম সম্রাটের আদেশ অমান্য
করে তুচ্ছ এক কবি, তাহলে তো ঘটতে পারে সবই;
সামন্ত রাজন্যবর্গ, দরবারে দরবারি, সুবাদার
মনসবদার, হাজারি গাজারি যদি আপন ইচ্ছের বেগে
ছোটে দিশেহারা, কি করে শাসন চলে
ভীষণ নাজুক হবে সাম্রাজ্য পাহারা।
সম্রাট:
(স্বগত)
মির তকি মির, শুরুতেই সতর্ক করেছি।
সদা স্বতস্ফূর্ত ভাব আসলে দুশমন। আশঙ্কা
সঠিক হলো, উজানি মাছের মতো কানে হেঁটে
এসে গেলে আইনের আওতায়, তোমার নিস্তার নেই।
(প্রকাশ্যে)
মির তকি একথা কি ঠিক!
সম্রাট আজ্ঞা লঙ্ঘন করো এত স্পর্ধা! এত বড়ো জেদ!
মির:
জাঁহাপনা, খোদাবন্দ বাদশাহ মেহেরবান,
আমার জিন্দেগি হোক আপনার খেদমতে কুরবান,
সম্রাটের আমন্ত্রণ সম্মানের উত্তরীয় হয়ে
সর্বাঙ্গ আবৃত করে রয়েছে জড়িয়ে,
আমি হই তেমন এক মন্দভাগ্য লোক
শিরোপা সম্মান আর উচ্চতর মহত্ত্বগৌরব
যার হৃদয়ধর্মের কাছে মানে পরাভব; সম্বল
হৃদয়মাত্র, নিবেদন তাই টুটাফাটা প্রাণ নিয়ে
অভ্যস্ত জীবনে আমি ফিরে যেতে চাই।
সম্রাট:
মির তকি মির, তোমার হৃদয়ধর্ম—
সম্রাটেরও রাজধর্ম আছে, দুই ধর্ম পরস্পর মুখোমুখি
পথে দাঁড়িয়েছে, সম্রাট হৃদয়ধনে ভাগ্যবান
নন, সম্রাটকে চালায় কানুন, আজ্ঞালঙ্ঘনের
দায়ে অভিযুক্ত তুমি—অপরাধ লঘু নয়, শাস্তি পেতে হবে—
(দরবারিদের দিকে তাকিয়ে)
আপনারা স্থির করুন, কি শাস্তি দেয়া যায়।
দ্বিতীয় দরবারি:
অপরাধ জমকালো
সোজাসুজি শিরশ্ছেদই ভালো—
প্রথম দরবারি:
তাহলে তো সম্রাটের নামে
দারুণ কলঙ্ক রটে, ভাবি ইতিহাসে
এ কথা লিখিত হবে, চিত্তসুখ লাগি
সম্রাট নিয়েছেন ক্ষ্যাপাটে কবির প্রাণ—
যা কিছু লিখিত হয় কালির অক্ষরে
টিকে থাকে বহুদিন বহুযুগ ধরে।
তৃতীয় দরবারি:
দুই হাত কেটে যদি ছিন্ন করা হয়!
প্রথম দরবারি:
লাভ নেই তাতে, মূল উৎস অন্যখানে
জিহ্বা থেকে অনর্গল কবিতা বেরুবে।
তৃতীয় দরবারি:
একসঙ্গে দুই হাত জিহ্বার কর্তন
করা হলে শাস্তি হয় উচিত মতন।
চতুর্থ দরবারি:
কাটাকাটি মারামারি এসব কি কাজ
একযোগে কেড়ে নাও সংসার সমাজ,
নির্বাসন দণ্ড দাও, যাক দেশান্তরে
মরু কি সাগরদ্বীপে মরুক সন্তরে।
প্রথম দরবারি:
উত্তম প্রস্তাব বটে ফাঁক আছে ম্যালা
যদি জানে সম্রাটশত্রু তাহলে ঘাপলা,
মির তকি পায় যদি নয়া দানাপানি
গদ্যে পদ্যে লিখে যাবে সম্রাটের গ্লানি;
তকিকে শাস্তি তো পেতে হবে অবশ্যই
অন্য কোন পন্থা দেখো, নির্বাসন নয়।
দ্বিতীয় দরবারি:
প্রথম দরবারে আমে কবির বিচার
বিষয়টা অভিনব—ভাবভাষ্যে চমৎকার।
একসঙ্গে মণি আর কাঞ্চনের যোগ
দাবি করে সকলের তীক্ষ্ণ মনোযোগ;
শূলদণ্ড, কারাদণ্ড, দণ্ড নির্বাসন,
অঙ্গচ্ছেদ মুণ্ডুচ্ছেদ, হাত পা কর্তন,
শুনে শুনে প্রতিদিন এ সকল রায়
সয়ে গেছে সকলের জলভাত প্রায়।
ধারা উপধারা আছে ঠেসে দিলে হলো
ভেবেচিন্তে কাজ নেই,
কার হলো বংশনাশ কার প্রাণ গেল।
মির তকির মামলাটি আসলে জটিল—
আইনগ্রন্থ আসে না কাজে— অতয়েব শাস্তি হওয়া
চাই সৃষ্টিশীল।
কল্পনা হাত পা মেলে খেলা করা চাই
তাহলেই পাওয়া যাবে মিরের দাওয়াই;
জিন্দানে ক্ষুধাতুর রেখে পূর্ণ তিনদিন
মিরকে শোনাতে হবে কবিতা ও বীণ,
পালাক্রমে প্রণয়িনী গণিকারা এসে
গেয়ে যাবে তকি মির বিরচিত গান,
দেখবে চতুর্থ দিনে কেচ্ছাখতম
স্বরচিত কাব্য হলো হন্তারক যম;
পরিষ্কার আমাদের সকলের বিবেক উজ্জ্বল
মিরের প্রকৃত হন্তা নিজহস্তে রচিত গজল।
প্রধান উজির:
মহামান্য বিদগ্ধ আমির
উর্বর কল্পনাশক্তি, যুক্তিযুক্ত শাস্তির প্রস্তাব
ফাজিল কবির ভাগ্যে এও এক লাভ—বোঝা গেল
সম্রাটের দরবারে সেও তুচ্ছ নয়
বিদগ্ধ আমির করে এতখানি চিন্তাশক্তি ক্ষয়—
দেখা যাবে যুদ্ধক্ষেত্রে গুজরাট কাবুলে
কল্পনা সম্বল করে জয় যদি মেলে।
ভাঁড়:
প্রবল প্রতাপ নিয়ে হাজির বাদশা হুজুর—
আসমানের সুরুজের মতো মহামান্য সম্রাটের অখণ্ড প্রতাপ।
যদি সম্রাট হুজুর একজন হিজড়ের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান
অমনি তার শরীর ভেদ করে যৌবন দেখা দেবে। অমন সম্রাটের জান্নাতসদৃশ দরবারে বসে আপনাদের পরামর্শগুলো শুনে শুনে আমার বুড়ো শরীরে বাত ধরে গেল। আপনারা নকশাদার কথা বলেন খুব ভালো। চিবিয়ে দেখলাম ওতে সারপদার্থ অধিক নেই। এই খবিস মির তকিকে শায়েস্তা করার জন্য অতখানি কল্পনা-জল্পনা করতে হবে কেন? আমার হাতে আছে তার মোক্ষম দাওয়াই। সম্রাট হুজুর! উজিরে আজম বাহাদুর! দরবারি ভাইরা! একটু মনোযোগ দিয়েই শুনুন।
আমি এই হারমজাদাকে এমন শাস্তি দিতে পারি, কবিতা রচনা লাটে উঠবে আর মরতে চাইলেও মরতে পাবে না। বিছুটি লাগিয়ে দিলে জ্বালা-যন্ত্রণায় মানুষ যেমন মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, মিরের ব্যাটাকেও অমন করে তামাম জিন্দেগি কাটাতে হবে।
সম্রাট:
(ঈষৎ হেসে)
দোস্ত মস্ত গলদ হয়ে গেছে, প্রথমে তোমার মতামত চাওয়া হয়নি; এখন তোমার ভারি এবং মহামূল্যবান মতামত উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করো।
ভাঁড়:
সম্রাট হুজুর, আমার সঙ্গে এক খাণ্ডারনি আওরতের জান-পহচান আছে, তার নাম মেহেরজান বানু। মেহেরজান বিবি দরিয়াগঞ্জে থাকে, বয়স পঁয়তাল্লিশ হবে, হলে কি হবে, শরীরে খুব ঢলানি আছে, দাঁতে মিশি দেয়, মাথায় বাসতেল মাখে। সেই মেহেরজানের সঙ্গে আমি মির তকির শাদির ব্যবস্থা করবো, দেখবেন দোসরা দিনে তার অবস্থা গয়া। এ পর্যন্ত মেহেরজান ষোল জন খসমকে বেমালুম হজম করে ফেলে সতের জনের এন্তেজারে রয়েছে। পয়লা শাদি করেছিল সলিম বেগকে, সে ছিল সম্রাটের বাহিনীতে তুরানি ঘোড়সওয়ার, মেহেরজানের চোটপাটে অস্থির হয়ে সে একবারে তুরান পালিয়ে বেঁচেছে। তার দোসরা খসম ছিল মির্জা নাসের, সে সম্রাটের খাজাঞ্চিখানায় পেয়াদার কাজ করতো, মেহেরজানের সঙ্গে শাদি হওয়ার একত্রিশ দিনের দিন পিপুল গাছে ফাঁসি দিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে, সকালে উঠে সকলে দেখলো তার শরীরে কাক ঠোকরাচ্ছে। তার তেসরা খসম ছিল শেরমাস্তান খান, সে ছিল জবরদস্ত কাবুলি পাঠান, বাজারে হিং এবং শিলাজুত ফিরি করতো, এই পাঠানের বাচ্চাটি ছিল খুব তেজিয়ান, অতি কষ্টে মেহেরজান তার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। জিন্দেগিতে মেহেরজান বিবি মাত্র একবারই কষ্টে পড়েছিল। আরো বলবো হজুর?
সম্রাট:
ইয়ার, আর নয়, ঢের হয়েছে। বুঝতে পারছি তোমার মেহেরজান খুব বিক্রমশালী আওরত। মিরের সঙ্গে শাদি দেয়ার বদলে সেনাবাহিনীর সিপাহশালার করে দিলে মেহেরজান বিবির বিক্রমের প্রতি সুবিচার করা হয়।
ভাঁড়:
সম্রাট হুজুর ভাঁড়ের সঙ্গে আবার ভাঁড়ামি করছেন না তো! তাহলে দিলে আমি মস্ত চোট পেয়ে যাবো।
সম্রাট:
(মির তকি মিরকে বাইরে দর্শকের সারিতে সরিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত করলেন এবং
দরবারিদের সন্নিকটে আসার আহ্বান জানালেন।)
উজিরে-আজম! সমবেত বন্ধুবর্গ! দরবারি সুজন!
বিষয়টা হালকা তবু দাবি করে সকলের মস্তকমন্থন,
বাইরে সরল বটে অভ্যন্তরে গ্রন্থিময়
একটা বিহিত করা জরুরি ফরজ।
আমার প্রতীতি হয় অদ্যকার দরবারের
সিদ্ধান্তের সার—মিটিয়ে বিশেষ দাবি—
সুবর্ণরেখার মতো আইনে নতুন মাত্রা করবে সংযোগ,
অতয়েব পূর্বাপর বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি,
যেন দণ্ড হয় যথাযথ ইতিহাসে মুক্তি যেন পায় দণ্ডধারী।
এখন মুশকিল হলো চন্দ্রাহত বদ্ধোন্মাদ হলে
মানে মানে করা যেত মিরকে বিদায়, আমাদেরও
চুকে যেতো দায়। মির তো পাগল নয়, আপন
স্বভাববদ্ধ জাগ্রত প্রতিভা—গনগনে অগ্নিগিরি—
তার পক্ষে সমস্ত সম্ভব, মেজাজ
প্রসন্ন হলে মধু বরিষন—অন্যথা করে বসে
অনল উদগার; কতিপয় পাখি আছে
আপন কণ্ঠের গানে মুগ্ধ হয়ে বনে বনে থাকে,
সোনার পিঞ্জর দেখে শিহরে শঙ্কায়,
তকি মির তেমনি বিরল এক ঋদ্ধসিদ্ধ লোক
প্রাণের আগুনে সেঁকে সৃষ্টি করে শ্লোক।
যদি এই বিচার আসনে বসে বিশ্বজয়ী বাদশাহ
সিকান্দার, মিরের কি দণ্ড হতো জিজ্ঞাসে
অন্তর, জানিনে দরবারে দাওয়াত করা
ঠিক হলো কিনা, আপনারা সাক্ষী সব
যেমন বুনোঘোড়া গ্রীবা নেড়ে বলে দেয়
নেবে না সোয়ারি, মিরের উক্তির সঙ্গে
কোথা যেন মিল আছে ভারি;
সম্রাট-আজ্ঞা দর্পভরে এমন হেলায় যে জন
লঙ্ঘন করে মৃত্যুদণ্ড তার জন্য লঘুশাস্তি হয়।
তবে একথাও মিথ্যে নয়, ভিন্ন অবস্থান থেকে মিরের
তারিফ করা নিতান্ত সহজ—যেহেতু কবির কণ্ঠে
মূর্ত হন স্বয়ং ঈশ্বর, শর্তহীন স্বাধীনতা
কবির ফুসফুসযন্ত্রে হাওয়ার মতো করা চাই
দিব্যি চলাচল। মির তকি মির নিজস্ব বয়ানে
সম্রাটের মহিমাকে করে অস্বীকার স্পষ্টত
ঘোষণা করে নিজের আপন ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র স্বরাট।
যমুনার তীর, দেহাতি হালটরেখা, আষাঢ়ের
রিমিঝিমি মেঘ বরিষন, ঘিনঘিনে ধীবরপল্লী
অপদার্থ হিজড়ে আর পাপিষ্ঠা গণিকা, ফুলপাখি
শস্যক্ষেত্র, পশুর চিৎকার সকলের প্রভুরূপে
করে অবস্থান; এখন মালুম হলো
এই সুবিস্তৃত রাজ্যপাট যেন তাঁর কবিতার মর্মকোষ
নিত্য নিত্য প্রাণরসে ফলে ওঠে ছন্দোগাঁথা শব্দের
ঝঙ্কার, রাজারূপে মির তকি কাব্যরাজি
পায় উপহার। ক্ষুদ্র হোক, হোক বায়বীয়,
মিরের জবানে আছে ভ্রূণাকারে বিদ্রোহের
সুর, অপরাধ দণ্ডযোগ্য অপরাধ, অনিচ্ছায়
ঘটে যাওয়া হঠাৎপ্রমাদ নয়—মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য তাঁর—
যদি হয় কার্যকর শঙ্কা করি আমরা দণ্ডিত
হবো ভবিষ্যতকালে, তাই আমি মনে মনে
সকলের বয়ানের মর্মবস্তু করেছি চয়ন আর
নিজস্ব সিদ্ধান্ত বলে অভিনব শাস্তিদণ্ড করি
উচ্চারণ—ইচ্ছেমতো চলাফেরা মিরের বারণ।
স্থাবর কি গতিমান, দৃশ্য কি অদৃশ্য, কল্পনার যতো
রাজ্যপাট, আইনের খড়গের ধারে সমস্ত লোপাট
হলো, যমুনার তটরেখা, দেহাতের পথ, হিজড়ে
গণিকাপাড়া, ধীবরকুটির, খসরুর মাজারে আড্ডা,
কাকি বখতিয়ার, পাপকেন্দ্র পুণ্যস্থান, সবখানে
ছদ্মবেশে থাকবে প্রহরী, কোনখানে কালোমুখ
দেখাবে না মির, নিষেধাজ্ঞা জারি হলো এই দণ্ডে স্থির।
নগরে চাঁদনিচকে সংকীর্ণ কুটিরে একলা একাকী
সঙ্গীসাথীহীন মিরকে কাটাতে হবে জীবনের দিন।
ঢোলবাদ্য সহযোগে এই দণ্ড বলে দাও হেঁকে
তকি মির উচ্ছেদ হলো কাল্পনিক
রাজ্যপাট, কবিতার মর্মকোষ থেকে।
দরবারিবৃন্দ:
সাধু! সাধু! সাধু!
মারহাবা! মারহাবা!
এ রকম সুবিচার আমাদের সম্রাটে সম্ভব।
মির:
এতক্ষণ ঢাকা ছিল ঘন কৃষ্ণমেঘে
স্বরূপে প্রকাশ পেল ঝড়ো হাওয়া লেগে;
সম্রাটের অগ্নিক্ষরা তীব্র জ্বালামুখ
শূলপাণি দণ্ডধারি মানবিক করুণাবিমুখ
নিক্ষিপ্ত বজ্রের দাহ নামুক নামুক,
অপমান অসম্মান কলঙ্কের ভার
নামুক কবির ঘাড়ে ভাগ্যের তরবার;
অত্যাসন্ন অন্ধকারে চিরস্থায়ী হোক
গম্ভীর জমাটবাঁধা স্তব্ধতর শোক—
অনাদি অনন্তকাল নয় পরমায়ু
প্রাণের সন্তাপ নেবে জল আর বায়ু।
এই প্রাণ অন্ধকারে কোন একদিন
সময়সিন্ধুর বুকে হয়ে যাবে লীন,
হাওয়াতে খোদাই করা অমর অক্ষরে
আমার করুণ মুখ যুগ যুগ ধরে
সময়সাগর বুকে বিদ্রোহী পদ্মের মতো ছড়িয়ে সুঘ্রাণ
গেয়ে যাবে মুক্তি প্রেম আনন্দের গান।
হে সম্রাট তাই হোক, তবে তাই হোক,
নিক্ষিপ্ত বজ্রের দাহ নামুক নামুক;
অপমান অসম্মান কলঙ্কের ভার
নামুক কবির ঘাড়ে ভাগ্যের তরবার।
(মির তকি মির দুহাতে মুখ ঢাকলেন। দুজন প্রহরী তাঁকে টেনে নিয়ে গেল।)
উৎস:
১. আহমদ ছফা, লেনিন ঘুমাবে এবার (চট্টগ্রাম: নিপ্পন একাডেমী, ১৯৯৯) ।
২. আহমদ ছফা, আহমদ ছফার কবিতা (ঢাকা: শ্রীপ্রকাশ, ২০০০)।
কে আর বাজতে পারে-আহমেদ ছফার কবিতা
যে শহরে বোবার মত জুলছে নীরবতা বুকের নদীর ঢেউে জাগে মাছের মত কথা কারা যেন সামনে দাড়ায় সোহাগ ভুলায় তারা ছায়ার মত চমক্কে মিলায় ছায়ার শরীরেরা কে আর বাজাতে পারে পাখী তোমার মত কে আর লুকাতে পারে পাখী তোমার ক্ষত কে আর বাজাতে পারে পাখী তোমার মত কে আর লুকাতে পারে পাখী তোমার ক্ষত