টোকন ঠাকুরের কবিতা

 

বসন্তে রচিত ভাব-ভালোবাসা

হাওয়া ধার্মিক, তার কর্তব্য ধাওয়া।

লক্ষণীয়, সম্পর্ক এসে সম্পর্কের চলে যাওয়া

পথের শেষে সূর্যাস্ত একটি ছবি, একটা ফ্রেম

একটু একটু করে জড়িয়ে যাওয়া লোভনীয় প্রবলেম

আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে, দেখি খা খা

একটা মাঠের মধ্যে রোদমাখা ঢিলিমিলি আঁকা

এক জ্যান্ত দুপুর, জ্যান্ত ঘূর্ণি, এক জ্যান্ত স্বপ্ন, তখন

টবেই ফুলের বাগান, ছাদে, শ্রী শ্রী ছাদই শ্রী বৃন্দাবন


ধেনু বিনে নদীহীনে, বসন্তের এ দিনে রাধারানীরা

কোথায় গো সব, দ্যাখো আমি কবিতা লিখছি, কবিতাগুলো

রাত্রিবেলার বুকের নিচে বালিশ চাপা তুলো মানে শিমুল ফুলও

তার জীবনের গল্প নিয়ে গল্প হয়ে ওঠার আশায়

আমার কাছে আসে কিন্তু প্রকাশিত হয় কবির ভাষায়


এটাই ব্যর্থতা। আর ব্যর্থকে ভালোবাসারা ভালোবাসা দিতে

পারে না বলেই ছেলেটি থাকে উত্তরায়, মেয়েটি শ্যামলীতে।



শ্রী বসন্তে মহুয়া-মদির

শুনিনি এমন কথা, শুনব, ভেবে কথার বাগানে যাই

দেখি, কথা হয়ে আছে গাছ, কথা হয়ে আছে ফুলও

কথা ভেসে যাচ্ছে ঘ্রাণময়, প্রাণময়, অপ্রতিরোদ্ধতায়

কথার যে এই ক্ষমতা, জানলাম, কথা হয়ে ছিল তীর


কারণ, আমি বয়ে বেড়াচ্ছি পাখির শরীর


কথায় কথায়, আমি হয়ে বেড়াচ্ছি যা হলে আমার ভালো

একদিন, বাঙ্ময় ভালোবাসার কাছে ‘আমি চলে যাচ্ছি’

শোনামাত্রই যে স্তব্ধতা আমার মুখোমুখি দাঁড়াল

শুনিনি এমন ভাষা, তখন বুঝিনি এমন বিধান

এককথায় আজ তাকে বলে দেব বিরহের গান!


 

সেই গানও একদিন চুপচাপ ঘুমোয়, গানকেও মনে হয়

বালুচরে ভেসে ওঠা নদী, গানকেও মনে হয় পরিত্যক্ত রাজবাড়ি

ঘুরতে ঘুরতে, আবারও কি মনে হয়, অন্য একদিন

মনের মধ্যে ঘুরঘুর করে অন্য কোনো গান, গান তুমি ঘুম থেকে ওঠো


গান তুমি কথা বলো আমার সঙ্গে, গান তুমি ফুল হয়ে ফোটো 

                                            শ্রী বসন্তে মহুয়া-মদির


কারণ, আমি বয়ে বেড়াচ্ছি হাওয়ার শরীর



পাখি সম্পর্কিত শেষ কবিতা

প্রেম হলো সেই পাখি, যার সোনালি ডানা ছুঁয়ে দেখবার সৌভাগ্য পাওয়া চাই। যার একটি মায়াবী পালক খসিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। প্রেম সেই পাখি, যার চোখের মণিতে সামুদ্রিক নৌকার মাস্তুল দেখা যায়। যার মসৃণ গ্রীবায় নিঃসন্দেহে রোমিও-জুলিয়েট মঞ্চস্থ হতে পারে। প্রেম সেই পাখি, যার ঠোঁট দেখলেই প্রতীয়মাণ হয়- একজন একা মানুষের আত্মজীবনী কী ভয়ঙ্কর পিপাসার্ত! বীভৎস!


যখনই কেউ প্রেমে পড়ে মানে সেই পাখিতে পড়ে। তখন সে প্রেমরূপ পাখির ডানা ছুঁতে চায়। কারণ, তার অবচেতন মন প্রার্থনা করে ডানার নিচে আত্মগোপন। একুশ শতকের যন্ত্রণায় জ্বলেও প্রেমে এরকম আত্মগোপন এখনো উঠে যায়নি। কিন্তু হঠাৎ কোনো পাখি যখন উড়ে যায়, ডানার নিচের ওমে যে আত্মগোপনকারী সে ধপ করে পড়ে যায়। নিঃশব্দে শব্দ হয়, ধপাস!


অর্থাৎ পাখি উড়ে গেলেই প্রেম উড়ে যায়। সেই প্রেম সেই পাখি আর সন্ধান করেও পাওয়া যায় না। এরপর যত পাখি চোখে পড়ে, সব অন্য পাখি। কোনোভাবেই আমি ভুলতে পারি না, সেই পাখি কোথায় গেল- যার অপরিসীম ডানার নিচে একদিন আত্মগোপনে ছিলাম, ওম সম্মেলন করেছিলাম!


আজ যেসব পাখি ওড়াউড়ি করছে, ডালে বসে আলস্য ভাঙছে- এরা তো জানেই না যে, প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করলেও আমি আত্মগোপনে থাকতে ভালোবাসি। ফলে, এখন আমি বুঝতেই পারছি না, কোন পাখিটার ডানার নিচে ওম্ সম্মেলন সফল হবে, সার্থক হবে?


কোন পাখিটা উড়বে না আর, স্বভাব ভেঙে?



পোকা ও প্রজাপতির গল্প

এখনো কবিতা পড়ো মানে তুমি মনে মনে ভাবো

আচমকা এক ফুরফুরে বিকেলে প্রজাপতি সম্মেলন হবে।

সেই সম্মেলনে তুমি স্বাগতিক; তোমার ব্যস্ততা থাকবে।

তুমি ফুলদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে 

ঘাসের বক্তব্য শুনতে শুনতে, হয়তো বা ভুলে যাবে-

একজন কবি এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে,

পোকা থেকে তুমি প্রজাপতি হয়ে কতটা বদলে গেলে? 


এখনও কবিতা লেখা হয় মানে সেই লোকটিই কবি-

যে কীনা পোকা হতে পারেনি বলে প্রজাপতি হতে পারছে না।



ভালোবাসা একটি বাঘ

স্বপ্নের সঙ্গে থাকা যায় না, সংকট তৈরি হয়। ভোরকে ভোর মনে হয় না, দুপুরকে মনে হয় গনগনে নদী, নদীর কী ধাঁধা! বিকেলকে ভাঁজ করে রাখতে পারি বীজগণিতের খাতায়। এবং সন্ধ্যে, সন্ধ্যের কথা তো আমি গতকালও বলেছি, সে আমাকে সপ্তসিন্ধুর দিকে নিয়ে যাওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে যায় রূপনগর আবাসিক এলাকায়। রূপনগরে যাওয়ার পর আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আর কিছুই দেখতে পাইনি, ভেতর থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গীত ছাড়া কানেও কিছু শুনতে পাইনি। মনে হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের আঘাতেই একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি, নিঃশব্দে চলাফেরা করছে উদ্বাস্তু রাত। পালাতে চাইলেও পালাবার পথ নেই। দিগন্তপ্লাবিত মাঠে নেমে আসে চাঁদ। প্রশাসনিক চাঁদ, আমাকে তুমি ক্রসফায়ারে মারবে?


জানি, চাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ টিকবে না, কোনো বিচার হবে না। কোন বনে বা উঠোনে কয়টা জোনাকি মরেছে গতকাল, তার কোনো নথি নেই, তারাও বিচার পাবে না। নদী হত্যারও বিচার হয়নি, সমতল গিয়ে পাহাড় কাটছে রোজ. . . 


এত এত সংকটের পরও, আমি প্রত্যেকদিন রান্না করেছি ভালোবাসা, ভালোবাসা খেয়েই বেঁচে আছি। ভাত রানতে যেমন চাল লাগে, চাল আনতে ধান লাগে, ধান বুনতে শ্রম লাগে, স্বপ্ন লাগে, ভালোবাসতেও স্বপ্ন লাগে অনেক। স্বপ্ন একটি বাঘ। খাঁচায় রাখা যায় না, ছেড়ে দিলেও মুসকিল। তবে কি আমি ভালোবাসার সন্ধ্যানে গিয়ে স্বপ্নের থাবায় পড়ে মরে যাব ? 


আমাকে বাঁচাবে কে?



আশংকা

বাবুই যে বৈষ্ণব-ঘরানার পাখি, এই তত্ত্ব, পরমার্থ অভিজ্ঞান

            আমি যথেষ্ট বুঝেছি

চড়ুইয়ের মতিচাঞ্চল্য, দেহস্ত সংরাগ


ভাল লাগছে ভরপুর ভাবনা-সন্দেশ


আমার মনে হয়, বাবুইবৃত্তির সঙ্গে আজ

চড়ুইবৃত্তির একটা টক্কর লাগছে


এদিকে আমি কবি হয়ে উঠছি



জুতো-মোজার গল্প কিম্বা মায়ের অনুভূতি 

চলতি শীতে আমি দুইবার ঝিনাইদহে গেছি। আবার যাব। কদিন আগে যখন আমি ঝিনেদায়, বাড়িতে ছিলাম, 'মা বলল, কি রে, এত শীত কিন্তু তোর জুতো কই ?'

জুতো পরা, জুতোর ফিতে বান্ধার টাইম নেই।'

'চল।'

বললাম, 'কোথায় যাব'

শেষপর্যন্ত মা'র সঙ্গে জুতো কিনতে যাওয়াই লাগল। জুতো কেনা হলো। একজোড়া মোজাও কেনা হলো। এর দু'একদিন পর আমি ঢাকায় চলে এলাম। সেই  নতুন জুতো-মোজা পরে বেড়াচ্ছি।


গত পরশু সন্ধ্যায় আমার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় ছিলেন প্রকাশক-লেখক বন্ধু। বলল, 'রেডি হয়ে নেন, চলেন বাইরে যাই।'

তখন সেদিনের ঝিনেদা থেকে আমার মায়ের কেনা মোজার একটি এক পায়ে পরে আমি বসে ছিলাম, অন্য মোজা খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। বন্ধুটিকে বললাম, 'আরেকটা মোজা খুঁজে না পেলে তো এখন আমার জুতোই পরা হবে না।'

ঠিক সেই সময়েই আমার ফোন বেজে উঠল। দেখলাম, মা, ঝিনেদা থেকে। ফোন করেই মা'র কথা_'শোন, তোর রুমের কাঠের ওয়ার্ডোবের একদম উপরের তাকে দ্যাখ তিনজোড়া মোজা আছে। বের করে নে। পর। আর সেদিন কেনা মোজা পরিষ্কার করে নিবি।'


বললাম,''আমি যে এই মুহূর্তে আমার একটা মোজা খুঁজে পাচ্ছি না, এটা তুমি জানলে কী করে?

'

'আমি তোর মা না?আমি তো টের পাবই।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন