বাছাই করা সর্বকালের সেরা ৫০ টি প্রেমের কবিতা

 

বাছাই করা সর্বকালের সেরা ৫০ টি প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,

যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।


আমি খুব অল্প কিছু চাই – হুমায়ুন আহমেদ

আমাকে ভালবাসতে হবে না,
ভালবাসি বলতে হবে না.
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ
নিয়ে আমার ঠোঁট
দুটো ছুয়ে দিতে হবে না.
কিংবা আমার জন্য রাত
জাগা পাখিও
হতে হবে না.
অন্য সবার মত আমার
সাথে রুটিন মেনে দেখা
করতে হবে না. কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও
খেতে হবে না. এত
অসীম সংখ্যক “না”এর ভিড়ে
শুধু মাত্র একটা কাজ
করতে হবে আমি যখন
প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব
তুমি প্রতিবার
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে একটু

খানি আদর মাখা

গলায় বলবে “পাগলি”


ভালোবাসি – রেদোয়ান মাসুদ

শুধু একটি বার বলো ভালোবাসি
তোমাকে আর কোনদিন ভালোবাসতে হবে না।
মরুভূমির তপ্ত বালিতেও পা দিতে হবে না।
আমার জন্য তোমকে নিশি রাতে পা ভিজাতে হবে না।
আকাশ বাতাস শুনুক তোমার প্রতিধ্বনি।
সবাই জানুক কেউ আমাকে ভালোবেসেছিল।
আমার হৃদয়ের ডাকে কেউ সাড়া দিয়েছিলো।
শুধু এতটুকুই আমি চাই, এর চেয়ে বেশি চাই না।
কাছে আসো বা না আসো, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
হৃদয়কে না হয় একটি বার হলেও সান্তনা দিতে পারব
কেউতো অন্তত একটি বার হলেও প্রাণের ছোয়া দিয়েছিল।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও শুকিয়ে যাওয়া নদীতে
আবার ঝড়ের বেগে অশ্রুর বন্যা বয়েছিল।
শুধু এতটুকুই আমি চাই, এর চেয়ে বেশি চাই না।
এর জন্য তুমি কি চাও?
হয়তোবা আমি তোমাকে আকাশের চাঁদটি এনে দিতে পারবোনা
পূর্ব দিকে উঠা সূর্যটিকেও হাতে তুলে দিতে পারবোনা।
কিন্তু পারবো তোমার জন্য আমি রজনীর পর রজনী জেগে থাকতে
পারবো আজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করতে।
হয়তো আমার এই শুন্য হৃদয়ে এক সময় কেউ স্থান করে নিবে
কিন্তু তুমিতো আর আমার হলে না।
কি হবে ভরে এই শুন্য হৃদয় ?
আমি তো চাইনি অন্য কেউ এসে আমার হৃদয়ে গোলাপ ফুটাক
পোড়া মন আবার সতেজ হয়ে উঠুক।
আমি চেয়েছি শুধু তোমার মুখ থেকে একটি বার হলেও
প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে উঠুক একটি শব্দ ‘ভালোবাসি’
শুধু এতটুকুই আমি চাই, এর চেয়ে বেশি চাই না।


মনে থাকবে? – আরণ্যক বসু

পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?

বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু’জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক’রে দুচোখ ভ’রে থাকবো চেয়ে…
মনে থাকবে?

এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?

আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে__
মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো…
মনে থাকবে?

আর যা কিছু হই বা না হই
পরের জন্মে তিতাস হবো
দোল মঞ্চের আবীর হবো
শিউলিতলার দুর্বো হবো
শরৎকালের আকাশ দেখার__
অনন্তনীল সকাল হবো;
এসব কিছু হই বা না হই
তোমার প্রথম পুরুষ হবো
মনে থাকবে?

পরের জন্মে তুমিও হবে
নীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরা
গাঁয়ের পোষাক ছুড়ে ফেলে
তৃপ্ত আমার অবগাহন।
সারা শরীর ভ’রে তোমার হীরকচূর্ণ ভালোবাসা।
তোমার জলধারা আমার অহংকারকে ছিনিয়ে নিল।
আমার অনেক কথা ছিল
এ জন্মে তা যায়না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল__
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে
পরের জন্মে মানুষ হবো
তোমার ভালোবাসা পেলে
মানুষ হবোই__ মিলিয়ে নিও!

পরের জন্মে তোমায় নিয়ে…
বলতে ভীষণ লজ্জা করছে
ভীষণ ভীষণ লজ্জা করছে
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে…
মনে থাকবে?



তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা – শহীদ কাদরী

ভয় নেই
আমি এমন
ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক
রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।
ভয় নেই…আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের
সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর
সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক,
প্রিয়তমা!
সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ
হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক
হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয়
পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু
নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।
ভয় নেই আমি এমন
ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি,
প্রিয়তমা।
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন
আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-
বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ
কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার
লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-
ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।


চিল্কায় সকাল – বুদ্ধদেব বসু

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।
তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?
আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায়না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
-তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি?
রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে; সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকেরউপর
সূর্যের চুম্বনে।-এখানে জ্ব’লে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধণু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?
কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে আর আমার
কী ভালো লেগেছিল।
তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ মুখ। দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ-আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।



কথোপকথন -১১ -পুর্ণেন্দু পত্রী

– তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছ শুভন্কর।

– এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি…

কিন্তু তার বদলে??

–বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো?

– খেয়েছি।

কিন্তু আমার খিদের কাছে সে সব নস্যি।

কলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি,

আকাশটাকে ওমলেটের মতো চিরে চিরে,

নক্ষত্রগুলোকে চিনেবাদামের মতো টুকটাক করে,

পাহাড়গুলোকে পাঁপর ভাজার মতো মড়মড়িয়ে,

আর গঙ্গা?

সে তো এক গ্লাস সরবত।

–থাক। খুব বীরপুরুষ।

–সত্যি তাই…

পৃথিবীর কাছে আমি এই রকমই ভয়ংকর বিস্ফোরণ।

কেবল তোমার কাছে এলেই দুধের বালক,

কেবল তোমার কাছে এলেই ফুটপাতের নুলো ভিখারি,

এক পয়সা, আধ পয়সা কিংবা এক টুকরো পাউরুটির বেশী আর কিছু ছিনিয়ে নিতে পারিনা।

–মিথ্যুক..।

–কেন?

–সেদিন আমার সর্বাঙ্গের শাড়ি ধরে টান মারনি?

– হতে পারে।

ভিখারিদের কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না একদিনও??


ভালোবাসি, ভালোবাসি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,
রাত জেগে পড়ার
টেবিলে বসে আছ,
ঘুম আসছে না তোমার
হঠাত করে ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি বললাম-
ভালবাসো?
তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো ক্লান্ত তুমি,
অফিস থেকে সবে ফিরেছ,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত,
খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই,
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে
ঘর্মাক্ত আমি তোমার
হাত ধরে যদি বলি- ভালবাসো?
তুমি কি বিরক্ত হবে?
নাকি আমার হাতে আরেকটু চাপ দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম
শতব্যস্ত হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে,
মাথার উপর তপ্ত রোদ,
বাহন পাওয়া যাচ্ছেনা এমন সময়
হঠাত দাঁড়িয়ে পথ
রোধ করে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার
দিকে তাকিয়ে
কাঁধে হাত দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো শেভ করছ তুমি,
গাল কেটে রক্ত পড়ছে,
এমন সময় তোমার এক ফোঁটা রক্ত হাতে নিয়ে যদি বলি- ভালবাসো?
তুমি কি বকা দেবে?
নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত আমার
গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল গলায় বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

ধরো খুব অসুস্থ তুমি,
জ্বরে কপাল পুড়েযায়,
মুখে নেই রুচি,
নেই কথা বলার অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে তোমার মুখের
দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?
নাকি তোমার গরম শ্বাস আমার শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..

ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,
প্রচন্ড যুদ্ধে তুমিও অংশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাসো?
ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও….
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে, বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…….

ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ
তুমি,
দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরুতে যাবে,
হঠাত বাধা দিয়ে বললাম-ভালবাসো?
কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি

ধরো প্রচন্ড ঝড়,উড়ে গেছে ঘরবাড়ি,
আশ্রয় নেই
বিধাতার দান এই পৃথিবীতে,
বাস করছি দুজনে চিন্তিত তুমি
এমন সময় তোমার
বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালবাসো?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..

ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-
ভালবাসো?
চুপ করে থাকবে?
নাকি সেখান থেকেই
আমাকে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি…..

যেখানেই যাও,যেভাবেই থাক,
না থাকলেও দূর
থেকে ধ্বনি তুলো,
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি..

দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর,
বুঝব তুমি আছ, তুমি আছ
ভালোবাসি,ভালোবাসি……..!



কেউ কথা রাখেনি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!





একবার তুমি – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর–
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল–ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই–পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল–
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় ।

মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো–সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো ।

রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে-ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো ।



তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না – আবুল হাসান

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
এখন তোমার কাছে যাবো
তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা–
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা
হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না– তোমার চিবুকে
তারা নিশ্চয়ই আছেন!

তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!



নিঃসঙ্গতা – আবুল হাসান

অতটুকু চায়নি বালিকা !
অত শোভা, অত স্বাধীনতা !
চেয়েছিলো আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক !
অতটুকু চায়নি বালিকা !
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম !
চেয়েছিলো আরো কিছু কম !
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী ।



তুই কি আমার দুঃখ হবি? – আনিসুল হক

তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচণ্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুড়ে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি?

তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি?
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি?

তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?



পাগলী, তোমার সঙ্গে – জয় গোস্বামী


পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।

অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।

মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।

এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।

দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।

কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।

নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।

দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার 


 লেট স্লিপ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।

সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।

পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।

এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।


মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় – জয় গোস্বামী

বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি

বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো

বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চেখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।

রাতে এখন ঘুমাতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যো‍‍‌ৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কী হবে? – কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ায় সেলাই দিদিমণি
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?


মেঘবালিকার জন্য রূপকথা – জয় গোস্বামী

আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতাম মেঘের দলে
একদিন এক মেঘবালিকা
প্রশ্ন করলো কৌতুহলে
‘এই ছেলেটা, নাম কি রে তোর?’
আমি বললাম, ফুস মন্তর
মেঘবালিকা রেগেই আগুন,
মিথ্যে কথা, নাম কি অমন হয় কখনো?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই হয়, আগে আমার গল্প শোনো
সে বলল, শুনবো না যাঃ, সেই তো রাণী সেই তো রাজা
সেই তো একই ঢাল তলোয়ার
সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে
শুনবো না আর ওসব বাজে।
আমি বললাম, তোমার জন্য নতুন করে লিখব তবে।
সে বলল, সত্যি লিখবি! বেশ তাহলে মস্ত করে লিখতে হবে।
মনে থাকবে? লিখেই কিন্তু আমায় দিবি।
আমি বললাম, তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী।

লিখতে লিখতে লেখা যখন সবে মাত্র দু চার পাতা
হঠাৎ তখন ভুত চাপলো আমার মাথায়
খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছোটবেলার মেঘের মাঠে
গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো একটিও নেই এ তল্লাটে
একজনকে মনে হল ওরই মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই
তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই?
সে বলেছে, মনে তো নেই। আমার ওসব মনে তো নেই
আমি বললাম, তুমি আমায় লেখার কথা বলেছিলে।
সে বলল, সঙ্গে আছে? ভাসিয়ে দাও গাঁয়ের ঝিলে।
আর হ্যা, শোন, এখন আমি মেঘ নই আর
সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।
বলেই হঠাৎ এক পশলায় আমায় পুরো ভিজিয়ে দিয়ে
অন্য অন্য বৃষ্টি বাদল সঙ্গে নিয়ে
মিলিয়ে গেল দূরে কোথায়, দূরে দূরে…।
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….
বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়….আপন মনে বলতে বলতে
আমিই কেবল বসে রইলাম ভিজে এক-সা কাপড় জামায়
গাছের তলায় বসে রইলাম
বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য…

এমন সময় অন্য একটি বৃষ্টি আমায় চিনতে পেরে বলল
তাতে মন খারাপের কি হয়েছে?
যাও ফিরে যাও-লেখ আবার
এখন পুরো বর্ষা চলছে, তাই আমরা সবাই এখন নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত
তুমিও যাও, মন দাও গে তোমার কাজে।
বর্ষা থেকে ফিরে আমরা নিজেই যাব তোমার কাছে।

এক পৃথিবী লিখবো আমি
এক পৃথিবী লিখবো বলে ঘর ছেড়ে সেই বেড়িয়ে গেলাম
ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম গহিন বনে
সঙ্গী শুধু কাগজ কলম
একাই থাকব, একাই দুটো ফুটিয়ে খাব
ধুলোবালি দু এক মুঠো যখন যারা আসবে মনে
তাদের লিখব, লিখেই যাব।
এক পৃথিবীর একশ রকম স্বপ্ন দেখার সাধ্য থাকবে যে রূপকথার
সে রূপকথা আমার একার।

ঘাড় গুজে দিন লিখতে লিখতে
ঘাড় গুজে রাত লিখতে লিখতে
মুছেছে দিন মুছেছে রাত
যখন আমার লেখবার হাত অসাড় হল
মনে পড়ল, সাল কি তারিখ, বছর কি মাস
সেসব হিসেব আর রাখি নি।
লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি
এক পৃথিবী লিখব বলে একটা খাতাও শেষ করিনি।

সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল খাতার উপর, আজীবনের লেখার উপর
বাইরে তখন গাছের নিচে নাচছে ময়ূর আনন্দিত
এ গাছ ও গাছ উড়ছে পাখি, বলছে পাখি
এই অরণ্যে কবির জন্যে আমরা থাকি
বলছে ওরা, কবির জন্য আমরা কোথাও, আমরা কোথাও, আমরা কোথাও হার মানিনি।

কবি তখন কুটির থেকে, তাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের পরে মাঠের পরে নদীর পরে
সেই যেখানে সারা জীবন বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
সেই যেখানে কেউ যায়নি, কেউ যায় না কোনদিনই
আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে
সেই দেশে সেই ঝর্ণা তলায়
এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়
সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী
কিশোর বেলার সেই হরিণী।



ভালোবাসার সংজ্ঞা – রফিক আজাদ

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;

ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি
খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।



যদি ভালবাসা পাই – রফিক আজাদ

যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি
যদি ভালবাসা পাই ব্যাপক দীর্ঘপথে
তুলে নেব ঝোলাঝুলি
যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাব
যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো
আর সমুদ্র সাঁতরাবো
যদি ভালবাসা পাই আমার আকাশ হবে
দ্রুত শরতের নীল
যদি ভালবাসা পাই জীবনে আমিও পাব
মধ্য অন্তমিল।


একবার ভালোবেসে দেখো __মহাদেব সাহা

তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
এই মুখে কবিতা ফুটবে না,
এই কণ্ঠ আবৃতি করবে না কোনো প্রিয় পঙ্‌ক্তিমালা
তাহলে শুকিয়ে যাবে সব আবেগের নদী।
আমি আর পারবো না লিখতে তাহলে
…অনবদ্য একটি চরণ, একটিও ইমেজ হবে না রচিত,
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো তবে
কবিতার পান্ডুলিপি জুড়ে দেখা দেবে ঘুরে ঘুরে অনাবৃষ্টি, খরা।
তুমি যদি না তাকাও এই চোখ দেখবে না কিছু
উজ্জ্বল আলোর ভোর ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাবে,
সন্ধ্যাতারা মনে হবে মৃত নিষ্পলক চোখ
যদি ফিরে না তাকাও মর্মে আর পল্লবিত হবে না কবিতা।
তুমি যদি না দাও চুম্বন এই মুখে ফুটবে না ভাষা
মরা গাঙে জাগবে না ঢেউ, দুই তীরে প্রাণের স্পন্দন,
হবে না শস্যের মাঠে শ্রাবণের ব্যাপক বর্ষণ
হৃদয়ে হৃদয়ে আর অঙ্কুরিত হবে না কবিতা, বাজবে না গান।
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
প্রকৃতই আমি আগের মতন পারবো না লিখতে কবিতা
আমার আঙুলে আর খেলবে না জাদুর ঝিলিক,
এই শাদা পৃষ্ঠা জুড়ে ফুটবে না জুঁই আর চাঁপা।
একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো
আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লক্ষ একটি গোলাপ
অনায়াসে কীভাবে আবার অনুভূতি করি সঞ্চারিত,
একবার ভালোসেবে দেখো আবার কীভাবে লিখি দুহাতে কবিতা।


চিঠি দিও – মহাদেব সাহা

করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল, পাখি, সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখর মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে।
এক কোণে শীতের শিশির দিও একফোঁটা, সেন্টের শিশির চেয়ে
তৃণমূল থেকে তোলা ঘ্রাণ
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!
ওই তো রাজার লোক যায় ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে,কাঁধে ব্যাগ,
হাতে কাগজের একগুচ্ছ জীজন ফ্লাওয়ার
কারো কৃষ্ণচূড়া, কারো উদাসীন উইলোর ঝোপ, কারো নিবিড় বকুল
এর কিছুই আমার নয় আমি অকারণ
হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি, আমার কি কোনো কিছু নাই?
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি।


আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে – রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ভালো আছি,
ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালা খানি ।।
বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

পুষে রাখে যেমন ঝিনুক খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ ।।
তেমনি তোমার নিবিঢ চলা ভিতরের এই বন্দরে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।

ভালো আছি, ভালো থেকো; আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো ।।
দিও তোমার মালা খানি বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম পাপড়ীর আবডালে ফসলের ধুম ।।
তেমনি তোমার নিবিঢ ছোয়া গভীরের এই বন্দরে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।

ভালো আছি, ভালো থেকো; আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো ।।
দিও তোমার মালা খানি বাউলের এই মনটারে
ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতরে বাহিরে আওন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে ।।



সেই গল্পটা – পূর্ণেন্দু পত্রী

আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিল মেঘকে
আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।

সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘেকে বললে
আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
আজ তোমাকে স্মান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।

ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনেরআগুনে
পাহাড় ছিল মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠল ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাইয়ের ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
ওঠ্ ছুড়ি! তোর বিয়ে।

এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিনই ভুলতে পারল না।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতো পারো
পাহাড়টার হাড় পাঁজর,
ভিতরে থৈ থৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।



আকাশলীনা – জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।



বনলতা সেন – জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
.
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
.
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।




এমন ভেঙ্গে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে – তসলিমা নাসরিন

কী হচ্ছে আমার এসব!
যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও
প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!
আমার বুঝি খুব মন বসছে সংসারকাজে?
বুঝি মন বসছে লেখায় পড়ায়?
আমার বুঝি ইচ্ছে হচ্ছে হাজারটা পড়ে থাকা কাজগুলোর দিকে তাকাতে?
সভা সমিতিতে যেতে?
অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,
অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।
মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।
মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।
সবারই হয়ত সবকিছু হয় না, আমার যা হয় না তা হয় না।

তুমি কাল জাগালে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে প্রেমের কথা শোনালে,
মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছি
স্বপ্নই তো, এ তো একরকম স্বপ্নই,
আমাকে কেউ এমন করে ভালোবাসার কথা বলেনি আগে,
ঘুমের মেয়েকে এভাবে জাগিয়ে কেউ চুমু খেতে চায়নি
আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন
এত প্রেম কেউ দেয়নি,
এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।
তুমি এত প্রেমিক কী করে হলে!
কী করে এত বড় প্রেমিক হলে তুমি? এত প্রেম কেন জানো? শেখালো কে?
যে রকম প্রেম পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, পাইনি

আর এই শেষ বয়সে এসে যখন এই শরীর খেয়ে নিচ্ছে একশ একটা অসুখ-পোকা

যখন মরে যাবো, যখন মরে যাচ্ছি — তখন যদি থোকা থোকা প্রেম এসে ঘর ভরিয়ে দেয়,
মন ভরিয়ে দেয়, তখন সবকিছুকে স্বপ্নই তো মনে হবে,
স্বপ্নই মনে হয়।
তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।
আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে
খুব ভালোবাসি
আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের
চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে
আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে
ভোর করতে পারি।


তুমি ডাক দিলে – হেলাল হাফিজ

একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,
কতো হুলুস্থূল অনটন আজম্ন ভেতরে আমার।

তুমি ডাক দিলে
নষ্ঠ কষ্ঠ সব নিমিষেই ঝেড়ে মুছে
শব্দের অধিক দ্রুত গতিতে পৌছুবো
পরিণত প্রণয়ের উৎসমূল ছোঁব
পথে এতোটুকু দেরিও করবো না।
তুমি ডাক দিলে
সীমাহীন খাঁ খাঁ নিয়ে মরোদ্যান হবো,
তুমি রাজি হলে
যুগল আহলাদে এক মনোরম আশ্রম বানাবো।

একবার আমন্রণ পেলে
সব কিছু ফেলে
তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল,
অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে
লোকালয়ে থাকবো না আর
আমরণ পাখি হয়ে যাবো, -খাবো মৌনতা তোমার


যদি বাসোই – তসলিমা নাসরিন

তুমি যদি ভালোই বাসো আমাকে, ভালোই যদি বাসো,
তবে বলছো না কেন যে ভালো বাসো! কেন সব্বাইকে জানিয়ে দিচ্ছ না যে ভালোবাসো!
আমার কানের কাছেই যত তোমার দুঃসাহস!

যদি ভালোবাসো, ওই জুঁইফুলটি কেন জানে না যে ভালোবাসো!
ফুলটির দিকে এত যে চেয়ে রইলাম, আমাকে একবারও তো বললো না যে ভালোবাসো!
এ কীরকম ভালোবাসা গো! কেবল আমার সামনেই নাচো!
এরকম তো দুয়োর বন্ধ করে চুপি চুপি তুমি যে কারও সামনেই নাচতে পারো।
আমি আর বিশ্বাস করছি না, যতই বলো।
আগে আমাকে পাখিরা বলুক, গাছেরা গাছের পাতারা ফুলেরা বলুক,
আকাশ বলুক, মেঘ বৃষ্টি বলুক, রোদ বলুক চাঁদের আলো বলুক, নক্ষত্ররা বলুক,
পাড়া পড়শি বলুক, হাট বাজারের লোক বলুক, পুকুরঘাট বলুক, পুকুরের জল বলুক যে
তুমি ভালোবাসো আমাকে!
শুনতে শুনতে যখন আর তিষ্ঠোতে না পারবো তখন তোমাকে ওই চৌরাস্তায় তুলে একশ
লোককে দেখিয়ে চুমু খাবো, যা হয় হবে।

ভালোবাসা কি গোপন করার জিনিস! দেখিয়ে দেখিয়েই তো
শুনিয়ে শুনিয়েই তো ভালোবাসতে হয়।
ভালোবাসা নিয়ে আমরা জাঁকালো উৎসব করবো, ধেই ধেই নাচবো, নাচাবো,
সুখবর বুঝি আমরা চারদিকে ঢোল বাজিয়ে জানিয়ে দিই না!
জুইঁফুলটি যেদিন বলবে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেদিনই কিন্তু তোমাকে বলবো যে
তোমাকেও বাসি, তার আগে একটুও নয়।


তোমার চোখ এতো লাল কেন? – নির্মলেন্দু গুণ

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।

আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন ?’





এ প্রেম নয় – তসলিমা নাসরিন

সারাক্ষণ তোমাকে মনে পড়ে
তোমাকে সারাক্ষণ মনে পড়ে
মনে পড়ে সারাক্ষণ।
তুমি বলবে আমি ভালোবাসি তোমাকে, তাই।
কিন্তু এর নাম কি ভালোবাসা?
নিতান্তই ভালোবাসা? যে ভালোবাসা হাটে মাঠে না চাইতেই মেলে!
ভালো তো আমি বাসিই কত কাউকে, এরকম তো মরে যাই মরে যাই লাগে না!
এ নিশ্চয় ভালোবাসার চেয়ে বেশি কিছু, বড় কিছু।
তোমার কথাগুলো, হাসিগুলো আমাকে এত উষ্ণ করে তোলে যেন
হিমাগারে শুয়ে থাকা আমি চোখ খুলছি, শ্বাস নিচ্ছি।
বলবে, আমি প্রেমে পড়েছি তোমার।
কিন্তু প্রেমে তো জীবনে আমি কতই পড়েছি,
কই কখনও তো মনে হয়নি কারও শুধু কথা শুনেই, হাসি শুনেই
বাকি জীবন সুখে কাটিয়ে দেব, আর কিছুর দরকার নেই!
এ নিশ্চয়ই প্রেম নয়, এ প্রেম নয়, এ প্রেমের চেয়ে বড় কিছু, বেশি কিছু।





ভালোবাসার কবিতা —  ইমতিয়াজ মাহমুদ 


ধরা যাক সাত জুলাই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। লোকজন পথ
খালি করে উঠে গেছে। দোকানের সামনের ছাউনিতে। দাঁড়াবার
জন্য আমিও একটা দোকান খুঁজছিলাম। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
একটা স্টেশনারি দোকান। ।
ধরা যাক দোকানের সামনে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে। আমি ভাবলাম
মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে! কী বলে জানি শুরু করেছিলাম।
খুব বৃষ্টি হচ্ছে/এত বৃষ্টি যে কোথা থেকে আসে- এরকম কিছু?
দেড় বছর পর শোনা গেলো তোমার বাবা আমাকে মেনে নেবে
না। আমি তখন মরে যাবার কথা ভাবছিলাম। তুমি ভাবছিলে
পালিয়ে যাবার কথা। আমরা গিয়েছিলাম সুন্দরবন অথবা
রাঙামাটির পাহাড়ে। তোমার বাবা কী মনে করে যেন
আমাদের ফিরিয়ে আনেন। ধরা যাক উনি মেনে নিয়েছিলেন।
বা ধরা যাক সাত জুলাই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। লোকজন পথ
খালি করে উঠে গেছে। দোকানের সামনের ছাউনিতে। দাঁড়াবার
জন্য আমিও একটা দোকান খুঁজছিলাম। একটা স্টেশনারি দোকান।
সেখানে বই, খাতা, কলম বিক্রি হয়
ধরা যাক দোকানের সামনে, তুমি না—অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে।




তুমি কাকে যেন ভালোবাসো? - সজল আহমেদ

লবন নিয়েছি ভাতে তাও তুমি দিচ্ছো না
তাল পুকুরের কৈয়ের ভাজি
বলো কার তরে রেখেছো এ পদ
কাকে খাওয়াবে বলে এত কারসাজি?

আমিও তো মানুষ, নাকি?
আমিও তো আহ্লাদে আটখানা হই
আমিও তো ভালোবাসি মুগের ডাল
সীমের কোলের কাছে কড়া ভাজা কৈ।

আমাকে দেখোনা তুমি, কি এর হেতু?
আমাকে কি চোখে পড়েনা?
নাকি এ পদ খাওয়াতে চাও
অন্য কাহাকে তাই এত বাহানা?

তোমার পিঠা কি খায় এখন অন্যকেহ
এখন খাওয়াও কাকে লেবুর সুরা?
বেগুন ভাজিটা কি অন্য কেহ খাবে—
শিথানে কার আগমনে ফুলের তোরা?

তুমি কাকে খাওয়াবে বলো, কীজন্য এত
কাকে দেখাতে লেপো ঘরের উঠান?
তুমি আমাকে এখন এড়িয়েই চলো বলো;
কার মুখ রাঙাতে সাজো মিস্টি পান?










একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন