শ্রীতন্বী চক্রবর্তীর কবিতা সংগ্রহ



।। সোনালী অজগর ।।

যদি বলো ধূপিবনের সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশ্বরকে ডেকে নেবো পরের জন্মে,

শামুকের খোল চিরে আনবো বদ্ধ আকাশ

তোমার দু-চোখে ঝরে পড়বো উশৃঙ্খল নীল ঢেউ হয়ে,

ছুঁয়ে থেকো অখ্যাংশের নিপুণ বুনোট

আঙুলের তীর ঘেঁষে রয়ে যাবে প্রেম প্রতিপালনের হাহাকার।

একাকী তখনও প্রশাখার শেষ প্রান্তে জড়িয়ে নেবো

তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকার বিকেলগুলো।

চোখ থেকে পথ, পথ থেকে সুর, সুর থেকে মেঘ, মেঘ থেকে আরো ধূপিছায়া।

নিভে যদি যায় গ্যাস-বাতি, কয়েক ছটাক মুনাফা-চুম্বন রয়ে যাবে সুস্নাত,

কানফুল-বেঁধানো পাহাড়ের গা-জুড়ে সোনালী অজগর আর আমার তুমি।

।। ভ্রমণ ।।

এখানে অনেকক্ষণ বৃষ্টি হয়,

পাহাড়ের শিখর, ঢাল, এলাচ-পাতার ডগা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে প্রস্রবণ,

ছোট ছোট নীল মাছ খেলে বেড়ায় স্বচ্ছতোয়ায়

নদী ফুলে ওঠে, হয় সৌষ্ঠবসম্পন্না, বেড়ে যায় তার ইজারা।

এখানে বৃষ্টি বাড়ে- সন্ধ্যারঞ্জিত লণ্ঠনে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দেয় অগণিত পতঙ্গ-মুদ্রা।

জলচিহ্ন-ভরা কোটরে রাতের উপহাস খোঁজে পাহাড়ি কাঠঠোকরা, হারায় উষ্ণতা,

ঝোরার গায়ে বাঁশ-বাড়িটা স্বপ্নের সুতোয় বাঁধা থাকে,

মালিনী এসে বেলচা দিয়ে তুলে ফেলে ইতিহাস, ইহজনমের প্রসাধন

বৃষ্টির দাগ লেগে থাকে কার্নিশে, জানালা পড়ে থাকে মৃতবৎ,

বিজ্ঞানী ঘুরে ফেরে অবিন্যস্ত নক্ষত্রে, ক্লান্ত হাতে নামিয়ে রাখে ভূ-গোলক,

এখানে এখনো বৃষ্টি হয়েই যায়, চিরঞ্জীব সভ্যতা প্রস্থানের পথে-

ভ্রামণিক হাতে তুলে নেয় ব্রহ্মাণ্ডের সুরাপাত্র,

আর বলে ওঠে, 'চরৈবতি'।

।। উড়ন্ত পরী।।

খাতায় কলমে ছিল হিসেব আর সম্পাদনা,

ঘামতেল, তুলি, সময়ের প্রহসনে ছিলোই বা নিত্যবিনোদন,

ভালো কি শুধুই তুমি বেসেছো?

গড়ে তুলেছো নির্ভুল নির্মিতির খেলা?

আজ আঁকা হোক স্ফটিকের রামধনু,

চেনা শহরটার উড়ন্ত পরীর ডানায়,

শব্দের কলমে শিউলীগন্ধ লেগে থাক, শরীরে নামুক বল্কলহীন ধারাপাত।

এসো না, আজ শুধু ফিরে যাই অতলের অন্দরসজ্জায়,

ফিরোজা কিন্নর-কিন্নরী আর এক মুঠো জোনাকি দিয়ে

সাজিয়ে দিয়ো বুকের উর্বশী-প্রান্ত।

।। মানচিত্র আর স্বাধীন দেশ ।।

এরোড্রোমের ফাটলে দু’ফোঁটা বেগুনী সন্ধ্যের রক্ত দেখতে পেয়েছিলে তুমি?

কাঁটাতার পেরিয়ে বাবা আর আমি যেদিন

আলপথ ধরে হেঁটে গিয়েছিলাম আর কোনো দেশ না-দেখার আশায়,

ইথারের আহ্বানে, কাক, কাঠচেরাইয়ের কল, আর নীলচে মাছরাঙা-নদীর শেষ স্রোত-

ইথারের নেশা আর স্বাধীন দেশ দেখতে পেয়েছিলে তুমি?

ওড়না-জড়ানো আগুনের লেলিহান শিখা

বইয়ের ভাঁজে সবুজ চিঠি, তোমার তাবিজ আনমনা...

মাটিতে একমুঠো প্রেম, মুয়াজিন ডাক দিলো, ওই বুঝি এলো পয়গম্বর।

পয়গম্বরের দেশ দেখতে পাও তুমি?

জাহাজের খালাসি হয়ে মাটি-কাদা-শুকনো ধুলোয়

খুঁজে পাও শেষ বাসে ফেরার টিকিটটা?

আমি আজ ভালো আছি, ইচ্ছে-বৃষ্টিতে ব্যাকুল হই না।

মাটির তার, নাকি তারের দেশ, নাকি দেশের তুমি, নাকি তোমার আমি?

ভাবতে থাকি... মানচিত্র, কাঁটাতার,

আফরোজ আর আমি একাকার!

কবি পরিচিতি: কবি, গদ্যকার, শিক্ষক ও গবেষক (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন