হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং (৫ম-৬ষ্ঠ-৭ম পর্ব)

 


আগের পর্বগুলোঃ

  1. হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং (১ম -২য় পর্ব)
  2. হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং (৩য় -৪র্থ পর্ব)

পঞ্চম পর্ব 

হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং

🔴 এরিসেডের আয়না

বড়দিন আসছে। ডিসেম্বর ৩০,সর মাঝামাঝি কোন এক সকালে দেখা গেল যে সমগ্র হোগার্টস কয়েক ফুট বরফে ঢেকে গেছে। হ্রদের পানিও জমে বরফ হয়ে গেছে। বরফের টুকরো নিয়ে জাদু করার জন্য উইলি পরিবারের যমজ দুভাইয়ের শাস্তি হয়েছে। তারা বরফের বল তৈরি করে কুইরেলের পেছনে লাগায় এবং বলটা কুইরেলের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তার পাগড়িতে লেগে ফিরে আসে। এই শীত উপেক্ষা করে চিঠি বিলি করার জন্য যেসব পেঁচা আসত সেগুলোকে সেবা করে সুস্থ করার দায়িত্ব হ্যাগ্রিডের ওপর।

সবাই ছুটির জন্য অধীর হয়ে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের কমন রুম ও গ্রেট হল গরম রাখার ব্যবস্থা থাকলেও করিডোর ছিল কনকনে ঠাণ্ডা। শীতল হাওয়ায় জানালায় প্রচণ্ড ঝটপটানি শোনা যায়।

সবচে খারাপ হলো অধ্যাপক স্নেইপের মাটির তলায় বন্দিশালায় ক্লাস–সেখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। আর ছাত্ররা চেষ্টা করত গরম কলড্রনের কাছাকাছি বসতে।

ওষুধ তৈরির এক ক্লাসে হঠাৎ করে ম্যালফয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল আমার তাদের জন্য দুঃখ হচ্ছে যাদেরকে বড়দিনের সময় হোগার্টসে কাটাতে হবে, কারণ তাদের নিজ বাড়িতে ঠাঁই নেই।

ম্যালফয় হ্যারির দিকে তাকিয়ে এই কথা বলল। ঐেব ও গয়েল টিটকারি দিল। হ্যারি তখন ওষুধ প্রস্তুত করছিল। সে ম্যালফয়ের কথায় গা করল না।

কিডিচ খেলায় গ্রিফিল্ডর হাউজের কাছে শিদারিন হাউজের পরাজয়ের পর হ্যারির ওপর তার ক্রোধ বহুগুণ বেড়ে গেছে।

ম্যালফয়ের এইসব শ্রেষপূর্ণ কথাবার্তায় আর কেউ যোগ দেয়নি। কিডিচ খেলায় গ্রিফিল্ডর হাউজের বিজয়ে হ্যারির বিশেষ ভূমিকা থাকায় হ্যারি এখন হোগার্টসে খুব জনপ্রিয়। হ্যারিকে কাবু করতে না পেরে ম্যালফয় এবার বলল–হ্যারির নিজস্ব কোন পরিবার নেই।

বড়দিনের ছুটিতে হ্যারি প্রিভেট ড্রাইভে যাবে না। বড়দিনের এক সপ্তাহ আগে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এসে তালিকা তৈরি করলেন–কারা বাড়িতে যাবে, আর কারা হোগার্টসে থাকবে। বড়দিনে হোগার্টসে থাকতে হবে বলে হ্যারির কোন দুঃখ ছিল না। কারণ এবারের বড়দিনটা হ্যারির খুব আনন্দে কাটবে। রন ও ফ্রেডও হোগার্টসে থাকবে কারণ চার্লিকে দেখার জন্য তার বাবা–মা বড়দিনের ছুটিতে রুমানিয়া যাবেন।

ক্লাস শেষ করে তারা যখন বাইরে বেরুল তখন দেখল, একটি ফারগাছ তাদের গতিরোধ করছে। গাছের পেছন থেকে একটি শব্দ শোনা গেল। ওরা অবাক, কি হতে পারে, না, গাছের পেছনে হ্যাগ্রিড দাঁড়িয়ে আছেন।

গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে রন চিৎকার করে উঠল–হ্যাগ্রিড! কোন সাহায্য করতে হবে?

কোন সাহায্যের দরকার নেই। আমি ঠিকই আছি। হ্যাগ্রিড বললেন।

আপনি কি পথ ছাড়বেন? পেছন থেকে ম্যালফয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। উইসলি, তুমি কি কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে চাইছ। ভবিষ্যতে তুমিও কি গেমকীপার হতে চাও না–কি? তোমাদের বাড়ির তুলনায় হ্যাগ্রিডের কুঁড়ে ঘর নিশ্চয়ই একটি প্রাসাদ।

রন ম্যালফয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠিক সেই সময় স্নেইপ এসে হাজির। তিনি রনকে জিজ্ঞেস করলেন–কী ব্যাপার, কী হয়েছে? রন ম্যালফয়কে ছেড়ে দিল।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হ্যাগ্রিড বললেন–প্রফেসর, ম্যালফয় রনকে খামোখা খেপিয়েছে। সে রনের পরিবার সম্পর্কে যা–তা বলেছে।

তা-হোক। মারামারি করা হোগার্টসের নিয়মের বাইরে, হ্যাগ্রিড। অধ্যাপক স্নেইপ বললেন–উইসলি, গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে পাঁচ পয়েন্ট কাটা গেল। তোমার ভাগ্য ভালো, তোমাকে বেশি কঠিন শাস্তি দেয়া হয়নি। তোমরা সবাই যেখানে যাচ্ছিলে যাও।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল গাছটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে যত্রতত্র গাছের কাটা ফেলে দুষ্টামির হাসি হেসে চলে গেল।

ম্যালফয়ের পেছন থেকে রন দাঁত কিড়মিড় করে বলল আমি তাকে একহাত দেখে নেব। একবার না একবার তো সুযোগ পাব।

ম্যালফয় আর স্নেইপ, আমি দুজনকেই ঘৃণা করি। হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিড বললেন-এসব বাদ দাও। বড়দিন আসছে। চল আমরা গ্রেট হলে আনন্দ করি।

হ্যারি, রন, হারমিওন, হ্যাগ্রিড ও তার গাছ অনুসরণ করল। তারা গ্রেট হলে প্রবেশ করে দেখল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ও ফ্লিটউইক বড়দিনের সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত।

হ্যাগ্রিড, সবশেষে গাছটা এনেছ তুমি, এই গাছটা কোনায় শেষের দিকে রাখবে একটু।

গ্রেট হল খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। কমপক্ষে বারোটা ক্রিসমাস গাছ ঘরের ভেতর রাখা হয়েছে।

ছুটির আর কদিন বাকি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।

মাত্র একদিন। হারমিওন জবাব দিল। আর এই কথার সাথে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে–মধ্যাহ্নভোজের আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি আছে। হ্যারি ও রন, চলো এই সময়টুকু লাইব্রেরিতে কাটাই।

অধ্যাপক ফ্লিটউইক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রন বলল–হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। ফ্লিটউইক সে সময় তার জাদুদণ্ড দিয়ে সোনালী বুদবুদ তৈরি করে সেগুলো নতুন গাছের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।

আবার লাইব্রেরি কেন? হ্যাগ্রিড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ছুটির আগে লাইব্রেরি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে লেখাপড়ায় তোমরা খুবই মনোযোগী।

লেখাপড়া করার জন্য আমরা লাইব্রেরিতে যাচ্ছি না। হ্যারি জবাব দিল।

আপনার মুখে নিকোলাস ফ্লামেলের নাম শুনেছি। আমরা তার সম্পর্কে আরো জানতে চাই।

কী জানতে চাও? বিরক্ত কণ্ঠে হ্যাগ্রিড বললেন–আমার কথা শোন। আমি তো আগেই বলেছি এ চিন্তাটা মাথা থেকে নামাও। কুকুর কী পাহারা দিচ্ছে। এ নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই।

নিকোলাস ফ্লামেল লোকটা কে–শুধু এটাই জানতে চাই। এর বাইরে অন্য কিছু জানার আগ্রহ আমাদের নেই। হারমিওন বলল। আপনি একটু সাহায্য করলে আমরা খাটনি থেকে মুক্তি পেতে পারি। হ্যারি বলল আমরা এ পর্যন্ত শতাধিক বই পড়েছি। কিন্তু নিকোলাস ফ্লামেল সম্পর্কে কিছুই পাইনি। তবে, আমার মনে হয় কোথায় যেন তার নাম শুনেছি।

আমি এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু বলব না। হ্যাগ্রিডের স্পষ্ট জবাব।

ঠিক আছে, আমরা নিজেরাই খুঁজে বের করব। রন বলল। বিরক্ত হয়ে তারা সবাই দ্রুত হাগ্রিডের কাছ থেকে বিদায় নিল।

লাইব্রেরিতে তারা নানা ধরনের বই খুঁজল। জাদুর ওপর সেখানে যে কটা বই ছিল সব তারা তন্ন তন্ন করে দেখল। কোথাও নিকোলাস ফ্লামেলের নাম পাওয়া গেল না। কিন্তু ফ্লামেল সম্পর্কে জানতে না পারা গেলে অধ্যাপক স্নোইপ কী চুরি করতে চেয়েছিলেন জানা যাবে না।

হারমিওন লাইব্রেরির ক্যাটালগ দেখতে লাগল। রন লাইব্রেরির বই দেখছিল আর হ্যারি চলে গেল নিয়ন্ত্রিত বইয়ের কোনায়। এখানকার বই ইস্যু করতে হলে কোন একজন শিক্ষকের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। কালো জাদুর ওপর নিয়ন্ত্রিত কিছু বই ছিল যা হোগাৰ্টসে কখনও পড়ানো হতো না। কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বিষয় নিয়ে যে সমস্ত সিনিয়র ছাত্র লেখাপড়া করত কেবল তাদেরকেই এ সমস্তু বই পড়তে দেয়া হত।

তোমরা কী খুঁজছ?

কিছুই না। হ্যারি জবাব দিল।

লাইব্রেরিয়ান মাদাম পিনস–তার ধূলা ঝাড়ার পালক তাদের দিকে ভাক করে বললেন–তাহলে তোমরা এখন বাইরে যাও।

হ্যারি লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে এলো। সে, বন ও হারমিওন একমত হয়েছিল যে তারা মাদাম পিসকে ফ্লামেল সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। তিনি নিশ্চয়ই ফ্লামেল সম্পর্কে বলতে পারবেন। তবে তারা কী খুঁজছে এটা স্নেইপ জানুন সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

হ্যারি কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে দেখে রন ও হারমিওন কোন ক্লু পেয়েছে কিনা। তবে হ্যারি তেমন আশাবাদীও ছিল না। গত পনেরো দিন ধরে তারা ফ্লামেল সম্পর্কে জানার এত চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। তারা চাচ্ছিল মাদাম পিনসের অনুপস্থিতিতে লাইব্রেরিতে এটা ভালভাবে খুঁজবে।

পাঁচ মিনিট পর রন আর হারমিওন হ্যারির কাছে এলো। তারা নানা রকম চিন্তাভাবনা করে মধ্যাহ্নভোজে গেল। আমি না থাকলেও তোমরা খুঁজে দেখ। হারমিওন বলল–যদি কিছু পাও আমার কাছে একটি পাচা পাঠিয়ে দিও।

তুমি তোমার বাবা–মাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো নিকোলাস ফ্লামেল কে? রন হারমিওনের উদ্দেশ্যে বলল। তাদেরকে জিজ্ঞেস করাটাই নিরাপদ হবে।

তুমি ঠিকই বলেছ, কারণ তারা দুজনেই দন্তচিকিৎসক। হারমিওন বলল।

বড়দিনের ছুটি শুরু হলে হ্যারি আর রনের সময় খুব ভালো কাটতে লাগল। ফ্লামেল সম্পর্কে ভাবার জন্য তারা অফুরন্ত সময় হাতে পেল। ঊর্মিটরি এখন তাদের দখলে। কমনরুম আগের তুলনায় অনেক ফাঁকা। ছুটিতে সবাই বাড়ি গেছে। তারা ইচ্ছেমত ভালো ভালো আরাম কেদারা নিয়ে আগুনের পাশে বসে। তারা ইচ্ছেমত খেতেও পারে।

বন এখন হ্যারিকে জাদুর দাবা শেখাচ্ছে। খেলাটা অনেকটা মাগলদের দাবা খেলার মত। তফাৎ হলো-এখানে রাজা, মন্ত্রী, হাতী, ঘোড়া, নৌকা সবই জীবন্ত।

বড়দিনের আগের রাতে শোবার সময় হ্যারি ভাবছিল, এবার বড় দিনে অনেক মজা হবে, তবে তার জন্য কোন উপহার আসবে না। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে অবাক। বিছানায় পায়ের সামনে একগাদা প্যাকেট।

শুভ বড়দিন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে রন হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। হ্যারি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে তার ড্রেসিং গাউন পরে নিল।

তোমাকেও শুভ বড়দিন। হ্যারি বললো–দেখ, আমি একটা উপহার পেয়েছি।

নিজের উপহারগুলোর দিকে তাকিয়ে রন বলল–হ্যারি তুমি কি শালগম আশা করেছিলে?

রনের অনেক উপহার।

হ্যারি তার উপহার খুলল। বাদামী কাগজে প্যাকেটটা মোড়ানো। মোড়ক খোলার পর দেখা গেল ওপরে সুন্দর করে লেখা আছে–হ্যারির জন্য, ইতি হ্যাগ্রিড। প্যাকেটটার ভেতর ছিল একটা কাঠের বাঁশি। হ্যারি বাঁশিটা বাজাল। পেঁচার ধ্বনির মত শব্দ শোনা গেল। দ্বিতীয় প্যাকেটটা ছিল খুবই ছোট। প্যাকেটের ভেতর ছিল টাকা আর একটা চিঠি।

চিঠিতে লেখা আছে–আমরা তোমার বার্তা পেয়েছি। এখানে তোমার বড়দিনের উপহার। আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়ার উপহারের সাথে সেলো টেপ দিয়ে লাগানো ছিল ৫০ পেনসের একটা নোট।

উপহারের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। হ্যারি বলল। হ্যারি ৫০ পেনসের নোট পাওয়াতে রন খুব অভিভূত হলো।

আশ্চর্য। রন মন্তব্য করল-একেবারে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।

তুমি এটা রাখতে পারো। রনের উল্লাস দেখে হ্যারি রনকে বলল।

হ্যাগ্রিড এবং আমার আঙ্কল ও আন্ট এই দুটো পাঠিয়েছেন।

আর এই প্যাকেটটা?

প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রন বলল–আমার মনে হয় আমি বলতে পারব-এটা কোত্থেকে এসেছে। আমার মা পাঠিয়েছেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে হ্যারিকে বড়দিনে কেউ উপহার পাঠাবে না। তাই তিনি তোমার জন্য একটা পশমীর সোয়েটার পাঠিয়েছেন।

হ্যারি প্যাকেটটা খুলে দেখল–ভেতরে হাতে বোনা একটি সোয়েটার। নিজের প্যাকেট খুলতে খুলতে রন বলল–আমার মা প্রতিবছর আমাদের সোয়েটার বানান। আমারটির রঙ হবে অবশ্যই মেরুন।

তিনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ। হ্যারি বলল।

পরবর্তী প্যাকেটে ছিল হারমিওনের পাঠানো মিষ্টি ও চকোলেট ফ্রগ।

উপহারের আরেকটা প্যাকেট খোলা বাকি। ওজনে খুবই হালকা। হ্যারি খুলে দেখে ভেতরে একটা অদৃশ্য হওয়ার পোশাক। হ্যারি পোশাকটা পরল। রন বলল–দেখ পোশাক থেকে একটা চিরকুট নিচে পড়ে গেছে। হ্যারি চিরকুটটা কুড়িয়ে নিল। চিরকুটে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা আছে

মৃত্যুর আগে তোমার বাবা আমাকে এটা দিয়ে গিয়েছিলেন। 
এখন সময় হয়েছে এটা তোমাকে ফেরত দেয়ার। 
এটার সঠিক ব্যবহার কর। 
শুভ বড়দিন।

চিঠিতে কারো স্বাক্ষর ছিল না। রন পোশাকের প্রশংসা করে হ্যারিকে চিন্তিত দেখে প্রশ্ন করল–হ্যারি, কি ব্যাপার, কি হয়েছে?

না কিছু না। হ্যারি বলল। তারপর চিন্তা করতে লাগল কে তাকে এ পোশাকটা পাঠিয়েছে। তার বাবাই কি এ পোশাকটার মালিক ছিলেন?

হ্যারি যখন চিঠির রহস্য উদঘাটনের কথা চিন্তা করছিল ঠিক তখনি দরোজা খুলে গেল।

ফ্রেড ও জর্জ ওয়েসলি ভেতরে প্রবেশ করেছে। হ্যারি পোশাকটা সাথে সাথে লুকিয়ে ফেলল। সে তার অনুভূতি কারো সাথে ভাগ করে নিতে চায় না।

শুভ বড়দিন।

তাকিয়ে দেখ হ্যারি একটা উইসলি জাম্পার পেয়েছে।

ফ্রেড আর জর্জ জাম্পার পরা ছিল। একটাতে হলদে রঙে বড় করে এফ লেখা ছিল অপরটাতে হলদে রঙে বড় করে জি লেখা ছিল।

হ্যারির জাম্পার হাতে নিয়ে ফ্রেন্ড বলল–আমাদের উপহারের তুলনায় তোমার উপহার সবচেয়ে ভাল। যেহেতু তুমি আমাদের পরিবারের সদস্য নও, সেহেতু মা তোমার জন্য আরও বেশি পরিশ্রম করে সুন্দর করে বানিয়েছে।

তুমি কেন তোমারটা পরছ না রন? জর্জ জানতে চাইল ও বলল এটা পর, কি সুন্দর এবং উষ্ণ।

মেরুন রঙ আমার পছন্দ নয়, মা প্রতিবছর এই রঙের সোয়েটার আমার জন্য বুনেন। জাম্পার খুলতে খুলতে রন বলল।

তোমারটাতে কোন অক্ষর নেই। জর্জ বলল–তার ধারণা তুমি তোমার নাম ভুলে যেতে পার না। আমরা বুদ্ধ নই। আমরা জানি আমাদেরকে ফ্লেভ এবং জর্জ বলা হয়।

কী ব্যাপার, এত হইচই কিসের? পার্সি উইসলি বিরক্ত স্বরে দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললো। তারও উপহারের প্যাকেট খোলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তার হাতেও একটা জাম্পার। ফ্রেন্ড তার জাম্পারটা কেড়ে নিল।

প্রিফেক্ট লিখতে পি। পার্সি এদিকে এসো। আমরা সবাই আমাদের জাম্পার পরেছি। হ্যারিও একটা পরেছে।

না, আমি পরব না। পার্সি বলল।

উইসলি যমজ দুভাই পার্সিকে চশমা পরা অবস্থায় জাম্পার পরাতে গেল। তার চশমাটা বাঁকা হয়ে গেল।

আজ তো তুমি প্রিফেক্টদের সাথে বসছ না। জর্জ বলল–বড়দিনের অনুষ্ঠান তো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান।

***

হ্যারি তার জীবনে বড়দিনের কোন ভোজে যোগ দেয়নি। একশটি তরতাজা টার্কির রোস্ট, অফুরন্ত সেদ্ধ আলু, মাখন দেয়া মটরশুটি এবং সুস্বাদু সস। একটু পর পরই বিকট আওয়াজে বোমা ফুটছে।

এই অদ্ভুত আতশবাজির সাথে মাগলদের আতশবাজির কোন তুলনা হয় না। ডার্সলি প্লাস্টিকের খেলনা এবং পাতলা কাগজের হ্যাটের সাথে সেসব আতশবাজি ক্রয় করে থাকেন। ফ্রেডের সাথে হ্যারি জাদুকরের আতশবাজি ফোটালো। এটা শুধু শব্দ করেনি, কামানের মতো বিকট আওয়াজ করেছে। কালো ধোঁয়া তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। আর ভেতর থেকে বিস্ফোরিত হলো একটা রিয়ার এ্যাডমিরালের হ্যাট ও কয়েকটা প্রাণী, সাদা ইঁদুর। উঁচু টেবিল ডাবলডোর তার হ্যাটটা ফুলের তোড়ার ওপর রেখে ফ্লিটউইকের সাথে আনন্দ কৌতুক করছেন।

ভোজনের পর এলো পুডিং। পার্সি তার দাঁত খোয়াতে বসেছিল প্রায়। হ্যারি লক্ষ্য করে দেখল–মদ চাইতে চাইতে হ্যাগ্রিডের চেহারা ক্রমশ লাল হচ্ছে। হ্যারি অবাক হয়ে দেখল হ্যাগ্রিড অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের চিবুকে চুমো খাচ্ছেন। ম্যাকগোনাগল লজ্জায় লাল হয়ে হাসলেন। তার হ্যাটটা তেরচা হয়ে গেছে।

হ্যারি যখন সবশেষে টেবিল ত্যাগ করল তখন তার ওপর এক বোঝার ভার। অদাহ্য তারাবাতি, বেলুন ও টুকটাক জিনিস। তার জাদুর নিজস্ব দাবার সেট। সাদা ইঁদুর অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং হ্যারির মনে এক বাজে চিন্তা এল যেন তাদের দশা হবে মিসেস নরিসের বড়দিনের ভোজের মত।

হ্যারি আর উইসলি যমজ দুই ভাই মাঠে বরফ নিয়ে খেলা করে একটি সুন্দর বিকেল কাটাল। ঠাণ্ডা, ভিজে অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে তারা তিনজন শরীরকে গরম করার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজের কমন রুমে ফিরে এলো। হ্যারি দাবা খেলায় রনের কাছে গো–হারা হারল। হ্যারির ধারণা–পার্সি যদি রনকে এত সাহায্য না করত তাহলে খেলার ফলাফল এরূপ হতো না।

তারপর চায়ের সাথে এলো টার্কি স্যান্ডউইচ, বড়দিনের কেক ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এটাই ছিল হ্যারির জীবনে সর্বোত্তম বড়দিন পালন। বিছানায় শুয়ে সে পাশ থেকে অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা বের করার চেষ্টা করল। এটা তার বাবা ব্যবহার করেছেন। রেশমের চেয়ে কোমল। এত হালকা যে বাতাসে ওড়ে। চিরকুটে লেখা ছিল-এটার সঠিক ব্যবহার কর।

এই পোশাকটার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তাকে এখন পোশাকটা পরতে হবে। পোশাকটা পরে সে বিছানা থেকে নামল। তার পায়ের সামনে জ্যোৎস্না খেলা করছে।

পোশাকটা পরার পর হ্যারির সমস্ত সত্তা নতুন করে জেগে উঠল। সম্পূর্ণ হোগার্টস তার সামনে উপস্থিত হলো। অন্ধকার আর নীরবতায় দাঁড়িয়ে নিজেকে মহানায়ক ভাবতে হ্যারির খুব ভালো লাগছিল। এ পোশাক পরে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারে। কেয়ারটেকার ফিলচও কিছুই জানতে পারবেন না।

রন ঘুমিয়েছিল। হ্যারি ভাবছিল তাকে জাগাবে কিনা। পরে সে ভাবল রনকে জাগানো ঠিক হবে না। তার বাবার পোশাকের সাথে কাউকে সঙ্গী করা ঠিক হবে না। সে ঠিক করল একাই পোশাকটা ব্যবহার করবে।

সে ডর্মিটরি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। কমনরুম দিয়ে বেরিয়ে দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

ওখানে কে? মোটা মহিলাটি প্রশ্ন করল–হ্যারি কোন জবাব দিল না। সে তাড়াতাড়ি করিডোর পেরিয়ে নিচে নামল।

সে কোথায় যাবে? সে দাঁড়াল। তার বুক কাঁপছে। এখন সে সেই স্থানটিতেই আসল–লাইব্রেরির নিয়ন্ত্রিত অংশ। হ্যারি এবার জানতে পারবে, পড়তে পারবে ফ্লামেল কে ছিলেন। অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে সে হাঁটতে লাগল।

লাইব্রেরির ভেতরে ছিল ভুতুড়ে অন্ধকার। হ্যারি একটা প্রদীপ জ্বাললো।

নিয়ন্ত্রিত শাখাটা ছিল লাইব্রেরির ঠিক পেছনের ডানদিকে। দড়ির ওপর দিয়ে হ্যারি সতর্কভাবে হাঁটতে লাগল। দড়িটা বইগুলোকে মূল লাইব্রেরি থেকে পৃথক করে রেখেছিল। হ্যারির খুব একটা লাভ হলো না। বইয়ের মুছে যাওয়া, মলিন হয়ে যাওয়া স্বর্ণাক্ষরের লেখা হ্যারি বুঝতে পারেনি কারণ সেগুলো ছিল ভিন্ন ভাষায়। কোনও কোনও বইয়ে নামও ছিল না। একটা বই দেখে হ্যারি শিউরে উঠল। মনে হয় রক্তমাখা। হয়ত তার মনের ভুল। কে যেন ফিসফিস করছে। হয়ত বা শোনার ভুল। হঠাৎ নিচের রকে একটা মোটা বই নজরে পড়ল। কালো চামড়ায় রূপালী লেখা। বেশ ভারী। কোলের ওপর নিয়ে হ্যারি বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগল।

আরে একি। বইটা যেন আর্তনাদ করছে। অস্ফুট চাপা আর্তনাদ। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার প্রদীপটা পড়ে গেল। চারদিক আবার অন্ধকার। আরও ভয় পেয়ে গেল হ্যারি। কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।

দৌড়ে পালাতে গিয়ে হ্যারি দেখল অধ্যাপক স্নেইপ ও কেয়ারটেকার ফিল। তারা অবশ্য হ্যারিকে দেখতে পাননি। পথটা ছিল খুবই সরু। সে পথে গেলে এঁদের দুজনের সাথে ধাক্কা লাগবেই। পোশাক তাকে অদৃশ্য করতে পারলেও তার শারীরিক অবয়বকে অদৃশ্য করতে পারবে না।

হ্যারি দৌড় শুরু করল।

হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে মালখানায় এসে পৌঁছল।

এতক্ষণ পালাবার সময় তার খেয়ালই ছিল না, সে কোন দিকে যাচ্ছে। চারদিক অন্ধকার থাকায় সে এটাও ঠাহর করতে পারেনি যে, সে এখন কোথায় আছে।

শুনতে পেল, প্রফেসর, আপনার কাছে সরাসরি চলে আসার জন্য আমাকে বলেছিলেন। যাতে রাতে কেউ লাইব্রেরিতে আসে কিনা সেটা দেখা যায়। মনে হয় লাইব্রেরির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কেউ না কেউ আছে।

হ্যারির মনে হলো তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে যেখানেই যাবে ফিলচ তা জানতে পারবে। তার কণ্ঠস্বর খুব কাছ থেকেই শোনা যাচ্ছে। ভীত হ্যারি শুনতে পেল যে অধ্যাপক স্নেইপ কথার জবাব দিচ্ছেন।

নিয়ন্ত্রিত এলাকা? এটা তো খুব দূরে নয়। যেই আসুক তাকে আমরা ধরতে পারব।

হ্যারি দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। অধ্যাপক স্নেইপ ও কেয়ারটেকার ফিলচ তার সামনে দিয়ে গেলেও তাকে দেখতে পেল না। আহ্, খুব বাঁচা গেছে। হ্যারি মনে মনে ভাবল।

হ্যারি একটু এগোতেই তার সামনে একটা দরোজা খুলে গেল। দরোজা দিয়ে সে ভেতরে চলে ঢুকলো। অধ্যাপক স্নেইপ ও ফিলচের দৃষ্টি এড়িয়ে হ্যারি একটি কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। আরো একটু আগে বেড়ে যে কক্ষে প্রবেশ করল। দেখে মনে হলো সেটা একটা পরিত্যক্ত ক্লাসরুম!

ডেস্ক আর চেয়ারগুলো দেয়ালের পাশে স্তূপ করে রাখা। ওয়েস্ট পেপারের বাস্কেটগুলো উলটিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর হ্যারি যে জিনিসটার ওপর দৃষ্টি দিল সেটা ক্লাসরুমের অংশ মনে হলো না। মনে হলো বাইরে থেকে কেউ এনে এখানে বসিয়ে দিয়েছে।

সিলিংয়ের সমান উঁচু একটি আয়না। সোনার ফ্রেমে বাঁধা। আয়নার চারদিকে খোদাই করে লেখা-এরিসেড স্ত্রা এহরু অয়েত উবে কাফ্রু অয়েত অন ওহসি।

এতক্ষণে হ্যারির ভয় কেটে গেছে। ফিলচ আর স্নেইপেরও কোন সাড়াশব্দ নেই। নিজেকে দেখার জন্য হ্যারি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কোন প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না। সে আরও কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

ভয়ে চিৎকার বন্ধ করার জন্য হ্যারি নিজের মুখে হাত হাত চেপে ধরলো। সে যখন আয়নার দিকে তাকাল তখন সে শুধু নিজেকেই দেখল না দেখল বিশাল জনতা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ হ্যারি যে কক্ষে দাঁড়িয়েছিল সে কক্ষটি ছিল সম্পূর্ণ খালি। দ্রুত নিশ্বাস নিতে নিতে হ্যারি আবার আয়নায় তাকাল।

হ্যারি আয়নায় অন্তত আরো দশটি মানুষের প্রতিবিম্ব দেখল। সে ঘাড় নাড়িয়ে এদিক–সেদিক তাকাল। না কেউই তো নেই। তাহলে আয়নায় যাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে তারা কি সবাই অদৃশ্য।

হ্যারি আবার আয়নায় তাকাল। আয়নায় দেখা গেল একজন মহিলা ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। হ্যারি ভাবল-এই মহিলা যদি সত্যিই সত্যিই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে তার হাতের ছোঁয়া হ্যারি তার ঘাড়ে অনুভব করবে না, তেমন কিছু ঘটল না। তাহলে তাদের অস্তিত্ব কি কেবলই আয়নার মধ্যেই।

মহিলাটি খুবই সুন্দরী। তার ঘন লাল চুল। তার চোখ দুটি হ্যারির চোখের মত। চেহারাও অনেকটা হ্যারির মতো। হ্যারি আয়নাতে দেখল

মহিলা চিৎকার করছেন আবার হাসছেন আবার কাঁদছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন পুরুষ, ভদ্রলোকের চোখে চশমা। তিনি তার বাহু দিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলেন। লোকের চুল ছিল একটু এলোমেলো। হ্যারি আয়নার এত কাছে এলো যে, তার নাক আয়না স্পর্শ করল।

মা হ্যারি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল।

একটু পর আবার উচ্চারণ করল–বাবা।

তাঁরা দুজনেই স্মিতহাস্যে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি আয়নায় অন্য এক মানুষের প্রতিবিম্বও দেখল। তাকে ভাল করে লক্ষ্য করে হ্যারি, তার মত গাঢ় সবুজ দুই চোখ, তার মত নাক, খাটো বৃদ্ধ মানুষটার হাঁটু হ্যারির মতো। হ্যারি এই প্রথমবারের মতো তার পরিবারকে দেখতে পেল।

হ্যারির বাবা–মা স্মিতহাসিতে তার দিকে তাকালেন এবং হাত নেড়ে হ্যারিকে অভিনন্দন জানালেন। হ্যারি ক্ষুধার্ত মানুষের মতো আয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু বাবা–মার সাথে করমর্দন করা গেল না। চরম আনন্দ আর প্রচণ্ড ক্ষোভ হ্যারিকে একাকার করে ফেলল।

হ্যারি এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তা সে বলতে পারবে না। একটা আচ্ছন্নতা তাকে ঘিরে ছিল। দীর্ঘসময় তার ঘোরের ভেতর কাটল। দূর থেকে শোরগোল শুনে হ্যারির চেতনা ফিরে এলো।

এখানে তো আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। তাকে ডর্মিটরিতে ফিরে যেতে হবে। ইচ্ছে না হলেও এখান থেকে তাকে বেরুতে হবে। মায়ের চেহারা থেকে হ্যারি তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অস্ফুট কণ্ঠে হ্যারি বলল–আমি আবার আসব। এই বলে হ্যারি সেখান থেকে বিদায় নিল।

*****

তুমি তো আমাকে জাগাতে পারতে। অনুযোগের স্বরে রন হ্যারিকে বলল।

তুমি আজ রাতে যেতে পারো। আমি আজও যাব। আমি তোমাকে সেই আয়নাটা দেখাতে চাই।

আমি তোমার বাবা–মাকে দেখতে চাই। রন আগ্রহের স্বরে বলল।

আর আমি তোমার পরিবারের সবাইকে দেখতে চাই। উইলি পরিবারের সবাইকে। তুমি আমাকে তোমার অন্যান্য ভাই ও তোমার পরিবারের সবাইকে দেখাবে। হ্যারি বলল।

তুমি যখনই খুশি তাদের দেখতে পারো। রন বলল–তুমি এই গ্রীষ্মকালে আমার সাথে আমার বাড়িতে এসো। সত্যি লজ্জাজনক যে আমরা ফ্লামেলের বিষয়টা ভুলেই গেছি। জানতে পারিনি। আরো কিছু খাবার মাও। একি, তুমি খাচ্ছ না কেন?

আসলে হ্যারি খেতে পারছিল না। তার বাবা–মার চেহারা বার বার তার চোখে ভাসছে। সে ফ্লামেলের কথা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিল। কারণ এখন ফ্লামেল তার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিন মাথা কুকুরও এখন তার ভাবনার বিষয় নয়। আর অধ্যাপক স্নেইপ যদি কোন কিছু চুরি করেই থাকেন তাতে হ্যারির কী আসে যায়।

তুমি ঠিক আছ তো? রন তাকে জিজ্ঞেস করে। তোমাকে খুব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।

***

হ্যারি মনে মনে ভয় পাচ্ছিল–আরেকবার গিয়ে যদি আয়নাটি না পাওয়া যায়।

রন আর হ্যারি অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে তাদের অভিযানে বেরুল। লাইব্রেরি থেকে বেশ ধীরে ধীরে তারা এগুতে থাকল। তারা আগের পথ ধরেই অন্ধকারে প্রায় আধঘণ্টা কাটাল।

আমি বরফে জমে যাচ্ছি। রন বলল।

কোন কথা বলবে না। হ্যারি বলল–আমি জানি এটা এখানে কোথাও হবে।

উল্টোদিক থেকে আসা একটা ডাইনি পেত্নীকে তারা অতিক্রম করল। এছাড়া তারা কোন লোকজন দেখতে পেল না। হ্যারি অস্ত্রভাণ্ডার ঘরটা শনাক্ত করে বলল-এটা এখানে।

দরোজা ধাক্কা দিয়ে তারা দুজনে ভেতরে ঢুকলো। ঘাড় থেকে অদৃশ্য হবার পোশাকটা নামিয়ে হ্যারি আয়নার দিকে তাকাল।

তারা দুজনেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। হ্যারির বাবা–মা উৎফুল্ল হলেন।

তাকিয়ে দেখ। নিচু হয়ে হ্যারি রনকে বলল।

রন জবাব দিল–আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

ভালো করে দেখ। এখানে সবাই আছে। হ্যারি বলল।

আমি তো কেবল তোমাকে দেখছি। রন বলল।

ভালো করে দেখ। আমি যেখানে আছি সেখানে এসে দাঁড়াও।

হ্যারি সরে দাঁড়াল।

রন আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালে সে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

রন হতবুদ্ধি হয়ে তার নিজের ছায়ামূর্তি দেখছিল। হ্যারি বলল আমার দিকে তাকাও।

তুমি দেখতে পাচ্ছ তোমাদের পরিবারের সবাই তোমার চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে।

না, আমি কিছুই দেখছি না। এখানে আমি একা। আমাকে একটু বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে। আমি এখন হেডবয়।

তুমি কি বললে?

বিল যে ধরনের ব্যাজ পরে আমি এখন সে ধরনের ব্যাজ পরে আছি। আমার হাতে হাউজক্যাপ আর কিডিচ ক্যাপ। আমি কিডিচ খেলায় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছি।

এই চমৎকার দৃশ্য থেকে রন তার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল। তারপর উত্তেজিতভাবে সে হ্যারিকে বলল–তুমি কি মনে কর এই আয়না ভবিষ্যৎ বলতে পারে?

আয়না কী করে বলবে। হ্যারি জবাব দিল–

হ্যারি নিজে আয়না দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সে রনকে বলল,

আমার পরিবারের কেউ তো আর বেঁচে নেই। আমাকে আরেকবার আয়নাটি দেখতে দাও।

গত রাতে তো তুমি একাই দেখেছ। আজ তুমি আমাকে একটু বেশি সময় দাও।

তুমি তো কিডিচ কাপ হাতে ধরে নিজেকে দেখেছে। এর মধ্যে মজাটা কি? আর আমি আমার বাবা–মাকে দেখতে চাই। হ্যারি বলল।

আমাকে সরিয়ে দিও না।

বাইরের করিডোরে একটি শব্দ শুনে কথা বলা বন্ধ করলো ওরা। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি যে তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল।

তাড়াতাড়ি পালাও।

ওরা অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেলো। মিসেস মরিসের জ্বলজ্বলে চোখ তখন দরোজার ওপর। হ্যারি আর রন দুজনেই দাঁড়িয়ে ভাবছিল-এই অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা কি বিড়ালের ওপরও কাজ করে। তাদের মনে হলো তারা এখানে এক যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস নরিস ঘুরে দাঁড়ালেন এবং ঘর ত্যাগ করলেন।

এটা মোটেও নিরাপদ নয়। তিনি ফিলচকে বলতে পারেন, আমি বাজি ধরে বলতে পারি তিনি আমাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছেন। এসো। রন হাত ধরে হ্যারিকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল।

***

পরদিন সকালে তখনও বরফ ভালোভাবে গলেনি।

হ্যারি, দাবা খেলবে নাকি? রন জিজ্ঞেস করে।

না। হ্যারি বলে।

তাহলে চল হ্যাগ্রিডকে দেখে আসি। রন আবার বলল।

না, যাব না। তুমি যাও।

আমি জানি তুমি কি চিন্তা করছ। হ্যারি, আজ রাতে আর ওখানে যেও না। রন বলল।

কেন যাব না? হ্যারি প্রশ্ন করে।

রন বলল–আমি ঠিক বলতে পারবো না, কিন্তু আমি সামনে বিপদ আশঙ্কা করছি। তুমি কয়েকবারই অল্পের জন্য বেঁচে গেছ। কেয়ারটেকার ফিলচ, অধ্যাপক স্নেইপ আর মিসেস নরিস সবাই তোমার ওপর নজর রাখছেন। তারা তোমাকে দেখতে না পেলেও তোমার আশেপাশেই ছিলেন। যদি হঠাৎ তারা তোমাকে দেখে ফেলেন।

তুমি দেখি হারমিওনের মত কথা বলছ। হ্যারি হেসে বলে।

হ্যারি, আমি তোমার ভালোর জন্যই কথাটা বলছি। আজ তুমি ওখানে যেওনা।

আয়নার কাছে যাবার জন্য হ্যারি অস্থির হয়ে পড়ল। রন তাকে ফেরাতে পারল না। তৃতীয় রাতে হ্যারি আরো তাড়াতাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছল। সে দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছিল বলে শব্দ হচ্ছিল। এত জোরে শব্দ করা ঠিক নয় জেনেও হ্যারি নিজেকে সংযুক্ত রাখতে পারেনি। তবে সে আশেপাশে কাউকেই দেখে নি।

এবারও হ্যারি আয়নায় তার বাবা–মার স্মিত হাসি দেখল। শুধু তাই নয়, তার একজন দাদাও তাকে সম্বোধন করল। হ্যারি আয়নার সামনে মেঝেতে বসে পড়ল। তার মনে হল, সে সারারাত এখানে কাটিয়ে দিতে পারে। এমন সময় পেছন থেকে শব্দ শোনা গেল–হ্যারি তুমি আবার এখানে এসেছ?

হ্যারির অন্তরাত্না বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হ্যারি পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে, তার ঠিক পেছনেই ডেস্কে বসে আছেন অধ্যাপক ডাম্বলডোর। হাঁটার সময় তাকে অতিক্রম করলেও তাড়াহুড়ার কারণে সে তাকে লক্ষ্য করেনি।

আত্নপক্ষ সমর্থন করে হ্যারি আমতা আমতা করে বলল–স্যার, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি।

আশ্চর্য। অদৃশ্য হতে গিয়ে তুমি যে চোখে কম দেখছো–তা বুঝতে পারনি। ডাম্বলডোর বললেন। ডাম্বলডোরকে মুচকি হাসতে দেখে হ্যারি অনেকটা আশ্বস্ত হলো। না, ভয়ের কারণ নেই।

তাহলে ডেস্ক থেকে নেমে অধ্যাপক ডাম্বলডোর হ্যারির পাশে মেঝেতে বসে বললেন–তোমার আগে বহুলোক এরিসেডের আয়নার আনন্দ উপভোগ করেছে।

স্যার আমি এটার নাম জানতাম না। হ্যারি বলল।

এটা কি কাজ করে–তা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন।

এটা–হা স্যার আমার পরিবারকে দেখিয়েছে।

এবং তোমার বন্ধু রনকে হেডবয় হিসেবে দেখিয়েছে।

কি করে জানলেন?

অদৃশ্য হবার জন্য আমার কোন পোশাক লাগে না। তুমি কি এখন বলতে পার এরিসেডের আয়না আমাদেরকে কি দেখায়।

হ্যারি মাথা নেড়ে না বলল।

অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–ঠিক আছে। আমি বলছি। পৃথিবীতে যিনি সবচে সুখী ব্যক্তি তিনিই এ আয়নাটি স্বাভাবিক আয়না হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি ঠিক যেমন–আয়নাতে ঠিক তেমনি দেখতে পাবেন। এতে কি কোন লাভ হয়?

হ্যারি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আস্তে আস্তে বলল–আমরা যা চাই বা যা কিছুই চাই–তা এ আয়নায় দেখা যায়।

তুমি যা বলেছ তা সত্যি আবার সত্যিও নয়, ডাম্বলডোর বললেন আমাদের হৃদয়ের পরম ইচ্ছে এই আয়নায় দেখা যায়। এই যে তুমি, এতদিন তোমার পরিবারের কাউকে দেখতে পাওনি। এখন আয়নায় তাদের দেখতে পেয়েছ। তুমি তোমার বাবাকে দেখতে পেয়েছ। তবে কি জান, এই আয়না কোন জ্ঞান দিতে পারে না বা সত্য জানাতে পারে না। এর আগে বহুলোক এই আয়নার দিকে তাকিয়ে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। আয়নায় যা দেখা যাচ্ছে তা বাস্তব বা সম্ভব কিনা–বিষয়টা তার ভেবে দেখেনি।

ডাম্বলডোর আরো বললেন–আগামীকালই আয়নাটি অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে। আবারও আয়নাটি দেখতে আমি তোমাকে বারণ করব। এরপরও যদি তুমি যাও তোমার ক্ষতি হতে পারে। এ কথাটা মনে রেখো। এই আয়না কোন স্বপ্নের কথা বলে না। এই আয়না কাউকে কিছু ভোলাতে পারে না। বুঝেছ? এখন তোমার অদৃশ্য হওয়ার পোশাক খুলে ঘুমুতে যাও।

হ্যারি উঠে দাঁড়াল।

স্যার, প্রফেসর ডাম্বলডোর, আমি কি আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে পারি?

ডাম্বলড়োর বললেন, তুমি তো এই মাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছ। ঠিক আছে, কর।

আপনি যখন আয়নার দিকে তাকান তখন আপনি কি দেখতে পান। হ্যারি প্রশ্ন করল।

আমি দেখি আমি এক জোড়া পশশী মোজা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অধ্যাপক ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। হ্যারি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন-একজন লোকের অনেক মোজা থাকে। আরেক বড়দিন এসে চলেও গেল। এই বড়দিনেও আমি একজোড়া মোজা উপহার পাইনি। সবাই আমাকে বই উপহার দিয়েছে।

যখন হ্যারি বিছানায় ঘুমোতে গেল তার মনে হল অধ্যাপক ডাম্বলডোর তাকে পুরোপুরি সতা কথা বলেননি। হ্যারি যে প্রশ্নগুলো করেছিল তা অবশ্য ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত।

🔴 নিকোলাস ফ্লামেল

অধ্যাপক ডাম্বলডোরের পরামর্শের পর হ্যারি আর সেই আয়নার কাছে যায়নি। তাই তার অদৃশ্য হওয়ার পোশাক বড়দিনের ছুটিতে তার ট্রাংকের মধ্যে রয়ে গেল। তবু হ্যারি চেষ্টা করেও সেই আয়নার কথা ভুলতে পারে না। প্রতি রাতে সে দুঃস্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্নে দেখে তার বাবা মা, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তা অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর অট্টহাসির শব্দ।

রন বলল–অধ্যাপক ডাম্বলডোর ঠিকই বলেছেন। এই আয়না মানুষকে পাগল করে দিতে পারে।

ক্লাস শুরু হবার আগে গতকালই হারমিওন ফিরে এসেছে। সে বিষয়টা অন্য দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করল। হ্যারি পর পর তিন রাত বিছানায় না থেকে আয়না দেখতে গিয়েছে-একথা শুনেই সে শিউরে উঠল। সে শঙ্কিত, যদি কেয়ারটেকার ফিলচ দেখে ফেলত তা হলে কি হত। নিকোলাস ফ্লামেলের ব্যাপারে কোন তথ্য সংগৃহীত না হওয়ায় সেও হতাশ।

ফ্লামেল সম্পর্কে জানার ব্যাপারে হ্যারি এখনও হাল ছাড়েনি। লাইব্রেরিতে অনেক বই খোঁজাখুঁজি করেও তারা ফ্লামেলের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। তবে ব্যারির মনে পড়ছে সে কোথায় যেন ফ্লামেলের নাম পড়েছে।

ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় এখন তাদের হাতে আগের মত সময় নেই। প্রতিদিন বিরতির সময় তারা লাইব্রেরিতে বই খোঁজে। দুজনকেই খুঁজতে হচ্ছে। কারণ কিডিচ প্রতিযোগিতার জন্য হ্যারিকে অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে। দলের জন্য উড় এখন দ্বিগুণ পরিশ্রম করছে। লাগাতার বৃষ্টি সত্ত্বেও উডের উৎসাহে কোন ভাটা পড়ল না। উইসলি ভাইয়েরা উডের অতি উৎসাহের বিরুদ্ধে আপত্তি করলেও হ্যারি ছিল উডের পক্ষে। তাদের পরবর্তী খেলা হাফলপাফ হাউজের বিরুদ্ধে। এ খেলায় যদি জেতা যায় তাহলে গ্রিফিল্ডর হাউজ স্লিদারিন হাউজের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। খেলার অনুশীলন শুরু হওয়ার পর থেকে হ্যারির দুঃস্বপ্নও কমে গেল। খেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সময় নাই তার।

কর্দমাক্ত মাঠে অনুশীলন চলছে। একদিন উড় রন আর তার ভাইয়ের ওপর খুব ক্ষেপে গেল। কারণ তারা ডাইভিং বোমা ও ঝাড়ু থেকে পড়ে যাবার ভান করেছিল।

উড চেঁচিয়ে বলল–তোমরা কি ফাজলামি বন্ধ করবে। এসব করলে তো খেলায় জেতা যাবে না। মনে রাখবে, এবার রেফারি হবেন অধ্যাপক স্নেইপ। তিনি অজুহাত পেলেই গ্লিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কেটে নেবেন। একথা শুনে জর্জ ওয়েসলি সত্যি সত্যিই ঝাড়ু থেকে পড়ে গেল।

জর্জ বলল, অধ্যাপক স্নেইপ রেফারি? এর আগে কি কোন খেলায় তিনি রেফারি ছিলেন? আর তিনি রেফারি হলে খেলা তো তিনি নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করবেন না।

উড বলল-এখানে আমার কিছুই করার নাই। আমাদের ভালো খেলতে হবে। তাহলেই স্নেইপ কোন অজুহাত খুঁজে পাবেন না।

হ্যারি চায় না যে সে যখন খেলবে তখন স্নেইপ সেখানে থাকুন। এর পেছনে আরেকটি কারণ আছে…।

অনুশীলন শেষে খেলোয়াড়রা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন রন আর হারমিওনের সাথে দাবা খেলার জন্য হ্যারি সরাসরি গ্রিফিল্ডর হাউজের কমনরুমে চলে এল। সেখানে হারমিওন ও রন দাবা খেলছিল।

দাবা খেলায় হারমিওনকে হারানো কঠিন। হ্যারির ও রন মনে করে হারমিওনের জন্য এই খেলাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত। হ্যারি রনের পাশে গিয়ে বসতেই রন বলল, এখন আমার সাথে কথা বলবে না, আমার মনযোগ নষ্ট হবে বলেই হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারিকে খুব চিন্তিত দেখে রন নিজেই কথা বলল–কি ব্যাপার, তুমি এত কী ভাবছ?

হ্যারি খুব শীতলকণ্ঠে বলল–চক্রান্ত করে স্নেইপ কিচি প্রতিযোগিতার রেফারি হয়েছেন।

তাহলে তুমি খেলো না। হারমিওন বলল।

তুমি বল তুমি অসুস্থ। রন পরামর্শ দিল।

তুমি ভান কর তোমার পা ভেঙে গেছে। হারমিওন বলল।

সত্যি সত্যিই পা ভেঙে ফেল। রন পরামর্শ দিল।

হ্যারি বলল-এটা তো সম্ভব নয়। আমাদের দলে কোন রিজার্ভ খেলোয়াড় নেই। আমি না থাকলে গ্রিফিল্ডর হাউজ খেলতেই পারবে না।

ঠিক এ সময়ে নেভিল ঘরে প্রবেশ করল। সে কীভাবে প্রতিকৃতির গর্ত দিয়ে এত ওপরে উঠল কেউ সেটা বলতে পারবে না, কারণ তার পা ছিল অভিশপ্ত। দুপা জোড়া লাগা। নিশ্চয়ই সে ব্যাঙ-এর মত লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছে।

নেভিলকে দেখে সবাই হাসলেও হারমিওন হাসল না। হারমিওন তাকে প্রতি–অভিশাপ দিলে তার পা দুভাগ হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে সে পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াল।

কি হয়েছিল? হারমিওন তাকে হ্যারি আর রনের পাশে বসবার সময় জিজ্ঞেস করল।

নেভিল বলল–লাইব্রেরির বাইরে ম্যালফয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। সে অনুশীলনের জন্য একজনকে খুঁজছিল।

তুমি এখনই বিষয়টা অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলকে জানাও।

নেভিল মাথা নেড়ে বলল–আমি সেটা পারব না। তাহলে আরো ঝামেলা হবে।

তাকে তোমার মোকাবিলা করতে হবে। রন নেভিলকে বলল–সে সবার মাথার ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে। সে যা করবে তার সব মেনে নেব, তা হতে পারে না।

আমি তা পারব না। আমাকে বলার দরকার নেই যে গ্রিফিরে থাকার মত সাহস আমার নেই। নেভিল বললো।

হ্যারি তার জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চকোলেট ফ্রগ বের করল। হারমিওন তাকে বড়দিনের উপহার হিসেবে যে বাক্সটা পাঠিয়েছিল এটাই ছিল সে বাক্সের শেষ চকোলেট ফ্রগ। হ্যারি এটা নেভিলকে দিলে সে খুশিতে আত্মহারা হলো।

হ্যারি বলল–ম্যালফয়কে এত ভয় পাও কেন, তুমি বারোজন ম্যালফয়ের সমান। তোমার কি মনে নেই সেই হ্যাটটা তোমার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজ নির্বাচিত করেছিল আর ম্যালফয়ের জন্য করেছিল স্লিদারিন হাউজ?

চকোলেট ফ্লগের প্যাকেট খুলতে খুলতে নেভিলের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল।

ধন্যবাদ হ্যারি… আমি এবার ঘুমোতে যাচ্ছি… ও তুমি তো কার্ড জমাও, এই কার্ডটা নাও। সে চকোলেট ফ্লগের প্যাকেটের কার্ডটা হ্যারিকে দিল। নেভিল চলে গেলে হ্যারি কার্ডটা দেখল।

আর ডাম্বলডোর। হ্যারি মন্তব্য করল।

হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আবার সে কার্ডের পেছনে দেখতে লাগল। সেখানে কার্ডের জাদুকর সম্পর্কে তথ্য থাকে।

তারপর হ্যারি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–পেয়েছি। আমি পেয়েছি। নিকোলাস ফ্লামেলকে পেয়েছি। ১৯৪৫ সালে একটা জাদু প্রতিযোগিতায় অধ্যাপক ডাম্বলডোর তার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

হারমিওন লাফ দিয়ে উঠল। হোমটাস্কের প্রথম অংশের মার্ক পাওয়ার পর হারমিওনকে আর কখনো এত উত্তেজিত দেখা যায়নি। তোমরা এখানেই থাকো। এই বলে হেমিওন সিঁড়ি দিয়ে উঠে মেয়েদের ডর্মিটরিতে চলে গেল। হ্যারি আর রন দৃষ্টি বিনিময় করার পূর্বেই সে বিশাল মোটা একটা বই হাতে ফিরে এল।

হারমিওন বলল-এ বইটা আমি কয়েক সপ্তাহ আগে লাইব্রেরি থেকে এনেছিলাম, কিন্তু পড়ার সময় পাইনি। তারপর হারমিওন রহস্যময় সুরে বলল–নিকোলাস ফ্লামেল কে জানো? ফ্লামেল হচ্ছে আমাদের জানা লোকদের মধ্যে পরশমণির একমাত্র আবিষ্কারক।

পরশমণি?

হ্যাঁ, পরশমণি। ফিলজোফার্স স্টোন।

সেটা কি?

আগে বইয়ের এ জায়গাটা পড়।

হ্যারি আর রন পড়তে লাগল। লেখা আছে–

রসায়নশাস্ত্রের প্রাচীন গবেষণায় যা পাওয়া গেছে 
তা হলো ফিলোসফারস স্টোন-এ রয়েছে 
কিংবদন্তী মর্মবস্তু, বিস্ময়কর ক্ষমতা 
যেকোন ধাতু সোনা হয়ে যাবে ছোঁয়ালে 
সে পরশ পাথর; এ পাথর জীবনের অমরত্ব সুধা 
যে পান করবে সে হবে চিরঞ্জীব।

ফিলোসফারস স্টোন নিয়ে বহু গল্প শুনেছি 
শতকের পর শতক; কিন্তু এখন একটি পাথরই 
আছে নিকোলাস ফ্লামেলের কাছে 
যিনি নিজেও একজন রসায়নবিদ ও অপেরা প্রেমিক 
যিনি গত বছর তার ৬৬৫তম জন্মদিন পালন 
করেছেন; যিনি ডিভোন-এ সস্ত্রীক যাপন করেন
ধীরস্থির জীবন বর্ষব্যাপী (ছয়শত আটান্ন)।

রন ও হ্যারির পড়া শেষ হলে হারমিওন বলল–আমার ধারণা ওই কুকুরটাই ফ্লামেলের পরশমণি পাহারা দিচ্ছে। এটা ডাম্বলডোরেরও দায়িত্ব বটে। তারা দুজনে বন্ধু। তাই তিনি চান এটা গ্রিংগট থেকে বাইরে থাকুক।

হ্যারি বলল–যে পাথর সব ধাতুকে সোনা করে, মানুষকে অমর করে, এমন একটি পাথরের পেছনে স্নেইপ তো ছুটবেনই। এতে আশ্চর্যের কী আছে। যেকোন লোকই এই পাথরের পেছনে ছুটবে।

রন বলল–বইটাতে উল্লেখ আছে নিকোলাস ফ্লামেল সম্প্রতি তার ৬৬৬তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছেন।

পরদিন কালো জাদুর ক্লাসে ক্লাস লেকচার নোট করার সময়ও হ্যারি আর রন ভাবছিল যদি একটা পরশমণি পেয়ে যায় তাহলে তারা কী করবে। রম বলল–আমি নিজে একটা কিডিচ দল কিনে ফেলব। ব্যারির মনে পড়ল শিগগিরই কিডিচ প্রতিযোগিতা হবে যেখানে স্নেইপ রেফারি থাকবেন।

আমি খেলব। রন আর হারমিওনকে হ্যারি বলল। আমি যদি না খেলি তাহলে দিারিন হাউজের খেলোয়াড়গণ মনে করবে আমি খেলতে ভয় পাচ্ছি। আমরা যদি জিতি তাহলে তাদের মুখের হাসি শুকিয়ে যাবে।

যতক্ষণ না আমরা তোমাকে মাঠ থেকে তুলে আনছি। হারমিওন ফোড়ন কাটলো।

প্রতিযোগিতার সময় যতই ঘনিয়ে এল হ্যারি ততই অস্থির হয়ে উঠল। দলের মধ্যেও অস্থিরতা বাড়ছে। স্লিদারিনদের বিরুদ্ধে হাউজ চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা গৌরবের বিষয়। গত সাত বছরে কেউ ওদের থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ নিতে পারেনি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো–পক্ষপাতদুষ্ট রেফারির কাছে কি নিরপেক্ষ খেলা পরিচালনা আশা করা যায়?

এসব হ্যারির কল্পনা না সত্যি, তা সে জানে না। শুধু জানে সে যেখানেই যায় সেখানেই সে স্নেইপের কথা ভাবতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় স্নেইপ তার পিছু লেগেছেন। স্নেইপের ওষুধ তৈরির ক্লাসটা ছিল যেন নরক যন্ত্রণা। শেইপ কি জানেন যে, তারা পরশমুণির সন্ধান পেয়েছে?

***

পরের দিন বিকালে ওরা হ্যারিকে গুডলাক জানিয়ে বিদায় নিল, কিন্তু হ্যারি জানে হারমিওন ও রন ফিরে এসে হ্যারিকে জীবিত দেখতে পাবে কিনা সে ব্যাপারে ওদের সন্দেহ আছে। তবে হ্যারিকে খেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তাই সে কিডিচ খেলার পোশাক পরে নিল এবং নিম্বাস ২০০০ ঝাড়ু হাতে তুলে নিল।

রন ও হারমিওন নেভিলের কাছাকাছি একটা জায়গা করে নিল। নেভিল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ওরা এত গম্ভীর কেন। ওরা দুজন জাদুদণ্ড নিয়ে কেনই বা মাঠে এল তার বোধগম্য হচ্ছিল না। হ্যারিও জানত না যে হারমিওন ও রন স্নেইপের ওপর পা–অচল হওয়ার অভিশাপ প্রয়োগ করবে যদি তিনি রেফারি হিসেবে পক্ষপাতিত্ব দেখান।

ভুলে যেও না-এটা লোকোমোটর মর্টিস। হারমিওন নিচুস্বরে হ্যাবিকে বলল।

রন তার আস্তিনে জাদুদণ্ডটি রেখে বলল–আমি তা জানি। প্রসাধন কক্ষে উড হ্যারিকে পৃথকভাবে নিয়ে বলল–হ্যারি, তোমার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। তবে আমাদের যদি জিততে হয় তাহলে এটাই সুযোগ। অধ্যাপক স্নেইপ পক্ষপাতিত্ব করার আগেই খেলা শেষ করতে হবে। ফ্রেন্ড উইসুলি এসে বলল–স্কুলের সবাই খেলা দেখতে এসেছে। এমন কী অধ্যাপক ডাম্বলডোরও এসেছেন।

ডাম্বলডোর! হ্যারি বিস্মিত কণ্ঠে বলল। একটু পরে নিজে গিয়েই দেখে এল যে ফ্রেড মিথ্যে বলেনি।

হ্যারি অনেকটা স্বস্তি বোধ করল। কারণ ডাম্বলডোর খেলা দেখলে স্নেইপ কোন পক্ষপাতিত্ত্ব দেখাতে পারবেন না এবং হ্যারিকে কোন ক্ষতি করতে পারবেন না।

খেলোয়াড়রা যখন মাঠে নামছে তখন স্নেইপকে খুব ক্ষুব্ধ দেখাল। রন বুঝতে পারল ডাম্বলডোরের উপস্থিতিই তার ক্ষোভের কারণ।

স্নেইপ যে এত নিচে নামতে পারেন তা আমি কখনোই ভাবিনি। রন হারমিওনকে বলল।

কে যেন রনকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল। সে পেছন ফিরে দেখে ম্যালফয়।

দুঃখিত, উইসলি। আমি খেয়াল করিনি। ম্যালফয় বলল।

এবার দেখা যাবে হ্যারি কতক্ষণ ঝাড়ুর ওপর থাকতে পারে। কেউ কি আমার সাথে বাজি ধরবে? উইসলি তুমি ধরবে? ম্যালফয় প্রস্তাব দিল।

রন কোন জবাব দিল না। খেলা শুরু হল।

স্নেইপ জর্জের একটা ফাউলকে কেন্দ্র করে হাফলপাফের অনুকূলে পেনাল্টি দিলেন। হ্যারি সারা মাঠ চষে স্নিচ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট পর মালয় উচ্চকণ্ঠে বলল–দেখেছ গ্রিফিল্ডর হাউজ কেমন খেলোয়াড় বেছে নিয়েছে।

প্রথম পেনাল্টি ব্যর্থ হলে কিছুক্ষণ পর স্নেইপ বিনা কারণে হাফলপাফের অনুকূলে আরেকটি পেনাল্টি দিলেন।

দর্শকরা হইচই করে উঠলো। সমস্ত দর্শকের সহানুভূতি এবার হ্যারির প্রতি।

ম্যালফয় বলে চলল, এদের জন্য সকলের দুঃখ হয়। এই যে পটার, ওর মা–বাবা নাই, আর উইসলি গরিব, কোন টাকা–পয়সা নেই ওর। আর এই যে তুমি লংবটম, তোমার একটা ভাল টিমে থাকা উচিত ছিল, কারণ তোমার মত যাদের মাথায় কিছু নেই তদেরই তো টিমে থাকার কথা।

নেভিলের চেহারা রাগে লাল হয়ে উঠল। সে পেছন ফিরে ম্যালফয়ের মুখোমুখি হলো।

আমি তোমার মত বারোটার সমান, ম্যালফয় নেভিল বলল।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল উচ্চস্বরে হেসে উঠল। রন খেলা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েই নেভিলকে বলল–ঠিক বলেছ নেভিল, বলে যাও।

লংবটম, যদি মস্তিষ্ক সোনা হতো তাহলে তুমি উইসলির তুলনায় গরীব হতে। আজ এইটুকুই বললাম, যাও।

হ্যারির চিন্তায় রন এমনিতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সে ম্যালফয়ের দিকে মুখ না ফিরিয়ে বলল–ম্যালফয়, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। এরপর যদি তুমি আর একটি বাজে কথা বল তাহলে তোমাকে দেখে নেব।

রন হারমিওন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–হ্যারি, হ্যারি,..

কী হয়েছে?… কোথায়?

হ্যারি একটা চমৎকার ডাইভ দিয়ে বুলেটের মত ছুটে গেল। দর্শকরা হর্ষধ্বনি ও হাততালি দিয়ে বাহবা দিল হ্যারিকে। হারমিওন হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে তার মুখে ফিঙ্গার ক্রস করল। আর হ্যারি বুলেটের মত মাটির দিকে ছুটছে।

উইসলি তোমাদের ভাগ্য ভাল। হ্যারি নিশ্চয়ই মাঠের ভেতর কিছু পয়সার সন্ধান পেয়েছে। ম্যালফয় হ্যারির মাটির দিকে ছুটে যাওয়া দেখে তামাশা করে বলল।

ম্যালফয়কে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই রন তাকে মাটিতে ফেলে দিল। নেভিল কাছেই ছিল। কিছুক্ষণ দ্বিধা করে সে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেল।

শাবাশ হ্যারি খেলে যাও। তার আসন থেকে উঠে হারমিওন চিৎকার করল। হারমিওন লক্ষ্য করল যে, হ্যারি স্নেইপের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হারমিওন ভীষণভাবে উত্তেজিত। হারমিওন এতক্ষণ লক্ষ্যই করেনি যে, তার পায়ের কাছে রন আর ম্যালফয় মারামারি করছে।

স্নেইপ তার ঝাড়ু সোজা করতে করতে অবাক হয়ে দেখলেন যে আকাশ থেকে একটি ঝাড়ু তার নাকের এক ইঞ্চি দূর দিয়ে তীরবেগে ছুটে গেল। আরেকটু হলেই…

ডাইভ থামিয়ে হঠাৎ হ্যারির চিৎকার। সে স্নিচটাকে ধরে ফেলেছে। এটা একটা রেকর্ড। সারা গ্যালারিতে হইচই। এর আগে কেউ কোন দিন এত তাড়াতাড়ি মিচ ধরে ফেলতে পারেনি।

হারমিওন চিৎকার করে বলল–রন, রন। কোথায় তুমি। খেলা শেষ। হ্যারি জিতেছে।

সবাই শুনল হেরমিওনের উল্লাস। আমরা জিতেছি, আমরা জিতেছি। গ্রিফিল্ডর এখন এগিয়ে।

হারমিওন আনন্দে নাচছে। সামনের সারির পার্বতী পাতিলকে জড়িয়ে ধরল।

মাটি থেকে মাত্র এক ফুট ওপরে থাকতেই হ্যারি ঝাড়ু থেকে লাফ দিল। এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, সে জিতেছে। একটু আগেই খেলা শেষ হয়েছে।

শাবাশ। ভালো খেলেছ। তুমি নিশ্চয়ই এখন আর আয়না নিয়ে চিন্তা করছ না। ডাম্বলডোর তাকে বললেন খুব ধীরে যাতে অন্য কেউ না শোনে।

স্নেইপ খুব তিক্ত বদনে মাটিতে থুথু ফেলল।

হ্যারি প্রসাধন কক্ষ থেকে একটু পরেই বের হয়ে এলো। এরপর নিম্বাস ২০০০ নিয়ে সে ঝাড়ুশালার দিকে রওনা হল। আজ তার মত আনন্দিত পৃথিবীতে আর কেউই নেই। সত্যিই সে গর্বিত হওয়ার মত কাজ করেছে। তার সুনাম এখন চতুর্দিকে। ক্লান্তি কাটাবার জন্যে হ্যারি কিছুক্ষণ ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ালো।

সে ঝাড়ু রাখার শেডে পৌঁছে শেডের কাঠের দরোজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সে হোগার্টসের দিকে তাকাল। অস্তাচলগামী সূর্যের কিরণে জানালার কাঁচ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। গ্রিফিল্ডরে এখন অগ্রগামী। আর এই কৃতিত্বের দাবিদার হ্যারি নিজে। স্নেইপকে বুঝিয়ে দেয়া গেছে।

হ্যারি স্নেইপের কথা ভাবতেই, দেখল.

একটি সারা শরীর আবৃত মূর্তি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। যেন চুপি চুপি কোথাও যাচ্ছে যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। যাচ্ছে নিষিদ্ধ বনের দিকে। হ্যারির মাথায় এবার আর জয়ের আনন্দ নেই। জয়ের পরিবর্তে এখন উৎকণ্ঠা। এ যে স্নেইপ। সবাই যখন ডিনারে যাচ্ছে তখন তিনি বনে যাচ্ছেন কেন?

হ্যারি আবার নিম্বাস ২০০০ এর ওপর চড়ে বসল। কাছে গিয়ে দেখল স্নেইপ বনে ঢুকে গেছেন।

বিরাট বিরাট গাছ হ্যারিকে বাধা দিচ্ছে। সে স্নেইপকে দেখতে পেয়ে নীরবে একটি বা গাছে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে স্নেইপ কি করছেন দেখতে থাকলে।

গাছের ঠিক নিচেই স্নেইপ দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে অধ্যাপক কুইরেল। তবু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হ্যারি শুনতে পাচ্ছে কুইরেল তোতলাতে তোতলাতে বলছেন–আ… আ… আমি জানি… না তুমি কেন আমাকে এখানে কেন। …. সেভেরাস…. স্নেইপ শীতল কণ্ঠে বললেন–আমি বিষয়টি গোপন রাখতে চাই। আমার ধারণা ছাত্ররা এখনও পরশমণি সম্পর্কে কিছুই জানে না।

হ্যারি আরেকটু সামনে ঝুঁকল। কুইরেল কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। স্নেইপ তাকে থামিয়ে দিলেন। স্নেইপ বললেন–হ্যাগ্রিডের কুকুরটাকে কীভাবে এড়ানো যায়, ভেবে দেখেছ কি?

কুইরেল বললেন–আ… আ… আমি কিছুই জানি না। তুমি কী বলতে…. চাইছ।

তুমি ভালোভাবেই জানো আমি কী বলতে চাইছি।

হঠাৎ একটা পেঁচা উড়ে গেল। হ্যারি একটু অসতর্ক হলেই গাছ থেকে নিচে পড়ে যেত। হ্যারি নিজেকে সামলে নিল।

ঠিক আছে। স্নেইপ বললেন–আমরা পরে আবার কথা বলব। তখন তুমি আরো ভেবে দেখতে পারবে। তোমার আনুগত্য কোনদিকে–সেটাও ঠিক করতে পারবে।

হ্যারি দেখল অধ্যাপক কুইরেল ভীত–সন্ত্রস্ত হয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন।

🔴 নরওয়ের নর্বার্ট

কুইরেলকে যতটা মনে হয়েছিল আসলে তিনি তারও বেশি সাহসী। পরের সপ্তাহগুলোতে তিনি আরো বিষণ্ণ, আরো শীর্ণ হয়ে পড়লেও ভেঙে পড়েননি। যতবারই তারা চারতলার দরোজায় কান পেতেছে ততবারই তারা ফ্লাফির গর্জন শুনতে পেয়েছে। স্নেইপের মাথা এখন গরম। তার মানে পরশমণি এখনও নিরাপদ।

কুইরেলের সাথে হ্যারির দেখা হলেই তিনি উৎসাহব্যঞ্জক হাসি হাসেন। এতে হ্যারি অনুপ্রাণিত হয়।

পরশমণি ছাড়াও হারমিওনের মনযোগ দেয়ার অনেক বিষয় ছিল। সে তার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করল এবং হ্যারি ও রনকে এ ব্যাপারে তাগিদ দিতে থাকলো।

পরীক্ষার তো অনেক সময় বাকি। হ্যারি আর রন বলল।

মাত্র দশ সপ্তাই। হারমিওন জবাব দিল। এটা অনেক কম সময়। আর নিকোলাস ফ্লামেলের কাছে এটা তো একটি মুহূর্ত মাত্র।

কিন্তু আমাদের বয়স তো ছশ বছর হয়নি। রন হারমিওনকে মনে করিয়ে দিল। তা যাই হোক–তুমি কী রিভাইজ দিচ্ছ? তোমার তো সবই জানা।

আমি কী রিভাইজ দিচ্ছি? তোমাদের কি মাথা খারাপ? আমার পড়া এখনো বাকি। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার জন্যে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। আমার একমাস আগেই পড়া শুরু করা উচিত ছিল। একাধারে হারমিওনের উপদেশ ও ক্ষেদোক্তি।

শিক্ষকরাও যেন মনে হলো হারমিওনের সাথে একমত হয়ে অতিরিক্ত পড়া চাপাতে লাগলেন। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হ্যারি ও রন তাদের অবসর সময়টাও লাইব্রেরিতে কাটাতে লাগলো।

আমার কিছুই মনে থাকছে না। এই বলে বিরক্ত হয়ে একদিন বিকেলে রন বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে লাইব্রেরির জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। তার মনে হলো অনেকদিন পর সে একটা সুন্দর দিন প্রত্যক্ষ করলো। মুক্ত অপরাজিতা নীল আকাশ এবং বাতাসে গ্রীষ্মের হাতছানি।

হ্যারি এক হাজার জাদুকরী গাছপালা ও ছত্রাক নামক বইটি নেড়ে চেড়ে দেখছে, তখনি তার কানে গেল রন বলছে হ্যাগ্রিড, আপনি লাইব্রেরিতে কী করছেন?

হ্যাগ্রিডকে দেখে মনে হলো তিনি তার পেছনে কিছু লুকোচ্ছেন। গন্ধমুষিকের চামড়ার ওভার কোটটাতে তাকে বেখাপ্লাই দেখাচ্ছে।

এমনি দেখছি, হ্যাগ্রিডকে বিব্রত মনে হল। তা তোমরা এখানে কী করছ, তোমরা কি এখনও নিকোলাস ফ্লামেলকে খুঁজছো?

না, আমরা বহু আগেই তাকে পেয়েছি। রন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল। এবং আমরা এটাও জানি কুকুরগুলো কি পাহারা দেয়। সেটা হচ্ছে পরশ…।

শ্‌শ্‌! হ্যাগ্রিড চারদিক সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন, কেউ শুনছে কিনা। এটা নিয়ে এত চিৎকার করো না।

আমরা আসলে আপনাকে দুএকটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে চাই। হ্যারি বললো, ফ্লাফি ছাড়াও ওই পাথরটা পাহারার আর কি ব্যবস্থা আছে, সে সম্পর্কে যদি বলেন।

শ্‌শ্‌…? হ্যাগ্রিড ভীত দৃষ্টিতে ফিস ফিস করে বললেন, ছাত্রদের এ বিষয়ে জানানো নিষেধ, এখানে এটা নিয়ে আলোচনা করনা, সাবধান! পরে আমার সাথে দেখা করো। হ্যাগ্রিড বিদায় নিলেন।

তিনি পেছনে কি লুকোচ্ছিলেন? এটা পরশমনির সাথে সম্পর্কিত কিছু নয়তো? চিন্তিত মনে হারমিওন বললো।

হ্যাগ্রিড যেখানে ছিলেন, এই জায়গাটা আমি একটু দেখে আসি। বলে রন এগিয়ে গেল। মিনিট খানেক পরেই ফিরে এল, হাতে একগাদা বই। সবাই বিস্মিত হলো এটা দেখে যে, বইগুলোর সবই ড্রাগন ও এদের লালন–পালন সম্পর্কিত।

হ্যাগ্রিড সব সময়ই একটা ড্রাগন চেয়েছেন, প্রথম সাক্ষাতের দিনই তিনি আমাকে তার ইচ্ছার কথা বলেছেন–হ্যারি বললো।

কিন্তু ১৭০৯ সালের ওয়ারলকস কনভেনশন অনুযায়ী ড্রাগন লালনপালন করাতো বেআইনি–রন বললো।

***

তাহলে হ্যান্ডি জেনেশুনে ড্রাগন চর্চা করছেন কেন? হারমিওনের প্রশ্ন।

 ঘণ্টাখানেক পরে ওরা তিনজন যখন হ্যাগ্রিডের বাসায় পৌঁছুলো, অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ঘরের সব জানালায় পর্দা টানা। এই গরম কালেও আলাদাভাবে আগুন জ্বেলে ঘর গরম করা হচ্ছে। হ্যাগ্রিড ওদেরকে চা এবং বেজীর স্যান্ডউইচ খেতে দিতে চাইলেন, কিন্তু তারা তা খেল না।

হ্যাঁ, কি যেন তোমরা জিজ্ঞেস করবে বলছিলে?

কোন রকম ভুমিকা না করে হ্যারি সরাসরি প্রশ্ন করলো–ফ্লাফি ছাড়া আর কে বা কারা পরশমনি পাহারা দেয়–সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন তো আমরা খুশি হব।

হ্যাগ্রিড ভ্রূ কুঁচকে হ্যারির দিকে তাকালেন। আমি এটা বলতে পারব না। প্রথমতঃ আমি নিজেই জানি না। দ্বিতীয়তঃ জানলেও আমি বলতাম না। কারণ, পরশমনিটা এখানে একটা ভাল কাজে রাখা আছে। তাছাড়া তোমরা ফ্লাফি সম্পর্কেই বা কিভাবে জানলে?

হ্যাগ্রিড, আপনি শান্ত হোন। হারমিওন মিষ্টস্বরে হ্যাগ্রিডকে অনেকটা খুশি করার জন্য বললো, আপনি জানেন, এখানে যা কিছু ঘটছে, সবই আপনি জানেন, আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আপনি না বলতে চাইলে সেটা আলাদা কথা। হ্যাগ্রিডের দাঁড়ি নড়ে উঠছে, মনে হলো তিনি মুচকি হাসছেন। হারমিওন বলে চললো–আমরা জানি পাহারার আসল কাজটি কে করেন। আমরা এও জানি ডাম্বলঙের সব কাজে কার ওপর বেশি নির্ভরশীল, আপনি ছাড়া আর কে?

শেষ কথাগুলোতে হ্যাগ্রিডের বক্ষ স্ফীত হলো, হ্যারি ও রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।

হ্যাঁ, তোমাদেরকে বললে আর কি ক্ষতি হবে!

অধ্যাপক ডাম্বলডোর ফ্লাফিকে আমার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। এরপর সকল শিক্ষক মিলে ফ্লাফিকে জাদু দিয়ে বশ করে এই পরশপাথর পাহারায় বসান। তাদের মধ্যে অধ্যাপক স্নেইপও ছিলেন। হ্যাগ্রিড ব্যাখ্যা করলেন।

স্নেইপ? হ্যারি অবাক হয়।

হ্যাঁ–হ্যাঁ, তোমরা এই ব্যাপারটা জান না, তাই না? স্নেইপ পরশপাথর রক্ষা করতে চান, তার পক্ষে এটা চুরি করা সম্ভব নয়। হ্যান্ডি বললেন।

ওরা তিনজনই ভাবছে–যদি স্নেইপ পরশমনি রক্ষার পক্ষে থাকেন তাহলে অন্যান্য শিক্ষকগণ কিভাবে এটা রক্ষা করেন তা জানা সহজ হবে। হ্যাগ্রিড সবই জানেন।

অন্ততঃ অধ্যাপক কুইরেলের জাদুশক্তি ও কিভাবে ফ্লাফিকে ফাঁকি দেয়া যাবে–সবই জানা যাবে।

গরমে সিদ্ধ হওয়ার দশা সকলের। একটা জানালা খুলে দিলে হয়, মি. হ্যাগ্রিড! হ্যারি জানালা খুলতে উদ্যত হয়।

খোলা যাবে না, হ্যারি আমি দুঃখিত। বলেই হ্যাগ্রিড আগুনের দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হ্যারিও আগুনের দিকে দৃষ্টি দিল। নজরে এল আগুনের মধ্যে কেতলির নিচে বিশাল কালো একটা ডিম। হ্যাগ্রিডকে বিচলিত মনে হলো।

কোথায় পেলেন এটা মি. হ্যাগ্রিড? রন আগুনের আরো কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে।

জিতেছি–হ্যাগ্রিড বললেন। গত রাতে পাশের গ্রামে গিয়ে একজনের সাথে তাস খেলায় বাজি ধরে এটা জিতেছি। লোকটা যেন এটা দিতে পেরে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। হ্যাগ্রিডের চোখে মুখে গর্বের হাসি দেখা গেল।

কিন্তু বাচ্চা ফুটে বেরুলে আপনি কি করবেন। হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।

এ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনা করছি। হ্যাগ্রিড বালিশের নিচ থেকে একটা বড় বই বের করলেন। বইটার নাম আনন্দ ও লাভের জন্য ড্রাগন প্রজনন। এর মধ্যেই লেখা আছে, কীভাবে আগুনে দিয়ে ডিম ফুটাতে হবে, কীভাবে ড্রাগনের বাচ্চাকে আধঘণ্টা পর পর মুরগির রক্ত মিশিয়ে পাতিল ভর্তি ব্রান্ডি খাওয়াতে হবে। এবং দেখো, আরও লেখা আছে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ডিম চিনতে হবে। আমার এটা নরওয়েজিয়ান রিজব্যাক। খুবই দুর্লভ এগুলো।

হ্যাগ্রিড খুশি হলেও ওদের দুশ্চিন্তা গেল না। তারা ভেবে পেল না হ্যাগ্রিডের এই কাঠের ঘরে কেউ যদি এই অবৈধ ড্রাগনের বাচ্চা দেখে ফেলে তাহলে হাগ্রিডের কী হবে।

রাতের পর রাত ওরা পড়ায় ব্যস্ত রইলো। হারমিওন হ্যারি ও রনকে রিভাইজ দেয়ার সময়সূচি বানিয়ে দিল। পড়ার চাপে তারা পাগলপ্রায়।

এমনি একদিন নাস্তার সময় হেডউইগ এল হ্যাগ্রিডের ছোট চিরকুট নিয়ে। হ্যাগ্রিড মাত্র দুটো শব্দ লিখেছেন : বাচ্চা ফুটছে।

পড়া রেখে রন হাগ্রিডের বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। হারমিওনের যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই।

হারমিওন, সারাজীবনে আমরা কটা দিন ড্রাগনের বাচ্চা ফোঁটা দেখার সুযোগ পাব বলতো? রনের জিজ্ঞাসা।

আমাদের পড়াশোনা আছে। আমরা বিপদে পড়ব, তাছাড়া কেউ যদি হাগ্রিডের ব্যাপারটা জেনে ফেলে, তখন কিছুই করার থাকবে না। হেমিওন জবাব দিল।

চুপ? হ্যারি ফিসফিসিয়ে বললো।

কয়েক গজ দূরে ম্যালফয়কে দেখা গেল সন্তর্পণে ওদের কথা শুনছে। কতটা শুনে ফেলো কে জানে। ম্যালফয়ের চাহনিটা মোটেই ভাল ঠেকল না।

আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত হারমিওন ওদের সঙ্গী হতে রাজি হলো এবং কোনাকুনি মাঠের ওপর দিয়ে হ্যাগ্রিডের বাসায় হাজির হলো ওরা। আনন্দে–উত্তেজিত হ্যাগ্রিড ওদের অপেক্ষায় ছিলেন।

প্রায় ফুটে বেরুল বলে। তিনি ওদেরকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন।

ডিমটা টেবিলের ওপর রাখা। ডিমের চারপাশে ফাটল দেখা যাচ্ছে। ভিতরে কি যেন নড়ছে। একটা মজার শব্দ নির্গত হচ্ছে।

সবাই আগ্রহভরে টেবিলের চারপাশে জড় হলো। বন্ধ নিঃশ্বাসে সবার দৃষ্টি একমাত্র ডিমের দিকে।

অকস্মাৎ সশব্দে ডিম ফেঁটে গেল। বাচ্চা ড্রাগন টেবিলের ওপর পড়ল। দেখতে যে খুব সুন্দর তা নয়। হ্যারির মনে হলো যেন একটা কালো ছাতা। ভানা দুটা জেট প্লেনের ডানার সাথে তুলনা করা যায়। উন্নত নাশা, তীক্ষ্ণ শিং যুগল, উজ্জ্বল কমলা রঙের চোখ। মুখ দিয়ে দু দুবার আগুনের রশ্মি বেরিয়ে গেল।

কি সুন্দর তাই না?–হ্যাগ্রিড বিড়বিড় করে বললেন–ওকে আশীর্বাদ কর, দেখ, ও কিন্তু ওর মাকে চেনে।

মি. হ্যাগ্রিড, একটা নরওয়েজিয়ান রিজব্যাক কতদিনে বড় ইয়?–হারমিওন জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাগ্রিড জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার চেহারা মলিন হয়ে গেল। দ্রুত জানালায় গিয়ে উঁকি দিলেন।

একটা বাচ্চামত কেউ পর্দা সরিয়ে আমাদের দেখে গেল। স্কুলের দিকে দৌড় দিয়েছে। হ্যাগ্রিড বললেন। হ্যারি দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে নিঃসন্দেহ হলো। আর কেউ নয়–ম্যালফয় ড্রাগন দেখে ফেলেছে।

পরের সপ্তাহে ম্যালফয়ের হাসি হাসি মুখ দেখে ওরা তিনজন বেশ উদ্বিগ্নতার সাথে কাটালো।

হারমিওন, রন ও হ্যারি তাদের অবসর সময় হ্যাগ্রিডের অন্ধকার কুটিরেই কাটালো।

এটাকে আটকে রাখবেন না, হ্যারি বলল, এটাকে মুক্ত করে দিন।

একে ছাড়ব না, এ অত্যন্ত ছোট। হ্যাগ্রিড বললেন। আমি এটাকে নর্বার্ট বলে ডাকবো।

কিন্তু প্রধান চিন্তা হলো, হ্যাগ্রিড তো সারাজীবন এটাকে রাখতে পারবেন না। ম্যালফয়ের মাধ্যমে এ কথা প্রচার হবেই।

হ্যারি হঠাৎই রনের দিকে ফিরে বললো পেয়েছি। রন, তোমার ভাই চার্লি রোমানিয়ায় থাকে না? চার্লিই পারবে নৰ্বার্টকে যত্নে রাখতে।

চমৎকার! রন বললো। হ্যাগ্রিড কি বলেন?

অবশেষে হ্যাগ্রিভ রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হলো চার্লিকে পেঁচা পাঠানো হবে তার মত জানার জন্যে।

পরের সপ্তাহ বুধবার পর্যন্ত গড়াল। সবাই যখন শুতে গিয়েছে তখন হারমিওন আর হ্যারি একান্তে কমনরুমে গিয়ে বসল। মধ্যরাত। হঠাৎ করে প্রতিকৃতির গর্তটা খুলে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল রন। সে গা থেকে হ্যারির ছদ্ম আবরণটা খুলে ফেলল। সে এতক্ষণ হ্যাগ্রিডের কুঁড়ে ঘরে নর্বার্টকে মরা ইঁদুর খাওয়াচ্ছিল।

ড্রাগনটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে। রন তার হাত দেখিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার হাত একটা রক্তাক্ত রুমাল দিয়ে বাঁধা।

রন বলল–আমার জীবনে আমি এ পর্যন্ত যত প্রাণী দেখেছি তার মধ্যে এই ড্রাগনটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। হ্যাগ্রিড যখন এটার কাছে যান, মনে হয় তিনি যেন তার পোষ খরগোশের কাছে যাচ্ছেন। আমাকে যখন কামড় দিল তখন হ্যাগ্রিড বললেন–ভয়ের কিছু নেই, তোমাকে ভয় দেখাল। আমি যখন চলে আসি তখন শুনতে পেলাম হ্যাগ্রিড দিব্যি গান গাচ্ছেন।

অন্ধকার জানালায় টোকা পড়লো।

এটা হেডউইগ। হ্যারি বলল–ওকে ঢুকতে দাও। ও হয়তো চার্লির জবাব নিয়ে এসেছে।

তিনজন একত্র হয়ে চিঠি পড়তে শুরু করল–

প্রিয় রন, 
তুমি কেমন আছ? তোমার চিঠির জন্য ধন্যবাদ। নরওয়ের প্রাণীটি নিজে আনতে পারলে আমি খুশিই হতাম। তবে তাকে এখানে নিয়ে আসার কিছু ঝামেলা আছে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে তাকে পাঠিয়ে দাও। তারা আগামী সপ্তাহে আমার এখানে আসছে। তবে তাকে এমনভাবে আনতে হবে যাতে এটা বাইরে থেকে দেখা না যায়। 
তুমি কি শনিবার মধ্যরাতে তাকে নিয়ে সবচেয়ে উঁচু চুড়ায় আসতে পারবে? আমার বন্ধুরা তোমার সাথে সেখানে দেখা করবে। অন্ধকার থাকতেই তাকে সরিয়ে দিও। 
যত দ্রুত সম্ভব জবাব দিও। ভালবাসা রইল। 
চার্লি

তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।

এটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। হ্যারি বলল–আমাদেরও অদৃশ্য হওয়ার পোশাক আছে। নর্বার্টকে নিয়ে আমরা দুজন অনায়াসে ওই পোশাকের ভেতর ঢুকে পড়তে পারব।

তারা একমত হল যে, গত সপ্তাই তাদের বেশ খারাপ গেছে। তাই তারা যেকোন মূলোই নর্বার্ট ও ম্যালফয়ের কাছ থেকে মুক্তি চায়।

পরদিন সকালে বেশ সমস্যা দেখা দিল। রনের হাত দ্বিগুণ ফুলে গেছে। সে ভাবছিল মাদাম পমফ্রের কাছে যাবে কিনা। তিনি কি বুঝতে পারবেন যে, এটা ড্রাগনের কামড়। নিরুপায় হয়ে বিকেলে তাকে পমফ্রের কাছে যেতেই হল। তার হাতে কামড়ের জায়গাটা অনেকটা সবুজ হয়ে গেছে। তার মনে হল নবার্টের দাঁত খুব বিষাক্ত। দিনশেষে হ্যারি আর হারমিওন হাসপাতালে গিয়ে দেখে রনের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সে বিছানায় শুয়ে আছে।

আমার হাতের সমস্যা বড় সমস্যা নয়। রন ফিস ফিস করে বলল এ ব্যথা বেশিক্ষণ থাকবে না। ম্যালফয় মাদাম পমফ্রেকে জানিয়েছে সে আমার কাছে বই ধার চাইতে আসবে। সুতরাং সে আসতে পারে। আমাকে নিয়ে সে কৌতুক করবে। সে বার বার আমাকে চাপ দিচ্ছিল–আমাকে কোন প্রাণী কামড় দিয়েছে তা মাদাম পমফ্রেকে জানাই। আমি মাদাম পমফ্রেকে বলেছি এটা কুকুরের কামড়। আমার মনে হয় তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। কিডিচ খেলায় ম্যালফয়কে মারা আমার ঠিক হয়নি। এখন সে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে।

হ্যারি আর হারমিওন রনকে সান্ত্বনা দিল।

শনিবার মাঝরাতের ভেতরই সব ঠিক হয়ে যাবে। হারমিওন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। এতে রনের উদ্বেগ কাটলো না। রন হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল–সর্বনাশ হয়ে গেছে। চার্লির চিঠিটা তো সেই বইয়ের ভেতরই রয়ে গেছে। ম্যালফয় যদি চিঠি পড়ে ফেলে তাহলে তো সে বুঝে ফেলবে যে আমরা নর্বার্টকে সরাবার চেষ্টা করছি। ঠিক সেই মুহূর্তে মাদাম পমফ্রে হাজির হলেন। তিনি বললেন–তোমরা এখন যাও। রনের নিদ্রা প্রয়োজন।

***

হেরমিওনকে হ্যারি বলল-এখন তো পরিকল্পনা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভাগ্য ভালো ম্যালফয় আমাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমাদেরকে সাবধানে এগোতে হবে। হ্যাগ্রিডকে তারা চার্লির চিঠির কথা বললে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। তার অশ্রুর কারণ হতে পারে নৰ্বার্ট তার পায়ে কামড় দিয়েছে।

ও কিছু না! সে আমার জুতো নিয়ে খেলছিল। নর্বার্ট তো এখনও শিশু। হ্যাগ্রিড বললেন।

ড্রাগনটা তার লেজ দিয়ে দেয়ালে আঘাত করলে দেয়াল এত জোরে কেঁপে ওঠে যে জানালার কাঁচ চুরমার হয়ে। হ্যারি আর হারমিওন দূর্গে ফিরে এল। কিন্তু তাদের বারবার মনে হচ্ছিল–শনিবার হনুজ দূর অস্ত। শনিবার এখনও অনেক দূর।

নর্বার্টকে বিদায় দেবার সময় হ্যাগ্রিডের জন্য তাদের দুঃখ হলো। তারা এতটা উদ্বিগ্ন না হলে হয়ত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারতো। রাতটা ছিল মেঘলা ও গাঢ় অন্ধকার। হাগ্রডের কুঁড়ে ঘরে সবকিছু প্রস্তুত করতে একটু বেশি সময় লাগলো। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তারাও একটু দেরিতে এসেছে। কারণ পিভস প্রবেশ কক্ষে দেয়াল জুড়ে টেনিস খেলছিল। পিভস সেখান থেকে খেলা শেষ করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। একটা বড় বাক্সে নৰ্বার্টকে রাখা হলো।

শোকাভিভূত হ্যাগ্রিড বললেন–বেশ কিছু ইঁদুর ও কিছুটা ব্রান্ডি বাক্সে রেখে দিয়েছি। খিদে পেলে খেয়ে নেবে। তাছাড়া ওর টেডি বিয়ারটা দিয়ে দিয়েছি, যাতে সে একজন সঙ্গী পায়, নিঃসঙ্গ অনুভব না করে।

বাক্সের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে ড্রাগন বোধহয় টেডি বিয়ারের মুও উড়িয়ে দিচ্ছে।

বাক্স বন্ধ করা হলে হ্যাগ্রিড ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। হ্যারি আর হারমিওন অদৃশ্য হওয়ার পোশাক দিয়ে বাক্সটা ঢেকে দিল এবং তারা দুজনও ওই পোশাকের নিচে ঢুকে গেল! কীভাবে দুর্গের চূড়ায় বাক্সটা ওঠানো হলো তা তারা জানতেও পারলো না।

এখন কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তারা অদৃশ্য পোশাকে। তবে তারা একটু পরেই প্রায় দশফুট দূরে প্রদীপের আবছা আলোয় দুটা ছায়ামূর্তি দেখল। তারা হলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এবং ম্যালফয়। ম্যাকগোনাগল ড্রেসিং গাউন পরেছেন। তিনি ম্যালফয়ের কান টেনে চিৎকার করছেন–ডিটেনশান। মাঝরাতে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এত বড় স্পর্ধা। স্লিদারিন হাউজের বিশ পয়েন্ট কাটা গেল।

ম্যালফয় বলল–অধ্যাপক, আপনি বুঝতে পারছেন না। হ্যারি পটার আসছে। তার কাছে একটা ড্রাগন আছে।

বাজে কথা বল না। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–চল অধ্যাপক স্নেইপের কাছে।

তারা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন।

যখন রাতের শীতল হাওয়া গায়ে কাঁটার মত বিধছে ঠিক তখনি টাওয়ারের চূড়ায় পৌঁছে তারা তাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক খুলে ফেলল। হারমিওন বলল–ম্যালফয় শাস্তি পেয়েছে। আমার একটা গান গাইতে খুব ইচ্ছে করছে।

হ্যারি তাকে চুপ থাকতে বলল।

ম্যালফয়ের শাস্তির কথা চিন্তা করে তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। নর্বার্ট বাক্সের ভেতর ছটফট করছে। ঠিক দশ মিনিট পর হঠাৎ চারটা ঝাড়ু তাদের সামনে উপস্থিত হলো। চার্লির বন্ধুরা খুব হাসি খুশি মেজাজের। নর্বার্টকে ওরা ঝুলিয়ে নিয়ে যাবে। হারমিওন ও হ্যারিকে ওরা দেখালো কি ভাবে ওকে ঝোলাবে এবং ওরা সবাই ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

নর্বার্ট চলে গেল। অবশেষে তারা নৰ্বার্ট থেকে অব্যাহতি পেল।

তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন তারা ফিলচকে দেখল।

সামনে বোধহয় আমাদের বিপদ আছে। তারা টাওয়ারের ওপর ভুল করে তাদের অদৃশ্য হওয়ার পোশাক ফেলে এসেছে।









ষষ্ঠ  পর্ব 

হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং

🔴 নিষিদ্ধ বাগান

পরিস্থিতি এর চেয়ে আর খারাপ হতে পারে না।

ফিলচ তাদেরকে নিয়ে দোতলায় অধ্যাপক মাকগোনাগলের কক্ষে গেলেন। ওরা চুপচাপ বসে আছে। হারমিওন ভয়ে কাঁপছে। হ্যারি নানা রকম অজুহাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

এই বিপদ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। তারা এত নির্বোধের মত কাজ করল কীভাবে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কাছে কোন অজুহাতই টিকবে না। তারা রাতে চুপিচুপি বেডরুম ছেড়ে বাইরে চলে গেছে। আর টাওয়ারে ওঠার অপরাধ, এটা তো মাফ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। টাওয়ার নিষিদ্ধ এলাকা। শুধু ক্লাসের জন্য টাওয়ারে যাওয়া যায়। এর সাথে যোগ হয়েছে নর্বার্টকে পার্সেল করা। সবচে বড় বোকামি তারা করেছে অদৃশ্য হওয়ার পোশাক ছেড়ে এসে।

একটু পরই ম্যাকগোনাগল এলেন। পেছনে নেভিল। নেভিল চিৎকার করে বলল–হ্যারি, আমি তোমাকে সাবধান করার জন্য খুঁজতে গিয়েছিলাম। ম্যালফয় বলেছিল ও তোমাকে ধরতে যাচ্ছে। তোমার কাছে নাকি একটা ড্রাগ…

হ্যারি জোরে মাথা নেড়ে ইশারা দিয়ে নেভিলকে থামাতে চাইল। ম্যাকগোনাগল সেটা দেখে ফেলেছেন। তার প্রশ্বাসে যেন নবার্টের চেয়েও বেশি আগুনের হলকা বেরুচ্ছে। তিনি বললেন–আমি বিশ্বাসই করতে পারি না যে তোমরা এ রকম একটা কাজ করবে। মি. ফিল বলেছেন, তোমরা নাকি এস্ট্রোনমি টাওয়ারে উঠেছিলে রাত একটার সময়। জবাব দাও।

এই প্রথমবারের মতো হারমিওন তার শিক্ষকের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে মাথা নিচু করে নীরব মূর্তির মতো তার চটি জুতোর দিকে তাকিয়ে রইল।

ম্যাকগোনাগল বলে চললেন-এই ব্যাপারটি বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার দরকার হয় না। আমি বুঝতে পেরেছি। তোমরা একটা গাঁজাখুরি গল্প তৈরি করেছো। তোমরা ম্যালফয়কে এই মিথ্যা গল্প শুনিয়েছ যাতে সে বিছানা ছেড়ে ওখানে যায় ও বিপদে পড়ে।

হ্যারি নেভিলের চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলতে চাইল যা বলা হয়েছে তা সত্য নয়। এসব শুনে নেভিলকে হতভম্ব ও ব্যথিত মনে হচ্ছিল। অন্ধকারে তাদেরকে সাবধান করতে গিয়ে নেভিলকে কী খেসারত দিতে হবে তা হ্যারি বুঝতে পারছিল।

ম্যাকগোনাগল বললেন–জঘন্য ব্যাপার। চার চার জন মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে বাইরে চলে গেছে। এ রকম কখনো আগে ঘটেনি। মিস গ্রেঞ্জার, আমি ভেবেছিলাম তোমার বেশ বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। ঠি, পটার, আমি ভেবেছিলাম এসবের তুলনায় তোমার কাছে গ্রিফিল্ডর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা তিনজনেই এখন ডিটেনশনে যাবে–মি. লংবটম, তোমাকেও যেতে হবে। তোমারও মুক্তি নেই। মাঝরাতে স্কুলের আশপাশে ঘুরে বেড়াবার অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি। বিশেষ করে এই সময়ে যখন পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে পঞ্চাশ পয়েন্ট কাটা হল।

পঞ্চাশ। হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তাহলে তো গ্রিফিল্ডর আর এগিয়ে থাকতে পারবে না। গত কিডিচ প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে তারা এক ঈর্ষান্বিত অবস্থানে এসেছিল।

তোমাদের প্রত্যেকের পঞ্চাশ পয়েন্ট কাটা গেল। দীর্ঘ খাড়া নাকের মাধ্যমে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ম্যাকগোনাগল বললেন।

প্রফেসর প্লিজ….

আমার কিছু করার নেই। ম্যাকগোনাগল জবাব দিলেন।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বলে চল্লেন–আমি কি করবো, কি করবো না, এটা তোমার বলার দরকার নেই মি. পটার। এবার তোমরা সবাই ঘুমোতে যাও। গ্রিফিল্ডর হাউজের ছাত্র–ছাত্রীদের জন্য আমাকে আর কখনও এত লজ্জা পেতে হয়নি।

এক রাতেই ১৫০ পয়েন্ট কাটা যাওয়াতে গ্রিফিল্ডর হাউজ অনেক পেছনে পড়ে গেল। মনে হলো তুলাটা পড়ে গেছে, পাত্রে আর কিছু নেই। কীভাবে তারা এই ক্ষতি পূরণ করবে?

হ্যারি সারারাত ঘুমোতে পারেনি। সে সারারাত নেভিলের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। সে বুঝতে পারে নেভিলও তার মত শোকাভিভূত। ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা বা বলার কিছু হ্যারির নেই। গ্রিফিল্ডর হাউজ এত পেছনে পড়ে গেছে এ ক্ষতিটা কীভাবে তারা পূরণ করবে-এ নিয়ে নেভিল হ্যারির মতই খুব উদ্বিগ্ন। কি হবে, যখন গ্রিফিল্ডরের সবাই জানবে তারা কি করেছে?

হ্যারি পটার থাকতেও দলের এই দশা। সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় হ্যারি পটারকে সবাই হঠাৎ ঘৃণা করতে শুরু করল। এমনকি বাভেনক্ল এবং হাফলপাফস-এর সবাই তার ওপর ক্ষুদ্ধ। কারণ তারাও চায় স্লিদারিরা যেন হাউজ কাপ না পায়। স্লিদারিন হাউজ খুবই উৎফুল্ল। তারা এখন হ্যারিকে দেখলেই মস্করা করে–থ্যাংক ইউ হ্যারি পটার। তোমার কাছে আমরা ঋণী।

একমাত্র রনই হ্যারির পাশে এসে দাঁড়াল।

কয়েক সপ্তাহের ভেতর তারা এটা ভুলে যাবে। এখানে আসার পর ফ্রেড ও জর্জ আনেক পয়েন্ট হারিয়েছে। তবুও তাদের সবাই পছন্দ করে।

তারা একবারে দেড়শ পয়েন্ট হারায়নি, হারিয়েছে কি? রন বলল, না, কখনোই না।

যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে। হ্যারি ভাবল এখন থেকে তার দায়িত্ব বা এখতিয়ারের বাইরে কোন জিনিস নিয়ে সে মাথা ঘামাবে না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, অন্যের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করা-এ ধরনের কাজে সে আর লিপ্ত হবে না। সে ভীষণ লজ্জিত হয়ে উডের কাছে গিয়ে বলল–আমি পদত্যাগ করতে চাই। পদত্যাগ। উড় হতভম্ব হয়ে বলে। কেন? পদত্যাগ করে কী লাভ হবে? উড পাল্টা প্রশ্ন করে-এতে কি তোমাদের দল জিতবে? যে পয়েন্ট খোয়া গেছে কিডিচ খেলায় না জয়লাভ করে তা কি করে ফেরত পাওয়া যাবে?

কিন্ডিচ খেলায় আগের মত মজা নেই। অনুশীলনের সময় দলের কোন খেলোয়াড় হ্যারির সাথে কথা বলে না। হ্যারির সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে তারা তাকে তার নাম না বলে সিকার বলে ডাকে।

হারমিওন আর নেভিলও কষ্ট পাচ্ছিল। তবে তাদের কষ্ট হ্যারির মত এত বেশি নয়। কারণ, তারা হ্যারির মত এত পরিচিত নয়। তাদের সাথেও কেউ কথা বলছে না। ক্লাসে হারমিওনও আগের মতো শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। সে মাথা নিচু করে নীরকে তার কাজ করে।

সামনে পরীক্ষা চলে আসায় হ্যারির খুব ভালো লাগল। কারণ পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সহজেই তার কষ্টের কথা ভুলতে পারবে।

হ্যারি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে অন্যের বিষয় নিয়ে সে আর মাথা ঘামাবে না। তার এই প্রতিজ্ঞা হঠাৎ এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো।

স্কুলের পরীক্ষা শুরু হবার সপ্তাহখানেক আগে লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে সে অধ্যাপক কুইরেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

কুইরেল বলছেন–না, না, আর নয় প্লীজ মনে হল কেউ তাকে ভয় দেখাচ্ছে। হ্যারি এগিয়ে গেল।

আবার কুইরেলের গলা–ঠিক আছে,.. ঠিক আছে।

একটু পরেই অধ্যাপক কুইরেল ফিরে এলেন। তিনি তার পাগড়ি ঠিক করলেন। তাকে বেশ মনমরা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই বুঝি তিনি চিৎকার করে উঠবেন।

হ্যারির মনে হল অধ্যাপক কুইরেল তাকে দেখতে পাননি। তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত হ্যারি অপেক্ষা করল। তারপর ক্লাসরুমে ঢুকল। সেখানে কেউই ছিল না। অবশ্য অপর প্রান্তের দরোজা খোলা ছিল। হ্যারি এগোচ্ছিল। হঠাৎ তার নিজের প্রতিজ্ঞার কথা মনে হলো। এসব নিয়ে ভাবা তো তার কাজ নয়।

লাইব্রেরিতে ঢুকে হ্যারি হারমিওন ও রনকে সব খুলে বললো। অভিযানের আগ্রহ রমের ভেতর আবার জাগতে শুরু করেছে, তার আগেই হারমিওন বললো–ডাম্বলডোরের কাছে যাও। অনেক আগেই তার কাছে আমাদের খাওয়া উচিত ছিল। এবার যদি আমরা কোন কিছু নিজেরাই করি তাহলে স্কুল থেকে নির্ঘাৎ আমাদের বের করে দেয়া হবে।

কিন্তু আমাদের হাতে তো কোন প্রমাণ নেই। হ্যারি বলল

আমাদেরকে সমর্থন করতে অধ্যাপক কুইরেলও ভয় পাবেন। অধ্যাপক স্নেইল্প বলবেন–হ্যালোইন দৈত্যটি কীভাবে এল তা তার জানা নেই। চতুর্থ তলায় যখন ঘটনা ঘটে তখন তিনি ধারে কাছে কোথাও ছিলেন। না। তাহলে কাকে বিশ্বাস করবেন–তাকে মা আমাদেরকে। ডাম্বলডোর ভাববেন তাকে পদচ্যুত করার জন্য আমরা গল্পটা বানিয়েছি। ঝুঁকি থাকলে ফিলও আমাদের সাহায্য করবেন না। আর এটাও মনে রেখো পরশমণি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানার কথা নয়। এটা জানাজানি হলে অনেক ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে হবে।

হারমিওন তার কথায় সন্তুষ্ট হলেও রন হলো না।

আমরা যদি এই নিয়ে একটু মাথা ঘামাই।

কোন প্রয়োজন নেই। হ্যারির সরাসরি উত্তর। আমরা বহু মাথা ঘামিয়েছি। এবার হ্যারি একটা মানচিত্র বের করল। জুপিটারের মানচিত্র। হ্যারি এর মধ্যেই জুপিটার গ্রহের চাঁদগুলোর নাম জেনে গেছে। পরদিন সকালে তারা যখন নাশতা করছিল তখন তাদের তিনজনের কাছেই একই বার্তা এল–

আজ রাত ১১টা থেকে তোমাদের ডিটেনশন শুরু হবে। 
প্রবেশ কক্ষে গিয়ে ফিলচের সাথে দেখা করো। 
–অধ্যাপক এস. ম্যাকগোনাগল।

হ্যারি ভুলেই গিয়েছিল যে পয়েন্ট খোয়ানোর জন্য তাদেরকে ডিটেনশনের মুখোমুখি হতে হবে। ওই রাতে তারা রনের কাছ থেকে বিদায় নিল। রাত ১১টায় তারা প্রবেশ কক্ষে গেল। ফিলচ সেখানেই ছিলেন। সেখানে ম্যালফয়কেও দেখা গেল। হ্যারি ভুলে গিয়েছিল যে ম্যালফয়েরও ডিটেনশন হয়েছে।

ফিলচ বললেন–আমার পেছন পেছন এসো। তারা তার পেছনে পেছনে গেল। ফিলচ বললেন–স্কুলের আইন–কানুন ভাঙার আগে তোমাদেরকে দুবার করে ভাবতে হবে। আমি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে আরও কঠিন শাস্তি দিতে পারতাম। কয়েকদিন তোমাদেরকে এ ঘরে বন্দি করে রাখতে পারতাম। শিকল দিয়ে বেঁধেও রাখতে পারতাম। আমার অফিসেই শিকল আছে। কিন্তু এবারের মতো ওদিকে যাচ্ছি না। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কোন কাজ করবে না। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না। করলে তোমাদেরই বেশি ক্ষতি হবে।

তারা অন্ধকার মাঠ দিয়ে এগিয়ে গেল। হ্যারি ভাবছিল তাদের কী শাস্তি হবে। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু।

চাঁদ ছিল উজ্জ্বল। তবে মেঘ চাঁদকে খানিকটা ঢেকে রেখেছিল। একটু এগিয়ে যেতেই হ্যারি গ্রিডের কুটিরের জানালায় আলো দেখতে পেল। তারা দূর থেকে কিছু কথাবার্তার শব্দ শুনতে পেল। এটা কে? তুমি ফিলচ? তাড়াতাড়ি এসো। আমি কাজ শুরু করতে চাই।

হ্যারি ভাবছিল তারা যদি হ্যাগ্রিডের সাথে কাজ করে, তাহলে খুব খারাপ হবে না। হ্যারি বেশ আশস্ত বোধ করল। কারণ ফিল তাকে বলল নিশ্চয়ই ভাবছ বন্ধুটার সাথে তুমি তোমার সময় আনন্দেই কাটাতে পারবে। ভালো করে ভাব, তোমরা ঠিকমতো ফিরে আসতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

এই কথা শুনে নেভিল কাদো কাঁদো হল আর ম্যালফয় পথে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গেল।

এই বনে। সে বার বার বলল–রাতের বেলায় যাওয়া নিষেধ। এছাড়া ওখানে অনেক কিছু আছে। আমি শুনেছি সেখানে নেকড়ে বাঘ আছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

নেভিল হাৱির জামার আস্তিন ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।

সেটা তোমাদের দেখার ব্যাপার। ফিলচ বললেন–

যদি নেকড়ে থেকে থাকে তাহলে তোমাদের আগেই ভেবে দেখা উচিত ছিল। তাই নয় কি?

অন্ধকার ভেদ করে হ্যাগ্রিড তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সাথে তার কুকুর ফাং। আর কাঁধে ছিল বড় ধনুক ও তীর।

হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি আর হারমিওন, আমি তো আধঘণ্টা ধরেই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।

ফিলচ শীতল কণ্ঠে বললেন–তাদের সাথে তোমার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা ঠিক হবে না, হ্যাগ্রিড। তাদেরকে এখানে আনাই হয়েছে শাস্তি দেবার জন্য।

এ জন্যই বুঝি তোমার দেরি হয়েছে? হ্যাগ্রিড প্রশ্ন করলেন। ফিলচের প্রতি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণ বক্তৃতা দিচ্ছিলে। তুমি তোমার কাজ করেছ। এবার আমি আমার কাজ শুরু করব।

ফিলচ বললেন–কাল সকালে আমি খবর নেব। এদের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে আমি দেখব।

হাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে ম্যালফয় বলল–আমি এই বনে যাব না। ম্যালফয়ের স্বরে ভয় পাওয়ার ভাব দেখে হ্যারি বেশ খুশি হলো।

হ্যাগ্রিড বললেন–হোগার্টসে থাকতে হলে তোমাকে ওখানে যেতেই হবে। তুমি অন্যায় করেছ। এখন তার শাস্তি ভোগ করতে হবে।

এগুলো তো চাকরবাকরের কাজ। ছাত্রদের নয়। আমরা ভেবেছিলাম আমাদেরকে কিছু লেখালেখি বা এ ধরনের কিছু করতে হবে।

হ্যাগ্রিড তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন–হোগার্টসে তাই করতে হয়। যদি না করতে ইচ্ছে হয় তাহলে দুর্গে ফিরে যাও এবং বহিস্কৃত হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও।

ম্যালফয় একটুও নড়ল না। কঠোর ভঙ্গিতে হ্যাগ্রিডের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল।

এবার হ্যাগ্রিড তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন–মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা, আমি আজ রাতে ফে কাজটা করতে যাচ্ছি–তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমি চাই না তোমরা কেউ বিপদে পড়। এসো, আমার পেছনে পেছনে এসো।

হ্যাগ্রিড তাদেরকে বনের এক প্রান্তে নিয়ে এলেন। হাতে একটা লণ্ঠন ধরে একটা আঁকাবাকা পথ তাদের দেখালেন। পথটা বনে মিলিয়ে গেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে তাদের চুল উড়ছিল।

এদিকে তাকাও। হ্যাগ্রিড বললেন–মাটির ওপর ঝলমলে জিনিসটা দেখ। রূপালী রঙ। এটা ইউনিকর্নের রক্ত। এখানে একটা ইউনিকর্ন আছে যে আঘাত পেয়েছে। এ সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের ঘটনা ঘটল। গত বুধবারে আমি একটা ইউনিকর্নকে মৃত অবস্থায় দেখেছি। আমাদের চেষ্টা হবে আহত প্রাণীটাকে খুঁজে বের করে তাকে কষ্ট থেকে বাঁচানো।

নিজের ভয় গোপন না করে ম্যালফয় প্রশ্ন করল–ইউনিকর্ন যদি প্রথমেই আমাদেরকে আক্রমণ করে বসে।

যতক্ষণ তোমরা আমার সাথে অথবা আমার কুকুর ফ্যাঙের সাথে থাকবে ততক্ষণ তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই।

ফ্যাঙের দীর্ঘ দাঁত দেখে ম্যালফয় বলে উঠল–আমি ফ্যাঙকে চাই।

হ্যাগ্রিড বলল–ফ্যাঙকে নিতে চাও নাও। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি ফ্যাঙ নিজেই খুব ভীরু। আমার দিকে তাকাও। হ্যারি আর হারমিওন বাম দিকে যাবে। ম্যালফয়, নেভিল আর ফ্যাঙ ডানদিকে যাবে। যদি আমাদের কেউ ইউনিকর্ন দেখতে পায় সে বা তার দল সবুজ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবে। ঠিক আছে তোমরা তোমাদের জাদুদণ্ড বের কর। এখনই এটা নিয়ে অনুশীলন কর। যদি আমাদের কেউ বিপদে পড়ে সে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবে। আমরা সবাই তার খোঁজে চলে আসব। সাবধানে থেকো। চলে, যাওয়া যাক।

বনটা অন্ধকার ও নীরব। কিছুদূর যাবার পর পথ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। স্যরি, হারমিওন আর হ্যাগ্রিড বাঁদিকের রাস্তা ধরল। ম্যালফয়, নেভিল আর ফ্যাঙ ডানদিকের রাস্তায় আগে বাড়ল।

মাটির ওপর দৃষ্টি রেখে তারা নীরবে কিছুদূর অগ্রসর হল। একটু পরই তারা চাঁদের আলোতে ঝড়ে পড়া পাতার ওপর রূপালী নীল রক্ত দেখতে পেল। হ্যারি দেখল, হ্যাগ্রিড খুবই উদ্বিগ্ন।

নেকড়েবাঘ কি কোন ইউনিকর্নকে হত্যা করেছে? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাগ্রিড বললেন–ইউনিকর্ন ধরা খুব সহজ নয়। তারা শক্তিশালী ঐন্দ্রজালিক প্রাণী। ইউনিকর্ন আহত হয়েছে-এর আগে আমি কখনো শুনিনি।

তারা একটি পিচ্ছিল শেওলাপড়া গাছ পার হলো। হ্যারি জল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। বুঝতে পারল কাছাকাছি কোথাও জলাশয় আছে। আঁকাবাঁকা পথের এখানে সেখানে তারা ইউনিকর্নের রক্ত দেখতে পেল?

হারমিওন তুমি ঠিক আছো তো, কোন অসুবিধা হচ্ছে? হাড়ি বললেন।

যদি এটা আহত ইউনিকর্ন হয় তাহলে এটা খুব বেশি দূর যেতে পারেনি।

তারপর হ্যাগ্রিড হঠাৎ বলে উঠলেন, তোমরা এই গাছটার পেছনে চলে যাও।

হ্যাগ্রিড, হ্যারি ও হারমিওনকে হাতে ধরে তাদেরকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে একটা বিশাল ওক গাছের পেছনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তিনি একটা তীর বের করে ধনুতে লাগালেন। তীর ছোঁড়ার জন্য তিনি প্রস্তুত। কাছাকাছি শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একটা পোশাক যেন শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর শব্দটি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

আমি জানি। তিনি বিড়বিড় করে বললেন-এখানে এমন কেউ আছে যার এখানে থাকার কথা নয়।

নেকড়ে? হ্যারি প্রশ্ন করে।

এখানে কোন নেকড়ে বাঘ নেই, নেই কোন ইউনিকর্ন। হ্যাগ্রিড বললেন–ঠিক আছে। এবার তোমরা আমার পেছনে পেছনে এসো। তবে সাবধান থেকো।

কিছুক্ষণ পর তারা একটা অদ্ভুত জীব দেখল। কোমর পর্যন্ত মানুষ। লালচুল–দাঁড়ি। কিন্তু কোমরের নিচ থেকে ঘোড়া। এমন কী একটা লাল লেজও রয়েছে!

হ্যাগ্রিড জানালেন যে এর নাম রোনান।

আর রোনান হচ্ছে একজন সেন্টর। গ্রীক পুরানে–তোমরা নিশ্চয়ই এর কথা শুনেছ। অর্ধমানব আর অর্ধ অশ্বদেহধারী।

ও তুমি রোনান। হ্যাগ্রিড নিরুদ্বেগে জানতে চাইলেন–তুমি কেমন আছ?

রোনান সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত নাড়ল।

গুড আফটারনুন হ্যাগ্রিড। রোনান বলল। তার কণ্ঠে একটা করুণ আর্তি ছিল।

রোনান হ্যাগ্রিডকে প্রশ্ন করল–তুমি কি আমাকে মারতে চেয়েছিলে?

তীরের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে হ্যাগ্রিড বললেন–নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। বনে এমন কেউ ছিল যার থাকার কথা ছিল না। থাক সে কথা। এরা ইল হ্যারি পটার আর হারমিওন গ্রেঞ্জার। তারা দুজনেই ছাত্র। আর ও হল রোনান। একজন সেন্টর।

আমরা দেখেছি। হারমিওন স্তিমিত কণ্ঠে বলল।

গুড আফটারনুন। রোনান বলল–তোমরা কি ছাত্র? তোমরা কি স্কুলে অনেক কিছু শিখেছো?

অল্প-সল্প। বিনীত কণ্ঠে হারমিওন জবাব দিল।

অল্প-সল্প। তবুও কিছু শিখছ রোনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। মাথা পেছনে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ও মন্তব্য করল–আজ মঙ্গলগ্রহ বেশ উজ্জ্বল।

তুমি ঠিকই বলেছ। আকাশের দিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড সায় দিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড বললেন–আমি আনন্দিত যে আমরা একত্রিত হয়েছি। একটা ইউনিকর্ন আহত হয়েছে। তুমি কি তাকে কোথাও দেখেছ?

রোনান কোন জবাব দিল না। সে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–সর্বত্রই দেখা যায় যে নিরীহ ব্যক্তিরাই সবার আগে শাস্তি পায়। এখানেও তাই দেখছি।

হ্যাগ্রিড বললেন–রোনান, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু তুমি কি কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখেছ?

মঙ্গলগ্রহ আজ উজ্জ্বল। রোনান বলল। হ্যাগ্রিড অধীরভাবে রোনানকে লক্ষ্য করছিলেন।

রোনান আবার বলল–আজ রাতে মঙ্গলগ্রহটা অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল।

হ্যাগ্রিড বললেন–তাহলে তুমি অদ্ভুত কিছু দেখনি?

এবারও জবাব দিতে রোনান অনেক সময় নিল।

তারপর বললেন–বনে অনেক জিনিস লুকিয়ে থাকতে পারে।

রোনানের পেছনে গাছে মৃদু আন্দোলন দেখা গেল। হ্যাগ্রিড তার তীর ধনুক প্রস্তুত করতে উদ্যত হলেন। এবার দ্বিতীয় সেন্টর সামনে এল। তার চুল কালো। সে রোনান থেকেও বেশি হৃষ্ট–পুষ্ট।

হ্যালো বেইন। হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি কি ভালো আছো?

গুড আফটারনুন হ্যাগ্রিড, আশা করি ভালো আছো।

ভালো। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন। দেখো, আমি রোনানকে জিজ্ঞেস করছিলাম তুমি কি সম্প্রতি এখানে অদ্ভুত কিছু দেখেছ? এখানে একটি ইউনিকর্ন আহত হয়েছে। তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানো?

বেইন উঠে রোনানের পাশে বসল। আকাশের দিকে তাকাল। তারপর শুধু বলল–আজ রাতে মঙ্গলগ্রহ উজ্জ্বল।

একথা তো আমরা আগেও শুনেছি। হ্যাগ্রিড একটু বিরক্তির সাথে বললেন–ঠিক আছে, তোমাদের দুজনের কেউ যদি কোন অদ্ভুত জিনিস দেখ তাহলে আমাকে জানিও। এবার আমি উঠি।

হ্যারি আর হারমিওনও উঠল। কয়েকটা বৃক্ষ তাদের পথরোধ না করা পর্যন্ত তারা হাঁটতে লাগল।

সেনটরের কাছ থেকে কখনো সরাসরি উত্তর আশা করো না। হ্যাগ্রিড হ্যারি আর হারমিওনের উদ্দেশ্যে বললেন।

এখানে কি অনেক সেন্টর আছে? হারমিওন জানতে চায়।

না, খুবই কম। তারা নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখতে চায়। তবে তারা মাঝে মাঝে বেশ উপকারী হয়ে ওঠে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যায়। তারা অনেক কিছুই জানে কিন্তু বলতে চায় না।

গভীর বনের ভেতর দিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। হ্যারি ভাবছিল সেনটরদের কথা। রাস্তার বাঁকে আসার পর হারমিওন হ্যাগ্রিডের হাত আঁকড়ে ধরে বলল–দেখুন, দেখুন ওখানে লাল শিখা দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তারা বিপদে পড়েছে।

তোমরা দুজন এখানে দাঁড়াও। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমরা এখান থেকে কোথাও যাবে না। আমি এখানেই ফিরে আসব।

বনের ভেতর দিয়ে হ্যাগ্রিডের যাবার শব্দ তারা শুনতে পেল। তারা দুজনেই খুব ভয় পেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পাতার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ তাদের কানে এলো না।

হারমিওন ফিসফিস করে বলল–তোমার কি মনে হয় না তারা আঘাত পেয়েছে।

আমি ম্যালফয়ের জন্য ভাবি না। তবে নেভিলের জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে, কারণ সে প্রথমবারের মতো এখানে এসেছে।

সময় বয়ে যাচ্ছিল। তারা সবাই সজাগ হয়ে রইল। প্রতিটি শব্দ হ্যারিকে সচকিত করে তুলছে। হ্যারি ভাবছিল–কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা এখন কোথায়। অবশেষে একটা জোরালো শব্দ গ্রিডের ফিরে আসার কথা জানাল। হ্যাগ্রিড রাগে ফুঁসছিলেন।

হ্যাগ্রিডের সাথে ছিল ম্যালফয়, নেভিল আর ফ্যাঙ। নেভিলকে কৌতুক করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় সে ভয় পেয়ে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়।

হ্যাগ্রিড বললেন-এবার আমি দল পরিবর্তন করে দিচ্ছি। নেভিল তুমিও হারমিওনের সাথে থাকো। হ্যারি, তুমি এই বুদ্ধ ও ফ্যাঙের সঙ্গে যাও। আমি দুঃখিত। হ্যাগ্রিড ফিসফিস করে হ্যারিকে বললেন–তোমাকে ভয় দেখানো তার জন্য কঠিন। আমাদের কাজটা এভাবেই সারতে হবে।

ম্যালফয় আর ফ্যাঙকে নিয়ে হ্যারি বনের আরো গভীরে যাত্রা শুরু করল। আধঘণ্টা হাটার পর তারা গভীর বনের আরো ভেতরে প্রবেশ করল। আরো কিছুদূর যাবার পর তারা খুবই ঘন গাছের মধ্যে এল যেখানে হাঁটা আর সম্ভবপর ছিল না। সামনে গাছপালা খুব চওড়া এবং ঘন ঘন।

হ্যারির কাছে মনে হল রক্ত ক্রমশঃ পুরু হচ্ছে। একটা গাছের শেকড়ে বেশ রক্ত দেখে হ্যারির কাছে মনে হলো আহত প্রাণীটি আশপাশে কোথাও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একটা পুরনো ওক গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে হ্যারি একটা প্রাণী দেখতে পেল।

ওই দিকে দেখ। ম্যালফয়কে থামাবার জন্য তার বাহুতে হাত রেখে সে নিচু কণ্ঠে বলল।

মাটিতে সাদা উজ্জ্বল কী যেন চিকচিক করছিল। তারা তার কাছাকাছি গেল।

এটা একটা ইউনিকর্ন। মৃত। হ্যারি জীবনে এত সুন্দর প্রাণী দেখেনি। পাগুলো ছিল চিকন। পাগুলোর ওপর অস্বাভাবিক চাপ পড়েছে। মাটিতে পড়ে আছে। ইউনিকর্নের কেশর কালো পাতার ওপর ছড়িয়ে আছে।

হঠাৎ ঝোঁপ থেকে একটা কাপড়–ঢাকা ছায়ামূর্তি ইউনিকর্নের কাছে। এসে রক্তপান করতে শুরু করল।

আর্তনাদ করে ম্যালফয় আরও পিছিয়ে এল। ফ্যাঙও পিছু হটল। কাপড়ে ঢাকা ছায়ামূর্তিটি মাথা তুলে সরাসরি হ্যারির দিকে তাকাল। ইউনিকর্নের রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তারপর দ্রুতগতিতে হ্যারির দিকে ছুটে এল। ভয়ে হ্যারি নড়তে পারছিল না।

হ্যারির তীব্র মাথাব্যথা শুরু হল। এত ব্যথা এর আগে তার কখনও হয়নি। প্রচণ্ড ব্যথায় সে তার হাটুর ওপর হাত রাখল। হ্যারি মাথা উঠিয়ে দেখল ছায়ামূর্তি অপসৃত হয়েছে, একটা সেন্টর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

হ্যারিকে কাছে নিয়ে সেন্টর প্রশ্ন করল–তুমি ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, হ্যারি জবাব দিয়ে প্রশ্ন করল–প্রাণীটা কী ছিল?

সেন্টর হ্যারির প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছিল বিবর্ণ নীলকান্ত মণির মত আশ্চর্যজনকভাবে নীল। সে খুব সতর্কভাবে হ্যারির দিকে তাকাল এবং অনেকক্ষণ ধরে হ্যারির কপালের দাগের দিকে তাকিয়ে রইল।

এরপর বলল–তাহলে তুমিই হ্যারি পটার। তোমার এখন হ্যাগ্রিডের কাছে চলে যাওয়া উচিত। এই বন নিরাপদ নয়। বিশেষ করে তোমার জন্য। তুমি কি আমার পিঠে চড়তে পারো? তাহলে এই পথে তাড়াতাড়ি যেতে পারবে।

সেন্টর বলল–আমার নাম ফিরেঞ্জ। সে সামনের হাঁটু ভাঁজ করে পিঠ কাত করে হ্যারিকে তার পিঠে উঠতে বলল। ওইদিকে ঘন বনের গাছের ডাল–পালা কেটে কারো আসার শব্দ শোনা গেল।

দ্রুতগতিতে রোনান ও বেইন এসে উপস্থিত হলো।

ফিরেঞ্জ, বেইন ধমকের স্বরে প্রশ্ন করল-এটা কী করছ তুমি? তোমার পিঠে একজন মানুষ। তোমার কি লজ্জা করে না? তুমি কী একটি মামুলী খচ্চর?

ফিরেঞ্জ বলল–তুমি কি জানো ছেলেটি কে? এ হল হ্যারি পটার। সে যত তাড়াতাড়ি বনের বাইরে যেতে পারবে ততই তার জন্য ভালো।

তুমি তাকে কী কথা বলছিলে বেইন বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করল ফিরেঞ্জ তোমার কি মনে নেই যে, আমরা শপথ নিয়েছি আমরা স্বর্গের বিরুদ্ধে কিছু করব না। আমরা কি গ্রহ–নক্ষত্রের গতিবিধি পড়িনি?

রোনান নার্ভাস হয়ে মাটি খুঁটতে লাগল।

আমি নিশ্চিত, ফিরেঞ্জ মনে করছে সে ভালো কাজ করছে। খুব বিমর্ষভাবে রোনান এই মন্তব্য করল।

রেগে গিয়ে বেইন তার পেছনের পা দিয়ে মাটিতে লাথি মারল।

অন্যের মঙ্গল–তাতে আমাদের কী এসে যায়? যা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে কেবল তার ওপরই নির্ভর করা সেনটরদের দায়িত্ব। আমাদের বনে বিপন্ন মানুষের সেবা করা আমাদের কাজ নয়।

ফিরেঞ্জ রেগে হঠাৎ তার পেছনের পায়ে ঝাঁকি দিল। তার পিঠে সওয়ার থাকার জন্য হ্যারিকে ফিরেঞ্জের কাঁধ জড়িয়ে ধরতে হয়।

তুমি কি ইউনিকর্নটা দেখতে পাচ্ছ না? ফিরেঞ্জ চিৎকার করে বলল তুমি কি বুঝতে পারছ না–কেন এটা মারা গেছে? গ্রহগুলি কি তোমাকে এই গোপন খবরটি জানায়নি? বনের অপশক্তিগুলো দূর করার জন্য আমি নিজেকে নিয়োজিত করেছি। হ্যাঁ বেইন, প্রয়োজন হলে আমি মানুষের সাথে কাজ করে যাব।

রোনান ও বেইনকে পেছনে রেখে হ্যারিকে নিয়ে ফিরে দ্রুত অরণ্য ছেড়ে গেল।

হ্যারি ঠিক বুঝতে পারছিল না সে কোথায় যাচ্ছে।

তোমার ওপর বেইনের এত রাগ কেন? হ্যারি জানতে চাইল–কী কারণে তুমি আমাকে উদ্ধার করতে চাইছ?

ফিরেঞ্জ তার গতি কমিয়ে হ্যারিকে বলল মাথা নিচু রাখতে যেন ছোট গাছের ডাল–পালার সাথে তার ধাক্কা না লাগে, কিন্তু সে তারির প্রশ্নের কোন জবাব দিল না, দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা নীরবে বনের গাছপালা পার হলো। হ্যারির মনে হল–ফিরেঞ্জ বোধহয় তার সাথে কথা বলতে চায় না। তারা যখন বনের গভীরে ঢুকছিল তখন ফিরে হঠাৎ করে থেমে হ্যারিকে প্রশ্ন করল–হ্যারি পটার, তুমি কী জানো ইউনিকর্নের রক্ত কি কাজে লাগে?

এই অদ্ভুত প্রশ্নে হ্যারি হতভম্ব হয়ে গেল। একটু থেমে হ্যারি জবাব দিল–আমি ঠিক জানি না। আমি শুধু এইটুকু জানি যে শিং, লেজ আর পশম ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়।

ফিরেঞ্জ ব্যাখ্যা করল–ইউনিকর্ন হত্যা করা ভয়াবহ অপরাধ। যার হারাবার কিছু নেই এবং সবকিছু পাবার সম্ভাবনা আছে কেবল সেই লোকই এ ধরনের অপরাধ করতে পারে। তুমি যদি মৃত্যু থেকে এক ইঞ্চি দূরেও থাক, ইউনিকর্নের রক্ত লোমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে। তবে এর জন্য তোমাকে ভয়ঙ্কর মাশুল দিতে হবে। তুমি নিজে বাঁচার জন্য এক পবিত্র অক্ষম প্রাণীকে হত্যা করেছ। তোমার জীবন হবে অর্ধেক জীবন, অভিশপ্ত জীবন। ইউনিকর্নের রক্ত তোমার ঠোঁটে স্পর্শ করার সাথে সাথেই এই জীবন শুরু হবে।

হ্যারি পেছন ফিরে ফিরেঞ্জের মাথার দিকে তাকাল। ওর মাথা চাঁদের আলোতে রূপালী দেখাচ্ছে।

এমন বেপরোয়া কেউ কি আছে? হ্যারি জোরে বলে উঠল–সারা জীবনের জন্য অভিশপ্ত হওয়ার চেয়ে মৃত্যু কি ভাল নয়?

তুমি ঠিক বলেছ। ফিরেঞ্জ বলল–জীবিত থাকার জন্য অন্য কিছু খাওয়া যেতে পারে–যা তোমার শক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে। এমন কিছু যা তোমাকে অমর করে রাখবে। হ্যারি পটার তুমি কি জানো, এই মুহূর্তে স্কুলে কি লুকোনো আছে?

নিশ্চয়ই পরশমণি। জীবনের সুধা। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কে–

তুমি কি এমন কারোরই কথা ভাবতে পারো না যে বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আসার অপেক্ষা করছে, জীবনের সাথে কোনভাবে ঝুলে থাকতে চাচ্ছে, সুযোগের অপেক্ষায় আছে?–ফিরেঞ্জের স্বগতোক্তি।

মনে হল লোহার মুষ্টি হ্যারির হৃদয়কে দুদিক থেকে চেপে ধরেছে। গাছের পাতার মর্মরশব্দের ভেতর দিয়ে হ্যারির মনে হল সে সেই কথা শুনতে পেয়েছে যা হ্যাগ্রিড তাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন।

কেউ বলেন উনি মারা গেছেন, আমি ঠিক জানি না উনি জীবিত না মৃত

তুমি কি বলতে চাচ্ছো তিনি ভল… হ্যারি উৎকণ্ঠিত।

হ্যারি, হ্যারি তুমি ঠিক আছে তো? হারমিওন দৌড়ে তাদের দিকে আসছিল। হ্যাগ্রিড তার পেছন পেছন।

ঠিক কী বলছে তা না বুঝেই হ্যারি বলল—

আমি ভালো। হ্যাগ্রিভ, ইউনিকর্নটা মারা গেছে।

আমি তোমাকে এখানে ছেড়ে যাচ্ছি। ফিরেঞ্জ বিড়বিড় করে বলল।

ইউনিকটা পরীক্ষা করার জন্য হ্যাগ্রিড ছুটে গেল।

তুমি এখন নিরাপদ। তোমার সৌভাগ্য কামনা করি, হ্যারি, ফিরেঞ্জ বলল-এর আগেও সেনটরগণ গ্রহ–নক্ষত্রের ভুল পাঠ করেছেন। আমার মনে হয় এবারও তাই হয়েছে।

হ্যারিকে পেছনে রেখে ফিরেঞ্জ আবার গভীর বনে ফিরে গেল।

***

তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থেকে রন অন্ধকার কমনরুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে কিডিচ খেলার ফাউলকে কেন্দ্র করে সে যখন চিৎকার করে উঠল, তখনই হ্যারি জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগাল। হ্যারি কি কি ঘটেছে বলা শুরু করতেই রনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

হ্যারি বসতে পারছিল না। সে আগুনের সামনে পায়চারি করছিল। তখনও সে কাঁপছিল।

স্নেইপ ভলডেমর্টের জন্য পাথরটা চাচ্ছেন,.. আর ভলডেমর্ট বনে অপেক্ষা করছে। অথচ আমরা ধারণা করে আসছি স্নেইপ পাথরটা চাচ্ছেন নিজে ধনী হওয়ার জন্য।

এসব কথা এখন রাখো তো। রন ফিসফিস করে বলল। রন এমনভাবে কথা বলল যে মনে হচ্ছে ভলভেমৰ্ট কাছাকাছি কোন স্থান থেকে। তার কথা শুনছে। হ্যারি রনের কথা শুনছে না।

ফিরেঞ্জ আমাকে রক্ষা করেছে যদিও এটা তার করার কথা নয়। বেইন খুব ক্ষিপ্ত ছিল। সে বলছিল ফিরে যা করছে তা গ্রহ নক্ষত্রের নির্দেশের হস্তক্ষেপ। তাদেরকে দেখাতে হবে যে ভলডেমর্ট ফিরে আসছে। বেইন মনে করে ফিরেঞ্জের উচিত আমাকে হত্যা করার জন্য ভলডেমর্টকে সুযোগ দেয়া। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে গ্রহ–নক্ষত্রের ভবিষ্যদ্বাণী আছে।

ওই নামটা কি তোমরা বলা বন্ধ করবে? রন ফিসফিস করে বলল।

এখন আমার অপেক্ষা করে দেখতে হবে স্নেইপ কখন পাথরটা চুরি করেন। হ্যারি আস্তে আস্তে বলে চলল–ভলডেমর্ট এসে আমাকে শেষ করে দেবে। আমার মনে হয় বেইন এতে খুশি হবে।

হারমিওন খুব ভয় পেয়েছে মনে হলো। তবে সে হ্যারিকে সান্ত্বনা দিল হ্যারি, সবাই জানে ডাম্বলডোরই একমাত্র ব্যক্তি যাকে ইউ-নো-হু ভয় পায়। যতক্ষণ ডাম্বলডোর আছেন–ততক্ষণ ইউ-নো-হু তোমার গা স্পর্শ করতে পারবে না। কে বলল সেনটররা সব সময় সঠিক কথা বলে? আমার কাছে এটা ভাগ্য–গণনার মত মনে হয়। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বলেন এটা জাদুর একটি অপরিপূর্ণ শাখা।

তাদের কথাবার্তা শেষ হবার আগেই আকাশ ফর্সা হয়ে গেল। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে তারা শুয়ে পড়ল। তবে রাতের বিস্ময় কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। হ্যারি বিছানার চাদর নিচে টেনে ঠিক করার সময় সুন্দরভাবে ভাঁজ করা অবস্থায় তার অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা পেল। পোশাকে একটা চিরকুট পিন দিয়ে আটকানো।

চিরকুটে লেখা—

যদি দরকার হয়।

🔴 দরোজার ফাঁদের ভেতর দিয়ে

সুদূর ভবিষ্যতে হ্যারি কখনও মনে করতে পারবে না এত সহজে কীভাবে সে সব পরীক্ষায় উতরে গেল। আর বিশেষ করে যখন ভলভেমর্টের আগমনের আশঙ্কা তার মাথার ওপর খাঁড়া হয়ে ঝুলছে।

এর মধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কুকুর ফ্লাফি এখনও নিশ্চয়ই সেই তালাবদ্ধ দরোজাটা পাহারা দিচ্ছে।

বড় ক্লাসরুমটা অত্যন্ত গরম। পরীক্ষার জন্য তাদের পালকের কলম দেয়া হয়েছে। এই কলমগুলো জাদু করা যেন কেউ পরীক্ষায় নকল না করতে পারে।

ব্যবহারিক পরীক্ষায় অধ্যাপক ফ্লিটউইক ছাত্রদের এক এক করে ডাকলেন। তারপর বললেন ডেস্কের ওপর নৃত্যরত আনারস তৈরি করতে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদের নির্দেশ দিলেন, ইঁদুরকে নস্যির কৌটা বানাতে। ভালো ফলাফলের জন্য পয়েন্ট দেবার ব্যবস্থা ছিল। বিস্মৃতির ওষুধ তৈরি করার নির্দেশ দিয়ে অধ্যাপক স্নেইপ তাদের অলক্ষ্যে পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে শ্বাস ফেলে সবাইকে নার্ভাস করেন।

কপালের তীব্র ব্যথা সত্ত্বেও হ্যারি যথাসাধ্য ভালো করল। বনে যাওয়ার পর থেকে সে কপালের যন্ত্রণায় ভুগছে। নেভিল ভেবেছিল, হ্যারি পরীক্ষায় ভালো করবে না। কারণ, তার মত হ্যারিরও রাতে ঘুম হয়নি। নেভিলের ধারণা পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় ওর ঘুম হয়নি, কিন্তু আসলে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো। মাঝে মাঝে সে ঘুমের ভেতর রক্তাক্ত ছায়ামূর্তি দেখতে পেতো।

হ্যারি বনে যা দেখেছে–তারা তা দেখেনি। অথবা এমনও হতে পারে যে তাদের কপালে হ্যারির মতো কাটা দাগ নেই। পাথর নিয়ে হ্যারি যতটা উদ্বিগ্ন রন বা হারমিওনকে তেমন উদ্বিগ্ন মনে হয় না। ভুলডেমর্টের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা তাদেরকেও ভাবনায় ফেলেছিল। অবশ্য ভলডের্ট তাদের কাছে স্বপ্নে এসে দেখা দিত না। তারা পরীক্ষার পড়া নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে–স্নেইপ বা অন্য কেউ কী করছেন বা কী করবেন-এ নিয়ে ভাবার মতো সময় তাদের হাতে ছিল না।

শেষ পরীক্ষাটা ছিল জাদুর ইতিহাসের ওপর। এক ঘণ্টার প্রশ্নোত্তর। অধ্যাপক রিনসের ভূত যখন তাদের বলল–কলম বন্ধ কর আর তোমাদের পার্চমেন্ট ভাঁজ কর তখন অন্যদের সাথে হ্যারিও ভীষণ খুশি না হয়ে পারলো না। পরীক্ষার ফলাফল বের হবার আগ পর্যন্ত তাদের ছুটি।

রৌদ্র করোজ্জ্বল মাঠে সবাইকে ডেকে হারমিওন বলল–আমি ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক সহজ।

হারমিওন সব সময় পরীক্ষার পর পরীক্ষার খাতাগুলো আবার দেখে। রন বলে যে এতে করে সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই তারা মাঠে, হ্রদে, বৃক্ষের নিচে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগল।

ঘাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে রন বলল–আবার এত রিভিসনের দরকার কি। পরীক্ষার চিন্তা বাদ দাও হাসিখুশি থাক হ্যারি। এখনও এক সপ্তাহ হাতে আছে। এক সপ্তাহ পর জানা যাবে আমাদের পরীক্ষা কেমন হলো। অতএব এখন চিন্তা করার কোন কারণ নেই। হ্যারি তার কপালে হাত বুলাচ্ছিল।

হ্যারি ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–আমার এই কপালের কাটা দাগ সব সময় আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি যদি জানতে পারতাম-এর অর্থ কী। এর আগেও কষ্ট দিয়েছে তবে এত কষ্ট দেয়নি কখনও।

মাদাম পমফ্রের কাছে যাও। হারমিওন পরামর্শ দিল।

আমি অসুস্থ নই। হ্যারি জবাব দিল–আমার মনে হয় এটা একটা সতর্ক সংকেত, মনে হয় সামনে বিপদ আসছে।

রনও কাজ করতে পারছিল না, কারণ তখন খুব গরম আবহাওয়া ছিল।

রন আর হারমিওন হ্যারিকে সান্তুনা দিয়ে বলল–হ্যারি এত অস্থির হয়ো না। ঘাবড়াবার এত কি আছে, যেখানে ডাম্বলডোর রয়েছেন সেখানে পরশমণি নিরাপদ। আর অধ্যাপক স্নেইপ কখনোই ফ্লাফিকে কোন অবস্থাতেই কাবু করতে পারবেন না।

হ্যারি মাথা নাড়াল, কিন্তু একটা চিন্তা মাথা থেকে কিছুতেই দূর করতে পারছিল না। তার বার বার মনে হচ্ছিল, একটা কাজ তার করা উচিত ছিল কিন্তু করা হয়নি। যখন সে বিষয়টা হারমিওনের কাছে ব্যাখ্যা করল, হারমিওন বলল–সামনে পরীক্ষা। আমি রাত জেগে পড়ছিলাম। পড়ার মাঝখানে আমার মনে হল যে কাজটা আমরা শেষ করেছি।

হ্যারি জানে, তার অস্থির মনের সাথে কাজের কোন সম্পর্ক নেই। হঠাৎ সে দেখলো একটা পেঁচা স্কুলের দিকে উড়ে আসছে। ঠোঁটে একটা চিঠি। আকাশটা উজ্জ্বল, নীল। হ্যাগ্রিড ছাড়া আর কেউ হ্যারিকে চিঠি লেখে না। অবশ্য হ্যাগ্রিড কখনোই ডাম্বলডোরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। হ্যাগ্রিড কখনোই বলবেন না, কীভাবে ফ্লাফিকে কাবু করা যায়–হ্যারি দ্রুত লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। রন জানতে চাইল–কোথায় যাও।

আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আমাদেরকে এখুনি হ্যাগ্রিডের কাছে যেতে হবে।

কেন? হারমিওন প্রশ্ন করল।

তুমি তো জানো, হ্যাগ্রিড কি চান? হ্যারি বলল–তিনি সবার আগে একটা ড্রাগন চান। অনেকেই পকেটে ড্রাগনের ডিম রাখে। এটা কিন্তু জাদু আইনের পরিপন্থী।

তুমি কী করতে চাও? রন জানতে চাইল। এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে হ্যারি বনের দিকে রওনা হল, রন ও হারমিওন তার পেছনে পেছনে গেল।

হ্যাগ্রিড বাইরে আরাম কেদারায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার ট্রাউজার আর জামার আস্তিন গুটানো। মটরশুটি ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে পাশে রাখছিলো।

হ্যালো মুচকি হেসে হ্যাগ্রিড তাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন পরীক্ষা তো শেষ। কি, একটু পানীয় পানের সময় হবে কী?

হ্যাঁ, তা হতে পারে। : বন বলল, কিন্তু হ্যারি ওর কথা থামিয়ে বললো–না, আমাদের একটু তাড়া আছে, হ্যাগ্রিড। আমরা একটা বিশেষ কারণে এখানে এসেছি। আপনার মনে আছে, আপনি যে রাতে নর্বার্টকে ডিমটা পেয়েছিলেন, তখন আপনি যে লোকটার সাথে তাস খেলছিলেন, সে লোকটি দেখতে কেমন।

আমার মনে নেই। হ্যাগ্রিড নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল।

হ্যাগ্রিডের কথা শুনে তারা তিনজনই হতভম্ব হয়ে গেল। হ্যাগ্রিড বললেন, এখানে কত রকম লোক আসে। গ্রামের শেষ প্রান্তের পাবে মদ খেতে কত কিসিমের আজব লোক আসে। কেউ কেউ ড্রাগন ডিলার। ওই লোকটার মুখটাও তো আমি দেখতে পাইনি, মাথার টুপিটা এমন নিচু করে মুখ ঢেকে রেখেছিল। হ্যারি মটরশুটি বৌলের কাছে বসে পড়ল।

হ্যাগ্রিড, আপনি তার সাথে কি কথা বলেছেন। আপনি কি কখনও হোগার্টসের কথা উচ্চারণ করেছেন?

হয়ত বলে থাকতে পারি। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন তাকে আমি এটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে হোগার্টসে আমি একজন গেইম কীপার। তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন আমি কী ধররে প্রাণী দেখাশোনা করি। আমি তাকে বলেছিলাম যে ড্রাগন আমার প্রিয় প্রাণী।

সে কি ফ্লাফির ব্যাপারে কোন আগ্রহ প্রকাশ করেছে?

হ্যারি জানতে চাইল।

হতে পারে, বলে হ্যাগ্রিড মনে করার চেষ্টা করলেন। বলল, হ্যা মনে পাড়েছে, আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ

আচ্ছা, হোগার্টসে তোমরা কটা তিন মাথাওয়ালা কুকুর দেখেছ? তাই আমি তাকে বলেছিলাম–তুমি যদি ওকে শান্ত করতে জান, তা হলে ফ্লাফি একটি কেকের মতো। গান বাজালেই সে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়বে।

হ্যাগ্রিড হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন-এসব তোমাদের বলা আমার উচিত হয়নি। যা বলেছি সব ভুলে যাও। তাকে চিন্তিত মনে হল উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে গিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলেন। হ্যারি, রন আর হারমিওন কেউ কোন কথা বললো না।

বিষয়টা ডাম্বলডোরকে জানাতে হবে। হ্যারি বলল–ফ্লাফিকে কীভাবে বশ করা যায়, হ্যাগ্রিড ওই লোককে বলে দিয়েছেন। আমার ধারণা লোকটা–ছদ্মবেশে হয় স্নেইপ নতুবা ভোলাডেমর্ট। আমার ধারণা, ভালভোর আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন, আমার এটাও বিশ্বাস, ফিরে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন যদি বেন তাকে বাধা না দেয়।

ডাম্বলডোরের অফিস কোথায়?

তারা চারিদিকে দেখতে লাগলো, ডাম্বলডোরের অফিসে যাওয়ার কোন নির্দেশনা দেখা যায় কিনা। ডাম্বলডোর কোথায় থাকেন তারা জানে না কেউ তাদের বলেওনি। ডাম্বলডোরের বাসভবনে কেউ গিয়েছে কখনো, এমন কথাও তারা শোনেনি।

আমাদের করতে হবে… হ্যারি যখন কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই একটা কণ্ঠস্বর হল ঘর থেকে তাদের কানে ভেসে এল।

তোমরা তিনজন এখানে কী করছ? কণ্ঠস্বরটা ছিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের। তার হাতে একগাদা বই।

আমরা অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে দেখা করতে চাই। হারমিওন সাহসের সাথে বলল। হ্যারি, আর রন চুপ রইল।

ম্যাকগোনাগল বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন–ডাম্বলডোরের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাও, কিন্তু কেন? একটু ঢোক গিলে হ্যারি বলল–বিষয়টা গোপনীয়।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের চেহারায় বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট।

তিনি বললেন–দশ মিনিট আগে ডাম্বলডোর বের হয়েছেন। তিনি জাদু মন্ত্রণালয় থেকে জরুরী পেঁচা পেয়ে লন্ডন গেছেন।

তিনি চলে গেছেন? হ্যারি হতাশার সাথে মন্তব্য করল–তাহলে এখন কী হবে?

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যারি, অধ্যাপক ডাম্বলডোর খুব উঁচু মাপের জাদুকর। তার সময়ের মূল্য আছে।

কিন্তু এটাও তো খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়।

মি. পটার। জাদু মন্ত্রণালয়ের কাজের চাইতে কি তোমার কথা বলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

কলড্রনটা বাতাসের দিকে ঠেলতে ঠেলতে হ্যারি বলল–প্রফেসর, বিষয়টা পরশমণি সংক্রান্ত।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল প্রত্যাশা কেন, কল্পনাও করতে পারেননি যে, তিনি এ রকম একটা কথা শুনবেন। অবাক বিস্ময়ে পাথরের মত তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং হাতের বইগুলো হাত থেকে পড়ে গেল। কিন্তু তিনি একটা বইও মাটি থেকে তুললেন না।

তোমরা এসব জানো কীভাবে? ম্যাকগোনাগল প্রশ্ন করলেন।

প্রফেসর–আমার মনে হয়–আমি জানি–অধ্যাপক স্নেইপ এটা চুরি করতে চাচ্ছেন। এই পাথরটা। তাই এ ব্যাপারে ডাম্বলডোরের সাথে আমাকে কথা বলতেই হবে।

সন্দেহ আর বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকালেন। তারপর একটু থেমে বললেন–অধ্যাপক ডাম্বলডোর আগামীকাল ফিরে আসবেন। আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কীভাবে পাথরটার খোঁজ পেলে। তবে নিশ্চিত থেকো–কেউই এটা চুরি করতে পারবে না। এটা এখন নিরাপদেই আছে।

কিন্তু প্রফেসর…

আমি কী বিষয়ে কথা বলছি সেটা আমি জানি। ম্যাকগোনাগল এই কথা বলে মাটি থেকে বইগুলো কুড়িয়ে নিলেন। তারপর একটু থেমে বললেন–তোমরা সবাই একটু বাইরে গিয়ে রোদ উপভোগ কর।

ম্যাকগোনাগল তাদের চোখের আড়ালে চলে যেতেই হ্যারি বলল আজ রাতেই স্নেইপ দরজার ফাঁদ পার হবেন। তার যা যা দরকার সবই তিনি হাতে পেয়ে গেছেন। ডাম্বলডোরকে কৌশলে বাইরে পাঠানো হয়েছে। আমি নিশ্চিত, ডাম্বলডোরের লন্ডন পৌঁছানোর পর জাদু মন্ত্রণালয়ও বিরাট ধাক্কা খাবে।

তাহলে আমরা কী করতে পারি?

হারমিওন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হ্যারি ও রন একটু ঘুরে তাকাতেই দেখে স্নেইপ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে।

তার দিকে তাকাতেই, গুড আফটারনুন, অদ্ভুত ধরনের হাসি হেসে স্নেইপ বললেন-এমন একটি দিনে তো তোমাদের এখানে থাকার কথা নয়।

আমরা হ্যারি কী বলতে কী বলবে, গুছিয়ে নিতে না পারায় তার কিছু বলা হলো না।

সাবধানে থেকো। এইভাবে ঘোরাফেরা করলে লোকে সন্দেহ করবে। আর তোমরা নিশ্চয়ই এটা চাইবে না যে, গ্রিফিল্ডর হাউজ আরো পয়েন্ট হারাক।

তারা বাইরে যেতে উদ্যত হলো। ঠিক তখনি স্নেইপ আবার তাদের ডাকলেন।

হ্যারি, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আবার যদি তোমাকে এভাবে রাতে ঘোরাঘুরি করতে দেখি, তাহলে তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

স্নেইপ স্টাফরুমের দিকে অগ্রসর হলেন।

হ্যারি রন ও হারমিওনের দিকে তাকাল।

আমাদের এখন যা করতে হবে। হ্যারি ফিস ফিস করে বলল আমাদের একজনকে অন্তত স্নেইপকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে। স্টাফ রুমের বাইরে তাকে ফলো করতে হবে। হারমিওন, তোমাকেই এ দায়িত্বটা নিতে হবে।

আমি কেন? হারমিওন প্রশ্ন করে।

কারণ, তুমি এ কাজটা ভালো করতে পারবে। ভান করবে, যেন তুমি ফ্লিটউইকের জন্য অপেক্ষা করছ। কেননা ফ্লিটউইকের সাথে তোমার পরিচয় আছে।

প্রথমে আপত্তি করলেও হারমিওন এই প্রস্তাবে রাজি হলো। হ্যারি বলল–আমাদের এখন চার তুলার করিডোরের বাইরে যাওয়া উচিত। রন, চলে এসো।

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। যে দরোজাটা ফ্লাফি থেকে স্কুলটাকে পৃথক করেছে, সেই দরোজায় তারা হাজির হওয়া মাত্র সেখানে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। তিনি তাদের দেখে রেগে আগুন, তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন–মনে হচ্ছে, তোমরা কাউকেই তোয়াক্কা করার প্রয়োজন মনে করছ না। তোমরা তো একেবারেই সীমা ছাড়িয়ে গেছ। আমি যদি তোমাদের কাউকে এখানে আবার দেখি, আমি গ্রিফিল্ডর হাউজ থেকে আরো পঞ্চাশ পয়েন্ট কেটে নেব। হ্যাঁ, গ্রিফিল্ডর আমার নিজের হাউজ হওয়া সত্ত্বেও

হ্যারি আর রন কমনরুমে ফিরে এলো। হ্যারি শুধু এইটুকু বলেছে–যা হোক হারমিওন স্নেইপের ওপর নজর রাখছে। ঠিক তখনি মোটা মহিলার প্রতিকৃতিটি উন্মুক্ত হলো এবং হারমিওনও এসে উপস্থিত হলো।

হ্যারি, আমি দুঃখিত। হারমিওন বলল–স্নেইপ এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি করছি। আমি বললাম–আমি ফ্লিটউইকের জন্য অপেক্ষা করছি। ফ্লিটউইককে আনার জন্য স্নেইপ চলে গেলেন। আমিও চলে এসেছি। আমি জানি না স্নেইপ আসলে কোথায় গেছেন।

ঠিক আছে। হ্যারি জবাব দিল।

অন্য দুজন তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ ও চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে।

হ্যারি বলল–আমি আজ রাতে বেরিয়ে পরশমণির খোঁজ করব।

তুমি কি পাগল হয়েছ? রন বলে উঠল।

না তুমি যেতে পারবে না। হারমিও বলল–বিশেষ করে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল আর স্নেইপের সাবধানের পর। তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দেবে।

হ্যারি জবাব দিল–বহিষ্কারই তো হবে আর কী? তোমরা কি বুঝতে পারছ না–স্নেইপ যদি পাথরটা পেয়ে যান তাহলে ভোলডেমর্ট ফিরে আসবে। সে তার ক্ষমতা ফিরে পেতে চায়। সে এলে হোগার্টসকে কালো জাদুর বিদ্যালয়ে পরিণত করবে। তোমরা কী মনে কর, গ্রিফিল্ডর হাউজ কাপ পেলেও তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে সে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবে। আমার পরশমণি পাবার আগে ওরা যদি আমাকে ধরে ফেলে, আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি বাড়ি ফিরে যাব। আজ রাতে আমি গোপন দরোজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করব। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না। মনে রেখো ভোলডেমট আমার বাবা–মাকে হত্যা করেছে।

তুমি ঠিকই বলেছ, হ্যারি। হারমিওন নিচু কণ্ঠে বলল।

হ্যারি বলল–আমি আমার অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা ব্যবহার করবো। ভাগ্য ভালো, পোশাকটা পাওয়া গেছে।

রন বলল-এ পোশাকটা কি আমাদের তিনজনকে ঢাকবে?

তিনজন কেন? হ্যারি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

তুমি কি ভেবেছ–আমরা তোমাকে একা যেতে দেব?

অবশ্যই নয়। হারমিওন সাথে সাথে করল–তুমি কি করে ভাবলে, আমাদেরকে বাদ দিয়ে তুমি পরশপাথরের খোঁজে যাবে? আমি এক নজর বইগুলো দেখে আসি। হয়ত সেখানে জরুরী কিছু পেয়েও যেতে পারি। যদি আমরা ধরা পড়ি তাহলে তোমাদেরকেও তো স্কুল থেকে বের করে দেয়া হবে। হ্যারি বলল।

না, আমার বেলায় তা হবে না। হারমিওন বলল–ফ্লিটউইক আমাকে গোপনে বলেছেন যে, আমি তার পরীক্ষায় ১১২% নম্বর পেয়েছি। এরপর তারা আমাকে আর স্কুল থেকে বের করে দেবে না।

***

ডিনারশেষে তারা তিনজন কমনরুমে গিয়ে বসলো, তারা চিন্তিত। কেউ তাদের ধারে কাছেও ভিড়লো না। গ্রিফিন্ডারের কারো যেন হ্যারির সঙ্গে কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই। এই প্রথমবারের মতো হ্যারি এ ধরনের উপেক্ষা নিয়ে মাথা ঘামালো না।

হারমিওন আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, বইয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা। হ্যারি আর রন তেমন কোন কথাবার্তা বলেনি। তাদের দুজনেরই মাথায় চিন্তা–আজ রাতে তারা যে কাজে বেরুবে সেটা নিয়ে।

এক সময় কমনরুম খালি হয়ে গেল। প্রায় সবাই শুতে গেছে।

অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা নিয়ে এসো। রন আস্তে আস্তে বলল।

হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ডর্মিটরিতে গেল। পোশাকটা নেবার সময় বাঁশির ওপর হ্যারির দৃষ্টি গেল। বাঁশিটি হ্যাগ্রিড তাকে তার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। এই বাঁশিটা ফ্লাফির ওপর প্রয়োগ করলে কেমন হয়!

হ্যারি আবার কমনরুমে ফিরে এলো।

আমরা এখানেই পোশাকটা পরে দেখি তিনজনের হয় কিনা। আবার ফিলচ আমাদের কাউকে দেখে ফেলে–সে ভয়ও রয়েছে।

তোমরা কী করছ? ঘরের কোন থেকে একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

নেভিলের কণ্ঠস্বর।

পোশাকটা পেছনে ভাল করে হ্যারি তাড়াতাড়ি বলল–না, কিছু না।

তাদের অপরাধী অপরাধী মুখের দিকে তাকিয়ে নেভিল বলল–তোমরা নিশ্চয়ই আবার বাইরে যাচ্ছো? তোমরা আবারও ধরা পড়বে। আবার গ্রিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কাটা যাবে।

হ্যারি জবাব দিল–তুমি বুঝতে পারবে না। আমাদের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নেভিলও ওদের থামাবার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সে বলল আমি তোমাদের যেতে দেব না। প্রতিকৃতির গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে নেভিল বলল–আমি তোমাদের বাধা দেব।

নেভিল রন বলল–সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। বুদ্ধুর মত কাজ করো না।

আমাকে বুন্ধু বলল না। নেভিল বলল–আমি তোমাদেরকে আর নিয়ম ভাঙতে দেব না। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা তোমরাই আমাকে শিখিয়েছ।

আমাদের বিষয়ে তোমাকে একথা বলা হয়নি। রন হতাশার সুরে বলল–নেভিল তুমি বুঝতে পারছ না তুমি কি করছ?

রন এক পা আগে বাড়ল। নেভিল তার ব্যাঙ ট্রেভরকে মাটিতে ফেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমাকে আঘাত করে যেতে পারলে যাও। নেভিল হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল–আমি তোমাদের বাধা দেয়ার জন্য প্রস্তুত।

হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকাল।

কিছু একটা করো। অস্থির হয়ে হ্যারি বলল।

হারমিওন আগে বাড়ল।

নেভিল, হারমিওন বলল–সত্যিই আমি তোমার ব্যবহারে খুবই দুঃখ পেয়েছি।

হারমিওন এবার তার জাদুদণ্ড ওঠাল।

পেট্ৰিফিকাশ টোটালাস। নেভিলের প্রতি ইঙ্গিত করে সে এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করল।

নেভিলের মুষ্টিবদ্ধ হাত শিথিল হয়ে ঝুলে পড়ল। সারা পা–শরীর পাথর হয়ে গেল। তারপর একটু নড়ে উঠে দুম করে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

হারমিওন দৌড়ে নেভিলের কাছে গেল। তার দাঁতে খিল লেগে গেছে। তাই সে কথা বলতে পারছে না। কেবল তীর চোখ কাজ করছে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নেভিল শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

তাকে তুমি কী করেছ? হ্যারি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

আমি তার শরীর নিশ্চল করার জাদু করেছি। হারমিওন জবাব দিল নেভিলের ওপর এ জাদু প্রয়োগ করতে হয়েছে বলে আমার খুব খারাপ লাগছে।

নেভিল, আমরা এটা করতে বাধ্য হয়েছি। ব্যাখ্যা করার মতো সময়ও। আমার হাতে নেই। হ্যারি বলল।

নেভিল তুমি পরে এটা বুঝতে পারবে। নেভিলের দেহের ওপর দিয়ে যেতে যেতে রন বলল। তারা অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা পরে ফেলো।

নেভিলকে এভাবে বেহুশ অবস্থায় ফেলে যাওয়াও ঠিক হচ্ছে না। এই নিয়ে তারা তিনজনই খুব উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় প্রতিটি ছায়ামূর্তিকেই তারা ফিলচ বলে মনে করতে লাগল। আর প্রতি মুহূর্তে ভয় করছিল-এই বুঝি পিভিস তাদের ওপর লাফিয়ে পড়বে। সিঁড়ির গোড়ায় তারা মিসেস নরিসকে দেখতে পেল।

তাকে লাথি দিয়ে ফেলে দেই। রন হ্যারির কানে কানে বলল। হ্যারি মাথা নাড়িয়ে না বলল। নরিস তার উজ্জ্বল চোখ দিয়ে তাদের দিকে তাকালেও সে কিছু করেনি।

চার তলার সিঁড়িতে ওঠার আগে তারা কাউকেই দেখেনি। চার তলায় এসে পেল পিভসকে। পিভস কার্পেটটা ঝাড়ুছিল। পিভস চিৎকার করে উঠল–কে ওখানে?

সে তার কালো চোখ ছোট করে বলল–আমি দেখতে না পেলেও আমি জানি তোমরা এখানে আছে। সে ছন্দ করে প্রশ্ন করলো, তোমরা কারা? তোমরা কী ভূত না পেত্নি, না ছাত্র না জন্তু…।

সে বাতাসে ভর করে তাদের কাছে চলে এলো।

আমি কি ফিলচকে ডাকব? পিভস বলল। কোন কিছু যদি অদৃশ্য হয়ে আমার চারদিকে ঘোরে তাহলে আমাকে তাই করতে হবে।

হঠাৎ হ্যারির মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। ধমকের স্বরে বলল, ব্লাডি ব্যারনের প্রয়োজন হলে সে অদৃশ্য হবেই। পিভস হ্যারিকে ব্যারন মনে করে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো।

নরম তল তলে স্বরে পিভিস বলল, জ্বী স্যার, জ্বী স্যার।

নিজেকে ব্লাডি ব্যারন বলে পরিচয় দিয়ে হ্যারি অনায়াসে ছাড়া পেয়ে গেল।

পিভস। হ্যারি একটু কর্কশকণ্ঠে বলল–আমাদের এখানে কিছু কাজ আছে। আজ রাতটার জন্য এখান থেকে একটু দূরে সরে থাকো।

আমি অবশ্যই দূরে থাকব স্যার। পিভস খুব বিনয়ের সাথে বলল আশা করি আপনার কাজ ঠিকভাবে হবে। পিভস তৎক্ষণাৎ বিদায় নিল।

চমৎকার হ্যারি। রন ফিসফিস করে বলল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা চার তলার করিডোরে পৌঁছলো। দরোজা আগে থেকেই খোলা ছিল।

আমরা এসে গেছি। হ্যারি নিচু কণ্ঠে বলল–স্নেইপ ইতোমধ্যেই ফ্লাফিকে অতিক্রম করেছেন।

দরোজা খোলা দেখে তাদের তিনজনেরই ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারিত হয়ে গেল।

পোশাকের ভেতরে থেকেই হ্যারি অন্য দুজনের উদ্দেশ্যে বলল তোমরা যদি ফিরে যেতে চাও যেতে পার, আমি তোমাদের দোষ দেব না। ফিরে যাওয়ার সময় অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা নিয়ে যেতে পারো। এটার প্রয়োজন আমার আর নেই।

বোকার মত কাজ করো না। রন বলল।

আমরা তোমার সাথেই আছি। হারমিওন বলল।

হ্যারি ধাক্কা দিয়ে দরোজাটা খুলল।

দরোজা খোলার সাথে সাথে কুকুরের গর্জন তাদের কানে ভেসে এলো।

কুকুরটা এর তিনটি নাক দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করছে। যদিও কুকুরের দৃষ্টি ছিল তাদের দিকে কিন্তু তাদেরকে দেখেনি।

তার পায়ে এটা কী? হারমিওন ফিসফিস করে প্রশ্ন করল।

বীণার মত মনে হচ্ছে। রন বলল নিশ্চয়ই অধ্যাপক স্নেইপ এটা ফেলে গেছেন। বাঁশি বাজানো শেষ হওয়া মাত্রই কুকুরগুলো জেগে উঠবে। হ্যারি বলল।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের দেয়া বাঁশিটা ঠোঁটে লাগিয়ে বাজাতে শুরু করল। বাঁশিতে হ্যারি তেমন কোন সুর তুলল না। কিছুক্ষণের মধ্যে কুকুরের ঘেউ ঘেউ বন্ধ হলো। হ্যারির বাঁশী শুনে কুকুর আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ল। গর্জন স্তিমিত হয়ে এলো। হাটু মুড়ে কুকুরটা বসে পড়ল। তারপরই মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

অদৃশ্য হওয়ার পোশাক থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁদের দরোজার দিকে যেতে যেতে রন বলল–বাঁশী বাজিয়ে যাও। এগিয়ে যেতে যেতে তারা যখন কুকুরের দানবীয় মাথার কাছাকাছি পৌঁছল তখন তারা কুকুরের নিঃশ্বাসের তাপ অনুভব করল।

রন বলল–আমার মনে হয়–চেষ্টা করলে আমরা দরোজাটা খুলতে পারব। হারমিওন, তুমি কি আমার সাথে যাবে?

না, আমি যাব না। হারমিওন বলল।

ঠিক আছে। দাঁতে দাঁত চেপে রন বলল। কুকুরের লেজ অতিক্রম করে রন ফাঁদের দরোজার হাতল চাপতেই দরোজাটা খুলে গেল।

তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ? হারমিওন উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করল।

রন বলল না, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। কিছু ধরে নিচে নামারও কোন উপায় নেই। আমাদেরকে লাফ দিতে হবে।

হ্যারির বাঁশি বাজানো তখনও শেষ হয়নি। তার দিকে তাকানোর জন্য হ্যারি রনকে ইশারা করল।

হ্যারিকে রন বলল–তুমি কি সবার আগে যেতে চাও? আমি জানি না স্থানটি কতটা গভীর। হ্যারি বাঁশি হারমিওনকে দিল, যাতে সে বাঁশি বাজিয়ে কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারে।

কয়েক মুহূর্ত বাঁশি বাজানো বন্ধ থাকায় কুকুরটা মৃদু স্বরে ঘেউ ঘেউ করল। হারমিওন যখন আবার বাঁশি বাজানো শুরু করল তখন কুকুরটা আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

হ্যারি ওপরে উঠল। সেখান থেকে নিচে তাকিয়ে সে কোন খেই খুঁজে পেল না। হ্যারি মাথা নিচু করে তার হাতের আঙুলের ওপর ভর দিল। এবং দরোজার ফঁদের ভেতর দিয়ে ওপরে রনের দিকে তাকিয়ে বলল–আমার যদি কোন কিছু ঘটে তাহলে তোমরা আর আমার পেছনে আসবে না। সরাসরি পেঁচাঁদের কাছে চলে যাবে এবং হেডউইগকে অধ্যাপক ডাম্বলডোরের কাছে পাঠিয়ে দেবে।

ঠিক আছে। রন জবাব দিল। আশা করি এক মিনিটের ভেতর আবার দেখা হবে।

হ্যারি নিচে ঝাঁপ দিল।

গভীর, গভীর তলদেশ। সে নিচে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কোথায় এর শেষ কে জানে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস।

ধপ করে হ্যারি নরম কোন বস্তুর ওপর পড়ল। মনে হল নরম কোন উদ্ভিদ।

হ্যারি ওপরের দিকে চেঁচিয়ে বলল–রন, ঝাঁপ দাও। ভয় নেই। এখানে রম কিছু আছে।

রন লাফ দিয়ে হ্যারির কাছে চলে এলো।

জিনিসটা কী? রন প্রথমেই প্রশ্ন করল।

মনে হচ্ছে এক ধরনের উদ্ভিদ। তারপর হারমিওনের উদ্দেশ্যে বলল হারমিওন তুমিও চলে এসো।

দুরের বাঁশি বন্ধ হয়ে গেছে। বিকট আওয়াজে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। হারমিওনও ঝাঁপ দিয়ে তাদের কাছে চলে এল।

আমরা এখন স্কুল থেকে অনেক অনেক দূরে। হারমিওন মন্তব্য বলল।

আমাদের ভাগ্য ভালো, এখানে উদ্ভিদ ছিল। রন বলল।

ভাগ্যবান! শব্দটি উচ্চারণ করেই হারমিওন চিৎকার করে উঠল।

তোমরা দুজনেই নিজেদের দিকে লক্ষ্য কর।

কোন কিছু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হারর্মিওন লাফ দিয়ে একটি স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। সে কোন কিছু থেকে আত্নরক্ষার জন্য হাত পা ছুড়ছে। সে যখন উদ্ভিদের ওপর লাফ দেয় তখন উদ্ভিদটার লতা সাপের মত পেচিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরেছে।

হ্যারি আর রনের অজান্তেই সাপ জাতীয় উদ্ভিদ তাদের পা জড়িয়ে ধরেছে।

হারমিওন কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে লতার বন্ধন থেকে মুক্ত করলেও হ্যারি আর রনকে লতা শক্ত করে জাপটে ধরেছে। তারা বাধন শিথিল করার জন্য যতই চেষ্টা করছে বন্ধন ততই শক্ত হচ্ছে।

হারমিওন বলল–তোমরা নড়াচড়া করো না। আমি জানি এটা কী। এটাকে বলা হয় ডেভিলস স্নেয়ার বা শয়তানের কাজ।

আমি খুশি হয়েছি যে, তুমি লতাটার নাম জানো। এটাও একটা বিরাট সাহায্য। এই বলে রন তার গলা থেকে লতার বাঁধন খোলার চেষ্টা করল।

চুপ করে থাক। এটাকে কীভাবে হত্যা করা যায় সেটা আমি মনে করার চেষ্টা করছি। হারমিওন বলল।

রন চিৎকার করল–আমাকে বাঁচাও। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

শয়তানের কাজ। অধ্যাপক স্প্রাউট এ বিষয়ে ক্লাসে কি বলেছিলেন হারমিওন মনে করতে পারছে না।

হ্যারি বলল আগুন জ্বালাও।

আগুন তো জ্বালাব। কিন্তু কাঠ কোথায়? হারমিওন প্রশ্ন করল।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রন চিৎকার করল। তুমি না জাদুকর?

ওহ! ঠিক বলেছ। বলে হারমিওন তার জাদুদণ্ড বের করল।

কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করল। বহ্নিশিখা ছুঁড়ে দিল। এ শিখ সে অধ্যাপক স্নেইপের দিকেও ছুঁড়ে দিয়েছিল। নীল ধোঁয়া এসে তার বাধন ঢিলে করে দিল। হ্যারি ও রন বাঁধন খুলে নিজেদের মুক্ত করল।

এরপর থেকে তুমি হার্বোলোজিতে আরো বেশি মনোযোগ দিও। হ্যারি তার মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল।

আমিও তাই বলি। রন বলল, আর এটা আমাদের সৌভাগ্য যে, কোন সঙ্কটের সময় হ্যারি মাথা গরম করে না।

এই পথে যেতে হবে। হ্যারি একটা পথের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

হঠাৎ পানির ছলাৎছল আওয়াজ।

কিছু শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

কোন ভূত প্রেত নয় তো।

বলা মুশকিল। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা নড়ছে।

হঠাৎ সামনে পড়ল উজ্জ্বল আলোকিত একটা ঘর। উঁচু সিলিং? আর্চের মতন। এক ঝাঁক পাখি উড়ছে। নানা রঙের পাখি। একদিকে একটা মোটা কাঠের দরোজা।

রন বলল–ঘরটা পেরোতে গেলে কি তারা আমাদেরকে আক্রমণ করবে?

হতেও পারে! হ্যারি বলল। তবে ওদের খুব খারাপ মনে হচ্ছে না। ওরা যদি সত্যিই আমাদেরকে আক্রমণ করে আমি দৌড় দেব।

হ্যারি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকল। তারপর ঘরের ভেতর দিয়ে দৌড় দিল।

হ্যারির আশঙ্কা ছিল পাখিরা তাদের তীক্ষ্ণ ঠোই বা নখ দিয়ে যেকোন সময় তাকে আক্রমণ করতে পারে।

কিন্তু ভাগ্য ভাল তেমন কিছু ঘটেনি। হ্যারি নির্বিঘ্নে দরোজার কাছে গিয়ে হাতল ধরে টান দিল, দরোজা খুলল না। দরোজাটা তালাবদ্ধ।

রন ও হারমিওন হ্যারিকে অনুসরণ করল। দরোজার সামনে এসে তারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা দরোজাটাকে একটুও নড়াতে পারল না। হারমিওনের মন্ত্রোচ্চারণও কোন কাজে আসল না।

এখন কি হবে? হ্যারি প্রশ্ন করল।

এ পাখিগুলো নিশ্চয়ই সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নয়। হারমিওন মন্তব্য করল।

তারা পাখিগুলোকে লক্ষ্য করলো।

এগুলো পাখি নয়। এগুলো উড়ন্ত চাবি। হ্যারি মন্তব্য করল।

দেখ, ঝাড়ু পাওয়া যায় কিনা।

ঝাড়ু নিয়ে উড়ে গিয়ে তারা চাবিগুলো ধরতে গেল, কিন্তু জাদু করা চাবি তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেল।

হ্যারি ছিল শতাব্দীর কনিষ্ঠতম সিকার। অন্যান্য লোকের তুলনায় কোন কিছু চেনার তার ক্ষমতা ছিল বেশি। মিনিটখানেক পরই রঙধনুর মতো পালকের ভেতর একটা চাবি হ্যারির নজরে পড়ল। রূপালী রঙের চাবি। হ্যারি দ্রুত চাবি ছিনিয়ে নিয়ে নিচে নেমে এল।

হ্যারি চাবি নিয়ে তালায় ঢুকাল, কিন্তু কোন কাজ হলো না।

হ্যারি বলল–রন, ওই চাবিটা আন তো। ওই পাশের বড় বাঁকা চাবিটা।

আমাদের সবাইকে কাছাকাছি থাকতে হবে। হ্যারি বলল–রন তুমি ওপরে থাকে। আর হারমিওন, তুমি নিচে।

রন দ্রুতগতিতে হ্যারির দেখানো স্থানে উঠতে গিয়ে তার মাথা ছাদে ধাক্কা খেল এবং অল্পের জন্য ঝাড়ু থেকে পড়ে যেতে যেতে রক্ষা পেল।

আর নিচে যেও না। আমি চেষ্টা করছি। তুমি এটা ধর। ঠিক আছে। এখনই আমদের এটা ধরতে হবে।

ওপর থেকে রন নিচে ঝাঁপ দিল। হারমিওন গেল ওপরের দিকে। কিন্তু চাবিটা তাদের দুজনকেই ফাঁকি দিয়ে দেয়ালের দিকে চলে গেল। এরপর হ্যারি ওষ্টার পেছনে ছুটলো। চাবিটা কেবল দেয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হ্যারি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চাবিটাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। এবার আর চাবি তাকে ফাঁকি দিতে পারল না। ধরা দিতেই হল। নিচে রন আর হারমিওনের উল্লাস শোনা গেল।

ওরা নিচে নেমে দরোজার দিকে দৌড় দিল। তালায় চাবি ঢুকিয়ে ঘোরাতেই দরোজা খুলে গেল। তালা খোলার সাথে সাথেই চাবিটা আবার উড়ে চলে গেল।

তোমরা প্রস্তুত? হ্যারি রন আর হারমিওনকে জিজ্ঞেস করল। হ্যারি দরোজার হাতলে হাত রাখল। তারা দুজন মাথা নাড়িয়ে জানাল তারা প্রস্তুত।

হ্যারি দরোজা খুলে ফেলল।

ভেতরের ঘরটি অন্ধকার। এত অন্ধকার যে এ ঘর থেকে তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু যখন ঘরে প্রবেশ করল ঠিক তখনই আলোর বন্যা পুরো ঘরটিকে উদ্ভাসিত করে দিল। আলোতে তারা যা দেখল তা সত্যিই এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

বিশাল এক দাবাবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরের এক দাবা খেলোয়াড়। কিন্তু দড়ির কোন মুখ নেই।

এখন কী করা? হ্যারি ফিসফিস করে বলল।

এটাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। রন জবাব দিল-এখন আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকে আমাদের কাজ সারতে হবে।

তারা পেছনে আরেকটা দরোজা দেখতে পেল।

এখন কী হবে? নার্ভাস হয়ে হারমিওন প্রশ্ন করল।

আমার মনে হচ্ছে রন বলল–আমাদেরকে দাবাড়ু সাজতে হবে। তারা ব্ল্যাক নাইটের ঘোড়া স্পর্শ করার সাথে সাথেই পাথরে প্রাণ এল। ব্ল্যাক নাইট তাদের অভিবাদন জানাল! দাবার ছকের ঘুটি সব জীবন্ত হয়ে উঠল।

এই স্থান অতিক্রম করার জন্য আমাদেরকেও কি দাবা খেলায় যোগ দিতে হবে?

ব্ল্যাক নাইট মাথা নাড়াল। হ্যারি রন ও হারমিওনের দিকে তাকাল।

হ্যারি আর হারমিওন চুপ করে অপেক্ষা করছিল, রন যেন কি ভাবছে। অবশেষে সে বলল–আমার কথায় তোমরা কেউ কষ্ট পেয়ো না। আসলে তোমাদের দুজনেরই কেউই দাবা খুব ভালো খেলতে পারো না।

আমরা কিছু মনে করিনি। হ্যারি বলল–আমাদের কি করতে হবে কেবল সেটা বলে দাও।

ঠিক আছে, হ্যারি তুমি বিশপ হও। আর হারমিওন তুমি কিস্তির পরিবর্তে হ্যারির পাশে দাঁড়াও।

আর তুমি কী হবে?

রন বলল–আমি নাইট হব।

দাবা খেলা জমে উঠল।

রন আটকা পড়ে গেছে। সে বলল–আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও।

–না, তা হতে পারে না। হ্যারি আর হারমিওন দুজনেই চিৎকার করে উঠল।

আরে এটাই তো দাবা খেলা। এখানে কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। সাদা রানী আমাকে গ্রাস করবে। হোয়াইট কুইন। ফাঁকা জায়গা। তোমরা পালাও। হ্যারি, তোমার রাজাকে বাঁচাও।

কিন্তু।

তুমি কী স্নেইপকে আটকাতে চাও, না চাও না?

রন–

দেখ, যদি দেরি করো, তাহলে স্নেইপ পাথর পেয়ে যাবে। আর পরশমণি চিরকালের জন্য আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

তোমরা প্রস্তুত? রন প্রশ্ন করল-এই আমি যাচ্ছি। তোমরা জেতার পর আর অপেক্ষা করবে না।

রন এগিয়ে গেল। সাদা রানী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোহার হাত দিয়ে সে রনের মাথায় আঘাত করল। রন মেঝের ওপর ছিটকে পড়ল। সাদা রানী তাকে একদিকে ছুঁড়ে ফেললো। হারমিওন চিৎকার করে উঠল।

এবার হ্যারির যুদ্ধ সাদা রাজার সাথে। রাজা তার মুকুট খুলে হ্যারির দিকে ছুঁড়ে মারল।

তারা জয়লাভ করল। পাথরের দাবাড়ুরা মাথা নত করে ধীরে ধীরে ভেগে পড়লো। দরোজা খোলা রেখেই হ্যারি ও হারমিওন শেষবারের মতো রনের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে এগুলো।

রনের কি হবে? হারমিওন জানতে চাইল।

রন ঠিক হয়ে যাবে। হ্যারির জবাব অনেকটা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো।

এখন আমরা কি করবো।

আমরা স্প্রাউটকে পার হয়ে এলাম, শয়তান জাদুটা করেছে ফ্লিটউইক চাবিগুলোকে মন্ত্র পড়িয়ে রেখেছেন। ম্যাকগোনাগল দাবাড়দের ভেতর শারীরিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, যাতে তারা প্রয়োজনে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এরপর বাকি থাকে অধ্যাপক কুইরেল আর স্নেইপ…।

তারা আরেকটা দরোজার সামনে উপস্থিত হলো।

সব ঠিক আছে তো? হ্যারি নিম্নকণ্ঠে বলল।

আগে বাড়ো।

হ্যারি দরোজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলল।

বিশ্রী গন্ধ তাদের নাকে এল। বাধ্য হয়ে তারা নাকে কাপড় দিল। তাদের চোখ ভিজে গেল। তারা দেখল তাদের সামনে একটা বিরাট দানব। তারা যে দানবটাকে কুপোকাত করেছিল এটা তার চেয়ে অনেক বড়। মাথায় একটা কুঁজ।

আমাদের ভাগ্য ভালো, ওটার সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়নি। হ্যারি অস্ফুট কন্ঠে বলল। তারপর তারা দানবের বিশাল পা ডিঙ্গিয়ে অগ্রসর হলো। হ্যারি বলল–চলে এসো। আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না।

হ্যারি ধাক্কা দিয়ে পরের দরোজাটা খুলল। এরপর তাদের সামনে কি আসতে পারে দেখার মতো সাহস তাদের ছিল না। না, এখানে ভয় পাবার মত কোন কিছু ছিল না। একটা টেবিল, টেবিলের ওপর বিভিন্ন ধরনের সাতটা বোতল সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে।

স্নেইপের কাজ। হ্যারি বলে উঠল–আমাদের কী করা উচিত?

হঠাৎ দরোজার কাছে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। অর্থাৎ ওরা হ্যারি, রন আর হারমিওন-এখন আটকা পড়ে গেছে। হারমিওন বোতলের পাশ থেকে এক টুকরো কাগজ তুলে নিল। কাগজটাতে লেখা–

বিপদ তোমার সামনে যখন নিরাপদ তোমার পেছনে 
আমাদের দুজন তোমাকে সাহায্য করবে যেভাবে তুমি পেতে চাও 
আমাদের সাতজনের একজন তোমাকে সামনে নিয়ে যাবে 
আরেকজন মদ্যপায়ী পেছনে নিয়ে আসার বাহন হবে 
আমাদের দুজন শুধু নিখাঁদ মদ নিয়ে টিকে আছে 
আমাদের তিন জন খুনি, অপেক্ষা করে আছে আড়ালে 
পছন্দ করো, অন্যথায় আজীবন তোমাকে এখানে থাকতে হবে 
আর তোমার পছন্দের জন্য আমরা চারটি সমাধান সূত্র দেব 
এক, যদি তুমি বিষ গোপন করার চেষ্টা কর, সেটি হবে হাস্যকর 
তুমি সর্বদা কিছু নিখাঁদ মদ পাবে বাম পাশে
দুই. যারা শেষে দাঁড়িয়ে আছে তাদের দেখবে ভিন্নতর
যদি তুমি সামনে এগোও কাউকেই বন্ধু হিসেবে পাবে না 
তিন, যেমন পরীক্ষার তুমি দেখো, বিভিন্ন আকারের তারা
অথবা অভিন্ন; ডোয়ার্ক বা অতিকায় কেউই ভেতরে মরে না 
চার, বামদিকের দ্বিতীয় ও ডানদিকের দ্বিতীয়টি যদি চেখে দেখ 
অভিন্ন স্বাদের; যদিও প্রথম দেখায় ভিন্ন মনে হবে।

হারমিওন এই লেখার মধ্যে একটা ইঙ্গিত খুঁজে পেল। হ্যারি বিস্মিত হয়ে দেখল যে হারমিওন মুচকি মুচকি হাসছে।

চমৎকার। হারমিওন বললো। এটা কিন্তু জাদু নয়। এটা একটা ধাঁধা। অনেক বড় বড় জাদুকরের মাথায় একবিন্দু যুক্তি কাজ করে না। তারা জীবনের জন্য এখানে আটকা পড়ে।

তাহলে আমরা এই কাগজের লেখাই মেনে চলব, কি বল?–হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

অবশ্যই। হারমিওন জবাব দিল–আমাদের যা যা দরকার সবই এই কাগজে লেখা আছে। এখানে সাতটা বোতল। তিনটা বিষাক্ত, দুটো মদের বোতল। একটা আমাদেরকে নিরাপত্তা দেবে। অন্যটা আমাদেরকে জাদুর জাল ভেদ করে নিয়ে যাবে।

কিন্তু কী করে বুঝব কোনটা পান করার মদ?

এক মিনিট। হ্যাঁ, পেয়েছি। ছোট বোতলটা। কাগজে লেখা আছে ওটাই আমাদেরকে কালো আগুনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবে–পরশমণির কাছে।

হ্যারি ছোট বোতলটার দিকে তাকাল।

এখানে তো মাত্র একজনের পানীয় আছে। হ্যারি বলল-এক চুমুকও তো হবে না।

তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।

কোনটা তোমাকে আগুন থেকে বাইরে নিয়ে যাবে?

সারির শেষে একটি গোলাকার বোতলের দিকে হারমিওন ইশারা করল।

তুমি ওটা পান কর। হ্যারি বলল–না, না শোনে, ফিরে গিয়ে রনকে নিয়ে চাবির ঘর থেকে আগে ঝাড়ুটি নিয়ে এসো। এরপর রনকে নিয়ে এসো এবং ফাঁদের দরোজা দিয়ে কুকুরটা পার হও। তারপর যাবে পেঁচাঁদের কাছে। হেডউইগকে ডাম্বলডোরের কাছে পাঠিয়ে দাও। তাকে দরকার। আমি স্নেইপকে কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারব, কিন্তু তিনি আমার চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী।

কিন্তু হ্যারি, স্নেইপের সাথে যদি ইউ-নো-হু থাকে তাহলে কী হবে?

আমি এক সময় সৌভাগ্যবান ছিলাম। নয় কি? সে তার কপালের দাগের প্রতি ইশারা করল–আশা করি, সেই ভাগ্য আরেকবার আমাকে দেখা দেবে।

হারমিওনের ঠোঁট কাঁপছিল। সে হঠাৎ হ্যারির গায়ে পড়ে গিয়ে বাহু দিয়ে হ্যারিকে ধরে ফেলল।

হারমিওন। হ্যারি বিস্মিত হলো।

হারমিওন বলল–হ্যারি, তুমি কি জানো তুমি একজন বড় মাপের জাদুকর।

তোমার মত দক্ষ নই। হ্যারি বলল।

আমি! হারমিওন আশ্চর্যের সাথে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল। আমি তো বই পড়েছি আর বুদ্ধি খাঁটিয়েছি। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে। তা হলো বন্ধুত্ব আর সাহস। হ্যারি, তুমি সতর্ক থেকো।

হ্যারি হারমিওকে বলল–তুমি আগে চুমুক দাও। তুমি সঠিকভাবে জানো কোন বোতলটি কোন কাজের জন্য।

তা ঠিক। এই বলে হারমিওন গোলাকার বোতল থেকে মদ পান করলো।

বিষ নয়তো এটা? হ্যারি উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করল।

না–তবে বরফের মত ঠাণ্ডা। হারমিওন জবাব দিল।

তাড়াতাড়ি যাও।

গুডলাক। সাবধানে থেকো।

তুমি যাও।

বেগুনি আগুনের ভেতর দিয়ে হারমিওন পার হয়ে গেল।

হ্যারি এবার ছোট বোতলটাতে চুমুক দিল। এরপর সে কালো অগ্নিশিখার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। আমি আসছি। হ্যারি চিৎকার করে বলল।

মনে হলো তার দেহ যেন বরফে ভাসছে। সে বোতল রেখে এগিয়ে গেল। কালো শিখা তাকে ঘিরে ধরল। সে কিন্তু কিছুই টের পেল না। কিছুক্ষণ শুধু কালো আগুন ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।

তারপর একদম ওপরে। শেষ চেম্বার। সেখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি স্নেইপও নন, এমনকি ভোলডেমর্টও নন।





সপ্তম এবং শেষ পর্ব 

হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং

🔴 দু’মুখো মানুষ

সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন অধ্যাপক কুইরেল।

আপনি! অবাক হয়ে হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

কুইরেল মুচকি হাসলেন। তার মুখ অন্য সময়ের মত এখন কাঁপছিলো না।

হ্যাঁ, আমিই। কুইরেল জবাব দিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমার সাথে এখানে দেখা হয়ে যাবে, মি. পটার।

আমি ভেবেছিলাম, আমি এখানে স্নেইপকে দেখতে পাব। হ্যারি বলল।

সেভেরাস? অধ্যাপক কুইরেল হাসলেন। তবে তার হাসিটাও অন্য সময়ের মত নয়। ছিল তীক্ষ্ণ ও শীতল। তারপর বললেন–হ্যাঁ, সেভেরাসকে ওই রকমই মনে হয়। তাই নয় কি? বড় বাদুরের মত তিনি ছোঁ মারতে পারেন। তাকে নিয়ে এলে ভালোই হতো। কেউ কি বিশ্বাস করতে পারবে এখানে আসবেন অধ্যাপক কুইরেল।

হ্যারি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।

কিন্তু স্নেইপই তো আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। হ্যারি বলল।

না, না, এটা ঠিক নয়। কুইরেল জবাব দিলেন–আমিই তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। তোমার বন্ধু মিস গ্রেঞ্জার কিডিচ প্রতিযোগিতায় যখন আগুন লাগাতে যায় তখন সে হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের ওপর পড়ে। সে তোমার সাথে আমার আই কন্টাক্ট ভেঙে দিয়েছিল। আর কয়েকটি মুহূর্ত হাতে পেলে আমি তোমার কাছ থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিতাম। তোমাকে বাঁচাবার জন্য স্নেইপ যদি মন্ত্র উচ্চারণ না করতেন, তাহলে সেদিনই তোমার একটা কিছু হয়ে যেত।

আপনি বলেন কি? স্নেইপ আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন! হ্যারি বিস্ময়মাখা স্বরে প্রশ্ন করল।

অবশ্যই। কুইরেল জবাব দিলেন–তুমি কি জানোনা তোমার পরবর্তী প্রতিযোগিতায় তিনি কেন রেফারি হতে চেয়েছিলেন। বোকা একটা… তার ভাবা উচিত ছিল, যতক্ষণ ডাম্বলডোর খেলা দেখছিলেন ততক্ষণ তোমার কোন অনিষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অন্য সকল টিচার ভেবেছিলেন স্নেইপ গ্রিফিল্ডরকে বাধা দিতে চান। স্নোইপ নিজেকে সকলের কাছে অপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সময় নষ্ট আর করা কেন, এত কিছুর পর আমি তোমাকে হত্যা করতে যাচ্ছি। অধ্যাপক কুইরেল তার হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁক করে কাঁপালেন, অমনি একটা রশি বাতাসে শাপের মত লাফিয়ে হ্যারিকে শক্ত করে বেঁধে ফেলো।

তুমি সব কিছুতেই নাক গলাও পটার। তোমার বেঁচে থাকাটা বিপজ্জনক। স্কুলের চারদিক ঘুরে বেড়াও। আমি জানি পাথরটা কে পাহারা দিচ্ছে দেখতে এসে তুমি সেখানে আমাকে দেখেছিলে।

তাহলে আপনিই সেই দানবটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন? হ্যারি জানতে চাইল।

হ্যাঁ, আমিই সে দানবটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। অধ্যাপক কুইরেল জবাব দিলেন–তবে আমার একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। স্নেইপ আমাকে সন্দেহ করে দৌড়ে তিন তলায় আমাকে মোকাবিলা করার জন্য চলে এলেন। তিনি আমাকেই শুধু ব্যর্থ করে দেননি, দানবটা তোমাকেও হত্যা করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ওই তিন মাথা কুকুরটাও স্নেইপের পা–টা ভালো করে জখম করতে পারেনি।

কিছুক্ষণ থেমে কুইরেল বললেন–হ্যারি, একটু অপেক্ষা কর। আমি এই মজার আয়নাটা নিয়ে একটু পরীক্ষা করতে চাই।

আর ঠিক তখনই হ্যারি বুঝতে পারল কুইরেলের পেছনে যে আয়না সেটা এরিসেডের আয়না।

ফিরে এসে কুইরেল বললেন-এই আয়নাটি হল পরশমণি পাবার চাবিকাঠি।

কুইরেলের উদ্দেশ্যে হ্যারি বলল–আমি আপনাকে ও স্নেইপকে অরণ্যে দেখেছি।–হ্যারি কুইরেলকে কথায় ব্যস্ত রাখতে চায়।

তুমি ঠিকই দেখেছ। আয়নাটা দেখতে দেখতে কুইরেল বললেন তিনি সব সময় আমাকে সন্দেহ করেন। তাই তিনি দেখতে এসেছিলেন আমি কত দূর এগিয়েছি। ভোলডেমর্ট আমার পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাকে ভয় দেখিয়েছেন।

কুইরেল আয়নার পেছন থেকে ফিরে এসে ক্ষুধার্তের মত আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কুইরেল বললেন–আমি পাথরটা দেখতে পাচ্ছি। আমি এটা আমার প্রভুকে উপহার দিতে যাচ্ছি। কিন্তু পাথরটা গেল কোথায়?

হ্যারি দড়ির বাঁধন শিথিল করার চেষ্টা করছিল। হ্যারি বুঝল তার এখনকার কর্তব্য হলো আয়না থেকে কুইরেলের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখা।

কিন্তু স্নেইপ সব সময় আমাকে দারুণ ঘৃণা করেন। হ্যারি বলল।

হ্যাঁ, স্নেইপ তোমাকে ঘৃণা করেন। হোগার্টসে তিনি তোমার বাবার সাথেই ছিলেন। তারা একে অপরকে খুব ঘৃণা করতেন। তবে তিনি কখনই তোমার মৃত্যু চাননি।

আমি শুনলাম হ্যারি বলল–কয়েকদিন আগে আপনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। কারণ স্নেইপ আপনাকে হুমকি দিয়েছিলেন?

প্রথমবারের মতো কুইরেলের চেহারায় একটা ভয়ের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল।

কুইরেল জবাব দিলেন–কখনও কখনও প্রভুর নির্দেশ মেনে চলা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি একজন উঁচু মাপের জাদুকর, আর আমি একজন মামুলী জাদুকর।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, তিনি ক্লাস রুমে আপনার সাথেই থাকেন? হ্যারি জানতে চাইল।

আমি যেখানেই যাই তিনি আমার সাথে থাকেন। কুইরেল শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন। আমি যখন বিশ্বভ্রমণে বের হই তখন তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন ছিলাম বোকা। ভালো ও মন্দ সম্পর্কে আমার মনে উদ্ভট ধারণা ছিল। লর্ড ভোলডেমর্টই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে আমার ধারণা কত অপরিপকু ছিল। তিনি আমাকে বোঝালেন যে ভালো বা মন্দ বলে কোন জিনিস নেই। যা আছে তা হলো শক্তি। তবে অনেকেই তা দেখতে পায় না। তারপর থেকেই আমি বিশ্বস্ততার সাথে তার সেবা করে যাচ্ছি। যদিও আমি তাকে বহুবার হতাশ করেছি। কোন ভুল তিনি সহজে ক্ষমা করেন না। আমার ভুলের জন্যই তিনি আমার সাথে কখনও কখনও কঠোর ব্যবহার করেন। আমি যখন গ্রিংগট থেকে পাথর চুরি করতে ব্যর্থ হই তখন তিনি আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট হন এবং আমাকে শাস্তি দেন। তারপর থেকেই তিনি আমাকে চোখে চোখে রাখা শুরু করেন। কুইরেলের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল। হ্যারির মনে পড়ল ডায়াগন এলির কথা। সে এত বোকা হল কী করে! সেই দিনই সে প্রথম অধ্যাপক কুইরেলকে দেখেছে এবং লিকি কলড্রেনে তার সাথে করমর্দন করেছে।

কুইরেলের নিঃশ্বাসে অভিশাপ।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না পাথরটা কি আয়নার ভেতর? আমি কি আয়নাটা ভেঙে ফেলব?

হ্যারি দ্রুত ভাবছিল।

হ্যারি মনে মনে বললো–আমার এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে কাম্য কাজ হলো–কুইরেলের আগে পরশমণিটি হস্তগত করা। আমি যদি আয়নাটা দেখি তাহলে আমি নিজেই জানতে পারব পরশমণিটা কোথায়? কুইরেলকে বুঝতে না দিয়ে আমি এ কাজটা কীভাবে করব?

কুইরেলের দৃষ্টি এড়িয়ে আয়নার কাছে যাবার জন্য হ্যারি বাঁ দিকে বাঁক নিল। হ্যারির পায়ের গোড়ালিতে দড়ি এত শক্তভাবে বাঁধা ছিল যে তার পক্ষে বাঁধনমুক্ত হওয়া কঠিন। সে বাঁধন মুক্ত করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কুইরেল এদিকে লক্ষ্য না করেই নিজে নিজে কথা বলছিলেন

এ আয়নাতে কী কাজ হয়। প্রভু, আমাকে সাহায্য কর।

সন্ত্রস্ত হয়ে হ্যারি এ প্রশ্নের উত্তর শুনতে পেল, আর উত্তরটাও ছিল কুইরেলের কণ্ঠস্বরে, ছেলেটাকে কাজে লাগাও! ছেলেটাকে কাজে লাগাও।

কুইরেল হ্যারির দিকে তাকালেন।

তারপর বললেন–পটার, এদিকে এসো।

কুইরেল হাতে তালি দিলেন। সাথে সাথে হ্যারির বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। হ্যারি নিজের পায়ে দাঁড়াল।

এদিকে এসো। কুইরেল আবার তাকে ডাকলেন, বললেন–আয়নায় তাকিয়ে আমাকে বল কী দেখছ।

হ্যারি হেঁটে হেঁটে কুইরেলের কাছে এল।

আমাকে মিথ্যে বলতে হবে। হ্যারি মনে মনে বলল–আমি অবশ্যই দেখব, কিন্তু দেখার ব্যাপারে মিথ্যে বলব।

কুইরেল হ্যারির পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কুইরেলের পাগড়ির বিশেষ গন্ধ হ্যারির নাকে এল। হ্যারি চোখ বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়াল এবং আবার চোখ খুলল।

আয়নাতে হ্যারি প্রথমে তার প্রতিবিম্ব দেখল। প্রথমে তার চেহারা বিবর্ণ দেখা গেলেও পর মুহূর্তেই দেখা গেল প্রতিবিম্বটা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। প্রতিবিম্ব পকেট থেকে একটা রক্ত–রাঙা পাথর বের করল। এ দৃশ্য দেখার পর তার পকেটে সে একটা ভারী বস্তুর অস্তিত্ব অনুভব করল। অবিশ্বাস্যভাবে পাথরটা হ্যারির নাগালের ভেতর চলে এল।

কুইরেল জানতে চাইলেন–তুমি কী দেখতে পেলে?

সাহস সঞ্চয় করে হ্যারি বলল–আমি দেখলাম আমি ডাম্বলডোরের সাথে করমর্দন করছি। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য হাউজ কাপ জয়লাভ করেছি।

কুইরেল আবার অভিশাপ দিলেন।

কুইরেল বললেন–আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। হ্যারি একটু সরে গেল এবং পকেটে পরশমণির স্পর্শ অনুভব করল। সে কি পরশমণিটি বের করে ফেলবে?

হ্যারি পাঁচ কদমও এগোতে পারল না। কুইরেলের ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে শোনা গেল–সে মিথ্যা বলেছে। সে মিথ্যা বলেছে।

কুইরেল আবার বললেন–পটার তুমি ফিরে এসো। তুমি আসলে কী দেখেছ তা সত্যি করে বল।

কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি হলো।

আমি তার সাথে মুখোমুখি কথা বলতে চাই।–কুইরেলের সেই কণ্ঠস্বর।

প্রভু, তোমাকে আজ রাতে তত শক্তিশালী মনে হচ্ছে না।

এর জন্য আমার যথেষ্ট শক্তি আছে।

হ্যারির মনে হল সে শয়তালের জাদুর চক্রান্তে আটকে গেছে। সে তার পেশী নাড়াতে পারছে না। ভয়ে আর আতঙ্কে সে কুইরেলের দিকে তাকাল। কুইরেল তার পাগড়ি খুললেন। পাগড়িবিহীন তার মাথা অস্বাভাবিক রকম ছোট মনে হলো। পাগড়ি মাটিতে পড়ে গেল। এবার তিনি ধীরে ধীরে তার ঘাড় নাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন

হ্যারির চিৎকার করে ওঠার কথা, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বেরুচ্ছে না। যেখানে কুইরেলের পিঠ তার সামনে থাকার কথা, সেখানে সামনে থেকে দেখা গেল তার বিকট চেহারা। এত ভয়ঙ্কর চেহারা হ্যারি এর আগে কখনোই দেখেনি। এ চেহারাটা চর্কের মত শাদা, তীক্ষ্ণ লাল চোখ আর সাপের মত নাক দিয়ে পানি বেরুচ্ছে। চেহারার দুপাশে দু রকম! দুজনের। কুইরেল আর ভোলমেট।

হ্যারি পটার। ফিসফিস শব্দ শোনা গেল।

হ্যারি পেছনে যেতে চাইল। কিন্তু তার পা চলছে না।

মুখটা বলছে–হ্যারি পটার, দেখতে পাচ্ছ আমার এখনকার রূপ। শুধু ছায়া আর ধোয়া দিয়ে অন্যের শরীর ধারণ করা যায়। ইউনিকর্নের রক্ত খেয়ে আমার শক্তি বহুগুণ বেড়ে গেছে। তুমি আগেই দেখেছ কুইরেলের রূপ ধরে, আমি অরণ্যে গিয়ে ইউনিকর্নর রক্তপান করেছি। এখন তুমি দয়া করে তোমার পকেট থেকে পরশমণিটা বের করে আমাকে দিয়ে দাও।

কুইরেল তা হলে সব জানে-এই কথা ভেবে হ্যারি পেছনে যেতে চাইল, কিন্তু তার পা চলছে না।

মুখটা হ্যারিকে বলল–বোকার মত কাজ করো না।

তোমার জীবন বাঁচাতে চাইলে আমার সাথে যোগ দাও। নতুবা তোমার বাবা–মার মতই তোমার পরিণতি হবে। তারা দুজনই মারা যাওয়ার সময় আমার অনুকম্পা চেয়েছিলেন।

মিথ্যুক। হ্যারি চিৎকার করে উঠল।

কুইরেল পেছন ফিরে হ্যারির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন যাতে ভোলডেমর্ট তাকে দেখতে পায়। শয়তানি মুখে মুচকি হাসি।

বড়ই মর্মস্পর্শী। শয়তানিমুখে উচ্চারিত হলো।

আমি সর্বদাই বীরত্বকে দাম দেই। তোমার বাবা–মাও সাহসী ছিলেন। প্রথমে আমি তোমার বাবাকে হত্যা করি। তিনি আমার সাথে সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তোমার মায়ের মারা যাবার কথা ছিল না। তিনি তোমাকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তার মৃত্যুকে ব্যর্থ করতে না চাইলে তুমি আমাকে পাথরটা দিয়ে দাও।

কখ্‌খনো না। হ্যারি জোর দিয়ে বলল।

হ্যারি লাফ দিয়ে আগুনের শিখার দিকে ধাবিত হল। ভোলডেমর্ট চিৎকার করে উঠল–তাকে পাকড়াও কর। পর মুহূর্তেই হ্যারি অনুভব করল যে কুইরেলের হাত তার মুষ্টির ওপরের অংশ স্পর্শ করেছে। সঙ্গে সঙ্গেই হ্যারি তার কপালের কাটা দাগে তীব্র ব্যথা অনুভব করল। তার মনে হলো তার কপাল দুটুকরো হয়ে যাবে। সে তার সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে জোরে চিক্কার দিল। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল, কুইরেল তাকে ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার ব্যথা অনেকটা কমে গেছে। কুইরেল কোথায় আছেন তা দেখার জন্য সে চারিদিকে তাকাল। কুইরেল ব্যথায় কুঁজো হয়ে তার আঙুল দেখছিলেন।

পাকড়াও কর। তাকে পাকড়াও কর। আবার ভোলডেমর্টের চিৎকার।

কুইরেল আবার উঠে হ্যারিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছে। হ্যারির কপালের কাটা দাগের ব্যথা অনেক বেড়ে গেছে। তারপরও সে দেখতে পেল যে কুইরেল নিজে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

কুইরেল চিৎকার করছেন–প্রভু, আমি তাকে আর ধরে রাখতে পারছি না–আমার হাত আমার হাত…।

কুইরেল হাটু দিয়ে হ্যারিকে মাটির ওপর চেপে রাখলেও সে তার গলা ছেড়ে দিলেন এবং বিস্ময়ে বিচলিত হয়ে নিজের হাতের ব্যথার প্রতি দৃষ্টি দিলেন।

তাহলে ওকে হত্যা কর, বোকা কোথাকার। ভোলডেমর্ট চিৎকার করে বলল।

একটা কঠিন অভিশাপ দেবার জন্য কুইরেল তার হাত ওপরে ওঠালেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই হ্যারি তার মুখ চেপে ধরল।

আহ…

কুইরেল মাটিতে পড়ে গেলেন। হ্যারি জানতো যে মারাত্নক যন্ত্রণায় কাতর হলে কুইরেল তার কেশ স্পর্শ করতে পারবেন না। সুতরাং অভিশাপ বন্ধ রাখতে কুইরেলকে কাবু করে রাখা ছাড়া উপায় নেই।

হ্যারি লাফ দিয়ে কুইরেলকে এমন শক্তভাবে জাপটে ধরল যে কুইরেল নড়তেই পারছিলেন না, শুধু চিৎকার করছিলেন। কুইরেল হ্যারিকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। হ্যারির কপালের ব্যথা আবার বাড়তে লাগল। হ্যারি কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। কেবল কুইরেলের চিৎকার আর ভেলডেমর্টের তাকে হত্যা কর, তাকে হত্যা কর কথাগুলো শুনছে। সে অনুভব করল, কুইরেল তার বাহুবেষ্টনি থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। সামনে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার।

মাথার ওপর সোনার মত কি যেন চকচক করছে। হ্যারি সেটা ধরতে গেল। তার হাত বেশ ভারি হয়ে যাওয়ায় সে এটা ধরতে পারল না।

হ্যারি ভালো করে তাকাল। দেখল, আসলে সেটা এক জোড়া চশমা। কী আশ্চর্য ব্যাপার।

শুভ অপরাহ্ন, হ্যারি ডাম্বলডোর তাকে বললেন।

হ্যারি তার দিকে তাকাল। তারপর সবকিছু মনে পড়ল। সে বলল স্যার, পরশমণিটা অধ্যাপক কুইরেল হস্তগত করে ফেলেছেন। তাড়াতাড়ি কিছু একটা করুন।

শান্ত হও বাছা। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–তুমি সময়ের একটু পেছনে আছ। কুইরেল পরশমণি পাননি।

তাহলে? হ্যারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

হ্যারি শান্ত হও। ডাম্বলডোর বললেন–নতুবা মাদাম পমফ্রে আমাকে এখান থেকে বের করে দেবেন।

হ্যারি ঢোক গিলে চারদিকে তাকাল। এতক্ষণে সে বুঝল, সে এখন হাসপাতালে সাদা বিছানার ওপর শুয়ে আছে। পাশেই একটা উঁচু টেবিল। টেবিলের ওপর এত মিষ্টি রাখা আছে, দেখে মনে হবে এটা বুঝি মিষ্টির দোকান।

এই দেখ তোমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তোমার জন্য উপহার পাঠিয়েছে। ডাম্বলডোর বললেন–পাতাল পুরীতে বন্দিদশায় তোমার আর কুইবেলের ভেতর কী ঘটেছে-এটা কেউ জানে না। সবাই জানে তুমি অসুস্থ। হাসপাতালে তোমার চিকিৎসা হচ্ছে।

কতদিন ধরে আমি এখানে আছি? হ্যারি জানতে চাইল।

তিনদিন হবে। তুমি যে সুস্থ হয়েছ এটা শুনতে পারলে রোনাল্ড উইসলি ও মিস গ্রেঞ্জার খুব স্বস্তিবোধ করবে। তোমার ব্যাপারে তারা খুব উদ্বিগ্ন।

স্যার, পরশমণি কোথায়? হ্যারি জানতে চাইল।

ডাম্বলডোর বললেন–আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি এখনও পাথরের কথা ভুলতে পারনি। অধ্যাপক কুইরেল তোমার কাছ থেকে পরশমণিটা নিতে পারেননি, কারণ আমি যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে পড়েছিলাম। যদিও তুমি খুব ভালভাবে ওঁকে মোকাবিলা করছিলে।

তাহলে পরশমণি আপনার কাছে। হ্যারি জানতে চাইল।

আমার ভয় ছিল, আমার যেতে হয়ত দেরী হয়ে যেতে পারে। অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন।

না, আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন।

আমি তাকে বেশিক্ষণ পরশমণি থেকে দূরে রাখতে পারতাম না। হ্যারি বলল।

ডাম্বলডোর আরো বললেন–আমি পাথরের কথা বলছি না। বলছিলাম তোমার চেষ্টার কথা। এতে তোমার মৃত্যুও হতে পারত। এজন্য আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আর পরশমণির কথা বলছ, সেটা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

ধ্বংস করা হয়েছে! হ্যারি বিস্ময়ের সাথে মন্তব্য করল–আপনার বন্ধু নিকোলাস ফ্লামেল?

তুমি তাহলে নিকোলাস সম্পর্কে জানো। ডাম্বলডোর বললেন–তুমি ঠিক কাজটাই করেছ, তাই না? আমি আর নিকোলাস আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম। যা করা হয়েছে তা ঠিকই ছিল।

তার মানে নিকোলাস এবং তার স্ত্রী মারা যাবেন। তাই নয় কি?

তবে তাদের কাছে প্রচুর মৃতসঞ্জীবনী সুধা আছে। হ্যাঁ, পরবর্তীতে তাঁরা মারা যাবেন।

হ্যারির চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ দেখে ডাম্বলভোর মুচকি হাসলেন।

ডাম্বলডোর বললেন–তোমাদের মত তরুণদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। নিকোলাস এবং পেরেনেলের কাছে এটা হবে দীর্ঘদিন পর শোবার জন্য বিছানায় যাওয়া। বড় কথা হলো সুসংগঠিত মৃত্যু হলো পরবর্তী পর্যায়ে যাবার অভিযান।

ডাম্বলডোর আরো বললেন, পরশমণি বড় কথা নয়। মানুষ এমন কিছু আকাঙ্ক্ষা করে যা বাস্তবে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।

হ্যারি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। ডাম্বলডোর মৃদু হেসে ওপরে ঘরের ছাদের দিকে তাকালেন।

স্যার, হ্যারি বলল–আমি ভাবছিলাম পরশমণি তো ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু ভোলডেমর্ট এবং ইউ-নো-হুর ভূমিকা কী হবে।

হ্যারি, তাকে সবসময় ভোলডেমর্ট ডাকবে। তার সঠিক নামে ডাকবে। কোন বিশেষণেরও দরকার নেই। নামের ভীতি মানুষের প্রতি বাড়িয়ে দেয়।

জী স্যার। হ্যারি বলল–ভোলডেমট ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। তাই না? তিনি তো এখনও বিদায় হননি, হয়েছেন কী?

হ্যারি তুমি ঠিকই বলেছ। ডাম্বলডোর বললেন–ভোলডেমর্ট ফিরে আসার চেষ্টা করছে। সে যায়নি। সে কাছাকাছি কোথাও আছে। সে কারো সঙ্গে তার শরীর ভাগাভাগি করে নিতে চাচ্ছে। সে যদি সত্যি সত্যিই জীবিত না থাকে তাহলে কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না। সে কুইরেলকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। শত্রু মিত্র কারো প্রতি সে করুণা করে না।

হ্যারি মাথা নাড়ল। তার কপালের ব্যথাটা আবার বেড়ে গেছে। তারপর ডালভোরের উদ্দেশ্যে বলল–স্যার, আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনি কি আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবেন?

সত্য শব্দটি একটা সুন্দর ও নিষ্ঠুর শব্দ। ডাম্বলডোর মন্তব্য করলেন তাই খুবই সতর্কভাবে তোমার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবার চেষ্টা করব। সমস্যা না হলে আমি তোমার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেব। যদি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে মিথ্যা বলব না।

হ্যারি শুরু করল, ভলডেমর্ট বলেছে তিনি আমার মাকে হত্যা করেছে, কারণ আমার মা আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন। এখন সে আমাকে কেন হত্যা করতে চাচ্ছে?

ডাম্বলডোর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন–হ্যারি, আমি দুঃখিত। আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। অর্থাৎ আজ ৰা এখন আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। তবে একদিন তুমি এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। তুমি বড় হলে সব জানতে পারবে। আর আমি এটাও জানি, এই প্রশ্নের উত্তর তোমার ঘৃণা উদ্রেক করবে। বড় হলে তুমি নিজেই সব জানতে পারবে।

হ্যারি বুঝতে পারল এ বিষয়ে আর কথা বলা অবান্তর।

কিন্তু কুইরেল কেন আমাকে স্পর্শ করতে পারেননি। হ্যারির পরবর্তী প্রশ্ন।

ডাম্বলডোর জবাব দিলেন–তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার মায়ের মৃত্যু ঘটেছে। ভালোবাসা কী জিনিস-এ বিষয়ে ভোলডেমর্টের কোন ধারণা ছিল না। ভালোবাসা যে কত শক্তিশালী হতে পারে তা সে কখনোই বুঝতে পারেনি। তোমার জন্য তোমার মায়ের ভালোবাসা একটা অনন্য ঘটনার স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি তার ভালোবাসার কোন চিহ্ন রেখে যেতে পারেননি। তোমার জন্য তোমার মায়ের ভালোবাসা তোমাকে চিরদিনের জন্য নিরাপদ করে দিয়েছে। আর কুইরেলের ভেতর আছে–ঘৃণা, লোভ আর উচ্চাভিলাষ। তার এই দোষগুলো ভোলড়েঘর্টের কাছ থেকে পাওয়া। এ জন্যই কুইরেল তোমাকে স্পর্শ করতে পারেননি।

ডাম্বলডোর জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এই ফাঁকে হ্যারি তার চোখের জল মুছলো।

হ্যারির বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে এলে তার পরবর্তী প্রশ্ন–আপনি কি জানেন অদৃশ্য হওয়ার পোশাকটা আসলে কে পাঠিয়েছিল?

ডাম্বলডোর জবাব দিলেন–তোমার বাবা আমাকে এ পোশাকটা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মনে হলো, পোশাকটা তোমার পছন্দ হবে। তোমার বাবা এই অদৃশ্য হওয়ার পোশাক পরে রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করতেন।

আমার আরো কিছু প্রশ্ন আছে।

বল।

কুইরেল বলছিলেন স্নেইপ–… হ্যারি বলল।

অধ্যাপক স্নেইপ ডাম্বলডোর জিজ্ঞেস করল!

জী স্যার… কুইরেল আমাকে জানালেন যে স্নেইপ–আমাকে ঘৃণা করেন কারণ তিনি আমার বাবাকে ঘৃণা করতেন।

হ্যাঁ, তারা দুজন দুজনকেই ঘৃণা করতেন। ডাম্বলডোর ব্যাখ্যা করলেন–তবে তাদের অপছন্দ তোমার আর ম্যালফয়ের অপছন্দের মত নয়। তোমার বাবা এমন একটা কাজ করেছিলেন, যা অধ্যাপক স্নেইপ কখনোই ক্ষমা করতে পারেননি।

সেটা কী? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তিনি তার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ডাম্বলডোর বললেন।

আপনি কী বলছেন? হ্যারি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, ডাম্বলডোর স্বপ্নিল দৃষ্টিতে বললেন–মানুষের মন বড় বিচিত্র। তারা কত রকম অদ্ভুত কাজ করে। স্নেইপ কখনোই তোমার বাবার কাছে ঋণি থাকতে চাননি। আমার ধারণা, এ বছর তোমাকে রক্ষা করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি তোমার পিতৃঋণ শোধ করতে চান। এটা করতে পারলে তিনি তোমার বাবার স্মৃতিকে ঘৃণা করতে পারবেন।

এসব কথা শুনে হ্যারির মাথা গুলিয়ে গেল। সে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।

স্যার, আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে। হ্যারি বলল।

একটাই মাত্র প্রশ্ন? ডাম্বলডোর বললেন।

আয়না থেকে আমি কীভাবে পরশমণিটা পেলাম? হ্যারি জানতে চাইল।

আমি খুব আনন্দিত যে, তুমি এই প্রশ্ন করেছ। ডাম্বলডোর বললেন এটা আমার চিন্তাপ্রসূত। এছাড়া তোমার সাথে আমার অন্য রকম একটা সম্পর্ক আছে। ভেবে দেখ, মাত্র একজন লোক পাথরটা পেতে চেয়েছিল পেলও কিন্তু ব্যবহার জানে না। নতুবা এটা থেকে সোনা বানাবে অথবা অমৃত মনে করে পান করবে। হয়েছে, অনেক প্রশ্ন করেছ; আর নয়।

এরপর ডাম্বলডোর হ্যারিকে মিষ্টি খাবার আমন্ত্রণ জানালেন এবং হ্যারির মুখে একটা মিষ্টি তুলে দিলেন। ডাম্বলডোরের উত্তরটা হ্যারির কাছে হেঁয়ালিই রয়ে গেল।

***

ম্যাট্রন মাদাম পমফ্রে অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু বড্ড কড়া মহিলা।

হ্যারি বলল–আর মাত্র পাঁচমিনিট।

অসম্ভব। মাদাম পমফ্রে বললেন।

অধ্যাপক ডাম্বলডোরকে ভেতরে আসতে দিয়েছিলেন…। হ্যারি বলল।

মাদাম পমফ্রে বললেন–হ্যাঁ, তাকে দিয়েছি, তবে অধ্যাপক ডাম্বলডোর তো হোগার্টসের প্রধান শিক্ষক। তবে হ্যারি, তোমার বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।

আমি তো বিশ্রাম নিচ্ছি। দেখছেন তো আমি বিছানায় শুয়ে আছি। হ্যারি বলল।

ঠিক আছে। মাদাম পমফ্রে বললেন–মনে রেখো। তোমাকে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হলো।

তিনি রন ও হারমিওনকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

হ্যারি। রন ও হারমিওন আনন্দে চিৎকার করে উঠল। তারা বলল আমরা আর অধ্যাপক ডাম্বলডোর তোমার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম।

পুরো স্কুলে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রন বলল–কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল?

এটা এমন একটা সত্য ঘটনা যা গল্পের চেয়েও অদ্ভুত এবং উত্তেজনাপূর্ণ।

হ্যারি তাদেরকে সব খুলে বলল–কুইরেলের কথা, ভলডেমর্টের কথা, আয়না ও পরশমণির কথা।

রন আর হারমিওন মনোযোগ দিয়ে হ্যারির কথা শুনল। হ্যারি তাদের কুইরেলের পাগড়ির তলায় কি আছে সেটাও বলল।

হ্যারির কথা শেষ হওয়া মাত্রই রন বলে উঠল–পরশমণি তাহলে কোথায়?

আর যদি পরশমণি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তো নিকোলাস ফ্লামেলের মৃত্যু অবধারিত। হারমিওন আত্নচিৎকার করল।

হ্যারি বলল–আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু ডাম্বলডোর আমাকে বোঝালেন যে সুসংগঠিত মনের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য অভিযান মাত্র।

তোমাদের দুজনের কী হয়েছিল? হ্যারি জানতে চাইল।

আমরা ঠিকভাবেই ফিরে এসেছি। হারমিওন বলল–রনকে নিয়ে আসতে অবশ্য কিছুটা সময় লেগেছে। অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমরা পেঁচার ঘরে যাওয়ার পথে প্রবেশ হলে ডাম্বলডোরকে পাই, তিনি আগেই সব জেনেছেন। তিনি বললেন–হ্যারি তার পেছনে গিয়েছে, তাই না? তারপর তিনি দ্রুত তোমার দিকে ছুটলেন।

তোমার মাধ্যমেই তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন কি? রন জানতে চাইল তোমাকে তোমার বাবার পোশাক আর অন্যান্য জিনিস পাঠিয়ে।

হারমিওন ক্রোধের সাথে বলল–তিনি যদি কিছু করে থাকেন–আমি বলতে চাচ্ছি–তোমার তো মৃত্যুও হতে পারত।

ঘটনা তা নয়। হ্যারি প্রতিবাদ করে উঠলো–আসলে তিনি আমাকে একটি সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। এখানে যা কিছু ঘটেছে সবই তার জানা ছিল। আমার ধারণা–আমরা কী করতে চাচ্ছি–তাও তিনি জানতেন। তিনি আমাদেরকে বাধা না দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। আমার মনে হয়, আয়নার বিষয়টা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। আসলে আগে থেকে তিনিই সবকিছুর পরিকল্পনা করেছিলেন।

হ্যাঁ, তুমি তো ডাম্বলডোরের প্রশংসা করবেই? রন বলল-এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আগামীকাল ভোজ হবে। খেলাতে স্লিদারিন হাউজ জিতেছে। কিডি প্রতিযোগিতায় তুমি ছিলে না। তোমাকে ছাড়া আমরা পেছনে পড়ে গেছি, তবে আগামীকালের ভোজটা ভালো হবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে মাদাম পমফ্রে ঘরে ঢুকেই বললেন–তোমরা পনেরো মিনিট কথা বলেছ। এবার বাইরে যাও।

রাতে ভাল ঘুমের ফলে হ্যারির সুস্থতা ফিরে এলো। হ্যারি মাদাম পমফ্রেকে বলল–আমি ভোজে যোগ দিতে চাই। আমি কি যেতে পারব?

মাদাম পমফ্রে বললেন–ভোজে যাবার জন্য অধ্যাপক ডাম্বলডোর তোমাকে ইতোমধ্যেই অনুমতি দিয়েছেন। তবে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, সেখানে যাওয়াটা তোমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে কিনা।

তোমাকে দেখতে আর একজন এসেছেন।

খুব ভাল, কে সে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। দরোজা খুলে হ্যাগ্রিড ভেতরে প্রবেশ করল। তার ইয়া বড় শরীর নিয়ে যখন সে ভেতরে ঢুকলো, তার শরীরের কাছে ঘরটাই ছোট মনে হচ্ছিল। হ্যাগ্রিড হ্যারির পাশে বসলেন। হ্যারির দিকে এক নজর তাকিয়ে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন।

এসবই আমার দোষে। হ্যাগ্রিড বললেন। আমিই তাদের ফ্লাফির কথা বলেছি। তারা ফ্লাফির কথা জানত না। তোমরা তো মারাও যেতে পারতে। আমি এসব করেছি ড্রাগনের ডিম পাবার জন্য। আমি আর পান করব না! এখন থেকে আমি সব কিছু বাদ দিয়ে মাগলদের মত জীবনযাপন করব।

হ্যাগ্রিড। হ্যারি বলল।

হ্যাগ্রিডকে অনুতপ্ত ও তার কান্না দেখে হ্যারির খুব খারাপ লাগল। হ্যাগ্রিডের দাঁড়ি বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল।

সে যেভাবেই হোক বের করে ফেলত। এ-ই হলো ভোলডেমর্ট। তাকে না বললেও সে সব ঠিক বের করে ফেলত।–হ্যারি যুক্তি দেখালো।

তুমি তো মারাও যেতে পারতে। হ্যাগ্রিড ফুঁপিয়ে কাঁদলেন–দয়া করে ওই নামটি আর উচ্চারণ করো না। ভলডেমর্ট হ্যারি নিচু স্বরে উচ্চারণ করলো। নামটা শুনে হ্যাগ্রিড এতটা চমকালো যে তার কান্না থেমে গেল।

হ্যারি বলল–আমি তাকে দেখেছি। এজন্যই আমি তাকে তার নাম ধরে ডাকছি। হ্যাগ্রিড, দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। বরং খুশি হোন। আমরা পরশমণিকে রক্ষা করেছি। যদিও এটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ভোলডেমর্ট তো এটা আর ব্যবহার করতে পারবে না। একটা চকোলেট ফ্রগ নিন। আমার কাছে অনেক আছে…।

হ্যাগ্রিড হাত দিয়ে নাক মুছে বললেন-এখন আমার মনে পড়েছে। হ্যারি, আমার কাছে তোমার জন্য উপহার আছে।

এটা কি আপনার সেই স্যান্ডউইচ? হ্যারি আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস

না, ডাম্বলডোর গতকাল আমাকে ছুটি দিয়েছেন। হ্যাগ্রিড বলল যেখানে আমাকে অপসারণ করার কথা–যাক তিনি তোমার জন্য এই উপহারটা দিয়েছেন।

দেখে মনে হলো চামড়ায় বাধানো একটা সুন্দর বই। হ্যারি আগ্রহের সাথে বইটা খুলল। বইয়ে ছিল জাদুকরদের অসংখ্য ছবি। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছিল তার বাবা ও মার ছবি। স্মিতহাসিতে তারা তাদের দিকে হাত নাড়ছেন।

***

ওই রাতে হ্যারি একাকীই তাদের বছর শেষের ভোজে গেল। মাদাম পমফ্রে তাকে আরেকবার চেক–আপের জন্য পীড়াপীড়ি করায় হ্যারির একটু দেরি হয়ে গেল। হ্যারি যখন পৌঁছল তার আগেই গ্রেট হলটা ভরে গেছে। হল ঘরটা ক্লিারিন হাউজের রঙ সবুজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কারণ স্লিথারিন হাউজ পর পর সাতবার হাউজ কাপ জয় করেছে। একটা ব্যানারে স্লিদারিন হাউজের প্রতীক–সাপ দেখানো হয়েছে। ওই ব্যানারটা বড় টেবিলের পেছনের দেয়ালে টাঙানো হয়েছে?

হ্যারি যখন হল ঘরে প্রবেশ করল তখন চারদিকে জোরে জোরে নানা কথাবার্তা শুনতে পেল। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হ্যারি নিজেই। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।

হ্যারি চুপচাপ গ্রিফিল্ডর টেবিলে রন আর হারমিওনের মাঝখানে একটা আসনে বসল। তাকে নিয়ে যে এত কথা হচ্ছে, সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে-এই নিয়ে হ্যারি মাথা ঘামাল না।

সৌভাগ্যবশতঃ একটু পরই ডাম্বলডোর এলেন, আর সাথে সাথে সব গুঞ্জন মিলিয়ে গেল।

আরেকটা বছর পার হয়ে গেল। ডাম্বলডোর বললেন–ভোজ শুরু হবার আগে আমি তোমাদেরকে কিছু কথা বলতে চাই। বছরটি কেমন ছিল। আশা করি–তোমরা যখন এখানে এসেছিল সেই সময় থেকে এখন তোমাদের জ্ঞানের পরিধি বেড়েছে। তোমাদের সামনে পুরো গ্রীষ্মকাল পড়ে আছে। সেটা তোমরা কাজে লাগাতে পার।

ডাম্বলডোর বলে চললেন–আমার মনে হয় এখন হাউজকাপ বিতরণ করা যেতে পারে। পয়েন্ট অনুযায়ী বিভিন্ন হাউজের অবস্থান তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি।

৩১২ পয়েন্ট নিয়ে গ্রিফিল্ডর হাউজ চতুর্থ

৩৫২ পয়েন্ট নিয়ে হাফলপাফ হাউজ তৃতীয়

৪২৬ পয়েন্ট নিয়ে ব্যাভেনক্ল হাউজ দ্বিতীয়

৪৭২ পয়েন্ট নিয়ে স্লিদারিন হাউজ প্রথম

স্লিদারিন হাউজ আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ল। হ্যারি দেখল ড্রাকো ম্যালফয় তার টেবিলে তার বাটি দিয়ে আওয়াজ করছে। দৃশ্যটা ছিল হ্যারির জন্য মনোকষ্টের।

শাবাশ। স্লিদারিন হাউজ। হাউজকে উৎসাহ দিয়ে ডাম্বলডোর বললেন–তবে সাম্প্রতিক ঘটনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।

ঘর আবার শান্ত হয়ে গেল। স্লিদারিনদের হাসিও কিছুটা মিলিয়ে গেল।

ডাম্বলডোর বললেন, সবশেষে আমি তোমাদেরকে কিছু বলতে চাই।

হ্যাঁ, প্রথমে রন উইসলি।… ভয়ে রনের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল।

গত কয়েক বছরের মধ্যে হোগার্টসে সবচে ভালো দাবা খেলার জন্য আমি গ্রিফিল্ডর হাউজকে পঞ্চাশ পয়েন্ট দিচ্ছি।

গ্রিফিল্ডর হাউজ ছাঁদ ফাটা হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ঘর শান্ত হলো।

দ্বিতীয় অধ্যাপক ডাম্বলডোর বললেন–আমি মিস গ্রেঞ্জারকে…। কঠিন অবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় অভূতপূর্ব সাহসের পরিচয় দেবার জন্য গ্রিফিল্ডর হাউজকে আমি পঞ্চাশ পয়েন্ট দিচ্ছি।

হারমিওন তার ভাঁজ করা হাতের ওপর তার মুখ গুজলো। হ্যারি নিশ্চিত যে হারমিওন আনন্দে কাঁদছে। গ্রিফিল্ডর হাউজ খুব খুশি। মোট একশ পয়েন্ট পেয়েছে।

তৃতীয়ত, হ্যারি পটার। ডাম্বলডোর বললেন। হ্যারির নাম ঘোষণার সাথে সাথে সমস্ত ঘর পিনপতন স্তব্ধ। কোথাও কোন কথা নেই। ধৈর্য ধারণ করে অভূতপূর্ব সাহস প্রদর্শন করার জন্য আমি গ্রিফিল্ডর হাউজকে ষাট পয়েন্ট দিলাম।

কান ফাটা হর্ষধ্বনি। চারদিকে হৈ-হুল্লা। আনন্দ উৎসব। গ্রিফিল্ডর হাউজের এখন পয়েন্ট হয়েছে ৪৭২। স্লিদারিন হাউজের সমান পয়েন্ট। ডাম্বলডোর যদি হ্যারিকে আরেকটা পয়েন্ট বেশি দিতেন তাহলেই গ্রিফিল্ডর হাউজ–হাউজ কাপ পেয়ে যায়।

ডাম্বলডোর তার হাত ওঠালেন। পুরো ঘর শান্ত হয়ে গেল।

ডাম্বলডোর বললেন–সাহসের রকমফের আছে, শত্রুকে মোকাবিলা করতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। আবার বন্ধুকে সাহায্য করতে হলেও সাহসের প্রয়োজন হয়। এবার আমি মি, নেভিল লংবটমকে দশ পয়েন্ট দিচ্ছি। গ্রেট হলের বাইরে যদি কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি ভাবতেন ঘরের ভেতর নিশ্চয়ই একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের আনন্দ উল্লাসের আওয়াজ ছিল এত তীব্র। নেভিলকে উৎসাহ দেয়ার জন্য হ্যারি, রন আর হারমিওন দাঁড়িয়ে হাত তালি দিতে শুরু করল। আর তখন নেভিলকে সবাই বুকে জড়িয়ে ধরছে। ওকে আর দেখাই যাচ্ছে না সবার ভিড়ে।

কেউ কেউ হ্যারিকে চাপড়ে দিচ্ছে। হ্যারি, রন ও হারমিওন দাঁড়িয়ে আনন্দ করছিলো, নেভিল অভূতপূর্ব ঘটনায় হতবিহ্বল ও তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য–নেভিল এর আগে কখনোই এত পয়েন্ট পায়নি। হ্যারি তখনও আনন্দে উদ্বেলিত। রনকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে হ্যারি ম্যালফয়ের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ম্যালফয়কে এত হতভম্ব ও বিচলিত আর কখনোই দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে অন্ধ হবার

অভিশাপটা তার ওপর প্রভাব ফেলেছে।

আবার ডাম্বলডোর হাত উঠিয়ে বললেন–সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। চারদিকে তখনও করতালি ও হর্ষধ্বনি।

স্লিদারিন হাউজের পয়েন্ট কমে যাওয়ায় র‍্যাভেনক্ল ও হাফলপাফ হাউজও হর্ষধ্বনি করছে। তারা বললেন–পয়েন্ট পুনর্বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাজ সজ্জাতেও কিছু পরিবর্তন করতে হবে।

ডাম্বলডোর হাতে তালি দিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই সবুজ চাদর লাল চাদরে রূপান্তরিত হলো। রূপো সোনা হয়ে গেল এবং পেছনের ব্যানারে স্লিদারিন হাউজের প্রতীক সাপের পরিবর্তে গ্রিফিল্ডর হাউজের প্রতীক সিংহ প্রতিস্থাপিত হলো। কৃত্রিম হাসি নিয়ে অধ্যাপক স্নেইপ অধ্যাপক স্ম্যাকগোনাগলের সাথে করমর্দন করলেন। একটু পর তার নজর পড়ল হ্যারির ওপর। হ্যারি অনুভব করল যে, তার প্রতি স্নেইপের মনোভাবে সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি। এতে অবশ্য হ্যারি উদ্বিগ্ন হলো না। জীবন তার স্বাভাবিক গতিতেই চলবে।

হ্যারির জীবনে এ সন্ধ্যাটা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। কিডিচ খেলায় জয়লাভ করা বা বড় দিনের উপহার পাওয়া বা দানবটাকে হত্যা করার তুলনায় এই সন্ধ্যাটা ছিল অনেক অনেক বেশি ভাল। এটা ছিল হ্যারির জন্য একটা অবিস্মরণীয় সন্ধ্যা।

সামনে যে পরীক্ষার ফল বেরুবে-এটা হ্যারি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফল শেষ পর্যন্ত বেরুল। বিস্ময়ের সাথে হ্যারি আর রন লক্ষ্য করল যে ভালো মার্ক পেয়েই তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। হারমিওন অবশ্য প্রথম হয়েছে। নেভিল হার্বোলজিতে ভালো করে ওষুধ তৈরির বিষয়ে প্রাপ্ত কম নম্বরকে পুষিয়ে নিয়েছে। তাদের ধারণা ছিল যে গর্দভ ও নীচুমনা গয়েল পরীক্ষায় পাস করবে না। তাদের বিস্মিত করে সেও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। এটা ছিল লজ্জার বিষয়। তবে রন হ্যারিকে বোঝাল–জীবনে যা চাওয়া যায় তার সবই কিন্তু পাওয়া যায় না।

হঠাৎ করেই ওয়ার্ডরোবগুলো খালি হয়ে গেল। সবাই তাদের ট্রাংক ভরে ফেলেছে। এবার ফেরার পালা। তাদেরকে নৌকা দিয়ে নিয়ে যাবার জন্য হ্যাগ্রিড এসে উপস্থিত। এরপর তারা হোগার্টস এক্সপ্রেসে উঠবে। প্ল্যাটফর্মে আসতে তাদের একটু বিলম্বই হলো। তারা দুজন দুজন করে, তিনজন তিনজন করে দরোজা অতিক্রম করল। তাদের প্রতি মাগলরা কেউ তেমন লক্ষ্য করল না।

তোমাকে গ্রীষ্মকালে আমাদের বাড়িতে কিছুদিন এসে থাকতে হবে। রন বলল–আমি তোমার কাছে পেঁচা পাঠিয়ে দেব।

ধন্যবাদ। হ্যারি জবাব দিল–আমি এর জন্য অপেক্ষা করবো।

বাই হ্যারি।

সি ইউ পটার।

তুমি তো এখানেও বিখ্যাত।

আমি কোথাও যাচ্ছি না। তবে তোমার শুভ কামনা করি। হ্যারি জবাব দিল।

সে, রন আর হারমিওন একত্রে গেইট অতিক্রম করল।

মা, এই তো হ্যারি। তাকিয়ে দেখ।

চুপ করো, জিনি। কাউকে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো অভদ্রতা। এটা ছিল গিনি উইসলি–রনের বোন।

তাদের দিকে তাকিয়ে মিসেস উইসলি মুচকি হাসলেন।

নিশ্চয়ই বছরটা ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। তিনি বললেন।

আসলেই। হ্যারি জবাব দিল–মিষ্টি আর জাম্পারের জন্য ধন্যবাদ।

এটা উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। মিসেস উইসলি বললেন।

তুমি কি যাওয়ার জন্য তৈরি?

আশ্চর্যের ব্যাপার। এ তো আঙ্কল ভার্নন। হ্যারির হাতে খাঁচা–বন্দি পেঁচা দেখে গোঁফধারী আঙ্কল তার বিরক্তি প্রকাশ করতে দ্বিধা করলেন না, তার পেছনে আছেন চাচী পেতুনিয়া। এমনকি ডাডলি পর্যন্ত। হ্যারির চেহারা দেখে সে কিছুটা সন্ত্রস্ত।

আপনারা নিশ্চয়ই হ্যারির পরিবারের সদস্য? মিসেস উইসলি তাদের জিজ্ঞেস করলেন। বলতে পারেন আঙ্কল ভার্নন উত্তর দিয়ে হ্যারির উদ্দেশ্যে বললেন–

বাছা, তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমাদের হাতে সময় নেই। আঙ্কল ভার্নন হাঁটতে শুরু করলেন।

রন আর হারমিওনের সাথে শেষ কথা বলার জন্য হ্যারি একটু দেরী করছিল।

গ্রীষ্মকালে আবার দেখা হবে।

তুমি সুন্দর ছুটি কাটাতে পারবে ভেবে আমার খুব ভালো লাগছে। হারমিওন এই বলে আঙ্কল ভার্ননের দিকে তাকালো। হারমিওনের বোধগম্য হল না–মানুষ কীভাবে দেখতে এত অপ্রীতিকর হতে পারে।

আশা করি পারব। হ্যারি জবাব দিল।

হ্যারি মনে মনে বলল–ওরা তো জানে না যে বাড়িতে জাদুবিদ্যার অনুশীলন করা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। হ্যারি ভাবতে লাগল–গ্রীষ্মের ছুটিতে ডাডলির সাথে অনেক মজা করা যাবে।

***


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন