যতীন্দ্রমোহন বাগচী এর কবিতা সংগ্রহ

যতীন্দ্রমোহন বাগচী

যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর নদিয়ার জমসেদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

কলকাতার ডাফ কলেজ (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে তিনি স্নাতক পাশ করেন। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে তিনি নিয়মিতি লেখালেখি করতেন।

১৯০৯ থেকে নিয়ে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্য পত্রিকা মানসী-র সম্পাদনায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯২১ থেকে নিয়ে বছরখানেক তিনি অপর এক সাহিত্য সাময়িকী যমুনা-র যুগ্ম সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি নিজস্ব পত্রিকা পূর্বাচল চালু করেন এবং এর সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।









কাজলা দিদি

- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক্-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে,
থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে নাএকলা জেগে রই,
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?

সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন
দিদি বলে ডাকি তখন,
ও-ঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকিতুমি কেন চুপটি করে থাকো?

বল্ মা দিদি কোথায় গেছেআসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে
আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন ক'রে রবে?
আমিও নাই---দিদিও নাই---কেমন মজা হবে!

ভূঁই-চাঁপাতে ভরে গেছে শিউলী গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল |
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটা লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা ছিঁড়তে গিয়ে ফল,
দিদি যখন শুনবে এসে বলবি কি মা বল্ |

বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর তলে পুকুর পাড়ে
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে নাতাইতো জেগে রই,---
রাত্রি হোল মাগোআমার কাজলা দিদি কই?



অন্ধ বধূ

- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চলনা ঠাকুর-ঝি —
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়?
তাইত বলি, বদোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল — মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল — কতই মনে হয় ।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরি ভাই —
আমের গায়ে বরণ দেখা যায় ?
—অনেক দেরি? কেমন করে’ হবে !
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া —বন্ধ কবে ভাই ;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে —
শেওলা-পিছল — এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয়না কিন্তু তায় —
অন্ধ চোখের দ্বন্ধ চুকে’ যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্ ,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা —দাদা তো তার আগে?
এই আষাড়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে’ না পাবে —
দেখবি তখন —প্রবাস কেমন লাগে ?
—কী বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল ?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল !
কত লোকেই যায় তো পরবাসে —
কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে ?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ !
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর —
ফিরে’ আসার নাই কোন উদ্দেশ !
—ঐ যে হথায় ঘরের কাঁটা আছে —
ফিরে’ আসতে হবে তো তার কাছে !
এই খানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল-ভারি — ফসকে যদি যাই —
এ অক্ষমার রক্ষা কী আর আছে !
আসুন ফিরে’ — অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা —
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্ম শোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’ —
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
‘চোখ গেল ঐই চেঁচিয়ে হ’ল সারা।
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা —
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ !
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার — ছাই!
কাঁদতে গেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
‌‌‍‍‍‌’চোখ’ গেল– তার ভরসা তবু আছে —
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে !
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি —
সেই তো ফিরে’ যাব আবার বাড়ি,
একলা-থাকা-সেই তো গৃহকোণ —
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে —
দরদ-ভরা দুখের আলাপন
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত !
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে —
বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে —
সকল বালাই বহি আপন মাথায় ! —
দেখিস তখন, কানার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর।
তারপরে – এই শেওলা-দীঘির ধার —
সঙ্গে আসতে বলবনা’ক আর,
শেষের পথে কিসের বল’ ভয় —
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে —
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়।
শেওলা দীঘির শীতল অতল নীরে —
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে’!



অপরাজিতা

- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম |
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি ;
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে—
ফুল কহে—মোর কিছু নাই কিছু নাই,
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক,
বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ |
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা-শুধু-পূজা জীবনের মোর ব্রত ;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে—


যৌবন-চাঞ্চল্য

- যতীন্দ্রমোহন বাগচী

ভুটিয়া যুবতি চলে পথ; 
আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা। 
চারিধারে কেবলই পর্বত; 
যুবতী একেলা চলে পথ। 
এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়, 
কভু বা চমকি চায় ফিরে; 
গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ 
আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে। 
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ। 

টসটসে রসে ভরপুর-- 
আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক 
পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর; 
যৌবনের রসে ভরপুর। 
মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়, 
একটু নাহিকো ডর তাতে; 
উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ 
উরস পরশি নিজ হাতে! 

অজানা ব্যাথায় সুমধুর-- 
সেথা বুঝি করে গুরুগুরু! 
যুবতি একেলা পথ চলে; 
পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে? 
আবেশে চরণ দুটি টলে-- 
পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে! 
আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়, 
তবু কেন আনপানে টান? 
করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি? 
--স্বরূপ জানেন ভগবান! 

সহজে নাচিয়া যেবা চলে 
একাকিনী ঘন বনতলে-- 
জানি নাকো তারো কী ব্যাথায় 
আঁখিজলে কাজল ভিজায়!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন