আবুল হাসান এর কবিতা সংগ্রহ

 


যে তুমি হরণ করো কাব্যগ্রন্থ থেকে

কালো কৃষকের গান

দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর!

সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ্র হাসি, ধৃতিপঞ্চইন্দ্রিয়ের
 সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের একপলক
তাকাবে এবং বোলবে, তুমি না হোমার? অন্ধ কবি ছিলে? তবে কেন হলে
চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা?

রূপশালী ধানের ধারণা আছে। এখানে কি মানুষেরা সমিতিতে মালা
পেয়ে খুশী?

গ্রীসের নারীরা খুব সুন্দরের সর্বনাশ ছিল। তারা কত যে উল্লুক!
উরুভুরুশরীর দেখিয়ে এক অস্থির কুমারী কত সুপুরুষ যোদ্ধাকে
তো খেলো!

আমার বুকের কাছে তাদেরও দুঃখ আছে, পূর্বজন্ম পরাজয় আছে
কিন্তু কবি তোমার কিসের দুঃখ? কিসের এ হিরন্ময় কৃষকতা আছে?
 মাটির ভিতরে তুমি সুগোপন একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো
 বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো?
নাকি এক অদেখা শিকড় যার শিকড়ত্ব নেই তাকে দেখে তুমি ভীত আজ?
ভীত আজ তোমার মানুষ বৃক্ষশিশু প্রেম নারী আর নগরের নাগরিক ভূমা?

বুঝি তাই দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও তুমি অনাবাদী রাখবে না আর
 এসিইথয়েটার থেকে ফিরে এসে উষ্ণ চাষে হারাবে নিজেকে, বলবে
ও জল, ও বৃক্ষ, ও রক্তপাত, রাজনীতি ও নিভৃতি, হরিৎ নিভৃতি
পুনর্বার আমাকে হোমার করো, সুনীতিমূলক এক থরোথরো দুঃখের
জমিন আমি চাষ করি এ দেশের অকর্ষিত অমা!

*

উদিত দুঃখের দেশ

উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!
মানুষের লোকালয়ে ললিতলোভনকান্তি কবিদের মতো।
তুমি বেঁচে থাকো
 তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!
 রমণীর বুকের স্তনে আজ শিশুদের দুধ নেই প্রেমিক পুরুষ তাই
দুধ আনতে গেছে দূর বনে!
 শিমুল ফুলের কাছে শিশির আনতে গেছে সমস্ত সকাল!
সূর্যের ভিতরে আজ সকালের আলো নেই সব্যসাচীর তাই
চলে গেছে, এখন আকাল
কাঠুরের মতো শুধু কাঠ কাটে ফল পাড়ে আর শুধু খায়!

উদিত দুঃখের দেশ তাই বলে হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,
সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন হোক লির শহর!

পিতৃপুরুষের কাছে আমাদের ঋণ আমরা শোধ করে যেতে চাই!
এইভাবে নতজানু হতে চাই ফলভারানত বৃক্ষে শস্যের শোভার দিনভর
তোমার ভিতর ফের বালকের মতো ঢের অতীতের হাওয়া
খেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাই!

হে কবিতা তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের ঘরে ঘরে তাঁতকল?
সাইকেলে পথিক?

সবুজ দীঘির ঘন শিহরণ? হলুদ শটির বন? রমণীর রোদে
দেয়া শাড়ি? তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের
আত্মহুতি দানের যোগ্য কাল! তুমি কি পাওনি টের
আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া চোখের কোণায় তুমি কি বোঝে নি আমাদের
 হারানোর, সব হারানোর দুঃখ- শোক? তুমি কি শোনোনি ভালোবাসা
আজও দুঃখ পেয়ে বলে, ভালো আছো হে দূরাশা, হে নীল আশা?

*

ক্ষমাপ্রদর্শন

তুমি কি সত্যি ক্ষমার মানুষ? করছি ক্ষমা পরিত্রাণের
গন্ধ ভরা জল ছিটিয়ে তুলছি ঘরে, কৃতজ্ঞতা
তোমায় আমি বদলে দিয়ে কৃতজ্ঞতা তুলছি ঘরে
আকাল পোশাক বদলে দিয়ে রাখালে পোশাক তুলছি ঘরে!

তুমি কি সত্যি ক্ষমার মানুষ? করছি ক্ষমা পরিত্রাণের
একজনমে এত ক্ষমা তুমি কি তাই পাওয়ার যোগ্য হে মন আমার
করছি ক্ষমা করছি ক্ষমা;

এখন তুমি সংসারে যাও, তোমার শিশু সমস্যাদি
সংগঠন আর ন্দ্রিা এবং লবণ মাংস মহোৎসবের
রৌদ্রমেঘের পাশে দাঁড়াও, কৃতজ্ঞতা এখন তুমি
কৃতজ্ঞ হও কৃতজ্ঞ হও!

একজনমে পাপ করেছে, পাপের ছায়া পরিত্রাণের গন্ধ হলো একজনমে
 খিড়কী দুয়ার এখন তোমার খিড়কী দুয়ার, ঝাপসা স্মৃতি রহস্য তার
জালা থেকে জানলা দেখায় অতীত থেকে অতীত দেখা।

একটু একটু তাঁদের ছায়ায় বেড়ে ওঠো এখন তুমি একটু একটু
তাদের বুকে তাদের চোখে তাদের ছায়ায় বেড়ে ওঠো,

হে মন তুমি অধঃপতন
 থেকে এবার বেড়ে ওঠো!

*

অপেক্ষায় থেকো

আমরা আসবো ঠিকই আসবো, অপেক্ষায় থেকো!
 নপুংশক ঘাতক বাউল সন্তু যাইই হই, বিবর্ণ বুলবুল
আমরা যাইই হই
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো!

শিকড়ে শুকনো ঘাস, যুথীফুল একটি কি দুটি
ঘূর্ণিত পাখির চিহ্ন, কুমারীর কেঁপে ওঠা করাঙ্গুল একটি কি দুটি
আমরা যাইই হই
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো!

উৎসবের মধ্যে আমরা যাইই হই পিষ্ট মোমবাতি!
 শাদা জ্বলন্ত লোবাণ আমরা যাইই হই
আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো।

নৃত্য শেষে নর্তকীর নিহত মুদ্রায় শান্ত স্তব্ধ আঙ্গুল
যেই ভাবে ফিরে আসে,
অন্দ্রিায় চোখের পাতার শান্ত সমুদ্র বাতাস যেই ভাবে ফিরে আসে
সমুদ্রচারীর নিশ্বাসে!

আমরা আসবো ঠিকই ফিরে আসবো, অপেক্ষায় থেকো!

*

ভ্রমণ যাত্রা

এইভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয়নি, আমি ভুল করেছিলাম!
করাতকলের কাছে কাঠচেরাইয়ের শব্দে জেগেছিল সম্ভোগের পিপাসা!
ইস্টিশানে গাড়ীর বদলে ফরেস্ট সাহেবের বনবালাকে দেখে
বাড়িয়েছিলাম বুকের বনভূমি!

আমি কাঠ কাটতে গিয়ে কেটে ফেলেছিলাম আমার জন্মের আঙ্গুল!
ঝর্ণার জলের কাছে গিয়ে মনে পড়েছিল শহরে পানির কষ্ট!
স্রোতস্বিনী শব্দটি এত চঞ্চল কেন গবেষণায় মেতেছিলাম সারাদিন
ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে!
আমি উপজাতি কুমারীর করুণ নশ্বর নম্র স্তনের অপার আঘ্রাণে
প্রাচীন অনাধুনিক হয়ে গিয়েছিলাম শিশুর মতো!
 আমি ভুলে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে তিন চতুর্থাংশ লোক এখনো
ক্ষুধার্ত!

আমি ভুলে গিয়েছিলাম রাজনীতি একটি কালো হরিণের নাম!
 আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব কুমারীর কৌমার্য্য থাকে না, যেমন
সব করাতকলের কাছে কাঠমিস্ত্রির বাড়ি, সব বনভূমিতে
বিদ্যুৎবেগবতী বাঘিণী!
যেমন সব মানুষের ভিতরে এক টুকরো নীল রঙ্গা অসীম মানুষ!

আমি ভুলে গিয়েছিলাম বজ্রপাতের দিনে বৃক্ষদের আরো বেশী
বৃক্ষ স্বভাব!

যেমন আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব যুদ্ধই আসলে অন্তহীন
জীবনের বীজকম্প্র, যৌবনের প্রতীক।

এইভাবে ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হয়নি আমার হৃদয়ে হয়তো কিছু
ভুলভ্রান্তি ছিল,
আমি পুষ্পের বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলাম পাথর!
আমি ঢুকে পড়েছিলাম একটি আলোর ভিতরে, সারাদিন আর
ফিরিনি!

অন্ধকারে আমি আলোর বদলে খুঁজেছিলাম আকাশের উদাসীনতা!
 মধু-র বদলে আমি মানুষের জন্য কিনতে চেয়েছিলাম মৌমাছির
সংগঠনক্ষমতা!
পথের কাছে পাখিকে দেখে মনে পড়েছিল আমার হারানো কৈশোর!
পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল আমি আসলেই পথ হাঁটছি,
পথিক!

তবু ভ্রমণে আবার আমি ফিরে যাবো, আমি ঠিকই পথ চিনে নেবো!
 অনন্তের পথিকের মতো ফের টের পাবো
কে আসলে সত্যিই কুমারী, কে হরিণ কে রমণী কেবা স্ত্রীলোক!
আর ঐ যে করাতকল, ওরা কেন সারারাত কাঠচেরাই করে!

আর ঐ যে অমৃত ঝর্ণা, ওকে কারা বুকে এনে অতটা স্বর্গীয় শব্দে
স্রোতস্বিনী ডাকে!

*

অসহ্য সুন্দর

যখোন একটি মৃত সুন্দরীকে গোর দেওয়া হলো
হায় ভগবান, যখন সুন্দরী মৃত!
একটি একাকী চুল দেখলাম মুখে এসে নিয়েছে আশ্রয়
ক্লান্ত ভুরু, কাঁধের দুদিকে হাত যেনো দুটি দুঃখের প্রতীক!
কপালের সমস্তটা যেনো দুঃখ, চিবুকের সমস্তটা যেনো দুঃখ!
 যখোন একটি মৃত সুন্দরীকে গোর দেওয়া হলো
হায় ভগবান, যখোন সুন্দরী মৃত!

তখোন মৃত্যুকে কী যে কোমল সুন্দর লাগছিলো!

মুখের সমস্তটা মুখ জুড়ে তার তখন করুণ এক মায়ার রহস্য আর
 শরীরের সবদিকে শেষ সুন্দরের অকস্মাৎ থমকে যাওয়া আভা!
আর ঠোঁটের ও বিষণ্ণ তিলটি কী বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল, কী বিষণ্ণ
দেখাচ্ছিল আহা
যখোন সুন্দরী মৃত যখোন সুন্দরী!

কিন্তু হায় একটি অসহ্য দৃশ্য ঘটে গেল হঠাৎ তখোনই
 যখন জানলাম আমি গর্ভে তার অসমাপ্ত একটি ভ্রূণ শিশু হতে পারল না।
একটি সুন্দর ভ্রূণ!

*

একটি মহিলা আর একটি যুবতী

জানেনা কখন ওরা পাশাপাশি এসে শুয়ে থাকে!
একটি মহিলা আর একটি যুবতী বহুব্রাত এইভাবে
 শুয়ে শুয়ে দেখেছে আলোর পাশে নির্জনতা কত বেমানান!

ফলে এক দিন-ভাঙ্গা-দিনান্তের আলো দুই দেহের ভিতরে নিয়ে
 দেখেছে আঁধার আজো কেন উষ্ণ, কেন এত তীব্র গন্ধময়!

দেখেছে খোঁপায় কালো ভাঙ্গনের বিলাসিতা কেমন মানায় সেই তমসায়
কেমন কালোর বর্ণ ধরে রাখে দুজনের দুটি কালো চোখ।

একটি মহিলা আর একটি যুবতী এইভাবে বহুরাত
আধখানি চোখে চায়- আধখানি ইশারায় কী যে কী সব বলে!
তারপর মহিলা যুবতী মিলে, যুবতী ও মহিলায় একটি উত্তপ্ত কণ্ঠ
কামুক রমণী হয়ে যায়!
আর সেই রমণীকে দেখে ফেলে একটি আদিম কালো রাত!

আর সেই রমণীকে দেখে ফেলে নগ্ন মহিলা আর নগ্ন যুবতী!
আর সেই রমণীকে দাঁতে দাঁতে দীর্ঘতর করে তোলে তীব্র দংশন!
আর সেই রমণীকে ঘৃণা করে মহিলা ও যুবতী আবার!

আর সেই রমণীটি মহিলা ও যুবতীতে পুনরায় পর্যবসিত হতে হতে
পুনরায় তারা ফের ঘৃণা ও ঘুমের মধ্যে হয় অন্তর্হিত!

*

অনুতাপ

আমাকে যে অনুতপ্ত হতে বলল, কার জন্যে অনুতপ্ত হবো আমি?
কার জন্য অনুশোচনার জ্বলন্ত অঙ্গারে আমি ছোঁয়াবো আমার ঠোঁট?
 দিন দিন আমার অধঃপতন পাহাড় কেবলি উঁচু হচ্ছে,
এত দাহ এত পাপ!
আমার পায়ের নখ থেকে মাথার প্রতিটি চুলে এত অপরাধ!
হাঁটু ভেঙ্গে একদিন আমার বুকের মধ্যে এসে পড়বে
কুয়াশা অস্থির শিলা রক্তের আগুন।
 হাত তুলে আর আমি কাউকে ডাকবো না কোনোদিন!
 সেই দুঃসহ দিনের কথা ভেবে অনুতপ্ত হবো আমি?
কিন্তু কেন, কার জন্যে অনুশোচনার জ্বলন্ত অঙ্গারে আমি
ছোঁয়াবো আমার ঠোঁট?
 অনুতপ্ত হবো আমি বিশেষ নারীর জন্যে?
সেই আমার প্রত্যাখাত প্রথম পুষ্পের জন্যে ফের অনুতাপ?

কিশোর বয়সে একদিন আমার শরীর জুড়ে
 গোলমরিচের ঝা ঝা গুড়োর মতোন তীক্ষ্ণ জ্বর নেমেছিল,
মনে আছে সেই জ্বরের রাত্রিতে জেগে জেগে জানিনা কখন
আমি মায়ের পাশেই…?

হঠাৎ নিদ্রা ভেঙ্গে যেতে দেখি মধুর চাকের মতো অন্ধকার!
 মনে আছে ভল্লুকের মতো বাবা নুয়ে এসে সে আঁধারে কার
টেনে টেনে ছিঁড়েছিল জটিল যৌবন?
সে রাতে আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছিল,
মনে আছে অন্তলীন আমার চীৎকার?

শুকনো পাতার মতো আমার চীৎকার থেকে ঝরে পড়া মা’র সেই হাত,
 সেই রুগ্ন বিষণ্ণ আঙ্গুল-মার মানসিক অনিন্দ্র দহন!
তারও শেষ বিষণ প্লাবন যদি সময়ের তোড়ে গেল
তবে আর কার জন্যে অনুতপ্ত হবো আমি?

কার কাছে বয়ে নিয়ে যাবো এই কুয়াশা অস্তির শিলা রক্তের আগুন?

*

আড়ালে ও অন্তরালে

কয়েকটি দালান কোঠা, বৃক্ষরাজি কয়েকটি সবুজ মাঠ
থাকলেই যে ছোটখাটো বিশিষ্ট শহর হবে এলাকাটা
এ রকম কোনো কথা নেই!
ছুটির দিনের পিকনিকে গেলেই কি সেই সব লোক
ভালোবাসে বনভূমির গভীর মৌনতা? তার মর্মর সঙ্গীত

অথবা যে পাখির বিষয় নিয়ে পত্রিকায় ছড়া লেখে
 শিশুদের সচিত্র মাসিক যার লেখা ছাপা হয়
সেই-ই শুধু পাখি আর শিশুর প্রেমিক?

পূজোর দিনে তো আমি অনেককেই দেখেছি
 কেমন প্রতিমা দেখার নামে চুপে চুপে দেখে নিচ্ছে
 লাবণ্য লোভন লোনা মাংসের প্রতিমা।

এইসব দেখে শুনে মনে মনে ভাবি,
আড়ালে ও অন্তরালে তবে কি রহস্য আছে,
যারা আজো চুপে চুপে কাজ করে যায়?

না হলে দ্যাখো না এই আমার বুকের নীচে ফুরফুরে গেঞ্জি নেই
শাসিত লোকের মতো আমার চোখের নীচে কালো দাগ কালো চতুরতা!
মুখে ম্লান মৃত্যুকে সরিয়ে বহুদিন
 বুকের ভিতরে কোনো কান্তির কোমল শব্দ শুনিনা এবং
বাসমতি চালের সুঘ্রাণও আমি পাইনা অনেকদিন!

তবু আমি শাসিত লোকের চেয়ে কেন আজো
তোমার মতোন নীল শোষকের সান্নিধ্যই বেশী ভালোবাসি!
কেন ভালোবাসি?

*

এখন পারি না

এখন পারি না, কিন্তু এক সময় পারতাম!
আমারও এক সময় খুব প্রিয় ছিল
নারী, মদ, জুয়া ও রেসের ঘোড়া!

আমিও গ্রহণ করে দেখেছি দুঃখকে
দেখেছি দুঃখের জ্বালা যতদূর না যেতে পারে
তারও চেয়ে বহুদূরে যায় যারা সুখী!

দেখেছি দুঃখের চেয়ে সুখ আরো বেশী দুঃখময়!

এখন পারি না, কিন্তু এক সময় পারতাম
 আমারও এক সময় খুব প্রিয় ছিল
 নারী, মদ, জুয়া ও রেসেও ঘোড়া প্রিয় ছিল, খুব প্রিয় ছিল।

*

স্তন
(জিনাত ও তারেককে)

কুমারী, তোমার অই অনুভূতিময় উষ্ণ অন্ধকার ঝুলবারান্দায়
আজ বড় মেঘলা দিন,
আজ বড় সুসময়,
এসো হোক তোমাতে আমাতে
এখন তমসা, কোনো চাঁদ নেই,
তোমার বুকের পাত্র আলো দেবে
স্পর্শ করলেই চোখে জেগে উঠবে যুগল পূর্ণিমা।

সমস্ত সতীর গাত্রে লাথি মেরে
 সমস্ত সৃষ্টির পাত্র ভেঙে-চুরে।

এসো হোক তোমাকে আমাতে
এসো ভয় নেই!

এসো অইতে উদ্ধারমূর্তি, অইতো বুদ্ধের বোকা ধ্যান!
কামুককে ভঙ্গি দিয়ে নৃত্য করে অইতো আদিম!
বুকে অইতো জলপাই ঘ্রাণ!
অই আনে মধ্যপ্রাচ্য, তেলের সংকট
দূতাবাসে খুনোখুনি,
অই আনে তুর্কী নারীর নাচ, তা তা থৈ অন্ধকার
 দুটি তলোয়ার হাতের তালুতে
অই আনে রোমান সভ্যতা!
 কুমারী, দহন ওকে কেন বলো?
ওতো লোকগাথা, ওতো প্রবচন,
 ওতো পৃথিবীর প্রথম হ্রদের তলদেশ-উথথিত
ক্রন্দন ভরা মাটি!
ওতো সমুদ্রের অপার মহিমা!
এসো হোক তোমাতে আমাতে
এসো নৃত্য করি, জল খাই,
 হাতে খুঁড়তে খুঁড়তে যাই তোমার তুমুল শাড়ি
 তোমার কুমারী জন্ম
তোমার সুষমা!

*

সেই মানবীর কণ্ঠ

প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম- কেন আমি
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরণ দাহ, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন!

আমি এ আঁধার স্পর্শ করে কেন তাকে বলেছি হৃদয়,
 তৃষ্ণায় তাড়িতে তবু কেন তাকে বলেছি ভিক্ষুক
আমি এ জলের পাত্রে জল চাই না, বিষ চাই বিষও তো পানীয়।

প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম, কেন আমি
 এ বুক স্পর্শ করে বলেছি একদিন গ্রীস, কলহাস্য, অদিতি উৎসব!
আমি তাম্রলিপি আমি হরপ্পার যুগল মূর্তির কার কে?
কী আমার অনুভূতির কোনোদিন কোনোই নারীকে

কেন আমি বলিনি মাতৃত্ব? কেন বলেছি নির্জন
 প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম, সঙ্ঘমিত্রা নাকি সে সুদূর
সভ্যতাসন্ধির রাণী, অন্য কোনো আশোকের বোন,

হয়েছি এখন আমি কেন বা এমন প্রবাহিত।

*

পরাজিত পদাবলী

আমার বাহু বকুল ভেবে গ্রীবায় পরেছিলে
মনে কি পড়ে প্রশ্নহীন রাতের অভিসার?
অন্ধকারে আড়াল পেয়ে ওষ্ঠে তুলে নিলে
হঠাৎ গাঢ় চুম্বনের তীব্র দহনগুলি?

মনে কি পড়ে বলেছিলে এ পোড়া দেশে যদি
বিরহ ছাড়া কিচ্ছুতে নেই ভালোবাসা বোধি-
রাজ্য জুড়ে রাজার মতো কে আর থাকে কার
 রাতের পথে সহজ হবে দিনের অভিসার

হৃদয় আজ কুপিয়ে দেই বিচ্ছেদের চারায়
দোলাই তাতে মন চেতনা মনস্তাপের ফুল!
 তোমার ইন্দ্রিয়ে তার সৌরভেরা হারায়
 যখোন তুমি বাধতে বসো তোমার এলোচুল?

তোমার কাছে গিয়েছিলাম রাতে নদীর ঢেউ
তোমায় আমি পরিয়েছিলাম অঙ্গুরীয় মেয়ে

ভুল বুঝা সে মানুষ তাকে বোঝেনি আর কেউ
তুমি যেমন তোমার মতো বুঝতে চেয়েছিলে।

*

পাতকী সংলাপ

এইসব থেকে আমি ছুটি চাই, ছুটি চাই
এই শিল্প, এই সামাজিক ফুল, হুলস্থুল সমিতি প্রধান যুগ
রৌদ্র আর রাত্রিভুক এই অবসাদ থেকে ছুটি চাই ছুটি চাই প্রভু!
 সিংহযূথ, অশ্ববাহন থেকে ফিরে আসি আজকাল এতেও অনেক ক্লান্তি
বিমবিষা লাগে খুব ঘৃণা হয়, ঘৃণা হয় প্রভু আমি কি পাতক?

এক বেদুইন শুধু আজকাল আমাকে জ্যোৎস্নারাতে কেবলি জ্বালায়-
 আমি আর ঘুমোতে পারি না, আমি ঘুমোতে পারি না প্রভু আমি কি পাতক

কসাইখানার কাছে রেখে আসি অবজ্ঞায় রাজার মুকুট আমি
ঘৃণা করি সিংহাসন, খুব ঘৃণা করি এই রাজাসন প্রভু আমি কি পাতক?

এক পাল সে গোলাপ্রভু সিংহ শুধু আজকাল আমাকে ইশারায় ইশারায়
কবি হতে বলে প্রভৃ ঘৃণা হয় প্রতিবাদে আমি সেই সুন্দর
গোলাপব্যাপী
 থুথু ফেলে দেই, আমি থুথু ফেলে দেই প্রভু, আমি কি পাতক

এক সে আলুলায়িত শিল্প শুধু আজকাল আমাকে তার স্তন
দেখিয়ে বলে,
 স্তন দেখিয়ে বলে দ্যাখো এই, দ্যাখো ঐইই আমার নারীত্ব এইই আমার
নির্মাণ প্রভু

আমি কি বলবো, আমি কি বলবো, আমি অভিমানে অভিমানে
তখন আমার সব মরপুটে শিশ্ন দেখিয়ে বলি এ দিয়ে হবে না
 এ দিয়ে হবে না কিছু এ দিয়ে হবে না আমি নপুংশক আমি তো
নপুংশক!

আমি দেখেছি তো মানুষ কেবলি তারা ভুল মানুষ ভুল মানুষ,
ভুল মানুষ!
 আমি দেখেছি তো শিল্প কেবলি তারা ভুল শিল্প, ভুল শিল্প!
আমি দেখেছি নির্মাণ কেবলি তো অবৈধ নির্মাণ শুধু অবৈধ নির্মাণ!
 হয়েছে আমার দেখা হয়ে গেছে সব, জানা হয়ে গেছে সব, চেনা হয়ে
গেছে সব!

হয়েছে আমার ভালোবাসা হয়েছে অনেক আর ঘৃণা করা হয়েছে অনেক!
আমি জেনেছি জলের ধারা, বৃঝেছি হত্যার শিল্প, চিনেছি সমিতি!
আমি দেখেছি গোলাপভুক সিংহেরও কারসাজি।
কসাইখানায় কারা সুন্দর নিষ্পাপ গাভী করে বিক্রি এও তো দেখেছি!
 সিংহয়ূথ, অশ্বাহন, মুক্তা, নারীর নিভৃত নাভি যাতনা সঙ্গম আমি
এওতো দেখেছি!
 আজ আমি খুব ক্লান্ত আমি ছুটি চাই প্রভু আমি কি পাতক?

*

ধুলো

ধুলো কি দগ্ধ কয়লা? ধুলো কি বারুদ?
রাস্তায় বেরুলে শুধু ধুলোর কাহিনী ওড়ে
ধুলোর কাহিনী ওড়ে!
 ধুলো যেনে দগ্ধ কয়লা যতদূর যায় কেবলি পোড়ায়
ধুলো যেনো একটি সুড়ঙ্গ পথ
ধুলো যেনো হৃদয়ের গোপন সম্পদ
 যতদূর যাই ঠিক ততদূর সেও যায়
মানুষের সকল শাখায়
 সাথী হয়ে জ্বালায় পোড়ায়- ধুলো কি বারুদ?

*

দৈতদ্বন্দ্ব

যেমন হাতিকে খুব গভীর গহন বনে মনে হয় একমাত্র স্বাভাবিক
 যেমন বনেই তার একমাত্র ‘বৃংহতি’ শব্দটি মানায়
 যেমন প্রার্থিত ওষ্ঠের উষ্ণ অধীর কিনারে অধর ভিড়ানো হলো
প্রকৃত চুম্বন!

আমি হরিণকে লোকালয়ে হরিণ বলি না,
বলি অসহায় কোমল করুণ জন্তু।

যেমন পথ ভুললে পথিক আর পথিক থাকে না, হয় ক্লান্ত মানুষ!
 যেমন ভিক্ষুকের পয়সা আমার পয়সার সাথে কখনো মেলে না।
 যেমন মেঘের দিনে ‘বিষণ্ণতা’ শব্দটিকে মনে হয় একা।
ভালোবাসতে পারে যেমন কেবল ভালোবাসা,

আমি বকুল বৃক্ষকে বোকা খুনীর ঘরের পাশে
কখনো যেমন আর বকুল বলি না, বলি তার আচ্ছাদন
 তার হতার হরিৎ পটভূমি।
যেমন যৌবন আজ যন্ত্রণায় আমার মনন বোধে, আমাকে খরচ করে
শেষকালে তৃপ্ত হয় আমারই মজ্জায়!
আজ আমিও কি তাই? তুমিও কি তাদের মতোন? নাকি
 পাকেচক্রে অন্য কিছু অন্য কোনো কিছু

*

অন্যরকম সাবধানতা

রৌদ্রে উঠলে পৌঁছে যাবো আপাততঃ এই মেঘের প্লাবনে দাঁড়াও।
কেউ সামনে যেওনা সাবধান!
 সাইকেল ঘণ্টি বাজিওনা, সাবধান!
তোমাদের যাবতীয় সহায় সদ্ভাব ঠিক করো
রৌদ্র উঠতে দাও।

আর তোমাদের চৌধুরীর মেয়েরা যেনো
একটুতেই খিল খিল না হাসে
 উষ্ণ চোখে না কাঁদে সাবধান!
মেয়েদের চোখে চোখে রাখো!

রৌদ্র উঠলে পৌঁছে যেতে হবে। আপাততঃ এখানে দাঁড়াও!
 তোমাদের ঠাণ্ডা পানির কুঁজো যেনো আজ না ফাটে সাবধান!
পথে পানি খুব মূল্যবান শোনো হে,
সোনার জিনিশগুলো টাকা পয়সাগুলো
 বাসে লুকিয়ে রাখো, চোর গুণ্ডা বদমাশ রয়েছে।

রুটি খেতে খেতে আর ভাতের ব্যাপার নিয়ে
কুটকচাল পোড়া না সাবধান!
গাছতলায় এসে দাঁড়াবে এমন
যেনো তুমি পথিক, উপরে ফলের প্রতি লোভ নেই
 যেনো তুমি আসলেই পথ হাঁটছো, পথিক, সাবধান!

গৃহপালিত পশুকে আর আঘাত দিওনা
 পাশুটে জিভের দিকে তাকিয়ে আর ক্ষুধাকে দেখোনা।
হা করে থেকো না, একটু পা চালাও,
চলো খুব দ্রুত চলো!

বলা যায় না কোথায় ফুটুস করে কে কাকে ঝপাৎ করে মেরে বসে।
মমতা তো নেই!

*

অস্থিরতা

একটু খানিক তন্দ্রাতে সে
একটু খানিক জেগে,
বুকের কাছে হাতটি ছিলো

হঠাৎ সে উদ্বেগে
বোললো তোকে বোললো যে নেই
নেই!

একটু খানিক ক্রন্দনে আর
একটি খানিক মনে
তন্দ্রাতে সে বিভোর ছিলো।

হঠাৎ সে উদ্বেগে
বোললো তোকে বোললো যে নেই,
নেই!

*

এই ভাবে বেঁচে থাকোএই ভাবে চতুর্দিক

বেঁচে থাকতে হলে আজ কিছু চাই। কিছুই কি চাই?
 গেরস্থালী নয়তো শূন্যতা? নয়তো সন্ন্যাসী নয় নীলাঞ্জনশ্যাম নারী
নয়তো কিছুই নয়? বসে থেকে বেয়াকুল দিন দেখে
দিন কাটানো অলস ভঙ্গি-সেও বেঁচে থাকা নাকি?

বেঁচে থাকতে হলে এই বেঁচে থাকা? চূর্ণ গেরস্থালী তাতে
 বসে থেকে উরুতে থাপ্পড় দিয়ে বলে ওঠা চাই হোক
শূন্য হোক, পুণ্য হোক খাঁ খাঁয় ভরপুর থোক সব কিছু

খঞ্জ ও খোঁড়ায় যেমন দেখতে পায় আমি ভালো আছি?
আমি অভাবের সমস্ত অক্ষর, নারীর উরুর জোড় জীবনের অসীম ভিতর
 জটিল শলায় গেঁথে আজো বলে উঠি হোক
শূন্য হোক, পূণ্য হোক খাঁ খাঁয় ভরপুর থোক সব কিছু
দুঃখ যেনো দেখতে পায় আমি সুখে আছি!

আমি চালের ভিতর ভুল সেঁকো বিষ, কৃত্রিমতা করুণ কাঁকর
তবু উরুতে থাপ্পড় দিয়ে তাই খাই, স্নান করি নয়তো ঘুমাই
 নয় নারীকে বুঝাই এসো এইভাবে এরকম ভাবে!

*

কচ্ছপ শিকারীরা

ওদের চোখে জলের কুহক আমরা বলি নদী
পা ডুবিয়ে দাহ ভেজাই জিহ্বা ভেজে তৃষ্ণা হরণ জলে।
ঐ জলেই বর্শা হাতে দাঁড়ায় ওরা দলেঃ

ওদের তখনো বাঁচার চিহ্ন কচ্ছপের পিঠে
সাঁতরে আসে সাঁতরে আসে জলেরই কংক্রিটে
কোমল কালো রহস্যের মৌন অলংকার
নদীর গ্রীবা শোভায় ঝরে কচ্ছপের হার!

আমরা ভাবি আদিজগৎ ফিরলো বুঝি প্রাণী
ওদের হাতে জীবনতৃষ্ণা ঝককে ওঠে বাণী,
বিদ্ধ করো! বিদ্ধ করে বিদ্ধ করে ওকে।
তিনদিকে তিন মূলশিকারী বর্শা তুলে তাঁকে
 বরণ করে কচ্ছপের ধাবিত যাত্রাকে।

কালো কঠিন পেশীর কালো রৌদ্র ভরা দেহ
সঞ্চারিত হতো তখোন বর্শা ফলায় আর।
 শিকারীদের শরীর থেকে সে এক চমৎকার
গতির ছায়া চমকাতো সেই কচ্ছপের পিঠে
মৃত্যু যাকে মরণ দিতো জলেরই কংক্রিটে।

ওদের হাতে কচ্ছপের করুতম লাশ
 কোন অতলের উষ্ণতম আহার্যে নিশ্বাস
ফেলতো ওরা তখোন যে ঐ কচ্ছপের ঘ্রাণে
এখনো যারা সুন্দরের স্বচ্ছতম দাস
কেউ কি জানে? কেউ কি তারা জানে?

ওদের চোখে জলের কুহক, আমরা বলি নদী
দু তীর ঘেঁষে কত না দাহ, কত না সম্বোধি
কত না কালো চিহ্ন আর কত না বাঁচা মরা!
 শিকারী ওরা সেই নদীতে এখনো জোড়া জোড়া
 ভাসতে দেখে কচ্ছপ, না শিল্প? না কি সংহতির ভ্রূণ?

ওদের হাতে বর্শা ফলা, মহাকালের তুণ
জলের স্রোতে ভাসছে কত মৃত্যু আর ঘুণ

ওদের ওরা বিদ্ধ করে, বিদ্ধ করে আর
শিকার করে শিকার করে কালো জলের প্রাণী
আমরা যাকে নদীর কালো তিলক বলে জানি!
 ওদের কাছে তারা কেবল চিহ্ন, বেঁচে থাকা।

কচ্ছপের পিঠের পরে দুইটি হাত রাখা
 দেখেছিলাম কোথায় কোন শিকারী ওরা কবে
নৌকা নিয়ে যারা দুপুর জলেরই উৎসবে
উষ্ণ হতো সমুদ্যত হাতের দুটি শিরা
বর্শা নিয়ে দাঁড়াতো-সেই সূক্ষ্ম শিকারীরা।

কচ্ছপের শিকারী ওরা কালো জলের ভীড়ে
নদীর কটিদেশের কালো চিকন দুটি হাড়ে
বাঁধতে সেতু কর্ম আর ধর্ম জোড়া দ্বিধা
এখন সেই জলেই যেনো জলের অসুবিধা

কচ্ছপের হারের মতো সহজতম হার
হারিয়ে গেছে আদিজগৎ প্রাণের অভিধার।

তবুও হাতে বর্শা ফলা, তবুও অন্ধকার
শিকার করে নদীর গ্রীবা কচ্ছপের হার
 ঐতো ওর চলছে, দেখি এখনো টানটান
ওদের হাতে বর্শা ফলা ওদের হাতে প্রাণ।

*

ঘুমোবার আগে

আমার কাছে আগুন ছিল না
আমি চাঁদের আগুনে
 শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়।
–কে ওখানে?
 শীতরাতে পউষ পাখির গলা শোনা গেলো জ্যোত্সায়,
–কে ওখানে?

পাখির কণ্ঠের গানে
কুয়াশায় আমি কালো জ্যোৎস্না ঘুরে হঠাৎ তখোন
 চাঁদের আগুনে পুড়ে
 ছুঁয়ে দিতে উদ্যত হলাম।

অসৃয়মাণ তুমি?

তোমাকে না ছুঁতে পেরে
আমি নিজ নিয়তির অন্তর্গত রোদনকে বোললাম, দ্যাখো
 আমি আর কাঁদতে পারবোনা!

*

আশ্রয়

তুমি শুভ্রা, তুমি শস্যশীলা, তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে কে কণা
অনিদ্র মাধুরী!
হোক উপহাস্য তবু তুমি প্রেম, তুমি প্রচলিত ভণ্ডামী নও!
তুমি প্রেমহীন পুরুষের ক্লান্তিবোধ নও,

তুমি কুমারীর কালো খোঁপা খুললেই কাঁপাও কুসুম!
তুমি ব্যাৎসায়ন পড়োনি তবু
ব্যাৎসায়ন-অধিক সূক্ষ্ম কামকলা অভিজ্ঞা সুন্দরী!

তুমি অনুর্বরা নও, কালো মৃত্তিকার মূলে মিলিত কুমকুম তুমি!
 বেঁচে থাকো অভিলাষ যৌবনের সাতমহল শুদ্ধ হাততালি!
তুমি নর্তকী যখোন নাচে তার তীব্র তমস্য হরণ ছন্দ, তুমি তামসিক!
তুমি জ্যোত্স্নায় সাতশো সুন্দর শাদা দুরস্ত ঘোড়ার খুরে খুরে
উন্মাতাল নাচ!
সমাজের সব ডাইনীদের খলপনা থেকে তুমি বেরিয়ে এসেছে আজ
 তমসার ভ্রূণ ভেঙে বেরিয়ে এসেছো তুমি সদ্যজাত ভোর।
তুমি নব সকালের নব রৌদ্রযুগ!

তোমরা ভিতরে গেলে গর্বিত গহন সারি সারি সুরম্য প্রাসাদ
দেখি আমি মর্মর খিলান ছাঁদ ঢের
 মসলিন তাঁতের খটাখট কানে আসে যেনো তুমি তাঁত
 যেনো তুমি কুয়াশার চেয়ে মিহি মসলিনে ফের
ফিরে আসা নব শিল্পকলা।

আমাদের প্রপিতামহীরা যাকে বাদশাজাদীর মতো শরীরে সাজিয়ে সময়ের
 ঘুমে ঢুলু ঢুলু আহা ডাকতো নোনারু কণ্ঠে আয় চাঁদ আয়!

আমি তোমার গ্রীবার গ্রামে আজ ফিরে পেলাম ব্যথায়
 বিলুপ্ত বৃক্ষের সেই সুরভিত পাতার সুঘ্রাণ!

আমার অরণ্য বিদ্যা তুমি হে বনানী হে আমার আম্রকানন
হাটুরে পায়ের চিহ্ন লেগে থাকা হে আমার ঘরে ফেরা পথ
 তুমি ধান ভানো, গান গাও, আজো কোলে শিশু ডেকে আনো!

আজো শীতরাতে তুমি কুয়াশায় ক্ষুধিত চাঁদের মতো বাঁকা জটিদেশ,
হায় তুমি, হায় অবিরাম রাতে ভেসে আসা উষ্ণ ছিপ নৌকা আমার!

তুমি আমাকে দহন দিয়ে এই যে সহন শান্তি অমরতা দিলে
 এই তো মানুষ চায়, যুগে যুগে এই তার জেগে থেকে ঘুমোবার সাধ!

*

সে আর ফেরে না

বহুদূরে ট্রেনের হুইসেল, যায় দিন যায়!
 বোনের মোন এক লাজুক পাড়া গাঁ তার
ডাক শুনে থাকে অপেক্ষায়।
তবু ভাই ফেরে না, ফেরে না!
 ডাকবাকসে ধু ধু শীত জমে ওঠে বিদায়ী জ্যোৎস্নায়
 বৃক্ষের কোটর থেকে শেষবার পনেরো দিনের মতো
উড়ে যায় বাদামের পাতার আড়ালে গোল চাঁদ
চারিদিকে ভেঙে যাওয়া ভুল অন্ধকারে যেন তারপর
মনে পড়ে যায় তার

সেই যে গিয়েছে ভাই দীর্ঘ দু’বছর
পরিচিত পথের রানার এসে দাঁড়ায়নি পোস্টম্যান
চিঠি নিয়ে ব্যস্ত সাইকেলে!

লাজুক পাড়াগাঁ তার নিসর্গের বারান্দায় তবু বসে থাকে অপেক্ষায়
 ইস্টিশনে বহুদূরে ট্রেনের হুইসেল
 যায় দিন, দিন চলে যায়।

*

তুমি ভালো আছো

হৃৎপিণ্ড থেকে দুটি দুঃখময় জাগরণ চোখের গোলকে এনে
দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?

বুকের বাঁ পাশ থেকে কারুকার্যময় একটি দীর্ঘনিশ্বাস আমি


নিদ্রাহীন আত্মার উপর তুলে চোখ খুলে দেখছি তোমাকে তুমি।
ভালো আছো?
 বন্যা বিতাড়িত ভীত জলের প্লাবন খাওয়া মানুষের মতো আমি
 দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?

বাইরে বিবস্ত্র যুগ, হাহাকার, বাইরে তমসা
বাইরে বাগানে ওরা বসে আছে গোলাপের নামে সব অবগোলাপের দল!
বাইরে কোথাও কোনো মেঘ নেই, নষ্ট নির্মেঘ রাত্রি কাঁদছে।
কুকুএ!
নেবুর পাতার মতো নিদ্রাহীন আমার নির্জন বুকে বইছে
বাতাস!
 মুহূর্তে কোথাও যেনো খুলে গেলো খুনের দরোজা; তুমি
ভালো আছো?
পৃথিবীতে আজ বড় অবিশ্বাস!
কখনো কান্নার কাছে মুখ নিয়ে মানুষ দেখিনি!
সৌর মাইল দূরে কান পেতে কম্পমান আত্মার ভিতরে আজ
অলৌকিক
 দেখছি তোমাকে, তুমি ভালো আছো?

*

করুণাসিঞ্চন
(কবি জসীমউদ্দীন শ্রদ্ধাস্পদেষু
)

অভিশপ্ত ঐ কবিকে এখন তোমরা করুণায় সিক্ত করে অসহায়
একাকী কবিকে!
 ওঁর নতুন চরের মতো মুখখানি জীবনেও কখনো পেলো না!
ওঁর কোরানোর মতো কালো কালো রাখাল ছেলেরা সেই যে গিয়েছে আর
দুধেল গাভীটি নিয়ে লোকালয়ে এখনো ফেরেনি।

ওঁর সুজনেরা ওঁকে ছেড়ে চলে গেছে, ওঁরা আজ আঘাটায়
পেতেছে বহর
ওঁর সব মানুষেরা গ্রামের গোমরা মুখে থুথু দিয়ে এখন অঢেল
 দলে দলে শহরে আসছে, তারা খুবই অসহায়,,
ওঁও-তো এখন খুব অসহায়, ওঁকে করুণায় সিক্ত করো, ওকে!
বহুদিন নকশীকাঁথার দিকে যাত্রা ভুলে গেছে ঐ কবি,
ওঁ এখন আপন ছায়ায় ডানা গুটিয়ে নিজের কাছে নিজেই কেমন
 যেনো বসে থাকে কথা নেই কাজ নেই যেমন মোরগ
দিন শেষে খোপের ভেতরে তার একা একা বসে থাকা, একা
একা শুধু জেগে থাকা!
কবে ডানকানা মাছ মানুষের মতো ওঁকে কাদা ও জলের কাছে নিয়ে..

এখন কোথায় কাদা, কোথায় সে জল? মাটির পুতুল বাঁধা মাছ দেখে
এখন কেবল কবি কামনায় সেই শাদা মাছটিকে ফিরে পেতে চায়!

ঘরে বসে বাঁশির শরীরে হাত জ্যোত্সা রাত যতটা না তার চেয়ে
এখন অধীর কবি শূন্যতায় নারীর নিদ্রায় নিজ আঙ্গুল বুলিয়ে পায়
জীবনের হারানো কবিত্ব কিছু কিছু!

কখনো বা মধ্যরাতে মাঝদরিয়ায় আহা ডুবন্ত নাবিক
 মরণ চিৎকার যেনো আজো তার ফেলে আসা তীর ছুঁতে চায়
সেই শীতল পাটির স্নেহ সরল নদীর গ্রাম, গাছ পালা, মাছ,
বেদে, মাঝির বহর!

*

টানাপোড়েন

প্রতি পদপাতে এক একটি রোমশ ভয় আমুণ্ডু আচ্ছন্ন করে।
যখন আমাকে
 আবিষ্কার করি ও কোটরের সাপগুলো বিষজিহ্বা দিয়ে সব নিচ্ছে টেনে
বাকলের সমস্ত শরীর!
 কোনটা ধরে রাখি আর কোনটা ফেলে দেই!
কোটর বাকল সবই আমার!
 একটায় বিষধর সাপ, অন্যটায় প্রকৃতির পাখির নখের নৃশংসতা!
 প্রতি পদপাতে এক একটি রোমশ ভয় আমুণ্ড আচ্ছন্ন করে
যখন আমাকে
আবিষ্কার করিঃ মৃত্যু তার কালো শুঁড় দিয়ে সব টেনে তুলছে।
জীবনের পাল্টে যাওয়া বয়সে পাথরগুলোকে!
কোনটা ধরে রাখি আর কোনটা ফেলে দেই
একটায় অবলুপ্তি, অন্যটায় অন্ধ জাগরণ!

*

ভুবন ডাঙ্গায় যাবো
(মাহফুজুল হক খান বন্ধুকে)

ভূবন ডাঙ্গায় যাবো তার আগে কী কী নেবো? কী কী আমরা নেবো?
রঙ্গীন রুমালে কিছু ফুলমূল, সবুজ তণ্ডুল নাও, তরতাজা তারুণ্য আর
তিনটি রমণী নাও, ধানশীষ মাটির কোদাল।

পথে যেতে দেখা হবে সময় ঘাঁটির সৈন্য, দেখা হবে ভিক্ষুক শ্রমণ
 বাম দিকে দেখতে পাবে অমর করবী ফুল, জোড়াদিঘি, ঘরের অঙ্গন!
একটি ভিক্ষুক হাসতে থাকবে ভিক্ষুণীর অর্ধকোল জুড়ে!

ভুবন ডাঙ্গায় যাবো, তার আগে কী কী দেখবো? কী কী দেখতে পাবো?

দক্ষিণে দারুণ যুদ্ধ পেরেকে বিদ্ধ হচ্ছে নর-নারী আগুন! আগুন!
সামনে পুড়ছে সব- পদ্মফুল, বেশ্যালয়, ঘোলা মদ্যশালা!

ঐ সব পিছে রেখে ডানে এগুলেই একটি গ্রামের ভিতর
দেখতে পাবে খড় এনে আজো ঘর বাঁধছে ঘরামী!

তিনটি রমণী তার কাঁধে নিয়ে ত্রিকালের জলের কলস
 হেসে হেসে বাড়ী ফিরছে, বাড়ী ফিরছে, বাড়ী…

*

প্রবাহিত বরাভয়

তোমরা ঐ বারোয়ারী মেয়েটিকে নিয়ে নাচো, মত্ত হও!

আপাততঃ আমি যাই
দ্রাবিড়-দেবদূত
আমি যেখানে যা পাই
ঐ মহান মিথুন মূর্তি
 গুনগুন কুমারীর ঘুণ,
রক্তলোহা পেছল আগুন
মৃত্যু
ঠায় অভিমান ঐ
বকুলবাগান
যাই
যেতে যেতে
 সমস্তই শুভ!

যেতে যেতে
যেখানে যা পাই
পথের উপর দল
হালহল।
ঐ যে পাগলগুলি
 খল খল হাততালি দেয়
 চলি,
 যেতে যেতে
 শান্ত হবে চলি!

যেতে যেতে
 এই জনস্থলী
 হবে সবই ধ্রুব
 হবে সবই ফুল,
যেতে যেতে
জেনো সব ঘাটের মাস্তুল
ফিরে পাবে নাও!

মেলা থেকে ফেরোনি কি ব্যাকুল লণ্ঠন?
— যাও
একলা বন্ধন টুটে চলেছেন ওরা
নবকুমারেরা–
 যাও,
পরাও মুকুট
যাও
সময়ের খুট ধরে টেনে আনো
 শস্যমন্ত্র আর
 নিরাকার সহিষ্ণু আঁধার
 টেনে আনো মাটিতে আবার
তুমি ফলাও উদ্ভিদ
যাও,
শীতল পাটিতে বসো
 হারানো আসনে
 থাক
 পিছনে অশুভ।

*

একজন ধর্মপ্রণেতা
 
(আশরাফুল আলমকে)

ছিলাম প্রথম ভ্রূণ খড়ের গাদায, ছিলাম তপ্ত লোহা, তোমার জ্বলন্ত ধাতু
ছিলাম মাটির বাসে লুকনো মোহর, ছিলাম শিল্পের লিপ্সা
জটিল বন্ধন।
আমাকে সমুদ্রস্নানে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন, অসতী নারীর সঙ্গে,
 আমাকে অরণ্যে নিয়ে যাওয়া হলো একদিন অসতী আলোর সঙ্গে,

এক যুবতীর জলের উপরে আমাকে ভাসতে দেওয়া হলো একদিন।
আমাকে জলের অর্থ বলে দেওয়া হলো এক জেলেনীর সঙ্গে শুতে দিয়ে।
আমাকে ঝর্ণার নৃত্য, সীমাবদ্ধ সমুদ্র দেখতে নিয়ে যাওয়া হলো
মরুদ্যানে, হায়
আমি কত কমনীয় খর্জুর বৃক্ষ দেখলাম!
আরব্য রজনী, শাহী গণিকাদের গোলগাল নাভির অপেরা হাউস!

আমি নৃত্যপরা তাবুর ভিতরে কত দেখলাম ঘুঙগুরের ঝাঁঝট তরঙ্গ
 কত দেখলাম দহন চুম্বনে বদ্ধ সিংহমূর্খ, নরনারী
শিশু ও লোবান আর মৃত্যু ও আতরদানী কত দেখলাম।

সার্কাস কুমারী ছিল একজন, সেইখানে তাবুর ভিতরে
সে আমার দিকে তার ছিন্ন ঘাঘরার দ্যুতি ছুঁড়ে দিল,
 নিদ্রার মিথুন মুদ্রা ছুঁড়ে দিল সেই প্রথম।

আমাকে মায়ের সঙ্গে পিতার কবর খুঁড়তে যেতে হলো, সেই প্রথম
 গ্রীষ্মের ঝাপটা লাগা রাত্রিতে একদিন,
শুক্লা দ্বাদশীর রাত্রে জ্যোৎস্নায় আমি মায়ের নারীত্ব ছুঁই সেই প্রথম।

আমি তার ভ্রূণের ভিতর হিংসা ভ্রাতৃহিংসা হেনে ফের
ভ্রাতৃহন্তাকারী হই, পরিব্রাজক হই
পায়ের ভিতরে আমি সেই প্রথম অনুভব দাবী করি আরো
অজস্র অজস্র পা আমার শরীরে

নৃত্য করছে নৃত্যপর- তারা
সেই প্রথম আমাকে বোঝালো,

এইসব তামসপ্রবাহে মিগ্ধ স্নান সেরে নাকি এক
বিলুপ্ত জাতির ফের জাগরণ হবে,
এক কান্তিমান নাকি ফিরে আসবে আবার উষ্ণীষে,
 কিন্তু কই? আমি যতবার আসি
ততবার ওরা তো আমাকে আজো হত্যা করে!
হত্যা করে ফেলে!

*

নির্বিকার মানুষ

নদীর পারের কিশোরী তার নাভির নীচের নির্জনতা
লুট করে নিক নয়টি কিশোর রাত্রিবেলা
আমার কিছু যায় আসেনা,
 খুনীর হাতের মুঠোয় থাকুক কুন্দকুসুম কি আসে যায়?
প্রেমিক করতলে না হয় লুকিয়ে ফেলুক ফুলের ফণা কি আসে যায়?
 শিশুর মাথায় সাপের মতো বুদ্ধি খেলুক আমার তাতে কি আসে যায়?

বৃক্ষ ফলাক বিষাক্ত ফল, ছোঁব না আমি তবেই হলো!
আমার ছুঁতে হবেই এমন শর্ত কি কেউ বলে দিয়েছে।

পথের উপর গর্ত আছে আঁধার আমি দেখিনা যে!
না হয় আমার পা-ই ভাঙ্গুক, সঠিক পায়েই সুখী মানুষ?
 নারীকে যে নিদ্রা থেকে চুম্বনে তার চোখ খুলিনি বলেই আমার
 তার বিরোধী হতেই হবে, এমন কোনো শর্ত তো নেই।

আসবো বলে আর আসিনি, আসায় কিছু যায় আসেনা
এমনি যেমন মানুষ আসে তেমনি আমি চলে এলাম,
এই আসাই প্রচলিত ভিন্ন অর্থে ভিন মানুষের
 কাঁপন খেয়ে কখন বনে কান্তি আবার কখন ধুলো
ধূসরতার প্রতিমূর্তি

এখন তোমার কাছে বসে এক অশান্তি এই যে কাঁদে কান্তি আমার
কোথায় আমি কান্তি পাবো? অভিমানের আগুনে যে
পোড়া পুতুল, কান্তি কোথায়?
 প্রজ্বলিত অগ্নি আমার শুদ্ধতম শান্তি কোথায়?
অন্ধ আমি চতুর্মতি

আমরা এখন এ ওর প্রতি বাণ ছুঁড়ি আর হো হো হাসির মধ্যে নামাই
আর মানুষের উগ্র ক্ষতি।

*

নিঃসঙ্গতা

অতটুকু চায়নি বালিকা!
 অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
 চেয়েছিল আরো কিছু কম,

আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
 বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
 মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!

অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম
চেয়েছিল আরো কিছু কম!

একটি জলের খনি
 তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল

একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!

*

ভিতর বাহির
(হাসান হাফিজকে)

আমার শরীর তোমরা খুঁড়ে দ্যাখো আছে কিনা
ভিতরে কোথাও সেই কুমারী মাটির গন্ধ, মানুষের মায়া ও মমতা আজো
আছে কিনা একাকার আরো কি কি সেইসব, তোমরা বলো ঐ যে কী সব!
 খুঁড়ে দ্যাখো আছে কিনা মস্তিষ্কে ও হাত পা জোড়ায় সেই
ঐ যে কী
মানুষের মনুষ্যত্ব, মর্মছেঁড়া জীবনের এপাশ ওপাশ এটা ওটা!
আমার শরীর খোঁড়া, দুঃখময় আত্মার গাঁথুনী, দ্যাখো আমি ঠিকই
 খণ্ডিত ইটের মতো খুলে যাবো সহজেই, কিছুই থাকবো না!
মায়া ও মমতা ছাড়া, মানুষের দুঃখবোধ, ব্যথাবোধ ছাড়া আমি
কিছুই থাকবো না!

*

তোমার চিবুক ছোঁবোকালিমা ছোঁবো না

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
 তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’, শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো!
কালিমা রাখবো না!

 এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
 এখন তোমার কাছে যাবো
 তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
 তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মাছ আকাশে তাকা-
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
 যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের শাদা হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখিনা- তোমার চিবুকে
তাঁরা নিশ্চয়ই আছেন!

তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
 তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!

*

বন্দুকের নল শুধু নয়

এমনও সময় আসে
 বন্দুকের নল শুধু নয়, মানুষেরও বুক বড় বেদনায়
বেজে ওঠে ব্যথায় বারুদে–

আর তাতে হাওয়া লাগে…
আর তাতে জ্বলে যায়…
 ভস্মীভূত হয় সব রাজ্যপাট, সিংহাসন, ভুল নৃপতির মুণ্ডু
চাঁদ
ফুল
নারী
শিল্প
সভ্যতার কুশপুত্তলিকা!

এমনও সময় আসে,
বিপ্লবীর মন শুধু নয়, বনভূমি সেও বড় বেদনায়
বিদ্রোহ জমিয়ে রাখে গাছে গাছে সবুজ পাতায়!

উত্তেজিত কাতুর্জে কান্দায়
 আমের বোলের মতো ঝরে পড়ে
তখোন যৌবন
টাকা
কাটামুণ্ডু
রাজপথে
 রাজার দ্বৈরথে!

এমনও আগুন আছে দমকলও নেভাতে পারে না!
সে আগুন নটীর মুদ্রায় জ্বলে,
পাটের গাঁটের মতো যুবতীর তলপেটে জ্বলে ওঠো
সে সব রহস্য-আগুনে দূরে…
দুপুরে হাওয়ার আহা তারপর
তখোন যেনো কার ভালোবাসা পোড়ে…
কার যেনো…
কার যেনো…
কা…র…

*

গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর

গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান
ছিলাম।
জ্যোত্সায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও
প্রেমিক হৃদয়!
আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকালয়ের গণিকার কাছে ক্লান্তি
সঁপেছি
বাঘিনীর মুখে চুমো খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও।
সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু
হে কবি কিশোর
 আমারও অনেক স্বপ্ন শহীদ হয়েছে জীবনে কাঁটার আঘাত সয়েছি
আমিও।
হৃদয়ে লুকানো লোহার আয়না ঘুরিয়ে সেখানে নিজেকে দেখেছি
পাণ্ডুর খুবই নিঃস্ব একাকী!
আমার পায়ের সমান পৃথিবী কোথাও পাইনি অভিমানে আমি
অভিমানে তাই
চক্ষু উপড়ে চড় ইয়ের মতো মানুষের পাশে ঝরিয়েছি শাদা শুভ্র পালক!
হে কবি কিশোর নিহত ভাবুক, তোমার দুঃখ আমি কি বুঝি না?
আমি কি জানি না ফুটপাতে কারা করুণ শহর কাঁধে তুলে নেয়?
তোমার তৃষ্ণা তামার পাত্রে কোন কবিতার ঝিলকি রটায় আমি কি
জানি না
 তোমার গলায় কোন গান আজ প্রিয় আরাধ্য কোন করতলও হাতে লুকায়
আমি কি জানি না মাঝরাতে কারা মৃতের শহর কাঁধে তুলে নেয়?
 আমারও ভ্রমণ পিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে
আমিও প্রেমিক জুবাদুর গান স্মৃতি সমুদ্রে একা শাম্পান হয়েছি
আবার
সুন্দর জেনে সহোদরাকেও সঘন চুমোর আলুথালু করে খুঁজেছি
শিল্প।
 আমি তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক তুমি সেরে ওঠো
 তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই আমাদের পথে কখনো এসো না,
আমাদের পথ
 ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ।

*

আমি অনেক কষ্টে আছি

আমার এখন নিজের কাছে নিজের ছায়া খারাপ লাগে
রাত্রি বেলা ট্রেনের বাঁশি শুনতে আমার খারাপ লাগে
জামার বোতাম আটকাতে কী কষ্ট লাগে, কষ্ট লাগে
তুমি আমার জামার বোতাম অমন কেন যত্ন কোরে
লাগিয়ে দিতে?
 অমন কেন শরীর থেকে আস্তে আমার
ক্লান্তিগুলি উঠিয়ে নিতে?
তোমার বুকের নিশিথ কুসুম আমার মুখে ছড়িয়ে দিতে?
জুতোর ফিতে প্রজাপতির মতোন তুমি উড়িয়ে দিতে?
 বেলজিয়ামের আয়নাখানি কেন তুমি ঘর না রেখে
অমন কারুকাজে সাথে তোমার দুটি চোখের মধ্যে
রেখে দিতে?
রেখে দিতে?
 আমার এখন চাঁদ দেখতে খারাপ লাগে
 পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে
 কথাবার্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
মোটের উপর আমি এখন কষ্টে আছি, কষ্টে আছি বুঝলে যুথী
 আমার দাঁতে আমার নাকে, আমার চোখে কষ্ট ভীষণ
চতুর্দিকে দাবী আদায় করার মতো মিছিল তাদের কষ্ট ভীষণ
বুঝতে যুথী,
হাসি খুশী উড়নচণ্ডী মানুষ আমার তাইতো এখন খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
আর তাছাড়া আমি কি আর যীশু না হাবিজাবি
ওদের মতো সব সহিষ্ণু?
 আমি অনেক কষ্টে আছি কষ্টে আছি কষ্টে আছি আমি অনেক…

*

স্থিতি হোক

একটি নারীর উড়াল কণ্ঠ বুকের ভিতর খুঁড়তে খুঁড়তে মন্ত্র দিলো
 স্থিতি থোক, স্থিতি হোক, হৃদয়ে আবার স্থিতি হোক!
 শ্যাওলা জুড়ে সবুজ দিঘির ঘাটলা ওদের জনবসতে স্থিতি হোক!
একা থাকার কপাল জুড়ে কলহ নয় স্থিতি চাই স্থিতি হোক!

বৃক্ষ ওদের বনানী জুড়ে চাইনা বিনাশ বালমিকী চাই স্থিতি চাই,
স্থিতি হোক!
 বৃষ্টি আবার বরণ করুক কোমল শস্য, বিলাপকে নয় বিলাপ এবার ।
বিলুপ্ত হোক!
 সেই সুরভি আবার আসুক অন্ধকারে সে মৃত্তিকা আনতমুখ।
আবার হাসুক, স্থিতি হোক!
 মৃত্যু মাখা মানুষ ওদের আড়াল থেকে আর এক মানুষ
মন্ত্র দিলো স্থিতি হোক!
কবে কোথায় শুনেছিলাম পথের পিঠে পায়ের চাবুক আবার তারা
স্থিতি হোক!
 ভুল প্রকৃতি পারস্পরিক প্রলয় শিখা অগ্নিখোলশ আবার খুলুক
স্থিতি হোক!
পালক পরা হরিতকীর আকুল বাগান হাতের কাছে ব্যাকুল বেলায়
স্থিতি হোক!
 সময় থেকে শাড়ির মতো আবার তুমি উন্মোচিত শান্তি আমার
শান্তি আমার
কর্পুরেরই গন্ধ ভরা এক অনাদি কৌটো তুমি হে স্থিতি
 তোমার ভিতর কাত হয়ে আজ সেই বিশুদ্ধি বিলিয়ে দিলাম হে স্থিতি
 মাটির কলস ভরা জলের ঠাণ্ডা বসত তুমি আমার
সোঁদা বনের রৌদ্রে ভরা টলমলানো উঠোন তুমি মন্ত্র আমার
গ্রীষ্মকালের সরল হাওয়া, বিনাশবিহীন জাগরণে শান্ত ভূমি
মাইল মাইল তুমি আমার
 কেবল শুধু ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি
তুমি আমার
 শহর ভরা কাঁচের কোকিল, মুখর হলো মুখর হলো, ওদের আবার
স্থিতি হোক,
ঐতো আমি দেখছি ভাঙ্গন ওদের গহন নাভির মূলে, ওদের আবার
স্থিতি থোক, স্থিতি হোক!
 রুটি গোলাপ শ্রমের সঙ্ঘ, স্বেচ্ছাচারের কানে এবার মন্ত্র দিলাম
স্থিতি হোক স্থিতি হোক?

*

কুরুক্ষেত্রে আলাপ

আমার চোয়ালে রক্ত হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম
আমি শিও হত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়!

ভ্রূণহত্যা! সেতো আরো সঙ্ঘাতিক, আমি জানতাম হে অর্জুন
 মানুষ জন্ম চায় না, মানুষের মৃত্যুই আজ ধ্রুব!

আমার নাভিতে রক্ত-আমি জানতাম আমি ঠিকই জানতাম
 আমি মানুষের এই রোষ থামাতে পারবো না, উন্মত্ততা থামাতে
পারবো না।
দুর্ভিক্ষ ও রাষ্ট্রবিপ্লব আমি থামাতে পারবো না
 চালের আড়ত থেকে অভিনব চাল চুরি থামাতে পারবো না,
 রিলিফের কাপড়ে আমি মানুষের অধঃপতন ঢাকতে পারবো না!

শেফালীর সোমত্ত গ্রীবায় লাগবে লাম্পটের লাল আর বিষ
আমি জানতাম হে অর্জুন অনাহারে অনেকেই যুবতী হয়েও আর
যুবতী হবে না!
ভাই পলায়নে যাবে বোন তার বাসনা হারাবে আমি জানতাম
 ফুল ফুটবে না, ফুল ফুটবে না, ফুল আর ফুটবে না, ফুল আর কখনো
ফুটবে না!

বকুল-বৃক্ষদের এইভাবে খুন করা হবে সব গীতিকার পাখিদের
 এইভাবে গলা, ডানা স্বরলিপি শব্দের পালকগুলি
ভেঙে দেয়া হবে আমি জানতাম
তিতির ও ঈগল গোত্রের সব শিশুদের এইভাবে ভিক্ষুক পাগল
আর উন্মাদ বানানো হবে

ভারতীয় যুদ্ধের উৎসবে আজ এই শুধু আমাদের
ধনুক ব্যবসা,
 আমি জানতাম, হে অর্জুন,-আমি ঠিকই জানতাম।

*

শস্যপর্ব

বুকের কাছে বৃক্ষ তাতে লিখতে লিখতে লিখেই ফেলি হলকর্ষণ।
যন্ত্রচাকা
মায়ায় ঢাকা মাংসমধুর আলস্য আর অগাধ জল আলোর জল,
 লিখেই ফেলি স্নিগ্ধ জল জিহ্বা-উরু ভালোবাসা নারীর চক্ষু নারীর
নাভি,

সাধ্য মতোন যেমন পারি শস্যগন্ধ, শস্যচাকা, শস্যমুগ্ধ, শস্যমানুষ!

লিখতে লিখতে ফিরে তাকাই মাটির দিকে, তাকাই ফিরে, মাটি মাটি,
মাড়াই মাটি
সঙ্গে সঙ্গে সুদৃষ্টিপাত, হিম অনাদি, হা হৃৎপিণ্ড, হা হৃৎকমল।
শিল্পবেদী,
 যুথচারী মানুষ আবার মানুষ গড়ে লোকলস্কর মহৎ আঁধার, অন্য আঁধার
অভিজ্ঞতা,

লিখতে লিখতে লিখেই ফেলি ফুল কুসুম, মুগ্ধ কুসুম, মুগ্ধ শস্য!
অজস্র নীল মুকুর আমার ফোঁটায় দৃশ্য লিখেই ফেলি হে দিগ্বিদিক,
হে অদৃশ্য,
শরীর জুড়ে শীতল জলের শস্যগন্ধ, শস্যযুথী, শস্যকুসুম!
শস্যমাখা কলস তাতে লিখেই ফেলি শস্যকণ্ঠ, শস্যবৃক্ষ, শস্যাদীঘি,
শস্যদৃশ্য।

নবীন উদাস আবদ্ধবোধ স্মৃতির মধ্যে সিক্ত বোধি শক্ত দৃশ্য;
এই তো জটিল বাঁচায় অলখ এই তো লেখা, এই তো প্রতীক
তাকাই ফিরে
 এত দিনের অন্ধ পেছন ভাঙ্গন রেখা অলস অধম অধঃস্তনের তুল্য প্রবল

প্রজ্বলন্ত সেই কদাকার হা কুচ্ছিৎ সমস্ত সব ভণ্ডামি আর উলটপালট
 লোভলালসা, লুব্ধজটিল সমস্ত সব চৌচুরমার হতকুচ্ছিৎ তাকাই ফিরে

লিখতে লিখতে তাকাই ফিরে মাটির দিকে, মাটি মাটি মাড়াই মাটি
সাধ্যমতোন যেমন পারি মাটিতে যাই শস্যপর্ব, শস্যমুগ্ধ শস্যমানুষ!

*

কবির ভাসমান মৃতদেহ

কেউ তাকে কখনো দেখেনি, অথচ সে ছিল পাশে
 আমাদেরই আশে-পাশে কিন্তু আজ এখন কোথাও নেই!
এখন সে জলে ভাসমান লাশ, মৃতদেহ একজন কবির।

আর জানোই তো কবিরা কাঁদলেও তার অশ্রু থেকে মৃত্যু ঝরে পড়ে?
 আর জানোই তো তাদের অশ্রুর মূলে মর্মর ঝরঝর করে আজো
ঝরে যায় ফের
 তারই স্বদেশ

কেউ তাকে কখনো দ্যাখেনি, অথচ সে ছিল পাশে
সে এখন জলে ভাসমান লাশ একজন কবির!
কবি তাকে যখোনই ভাসায় জলে,
 পদ্ম তাকে ঠুকরে ঠুকরে খায় যেনো তারই অশ্রু, তারই অক্ষমতা!
অর্থাৎ তারই মৃত্যু, তার অবসান তার
উদগত নিঃশ্বাস!
মাছরাঙ্গা এই মৃত্যু দেখে ফেলে, বারবার
 জলের ঘূর্ণিও তার এ রকম মৃত্যুর ভিতর হাতছানি দিয়ে যায়
জেলেরা দুহাতে জাল ফেলে দিয়ে তুলে নেয় শেষে তার
চকচকে রূপোলী ইলিশমৃত্যু!
যুবতীরা জলের জঙ্ঘায় ফিরে পায় তার জীবনের ও বিগত প্রবাহ।

ঢোঁরা সাপ, কামট, হাঙ্গর মাছ এসে তাকে ছায়া দিয়ে যায়!
কবির চোখের কালো কোটরেও পৌঁছে দেয় যেনো দু’টি কালো মুক্তো
সেইখানে দুইটি ঝিনুক!
 কবি যতবার কাঁদে এদেশেও অনাচার, মৃত্যু আর রক্তারক্তি বাঁধে!

কবির মৃত্যু নিয়ে আজো দ্যাখো ঐখানে লোফালুফি
ঐ তো পদ্মায় ওরা কবির ভাসন্ত মরা দেহ নিয়ে
খেলছে, খেলছে!


একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই
- আবুল হাসান

একসময় ইচ্ছে জাগে, মেষপালকের বেশে ঘুরিফিরি;
অরণ্যের অন্ধকার আদিম সর্দার সেজে মহুয়ার মাটির বোতল
ভেঙ্গে উপজাতি রমণীর বল্কল বসন খুলে জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসি-

আর তারস্বরে বলে উঠি নারী, আমি মহুয়া বনের এই
সুন্দর সন্ধ্যায় পাপী, তোমার নিকটে নত, আজ কোথাও লুকানো কোনো
কোমলতা নেই, তাই তোমার চোখের নীচে তোমার ভ্রুর নীচে তোমার তৃষ্ণার নীচে

এই ভাবে লুকিয়েছি পিপাসায় আকণ্ঠ উন্মাদ আমি
ক্ষোভে ও ঈর্ষায় সেই নগরীর গুপ্তঘাতক আজ পলাতক, খুনী
আমি প্রেমিককে পরাজিত করে হীন দস্যুর মতোন
খুনীকে খুনীর পাশে রেখে এখানে এসেছি, তুমি
আমাকে বলো না আর ফিরে যেতে, যেখানে কেবলি পাপ, পরাজয়
পণ্যের চাহিদা, লোভ, তিরীক্ষু-মানুষ- যারা কোজাগরী ছুরি
বৃষ্টির হল্লায় ধুয়ে প্রতি শনিবারে যায় মদ্যশালায়, যারা
তমসায় একফোঁটা আলোও এখন আর উত্তোলন করতে জানে না।
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে কেবলি যাদের রক্ত, রাত্রিবেলা আমি আজ
তোমার তৃষ্ণার নীচে নিভৃতের জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসেছি আদিম আজ
এখন আমার কোন পাপ নেই, পরাজয় নেই।
একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেতো।


বিচিত্রাঃ ইদ সংখ্যা ১৯৭৭



তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না

আবুল হাসান---সংকলিত (আবুল হাসান)

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
এখন তোমার কাছে যাবো
তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা–
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা
হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না– তোমার চিবুকে
তারা নিশ্চয়ই আছেন!

তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!

আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!

ভালোবাসার কবিতা লিখবো না
আবুল হাসান---সংকলিত (আবুল হাসান)

‘তোমাকে ভালোবাসি তাই ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।
আমার ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো কবিতা সফল হয়নি,
আমার এক ফোঁটা হাহাকার থেকে এক লক্ষ কোটি
ভালোবাসার কবিতার জন্ম হয়েছে।

আমার একাকীত্বের এক শতাংশ হাতে নিয়ে
তুমি আমার ভালোবাসার মুকুট পরেছো মাথায়!
আমাকে শোষণের নামে তৈরি করেছো আত্মরক্ষার মৃন্ময়ী যৌবন।
বলো বলো হে ম্লান মেয়ে,এতো স্পর্ধা কেন তোমার?

ভালোবাসার ঔরসে আমার জন্ম! অহংকার আমার জননী!
তুমি আমার কাছে নতজানু হও,তুমি ছাড়া আমি
আর কোনো ভূগোল জানি না,
আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি!

আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!
হে মেয়ে ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও!

আমার অপার করুণার মধ্যে তোমারও বিস্তৃতি!
তুমি কোন্ দুঃসাহসে তবে
আমার স্বীকৃতি চাও,হে ম্লান মেয়ে আমার স্বীকৃতি চাও কেন?
তোমার মূর্খতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে,পৃথিবীটা পুড়ে যাবে
হেলেনের গ্রীস হবে পুনর্বার আমার কবিতা!
এই ভয়ে প্রতিশোধস্পৃহায়
আজো আমি ভালোবাসার কবিতা লিখিনি
কোনোদিন ভালোবাসার কবিতা লিখিনি।

হে মেয়ে হে ম্লান মেয়ে তোমাকে ভালোবাসি তাই
ভালোবাসার কবিতা আমি কোনোদিন কখনো লিখবো না!’





গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর

আবুল হাসান---সংকলিত (আবুল হাসান)

গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান
ছিলাম ।
জোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ারা চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও
প্রেমিক হৃদয় !
আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকার কাছে ক্লান্তি
সঁপেছি
বাঘিনীর মুখে চুমু খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও !
সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু
হে কবি কিশোর
আমারও অনেক স্বপ্ন শহীদ হয়েছে জীবনে কাঁটার আঘাত সয়েছি
আমিও ।
হৃদয়ে লুকানো লোহার আয়না ঘুরিয়ে সেখানে নিজেকে দেখেছি
পান্ডুর খুবই নিঃস্ব একাকী !
আমার পয়ের সমান পৃথিবী কোথাও পাইনি অভিমানে আমি
অভিমানে তাই
চক্ষু উপড়ে চড়ুইয়ের মতো মানুষের পাশে ঝরিয়েছি শাদা শুভ্র পালক !
হে কবি কিশোর নিহত ভাবুক, তেমার দুঃখ আমি কি বুঝি না ?
আমি কি জানি না ফুটপাতে কারা করুণ শহর কাঁধে তুলে নেয় ?
তোমার তৃষ্ণা তামার পাত্রে কোন কবিতার ঝিলকি রটায় আমি কি
জানি না
তোমার গলায় কোন গান আজ প্রিয় আরাধ্য কোন করতলও হাতে লুকায়
আমি কি জানি না মাঝরাতে কারা মৃতের শহর কাঁধে তুলে নেয় ?
আমারও ভ্রমণ পিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে
আমিও প্রেমিক ক্রবাদুর গান স্মৃতি সমুদ্রে একা শাম্পান হয়েছি
আবার
সুন্দর জেনে সহোদরকেও সঘন চুমোয় আলুথালু করে খুঁজেছি
শিল্প ।
আমি তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক তুমি সেরে ওঠো
তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই আমাদের পথে কখনও এসো না,
আমাদের পথ

ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন