দেবব্রত সিংহ এর কবিতা






ত্যাজ

আবৃত্তি শুনুনঃ 

আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার
শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি
কাগজ আওলারা বললেক,
উঁহু অতটুকন বললে হবেক কেনে
তুমি ইবারকার মাধ্যমিকে পথম
তুমাকে বলতে হবেক আর অ কিছু।
টিভি আওলারা বললেক,
তুমি ক্ষেতমজুরের মেইয়া
তুমি কী করে কামিন খাটে মাধ্যমিকে পথম হলে
সেটা তুমাকে বলতে হবেক খুলে
পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান,উপপধান,এম.এল.এ.এম.পি.
সবাই একবারি হামলে পড়ল আমাদে মাটির কুঁড়াঘরে ।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার কন বিহানবেলায়
টিনের আগুড় খুলে
হাঁকে ডাকে ঘুম ভাঙ্গাই
খবরটা যখেন পথম শুনালেক
তখেন মা কে জড়াই শুয়েছিলম আমি,
কুঁড়াঘরের ঘুটঘুটা অন্ধকারে
হেডমাস্টার কে দেখে
মায়ের পারা আমিও চোখ কচালে হাঁ হয়ে ভালেছিলম
ইকি স্বপুন দেখছি নকি,
সার বললেক ,ইটা স্বপুন লয় সত্যি বঠে।
কথাটা শুনে কাঁদে ভাসাইছিলম আমরা দু মা বিটি
আজ বাপ বাঁচে থাকলে
মানুষটাকে দেখাতে পারথম
আমি দেখাতে পারথম বহুত কিছু
আমার বুকের ভিতরে যে তেজাল সনঝাবাতিটা
জ্বালে দিয়েছিল মানুষটা
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদে কুঁড়াঘরটাকে
আলো করেছে সেটা দেখাতে পারথম ।
আপনারা বলছেন বঠে
কথাটা শুনতে কিন্তুক খুব ভাল অ,
“তুমাদে মতন মেইয়ারা যদি উঠে আসে
তাহালে আমাদে গোটা দেশটাই উঠে আসে”,
কিন্তক উঠে আসার রাস্তাটা যে আখনও তয়ার হয় নাই
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কী জিনিস
বহুত দম লাগে
বহুত তেজ লাগে।

আমি জামবনির শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি
যখন থাকে হুঁস হ ইছে তখন থাকে শুনে আসছি
” বিটি না মাটি”,
ঠাকুমা বলথক,
পরের ঘরে হিঁসাল ঠেলবেক তার আবার লেখাপড়া
গাঁয়ের বাবুরা বলথক,
তুই কুঁইরিপাড়ার বিটিছেলা
তোর কামীনখাটা ছাড়া গতি কি ।
বাপ বলথক, দেখ সাঁঝলি
মন খারাপ করলি ত হারে গেলি
শুন যে যা বলছে বলুক
ইসব কথা এক কানে সিমালে
আরেক কানে বার করে দিবি ।

তখেন বাবু পাড়ার কুচিল দেঘরার ঘরে
কামীন খাটতক মা
ক্ষয় রোগের তাড়সে মায়ের গতরটা ভাঙ্গে নাই আতটা
মাঝেমধ্যে জ্বর টর আসত,
জ্বর আল্যে মা চুপচাপ এগনাতে তালাই পাতে
শুয়ে থাকত,
মনে আছে সে ছিল এক জাড়কালের সকাল
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি
ঝিঙাফুলা রোদ,
আমি সে রোদে পিঠ দিয়ে গা দুলাই পড়ছিলম
ইতিহাস
ক্লাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দেঘরা গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক
মায়ের জ্বর
সে তারা শুনতে নাই চায়
আমাদে দিদিবুড়ি তখন বাঁচে
কুলতলায় বসে ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে
বিড়ি ফুঁকছিল বুড়ি
শেষতক বুড়ি সেদিন পড়া থাকে উঠাই
মায়ের কাজটুকুন করতে পাঠাইছিল বাবু ঘরে ।
পুরন অ ফটক ঘেরা উঠান
অতবড় দরদালান
অত বড় বারান্দা
সব ঝাঁটপাট দিয়ে সাফসুতরা করে
আসছিলম চল্যে ,
দেঘরা গিন্নি নাই ছাড়লেক
একগাদা এঁটাকাটা জুঠা বাসন
আমার সামনে আনে ধরে দিলেক।
বললম,তুমাদে জুঠা বাসন আমি ধুতে নাই পারব।
বাবু গিন্নির সে কী রাগ ,
কী বললি
আরেকবার বল দেখনি
যতটুকুন মু লয় ততবড় কথা
জানিস তোর মা, তোর মায়ের মা, তার মায়ের মা
সবাই আমাদে জুঠা বাসন ধুইয়ে
আতককাল গুজারে গেল
আর তুই বললি জুঠা বাসন ধুতে লারবি ?
বললম, হ,তুমাদে জুঠা বাসন আমি ধুতে লারব
তুমরা লোক দেখে লাও গা
আমি চললম।
কথাটা বলে গটগট করে
বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেরাই চল্যে আইছিলম।

তাবাদে সে লিয়ে কী কান্ড কী ঝামালা
বেলা ডুবলে মাহাতোদে ধান কাটে
বাপ ঘরকে আলে
দু পাতা লেখাপড়া করা লাতনীর
ছোট মুখে বড় থুতির কথা
সাতকাহন করে বলেছিল দিদিবুড়ি,
মা কোনো রা কাড়ে নাই
আঘনমাসের সনঝাবেলায় এগনাতে আগুন জ্বালে
গা হাত পা সেঁকছিল মা,
এক মাথা ঝাঁকড়া কালো চুল ঝাঁকানো বাপের
পেটানো পাথরের মুখটা
ঝলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে ।
বাপের অমন চেহারা
আমি কোনোদিন দেখি নাই
বাপ সেদিন মা আর দিদিবুড়ির সমুখে
আমাকে কাছকে ডাকে
মাথায় হাত বুলাই গমগমা গলায় বলেছিল,
যা করেছিস বেশ করেছিস,
শুন , তোর মা, তোর মায়ের মা, তার মায়ের মা
সবাই করেছে কামীন গিরি
বাবু ঘরে গতর খাটাই খাইছে
তাতে হ ইছে টা কী,
ই কথাটা মনে রাখবি
তুই কিন্তুক কামীন হওয়ার লাগে জন্মাস নাই
যত বড় লাট সাহেব ই হোক কেননে
কারু কাছে মাথা নুয়াই লিজের তেজ বিকাবি নাই
এই তেজ টুকুনের লাগে লেখাপড়া শিখাচ্ছি তোকে
নাহালে আমাদে পারা হাভাতা মানুষের ঘরে
আর আছেটা কি।

আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার
শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি
কবেকার সেই ক্লাস সেভেনের কথা ভাবতে যাইয়ে
কাগজ আওলা টিভি আওলাদের সামনে আখন
কী যে বলি
তালপাতার রঁদ দিয়ে ঘেরা গোবুরলাতার এগনা তে লোকে আখন লোকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই জীবগাড়িতে চাপে
আগু পেছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আলেক ছুটে,
কোথায় সাঁঝলি কুঁইরি কোথায়
বলতে বলতে বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে
সোজা আমাদে মাটির কুঁড়াঘরে।
হেড সার বললেক, প্রনাম কর সাঁঝলি প্রণাম কর,
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়ালেক
পিঠ চাপড়াই বললেক,
তুমি কামীন খাটে মাধ্যমিকে প্রথম
তাই তুমাকে দেখতে আলম
সত্যি বড় গরিব অবস্থা
তুমাদে মতন গরিব ঘরের মেয়েরা যাতে উঠে আসে
তার লাগে আমাদের পার্টি
তার লাগে আমাদের সরকার
নাও দশ হাজার টাকার চেক টা আখন নাও
শোনো আমরা তোমাকে আরো টাকা তুলে দেব
ফুল দেব
সম্বর্ধনা দেব
এই টিভির লোক কাগজের লোক কারা আছেন
এদিকে আসুন।

তক্ষুনি ছোট বড় কত রকমের সব
ঝলকে উঠল ক্যামেরা
ঝলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ
না না মন্ত্রী লয়
ঝলকে উঠল আমার বাপের মুখ
গনগনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ
আমি তখুনি বলে উঠলম,
না না ই টাকা আমার নাই লাগবেক
আর আমাকে যে ফুল দিবেন সম্বর্ধনা দিবেন
আর অ দেদার টাকা তুলে দিবেন
তাও আমার নাই লাগবেক।
মন্ত্রী তখন ঢোক গিললেক
গাঁয়ের সেই দেঘরা গিন্নির বড় বেটা
সে আখন পার্টির বড় লেতা
ভিড় ঠেলে সে আসে বললেক,
কেনে কী হ ইছে রে সাঁঝলি
তুই ত আমাদে ঘরে কামীন ছিলি
বল তোর লাগে আমরা কি করতে পারি বল
তোর কি লাগবেক সেটা খুলে বল।

বললম, আমার পারা শয়ে শয়ে আরো অনেক
সাঁঝলি আছে
আরো শিবু কুঁইরির বিটি আছে গাঁ গেরামে
তারা যদ্দিন অন্ধকারে পড়ে থাকবেক
তারা যদ্দিন লেখাপড়ার লাগে কাঁদে বুলবেক
তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া নাই লাগবেক
তদ্দিন কোনো বাবুর দয়া আমার নাই লাগবেক।



 

শিকড় – দেবব্রত সিংহ

কেঁদুলির মেলা পেরাই তখেন আমাদে রাঙামাটির দেশে
ফাগুনা হাওয়া বইছে,
কচি পলাশের পারা রোদ উঠেছে ঝলমলা,
সেই রোদ ধুলা পথে কানা বাউলের আখড়ায় যাতে যাতে
থমকে দাঁড়ালেক মাস্টর,
কিষ্টনগরের সুধীর মাস্টর,
বললেক, ‘তুই হরিদাসীর লাতি কানুবাগাল না?”
গরুবাথানের গোরুপাল খুলে
গাছতলাতে বাঁশি ফুঁকতে যাইয়ে
আমি ফিক করে হাস্যে ফেলেছি।
মাস্টর বললেক, ‘শুন তোকে একটা কাজ করতে হবেক’।
বললম, কাজ টো কি বঠে?
বললেক, ‘তোকে একটা ছবি আঁকে দিতে হবেক’,
ই বাবা! ছবি আবার কী আঁকব হে
আমি গােরুবাগালি আর বাঁশি ফুঁকা ছাড়া
আর ত কিছু জানি নাই ।
মাস্টর নাছোড়,
ঝোলা হাতড়ে বললেক, ‘এই লে রং, এই লে তুলি
এই লে কাগজ।’
সক্কাল বেলা গোরুবাথানের মাঠে এক পাল গাইগোরুর মাঝে
আমি হা হয়ে ভাল্যে,
বললম, বাবুদে ইসকুলডাঙাতে দেখগা যাইয়ে
আমার পারা কত ছেলেপিলেরা
বসে বসে ছবি আঁকছে,
দেদার ছবি।
মাস্টর শুনলেক নাই কিছুই।
বললেক, ‘উয়াদে ছবি অনেক আছে আমার ঝোলাতে
লে লে দেরি করিস না
তুই একটা গাছের ছবি আঁক দেখনি
অজয়ের পাড়ে এত ফুল ফুটেছে পলাশের
তুই আমাকে একটা পলাশ গাছের ছবি আঁকে দে।”
আমি আর কি করি
অত বড় মানুষ অমন করে বলছে
ই দেখে শেষতক কাগজ নিয়ে বসে গেলম
গরুবাথানের ধুলাতে
হেলাবাড়ি ছাড়ে বাঁশি ফেলে তুলি ধরলম হাতে,
তাবাদে ভাবতে ভাবতে একসমতে
অজয় লদীর পাড়ের একটা আদ্দা পলাশ গাছ’কে
উপড়াই লিইয়ে আস্যে
কৌটা ভর্তি রঙে চুবাই
বসাই দিলম মাস্টরের কাগজে,
কি হইছে কে জানছে
বললম, হেই লাও তুমার ছবি।
ছবি দেখে চোখের পাতনা লড়ে নাই মাস্টরের
আলোপনা মুখে মাস্টর বললেক,
‘তুই ই কি করলি
ই কি ছবি আঁকলি?’
বললম, কেনে, কি হইছে।
মাস্টর বললেক, পলাশ ফুলের গাছ টা না হয় বুঝলম
গাছের তলায় মাটির ভিতরে
তুই ই সব আঁকিবুকি কি আঁকলি?’
বললম, উগুলা শিকড় বঠে হে মাস্টর
চিনতে লারছ,
তুমি শিকড় চিনতে লারছ!
মাস্টর তখন ঝোলা উবুড় করে
যত ছবি সব দিলেক ঢাল্যে,
দেখলম কতরকমের সব গাছের ছবি
তার একটাতেও শিকড় নাই,
আমি অবাক,
বললম, হে মাস্টর,
ই গুলা কি গাছ বঠে হে-?
বাবুদে ঘরের স্কুলে পড়ে ছেলেপেলারা ইসব
কি আঁকছে?
মাস্টর কোনো রা নাই কাড়লেক
আমার আঁকা ছবির দিকে ভালতে ভালতে
একটা কথা শুদালেক,
‘তুই গাছের সঙ্গে শিকড় কেনে আঁকলি ?
বললম, ই বাবা, বড় আশ্চয্যি শুনালে বঠে
গাছ আছে শিকড় নাই
ই কখনঅ হয় নাকি?
তুমি বলঅ,
শিকড় ছাড়া কি গাছ বাঁচে?
জানঅ মাস্টর, বাপ বলথক
‘ছােটোলােক মােটোলােক যে যা বলছে বলুক
আমরা কি জানিস,
আমরা হলম শিকড়ের লোক
আমরা হলম শিকড়ের লোক।’



স্বাধীনতা – দেবব্রত সিংহ

কথাটা ত মিছা লয়
লালগড়ের জঙ্গলমহলের সবাই জানে
ডুমুরগড়্যা, বেণাচাপড়া, বাঁকিশোল,হাতিঘোসা,শালডাঙ্গা
মোহনপুর, কলাইমুড়ির জানে সবাই
দিনের বেলা পুলিশ
রাতের বেলা উয়ারা,
পুলিশ বলে স্বাধীনতা
উয়ারা বলে মিছাকথা
ফের পুলিশ বলে স্বাধীনতা
ফের উয়ারা বলে মিছা কথা,
আমরা গরীব মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
ইসবের ত কিছু বুঝি নাই,
তবু দিনের বেলা পুলিশ আসে,
“হপন আছিস?”
হঁ আইজ্ঞা আছি
আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
রাতের বেলা জঙ্গলমহলে রাত নামলে
আমার তালপাতায় ছাওয়া মাটির ঘরে
জুমড়াকাঠের আংরার পারা অন্ধকার
কপাট ও নাই হুড়কাও নাই
তখন উয়ারা আসে
কমরেড হপন আছো?
বলি হঁ আইজ্ঞা আছি
আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
এমনি করে দিন কাটে
এমনি করে রাত কাটে
ইয়ার মাঝে গেলবছরে
বাঁকিশোলের কালভাট গেল বোমা তে উড়ে
তখন আমি খাটতে গেছি খড়গপুরের মুরগি খামারে
দিনটা ছিল বাবুদে পতকা তুলার দিন
আমরা হাভাতা মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
পতকা ত বুঝি নাই
তাই ভাল্যে ভাল্যে দেখছিলম
কিরম তিরঙ্গা পতকা তুলছে বাবুরা
খড়গপুরের টাউনের বাবু
দেখতে দেখতে পুলিশ গাড়ি,
পুলিশ বললেক, তোর নাম কি?
বললম, হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
গাঁ?
বেণাচাপড়া।
বলক?
লালগড় জঙ্গলমহল।
বললেক, আর বলতে হবেক নাই চল চল।
বলি যাব অ কুথাকে?
বললেক,লক আপে।
সেটা কী বঠে আইজ্ঞা?
সে তুই বুঝে যাবি থানাতে গেলেই বুঝে যাবি।
ই বাবা আমি হপন মান্ডি হে
গরিব মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
উসবের ত কিছু বুঝি নাই।
মারাংবুরুর কিরা কাড়্যে বলছি
হাঁ দেখ অ বোমা যে কী জিনিস বঠে
বাপের কালে সেটা চোখে দেখি নাই।
বলতে বলতে আমার লাঙ্গল চষা আঁকল পরা হাতে
লুহার বেড়ি দিলেক পরাই
তারপরে ঘাড়ে ধরে ধাঁকালে জিবগাড়িতে দিলেক ভরে,
গাড়ির ভিতরে বন্দুকের নল ঠেকাই ইপাশে পুলিশ উপাশে পুলিশ
তার মাঝে আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
দিনটা ছিল বাবুদে পতকা তুলার দিন
থানায় তখন পতকা তুলছে দারগাবাবু
আমরা গরীব মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
ইসবের ত কিছু বুঝি নাই
তাই শুদাইছিলম,
ইটা কী বঠে আঁইজ্ঞা?
এই পতকা জিনিসটা কি বঠে?
পতকা তুললে কী হবেক আমাদে?
মাত্তক এইটুকুন কথা
মাইরি বলছি,
সেই কথা শুনে কি বলব
ভেড়ার পালে যেমনি হামলে পড়ে নেকড়া হুঁড়াল
তেমনি করে আমার ঘাড়ের উপরে
হামলে পড়লেক দারগাবাবু
তা বাদে বুট জুতা পরা পায়ে
এমন একটা গড়ারি দিলেক মারে
আমি মু থুবড়াই গেলম পড়্যে
বললেক,
তুই জানিস নাই
তুই শুনিস নাই
শা-লা
ইটাই তো স্বাধীনতা
ইটাই তো স্বাধীনতা ।
আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি
আমরা গরীব মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝথম
তিলষা বুঝথম
ইবার বুঝলম
কাকে বলে স্বাধীনতা
কাকে বলে মিছা কথা
কাকে বলে স্বাধীনতা
কাকে বলে মিছা কথা ।


দুর্গা – দেবব্রত সিংহ

ও বিল্টু তুই এখন কোথায় আছিস বাবা
তুই এখন আছিস কোথায়,
হাসপাতালে তোর বাপ বলেছিল “ছেলে তো অন্য ঘরে”
সেই ঘরটা কোথায় রে,
আমি সব ঘর দেখেছি ঘুরে

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে
আমি ঘুরে দেখেছি সব ঘর
কোথাও তোর দেখা পাইনি
দেখা পাইনি কোথাও ।
তারপর আর কি
তারপর ছুটির কাগজ হাতে তোর বাপ যখন
আমাকে নিয়ে গেট পার হয়ে
নামলো বড় রাস্তায়,
তখন দেখলাম গোটা কলকাতা শহর
সেজে উঠেছে পুজোর আনন্দে
গোটা কলকাতা শহর
মেতে উঠেছে পুজোর উল্লাসে
মণ্ডপ সজ্জা, প্রতিমা, আলো, আরো কত কী
মোটকথা কোথাও কিছু কম পড়ে নাই রে
কোথাও কিছু কম পড়ে নাই।
তোর বাপ আমাকে বাড়িয়ে বলেছিল অনেক কথা
আমি সেসব পাইনি দেখতে কিছুই
ওই যে রে মগজজীবী না বুদ্ধিজীবী
কি সব বলে না
সেই সব বড় বড় বাবুদের
মোমবাতি হাতে মিছিল টিছিল
সেসব আমি দেখতে পাইনি কিছুই
তোর বাপ মানুষটা চিরকালের
বড় হুজুগে মানুষ
কাগজে বেরোনো তোর ছবি পর্যন্ত
যত্ন করে রেখেছে কেটে
কুলপির গ্রাম থেকে দমদমের খালপাড়ের বস্তি
বাবুদের ঘরে বাসন মেজে ঘর মুছে
কাজের মাসির কাজ
সে দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল দশটা বছর
আমি জানি রে বিল্টু
আমি সব জানি,
একজন কাজের মাসির শিশু
বোমার আঘাতে ঝলসে গেলে
একজন কাজের মাসির শিশু
বোমার আঘাতে মুখ থুবড়ে ছিটকে পড়লে
আতঙ্কে যন্ত্রণায়
” মা-গো মা-গো”বলে চিৎকার করলে
“বাবা জ্বলে যাচ্ছে, জল দাও
আমায় জল দাও” বলে
কাতরে উঠলে ,
বড়জোর বাবুদের টিভিতে আর কাগজে
দু-‘চারদিনের খবর হতে পারে
তার বেশি কিছু না
তার বেশি আর কিছুই না ।
এখন বাবুরা সবাই খুব ব্যস্ত রে বিল্টু
মা আনন্দময়ীর আগমনে
বাবুরা এখন ব্যস্ত সবাই
মণ্ডপ সজ্জা, প্রতিমা, আলো,
কোথাও কিছু কম পড়ে নাই রে
কলকাতা শহরে কোথাও কিছু কম পড়ে নাই,
শুধু একজন কাজের মাসির-
থাক সে কথা,
জানিস বিল্টু
এবার আমি ভেবেছিলাম মুখ দেখবো না ঠাকুরের
আর কখখনো দেখবো না ওই মুখ,
তারপর কি হল জানিস
কাগজের লোকেরা প্রথম পাতায়
যে ছবিটা ছেপেছিলো তোর
সেই যে রে লাল চেক জামা পরা
তোর ডাগর চোখে চেয়ে থাকা সেই ছবিটা
সেটা বুকে চেপে আঁকড়ে ধরতেই
বুকের ভিতর কেমন যেন একটা হতে লাগলো আমার
তখনই ঠিক করলাম
যাবো
ঠাকুর দেখতে আমি যাবো
একাই যাবো
হাতজোড় করে মাকে বলবো
“মাগো, আমি খালপাড়ের বিল্টুর মা সীতা
জন্মের পরে বেছে বেছে
এই নামটাই রেখেছিল আমার মা
কেন রেখেছিল
কি ভেবে রেখেছিল
সে আমি জানি না
তোমায় মিনতি করি মা
তুমি আমার সীতা নামটা বদলে দিও
জনম দুখিনী সীতা নামটা বদলে দিও
আমি আর সীতা হতে চাই না মা
এবার আমি দুর্গা হতে চাই
অসুরদলনী দুর্গা
শিশুঘাতী অসুরদলনী দুর্গা।


যিখানে মাটি লালে লাল – দেবব্রত সিংহ

যিখানে মাটি লালে লাল কাঁকর লিয়ে গড়াগড়ি যায়
একটোপ জলের লাগে মুনিষ কামীন হাঁ করে
ক্ষেতের আড়ে জিরায়
ঝিঙাফুলা রোদের আঁচে গোরু বাছুর ধুকে মরে
ইদিক সিদিক ভাললে পরে
হট্টিটি পাখি আর চাতক পাখির সি -টো সি-টো করা সুরে
হলুদডাঙার মাঠে শাল ফোঁড়ের বনে পাতা লড়ে
একজাম বাসী ভাত আর মাড়ের লাগে
সেই দুখী দেশের মানুষ আমি
নামটা নাই বললম হে
পাড়ার বুড়া সদদারের তাগদ আওলা বেটা বঠি
কাল অ হুঁ দ হুঁ দা গতর ছাড়া
একটা তালপাতার আগুড় দিয়া ঘর আছে
তার লালমাটির দিয়ালে
আমার ভালবাসার মানুষের লকশা ছেপা
আমি থাকি ইধারে ত বাপ থাকে বেলগ
সারাবেলা ঘুরে ঘুরে গতর তার ঢিলা
টিংগের একটা তপড়া থালায়
দু’মুঠা ভাতের লাগে
ভিখ মাগে বুলে সে
চোখে আর লজর হয় নাই
গতর ও গেছে পড়ে
তবু গলা ঘরে বাবুদে কাছকে গেলে বলবেক,
“শালা রোজ রোজ ভিখ লিয়ে লিয়ে সুখ পায়ে গেছে “।
হায় রে
দেখেন ই বাবুদে তিন কুড়ি বিঘা জমির চাষ
বাপ এক কালে একলাই করেছে
আজ মাঝে মাঝে দুটা মাড় ভাতের লাগে
বাপের পেট ফুলে
ফোকলা দাঁতে কাতরানির মাঝে দুখের হাসি ফুটে
আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়
চুয়াল দুটা লুয়ার পারা কড়া
কিন্তুক কি হবেক
বাবুদে হিসাবে বুড়া ভিখ লিয়ে লিয়ে সুখ পায়ে গেছে
সুখ
ধরণকালে সবুজ গাছ পাত রোদে পুড়ে ছাই
রবি গয়লার মরি গাই আশথ তলায় হাঁপায়
তখেন পঞ্চাতের কাজ হয় রাস্তাতে পখরে
এক বেলা খাওয়া পেটে আমরা মেইয়া মরদ
কাঁধে কোদাল ঝুড়ি লিয়ে হাজির
বাবুরা দুদিন কাজ চালাই হুট করে তিনদিনের দিন বলবেক,
“আখন কাজ দশ দিন বন্ধ থাকবেক রে ”
বাবুদে তখেন গলায় চিকচিকা হার ঝুলবেক
জমি বন্ধকী কারবার চলবেক
লতুন মোটরবাইকের দমতক ধোঁয়া উড়বেক
ঘর ভিতরে সলি সলি চালের পুড়া বাঁধা হবেক
আবার কি গজড় ট দেখেন
দিন কতক বাদে বাবুরা একদিন মচ ফরকাই
আমাদিকে গাদে এক পোড় বুঝাই দিলেক,
“চল বলক আপিস ঘেরাও করতে হবেক
ইটা তদের অধিকার বঠে জানিস”
আমরা ত কিছু জানি নাই
বাবু দে টাকার ফিসফাস কত আগু থাকতে হয়ে গেছে
তাথেও যখেন সবাইকার গা গরম হয়ে গেল
চলে গেলম বলক
সিখানে বাস কতকবার গরম গরম
ঝিঙ্গা ভাত ঝিঙ্গা ভাত শুনাই
বাবুরা সাঁইকল চাপে মোটর সাঁইকল চাপে চ চাঁ চলে গেলেক
আর আমরা ধুপসী রোদে না খাওয়া পেটে
ছুটু ছুটু ছেলেপেলা লিয়ে মাছ ভাজা হয়ে
ঘরে ফিরে আলম।

তা বাদে মাসকতক পেরাই জাড়কাল আল্য
তখেন ত ক্ষেতে ক্ষেতে গাদা ধান
একা ধেড়া ইঁদুরের গাড়েই সলিটেক ধান বেরাবেক
তখেন আমাদিকে লেই কে
বাবুরা তখেন ধেড়ী কুকুরের পারা জিভ লেহে লেহে করে
বিহান বেলা তে হাজির হবেক,
“হে ধনা চল আজ বনের ধারে বহালে
আমার পাঁচ বিঘা ধান কাটতে হবেক
তুই নাহালে হবেক নাই”
কি বলব ই বাবুর পায়ে পড়ে বাপের লাগে
একসলি ধান জোগাড় করতে লারেছি ধরণকালে
আমার বাপ বুড়া গপপ অ করে
পঞ্চাশ সালের আকালে ই বাবুর বাপ দাদারা
সলি সলি চাল মাটি খুঁড়ে ঘর ভিতরে ঢুকাই দিলেক
তবু হাড়জিরজিরা ধুকা মানুষগুলাকে ঠেকালেক নাই।

সেই বন্দেমাতর করার দিন থাকে
আজকার দিনতক
আমরা সেই আছি
আখনো না পাই পরতে
না পাই সমবছর পেটভরে খাতে
লিরিফ দিয়ে লোন দিয়ে
ভোট আলে ভোটের লোট দিয়ে
চাল দিয়ে গম দিয়ে
শুকনা কথার লেকচার দিয়ে
আমাদিকে আখনও ভিখারি করে রাখেছে ।
বাবুরা কিন্তুক ঠিক আছে
যখেন যার রাজত্ব তখেন তার লেতা
ভোট আলে ঠিক সমতে ভোল পাল্টাবেক
ক্যানে আমরা কি কেউ ল ই
আমাদে পঞ্চাতের টাকা খাইয়ে বাবুরা পেট ফুলাবেক
কুড়ি বিঘার থাকে চল্লিশ বিঘা জমি বাড়াবেক
দালানবাড়ি মটরগাড়ি করবেক
আর আমরা
সেই আঘন মাসে বাবুদে ধান কাটব
জাড়ের চোটে ছেঁড়া টেনা উড়ে
হু হু করব
ধরণকালে রোদে পুড়ে গতর খাটাব
বরষা আল্যে জলে ভিজে বাবুদে চাষ উঠাব
তা বাদে ভাদর মাসে তপড়া টিঙের থালা লিয়ে
বাপ বেরালে
বাবুরা বারান্দার আরাম চেয়ারে গা হেলাই বলবেক,
“শালা রোজ রোজ ভিখ লিয়ে লিয়ে সুখ পায়ে গেছে”।

এই ভিখ মাঙ্গা বাপের ফটক আমি যেমন দেখছি
আমার বাপ ও তেমনি তার বাপ কে দেখেছে
আমি বুড়া হলে আমার বেটাও
ভাবতে ভাবতে কল কল করে ঘাম ছুটছিল আমার
পরের দিন ঠিক জলখাওকী বেলা
বাপ বেরোচ্ছিল ভিখ মাঙ্গতে
আমি যাইয়ে পথ আগুলে দাঁড়ালম
বাপের ভিখ মাঙ্গা হাত থাকে
টিঙের থালা টা কাড়্যে লিলম
ছানি পড়া ঘলা চোখে বাপ থ হইয়ে ভাল্যে
আমি দুহাতের তাগদ দিয়ে
দমড়াই মচড়াই
দুযযা করে ছুড়ে দিলম থালাটা
বাপ বললেক,”করলি কী রে
আমার গতর গেছে পড়্যে
থালাটা তুই ভাঙ্গে দিলি
আমি খাব কী”
বললম,” থালা ত আমি ভাঙ্গি নাই”
বাপ বললেক , “তাহালে উটা কী ভাঙ্গলি”
বললম, “ফটক ভাঙ্গলম বাপ,
বহুতকালের বাবুদে আমলের
মরচাপড়া জং ধরা ফটক
বাবুদে হাতের যতন করে বাঁধাই রাখা ফটক
আমি আজকে ভাঙ্গে দিলম
আজকে আমি ভাঙ্গে দিলম ।



দ্রোহ কথা – দেবব্রত সিংহ

দিনটা ছিল ঈদের দিন
খুশির ঈদের খুশির দিন
তখন আমার কিশোরীবেলা
তখন আমি তেরো কি চোদ্দ,
আমার ছোট কাকার মেয়ে
সে আমার থেকে অনেক বড়
দিল্লিতে কাজ করত কীসব
মাঝে সাঝে বাড়ি আসত
ঈদের দিনে সে আমাকে মেলা দেখাতে নিয়ে গেল
ক্যানিং ইস্টিশানে
সারি সারি দোকানদানি,রঙিন শাড়ি,রঙিন চুড়ি,
নতুন জামা,নতুন পোশাক,ঈদের মেলা,খুশির মেলা,
তার মাঝে ভিড় ঠেলে কোত্থেকে দিদি আমাকে
ঠান্ডা কিনে এনে খাওয়ালে
সে খাওয়ার পরই কেমন ঝিম মেরে উঠল সব
দেখতে পাচ্ছি
শুনতে পাচ্ছি
বলতে পারছি না কিছুই
দেখলাম ইস্টিশানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রেনে
তোলা হল আমাকে
তারপর আর কিছু না
তারপর ঢলে পড়েছি ঘুমে।

একসময় ঘুম ভাঙতে দেখি
আমার পাশে চারটি ছেলে
তাদের পাশে ছোট কাকার মেয়ে
তাকে দেখতে পেয়ে আমি শুধালাম,
“দিদি, আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস কোথায়?”
দিদি বলল,”তুই সবসময় দিল্লি দিল্লি করিস
তোকে দিল্লি নিয়ে যাচ্ছি।”
খুব তেষ্টা পাচ্ছিল আমার
জল চাইলাম,
সে জল খেতে আবার ঝিম মেরে গেল মাথাটা
ঘুমিয়ে পড়লাম
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ট্রেনে চড়ে আরো কতদূর গেলাম কেজানে হঠাৎ ঘুমটা যখন ভাঙল
তখন দেখি মস্ত একটা বড় ইস্টিশান
পাশে তিনটে নতুন ছেলে,
“দিদি গেল কোথায়
কোথায় গেল দিদি?”
ওরা বললে,”দিদি টিদি কেউ নেই এখানে
যা বলছি শোনো
চুপচাপ নেমে এসো
কথা বলো না
আর একটাও কথা বলো না”।

জায়গাটা ইস্টিশান থেকে অনেক দূরে
শহরের পুরনো একটা ঘিঞ্জি জায়গা
সেখানে পলেস্তারা খসা চারতলা বিল্ডিং
ঘোরানো সিঁড়ি
দেখি পরপর ঘরে শুধু মেয়ে আর মেয়ে
কম বেশি আমার বয়সী সব মেয়ে
একজন মুখ টিপে হেসে বললে,”নতুন চিড়িয়া”,
সে আবার কী!
আমি হাঁ হয়ে চেয়ে রইলাম ওদের মুখের দিকে
অন্য একজন বললে,”তোর মরণ হয় না রে”,
সত্যি মরে যেতেই চাইছিলাম তখন
পরের দিন সকাল বেলা এক বয়স্কা মহিলা এলো
সে আমাকে বোঝাতে লাগলো সব
কিভাবে থাকতে হবে
কি করতে হবে আরও অনেক কিছু
সে শুনে বমি এসে গেল আমার
আমি বললাম,হবে না
ওসব আমার দ্বারা হবে না
তারপর আর কী
বোঝানোয় যখন কাজ হলো না
তখন শুরু হয়ে গেল মার
রোজদিন নিয়ম করে এলোপাতাড়ি মার
তখন ঠিকমতন খেতেও দিত না
কারো সঙ্গে কথা বলতেও দিত না
তিন মাস ধরে এরকম করে খালি পিটিয়ে গেছে
একদিন এমন মারলো যে রক্তারক্তি
অজ্ঞান হয়ে গেলাম
আমাকে ভর্তি করতে হল হাসপাতালে
অনেক ওষুধ খেলাম
স্যালাইন টানলাম
তারপর কিছুটা সুস্থ হলে ফের ওই বিল্ডিংয়ে
তারপর আমার সঙ্গে কীজানি কীভেবে
একটু ভালো ব্যবহার করতে শুরু করলে ওরা।

একদিন মন্দির দেখাতে নিয়ে গেল
একদিন বাজার ঘোরাতে নিয়ে গেল
তখন আমার মনে ঘুরতে শুরু করেছে একটা কথা
পালাতে হবে
যেভাবেই হোক পালাতে হবে এখান থেকে
ক’দিন পরে ওরা কী ভাবল জানি না
ওরা আমাকে সরিয়ে দিলে অন্য বিল্ডিংয়ে
সেটা ছিল দোতলা বিল্ডিং
মেয়েদের সংখ্যাটা আগের চেয়ে কম
তবে সেখানেও মেয়েরা সবাই বাঙালি মেয়ে
তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ভাব জমে গেল আমার
আমি ওদের সময় পেলেই বোঝাতাম
“চল পালিয়ে যাই”
ওরা বলত,”পালানো অত সহজ না
ধরা পড়লে জ্যান্ত কেটে ফেলে মালকিনের লোকেরা
সেটাই নিয়মে এখানের
এভাবেই মাসছয়েক আগে একটা মেয়েকে
সবার সমুখে টুকরো টুকরো করে কেটেছে”।
আমি তবু ভয় পেলাম না
আমি তবু পালানোর কথা ছাড়লাম না।

যেসব ছেলেরা আসতো আমাদের কাছে
তাদের মধ্যে সবাই যে খুব খারাপ ছিল তা না
ভালোও ছিল
কেউ কেউ আবার জানতে চাইত
ভালোবাসতে চাইত
ভালোবাসা করে একদিন ভোরবেলায়
খুব ভোরবেলায়
দুজন ছেলে দুজন মেয়েকে নিয়ে গেল পালিয়ে
ওদের পালানো দেখে সাহস পেয়ে গেলাম আমরাও
তার ক’দিন পরে
একদিন সন্ধ্যের পর থেকে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি
মনে হল আজিই পালানোর দিন
সবচেয়ে ভালো দিন
আমি বোঝালাম আমার সঙ্গী মেয়েদের
আমরা বারো জন ছিলাম এক ঘরে
সাত জন সায় দিলে আমার কথায়
বিল্ডিংয়ের গেটে একজনা মাঝবয়সী দারোয়ান
দিনভর বসে থাকত পাহারায়
সেদিন ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় সে মদ খেয়ে বেহুঁশ
ওকে টপকে আমরা পালালাম গেট খুলে
তারপর সবাই মিলে দিলাম দৌড়
গলিটা অনেক লম্বা
গলি পেরিয়ে বড়রাস্তা
রাস্তায় ঝড়-বৃষ্টিতে অটো খুবই কম
যারা যায় তারা হাত দেখালেও থামে না
শেষে আমরা সাতজনা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে পড়লাম- রাস্তায়
তারপর একটা অটো আসতেই হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম সবাই
অটোওয়ালা শুধালো,”কাহা জাওগে?”
কথাটা শুনে কী বলব কিছু খুঁজে পাইনি তখন
হঠাৎ মনে পড়ে গেছিল দেহাতিটোলার সেই ছেলেটার কথা ওখানকার মুখীয়ার ছেলে
সে বলেছিল,”কোনো বিপদে পড়লে
আমাকে একটা খবর দিও
আমি আসবো এগিয়ে”
সেদিন সেই ছেলেটা যা করেছিল
সে একেবারে দেবদূতের মতো ফেরেস্তার মতো
সে আমাদের নিয়ে তুলেছিল তার ফুপুর বাড়িতে
মালকিন কোত্থেকে খবর পেয়েছিলো কে জানে
পুলিশ পাঠিয়ে সার্চ করিয়েছিল ছেলেটার বাড়ি
ওঃ সেই দিনগুলো কী টেনশনে না কেটেছে
ট্রেন ধরতে ইস্টিশানে যাবো
সেখানেও জাল বিছিয়ে রেখেছিল মালকিনের পুলিশ
ছেলেটা কি না করেছে তখন
শেষে আমাদের সাতজনাকে সাতটা বাড়িতে রেখেছে জামাকাপড় কিনে দিয়েছে
বাড়ি ফেরার টাকা দিয়েছে
তারপর একদিন ভোররাতে অন্য একটা ইস্টিশানে
হাওড়ার ট্রেনে তুলে দিয়েছে।

তারপর বাড়ি ফেরা
বাড়ি ফিরে কদিন যেতে না যেতেই
আবার-আরেক লড়াই
কী অদ্ভুত জীবন আমাদের
কী অদ্ভুত দেশ আমাদের
পাড়ায় আমার পরে মিসিং হয়েছিল আর একটা মেয়ে
আমি ফিরে আসার পরে সেই মেয়েটার বাপ
কেস ঠুকে দিলে আমার নামে
কারণটা কী
আমি নাকি পাচার করে দিয়েছি ওর মেয়েকে
ভাবুন একবার
কোন দেশে বাস করছি আমরা ভাবুন
ক্ষমতাবান পাচারকারীরা
ক্ষমতার সঙ্গে ওঠাবসা করে
কেমন অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র গড়েছে ভাবুন
আসলে আমি গ্রামে ফিরতেই ভয় পেয়ে গেছিল ওরা
ওদের ভালোমানুষের মুখোশ খসে পড়ার ভয়
তাই গরিব ঘরের অসহায় মেয়ের বাপকে টোপ দিয়েছিল ওরা “তোমাকে কিছু করতে হবে না
যা করার সব আমরাই করব
তুমি শুধু কোর্টে দাঁড়িয়ে একবার বলে দেবে কথাটা
তারপর দেখবে তোমার পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে
আমরাই ফিরিয়ে এনে দেবো ঘরে।”

এত কাণ্ড করেও ওরা দমাতে পারেনি আমাকে
আমি আমার কাকার মেয়েকে ছেড়ে দিইনি
মামলা করেছি ওর নামে
তার সঙ্গে আড়কাঠি আর এজেন্ট দেরও বাদ দিইনি
আরও শুনবেন
আমাদের গরিব ঘরের গরিবী ঘুচাতে
চালাঘরের গায়ে মাটির দেওয়াল তুলে
ছোটখাটো একটা পোলট্রি করেছিলাম আমি
খারাপ না চলছিল ভালোই
ওরা সেসব সইতে না পেরে
একদিন এক রাতের অন্ধকারে
মুরগির খাবারে বিষ মিশিয়ে
মেরে ফেলে দিলে সব
শুধু তাই না
পোলট্রি ঘরের পাশে খড়ের ছাউনি দেওয়া
আমাদের যে মাটির ঘরটা ছিল
সেটা পুড়িয়ে দিলে আগুন দিয়ে
এখন মা’কে নিয়ে পোলট্রি ঘরেই থাকি আমি,
ক্ষমতাবানদের হাত অনেক লম্বা হয়
কথাটা শুনেছেন আপনারাও
এখন শুনে রাখুন
তার চেয়েও বেশি লম্বা পাচারকর্তাদের হাত
আমি সেই পাচারকর্তাদের বলছি
মুরগির ঘরে থাকছি বলে আমি কিন্তু মুরগি না
আমি রুবিনা বেওয়ার মেয়ে রিজিয়া
আমি লড়াইটা এত সহজে ছাড়বো না
আমরা পাচার ফেরত মেয়েরা ভয় পাই না মরতে
মরতে তো একদিন হবেই
তার আগে লড়াই করে দেখতে চাই
সবেরই একটা শেষ বলে জিনিস আছে
আমরা এর শেষ দেখতে চাই
পাচারের শেষ দেখতে চাই।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন