আমার ৬টা বই থেকে কয়েকটা কবিতা এখানে থাকল। এই কবিতাগুলোর মধ্যদিয়ে মোটামুটি বোঝা যাবে আমার কবিতা-চিন্তার বিবর্তন। আপনারা পড়েন, মতামত দেন, এবং ভালোবেসে কবিতাগুলো শেয়ার করেন, প্রচারেই প্রসার।
--------------------------------
ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে
[ চৈতন্য, ২০১৬; ২য় সংস্করণ, বৈভাষিক, কলকতা]
শ্রী মন
*
কী অসংখ্য চোখ
উড়ছে
নামছে
এলিজির বাইরে আর বৃষ্টি হলো না কোথাও!
-----------
বাবা
*
খুব ভোর বাবাকে ভুলে যাচ্ছে বাবা।
---------
শূন্য
*
কোথাও শূন্যতা নেই।
এই বর্তুলাকার নীল উড়ন্ত মাছের চোখে
যে বিভ্রমের ঝোঁক—
তার ফুলগুলো নুয়ে পড়ে ট্রাপিজিয়ামের দিকে।
যে মেঘ ত্রিকাল বর্ষাবে বলে বাবলা গাছের নিচে রুয়ে দেয়
শুকনো করবীর ছায়া, সেখানেও জমে আছে প্রবীণ তিমিদের বাড়ি।
-------------
অটোবায়োগ্রাফি
*
আত্মার সমান বাঁকে শুয়ে আছে পথ—
যে গান
মাবুদ মাবুদ বলে হে লম্ব
নিখিল গ্র্যাভিটির পাশে হয়তো একটি তারা
ঘুমন্ত ঢোঁড়ার দিকে শুয়েছে মুদ্রাদোষে
আত্মহত্যা শেষে যে সকাল স্থির
যে সকাল শূন্য করবীর পাশে
লাল।
-------------
কপারের স্মৃতি
*
রাত, এক অদ্ভুত কপারের স্মৃতি
দরিদ্র হামের ফুটকি উড়ে যায় মিউকাসে।
আহা জীবাশ্ম, এই জিহ্বার পাশে
যদি দুলে ওঠে নিঃশব্দ ময়ূর, বিপরীতে বেঁকে যায় বড়ে
কোথায় উজ্জ্বল তীরবিতানের হাওয়া !
তাসের বাজার থেকে যদি কিনে নেয় কথা বলা চারু
কে আর গোনায় ধরে কার্পাস!
যতটুকু নির্ণেয় তারও বেশি
এঁকে দেয় মূক—
দূরে, পাতা নড়ে হিংসার চেয়েও ধীরে—
-------------
ফুল
কোথাও ভেঙে পড়ছে শিউলির ঘ্রাণ।
শিশুরা জুতার মধ্যে
লুকিয়ে রাখছে কয়েন। একলা একটা গাছ
শামুকের ভাষা অনুবাদ করবে ব'লে
শুয়ে আছে ক্যামরার ফ্ল্যাশে।
কোথায় পর্যটকের হাসি, গুণিনের সুর থেকে
যারা নিভে যাবে অর্জুন বনে!
আগুনের সন্তাপ বুঝে যে কবি
দাঁড়িয়েছে মোড়ে, বিছানায় টের পাবে সে-ও
অনাঘ্রাত ডালিমের পাশেই ফুটে আছে কামিনীর দাঁত।
---------------
ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান
Nomro Nomrota-কে
.
গভীর অহেতু বলে যে সূর্য শুনেছে চক্ষুপাত
ঐ দিকে বাষ্পকুট রণগ্রীষ্মের ভূমিকায়
তোমাদের শিশুগাছ আড়াল হয়েছে বহুবার।
অথচ হৃদয়, যৌথ মহড়া বৈ তো কিছু নয় !
অ্যাসিডের ভয় থেকে, পিলু-বারোয়ার সুর থেকে
বহুকাল নড়ে ওঠা বিপুল আদল! সেইখানে
এখনো বাতাসে বয়ে যায় সেবিকার ব্যথা। ভাবি,
ঘ্রাণ কি জবার আয়ু ! প্রিয়তর পরিহাস কোনো !
যামিনী লতিয়ে ওঠা মলিন বিভাব নেমে গেছে
অধোগমনের দিকে—
………………আহা জ্বর চিরকাল সেই
অসম্পূর্ণ প্রেমিকার ব্যবহৃত মুদ্রাদোষ! যেন
মাংসলোভী পরার্থের ফল, ক্যালেন্ডার উল্টালেই
চলে যাবে শীত ছেড়ে রঙ করা জাহাজের দিকে !
জানালা খোলার পরও শিশুরা মুখস্থ করে ভোর—
শেষবার ঢেউ এলো বলে ঈষৎ সে জামরুল
ঝুলে থাকে অবিকল—সর্বস্বই অপচয় তার।
ভূমিকা অসম হলে বক্রতাও একরূপ ভাষা—
অথচ প্রার্থনা কুন-ফায়াকুন হয়ে ডোবে নীল,
ডোবে সমুদ্রের স্নায়ুমেঘ সিন্ধুবোরাকের তিলে।
কতনা কার্পাসধুলো ভুট্টা-পাহাড়ের দিকে খাঁ খাঁ—
একদা খিলান রেখে যাই লুব্ধ আশুরার ফাঁকে।
কেননা ইমামবাড়া ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান—
আয়ুর বদলে আজ নেমে আসে মাহুতের স্মৃতি।
সোনালি তামাশা-ঘেরা ক্রিটিকস্বভাব।
………………………
যে পাথর
শূন্যতার চেয়ে ভারি আমি তার রূপকথা জেনে
কঠিন করিনি মানে; কিছুটা আরোগ্য ছিল সুর।
সেই পরা-অপরার ভেক্টর—নিজস্ব ঘাসে যার
লিভারের বন এসে টুকে নেয় পাতার মর্মর—
যেভাবে হিংসার পাশে ফুল এক নীরব দেয়াল!
বায়ুভুক তারাদের সাথে তুমি কথা বলো রোজ
কফিনের কাঠ থেকে খসে পড়ে ছোট ছোট শীত।
এই যে তাসের মুদ্রা, সে কেমন হেলে যায় ধীরে!
যেকোন স্বপ্নেই ছোট হয় দোতলার কিছু ঘর,
হয়তো কাঠের সবটুকু শুধু দরজার নয় !
এসব প্রশ্নের কাছে কেটে গেল নাবিকের গান।
মাছ কাটা হলে গর্ভে শিস দেয় একঝাঁক খুনি—
কখনো, হ্যাঙার সরানোর পাশে মুখের আদল।
যে বাতাস দেয়ালের অন্যভাগে আকস্মিক, আমি
ছুড়েছি ব্যাপক ঢিল, তার মৃদু করবীর নিচে—
ফোটা শেষ হলে বোঝা যায়, নিদ্রাভঙ্গের প্রস্তুতি।
কত দূর উপচাঁদ ভাসে সনাতন তারপিনে।
অখণ্ড শস্যের দিনে যদি ফিরে যাও মনীষায়।
রক্তদ্রোণ, কতখানি ফাঁক থাকে আত্মা ও আরশে !
আদতে সমস্ত রুহ অতিকায় নীরবতা এক—
পথিকভূমির কাছে দুপুরের চিরায়ত খল!
বাতাস যেদিকে গেছে পেয়ারা ফুলের চেয়ে একা।
কে জানে প্রকৃত অবসর নেই তরঙ্গে কোথাও—
তখন আকাশ এক শ্যালোমেশিনের স্মৃতি। যদি
বিদূষক আসে, দিয়ো বারবার ঘনিষ্ঠ সংকেত।
পলাতক ঘোড়ারাও কিছু শ্বাস গোপন করেছে
সন্ধ্যায়। সমাপ্তি এইভাবে বসন্তের অধিকার—
দু একটা অশ্লীলতা বেয়ে যেন পলাশ ফুটছে
যেকোনো ইঙ্গিত দেখো তবু বেজে যায় অবিকল।
নিজের বলতে কোনো বেসমেন্ট নেই হাতিদের
যতটা সমুদ্র হয় নুন অন্ধ রিফুজির কাছে।
বোঁটার অসুখ ভুলে এই কীটজীবনের কথা
পড়ে থাক পরাগের পাশে। যে ভবিতব্যের দেশে
অজস্র বাবলা ফুল পাতার নৈঃশব্দ্য ঘিরে একা।
বলো অব্যাহত, কত দূর চির-ওপারের ছাদ!
চলে গেলে শুধু পাল্টে যায় একই জুতোর ঠিকানা—
পুরনো টেবিল ক্লথে বহুদিন আজন্ম সন্তাপ
ছেঁড়া সুতা কতবার নকল করেছে মনোযোগ—
শহরের ওপাশে যে রঙ তার প্রতিক্রিয়া হলো
কিছুতে মিমিক করবে না হাওয়া। ছাতিম, কেবল
একটি ফুলের গাছ; আপামর মাধবী খুনের।
কেন যে মৎস্যের দিকে নিয়ে যায় আসমুদ্র শিস !
ঘোড়ার কেশর থেকে দুয়েকটি মুকুল ছিঁড়লে
উড়ে যায় পারাবত—দ্বিধাহীন খলপ্রকৃতির।
যেসব ময়ূর খুব অবহেলা করে পেখমের
সর্বত্র মৈথুন ঘিরে তারও বাকি ছিলো চক্রবাল।
একটি পাখির মধ্যে তৈরি হয় আরেক পাখির
ভাষা—যেন বুদবুদ করে ব্রিজ। যেকোনো সাদায়
মেয়েরা অব্যর্থ নার্স—
…………… শেষাংশের ভূমিকা যেমন
মৌল আকাশের নিচে শিশুদের অবতল ধাঁধা।
গাছ ও পথের মাঝে কোথাও শূন্যের খেলা নেই
যতটুকু ফাঁকা তার সবকিছু রপ্ত করে হাওয়া।
একান্ত আয়ুর পাশে উড়ে যায় একজোড়া ঘুঘু।
বিনীত অশ্বের মাঠ, আজ এই বাগানের কাছে
অন্ধের ডিলেমা ছিল সারাদিন পৃথ্বীরাজ ফুল।
উড়ন্ত দৃশ্যের দিকে যে হ্রেষা, তারাও সুলতান—
কীভাবে সে বনতল ভ্রান্ত এক তারার উন্মাদ—
মরিচাবিহীন রোদে কত ফুল ফুটে গেছে পাড়া।
হা-ঘরে পশম হয়ে বাঘিনীর জুল জুল চোখ
কথা বলে স্নায়ুতর মেঘে; না বাগান কৌতুহলে
থেমে যায় শোরগোল। কোনো এক সাদামাটা রেখা,
এ দুপুর মনে হয় দুধ বেয়ে ভেসে ওঠা সর।
পাতার বিভূতি ছেড়ে একদিন মুকুলের স্বাদ
পড়ে থাকে রসাতল; যেন ধ্যানবিমানের ছায়া
শ্বাসের ওজন ঘিরে হে নিরর্থ নয়নাভিরাম
নিখিল পিস্টনে ভাসে অকস্মাৎ কেন্দ্রাতিগ রুহ—
আজানুলম্বিত সেই ঘোড়াদের ডানা কথা বলে
পত্রালাপে। সেই সব আফিমের ছায়া, যার বেধ
উড়ন্ত হ্রেষার দিকে লীন— দুটো হাঁস হেঁটে গেলে
আমরা ভেবেছি শুধু কোথাও সমুদ্র নেই আর।
মানুষ যতটা দূরে যায় সে তার ছায়ার চেয়ে
বেশি নয়। ভাগ্যহীন জলাশয়ে অতিরিক্ত ঢেউ
যেভাবে হারায় ছাঁচ—
……………………তবু এই বসন্তমর্মর—
যে হাওয়াচিত্রের দেশ পেয়েছি শ্রাবণী সন্ধ্যাতীরে।
অজস্র ময়ূর ছিল সামান্য ফুলের দ্বিরালাপ—
কখনো জিজ্ঞেস করো তাকে নৈশপ্রহরীর গানে
‘তুমিও কি সাইকেল-চেপে এলে এইবেলা ?’ দেখি
গ্যারেজের পাশে দিব্যি হেঁটে যায় ঘন রাজহাঁস
ট্রমার ভেতরে তার ক্ষুব্ধ ত্বক। ইঙ্গিত এমনই
কেবল সুপুষ্ট হোক দুধ। চিরছদ্মবেশ খুলে
কে আর অধিক চাল দেয় ঘোড়া, যাতে বোঝা যায়
মানুষ মুখের চেয়ে তার ঢঙ বেশি ভালোবাসে।
-----------------
মীনগন্ধের তারা [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮]
বৃহস্পতিবার
(তুহিন খানকে)
শত- রঞ্জি ছিল ধু ধু
তুমি চাল দিলে নির্জনে
আমার নিজের তারাটিকে
ঘুরি ঊর্ধ্ব-আকর্ষণে—
যাও মধ্য-দুপুর তামা
আমার অন্ধ আকরিক
দেখি পেরিস্কোপের ছায়ায়
ভেসে যাচ্ছে সারাদিক—
হাঁটে রাস্তা তোমার পায়ে
দাও স্পর্শ-পারাপার
গ্রীবা বাড়িয়ে দিয়ে তারা
শোনে ধূলিতে শীৎকার—
দূরে সুইংমেশিন বাজে
কী যে তোমার উপস্থিতি!
মৃদু বর্ষাকালের দিকে
ভাসে সুইসাইডের স্মৃতি
তুলা বাতাসে উড্ডীন
এই অহেতু চিৎকার
আমি- তুমির মধ্যখানে
ওড়ে বৃহস্পতিবার
তুমি, বোঝার আগেই ভাষা
ভাবি, অর্থ কতটুকু!
বাজে অনর্থ রঞ্জনে
বড়ে গোলাম আলির খেয়াল
যেন দাঁড়িয়ে আছে দূরে
ভাঙা এতিমখানার দেয়াল
গত জন্মে দেখা টোল
আজো কাঁপছে তোমার শ্বাসে
আমি সামান্য মৌমাছি
এক স্ত্রী ফুলের পাশে
হাওয়া রাত্রি-পরাঙ্মুখ
যেন জিরাফ সারি সারি
নামে ধাতব নগরীতে
শুনি কণ্ঠতে পায়চারি
তোমার চুপ থাকার অর্থকে
ভাবি পাখির জটিলতা
পাতা হাওয়ায় উড়ে যাও
প্রিয় হাজার নীরবতা
যাও লুব্ধকে মর্মরে
আমি ত্রস্ত করণিক
আমার তাকিয়ে থাকার দিকে
তুমি অপার আপেক্ষিক
যেন ফুলের শাদা ভাষা
এই ঘ্রাণের শীৎকার
আমি- তুমির মধ্যখানে
ওড়ে বৃহস্পতিবার
তুমি, বোঝার আগেই ভাষা
ভাবি, অর্থ কতটুকু!
নুয়ে পড়ছে ফলের ত্বকে
রোদে সান্দ্র খোঁপার ভারি
তিত- পুঁটির চোখে ডোবে
জলে তোমার বাড়াবাড়ি
আত- তায়ীর সুরে রাত
বেঁধে কণ্ঠে এ কোন মিড়
আমি তোমাকেই শুয়ে শুয়ে
হাঁটি বিস্মরণের তীর
তবু ফুরায় না সেই নদী
খাঁখাঁ চারণ-ভূমি-পাড়ে
জাত সাপের ফণা দোলে
এই শ্যেন-অন্ধকারে
আজ অসুখ ভরা দিন
আজ ট্রেনের দিকে যাওয়া
খোঁপা খুলছে ঘন রোদ
পরে জারুল ফুলের হাওয়া
ভাবি অন্ধকারের চোখে
বাঁচে সানাই বহুদিন
আমি ধূলিতে প্রাণপণ
ক্ষয়ে যাচ্ছি মনোলীন
শুনি ক্লান্ত রোদের পাশে
লেবু ফুলের হাহাকার
আমি- তুমির মধ্যখানে
ওড়ে বৃহস্পতিবার
তুমি, বোঝার আগেই ভাষা
ভাবি, অর্থ কতটুকু!
ঢেউয়ে হাঁসের ভঙ্গিমা
যেন তুলার বাগান দোলে
একটা হাল্কা বিকেল বেলা
হেলে পড়ছে তোমার টোলে
জমে লোহায় বিষণ্নতা
এই জানলা-খোলা শীতে
তোমার সমস্ত রোলকল
ভিজে যাচ্ছে যে বৃষ্টিতে
এই রাস্তা পাথর-ফাঁকা
পিচে মরীচিকা জ্বলে
যেন দৌড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়
মায়া হরিণ সদলবলে
ঘোরে টারবাইনের হাওয়া
দূরে ঘাসের দিন যায়
জানু অব্দি পাখির ছায়া
খুঁজি ভাষার বক্রতায়
এসো কালশিটে দাগ, এসো
পরা- ভূমির এই লোকে
পাকে জামের বনে ছায়া
ধীরে ঘূর্ণায়মান শোকে
এসো চাকরিরত দিনে
আমার অন্ধ সারাৎসার
আমি- তুমির মধ্যখানে
ওড়ে বৃহস্পতিবার
তুমি, বোঝার আগেই ভাষা
ভাবি, অর্থ কতটুকু!
---------------
মিডল ক্লাস
রুম্মানা জান্নাত-কে
*
ছাতা তুমি হারিয়ে ফেলো, শুধু
বৃষ্টি নামে বাইরে অকস্মাৎ—
হিপোক্রিসি ভরা এ মৌসুমে
পশুর লোমে গড়িয়ে পড়ে রাত—
যাচ্ছে ভেসে রুবাইয়্যাতের শের
মিডল ক্লাসের অহেতু সব ছবি
এইখানে মেঘ নামছে মূহুর্মূহু
তোমার প্রিয় হারানো মসনভি—
এখন তুমি সহজ পাতা, ভেজো
এখন তুমি প্রসঙ্গত লীন
লোকাল বাসের জানলা ভাঙা সিটে
ঝাপটা আসে প্রতিধ্বনিহীন—
--------------
রু
*
যদি না তুমিও ফিরে আসো এই পথে
এর ধুলাবালি ছেঁড়া স্যান্ডেল-পাশে
পাকার যেখানে গমখেতে সূর্যেরা
কাকতাড়ুয়ার আত্মা কাঁপছে ঘাসে—
তরমুজে লাল ছড়িয়ে পড়ছে রাত
বাতাসে মদের আকণ্ঠ দ্রাব্যতা
নারিকেল সারি চরছে জোসনা ভরে
মেশে দিগব্যাপী বিন্দু ও পরমতা
বনের মধ্যে একেকটি লাল ট্রেন
মনে হয় কোন জিরাফের উৎকণ্ঠা
ঘুমের চূড়ায় গির্জার প্রাচীনতা
কুয়াশা পেরিয়ে ভেসে আসে দূর ঘণ্টা
তুমি কি মনের পড়ে যাওয়া বিব্রত
অনেক কালের মুদি-দোকানের ঋণ!
চাঁদকে এখানে পোড়ানোর কৌশলে
রাত্রির দিকে ছুড়ে দিই কেরোসিন—
বিবাহপথের কত দিন তুমি ছায়া
মাঠে পড়ে আছে সহমেয়েদের গীতি
বালির শঠতা ঝরে গেছে কেয়াবনে
পাথর ফেরে নি ফিরে আসে বিস্মৃতি—
-------------
শাহানা আপা
১
সন্ধার দু তিন বিঘৎ পরেই শাহানা আপার চোখ
সেখানে লণ্ঠনঝড়ে
অজস্র উড়ছে পারাবত—
বিশ্রুত হিংসার পাশে সেটুকুই পরিত্রাণ
২
শাহানা আপার সাথে রোজ কথা হয়
জামগাছটির—
সেখানে ভ্রমর বসে গ্রহণীয় করে তোলে ফুল!
কোনো এক সাইকেলঅলা আতার বাগানে ঢুকে
ভুল করে শ্রাবণ!
যেন এক গাঙের ডাহুক তার বৃষ্টিতে ফেলে যায় ওড়া
আপা,
অয়নপথের ছবি আঁকে—
মাছের পেটির পাশে যে সকাল বস্তুত
তুলাবন—
পাতাদিন স্রোত আর ঝোলমাখা হাত নিয়ে
শাহানা আপা কবুতর ডাকে
আ আ আ আ...
৩
দুপুরের সাইকেলঅলা কোনোদিন এ পথে না এলে
আপা প্রার্থনা করে জানের সদকা দিয়ে—
যেন উঠোনের শিমফুলে হেলে থাকে রোদ!
অবশিষ্ট বাউলের দেশে
আপা গান হয়ে, দধির ঘনত্ব হয়ে নেমে আসে কবুতরবনে—
কয়েকটি শিশু-জাম তাকিয়ে থাকে দাওয়ায়!
এইসব গার্হস্থ্যদিন কুরুশকাঁটায় বোনে
শান্ত সোয়েটার—
শালিক-ব্যাথার পাশে আমাদের বোনগুলো
খুলে রাখে দুল!
এখানে বৃষ্টিকে ডাকা হয় কার্পাস বলে—
৪
ও গাঁয়ের বাতাস এইপথ থেকে পাতা নিয়ে গেলে
কেমন অচিহ্নিত হয়ে পড়ে দিক—
আপা দাঁড়িয়ে থাকেন পাঁচ কালেমার ভীড়ে!
গোধূলির আলো চেটে কয়েকটি ষাঁড়
ফিরে আসে বাড়ি—
মাগরিবের শূন্যতা ঘিরে কেবল শাহানা আপাই ঢেউ
যেন ধুধু এক মাঠ
আপার জায়নামাজ ভরে যায় বরুণ ফুলের ডাকে!
এইসব পত্রমোচী বন নিয়ে আসে বেহাগের ধ্বনি—
চৌকাঠ পার হয়ে আপা শুনতে পান
প্রকৃতিপুরুষরূপী এক হাওয়া সারারাত ডেকে যায় বনে!
পূরবী-স্নানেই পড়ে আছে আপার বয়স—
৫
আপা চলে গেলেও
আমাদের ধানক্ষেতে পড়ে থাকে বিবাহের গান—
-------------
সংকেত
*
চিরকাল বসন্তের বাইরেও কিছু ফুল ফোটে—
-------------
পারাবত
৩
বাতাস কাঁদে না ফুলের অমঙ্গল হবে বলে—
--------------
চাকা
*
আমার শরীর বেয়ে সন্ধ্যা নামছে প্রতিদিন
দূরের আড়তে কয়েকটা মাছ
ভেবে যাচ্ছে জলজীবনের কথা—
---------------
পানাহ্
(সোহেল হাসান গালিব ভাই-কে)
.
পানাহ্ এই রাত, কণ্ঠহীন আলো—
পানাহ্ এই চোখ, অস্তমান শামা—
বালির তরঙ্গে যে বাঁশি নিভে গেছে
অর্থময় খাদে সৌরকণিকায়—
প্রতিটি ফুল তার বক্রতায় ফুটে
বাতাসে ছুড়ে দেয় ঘ্রাণের জটিলতা
তবুও অন্ধেরা শূন্যে চিরকাল
তিলোত্তমা ভেবে শুনেছে নির্বাণ
তাদের তন্দ্রায় একটি বৃশ্চিক
হাঁটছে মিউকাসে, পোড়ায় মেমব্রেন
কেন যে পাতাগুলো কাঁপছে চোখ-ভরে
প্রতিধ্বনি ক্ষয়ে পাথরে যায় দিন—
লাকুম দিনুকুম ওয়ালি ইয়া-দিন—
পানাহ্ এই হাওয়া, ঘূর্ণিসমবায়—
পানাহ্ এই বন, মর্মপরিধির—
নৈশ-মালগাড়ি কাউকে ডাকে দূরে
গূঢ় তুমি আজ লোহায় টানো ঢেউ
ফেনায় সম নীল ফুঁসছে পৌরুষ—
অদূরে ট্রেনগুলো বিষণ্নতা ঘিরে
ছড়ায় রাত্রিতে ড্রাগন এক ঝাঁক
নিরুত্তর বন পাতার অস্ফুটে—
হাঙরে আধ-খাওয়া জোছনা-মাছটিকে
বিঁধছে শিকারিরা অমৃত বর্শায়
মৌন ব্যাধ শুয়ে এ মাঠে দহলিজে
ভাবছে ধমনীতে সাঁতরে যায় মীন—
লাকুম দিনুকুম ওয়ালি ইয়া-দিন—
পানাহ্ এই মুখ, মলিন আশরীর—
পানাহ্ এই স্মৃতি, রেণুর মর্মর—
অহেতু এইখানে মৃত্যু-সংঘের
প্রতিটি হাসি যেন ব্যক্তিগত ছাঁচ
ঘাসেরা টের পায় হরিণ শুয়ে আছে
অনেক কাল ধরে ছায়ার ঈর্ষায়—
কিছুটা পাখি তুমি কিছুটা তনুভরা
দিঘির কূট জলে নিভৃতে সন্তাপ
ব্যাকুল দীপাবলি নিভছে সৌরভে
একটি ঘোড়া এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রোজ
পেছনে সূর্যেরা তামাটে বিস্ময়ে
গলছে গমক্ষেতে অন্ধ-অবলীন—
লাকুম দিনুকুম ওয়ালি ইয়া-দিন—
পানাহ্ এই প্রাণ প্রবল বর্তুল—
পানাহ্ এই নীল শীর্ষে উড্ডীন—
ঝঞ্ঝা-আপ্লুত তৃণের ক্রন্দন
লৌহ-দ্বার ভেঙে তারায় সারারাত
পাঠায় সাইরেন মূকাভিনয় ধরে
সেসব আলোঝড়, হরিণ-পোড়া শিঙ
স্বপ্নে ভেসে আসে গভীরতর স্রোতে
শূন্যে নাবিকের ডুবছে পাটাতন—
হে ঢেউ-কারাগার, নিরর্থের স্মৃতি
তোমার অধিমূলে এ কোন মনীষায়
বাতাসে শিলীভূত তারায় আজো দেখি
মৃত্যু ভেঙে যায় পরম্পরাহীন—
লাকুম দিনুকুম ওয়ালি ইয়া-দিন—
পানাহ্ এই জিভ মাংস-অভিশাপ—
পানাহ্ এই ভোর নীরব রেণুটির—
কেন যে বনতল নপুংসক ফুলে
সৌরকাল-দূরে ভাষায় সঙ্কেতে
জেগেছে বিস্মৃত শূন্য পরাদিঘি—
যেন সে মল্লিকা ঘামের বহুদূরে
সন্ধ্যা-কলোনির বাইরে ফুটে আছে—
গমের ক্ষেত ঘেঁষে তারার জলাশয়ে
তুমিও দেখেছিলে অস্ত-বিকিরণ
সে ছায়া বাঁশবন হারিয়ে চলে যায়—
তাদের ধূলিকণা সহিস পিঠে নিয়ে
লুপ্ত মর্মরে ছড়ায় মরফিন—
লাকুম দিনুকুম ওয়ালি ইয়া-দিন—
পানাহ্ এ-স্তন সমূহ মৃদু তিল—
পানাহ্ এই কূট সুগোল প্রতারণা—
তীক্ষ্ণ রাত্রির গভীর বল্লমে
যে বিষ দুরারোহ অহেতু বাঙ্ময়
শঙ্খচূড় সেই আমূল সাপিনীরা
ছোবলে হেলে দেয় গরল পরাভব
অথচ অশ্বেরা হ্রেষায় উদগ্রীব
বোঁটায় ফুলে ওঠে হেঁয়ালি-চিৎকার
দৃশ্য ভরা এই প্লাবিত করপুট
দু’মুঠ খুললেই হরিণ দৌড়ায়
তবুও ধ্যান তুমি ব্যাপক প্রজননে
শুনেছ রৌদ্র ধাতুর অমলিন
লাকুম দিনুকুম ওয়ালি ইয়া-দিন—
পানাহ্ এই ঘাম গোলক রসাতল—
পানাহ্ এই রুহ-চূর্ণ ধুপছায়া—
কতটা কাছে এসে একাকী জংশনে
দেখেছি রাশি রাশি মৃত সে সাইরেন
উড়ছে আঙুরের দৈব-বিভ্রম
এ কষ-রসায়ন কেন্দ্রাতিগ টানে
সহসা লুপ ঘুরে শীতের অবকাশে
বাঁচার ফাঁকে ফাঁকে কিছুটা ভাঁড়ামোয়
তুমিও পেয়ে যাবে ডাউন ট্রেন একা
বিকেলে একদিন গূঢ় বন্দরে,
কোমল ঝুলে থাকা আত্মহত্যায়—
আদতে ফুলগুলো বাতাসে ভালগার
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ পদধূলি তীর্থযাত্রীর—
পানাহ্ কার্পাস হাওয়ায় ফুলে ওঠা—
তুমি কি আমাদের পত্রঝরাকাল
অ্যাসিডে দ্রবীভূত নীলিমা-আকরিক!
একদা হুইসিল ঘুঙুরবন হয়ে
পায়ের অনটনে বেজেছে সন্ধ্যায়
একটি ফাঁকা রোদ গানের কণ্ঠতে
নির্বিকারভাবে ঢুকছে প্রতিদিন—
সুপেয় খাঁড়ি বেয়ে ঘোড়ারা সহসাই
উড়ায় পাটাতনে তন্তু-হ্রেষা তার—
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ লুব্ধক নীলিয়মান ছায়া—
পানাহ্ সিম্ফনি ব্যাপ্ত নীহারিকা—
তারার ধারণায় ঘুরছে টায়ারেরা
বাতাসে জাফরান ছড়ায় বার্নিশ—
ভাষার প্রত্যাশা থেকেও কিছু ফুল
অন্যভাবে ঝরে তখন হিংসায়—
এ চোখ শব্দের বাজায় সোনাঝুরি
যে পথ ধরে তুমি আসতে চেয়েছিলে
সেখানে কণীনিকা রোদের টুকরায়
হাস্নাহেনা ফোটে গ্র্যাভিটি-কম্পনে
আকাশে দমকল রোদের অচেতনে
বাড়ায় মেশিনের জন্ম-চিৎকার—
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ আসমান ও তার ফ্যালকন—
পানাহ্ ঘোর রোদে হেলানো কচুফুল—
দুপুর ঝুলে আছে বিদ্যুতের তারে
সূর্যপশুদের আবিল অঞ্চলে
তন্দ্রা-উড্ডীন দুরূহ বাইসন
নেমেছে উপকূলে লুপ্ত বহুকাল—
এখনো সেইসব পাথর-অশ্রুত
রশ্মি ছুড়ে দেয় কেন্দ্র-নীলিমায়—
ছোবলে সমুদ্র ফুটছে মাশরুমে—
প্রাকার-বিস্মিত তুমিও হে নাবিক
ফেনাকে ভুল করো ডানার বিশ্রামে
ভাঙছে নীরবতা অলস প্রোপেলার—
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ এই শিস পাতায় টলমান—
পানাহ্ এই শাদা ধ্বনিত কার্পাস—
তুমিও কত দিন মেহেদি ঝরা বনে
হারিয়ে একাকিনী একটি পাশা-চাল
পাতার ঝরে পড়া সহসা ভায়োলিনে
নাচের মুদ্রা ও আধুলি ডুবে যায়—
অসুখ আমাদের বাসের খোলা সিটে
বিষণ্নতা ছাওয়া দারুণ ভেক্টর—
একাকী মথ কাঁপে আকাশগঙ্গায়
তুমিও এসো এই ঘামের টোল বেয়ে
অদূরে ভেসে যায় শিমুল-পারাপার—
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ এই নাচ আর্ত খনিজের—
পানাহ্ এই হেম সান্দ্র বনবিভা—
কোথাও মহিষেরা সূর্যরশ্মিকে
তাড়িয়ে নিয়ে যায় প্রখর প্রান্তরে
বন্য রাত্রিরা পাহাড় বেয়ে নামে
দোলায় কেশরের ছিন্ন হাহাকার—
তবে কি বল্লম আত্মভেদ ক’রে
পৌঁছে যাবে দূরে ডানার তন্দ্রায়
ভাষাও সন্দেহ—আস্থাহীন সাঁকো:
অপব্যায়বোধে কাঁপছে মোহনায়
তবুও ফিরে এসো স্রস্ত খনিতটে
ফেনায় ভেসে যায় ভৌত-শীৎকার
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ এ দুপুর তসবি গণমান—
পানাহ্ জংশন খালাসি-চিৎকার—
তুমিও কতদিন এখানে গান ফেলে
হঠাৎ চলে গেছ সৌর-স্নান গেয়ে
কাঁকরে শ্যাওলায়, গলানো ফ্যানভাতে
পরিত্যক্ত সে নিদ্রাহীনতায়—
তরঙ্গের মৃত, ফেনা এ সৈকতে
জাগায় দ্রাক্ষার মিথুন-প্ররোচনা
কতটা বালিঘোর টিকিটে ডুবো-ট্রেন
শিশুরা হাত রাখে স্তনের ধারণায়—
পথ কি দেয় শুধু, নিয়েও চলে যায়
বাতাসে বাজে ধুধু শূন্য রাংতার—
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ দহলিজ কাঠের গান ভরা—
পানাহ্ কড়িকাঠ গর্ভলীন ধুলা—
সূর্যে উন্মূল কাঁপছে মার্কারি
বর্গাকার রোদে একটি পিস্টন
দেখছে সাপিনীর ছোবলে কালো শিস
ফুটছে করবীর গর্ভাশয় বেয়ে—
তুমি কি ফিরবে না তুমুল শঠতায়
আহত ফলটির পচার অধিকারে
অথবা কসমস ফুলের যৌনতা
অহেতু ভেসে যায় যুদ্ধ-প্রস্তাবে—
হ্রদের তলে একা সৌম নীল ঘোড়া
উড়ছে মৃদু ঢেউয়ে শান্ত কেশ তার—
ইন্না শানিয়াকা হুয়াল আবতার—
পানাহ্ বাতাসের কেশর-ভঙ্গিমা—
পানাহ্ কিংশুক ক্ষীপ্রগতি বাজ—
ঘাসের রুহ থেকে অন্তরীপ ছেড়ে
মেরুর উজ্জ্বল সারস ডুবে যায়
আমরা পেয়ে যাবো কীর্ণ বীতশোক—
পুরনো গির্জার শান্ত চৌকাঠে
একটি বুনোফুল ভাবছে কূটাভাস—
গোধূলি লাল বল শিশুরা কোলে নিয়ে
হয়তো উড়ে গেছে না ফেরা দ্রাঘিমায়
কেউ কি আমাদের করবে জিজ্ঞাসা—
‘এখানে যাত্রীরা উইন্ডমিল ধরে
গমের ক্ষেত দিয়ে কোথায় চলে যান’
অ্যাওমা তামুরুস-সামায়ু মাউরান—
পানাহ্ এই ভাষা জন্ম-সয়ম্ভু—
পানাহ্ এ আয়াত আরক্তিম বাঁশি—
এ মাঠে কান্তারে যে তির সহোদর
কে তাকে তুলে নেবে পরাঙ্মুখ স্রোতে
একটি মাছ এসে ক্রন্দসীর নিচে
দেখছে রেণুওড়া পানির আত্মায়
দুপুর ভরা ধুধু প্রগল্ভতা নিয়ে
পাতারা মনগড়া উড়ছে পরিখায়
তবুও এসো তুমি শুশ্রূষায় ভিজে
পাকছে জলপাই ঊষার আলো লেগে—
আমরা এইভাবে নিহিলিজম ধরে
ভাবছি প্রতিদিন অহেতু নির্বাণ—
অ্যাওমা তামুরুস-সামায়ু মাউরান—
ফাইন্-না মাআল উসরি ইউসরা
ফাইন্-না মাআল উসরি ইউসরা
---------------
আনোখা নদী [তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৮]
আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব
*
শরৎকাল এলে দুনিয়া বহুদূর
অহেতু নিয়ে আসে শূন্য বুধবার
নানিকে দেখি একা হাঁসের বন ধরে
কোথায় হেঁটে যায়—সে দেশে-দ্রাঘিমার
মাঠের সন্ধ্যা কি কখনো ব্যথা ঘিরে
পুরনো চকিটাতে ঘুমায় সহজিয়া
সে দেশ মিদরাসে—? আনোখা নদীতীরে—?
যেখানে আয়াতুল কুরসি লেখা পাতা
জামের নয়া ফুলে ছড়িয়ে পড়ে আয়ু
রঙীন হাঁসিনীরা তারার শিস গুনে
পেরিয়ে ধুলাপথ সান্দ্র হেমবায়ু
কোথায় চলে গেছে, নানিও নিশ্চুপ—
আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব—
নানাকে দেখি নাই মামাও মরে গেছে
এমনি শরতের বৃহস্পতিবার
কসকো সাবানের গন্ধ উড়তেছে
নিমের ফুল ঝরে সফেদ জানাজার
তামাটে সন্ধ্যায় নানির ছোট ঘরে
টেবিলে হারিকেন বিষাদে আলোহীন
একটা শিশি ঝোলে স্মৃতির মতো করে
আকাশে জ্বল ওঠে বাকির কেরোসিন
জামের নিধু বনে সেসব হাঁসেরাও
লালের পায়ে পায়ে বাজছে সন্তুর
সে দেশ মায়ারোদে—? কেনানে ছোট গাঁও—?
খালারা আসে নাই তাদের বাড়ি দূর—
আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব—
একটা ছোট তাক যেখানে ছিল হাঁস
মার্কা নারিকেল তেলের কৌটাটা
অতীতকালে এক ভোটের ব্যবহৃত
ধূসর পোস্টার রয়েছে ঘরে সাঁটা
মাটির চুলা খাঁ খাঁ আমাকে ডাকবে না
তারার খুলি থেকে একলা হয়রান
হাঁসের বনে কেউ সুদূরে চলে গেছে
সে দেশ পারথিয়া—? ন্যুব্জ খোরাসান—?
আম্মা বসে আছে লাউয়ের পাতা বুঁটে
আকাশমণি ফুলে হীরার শিশিরেরা
কাঁপছে রাতভর অমরাবতী যেন
এ মাঠে শুয়ে আছে নানির গন্ধেরা—
আম্মা মেজো মেয়ে, আম্মা কাঁদে খুব—
----------------
রসায়ন
*
বাড়ি ফুরোলেই আব্বা চিঠি লেখেন
আগের প্রেমিকাকে
এ নিয়ে মার কোনো অভিযোগ নেই
মা চুল বাঁধতেই তেলের কাছে জমা দেন
সমস্ত দুপুর
ঘর জুড়ে দেশলাই-বিকেল
কেটলিতে পোড়া ঘাম
আঙিনায় ভেজা শাড়ি হেঁটে গেলে
শিউরে ওঠে ধান
-------------
এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে
(ঢাকাপ্রকাশ, ২০১৮; ২য় সংকরণ, ঐতিহ্য ২০২১)
আঠারো সাল
*
যখন আমার
চোখের পাশে
বাড়ছে ক্ষত
ফুল তখনো
ফুটছে মাদারচোদের মতো—
-----------
সুরা ইয়াসিন
*
কোনো সন্ধ্যায়, কারো সঙ্গের
ছাতাতলটায় এক পার্শ্বে
তুমি হাঁটছো একা শরীরিণী
পাশে যেই লোক, ভাবো, ‘কার সে—!’
তুমি সঙ্গ ও নিঃসঙ্গের
টানাপড়েনেই ভাবো কই যাই—!
ভাবো, এই সময়েই ছোট কৌটায়
মা খুঁজতেছে ভেজা দেশলাই
বাবা রিটায়ার্ড বাবা ক্লান্ত
সুরা ইয়াসিন ঝোলে দেয়ালে
দূরে শাদা ফুল ধীরে কালো হয়
চাঁদে মুখ দেয় কত শেয়ালে—
তুমি ছিঁড়ে যাও কূট হিংসায়
দম্পতিদের ফাঁকা কাপটায়
শাঁ শাঁ চলে যায় কারো গাড়িটা
তুমি মেখে যাও কাদা-ঝাপটায়—
ভাবো, অহেতুক এই বৃষ্টি
বেনী চুয়ে চুয়ে নামে সন্ধে
কোনো চুম্বন পৌঁছায় নি
আজ অব্দিই হৃদপিণ্ডে
এই নীলক্ষেত: খোপ-পায়রার
জল ছলছল ডুবো দোকানীর
দুই চোখ যেন এই দেশটাই
ধনধান্য ভেসে অস্থির—
ক্রমসংকোচে তুমি গুটে যাও
আসে মাৎস্যন্যায়ে ভরা দিন
দূরে বুলবুল কাঁপে সন্ধ্যায়
মার ঠোঁট জুড়ে সুরা ইয়াসিন—
---------------
বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে, তুমি ভিজবে না
*
বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে
তুমি ভিজবে না, না, খুঁজবে না
ছেঁড়া স্যান্ডেল নিচে নামবার—
ছাদে শুকনা কাপড়,
বড় মাদরাসাতে একা তালেবে এলেম
মোছে বোখারি শরিফ
তার জানালাপাশে দোলে আরশি, বেতের—
আজ শাওন মাসের কত যাচ্ছে তারিখ
সে কি ভাবছে তা-ই—!
ভাবি, তোমার পথে
যত দৃষ্টিবকুল ফুটে তুলবে ভুলে ওই তালেবে এলেম—!
তুমি দেখার ক্ষুধা হয়ে জ্বলো না, মানিক!
সে কি খুৎবা পড়ে দূর শুক্রবারে
নাকি মুয়াজ্জিনই খালি, কোনো মসজিদে—!
তুমি জানো না কিছুই, ভাবো ছাত্রটিও
এই বর্ষাদিনে কেন জানলা খুলে
আছে দাঁড়িয়ে একা, ছাদে পায়রা দুটি
শাদা পাখনা মেলে
দোঁহে ভিজছে হাওয়ায়, ফাঁকা জলকেলীতে—
ভাবো নীরিহ এসব ছবি বর্ষাকালে
তুমি জানো না সোনা—এরা দৃশ্যভিলেন—
তুমি বেরিয়ো না যেন—
শোনো, রাস্তা খুড়ে কারা পালিয়ে গেছে
ধু ধু ভ্যানের উপর কোন স্ত্রীটি আজ
তার স্বামীর শরীর
ছেঁড়া ছাতা জড়িয়ে
ঢেকে রাখছে বুকে—তার লিউকোমিয়া,
তার চোখের নিচে
কোন বিপন্নতা কাঁপে বর্ষা জুড়ে—
কূট ছিন্ন কদম, নবজলধারাটির
আজ যাচ্ছে ধুয়ে
ওই ভ্যানের নিচে—
ফ্যাসিবাদের এসব ক্রুর স্বর্ণযুগে
তুমি জানতে পাবে
কেউ, কারোর পাশেই, দেখা বৃষ্টি ভিজে
পারছে না দাঁড়াতে—
রু—
বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে
তুমি পুলিশভ্যানের পাশে
এসে দাঁড়ায়ো না—
দেখো, কামরাঙাটির ফুল
ভেসে যাচ্ছে,
অজস্র মৃত্যু চোখ চুয়ে তার—
----------------
রুম্মানা জান্নাত
*
রুম্মানা
এই তো আমার যত্নে পোষা রেখা
হারিয়ে যাওয়া হাতের করতল
বাড়ির পাশেই অন্ধ লেবুর গাছ
পালিয়ে গেলো বৃষ্টিছাটের পর—
এই যে তোমার দূরের কাছে যাওয়া
দরদ-ভরা হাওয়ায় আবির্ভূত
নিমের ছায়া জড়িয়ে ধরে পাতা
টান মারে কেউ অনেক কালের সুতো
তখন শুধু গড়িয়ে পড়ে হাওয়া
তখন শুধু গড়িয়ে পড়ে জ্বর
রাংতা ছাওয়া অন্য কোনো মাঠে
এখন তুমি অনেক প্রিয়তর
জান্নাত
লোহার বাতাস কাঁপছে যে বার্নিশে—
দাহকালের প্রচণ্ড এক ক্ষত
এখন তোমার অনেক দিনের ধুলা
আসছে উড়ে হঠাৎ প্রসঙ্গত—
ফলের দিকেই তাকিয়ে পাকে পথ
চোখের দূরে কে আর ছিল কবে
এইখানে গিঁট আধো-মলিন সুরে
ডুবছে ক্রমে ঢেউয়ের উপদ্রবে—
অন্ধ ছিল পাখির কাছে ধান
তোমার দিকে নিরর্থ এই ওড়া
মৌমাছি কি জানতো আগে থেকেই
ফুলের পাশে ফুটছে চন্দ্রবোড়া!
-----------
যোগাযোগ
*
মেয়েদের বিয়ে হলে পাড়ায় ওই নামে আর কেউ থাকে না—
------------
পূরবী
*
এখানে নদীর নাম জলমিতা
এখানে আকাশ নীল বহুদিন
এখানে ভেড়ারা চরে সারাগ্রাম
এখানে তোমার মুখ কী মলিন!
তুমি কি সজনা ডালে পাখিটার
বাঁকা সে ঠোঁটের পাশে নদীতীর—!
জানি না কোথায় তারা চলে যায়
শূন্য চিরটাকাল মন্দির—!
তুমি কি আসবে বঁধু, আমাদের
আত্মজীবনী ভরা সন্ধ্যায়
হাওয়াই মিঠাই যেন এ সময়
ধাতব শীতের মনোবেদনায়—
এখানে তোমার দিন সহজিয়া
এখানে মেঘের নাম মালহার
এখানে ভেড়ারা চরে দিনমান
হাওয়ায় পূরবী কাঁপে সন্ধ্যার—
-------------
দূরত্ব
*
মানুষের দেখার থেকেও পাখিরা অন্যরকম—
-------------
কারবালা
*
চারদিকে বনমুহুলির খেত—কামারজানির দুইপাশে দুই পাকুর দাঁড়িয়ে আছে জলাশয় অতিক্রান্ত হাওয়ায়—সমতল ভূমি আর ভেরেণ্ডা গছের ঊর্ধ্বে যে তারাযাত্রীদল জ্বলে আছে মলিন হ্রেষাধ্বনির আলোয় সেখানে বনপাহাড়ের আদি নিভৃতে ঝরে পড়ছে কাঠগোলের ভাগ্যহীন পাতা—কে চলছে গরুর দড়ি হাতে বুনো ঘাসের শিস মাড়িয়ে বিরল তৃণখাতের দিকে—কী করে জানবেন তিনি বিকাল শেষের এই রজতাভ ছায়ায় নিঃশব্দে কেঁদে চলছে ফোরাতের তাঁবুর ধুলা—এমন অশ্রুপাত যা শুধু সমুদ্রের তটরেখা ধরে ঝাউ-বিলীয়মান সন্ধ্যার বুকে তৈরী করে মুহুর্মুহু নৌ-লীন ঢেউ—
পিতরাজ ফুলের মাঠে গরুকে বাঁধতে বাঁধতে তার মনে পড়ে—হোসাইনের শেষ পানি পানের আকাঙ্ক্ষা, যেন সমগ্র তাইগ্রিস মিঠা পানির আনোখা মেঘের ঝাঁক হয়ে আদরে নেমে আসবে কারাবালায়—পানি আনা হলো, তৎক্ষণাৎ তার চোয়াল রক্তাক্ত করে তির ছুড়লো ইবনে নুমায়র—আঁজলা ভরে রক্ত দেখছেন হুসাইন। তাঁর ঘাড়ে আঘাত করলো যুরআহ, তারপর, কণ্ঠার হাড় ও বুকে বর্শা গেঁথে দিলো সিনান ইবনে আনাস—হুসাইনের মাথা কেটে ধড় থেকে আলাদা করলো সে-ই—মহুয়া ফুলের ঘ্রাণ থেকে যেন কারা বিচ্ছিন্ন করছে অনন্তর বেলাভূমির নিস্তব্ধতা, গমের শূন্য খেতে মাইল মাইল অনুস্মৃতি—
দশদিক উথাল পাতাল বাতাস, চরাচর ব্যপ্ত করে বৃষ্টি আসছে নক্ষত্রপুঞ্জের, যেন কেউ গোরস্থানের থেকে ফিরে হাত ধুতে ধুতে ভেবে নিচ্ছে—‘নবিজি সফর থেকে ফিরলে বুকে জড়িয়ে ধরতেন যাকে সেই শিশুটাকেই হত্যা করেছে তারা’—
দূরে, তরমুজবীথিকার দিকে অনন্তর ভেড়ারা হেঁটে যাচ্ছে ক্রমে—উড্ডীন শান্ত মেঘের নিচে একটা সন্ধ্যা রোদনরত বৃক্ষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে—না কিনার না জলরাশি কিছুই আর অবশিষ্ট নাই—অজস্র পাতার নিচে মচমচ করছে পথিকদলের খোঁড়া পায়ের আওয়াজ, নবিজি ফিরছেন কারবালা থেকে, সঙ্গে ছোট শিশি, যাতে হোসাইন আর তার সঙ্গীদের সুরেলা রক্তের ছায়া তরমুজের লাল অন্ধকারে লোকটা শুনতে পাচ্ছে অনিমিখ তমসার হাওয়ায় যয়নব বিনতে আলীর গুমরে ওঠা কান্নার ধ্বনি—
‘ও মোহাম্মাদ! ও মোহাম্মাদ! এই ধুধুল প্রান্তরে বিস্রস্ত দেহ আর রক্তে ভিজে পড়ে আছে হোসাইন—ও মোহাম্মাদ! আপনার কন্যাগণ আজ যুদ্ধবন্দী আর মৃত সমগ্র বংশধর—পুবের বাতাস বয়ে চলেছে তাদের উপর’
চারদিকে বনমুহুলির খেত—একটা সন্ধ্যা লাল হয়ে ঢুকে যাচ্ছে ডালিমের রক্তরসে—
--------------
মোহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
Hujaifa Mahmud-কে
এখানে কতদিন হিংসায়
গভীর ঢালুপারে নদীটির
জমেছে নীলাক্ষি কুয়াশায়
আমরা শুনি রাত মায়াবীর
আলো ও ছায়াময় নিয়রের
খেলেছে স্বেদবীজ সন্ধ্যায়
চোখের বুলবুলি উড়ে ফের
বসেছে মগডালে, নীলিমায়
ফলের ত্বকধোয়া আলো আর
ধানের দুধভরা রাত্রিতে
দিঘিতে কতদূর জোছনার
বাজছে বিউগল সরণীতে—
তবুও বালিহাঁস ঠোঁটে তার
রোদের সায়োনারা মারে ঝিম
পাথরে বাতাসের মাছরাঙা
নিভৃতে আকাশের নিচে দিন—
ডাকছি তোমাকেই, হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
ফসল চক জুড়ে, বিকালের
আলোয় মুছে গেছে আয়ুরেখা
পাতাই পথ ছিল অন্ধের
ভূয়সী ইতিহাস, হাওয়ালেখা
ছুঁয়েছে সময়ের যোনিমুখ—
শস্য-উড্ডীন এই মাঠে
তারায় অশ্বেরা উন্মুখ
একাকী মহুয়ার আলো চাটে
সময় শুয়ে আছে যেন কুঁজ
যেন সে পাহাড়ের সানুতল
এ গান বিষণ্ন বহুভুজ
শরীরে ভাঙনের হাওয়াকল
এশিয়া বুদবুদ অনায়াসে
মজ্জা পচে গেছে বাতাসের
কণ্ঠে নীল হয় ইয়োরোপ
দুনিয়া এইখানে কী মলিন—
ভাঙছে শূন্যতা হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
তুমি কি আসবে না এই খেতে
যেখানে বৃষ্টি ও পৃথিবীর
কাদায় শুয়ে মেঘ-সঙ্কেতে
মাটিতে ভিজে যায় আশরীর
বটের কষ ভরা এই বাঁক
যেখানে একা পাখি মরে যায়
যেখানে পানিকাউরের ঝাঁক
বিলের স্বেদ ফেলে হতাশায়
কোথাও ওড়ে ঘ্রাণ মৃত্যুর
ফাঁদের বিবমীষা, নোনা ঢাল
ভাবছে সে মরণ কতদূর
কোথায় সতীর্থ, সে বিকাল—!
তাদের তনুভরা কালো রঙ
হঠাৎ ছুড়ে দেয় ভরা চাঁদে
তুষার ঝরে যায় বাঙ্ময়ে
মহা সে সময়ের মেলানিন—
ডাকছে বহুকাল, হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
অশোক-পাতাটির স্বেদ হিম
দুঠোঁটে মেখে নিয়ে সন্ধেরা
শনের আর্দ্রতা, ভেজে ডিম
ডানায় উড়ে আসে ঘরফেরা
যেন সে কিষানির কবুতর
রঙের ধনু হয়ে উড়ে যেত
সুগোল নেমে এসে তারপর
জীবন এইখানে সমবেত
তাদের কথা ভাসে হু হু রাতে
অতীতকাল সেই ঘননীল
কাঁপছে তিরতির আঙিনাতে
মেঘের আলো ঘেঁষে গাঙচিল
একদা গোধূলির নাইলনে
কোথাও ঝুলে আছে হারিকেন
টুপছে নিভু নিভু আলো তার
সূর্য ডুব যায় ধুলালীন—
ডাকছি দিনশেষে হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
সাক্ষ্য গাঙপাড়ে কুঁজা গাছ
সাক্ষ্য ডাহুকের চোখা ঠোঁট
সাক্ষ্য শিশুদের গোল জিভে
মায়ের দুধ ভরা কালো বোঁট
সাক্ষ্য মাধুডাঙা নদীতীর
সাক্ষ্য সজনার ঋজু ফুল
সাক্ষ্য মায়াঢেউ শঙ্খের
মহররম মাসে দুলদুল
সাক্ষ্য দারুচিনি গাছটির
সাক্ষ্য চেলামাছ দওজোড়া
সাক্ষ্য হরিণের চরটিতে
একলা বেঁধে রাখা কাবু ঘোড়া—
কখনো মুদি সেই দোকানীর
পণ্য বেচবার ফাঁকে ফাঁকে
দেখার চোখ নিয়ে কী স্থির
ভালোও বেসেছিল হিংসাকে
অথবা গুল্মেরা দেবে ঋণ
হাওয়া ও মেশিনের ন্যুব্জতা
আকাশে ছড়িয়েছে সারাদিন
যেন এ কারাগার: সফলতা—
মৃতের পৌরুষ ভাবে চোখে
ব্যাকুল জাহাজির নৌপথ
ডুবছে সৈকতে, মীনলোকে
ভাসছে কতদূর দ্বৈরথ—!
ধাতুর শীত জুড়ে চলে যায়
নীরবে ট্রেনভরা হুইসেল
কাছিম শুয়ে আছে রোদপাশে
বাতাসে আলোছায়া কাঁপে ক্ষীণ—!
আত্মজীবনীতে এসো আজ
রাহমাতাললিল আলামিন—
যখন বনতলে দুটো চাঁদ
পাতার নদী ঝরে একাকিনী
বিষাদ এইখানে সারারাত
ছোট সে খাঁড়িটিও দুঃখিনী
স্রোতের মায়াঢেউয়ে মহিষেরা
রাতের ডুবোলীন জলাশয়ে
শুনছে দূরাগত অন্ধেরা
ঘোড়াকে ডেকে ওঠে সংশয়ে
তাদের খুর লেগে আলো ক্ষয়ে
হাওয়ায় পাক খায় সরলতা
আলোর যোনিমুখ সুর হয়ে
বেরিয়ে আসে গান, শূন্যতা—
দূরের খাঁড়িটিও বহমান
সাঁতারে আধোডোবা মহিষের
হাওয়ার অশ্রুতে কিশোরেরা
শুনছে অশরীরী কালো দিন—
তোমাকে ডাকে তারা, হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
এখানে জীবনের বিবমিষা
খিন্ন আহ্লাদে কতদিন
শুনেছে নিখিলের বহু তৃষা
যুদ্ধ ভালোবেসে সীমাহীন
এশিয়া ইয়োরোপ আফ্রিকা
ব্যথায় ঘুমিয়েছে শূককীট
ফসলে মায়াবীর বিভীষিকা
সারাটা হাওয়া জুড়ে মর্বিড
মাথার খুলি ঘোরে সবিনয়ে
অন্ধকার এসে কত কাল
অক্ষিকোটরের ফুটা হয়ে
দেখছে চাঁদ সুইসাইডাল—
মৃত্যু টুপটাপ ঝরে যায়
অন্ধ এস্রাজে দিনমান
কোথাও বোধ নেই হাওয়াতেও
আলোর গন্ধতে কেরোসিন—
তোমাকে ডাকতেছে, হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
আত্মহত্যার এইসব
অনেক আয়োজন এইখানে
সূর্যে হেঁটে গেছে হাওয়ামব
অপার হিলিয়াম সন্ধানে
ভাঙছে জুলকারনাইনের
সিসার তরলিত বিস্ময়
সময় ফুরিয়েছে দেয়ালের
উড়ছে শ্বাপদের কনভয়—
তবুও ফসলের সরণীতে
শান্ত পাকুড়ের ছায়াতীর
নদীর পাড়ঘেঁষা মসজিদে
তুমি সে নীরবতা মায়াবীর
কৃষির ঘাম চুয়ে শস্যতা
দুপুরে শিউলির ঝরা বুকে
ভাতের দানা ঘুম ফেলে গেছে
ঝাউয়ের বনানীতে যে কামিন—
তোমাকে ডাকে তারা, হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
সাক্ষ্য শালিকের ফাটা ডিম
সাক্ষ্য জঙ ধরা এঁটো তালা
সাক্ষ্য কাপড়ের শত ভাঁজে
মায়ের তুলে রাখা হাতবালা
সাক্ষ্য দওপাড়ে বটগাছ
সাক্ষ্য মাতামহী, যত শ্লোক
সাক্ষ্য ঘাসবনে বেঁধে রাখা
গাভিন গরুটির দুই চোখ
সাক্ষ্য বাতাসের জোড়া মোষ
সাক্ষ্য আসরের মোনাজাত
সাক্ষ্য কবরের নিমফুলে
ছড়িয়ে থাকা মাটি, তৃণখাত
সাক্ষ্য দুবলার চরে কাশ
সাক্ষ্য বতুয়ার ঘন রঙ
সাক্ষ্য মসজিদে ঘড়িটির
পুরনো ঘন্টার ঢং ঢং
কিছুই ফেরে নাই, ভেসে যায়
নদীতে শালবন, নির্বাণ
প্রতিধ্বনিময় এ হাওয়ায়
নৌকা বয়ে যায় দিনমান
তাদের দেশ যেন নীলিমায়
তাদের দেশ যেন লুব্ধকে
নদীর ফেনাভূমি বৃথা যায়
অধ্যুষিত জলে কার শোকে
নৌকা যায় ভেসে একা একা
দরজা খুলে ধরে হাওয়ামন
পাথরে প্যাপিরাসে কাল-লেখা
হঠাৎ ভেসে ওঠে তুঁতবন—
কোথাও ঝুলে আছে সারা পথ
ময়লা রবিবার একা তারে
হেমন্তের স্বেদ ডুবে যায়
সুতার কৃষকেরা মাকুহীন—
সে মাঝি, তুঁতবন ডাকতেছে
রাহমাতাললিল আলামিন—
এ মাঠ বহুকাল দণ্ডিত
এ নদী বহুকাল শাপে লীন
এখানে চারু নিশিথিনী মৃত
গুল্মশাসিতেরা মনোহীন
মোহাম্মাদ প্রিয় দরদিয়া
মগজে হো হো হাসে লাল ট্রেন
আগুনে পোড়া জিভে ডাকে হিয়া
বাতাসে শুয়ে আছে অহিফেন
আমার চিরব্যথা আত্মায়
চূর্ণ ক্রমাগত গম্বুজ
সমুদ্রের মদে দিন যায়
নিখিল বিশ্ব কি মহাপুঁজ—!
মোহাম্মাদ প্রিয়, দরদিয়া
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি
আমাকে তুলে নাও মারী থেকে
প্রতিধ্বনি থেকে উড্ডীন—
দরুদ বর্ষিত হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
কুয়াশাক্লান্ত এ ফ্যাসিবাদে
প্রেতের উড়ে যাওয়া সন্ধ্যায়
পালঙবনে কার পাখি কাঁদে
গোধূলি বেজে ছিল মনীষায়
ডিমের আধোভাঙা নীল সুর
বাতাসে, তৃণখেতে গোল হয়ে
পানির আলোছায়া যতদূর
সেখানে ঢেউলীন সংশয়ে
লাইট হাউজের ক্ষীণ আলো
পড়ছে রাত্রির ঘটনায়
হঠাৎ শুশুকের মিশকালো
শরীরে ডুবো চাঁদ মিশে যায়—
একটি মদ আসে ফেননিভ
সূর্য, বাতাসের মন্দিরে
ঝাউয়ের বন আর সৈকতে
রোদেরা কথা বলে ভূ-মুখিন
ডাকছে বালিয়াড়ি, ম্লান ঢেউ
রাহমাতাললিল আলামিন—
ভুবন চিলটির মিঠা ডাকে
সঘন হয়ে আসে এ দুপুর
তারার ঘ্রাণ ছুঁয়ে বিশাখাকে
বাজায় সারারাত সন্তুর
মৃতেরা কোনদিকে চলে যায়!
বনের সন্ধ্যায় থামে ঘোড়া—?
সূর্য-পারাপার নৌকায়
সে দেশ কতদূর, আনকোরা—!
সে দেশে বনেঘেরা তরমুজ
বাতাসে নীল মদ নহরের
উটের ক্রীড়াময় হাওয়া-কুঁজ
চলছে সারি সারি বণিকের
আমার আত্মা কি সেইসব
কুঁজের সঙ্কেত বঙ্কিম
পাহাড়ে আড়ালের ফাটা দাগে
বেগানা চাঁদ যেন প্যারাফিন
জ্বলছে বিস্ময়ে—হৃদয়ের
রাহমাতাললিল আলামিন—
কীর্ণ হয়ে আসে গোলাঘর
পরাঙ্মুখ রেলকলোনির
ছিন্ন টিকিটের মর্মর
আমরা শুনি নি কি ঝরা মিড়!
চন্দনের বনে রাজহাঁস
একলা ডেকে গেছে তনুমন
মিথুন-উদ্বাহু চারপাশ
উঠছে জেগে দূরে তুঁতবন
কাউকে মনে পড়ে দিনমান
শ্রাবণ-বৃষ্টিতে রেডিয়োয়
বাজছে সুরা আলে ইমরান
নিভৃত ঘুমিয়েছে মৃন্ময়
কাউকে মনে পড়ে এইখানে
অথবা দ্রুতগামী মর্মের
বিদায়গ্রস্ততা, অবসাদে
পাতার ঝরা পথে চিরদিন
মোহাম্মাদ, প্রিয় দরদিয়া
রাহমাতাললিল আলামিন
সাক্ষ্য দুপুরের মালিদও
সাক্ষ্য ঘুঘুভরা মেঠো তারা
সাক্ষ্য ভোরশীতে মায়ারোদ
রেহেলে শুয়ে আছে আমপাড়া
সাক্ষ্য কঞ্চিতে মাছরাঙা
সাক্ষ্য জেলেদের কালো গাও
সাক্ষ্য এক ডুবে ধরা মাছ
বাঁশের ফুলে ফোটা সন্ধ্যাও
সাক্ষ্য বেনেবউ পাখিটার
সাক্ষ্য হাতে বোনা ছোট ডালা
সাক্ষ্য বাতাসের রন্ধ্রতে
কাঁদছে হুসেনের কারবালা
সাক্ষ্য ভেড়াদের ঝুনঝুনি
সাক্ষ্য বন্ধুর কাছে ঋণ
মোহাম্মাদ, প্রিয় দরদিয়া
রাহমাতাললিল আলামিন—
--------------
মাধুডাঙাতীরে [২০২০, ঐতিহ্য]
মাধুডাঙাতীরের বিভাব কবিতা
*
তুমি বিনা আমি হই
কীসের যতনে
মন পোড়ে চক্ষু পোড়ে
পূরবী-অয়নে
শতধারা হও তুমি
একলা বৃথাই
ঊর্ধ্বে আছে অগ্নিবায়ু
নিম্নে আমি ছাই
যেই গাঙে পানি হও
ভাসিতে ভাসিতে
আমারে রাখিও মোহ
তার বিপরীতে
তুমি অঙ্গ তুমি শ্বাস
আয়ু-ব্যাতিহার
কোন অক্ষে যাবো আমি
সর্বঅন্ধকার—
---------------
*
তোমার মুখের থেকে বেশি
মহাকাল নাই পৃথিবীতে—
কথ পথ যাওয়া যাবে আর
ডালিম ফুলের বিপরীতে!
সোনাঝুরি বনের হলুদ
ছড়িয়ে রয়েছে এই মাঠে
যেন মায়াহরিণীর জিভ
ঘাসের ভাবনাটুকু চাটে—
সে কোন নিখিল পারাপার
মানুষ দেখেছে বাতাসের
ভাষার অধিক স্বীয় ভূমি
কখনো কি ছিল আমাদের—!
বিষের যে সবচেয়ে কাছে
মনে রাখি মুখটুকু তার
ভরে আছে পাখির ছায়ায়
খালি এক পুরানা ড্রয়ার—
---------------
*
অজানায় থেকে যাও তুমি
পেতলফুলের দেশে ঘ্রাণ
তোমাকে পাবার পথে হাওয়া
শুয়ে আছে নিখিল বিরাণ—
এই শ্বাস রুহ-নিরবধি
তারার বাইরে কূটাভাস
জেগে ওঠে পারুলের ডাকে
ভেড়াগুলো খুরের ভেতর
গোপন করছে লালিমাকে—
এখানে দূরের সাইরেনে
পশুদের লোম ওড়ে রাতে
অন্ধ তারার আলো এসে
নিয়ে যায় ঢেউ পরিখাতে—
তবুও মানুষ কোনো সুরে
বিকালের থেমে যাওয়া নদী
নিজের শিশুর গোল হাতে
রেখে যায় আয়ু-শেষাবধি—
----------------
*
তোমাকে বলার কথাগুলো
অস্থি কাঁপিয়ে যেন জাগে
কাকাতুয়াদের পিছে হাওয়া
উড়ে গেছে বহুদিন আগে
শিউলিতে জ্বেলে দীপাবলি
একদিন মুছে গেছে তারা
মহুয়ার পাপড়িতে চাঁদ
পেঁচিয়ে ধরেছে গোখরারা—
কোথায় সেসব দিনলিপি
ফেরে নি নতুন পারাবত
হারানো জুতায় একদিন
মনে হয় ঘুরে আসি পথ—!
ঋতুর ওপারে নদীতীর
চাল দেয় কী গভীর পাশা!
নিখিল তোমাকে ভেবে তাই
বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাষা
----------------
*
ফুটেছে ফুলের প্রতারণা
চোখব্যাপী থির এই দেখা
গভীর পানির নিচে পাতা
বহুদিন চেয়ে আছে একা
যে মুখ দূরের অধিকারে
ফেলে গেছে শতরূপ, কথা—
একটি ফুলের ঝরা থেকে
ছড়িয়ে পড়ছে শূন্যতা
এখানে সোনার সৌরভে
খুঁজি তার গানের হদিস
ছোবল দেবার পরে কাল-
গোখরা কি ফিরে চায় বিষ!
মাটি তার পুরনো সহায়
পথচারিনীর ছায়াঘরে
শরীরে অসুখ এলে আজো
মানুষের মুখ মনে পড়ে—
-----------------
*
এইখানে সন্ধ্যার রং
পুড়ে যাওয়া করুণ ডিজেল
নগ্ন পায়ের শিশুগুলো
চাঁদকে ভাবছে স্যান্ডেল—
নতজানু পড়ে আছি, ধাঁধাঁ
ব্যাধির গভীরে পরাবই
পথশেষে জংধরা খুঁটি
জেনেছি আমিই কেউ নই—!
বলো তবে সমারূঢ় হাওয়া,
মগজে কাঁপছে হুইসিল—
সেলাই মেশিন এই মুখ
ফুঁটা করে অসহ নিখিল—
কোথাও, হয়তো ঝরে একা
প্রসূতি ফুলের অভিশাপ
বোঝে নি মানুষ কোনোদিন
মুখ তার শেষ এপিটাফ—
-------------
*
মাটিতে এলিয়ে পড়ে রাত
বীতভাব জানালার শিকে
গানের অর্থ ভুলে কেউ
মনে রাখে প্রিয় মুখটিকে।
ঝরে গেছে ঋষভের সুরে
জারুল ফুলের মঞ্জরী
পাতার উপরে সরলতা
তোমাকেও সন্দেহ করি।
এই রাত নুয়ে পড়ে ব্রিজে
গরাদে প্রবল এক নীল
মাছরাঙাদের খালি ঠোঁটে
ফোঁটা ফোঁটা উড়ে গেল বিল—
মৃত্যুর কিছু দূরে, দেখি
প্রশান্ত নৌকাটি বাঁধা
তুমি এক ফাঁকা দেহরূপ
চিরকাল ওপারের ধাঁধা—
-------------
তারাধূলিপথ [২০২১, ঐতিহ্য]
১
ভাবছি, একদিন খুব গভীর পানিতে তলিয়ে গেলাম— তারপর, ধীরে, হিম সেই পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছি—চারপাশে নানান লতাগুল্ম, ফুলের ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে পাখিরা আমাকে দেখছে— একটু নিচেই মাছ—মৃতশরীরের নিচে সাঁতার কাটছে—
সেই অনেক নদীর দূরে কোথাও একটা অশোক গাছ— সেখানে তারারা নিচে নেমে আসে— উড্ডীন তুলাগুলো আমার সাথে সাথে উড়ে যাচ্ছে ঝরা নদীপারের দেশে— কেউ হয়তো আছে যে আমাকে কাঠের গোধূলি দেবে, নদীর মায়াঞ্জন দেবে—
-------------
৩৩
ভাবছি, একদিন তোমার সমস্ত চলে যাওয়াকে মনে হয়, যেন বৃষ্টিশেষে কেউ ফেলে গেছে বাড়ি ফেরার পথ—
---------------
৩৯
ভাবছি, একদিন, প্রাচীন দুপরের নিচে কয়েকটি ভেড়ার সাথে কথা হবে—নদী পার হয়ে কারা যেন চলে গেল রেলকলোনির দিকে! সেসব জানে না তার অমিত পিয়াল—কোথাও, হয়তো পড়ে আছে পৃথিবীর শেষ সাঁকোটির ছায়া—চাতালের জাম গাছ আমাকে ডাকছে অজস্র পত্রসমেত—
ক্ষমা: এক দীর্ঘ দ্বীপান্তর—
চৈত্রমুখর নোনা হাওয়া, তোমার মলিন গীতে আমাকেও রেখো কোনো সুরে: গভীর কাঠের ভেতর যতদূর সরোদের ছায়া—