কবি ফরহাদ মজহার এর একান্ত সাক্ষাৎকার

 সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও সম্পাদক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ



আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নিছিলাম। এরমধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ছিল বোধহয় ফরহাদ ভাইয়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারটা। আমি ভয়াবহ উপভোগ করছিলাম ওই আড্ডাটা। এমনকি ফরহাদ ভাই যখন আমার কাছে জানতে চাইছিলেন, আমি 'আওয়ামী দালাল' নাকি? তখনও! সাক্ষাৎকার নিতে গিয়্যা এইসব তর্কের ঝড় উঠলে আমার ভালোই লাগে। খালি হ্যাঁ-হুম-জ্বি বইল্যা চইল্যা আসা আমার কখনোই পোষায় না। যাই হোক, ফরহাদ ভাইয়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারের ক্ষুদ্র একটা অংশ আবার পোস্ট করলাম। নিজের যেমন এটা বারবার পড়তে ভালো লাগে, মানুষরেও পড়াইতে ভালো লাগে আর কী।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: সাহিত্য জীবন থেকে একটু আপনার রাজনীতি জীবনে আসি।


ফরহাদ মজহার: রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তো ভয় পাই!


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।


ফরহাদ মজহার: বাম রাজনীতি কী?


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আপনি কার্ল মার্কসের অনুসারী ছিলেন। তো সত্তরের দশকের শুরুর দিকে আপনি নকশাল আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি ছিলো সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন।


ফরহাদ মজহার: ঠিক না। কোনোটাই ঠিক না।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আপনার মুখ থেকেই শুনি কোনটা সত্য, কোনটা ঠিক...


ফরহাদ মজহার: রাজনীতির আলোচনা করতে হলে আপনাদেরকে রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে। যেমন, নকশাল কথার অর্থ কী? কথাটাকে তো নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আপনি না করলেও আপনি যখন লিখবেন যারা পড়বে তাদের তো তাই মনে হবে। তাহলে আমার একটা বই লিখতে হবে। রাজনৈতিক বিষয় নিয়া কথা বলতে আমার অসুবিধা নাই। সে আমলে লেফটের তর্কের ক্ষেত্র কী ছিলো? তারা কী নিয়ে তর্ক করতো। তাদের রাজনৈতিক পক্ষ...। ব্রডলি যারা রেডিকেল লোক, সোভিয়েতপন্থি না। রেডিকেল লোক বলতে যারা লেনিনের অনুসারী ছিলো, তাদের বক্তব্য ছিলো এই যে আমাদেরকে পুরো পাকিস্তানব্যাপী একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হবে। যেমন, নকশালরা একাত্তরের যুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলেছে। এটা কে বলছে? এটা তো প্রোপাগান্ডা। তখন গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছিলো সকল র‍্যাডিকেল বাম ধারা – মার্কস, লেনিন ও মাওবাদি ধারার কর্মসূচী। লক্ষ্য ছিল পুরো পাকিস্তানব্যাপী একটা গণতান্ত্রিক লড়াই করতে হবে, না করলে বিচ্ছিন্নবাদী অদূরদর্শী চিন্তা দ্বারা যদি পূর্ব পাকিস্তান আলাদা করে ফেলার মতো কোনো কিছু করা হয়, আলাদা হয়ে যায়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান ফিউডাল সমাজ ও ফিউডাল রাষ্ট্র হিসাবে থেকে যাবে। সামন্ত শ্রেণিকে উৎখাত করা যাবে না। দ্যাট উইল বি ডেঞ্জারাস। আমরা বাম, যারা মার্কসের অনুসারী, আমরা জাতীবাদী না। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের লোক না আমরা। কখনো ছিলাম না, এখনো না। আমি জাতিবাদ বিরোধী লোক। আমি সেটা সবসময়ই বলে আসছি, এখনও বলতে পারি। এখনও বলি, অসুবিধা নাই।


ফলে র‍্যাডীকাল বাম বা তথাকথিত নকশালদের বক্তব্য ছিলো পুরো পাকিস্তানব্যাপী একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হবে। এই গণতান্ত্রিক বিপ্লব করবার ক্ষেত্রে একটা তাত্ত্বিক তর্ক চলছিলো তখন, রেহমান সোবহানদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশে দুই অর্থনীতি চলে। আমরা বলছি যে রহমান সোবহানরা ভুল। এটা পেটিবুর্জোয়ার বর্ণবাদি ও সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা। পেটিবুর্জোয়া মনে করে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা বাঙালি বনাম পাঞ্জাবির সমস্যা, বাঙালি বিহারির সমস্যা, ইত্যাদি। অথচ বাংলাদেশে যে শোষণ সেটা একটি সামন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্যাপিটালিস্ট বা পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবহৃত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সম্প্রসারণের জন্য। পাকিস্তানে সামন্ত ও আধা সামন্ত শ্রেণি ক্ষমতায়। ফলে লড়াই গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে সামন্ত শ্রেণির। পাঞ্জাবির সঙ্গে বাংগালির কিম্বা বাংলাভাষীদের সঙ্গে উর্দুভাষীদের না।


ভুলে যাবেন না পাকিস্তান পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করেছিলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন পাকিস্তানের ডেভেলপমেন্ট পলিসি নির্ণয় করেছে। মার্কিন বিশবিদ্যালয়ের প্রফেসররা ঠিক করে দিচ্ছে সেই পলিসি। সেখানে মেইন পলিসি হচ্ছে ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট ঘটানো। যখন একটা দেশে ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট ঘটে তার চরিত্র হচ্ছে কৃষিকে শোষণ করা এবং সেই শোষণের অর্থ দিয়ে শিল্পায়ন করা। এখানে কৃষির সবচেয়ে লাভজনক ক্ষেত্র কী ছিলো? সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বভাবতই ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়ন নীতির কারণে এক্সপ্লয়েট করা হয় পূর্ব পাকিস্তানকে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশকে শোষণ করে ইসলামাবাদকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড করার নীতি সামন্ত শ্রেণি গ্রহণ করেছিল, তার সহযোগী ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তাই সারা পাকিস্তানব্যাপী গণতান্ত্রিক বিপ্লব মানে একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। র্যা ডিকেল বা তথাকথিত ‘নকশাল’ বলতে যাদের নিন্দাসূচক ভাবে ইতিহাসে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয় – এটাই কম্বেশী তাদের প্রত্যকের প্রধান বক্তব্য।


আমরা বলেছি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ একটি সামন্ত বা আধা সামন্তবাদী রাষ্ট্রে ক্যাপিটালিজমের বিশেষ চরিত্রের লক্ষণ। সাম্রাজ্যবাদের কারণে দেশের অভ্যন্তরে বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবার সমস্যা। ইট হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ রেসিজম। রেহমান সোবহানদের‘টু ইকনমি’ মূলত পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশার বর্ণবাদি বয়ান। পাঞ্জাবীরা বাঙালিদের মারতে চায় পাঞ্জাবীরা বাঙালি মারতে উন্মুখ, এটা ট্রু না। পাঞ্জাবিদের মধ্যেও গরিব, শ্রমিক ও সর্বহারা আছে। এটা হচ্ছে প্রথম বক্তব্য।


দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে যদি পূর্ব পাকিস্থান বিচ্ছিন্ন হয়, আমরা এটাকে অবশ্যই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বলেছি, সেই বিচ্ছিন্নতায় বাংলাদেশ ভারতের কলোনি হবে। এখন কী হয়েছে? বাংলাদেশ তো ভারতের কলোনি এখন। এটাই তো আমরা বলেছি সেভেন্টিতে। অতএব জাতিবাদী আবেগে বিভ্রান্ত না হয়ে সারা পাকিস্তানব্যাপী গণতান্ত্রিক বিপ্লব করাটা প্রথম কাজ গণ্য করেছি আমরা।


ঠিক আছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কারন আমাদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও ভূট্টো যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। ভারত যুক্ত হোল তার নিজের স্বার্থে। সেভেন্টি ওয়ানে যুদ্ধ করলাম। কিন্তু যুদ্ধ করার পর আমরা, আওয়ামি লীগ ওয়ালারা, ডেমোক্রেটিক রেভোলিউশন করতে দিলাম না। যারা পাকিস্তানে গিয়েছিলো পাকিস্তানের সংবিধান লেখবার জন্য, ড. কামাল হোসেনের মতো লোকজন, তারা এসে বললো তারাই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সংবিধান লিখবে। কিন্তু ওরা তো নির্বাচিত হয়েছিলো পাকিস্তান সংসদে, লিগাল ফ্রেইম ওয়ার্ক অর্ডারে বা এল এফ ও’তে স্বাক্ষর দিয়ে। সেই নির্বাচন পাকিস্তানী শাসকরাই করতে দিয়েছে। এল এফ ও যখন ওরা সাইন করে তখন তো ওরা কথা দিয়ে এসেছিলো ইয়াহিয়া খানের সাথে যে তারা পাকিস্তান ভাঙবে না। তো পাকিস্তান ভেঙে তারা তো রাষ্ট্রদ্রোহী পাকিস্তানের চোখে। তারা এসে তাদের একটা দলীয় ফ্যাসিস্ট আদর্শের সংবিধান বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিল।


অথচ, স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ, যারা ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ‘প্রোক্ল্যামেশন অফ দি ইন্ডিপেনডেন্স’ বা স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বলে দিয়েছে তারা কী চায়: তারা বলেছে তারা সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়। কিন্তু ফ্যাসিস্টরা দিল্লীর সহযোগিতায় সেটা করতে দিল না। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বদলে আপনি কী ঢুকালেন? ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ইত্যাদি। আপনি ফ্যাসিজম এনে ঢুকালেন। ঢুকিয়ে বাংলাদেশকে আপনি এখন বর্তমান জায়গায় নিয়ে এসেছেন।


তো আমাকে কী করে বুঝবেন? যদি ইতিহাস, বিশেষত বাংলাদেশের বিপ্লবী বাম ধারার পুরো হিস্ট্রি যদি কারো অজানা থাকে -- যেমন, কেন এল এফ ও করলো ইয়াহিয়া খান? করে কেন আওয়ামি লীগকে জিততে দিলো। এটাও আপনার খোঁজ করতে হবে।


এখন দেখুন, শেখ মুজিব ছিলো অ্যামেরিকানদের বন্ধু, তিনি সিয়াটো সেন্টো সমর্থন করেছেন এবং সমর্থন করতেন। তাতে মুজিবের কোন দোষ হয়ে যায় নাই, কারন তিনি তো হো চি মিন না। আমেরিকানরা চেয়েছে চীন এবং ভারতের বিপরীতে একটা শক্তি তারা এখানে তৈরি করবে এবং সেটা তারা তৈরি করবে শেখ মুজিবকে দিয়ে। ভারত তখন কিন্তু নন অ্যালাইনমেন্টে শিবিরে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন এল এফ ও এর অধীনে ইয়াহিয়া খানের নির্বাচন করলে্ন। তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক কেউ না। তাদেরই লোক। গোলটেবিল বৈঠকে তাদের কথাবার্তা হয়েছে। হওয়ার পরে ইলেকশনটা হলো। স্বভাবতই বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেয়েছে, মওলানা ভাসানীও চেয়েছিলেন, কারণ জনগণ চায়। আমেরিকানরাও চেয়েছে, অনেকে চেয়েছে।


চাইলে কী সুবিধা হতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, একটা বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে? শেখ মুজিব কুড বিকাম অ্যা গ্লোবাল লিডার। একটা আন্তর্জাতিক নেতা হতো। স্বায়ত্ব শাসিত পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের দিল্লীর দালালরা কী করলো? তারা শেখ মুজিবরকে আন্তর্জাতিক নেতা হতে দিলো না। কারন তাদের ইন্দিরা গান্ধী আছে। শেখ মুজিবর তো পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। তাহলে পাকিস্তান ভাঙলোটা কে? বা কারা? কী জন্য? এদেরকে চিহ্নিত করা ছিল তখনকার কাজ। আমাদের লড়াই তো ছিলো বড় ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এদেরই বিরুদ্ধে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত। আমরা, র‍্যাডিকাল বাম ধারা বা তথাকথিত নকশালরা, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান চাই নি। ভারতের উপনিবেশ হতে চাই নি, বরং ভারতীয় উপনিবেশ কাশ্মির ও উত্তর পূর্ব ভারতের জনগণের মুক্তি এবং উপমহাদেশ ব্যাপী গণতান্ত্রিক বিপ্লব চেয়েছিলাম, ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক হিন্দু ও মুসলমানের রূপান্তর চেয়েছিলাম। শেষ মেষ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বাংলাদেশ হয়ে ভারতীয় উপনিবেশ হয়েছে। কিছুই তো বদলায়নি।


তো কী করলেন আপনি শেখ মুজিবুর রহমানকে? আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বানানো হোল একটা মাইনর মফস্বলের লিডার। আন্তর্জাতিক রাজনীতির তাৎপর্যের দিক থেকে হু ইজ হি? হি ইজ নোবডি। আপনি তাকে ‘বঙ্গবন্ধু' পর্যন্ত করলেন। কিন্তু আমরা তো ‘বঙ্গ’ না। আমরা তো খণ্ডিত বাংলা। টুকরা বাংলা। মুসলমানদের বাংলা। বঙ্গ তো বিশাল ব্যাপার। সেটা সৈয়দ সুলতানের বাংলা। কিম্বা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের স্বাধীন বঙ্গ। বঙ্গ এই প্রথমবার একাত্তরে নতুন স্বাধীন হয় নাই। সে স্বাধীন ছিল, কিন্তু সে স্বাধীনতা হারিয়েছে ইংরেজ আমলে। ইট’স অ্যান এ্যামপায়ার। সে এ্যামপায়ার হওয়ার যোগ্যতা তো আমাদের ছিলো। যারা ভাঙলো, তাদের তো ইতিহাস দিয়ে আপনাকে চিনে নিতে হবে এবং চিনিয়ে দিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এটা তো আমাদের বুঝতে হবে, কেন এটা ভাঙলো!


তাহলে তখনকার খাঁটি বিপ্লবীদের, যাদের ‘নকশাল’ বলেন আর যাই বলেন, কমবেশী এটাই ছিল বাংলাদেশী নকশালের অবস্থান। তাদের প্রধান রাজনৈতিক ধারা। তাদের মধ্যেও ভেদ ছিল, দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু আপনি এই ঐতিহাসিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে না পারলে, বাকি খুচরা জিনিস বুঝে তো লাভ নাই। যেমন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দুই কুকুরের লড়াই বলেছে; নকশাল মানে তারা গলা কাটে, নকশাল মানে তারা এই করে সেই করে...। এগুলা হচ্ছে প্রোপ্যাগান্ডা। আপনি এখানে এখন ইসলামিক ফোবিয়া যেমন, মোল্লারা এটা করে, ওটা করে। এটাও একই অর্থে সেই রকম প্রোপাগান্ডা। নকশালীদের বূত বানাতেই হবে, নইলে দিল্লীর গোলামি করবেন কিভাবে?


এখন আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের এই পলিটিকসটা ফেইল করেছে। এই বৃহৎ রাজনৈতিক স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে। হিস্ট্রিতে তো ভিলেন এবং হিরোর সীমারেখা খুব ক্ষীণ। আপনি যখন পরাজিত, তখন আপনি পরাজিত। ফলে আপনাকে সেই পরাজয়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার ফিরে আসতে হচ্ছে। আপনি বুঝতে পারছেন আপনার স্বপ্ন মিথ্যা না। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করবার জন্য যে কাজ করা দরকার ছিল, আপনি সেটা করেন নি। ভেবেছেন সশস্ত্র সংগ্রাম দিয়ে বিশ্ব জয় করে নেবেন। চিন্তা ও পর্যালোচনাকে গুরুত্ব দেন নি। হেরে গিয়েছেন। তাই চিন্তা ও পর্যালোচনার রাজ্যে অধিপতি হয়ে আপনাকে আবার ফিরে আসতে হবে। তো এখন এই হচ্ছে পরিস্থিতি।


ফলে আমাকে আমার রাজনীতি সম্পর্কে বললে এভাবে বলতে হচ্ছে। না বললে আপনি ভালো বুঝবেন না। আপনাকে বুঝতে হবে হুইচ ইজ ট্রু। আর হ্যাঁ, আমি আলবৎ মার্কসের অনুসারী, মার্কসের নিষ্ঠাবান ছাত্র। তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু মার্কস পয়গম্বর না। তার কাছে এসে জ্ঞানচর্চা থেমে যায় নি।


আর আমি সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি ছিলাম শুরুর দিকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে। যেখান থেকে সর্বহারা পার্টি হয়েছে। পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিলো। হুইচ ইজ ট্রু। এদের বহু লিফলেটে যে তাত্ত্বিক কথাবার্তা সেগুলো লিখবার ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা আছে। কিম্বা সেইসব আমার লেখা বা চিন্তা থেকে সারার্থ করা। পরবর্তীকালে সর্বহারা পার্টি যে ধারায় রাজনৈতিক সংগ্রামকে নিয়ে যায়, মানে  গণবিচ্ছিন্নভাবে হত্যার যে রাজনীতি, সেটা আমি কখনোই সাপোর্ট করিনি। আমি গণবিচ্ছিন্ন গোপন সামরিক লাইনে বিশ্বাস করি না। রাজনীতি একান্তই গণতৎপরতা যেখানে চিন্তা ও চিন্তার প্রচার প্রধান ভূমিকা রাখে। জনগণের সংগঠিত ও সামষ্টিক ইচ্ছার অভিপ্রকাশ হিশাবেই গণঅভ্যূত্থান ঘটে। আমি সারা জীবন তারই বন্দনা করে এসেছি।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আপনি তো তারপরে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে আসলেন। এসে মাওবাদী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার একটা চেষ্টা করেছিলেন। সেটা কি খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে?


ফরহাদ মজহার: হ্যাঁ, এখনও 'একত্র' করছি। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে একত্র করা। যদিও ‘মাওবাদী’ বলতে কিছু নাই বাংলাদেশে এখন। কিন্তু মাও জে দং ইতিহাসে মজুদ রয়ে গিয়েছেন। মাওবাদের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক কী? সেটা হচ্ছে ‘মাস লাইন’ বা গণলাইন যা জনগণ থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন হতে রাজি না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেটি বুর্জোয়া যে শ্রেণি নিজেদের বামপন্থি বলে এবং তত্ত্ববাগীশ হয়ে জনগণের কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে, নিজের মনগড়া তত্ত্ব নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে, সেই রাজনীতি আমি করি না। মতাদর্শিক ভাবে যেমন দেখুন, তাদের ইসলাম আতঙ্ক, ইসলাম বিদ্বেষ কিংবা ইসলাম নির্মূল করার রাজনীতি এগুলা সবই তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। মাওবাদীরা ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের ক্রিটিক অ্যাকসেপ্ট করে। সেটা নাস্তিক্যবাদ না। ‘মোকাবিলা’ বইতে আমি যা ব্যাখ্যা করেছি। কিন্তু কৌশলগতভাবেও তারা ধর্মের প্রশ্ন মীমাংসার ক্ষেত্রে পেটি বুর্জোয়াদের সঙ্গে এগ্রি করে না। ধর্ম বিদ্বেষ আধুনিক যুগের অসুখ।


আমি সহজ করে বুঝিয়ে বলি। সবচেয়ে বড় ক্রিশ্চিয়ান হচ্ছে রুশরা। আপনি কি লেনিনের কোন লেখায় খ্রিস্ট ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো লেখা পাবেন? এটা অবশ্যই পলিটিকাল কারণে। আপনি একজন শ্রমিক। আপনি একটা ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হতেই পারেন। আর আপনি যদি জালিমের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যান তাহলে আপনার অভিজ্ঞতাই আপনাকে ধর্মের পর্যালোচনার সঠিক পথ বাতলিয়ে দেবে। কিন্তু বাংলাদেশে পেটি বুর্জোয়া প্রথমেই জনগণকে শত্রু পরিগণনা করে। কেন? কারণ তারা মুসলমান। তারা আর এস এস বা নরেন্দ্র মোদীর উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি সক্রিয় ভাবে করে।


আরে! ইসলামের নিশ্চয়ই ভালো কিছু আছে নইলে বর্ণাশ্রম জাতপাত থুয়ে আমাদের পূর্বপুরুষ এই ধর্ম গ্রহণ করলো কেন? কিন্তু ধর্ম বিদ্বেষের কারণে তথাকথিত বাম পেটিবুর্জায়া ক্লাউন হয়ে যাচ্ছে, খামাখা হেফাজতের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া যাইতেছে, মোল্লাদের টুপিকোর্তা কিম্বা মেয়েদের হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতেছে। তো পিপল আপনাকে একসেপ্ট কেন করবে? তারা তো ধরেই নিবে আপনি তাদের এনিমি। আপনি জনগণের সঙ্গে থেকে লড়ুন। জনগণ বুঝে যাবে কে ধর্মকে শোষণের জন্য আর কে গণমুক্তির জন্য ধর্মের তফসির করছে? তারা মওলানা ভাসানী আর শফি হুজুরকে একই নিক্তি দিয়ে মাপবে না। এটাই গণলাইন। গণ লাইনের রাজনীতি।


অতএব মাওয়ের 'গণলাইন', এটা তো আমি অ্যাকসেপ্ট করি। আমি যখন রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। আমার তো ফিলোসফার একটা রূপ আছে, আমার একটা কবি রূপ আছে। পলিটিক্যালি আমি যখন রোল প্লে করি তখন তো আমি ডেফিনিটলি মাও এর কাছে থেকে, চীনা বিপ্লব থেকে, রুশ বিপ্লব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই আমি কাজ করি।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ:  এখনো কি আপনার সেই চেষ্টা চালু আছে কিনা এটাই জানতে চাচ্ছিলাম।


ফরহাদ মজহার: এটা তো আমার স্বভাবের মধ্যেই বর্তমান। শেষ নিঃশ্বাস অবধি থাকবে। না, আমি তো ডেফিনিটলি মাসলাইনকে কবুল করে কাজ করি। এখন দেখুন, আমি বারবার বলি যে বাংলাদেশে বিভাজিত রাজনীতির আমি বিপক্ষে। গণলাইন এই ক্ষেত্রে আস্তিক-নাস্তিক, ধর্ম প্রাণ ধর্ম ভীরু সকলকেই ফ্যাসিস্ট সরকার ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করবার রাজনীতি। এটাই আমাদের এখনকার বাস্তবতা। এর মীমাংসা সবার আগে করতে হবে। জনগণকে আপনি ধর্ম বনাম ধর্ম বিরোধিতা, বাঙালি জাতি বনাম জাতি বিদ্বেষ, যে কোনোভাবে আপনি বিভাজন করেন না কেন, আমি তো তার বিরোধী। মাস পিপলকে, জনগণকে তো আমাদের একটা জায়গায় একত্র করতে হবে। আনতে হলে তো আমাকে নিঃসন্দেহে একটা নীতি এবং কৌশল কার্যকর করতে হবে। বলতে পারেন কাজটা কঠিন। কেন কঠিন?


প্রথমত, দেখুন, আগে আপনি জনগণকে উদাহরণ দিতে পারতেন সোভিয়েত ইউনিয়ন আছে, চীন আছে আপনার সামনে, কিন্তু সেই উদাহরণ তো আর নাই। আপনি কোন মডেল দেখিয়ে জনগণকে কাছে ভিড়াতে পারবেন না। সেটা ভাল। খুবই ভাল। আপনাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে আপনার আদর্শ, আপনার চিন্তা, আপনার ফিলোসফিকাল প্রশ্নগুলো, জিজ্ঞাসাগুলোকে নতুনভাবে সাজাতে হচ্ছে, নতুনভাবে উত্তর দিতে হচ্ছে। যেটা আমি আমার লেখাতে ক্ষুদ্রভাবে চেষ্টা করি। আমাদের দার্শনিক জিজ্ঞাসাগুলো বর্তমানকালে কী আমাদের কাছে, সেটা যথাসাধ্য বোঝাবার চেষ্টা করি।


দ্বিতীয়ত, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের সময়ে পুরানা জাতিবাদ ইমপসিবল, পুঁজির তৈরি বিশ্বে তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কা্রণে নানান কিসিমের আত্মপরিচয়ের রাজনীতি দানা বাঁধছে। নারীবাদ, সমাকামিদের লড়াই, রাষ্ট্রহীন শরণার্থিদের প্রশ্ন, পুঁজি ও ক্রিয়েটিভিটির দ্বন্দ। ইত্যাদি; কারণ মানুষ ক্রিয়েটিভ কিছু করলেই সেটা তৎক্ষণাৎ পণ্য হয়ে ওঠে, শ্রেণি রাজনীতির পুরানা তর্ক বিমূর্ত ও অস্পষ্ট হয়ে আছে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। তালিকা বিশাল। ফলে রাজনীতি বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা এখন প্রাচীন বা তামাদি হয়ে গিয়েছে, বাস্তবতার সম্পূর্ণ বদল ঘটেছে। এটা আগামী দিনে বাংলাদেশে আরও ক্রমশ স্পষ্ট হবে। তাই আমি মনে করি সেদিক থেকে আমার কিছুটা অবদান থাকতে পারে। কারণ বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের রাজনীতিতে ক্ষুদ্র হলেও আমার একটা উপস্থিতি আছে, আমাকে এড়িয়ে, টপকে কেউই যেতে পারছেন না। যতই বলেন না কেন! আমরা বলতাম,বাংলাদেশে কোনো বিপ্লব হলে আমাকে মোহাম্মদপুরে রেখে কেউ কিছু করতে পারবেন না। হা হা হা।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: এই প্রসঙ্গে আরেকটু টানি, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আনসার বিদ্রোহের পক্ষে লিখে আপনি কারাবরণ করেছিলেন। এমন কী বিএনপির ডানঘেঁষা রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন আপনি। নিজের কলামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে জামাত ও আওয়ামী লীগের আঁতাত কটাক্ষ করেছেন আপনি। কিন্তু অনেকেই বলে, আপনি ইসলাম বিপ্লব সমর্থন করেন?


ফরহাদ মজহার: অনেকের কথা বাদ দিন। আপনি কী মনে করেন সেটা বলুন। 'অনেকে বলে' ধরনের কথা  খুব খারাপ। এভাবে জিজ্ঞাসা করলে  আমি বলবো না।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আচ্ছা, তাহলে আমি ডিরেক্টলি জিগ্যেস করি, আপনি কি ইসলাম বিপ্লবের কোনো স্বপ্ন দেখেন?


ফরহাদ মজহার: আমি অবশ্যই বর্তমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিপরীতে গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিক রূপান্তরের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেটা ইসলামি হবে, নাকি বাঙালি হবে, নাকি অন্য কিছু সেটা আমাদের ইতিহাস ও বাস্তব অবস্থাই নির্ণয় করে দেবে। ইরানের বিপ্লব ইরানের বাস্তবতা অনুযায়ীই হয়েছে। আমাদের বাস্তবতা অনুযায়ী আমাদের বিপ্লবও হবে। কসম বিপ্লবের, আমি এই স্বপ্নটাই দেখি।


কিন্তু আপনার প্রশ্নের অর্থটা কী? আপনি কি ফ্যাসিজমের পক্ষের লোক। আপনি কি আওয়ামী লীগের দালাল, আপনি কি ইসলাম বিদ্বেষী? যদি ইসলামি বিপ্লবও হয়, অসুবিধা কি? ইরানের বিপ্লব ফরাসি বিপ্লবের মতোই মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: না, মোটেও না।


ফরহাদ মজহার: তাহলে কেন আপনি ইসলাম নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন। কই? খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে তো আপনি চিন্তিত না, অথচ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত খ্রিস্টিয় জগতেই আপনি বাস করছেন। আপনার চিন্তা, চলাফেরা পোশাক আশাক সবই। ধর্মের প্রশ্ন তো পিপল বা জনগণ ঠিক করবে। যাতে আমরা বিপ্লবী ভাষায় বলতে পারি, ‘উই দ্য পিপল’ বা ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ...’, ইত্যাদি। কিন্তু আপনি ইসলাম নিয়ে এতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? মানে আমরা শুধু ইসলাম নিয়ে এতো উৎকন্ঠিত কেন? ইসলাম সম্পর্কে আমার ক্রিটিক, আমার লেখা পড়েন, আপনি। নিজেকে বুঝবেন।


প্রথম কথা হচ্ছে আপনি রেসিস্ট হবেন না। আমরা বর্ণবাদী হবো না। অবস্থা ভেদে যে কোন ধর্মের ভাল কিম্বা মন্দ ভূমিকা থাকতে পারে। বিভিন্ন বাস্তব পরিস্থিতে ধর্মের ভূমিকাও আলাদা হয়। আমাদের এখনকার ‘কী ওয়ার্ড’ হচ্ছে জালিম ও মজলুম। ধর্ম মজলুমের পক্ষে বয়ান দিচ্ছে, নাকি জালিমের হাতিয়ার হচ্ছে। এটাই তো বিবেচ্য। নাকি?


কিন্তু বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা খুবই বিতিকিচ্ছি জিনিস। বাঙালি মুসলমান কী পরিমাণ সহনশীল, আমাদের কোন ধারণা নাই। দেখেন, আপনি দাবি করছেন যে আপনি টিপ পরবেন। বাঙালি মুসলমান তো বলেনি টিপ পরবেন না। বলেছিলো? কখনো বলেনি। বাঙালি মুসলমানের সহনশীলতায় আমি বিস্মিত হই।


এটা কিন্তু সংস্কৃতি। হিন্দু বাঙালির। বেশ। অতএব হিন্দুর সংস্কৃতি বাঙালিরই সংস্কৃতি। টিপ পরা অতএব বাঙালি সংস্কৃতি। কিন্তু আপনি হিজাবে এত আপত্তি করেন কেন? বাঙালি মুসলমান মেয়ে তো হিজাব পরতেই পারে। আপনি বাঙালি মুসলমান মেয়ে হয়ে যদি টিপকে বাঙালি সংস্কৃতি হিসাবে গ্রহণ করেন, তাহলে হিজাব তো হিন্দু মেয়েও পরতে পারে। হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতিকে সকলের সংস্কৃতি করতে আপনার আগ্রহের অবধি নাই, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি গ্রহণে আপনার অসুবিধা। কেন? মুসলমান মেয়েকে যদি টিপ পরাতে পারেন, তাহলে হিন্দু মেয়েদেরও হিজাব পরাতে শেখান।


তো তাহলে এই যে বর্ণবাদ এবং রেসিজমটা রয়ে গেছে সমাজের মধ্যে, এর বিরুদ্ধে লড়ুন না। এই লড়াইয়ের সঙ্গে তো ইসলামের সম্পর্ক নাই। কিন্তু যেহেতু আপনি এটা এগ্রি করতে চান না, বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিকে বাঙালির সংস্কৃতি বলে মানতে চান না, হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতিকেই একমাত্র বাঙালি সংস্কৃতি বলে মানেন, তখন প্রশ্নটাই সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়।


তখন কী প্রশ্ন তৈরি হয়? আপনি কি ইসলামের পক্ষে না বিপক্ষে? আপনি কি ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন নাকি দেখেন না? হোয়াট ডাজ ইট মিন? মূল প্রশ্ন তো এটা না। এটা তো ইসলামের পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপার না।


আপনি বাঙালি মুসলমান, আপনি হাওয়ায় এখানে গজান নি। ফলে বাঙালি মুসলমান হিশাবে বাঙালি সংস্কৃতির উচ্চ বর্ণের হিন্দুয়ানির চরিত্রে রূপান্তর ঘটিয়ে আপনি কিভাবে তাকে সকল বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য করবেন, সেটা একটা জিজ্ঞাসা হতে পারে। বিপ্লবে ইসলামের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে। তো সেটা করুন। আমি যা করি।


বাংলাদেশের বিপ্লবে এবং উপমহাদেশের ইতিবাচক রূপান্তরের ক্ষেত্রে আপনার কী দেবার আছে সেটাই বাঙালি মুসলমানের মূল কথা, যদি নিজেকে কংক্রিট ইতিহাসে স্থাপন করে আপনি ভাবেন, তখন আপনি পথ খুঁজে পাবেন। দেখুন, আমরা আল্লাহর সঙ্গে চুক্তি করে মুসলমান হয়ে জন্মলাভ করি নি। কিন্তু যখন হয়েছি, তখন নিজের লোকেশানে দাঁড়িয়েই আমাকে ভাবতে হবে। অন্যকেও লোকেশান জানান দিতে হবে স্মার্ট ফোনের মতো, হাইড করে লাভ নাই।


বাংলাদেশের এখনকার প্রশ্ন: আপনি একটা ফ্যাসিস্ট স্টেট চান নাকি আপনি একটি ডেমোক্রেটিক স্টেট চান। সো, ডেমোক্রেটিক স্টেট চাইলে কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় আপনার সঙ্গে আমার ঐক্যমত হতে পারে, কিভাবে আমরা একটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি হতে পারি, কিভাবে পরস্পরের দায় ও অধিকার আমরা সাব্যস্ত করতে পারি সেইসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।


প্রশ্ন হচ্ছে হোয়াট ইজ পলিটিক্যাল কমিউনিটি? আপনার সঙ্গে আমার অনেক ক্ষেত্রে ডিফারেন্স থাকতে পারে। আমার সঙ্গে একজন ইসলামপন্থির ম্যালা ডিফারেন্স থাকতে পারে। কিন্তু তারা যদি আমার সঙ্গে একই পলিটিক্যাল কমিউনিটির মধ্যে বিলং করে তাহলে তার প্রতি আমার দায় এবং তার অধিকার আমাকে কবুল করতে হবে। একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির সদস্য হিশাবে আমরা এই কমিউনিটির মধ্যে পার্থক্য ও বৈচিত্র্য মানি। মানুষ গরুছাগল নয় যে আপনি ধরে বেঁধে তাদের একই গোয়ালে রাখবেন।


ফলে আপনি পরস্পরের সঙ্গে এনগেইজ করবেন কী করে, যাতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির মধ্যে রাজনৈতিক বন্ধন দৃঢ় হয়? সেটা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু দেখুন আপনি কী করছেন? বাংলাদেশে আপনি মূলত ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা সিভিল ওয়ার, একটা গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৯৭১ সালে। আপনি সেই গৃহযুদ্ধের অংশ হয়ে থাকতে চাইছেন। ফলে আপনি ইসলাম প্রশ্নটা বারবার আনছেন। ইসলাম এদেশের মানুষের ধর্ম, এর মধ্যে ভাসানী আছে। সুফিরা আছে, পীরমুর্শিদ ইত্যাদি আছে। আপনি কি ভাসানীর বিরুদ্ধের লোক? না। তাহলে আপনি ইসলাম নিয়ে এত ব্যস্ত কেন? আপনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, কোরান-হাদিস সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য। আমি আপনি চাই বা না চাই লোকে কোরানহাদিস পড়বে। আল্লা রসুলে বিশ্বাস করা বাদ দেবে না। বলুন, ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে, যার নানান ধারা এবং নানান ফেরকা আছে, সে সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য? তাহলে আমি বলতে পারি, কংক্রিট উত্তর দিতে পারি। একজন চিন্তাশীল মানুষ হিশাবে এনগেইজ করতে পারি। বলুন, জামাত সম্পর্কে আপনার সুনির্দিষ্ট কী বক্তব্য। দ্যান,আই ক্যান টক অ্যাবাউট ইট। ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি কিনা সেটা তো খুব ক্লিশে প্রশ্ন হয়ে গেল।


কিন্তু ইসলামকে জেনারালাইজ কেন করি আমরা? আমি তো বাঙালি মুসলমান ঘরে জন্মগ্রহণ করা একটা ছেলে, আমি তো বিলং করি এই কমিউনিটির মধ্যে। আমি তো আমার পূর্ব পুরুষের ইতিহাস ধারণ করি। ১৮৫৭-এর ইংরেজের বিরুদ্ধে সিপাহিদের লড়াই তো অস্বীকার করি না, আমি তো হিস্ট্রির মধ্যে বিলং করি। ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভূমিতে অধিকার বঞ্চিত কৃষকের লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আমি বর্তমানে এসেছি। সাতচল্লিশে আমার বাবাদাদারা পাকিস্তান আন্দোলন করে ঠিক কাজ করেছেন বলে মনে করি। বালাকোটের যুদ্ধে অনেকে হেরে নোয়াখালিতে ইসলাম প্রচার করেছে। আমি সেই জায়গার লোক। এটা তো আমার হিস্ট্রি। এটা তো আমি ভুলে যাবো না। আমার হিস্ট্রি পড়বার যে পদ্ধতি সেটা আমার জন্ম, পরিবার এবং রাজনৈতিক জনগোষ্ঠিকে বাদ দিয়ে না।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: ফরহাদ ভাই, তাহলে এই ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইসলামকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা কেন মানুষের মধ্যে কাজ করে?


ফরহাদ মজহার: মানুষের মধ্যে না তো। মধ্যবিত্ত একটা অংশের মধ্যে। যদি আসলেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইসলাম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা থাকত তাহলে একাত্তরের পর এতো ইসলাম এতো মুসলমান এলো কোত্থেকে?


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: কেন মধ্যবিত্ত একটা শ্রেণির মধ্যে নেতিবাচক ধারণা কাজ করে?


ফরহাদ মজহার: প্রথমত তারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুর বাঙালিপনা থেকে তারা ইসলামবিদ্বেষটা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছে।


দ্বিতীয়ত এই বিদ্বেষ গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর পলিটিকসের অংশ। মানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে অনন্ত যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার অংশ। শুনেন, একটা কুকুরকে মারতে হলে তাকে ‘কুত্তা’ বলতে হয়। আপনি মারতে পারবেন ‘কুত্তা’ না বললে? তাহলে আপনাকে যদি আমি খারাপ না বলি, মুসলমানদের জঙ্গি বর্বর না বলতে থাকি, আপনি কি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চালাতে পারতেন তেলের জন্যে?


তাহলে এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাই কেন? তার কারন আমাদের বুঝতে হবে। এটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা ইসলামকে নেতিবাচক ভাবে ভাবা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না, তারা অ্যাসেনশিয়ালি ওয়ার অন টেররের লোকাল ছানাপোনা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের স্থানীয় বরকন্দাজ এবং একই সঙ্গে দিল্লির ছানাপোনা। হিন্দুত্ববাদীরা এই যুদ্ধকে নিজ দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগাতে, গরু খায় বলে পিটিয়ে মারতে এবং উপমহাদেশের ইতিহাস থেকে ইসলাম নির্মূল করবার কাজে নেমে পড়েছে। স্থানীয় বরকন্দাজ এবং তাদের সহযোগীদের জন্য এটা ভাল সুযোগ। একটা সিভিল ওয়ার তারা কন্টিনিউ করে চলেছে বাংলাদেশে।


মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা ছোট অংশ কেন এটা পারছে? কারন তারা মহা শক্তিশালী। আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় তারা এই যুদ্ধটা চালাতে পারছে। নইলে তারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তারা পিপলকে রিপ্রেজেন্ট করে না।


ফলে তারই প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে এক ধরনের ইসলামাইজেশন ঘটছে। যেটা নট নিসেসারিলি পজিটিভ সবক্ষেত্রে। উৎকন্ঠা এখানে। যেহেতু ওদেরকে নেতৃত্ব দেবার, ওদেরকে পথ করে দেবার যে কাজগুলি করার দরকার ছিলো ওই কাজগুলি আমরা করছি না। ওদের তাহলে ছেড়ে দিচ্ছি আমরা কার হাতে? সেই সব লোকের হাতে যারা আন্তর্জাতিক বিশ্ব বা যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞ। ফলে বিভিন্ন শক্তি নিজ নিজ স্বার্থে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করতে পারছে। দোষটা তো আমাদের। আমরাই তো ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে ওদের মতো করে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে দিয়েছি। এরা তো ডেফিনিটলি জনগণের মিত্র না। জনগণ ভুল লোকের হাতে জিম্মি হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।


তো আমরা দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে গিয়েছি। এটাতো সহজ কাজ না। আমার কাজটা যদি মনে করেন, এটা মোটেও সহজ না। আমাকে নিঃসন্দেহে সরলার্থে সাধারন মানুষের পক্ষের লোক ভাবতে পারেন। আমি আমার কমিউনিটি অর্থাৎ আমি যে কমিউনিটির মধ্যে বাস করি, যারা আমার গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, যারা এখান থেকে চাকরি না পেয়ে উৎখাত হয়ে মরে, সমুদ্রে গিয়ে মরে, মালয়েশিয়ায় গিয়ে মরে, সৌদি আরবে মরে, তাদেরই লোক। এরাই তো আমার কমিউনিটি। এমনকি পেটি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত আমার কমিউনিটি, ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের কোন ধারনা নাই, আগ্রহও নাই। তাদেরও তো আমি বাদ দিতে পারি না। তাদেরকেও আমার শেখাতে হচ্ছে। তাদের বলদামি দেখিয়ে দিতে হচ্ছে। আমি জিতছি বলেই মনে হয়!


কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলাম বিদ্বেষী জাতিবাদী মধ্যবিত্ত আমার কমিউনিটি না। এরা ধর্মের জায়গায় জাতিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নাগরিক দায় ও অধিকার এদের কাছে গৌণ, উচ্চ বর্ণের হিন্দুর তৈরি ‘বাঙালি জাতি’র বাইরে আর কোন নাগরিকের অধিকার তারা মানে না। এরাই তো আমার এনিমি। আমার ক্লাস এনিমি, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষের শত্রু, অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের দিক থেকেও আমার শত্রু, কারন তারা ইতিহাস মানে না, ইতিহাস থেকে শিক্ষাও নেয় না। এদের সঙ্গে তো আমার বিরোধ হবেই। এই বিরোধিতায় আমি আনন্দিত এবং গর্বিত যে, দ্যা টেক মি সিরিয়াসলি। কারণ আমি ওদের জন্য সবচেয়ে বড় পলিটিক্যাল এবং ফিলোসফিকাল চ্যালেঞ্জ। আমি যদি খালি আল মাহমুদ হতাম, আমাকে যদি আল মাহমুদ বানাতো পারতো, তাহলে ওরা খুব খুশি হয়ে যেত। ওদের কোনো সমস্যা থাকতো না। হয়তো এতোদিনে আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক বা জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যেতাম।


কিন্তু আমাকে আল মাহমুদ বানানো যাচ্ছে না। এটা তাদের খুব দুর্ভাগ্য। এজন্য খুব কষ্ট পায় ওরা। কেন যে আমার বিরুদ্ধে এতো প্রপাগান্ডার পরও আমাকে আল মাহমুদ বানাতে পারছে না, তার জন্য এরা ক্ষুব্ধ।


ডেফিনিটলি আমার ইসলাম নিয়ে অনেক পঠন পাঠন আছে। ইসলামীদের পঠন পাঠন আমার পঠন পাঠন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি মার্কসের ক্রিটিক অব রিলিজিয়ন সম্পর্কে অবহিত। হেগেল যেমন ক্রিশ্চিয়ানিটির ক্রিটিক করেছেন সেটা আমি থরোলি জানি। ফলে আমি মনে করি ইসলামের একটা ক্রিটিক দরকার। এটা হয় নাই। এটা যে শুধু আমাদের দেশে হয় নাই তা না। ইসলামী জগতে হয় নাই। ফলে ইসলাম একটা থিওলজিকাল জগতে পড়ে আছে। আপনাকে সেই থিওলজিকাল জগৎ অতিক্রম করে একটা প্রজ্ঞার জগৎ অর্থাৎ দার্শনিক জগতে প্রবেশ করতে হবে। আমার ভূমিকা সুনির্দিষ্ট ভাবে এই জায়গায়। এই প্রজ্ঞা অর্জন করতে গিয়ে আপনারা যদি আমাকে ইসলামিস্ট বলেন, হেনতেন বলেন এগুলা পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই না। একটা সুবিধা আছে, আমি ইসলামিস্টদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠি।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আপনি একটু আগে যে বললেন, ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ারের সহায়তায় এখানে তারা যা করে সেটা করে যাইতে পারতেছে। কিন্তু এর আগে যে যখন বললাম বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রসঙ্গে যে, ইন্ডিয়ার কলোনি হয়ে থাকবে। তো আপনারা কী ওই মুহূর্তে মনে করতেছিলেন না এটা পাকিস্তানের কলোনি হয়ে আছে? আর তাছাড়া এটা যদি ভারতের কলোনিও হয়, আর তার মাধ্যমে আমরা সাংবিধানিকভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পাই তাতে ক্ষতিটা কী?


ফরহাদ মজহার: প্রথম কথা হলো,পাকিস্তান কী বাংলাদেশের জনগণ চাইছে না চায় নাই?


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: চাইছে।


ফরহাদ মজহার: দ্বিতীয়ত আপনি কলোনি হয়ে থাকতে চাইতেই পারেন, সেই দিক থেকে তো আমরা দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে গেলাম। তৃতীয়ত ‘সাংবিধানিক রাষ্ট্র’ কথাটা ভালই বলেছেন, ব্রিটিশদেরও কলোনির শাসন চালাবার ‘সংবিধান” ও বিধিবিধান ছিল। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান তেমনই সংবিধান গণ্য করলে ঠিক আছে। আর আসলে, ঠিকই। কিন্তু যখন বলছেন, ভারতের কলোনি হয়ে থাকতে ‘ক্ষতি কী?’ তখন এর উত্তর কী দেবো?


পূর্ব পাকিস্তানকে তাহলে আপনি কলোনি বলছেন কেন? পূর্ব পাকিস্তানের জনগণই পাকিস্তান চেয়েছে, তারা নতুন জন্ম লাভ করা পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবার অধিকারী হয়ে নির্বাচন করেছে, নির্বাচিতও হয়েছে। সেটা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।


আমরা যে কোনো কলোনাইজেশনের বিপক্ষে। কারণ কলোনাইজেশনের আধুনিক ফর্ম হলো ক্যাপিটালিজম। ফলে যখনই আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় ওপর থেকে পাকিস্তান ক্যাপিটালিস্ট রিলেশনস প্রোডাকশন ইন্ট্রোডিউজ করছে, কিন্তু একটা বুর্জোয়া ডেমোক্রেটিক স্টেট আমাদের হতে দিচ্ছে না, উলটা রাষ্ট্রশক্তি হিশাবে সামন্ত ক্ষমতা বহাল রাখছে। তাহলে তার সঙ্গে লড়াই করা কি একই সঙ্গে ‘কলোনি’ বা সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করা না? সো দ্যাটস হোয়াট উই হ্যাভ ডান।


তাহলে আমরা পাকিস্তানের কলোনি ছিলাম, আপনার এই প্রশ্নটাই তো ভিত্তিহীন। এটা বাঙালি জাতিবাদের জাতিবাদী বয়ান। তারা বলে, বাঙালি জাতি পাকিস্তানের কলোনি হয়ে আছে। অতএব আমাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের অবস্থান ভিন্ন। আমরা পাকিস্তানের কলোনি ছিলাম বলা ভুল হবে। তাছাড়া পাকিস্তান আন্দোলন আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণই করেছে। তাহলে কিভাবে আমরা পাকিস্তানের ‘কলোনি’ ?


কিন্তু ভিন্ন অর্থে ‘কলোনি’ বা সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশীকরণের অধীনে পড়ে গিয়েছিলাম বলেই যুদ্ধ করেছি। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামাবাদের কলোনি ছিল না।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: আপনারা বিগার সেন্সে অন্য এক কলোনির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, সেটাই তো বলতেছেন?


ফরহাদ মজহার: না, পুঁজির প্রান্তিক সমাজগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়েছি, বাঙালি, পাঞ্জাবি, বালুচি ইত্যাদি প্রকার জাতিবাদী বিভাজন করি নি। এটা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ শ্রেণি ও নানান জাতিসত্তার সম্পর্কে রূপান্তরের লড়াই, গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার লড়াই। একটা হলো আপনি আর্থ-সামাজিক বা সাংবিধানিক ভাবে শাসিত আরেকটি পরাক্রমশালী দেশের অধীন, টোটালি আন্ডার দ্যা পলিটিক্যাল কন্ট্রোল। সেটা ঔপনিবেশিক পরাধীনতা। কিন্তু স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিপ্লব চাওয়া একদমই আলাদা জিনিস। ভুলে যাবেন না, পাকিস্তান চেয়েছে বাঙালি মুসলমানরা।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: বাঙালি মুসলমানরা কি বাংলাদেশ চায়নি কখনো?


ফরহাদ মজহার: না। নট নেসেসারিলি। এভাবে প্রশ্ন করলে তো হবে না। আপনাকে হিস্ট্রিতে আসতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিম কী চেয়েছে? ব্রিটিশরা এখানে যে প্রোপার্টি ব্যবস্থা, তাদেরকে জমি উৎখাত করে তাদের রায়তে পরিণত করা এবং হিন্দু জমিদার এবং হিন্দু মহাজনদের প্রতিষ্ঠিত করা, তার বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছে। ফলে এটা তো জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই।


তাছাড়া আপনি দেখবেন যে, ভারত ভাগ হওয়ার জন্য তো মুসলমান দায়ী না। এই যে লড়াইটা আমরা করলাম, বাংলাদেশে যখন জমির প্রশ্ন মীমাংসা হয়ে গেল ১৯৫৩ তে- বাংলাদেশ থেকে জমিদাররা চলে গেল। বাংলাদেশের জমিদারি তখন সর্বত্র ভাঙাভাবে পড়ে আছে। এটা আপনার জেনারেশনের বোঝা খুব মুশকিল হোয়াট ডাজ ইট মিন! তখন বাঙালি মুসলমানের সেকেন্ড পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেনটা কী? তার ল্যাংগুয়েজ, তার ভাষা। ফলে তারা ভাষা নিয়ে লড়াই করতে নেমে গেছে। কিন্তু ভাষা নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে তো কেউ পাকিস্তান ভাঙতে বলে নাই। বাঙালি জাতিবাদীদের সঙ্গে আমাদের রাজনীতির পার্থক্য এখান থেকে শুরু, কথাটা এখান থেকে শুরু করলে বুঝবেন। আমাদের এখন শুধু জাতীবাদী হলে চলবে না। আমাদের এখন আরও গ্লোবাল হতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তো অনেক বেশি গ্লোবাল।


সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: ফরহাদ ভাই, আমাদের কাছে কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসটা কিন্তু অনেকটা বিকৃতভাবে প্রচার হচ্ছে। আমরা কিছু জানি, কিছু জানি না। এটা কিন্তু আপনাদের দায়িত্ব আমাদের কাছে ইতিহাসটা সুন্দর ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা।


ফরহাদ মজহার: শুনেন, আমি তো ইতিহাসবিদ নই। তাছাড়া আমার জেনারেশানের বিপ্লবী তরুণদের ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনই ডেড। কারে বলছেন ‘আপনারা’! আমরা বাই চান্স বাঁইচা আছি। হুইচ ইজ গুড। কিন্তু যদি বলেন আপনাদেরই দায়িত্ব, একথা বললে এটা ঠিক না। হ্যাঁ, আমরা ডেফিনিটলি, যেমন আপনি আসছেন আপনার সঙ্গে, আমি কথা বলছি। কিন্তু সেভেন্টি ওয়ানে লেফটের ভূমিকা সম্পর্কে বহু দলিল আমাদের হাতে নাই। তাই মৌখিক একটা কথা বললাম, লোকে বলবে আপনি এটা কিসের ভিত্তিতে বললেন? ইট বিকামস অ্যা ভেরি সিরিয়াস প্রব্লেম। হিস্ট্রির জন্যে যে একাডেমিক লেভেলে কষ্ট করা দরকার, আমাদের একাডেমিক লেভেলে তো এই কাজটা হয় নাই। আমি তো অ্যাকটিভিস্ট। অনেকগুলো কাজ একাডেমিশিয়ানরা করে। একটিভিস্টরা তা ব্যবহার করে। আমি তো একাডেমিশিয়ান হই নাই। কারণ একাডেমিশিয়ানদের নিরপেক্ষভাবে এই কাজটা করবার কথা। এদের কাজ দ্বারা আমাদের কাজ করাটা সহজ হয়...


(সংক্ষিপ্ত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন