নাহিদ ধ্রুব এর কবিতা

ছবিগুলো নাহিদ ধ্রুব এর আঁকা







❑ কয়েকটি খন্ডচিত্র 


প্রেম 

.

ফুল ফুটছে

বাগানে তাই আজও

বাতাস আসে


...

আত্মাহুতি 

.

শীতের রাত

গোল হয়ে পুড়ছে

শুকনো পাতা 


...

আত্মপক্ষ

.

শিকারিপাখি

শিকার করি শুধু

শিকারি বলে


...

দুঃসময়

.

এমন রাত

ব্যাকুল হয়ে ডাকে

একটা কাক


...

নিয়তি

.

এই অনিদ্রা

নক্ষত্র দেখে কাটে

আকাশে মেঘ





 ❑


তোমার কথায় সায় দেইনি শত্রু হয়েছি তাই

লেনাদেনার বাইরে কোথাও কোন হিসেব নাই


যা কিছু স্নেহ, দানখয়রাত, মানুষের উদারতা

কথায়গলানো, যায় নাকি সব, কথাই সজীবতা


যার নাই কোন কথার মানুষ তারে যদি বলি দুঃখী

গর্জন ছাড়া সমুদ্র কী পারে, হতে কোনদিন সুখী 


শিশুর কথা শোনার জন্য উদগ্রীব থাকে পিতা

কথার গিঁট খুলে গেলে হয় কিশোরী পরিণীতা


মানুষের মন, আয়না যেমন, কথাই রাজনীতি 

কথার জন্য মরেছে মানুষ, দেখেছে সম্প্রীতি 


যদিও মানুষ নীরব থাকে একা একা বনবাসে

গাছেরা কষ্ট পেলেই বুঝি দাবানল কাছে আসে







শূন্যে ভাসা লাশ। বয়স বাড়েনি একদিন। কী সুন্দর তার মুখ, এখনও মলিন। তারে কেন যে দাফন, করতে পারি না। সাথে সাথে চলে। কথা কিছু বলে। আমি নুয়ে পড়ি — তার ওজনও কী বাড়ে? কে জানে — কী তার নাম, কেন পিছু ছাড়ছে না। হতে পারে স্মৃতি কিংবা বেদনা।




অপরিচিত ভাষার কোন গান শুনে 

মাঝেমাঝে বড় ভালো লাগে —

হয়তো সুরের জন্য, কখনও আপনমনে 

করে উঠি গুনগুন ; 


কথা নাই, ভাষা নাই —

তবু কী এক অদ্ভুত গাঢ় অনুভূতি

আমারে আক্রান্ত করে! 


যেন পথেঘাটে হঠাৎ দেখতে পাওয়া

কোন মৃতদেহ —

চেনাজানা নাই তবু মনে দাগ কাটে!






সবাই যখন ধরেছে অন্য পথ,

ধীরে ধীরে সরে গিয়েছে নদীর বাঁকও

থেমে গেলে সব জীবনের মহারথ —

আমরা দু'জন পাড়ি দেবো ভাঙা সাঁকো


কত কিছু তো বদলে যেতে দেখি,

সন্ধ্যায় আজও লণ্ঠন তবু জ্বলে —

অনুভূতি ছাড়া বাদবাকি সব মেকি,

এখনও মানুষ নিয়তির কথা বলে।


হয়তো এসব চিরকাল থেকে যায়,

বারবার আসে, পুরনো গানের মতো,

মানুষ হারায়ে মানুষই ব্যথা পায় —

মঙ্গল থেকে বুধে পাড়ি দিলেওতো। 


তাইতো জগতে আমরা পৌরাণিক

জীবন আর মৃত্যুর কাছাকাছি —

বদলে গেছে জগতের সবদিক —

বিদায়ের মতো বেদনার মাঝে আছি।





টেলিপ্যাথি খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে

মাঝে মাঝে তোমাকে খুব মনে পড়ে যায় :


মাঝরাতে — 

সমস্ত আলো নিভিয়ে 

বসে থাকি খোলা জানালায়,

মিষ্টি ফুলের গন্ধ আসে —

শাদা মেঘ নক্ষত্রের পাশে

তোমাকে জানাই..  


হঠাৎ অচেনা হাওয়া এসে

তোমার মতো এলোমেলো করে দেয়

আমার চুল..






নিজেরে দেখার মতো আয়নাও নাই

আমি তো আমারে দেখি তারাদের চোখে,

কেউ যদি বলে রাত আমি হই তাই —

সারারাত জেগে থাকি অন্ধকার মেখে 


মনে হয় অপেক্ষায় আছি বহুকাল —

কোথাও ফুটবে ফুল ভেবেছি এমন

মেঘ হয়ে ছুটে যাবে হরিণের পাল,

স্বপ্ন পূরনের স্বাদ কে জানে, কেমন! 


এমন তো হতে পারে ফুল ঝরে গেছে

যে ফুলের অপেক্ষায় থাকি সারাবেলা

মাছ নাই জলে তবু ছিপ ফেলি পাছে —

জল যদি ভাবে তারে করি অবহেলা


জলে জলে ছায়া দেখি, কী করুণ মুখ

নিজেরে চিনিনা আমি এমন অসুখ!




ঘর নির্জন, এই সন্ধ্যা

যেন রাত্রির পথ ধরলো

সব চুপচাপ, তবু মনে হয়

কেউ দরজায় কড়া নাড়লো 


সরেস মাটিতে এক মহীরুহ 

উঠোনের মাঝে একা দাঁড়ায়ে 

ভাসে বাতাসে আজানের সুর 

পাখি এসেছে পথ হারায়ে 


শুনি চৌচির পাতা মরমর

দূরে জঙ্গল শেয়াল ডাকছে

যার হাঁসগুলো খোপে ফেরেনি

তার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে


নেই কেরোসিন আলো জ্বলেনি

কালো চিমনি ভাঙা হারিকেন 

বসে আধারে শুনি মশাদের

অদ্ভুত সুরে প্রিয় বেথোভেন


এই ঘরেতে কতো সন্ধ্যায় 

বসে দেখেছি মৃত তারাদের

এই দৃশ্য খুব পরিচিত 

যেন ভ্যানঘগ আঁকে আমাদের 


খুব শীতকাল এতো কুয়াশা

শৈত্যপ্রবাহে পাতা কাঁপছে 

আসে বৃষ্টি, এই সন্ধ্যায়

নিঃসঙ্গতা ঝরে পড়ছে..





যদি পাখি হয়ে যাই —

যদি হই যা কিছু চেয়েছি চিরকাল!

নাকি হবো গন্ধহীন ফুল? 

অথবা মাকাল কোন ফল?

যদি হই পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা লতা —

যদি কেউ বেছে নিতে বলে

গাছ নাকি ঝরাপাতা?  

আমি কার দিকে যাবো? 

মসৃণ রাস্তায় ছেঁড়া চটি পায়ে —

দুঃখ পাবো, চিরকাল কি দুঃখই পাবো?





দলছুট পাখি হয়ে তোমার শহর —

ছেড়ে এসে দাঁড়ায়েছি মেঘের পাহাড়ে 

এইখানে রোদ যেন সোনার মোহর

একটা গমের শিষ বাড়ে ঝোপঝাড়ে 


দূর্বাঘাসে ভরে গেছে পরিচিত পথ —

বন্য বৃক্ষ গিলে নিচ্ছে লেলিহান শিখা

ধীরে ধীরে ম্লান হয় সমস্ত শপথ

আমাদের মাঝে বাড়ে প্রাচীন পরিখা


আমারে নিয়েছে বুকে টিলার জঙ্গল 

দুপুরে টিফিন খাই ফুলেদের গ্রামে —

পানাপুকুরের জলে ভাসে শতদল

সাদা বক উড়ে এসে এইখানে নামে


আমারে কে দুঃখ দেবে, দুঃখ তার হয়

যার আছে হারাবার, অগণিত ভয়!





পৃথিবীর মতো গোল অ্যারেনাতে

আমি এক পরাজিত গ্ল্যাডিয়েটর


গ্যালারীতে অজস্র দর্শক —

তাদের উচ্ছ্বাসের জন্য প্রয়োজন

ছিন্ন মস্তক


কী ক্ষুধা, তাদের চোখেমুখে!  


এই ক্ষুধা আমারও পরিচিত —

পৃথিবীর সব মানুষের মনে হয়তো 

এমন ক্ষুধা থাকে!




যে মানুষ কাঁদে, প্রতি মাঝরাতে

জেগে জেগে একা — তুমি তার দুঃখ বুঝবে না।


পর্দার আড়াল থেকে তুমি তাকে দেখো,

তুমিও তো রাত জাগো — 

দুঃখ তোমারও তো কম নাই


হয়তো সে বুঝবে না তোমার বেদনা,

তবু তাকে ডাকো —

কথা বলো, কথা বলো


কতো রাত ঘুমাওনি তুমি —

যদি কথায় কথায় ঘুম এসে যায়!





জিপসি বলে, চলো যাই দূরে, দেখি এলোমেলো রাত

যেখানে রয়েছে রূপালী বাঁকানো কাস্তের মতো চাঁদ 


আকাশে উড়ছে বিবাগী রুমাল যেন পাখিদের সারি —

সমুদ্রের ছোট ঢেউয়ের মাঝে আছে তারাদের বাড়ি


জিপসি বলে, খুঁজে বের করো, তিতির পাখির সুর —

নগ্ন পাহাড়ে দাঁড়ায়ে দেখো আকাশ কতদূর ;


এসো ঝোপঝাড়, ফুলের বাহার, বিগত মেঘের ছায়া —

জল থেকে ওঠা বাতাসের জন্য সূর্যের এতো মায়া! 


জিপসি বলে, টেনে বের করো, বৃষ্টি ধরে যে চোখ —

হতে পারে গিরি কিংবা খাতে পাবে তোমাদের মুখ


বনভূমি বলে আগুনের সাথে ঘোরলাগা সুরে কথা

অনুভব করো, গাছের বেদনা, ভীতিপ্রদ বিশালতা


জিপসি বলে, চুপচাপ থাকো, যদি কিছু বাকি রয়

ঘাসেদের ব্যথা যদি বোঝে মাঠ তবে নীরবতা হয়।






মেমোরি লেন

 

ঘা শুকায়ে যায়, দাগ মুছে যেতে পারে —

ক্ষত কতোটুকু ছিল, সে চাবুক জানে!

লীন

 

ঠিকানা হারানো চিঠি —

কেউ একজন খুলে পড়ে অবসরে।

 

কোনদিন যার কাছে আসে নাই কোন চিঠি

তার চোখ তিরতির করে —

লেখাগুলো কখন অস্পষ্ট হয়ে যায়.. 

 

মৃত নক্ষত্রের আলো আসে তক্ষকের মতো

নিঃসঙ্গ মানুষের জানালায়।

 

এখানে

 

এখানে বৃষ্টির দিন আবছায়া মাঝে —

এখানে ঈশানকোণে কাকাতুয়া নাচে

হুডখোলা রিক্সা আর যাত্রীশূন্য বাস

বাতাসে রহস্যময় ফুলের সুবাস;

চতুর্দিক অন্ধকার উড়ে যায় পাখি —

এখানে ছাউনিতলে একা বসে থাকি।

খরস্রোতা নদী খোঁজে মেঘেদের সাঁকো —

কাগজের নৌকা ভুলে যেও নাকো।

ম্লান হয়ে যায় স্মৃতি, চলমান জলে —

ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙ ডাকে, এই অন্ধকারে

এখানে বনের মাঝে গাছ দিশেহারা —

এখানে ঝরছে পাতা ভিজেছিল যারা।

 

 

ঝরাপাতা মানে বন

 

কিছু মেঘ এতো চেনা চেনা লাগে

মনে হয় সাঁওতালি

কোন কোন দিন মনে হয় শুধু

পাহাড়ে বসত গড়ি

 

যেখানে একটা কাঠের বাড়িতে

জানালার পাশে বসে —

সবুজের মাঝে দেখবো কীভাবে

সন্ধ্যা নেমে আসে

 

দুপুরবেলাতে ছেলেপেলে নিয়ে

গাছের ছায়ার নিচে

পাঠশালা খুলে শেখাবে তাদের

ময়ূর কীভাবে নাচে

 

কিংবা পাহাড়ে জুমচাষ করে

কাটায়ে দিবো জীবন

যেখানে মানুষ সহজ এখনও —

ঝরাপাতা মানে বন

 

একটা সুন্দর দিন

 

মেঘের চাদরে শুয়ে

নামতা পড়ার শব্দের মতো

কবেকার বৃষ্টি —

মাঝেমাঝে পড়ে মনে

 

হুডখোলা রিক্সায় বসে কতো অভিযোগ

জলকাদায় মাখামাখি

 

হাওয়ার তাণ্ডব। কেঁপে কেঁপে উঠছিলে শীতে।

 

তখনও যদি জানতাম —

সুন্দর সমস্ত দিন পড়ে থাকে অতীতে!








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন