বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুন ২৭, ১৮৩৮- এপ্রিল ৮, ১৮৯৪) উনিশ শতকের বাঙালি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁকে সাধারণত প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে গীতার ব্যাখ্যাদাতা হিসাবে, সাহিত্য সমালোচক হিসাবেও তিনি বিশেষ খ্যাতিমান। তিনি জীবিকাসূত্রে ব্রিটিশ রাজের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছদ্মনাম হিসেবে কমলাকান্ত নামটি বেছে নিয়েছিলেন।
আদর
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১
মরুভূমি মাঝে যেন, একই কুসুম,
পূর্ণিত সুবাসে।
বরষার রাত্রে যেন, একই নক্ষত্র,
আঁধার আকাশে ||
নিদাঘ সন্তাপে যেন, একই সরসী,
বিশাল প্রান্তরে।
রতন শোভিত যেন, একই তরণী,
অনন্ত সাগরে।
তেমনি আমার তুমি, প্রিয়ে, সংসার-ভিতরে ||
২
চিরদরিদ্রের যেন, একই রতন,
অমূল্য, অতুল।
চিরবিরহীর যেন, দিনেক মিলন,
বিধি অনুকূল ||
চিরবিদেশীর যেন, একই বান্ধব,
স্বদেশ হইতে।
চিরবিধবার যেন, একই স্বপন,
পতির পীরিতে।
তেমনি আমার তুমি, প্রাণাধিকে, এ মহীতে ||
৩
সুশীতল ছায়া তুমি, নিদাঘ সন্তাপে,
রম্য বৃক্ষতলে।
শীতের আগুন তুমি, তুমি মোর ছত্র,
বরষার জলে ||
বসন্তের ফুল তুমি, তিরপতি আঁখি,
রূপের প্রকাশে।
শরতের চাঁদ তুমি, চাঁদবদনি লো,
আমার আকাশে।
কৌমুদীমুখের হাসি, দুখের তিমির নাশে ||
৪
অঙ্গের চন্দন তুমি, পাখার ব্যজন,
কুসুমের বাস।
নয়নের তারা তুমি, শ্রবণেতে শ্রুতি,
দেহের নিশ্বাস ||
মনের আনন্দ তুমি, নিদ্রার স্বপন,
জাগ্রতে বাসনা।
সংসার সহায় তুমি, সংসার-বন্ধন,
বিপদে সান্ত্বনা।
তোমারি লাগিয়ে সই, ঘোর সংসার-যাতনা
সাবিত্রী
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১
তমিস্রা রজনী ব্যাপিল ধরণী,
দেখি মনে মনে পরমাদ গণি,
বনে একাকিনী বসিলা রমণী
কোলেতে করিয়া স্বামীর দেহ।
আঁধার গগন ভুবন আঁধার,
অন্ধকার গিরি বিকট আকার
দুর্গম কান্তার ঘোর অন্ধকার,
চলে না ফেরে না নড়ে না কেহ ||
২
কে শুনেছে হেথা মানবের রব?
কেবল গরজে হিংস্র পশু সব,
কখন খসিছে বৃক্ষের পল্লব,
কখন বসিছে পাখী শাখায়।
ভয়েতে সুন্দরী বনে একেশ্বরী,
কোলে আরও টানে পতিদেহ ধরি,
পরশে অধর অনুভব করি,
নীরবে কাঁদিয়া চুম্বিছে তায় ||
৩
হেরে আচম্বিতে এ ঘোর সঙ্কটে,
ভয়ঙ্কর ছায়া আকাশের পটে,
ছিল যত তারা তাহার নিকটে
ক্রমে ম্লান হয়ে গেল নিবিয়া।
সে ছায়া পশিল কাননে,-অমনি,
পলায় শ্বাপদ উঠে পদধ্বনি,
বৃক্ষশাখা কত ভাঙ্গিল আপনি,
সতী ধরে শবে বুকে আঁটিয়া ||
৪
সহসা উজলি ঘোর বনস্থলী,
মহাগদাপ্রভা, যেন বা বিজলী,
দেখিয়া সাবিত্রী যেন রত্নাবলী,
ভাসিল নিঝরে আলোক তার।
মহাগদা দেখি প্রণমিলা সতী,
জানিল কৃতান্ত পরলোকপতি,
এ ভীষণা ছায়া তাঁহারই মূরতি,
ভাগ্যে যাহা থাকে হবে এবার ||
৫
গভীর নিস্বনে কহিলা শমন,
থর থর করি কাঁপিল গহন,
পর্ব্বতগহ্বরে ধ্বনিল বচন,
চমকিল পশু বিবর মাঝে।
“কেন একাকিনী মানবনন্দিনী,
শব লয়ে কোলে যাপিছ যামিনী,
ছাড়ি দেহ শবে ; তুমি ত অধীনী,
মম অঙ্গে তব বাদ কি সাজে ||”
৬
“এ সংসারে কাল বিরামহীন,
নিয়মের রথে ফিরে রাত্রি দিন,
যাহারে পরশে সে মম অধীন,
স্থাবর জঙ্গম জীব সবাই।
সত্যবানে আসি কাল পরশিল,
লতে তারে মম কিঙ্কর আসিল,
সাধ্বী অঙ্গ ছুঁয়ে লইতে নারিল,
আপনি লইতে এসেছি তাই ||”
৭
সব হলো বৃথা না শুনিল কথা,
না ছাড়ে সাবিত্রী শবের মমতা,
নারে পরশিতে সাধ্বী পতিব্রতা,
অধর্ম্মের ভয়ে ধর্ম্মের পতি।
তখন কৃতান্ত কহে আর বার,
“অনিত্য জানিও এ ছার সংসার,
স্বামী পুত্র বন্ধু নহে কেহ কার,
আমার আলয়ে সবার গতি ||
৮
“রত্নছত্র শিরে রত্নভূষা অঙ্গে,
রত্নাসনে বসি মহিষীর সঙ্গে,
ভাসে মহারাজা সুখের তরঙ্গে,
আঁধারিয়া রাজ্য লই তাহারে।
বীরদর্প ভাঙ্গি লই মহাবীরে,
রূপ নষ্ট করি লই রূপসীরে,
জ্ঞান লোপ করি গরাসি জ্ঞানীরে,
সুখ আছে শুধু মম আগারে ||
৯
“অনিত্য সংসার পুণ্য কর সার,
কর নিজ কর্ম্ম নিয়ত যে যার,
দেহান্তে সবার হইবে বিচার,
দিই আমি সবে করমফল।
যত দিন সতী তব আয়ু আছে,
করি পুণ্য কর্ম্ম এসো স্বামী পাছে-
অনন্ত যুগান্ত রবে কাছে কাছে,
ভুজিবে অনন্ত মহা মঙ্গল ||
১০
“অনন্ত বসন্তে তথা অনন্ত যৌবন,
অনন্ত প্রণয়ে তথা অনন্ত মিলন,
অনন্ত সৌন্দর্য্যে হয় অনন্ত দর্শন,
অনন্ত বাসনা, তৃপ্তি অনন্ত।
দম্পতি আছয়ে, নাহি বৈধব্য-ঘটনা,
মিলন আছয়ে, নাহি বিচ্ছেদযন্ত্রণা,
প্রণয় আছয়ে, নাহি কলহ গঞ্জনা,
রূপ আছে, নাহি রিপু দুরন্ত ||
১১
“রবি তথা আলো করে, না করে দাহন,
নিশি স্নিগ্ধকরী, নহে তিমির কারণ,
মৃদু গন্ধবহ ভিন্ন নাহিক পবন,
কলা নাহি চাঁদে, নাহি কলঙ্ক।
নাহিক কণ্টক তথা কুসুম রতনে,
নাহিক তরঙ্গ স্বচ্ছ কল্লোলিনীগণে,
নাহিক অশনি তথা সুবর্ণের ঘনে,
পঙ্কজ সরসে নাহিক পঙ্ক ||”
১২
“নাহি তথা মায়াবশে বৃথায় রোদন,
নাহি তথা ভ্রান্তিবশে বৃথায় মনন,
নাহি তথা রিপুবশে বৃথায় যতন,
নাহি শ্রমলেশ, নাহি অলস।
ক্ষুধা তৃষ্ণা তন্দ্রা নিদ্রা শরীরে না রয়,
নারী তথা প্রণয়িনী বিলাসিনী নয়,
দেবের কৃপায় দিব্য জ্ঞানের উদয়,
দিব্য নেত্রে নিরখে দিক্ দশ ||”
১৩
“জগতে জগতে দেখে পরামাণুরাশি
মিলিছে ভাঙ্গিছে পুনঃ ঘুরিতেছে আসি,
লক্ষ লক্ষ বিশ্ব গড়ি ফেলিছে বিনাশি,
অচিন্ত্য অনন্ত কালতরঙ্গে।
দেখে লক্ষ কোটী ভানু অনন্ত গগনে,
বেড়ি তাহে কোটী কোটী ফিরে গ্রহগণে,
অনন্ত বর্ত্তন রব শুনেছি শ্রবণে,
মাতিছে চিত্ত সে গীতের সঙ্গে ||
১৪
“দেখে কর্ম্মক্ষেত্রে নয় কত দলে দলে,
নিয়মের জালে বাঁধা ঘুরিছে সকলে,
ভ্রমে পিপীলিকা যেন নেমীর মণ্ডলে,
নির্দ্দিষ্ট দূরতা লঙ্ঘিতে নারে।
ক্ষণকাল তবে সবে ভবে দেখা দিয়া,
জলে যেন জলবিম্ব যেতেছে মিশিয়া,
পুণ্যবলে পুণ্যধামে মিলিছে আসিয়া,
পুণ্যই সত্য অসত্য সংসার ||
১৫
“তাই বলি কন্যে, ছাড়ি দেহ মায়া,
ত্যজ বৃথা ক্ষোভ ; ত্যজ পতিকায়া,
ধর্ম্ম আচরণে হও তার জায়া,
গিয়া পুণ্যধাম।
গৃহে যাও ত্যজি কানন বিশাল
থাক যত দিন পরশে কাল,
কালের পরশে মিটিবে জঞ্জাল,
সিদ্ধ হবে কাম ||”
১৬
শুনি যমবাণী জোড় করি পাণি,
ছাড়ি দিয়া শবে, তুলি মুখখানি
ডাকিছে সাবিত্রী ;- কোথায় না জানি,
কোথা ওহে কাল।
দেখা দিয়া রাখ এ দাসীর প্রাণ,
কোথায় গেলে পাব কালের সন্ধান,
পরশিয়ে কর এ সঙ্কটে ত্রাণ,
মিটাও জঞ্জাল ||
১৭
“স্বামীপদ যদি সেবে থাকি আমি,
কায় মনে যদি পূজে থাকি স্বামী,
যদি থাকে বিশ্বে কেহ অন্তর্য্যামী,
রাখ মোর কথা।
সতীত্বে যদ্যপি থাকে পুণ্যফল,
সতীত্বে যদ্যপি থাকে কোন বল,
পরশি আমারে, দিয়ে পদে স্থল,
জুড়াও এ ব্যথা ||”
১৮
নিয়মের রথ ঘোষিল ভীষণ,
আসি প্রবেশিল সে ভীম কানন,
পরশিল কাল সতীত্ব রতন,
সাবিত্রী সুন্দরী।
মহাগদা তবে চমকে তিমিরে,
শবপদরেণু তুলি লয়ে শিরে,
ত্যজে প্রাণ সতী অতি ধীরে ধীরে
পতি কোলে করি ||
১৯
বরষিল পুষ্প অমরের দলে,
সুগন্ধি পবন বহিল ভূতলে,
তুলিল কৃতান্ত শরীরিযুগলে,
বিচিত্র বিমানে।
জনমিল তথা দিব্য তরুবর,
সুগন্ধি কুসুমে শোভে নিরন্তর,
বেড়িল তাহাতে লতা মনোহর,
সে বিজন স্থানে ||
অধঃপতন সঙ্গীত
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১
বাগানে যাবি রে ভাই? চল সবে মিলে যাই,
যথা হর্ম্ম্য সুশোভন, সরোবরতীরে।
যথা ফুটে পাঁতি পাঁতি, গোলাব মল্লিকা জাতি,
বিগ্নোনিয়া লতা দোলে মৃদুল সমীরে ||
নারিকেল বৃক্ষরাজি, চাঁদের কিরণে সাজি,
নাচিছে দোলায় মাথা ঠমকে ঠমকে।
চন্দ্রকরলেখা তাহে, বিজলি চমকে ||
২
চল যথা কুঞ্জবনে, নাচিবে নাগরী গণে,
রাঙ্গা সাজ পেসোয়াজ, পরশিবে অঙ্গে।
তম্বুরা তবলা চাটি, আবেশে কাঁপিবে মাটি,
সারঙ্গ তরঙ্গ তুলি, সুর দিবে সঙ্গে ||
খিনি খিনি খিনি খিনি,
ঝিনিক ঝিনিক ঝিনি
তাধ্রিম্ তাধ্রিম্ তেরে গাও না বাজনা!
চমকে চাহনি চারু, ঝলকে গহনা ||
৩
ঘরে আছে পদ্মমুখী কভু না করিল সুখী,
শুধু ভাল বাসা নিয়ে, কি হবে সংসারে।
নাহি জানে নৃত্যগীত, ইয়ার্কিতে নাহি চিত,
একা বসি ভাল বাসা ভাল লাগে কারে?
গৃহকর্ম্মে রাখে মন, হিত ভাবে অনুক্ষণ,
সে বিনা দুঃখের দিনে অন্য গতি নাই!
এ হেন সুখের দিনে, তারে নাহি চাই ||
৪
আছে ধন গৃহপূর্ণ, যৌবন যাইবে তূর্ণ,
যদি না ভুঞ্জিনু সুখ, কি কাজ জীবনে?
ঠুসে মদ্য লও সাতে, যেন না ফুরায় রাতে,
সুখের নিশান গাঢ় প্রমোদভবনে।
খাদ্য লও বাছা বাছা, দাড়ি দেখে লও চাচা,
চপ্ সুপ কারি কোর্ম্মা, করিবে বিচিত্র।
বাঙ্গালির দেহ রত্ন, ইহাতে করিও যত্ন,
সহস্র পাদুকা স্পর্শে, হয়েছে পবিত্র।
পেটে খায়, পিঠে সয়, আমার চরিত্র ||
৫
বন্দে মাতা সুরধুনি, কাগজে মহিমা শুনি,
বোতলবাহিনি পুণ্যে একশ নন্দিনি!
করি ঢক ঢক নাদ, পূরাও ভকতসাধ,
লোহিত বরণি বামা, তারেতে বন্দিনি!
প্রণমামি মহানীরে, ছিপির কিরীটি শিরে,
উঠ শিরে ধীরে ধীরে যকৃৎজননি!
তোমার কৃপার জন্য, যেই পড়ে সেই ধন্য
শয্যায় পতিত রাখ, পতিতপাবনি!
বাক্স বাহনে চল, ডজন ডজনি ||
৬
কি ছার সংসারে আছি, বিষয় অরণ্যে মাছি,
মিছা করি ভন্ভন্ চাকরি কাঁটালে।
মারে জুতা সই সুখে, লম্বা কথা বলি মুখে,
উচ্চ করি ঘুষ তুলি দেখিলে কাঙ্গালে ||
শিখিয়াছি লেখা পড়া, ঠাণ্ডা দেখে হই কড়া,
কথা কই চড়া চড়া, ভিখারি ফকিরে।
দেখ ভাই রোখ কত, বাঙ্গালি শরীরে!
৭
পূর পাত্র মদ্য ঢালি, দাও সবে করতালি,
কেন তুমি দাও গালি, কি দোষ আমার?
দেশের মঙ্গল চাও? কিসে তার ত্রুটি পাও?
লেক্চারে কাগজে বলি, কর দেশোদ্ধার ||
ইংরেজের নিন্দা করি, আইনের দোষ ধরি,
সম্বাদ পত্রিকা পড়ি, লিখি কভু তায়।
আর কি করিব বল স্বদেশের দায়?
৮
করেছি ডিউটির কাজ, বাজা ভাই পাখোয়াজ,
কামিনি, গোলাপি সাজ, ভাসি আজ রঙ্গে।
গেলাস পূরে দে মদে, দে দে দে আরো আরো দে,
দে দে এরে দে ওরে দে, ছড়ি দে সারঙ্গে।
কোথায় ফুলের মালা,আইস্ দে না? ভাল জ্বালা,
“বংশী বাজায় চিকণ কালা?” সুর দাও সঙ্গে।
ইন্দ্র স্বর্গে খায় সুধা, স্বর্গ ছাড়া কি বসুধা?
কত স্বর্গ বাঙ্গালায় মদের তরঙ্গে।
টলমল বসুন্ধরা ভবানী ভ্রূভঙ্গে ||
৯
যে ভাবে দেহের হিত, না বুঝি তাহার চিত,
আত্মহিত ছেড়ে কেবা, পরহিতে চলে?
না জানি দেশ বা কার? দেশে কার উপকার?
আমার কি লাভ বল, দেশ ভাল হলে?
আপনার হিত করি, এত শক্তি নাহি ধরি,
দেশহিত করিব কি, একা ক্ষুদ্র প্রাণী।
ঢাল মদ! তামাক দে! লাও ব্রাণ্ডি পানি ||
১০
মনুষ্যত্ব? কাকে বলে? স্পিচ দিই টোনহলে,
লোকে আসে দলে দলে, শুনে পায় প্রীত।
নাটক নবেল কত, লিখিয়াছে শত শত,
এ কি নয় মনুষ্যত্ব? নয় দেশহিত?
ইংরেজি বাঙ্গালা ফেঁদে, পলিটিক্স লিখি কেঁদে,
পদ্য লিখি নানা ছাঁদে, বেচি সস্তা দরে।
অশিষ্টে অথবা শিষ্টে, গালি দিই অষ্টে পৃষ্ঠে,
তবু বল দেশহিত কিছু নাহি করে?
নিপাত যাউক দেশ! দেখি বসে ঘরে ||
১১
হাঁ! চামেলি ফুলিচম্পা! মধুর অধর কম্পা!
হাম্বীর কেদার ছায়ানট সুমধুর!
হুক্কা না দুরস্ত বোলে? শের মে ফুল না ডোলে!
পিয়ালা ভর দে মুঝে! রঙ্ ভরপুর!
সুপ্ চপ কটলেট, আন বাবা প্লেট প্লেট,
কুক্ বেটা ফাষ্টরেট, যত পার খাও!
মাথামুণ্ড পেটে দিয়ে, পড় বাপু জমি নিয়ে,
জনমি বাঙ্গালিকুলে, সুখ কর্যেও যাও।
পতিতপাবনি সুরে, পতিতে তরাও ||
১২
যাব ভাই অধঃপাতে, কে যাইবি আয় সাতে,
কি কাজ বাঙ্গালি নাম, রেখে ভূমণ্ডলে?
লেখাপড়া ভস্ম ছাই, কে কবে শিখিছে ভাই
লইয়া বাঙ্গালি দেহ, এই বঙ্গস্থলে?
হংসপুচ্ছ লয়ে করে, কেরাণির কাজ করে,
মুন্সেফ চাপরাশি আর ডিপুটী পিয়াদা।
অথবা স্বাধীন হয়ে, ওকালতি পাশ লয়ে,
খোশামুদি জুয়াচুরি, শিখিছে জিয়াদা!
সার কথা বলি ভাই, বাঙ্গালিতে কাজ নাই,
কি কাজ সাধিব মোরা, এ সংসারে থাকি,
মনোবৃত্তি আছে যাহা, ইন্দ্রিয় সাগরে তাহা
বিসর্জ্জন করিয়াছি, কিবা আছে বাকি?
কেহ দেহভার বয়ে, যমে দাও ফাঁকি?
১৩
ধর তবে গ্লাস আঁটি, জ্বলন্ত বিষের বাটি
শুন তবলার চাঁটি, বাজে খন্ খন্।
নাচে বিবি নানা ছন্দ, সুন্দর খামিরা গন্ধ,
গম্ভীর জীমূতমন্দ্র হুঁকার গর্জ্জন ||
সেজে এসো সবে ভাই, চল অধঃপাতে যাই,
অধম বাঙ্গালি হতে, হবে কোন কাজ?
ধরিতে মনুষ্যদেহ, নাহি করে লাজ?
১৪
মর্কটের অবতার, রূপগুণ সব তার
বাঙ্গালির অধিকার, বাঙ্গালি ভূষণ!
হা ধরণি, কোন্ পাপে, কোন্ বিধাতার শাপে
হেন পুত্রগণ গর্ব্ভে, করিলে ধারণ?
বঙ্গদেশ ডুবাবারে, মেঘে কিম্বা পারাবারে,
ছিল না কি জলরাশি? কে শোষিল নীরে?
আপনা ধ্বংসিতে রাগে কতই শকতি লাগে?
নাহি কি শকতি তত বাঙ্গালি শরীরে?
কেন আর জ্বলে আলো বঙ্গের মন্দিরে?
১৫
মরিবে না? এসো তবে, উন্নতি সাধিয়া সবে,
লভি নাম পৃথিবীতে, পিতৃ সমতুল!
ছাড়ি দেহ খেলা ধূলা, ভাঙ বাদ্যভাণ্ডগুলা
মারি খেদাইয়া দাও, নর্ত্তকীর কুল।
মারিয়া লাঠির বাড়ি, বোতল ভাঙ্গহ পাড়ি,
বাগান ভাঙ্গিয়া ফেল পুকুরের তলে।
সুখ নামে দিয়ে ছাই, দুঃখ সার কর ভাই,
কভু না মুছিবে কেহ, নয়নের জলে,
যত দিন বাঙ্গালিকে লোকে ছি ছি বলে ||