হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং (৩য় -৪র্থ পর্ব)



প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব পড়তে →

তৃতীয় পর্ব 


হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং

🔴 পৌনে দশ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে যাত্রা

ডার্সিলি পরিবারে হ্যারির শেষ মাসটা খুব আনন্দে কাটেনি। ডাডলি তাকে এমন ভয় পেত যে সে তার সঙ্গে কোন সময়ই এক ঘরে থাকতে চাইত না। অন্যদিকে তাকে কাবার্ডে ভরতে, ধমক দিতে বা জোর করে কিছু করতে ডার্সলিরা সাহসও পেতেন না। প্রকৃতপক্ষে, কেউই হ্যারির সাথে পারতপক্ষে কথা বলতেন না। কিছুটা ভয়, কিছুটা রাগের কারণে হ্যারি সামনে বসে থাকলেও তারা মনে করতেন চেয়ারটা খালি। ওখানে কেউ নেই। এটা অনেক দিক থেকে ভালো হলেও হ্যারির কাছে এই উপেক্ষা বিষাদে পরিণত হয়েছিলো।

সঙ্গী হিসেবে পেঁচাকে হ্যারি তার ঘরে রেখেছে। পেঁচার নাম দিয়েছে সে হেডউইগ। এ নামটি সে পেয়েছে এ হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক গ্রন্থে। তার বইগুলো ছিল খুব মজার। সে গভীর রাত পর্যন্ত বইগুলো পড়ত। হেডউইগ জানালা দিয়ে ইচ্ছেমত ঘরের বাইরে যেত আবার আসত। ভাগ্য ভালো যে, আন্ট পেতুনিয়া কখনো হ্যারির ঘরে ঢুকতেন না, কারণ, প্রতিদিনই হেডউইগ ঘরে মরা ইঁদুর নিয়ে আসত। শোবার আগে সে প্রতি রাতেই দেয়ালে পিন দিয়ে আটকানো একটা কাগজে লেখা একটি করে তারিখ কেটে দিত। এভাবেই সে হিসাব রাখতো ১লা সেপ্টেম্বর আসতে আর কদিন বাকি আছে।

আগস্টের শেষ দিন হ্যারি কিভাবে সে কিংসক্রসে যাবে সে বিষয়ে আঙ্কল–আন্টের সঙ্গে একটু কথা বলে নেয়া ভালো। হ্যারি যখন তাদের বসার ঘরে গেল তখন তারা টিভিতে একটি কুইজ দেখছিলেন। হ্যারি গলা দিয়ে কাশির মতো শব্দ করল। তাকে দেখেই ডাডলি চিৎকার করে পালিয়ে গেল।

হ্যারি কাশি দিয়ে নিজের আসার কথা জানান দিল।

ভার্নন আঙ্কল, হ্যারি বলতে শুরু করল।

আঙ্কল কোন কিছু বললেন না, তবে বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি হ্যারির কথা শুনছেন।

হ্যারি বলল–আঙ্কল কাল আমি কিংস ক্রস স্টেশনে যাব। আমাকে হোগার্টস যেতে হবে। আপনার গাড়িতে আমাকে লিফট দিতে পারবেন?

আঙ্কল ভের্নন কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

ধন্যবাদ। হ্যারি বলল।

হ্যারি যখন ওপরতলায় ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল তখন তার আঙ্কল কথা বললেন, জাদুকরদের স্কুলে যেতে আবার ট্রেনের প্রয়োজন হয় কেন? ওদের ম্যাজিক কার্পেটগুলো কি ফেঁটে গেছে? তারপর হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন–তোমার স্কুল কোথায়?

আমি ঠিক জানি না। হ্যারি জবাব দিল। হ্যারি তখনই উপলব্ধি করলো যে সে বিষয়টি আগে খেয়াল করেনি। সে পকেট থেকে হ্যাগ্রিডের দেয়া টিকিট বের করলো।

কী জানো তাহলে?

হ্যারি জবাব দিল-এতটুকু জানি পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠিক এগারোটায় ট্রেনে চড়তে হবে।

কী প্ল্যাটফর্ম বললে? আন্ট ও আঙ্কল তার দিকে বিস্ময়ে তাকালেন।

পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। হ্যারি বলল।

যত্তসব রাবিশ–

এ নামে তো কোন প্ল্যাটফর্ম নেই। আঙ্কল ভার্নন মন্তব্য করলেন। টিকিটে তো তাই লেখা আছে। হ্যারি মরিয়া হয়ে জবাব দিল।

যত্তসব পাগলের কাণ্ড। আঙ্কল ভার্নন মন্তব্য করলেন–ঠিক আছে। অপেক্ষা করো, তুমি নিজেই দেখতে পাবে। তোমাকে কিংস ক্রস স্টেশনে নামিয়ে দিতে আমার কোন অসুবিধে নেই। কারণ কাল আমরাও লন্ডন যাচ্ছি।

পরিবেশ লঘু করার জন্য হ্যারি প্রশ্ন করল–আপনারা লন্ডন যাচ্ছেন, কেন?

ডাডলিকে হাসপাতালে নিতে হবে। বড় হওয়ার আগেই তার পেছনের ছোট লেজটায় অস্ত্রোপচার করতে হবে। সে-ই লেজটাই, যেটা গজিয়েছিল ঝড়ের রাতে, হ্যাগ্রিডের জাদুমন্ত্রে। সে রাত থেকে হ্যারিকে ডাডলির জ্বালাতন করাতো দূরের কথা, ওর ধারে কাছে যেতে সাহস পায় না।

পরদিন ভোর পাঁচটায় হ্যারি ঘুম থেকে উঠল। ভেতরে টান টান উত্তেজনা। তাই দ্বিতীয়বার আর ঘুমোতে গেল না। সে তার জিনসের কাপড় বের করল, কারণ জাদুকরের পোশাক পরে সে স্টেশনে যেতে চাচ্ছিল না। ট্রেনে উঠে সে পোশাক পালটে নেবে। হোগার্টসের জন্য যা যা জিনিস, তার তালিকা হ্যারি একবার যাচাই করে নিল। কারণ হোগার্টসে গিয়ে দেখা যাবে যে এমন কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনা দরকার ছিল কিন্তু সেগুলো আনা হয়নি।

তারপর হ্যারি অপেক্ষা করতে লাগল–ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের কখন ঘুম ভাঙে। দু ঘণ্টা পর হ্যারির ভারী ট্রাংক ডার্সলির গাড়িতে ওঠানো হলো। আন্ট পেতুনিয়া ডাডলিকে বলে দিলেন–গাড়িতে ও যেন হ্যারির পাশে বসে। ভয়ে ভয়ে হলেও ডাডলি হ্যারির পাশে গাড়িতে বসলো, গাড়ি চলতে শুরু করলো।

সাড়ে দশটায় তারা কিংস ক্রস স্টেশনে পৌঁছলেন। আঙ্কল ভার্নন হ্যারির ট্রাংকটা ট্রলিতে উঠিয়ে দিলেন এবং নিজেই ট্রলিটি স্টেশনে ঠেলে নিয়ে গেলেন। হ্যারি আঙ্কলের ওই কাজকে একটা আশ্চর্য সদয় ব্যবহার বলে মনে করল। একটু পরে যখন আঙ্কল ভার্নন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলেন তখন তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি।

আঙ্কল ভার্নন বললেন-এই তোমার প্ল্যাটফর্ম প্ল্যাটফর্ম নয়… প্ল্যাটফর্ম দশ। তোমার প্ল্যাটফর্ম এ দুটি সংখ্যার মাঝামাঝি হওয়া উচিত। মনে হচ্ছে–প্ল্যাটফর্ম এখনও তৈরি করেনি। আঙ্কল ভার্নন ঠিকই বলেছেন। প্ল্যাটফর্মের কোন এক জায়গায় প্লাস্টিকে বড় অক্ষরে নয় এবং অন্য এক স্থানে দশ লেখা আছে। এ দুয়ের মাঝামাঝি জায়গায় কোথাও কোন কিছু লেখা ছিল না।

ভালো থেকো। এই বলে তার সে-ই অদ্ভুত ও সংশয়মিশ্রিত হাসি হেসে আঙ্কল ভার্নন আর কোন কথা না বলেই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেলেন। হ্যারি তাকিয়ে দেখল ডার্সলিরা গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের তিনজনই হাসছে। হ্যারির মুখ শুকিয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল সে এখন কি করবে? পেঁচা হেডউইকের কারণে লোকজন তার দিকে তাকাচ্ছে। ট্রেনের ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত। হ্যারি গার্ডের কাছে গিয়ে হোগার্টসের ট্রেনের কথা জানতে চাইল। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পৌনে দশ বলতে হ্যারির সাহস হচ্ছিল না। হোগার্টস কোথায়? জানতে চাইল গার্ড। হ্যারিও তাকে বলতে পারল না হোগার্টস দেশের কোন জায়গায় অবস্থিত। হ্যারি কি বলবে, তার মাথায় কিছু আসছিলো না। এবার প্রশ্ন করল–আচ্ছা এগারোটার সময় কোন ট্রেন আছে কি?

তাতো বলতে পারলাম না। গার্ড জবাব দিল। তখন এগারোটা বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। ট্রেনের মাত্র দশ মিনিট বাকি। সে স্টেশনের মাঝখানে ভারি ট্রাঙ্ক, পেঁচা ও পকেটভর্তি জাদুকরদের টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ঠিক এই সময়ে পেছনে একদল লোক দেখতে পেল যারা আলাপে মাগল শব্দটি বারবার বলছিল। এক মোটা মহিলা চারজন লাল চুল যুবকের সাথে কথা বলছিলেন। হ্যারি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। শুনতে পেল মহিলা বলছেন–

–তোমাদের প্ল্যাটফর্ম নাম্বার কত?

পৌনে দশ। একটি ছোট মেয়ে জবাব দিল। তারও লালচুল। মাম, আমিও কি ওদের সাথে যেতে পারি না।

না, না, গিনি তুমি ছোট এখনো বড় হওনি। এখন চুপ কর। আর পার্সি তুমি আগে আগে যাও।

ছেলেদের মধ্যে যাকে সবচে বেশি বয়সের মনে হলো তাকে প্ল্যাটফর্ম নয় ও দশের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল। হ্যারি তাকে অপলক দৃষ্টিতে লক্ষ্য রেখে তার পেছনে পেছনে অগ্রসর হলো। ছেলেটা যখন এই দুটো প্লাটফরমের মাঝামাঝি পৌঁছলো, তার সামনে দলে দলে পর্যটক। যখন সর্বশেষ ব্যাগটিও ট্রেন থেকে খালাস করা হলো তখন দেখা গেল যে ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। ফ্রেড, তারপর তোমার পালা। ভদ্রমহিলা বললেন।

আমি ফ্রেড নই। আমি জর্জ। ছেলেটি জবাব দিল। তুমি কি আমাকে জর্জ বলে ডাকতে পারো না?

দুঃখিত, জর্জ। ভদ্রমহিলা বললেন।

ঠাট্টা করছিলাম। আমিই ফ্রেড। এই বলে সে চলে গেল।

তারপর তৃতীয় ভাইটি বদ্ধ দেয়ালের দিকে অগ্রসর হলো। তাকে আর দেখা গেল না। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল তারও কোন হদিস নেই। হ্যারির পাশে কেউ আর রইল না।

মাফ করবেন। ভদ্রমহিলার কাছে এসে হ্যারি বলল।

হ্যালো! হ্যারিকে সম্বোধন করে ভদ্র মহিলা বললেন–তুমি কি প্রথমবারের জন্য হোগার্টসে যাচ্ছে? রনও প্রথমবারের মতো যাচ্ছে।

তিনি তার ছোট ছেলের প্রতি ইশারা করলেন।

রন লম্বা, পাতলা। হাত পা বড় বড়। চোখা নাক।

হ্যাঁ হ্যারি জবাব দিল। কীভাবে যাব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি

কেন, তুমি কি প্লাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছি না।

না। হ্যারির জবাব।

চিন্তা নেই। তোমাকে শুধু দু প্লাটফর্মের মাঝখানে যেতে হবে। নয় ও দশের মাঝখানে। ওই দেয়ালের দিকে যাও। ঘাবড়াবার কারণ নেই। চেষ্টা কর যাতে রনের আগে পৌঁছতে পারো।

ঠিক আছে। হ্যারি বলল।

হ্যারি তার ট্রলি ধাক্কা দিল এবং সামনের বদ্ধ দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়ালটা একেবারে নিরেট।

হ্যারি হাঁটতে শুরু করল। যাওয়ার পথে লোকজনের সাথে হ্যারির ধাক্কাধাক্কি হলো। হ্যারি আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল। টিকিট বাক্সের সাথে হ্যারির ধাক্কা লেগে গিয়েছিল প্রায়। ধাক্কা লাগলে তার জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে যেত। ভাগ্য ভালো। হ্যারিকে দুর্ঘটনায় পড়তে হয়নি।

জনাকীর্ণ প্লাটফর্মের পাশে একটি লাল রঙের বাস্পীয় ইঞ্জিন অপেক্ষা করছিল। ইঞ্জিনের ওপর লেখা ছিল হোগার্টস এক্সপ্রেস।

১১টা। হ্যারি পেছনে তাকাল। তাকিয়ে দেখল। নয় ও দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে লেখা ভেসে উঠল–প্লাট ফরম পৌনে দশ।

কথাবার্তায় ব্যস্ত লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে ইঞ্জিনের ধোঁয়া ভেসে চলেছে। নানা রঙের বিড়াল পায়ের ফাঁক গলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক পেঁচা এদিক–সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রাংক টানাটানির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

প্রথমদিকের কামরাগুলোতে ছাত্ররা গা ঘেষাঘেষি করে বসে আছে। কেউ কেউ জানালা দিয়ে মুখ গলিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলছে। একটা ছেলে তার ব্যাঙ হারিয়ে ফেলেছে। হ্যারির ভাগ্য ভালো। সে মোটামুটি একটি খালি কামরা পেয়ে গেল।

ফ্রেড নামের ছেলেটা হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল–তুমি কি হ্যারি পটার?

হ্যাঁ। হ্যারি জবাব দিল।

হ্যারির দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে লালচুল যমজভাই দুজন ট্রেন থেকে নেমে এল। হ্যারি জানালার পাশে বসেছিল। সেখান থেকে নিজেকে অনেকটা আড়ালে রেখে হ্যারি প্ল্যাটফর্মে লালচুল পরিবারের সবাইকে লক্ষ্য করছিল এবং তারা কি বলছিল তা শুনছিল। মা এইমাত্র তার রুমাল বের করলেন।

রন, তোমার নাকে ওটা কি?

ছোট ছেলেটি তার মার কাছ থেকে সরে যাচ্ছিল। তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে তার নাক মুছে দিলেন।

যমজ ভাইদের একজন বলে উঠল–রনের নাকে কি কিছু আছে?

চুপ কর। রন ধমক দিল।

পার্সি কোথায়? তার মা জানতে চাইলেন।

সে আসছে

বড় ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এল। এরই মধ্যে সে তার পোশাক বদলে হোগার্টসের জাদুর স্কুলের পোশাক পরে নিয়েছে। হ্যারি দেখল ইংরেজি পি বর্ণ দিয়ে তার বুকের ওপর একটি উজ্জ্বল ব্যাজ।

মা, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। ছেলেটি বলল।

আমি প্রিফেক্টদের কামরা থেকে এলাম। তারা তাদের জন্য দুটি কামরা পৃথক করে রেখেছেন।

পার্সি, তুমি কি একজন প্রিফেক্ট? যমজদের একজন প্রশ্ন করল।

যমজদের একজন আবার প্রশ্ন করল–পার্সি প্রতিদিন নতুন পোশাক পায় কিভাবে?

কারণ সে একজন প্রিফেক্ট। মা জবাব দিলেন। ভালোভাবে থেকো। যখন সুযোগ পাবে তখন আমাকে একটা পেঁচা পাঠাবে।

তিনি পার্সির কপালে চুমু দিলেন। পার্সি চলে গেল! এরপর তিনি যমজ ভাইদের দিকে নজর দিলেন।

হ্যারি লক্ষ্য করল ট্রেন বাঁক নেবার সাথে সাথেই মা ও মেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ট্রেনে চড়তে পারায় হ্যারির অনেক আনন্দ হচ্ছিল। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ করে সামনের দরোজা খুলে গেল। একজন লালচুলের বালক কামরায় প্রবেশ করে হ্যারির উল্টোদিক দেখিয়ে জানতে চাইল-এখানে কি কেউ আছে? হ্যারি না বলাতে বালকটি ওই আসনে বসে পড়ল।

প্রথমে সে হ্যারিকে লক্ষ্য করল। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে এমনভাবে তাকাল যেন সে হ্যারিকে দেখতেই পায়নি। হ্যারি লক্ষ্য করল এর ভেতরে দু যমজ ভাই ফিরে এসেছে।

যমজ ভাইদের একজন বলল আমাদের কি পরিচয় হয়েছে? আমরা ফ্রেড ও জর্জ। এ হলো আমাদের ভাই রন। আবার দেখা হবে।

বিদায়, হ্যারি ও রন বললো। যমজ দু ভাই অন্য কামরায় গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিল। তুমি কি আসলেই হ্যারি পটার? রন আবার প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ। মাথা নেড়ে হ্যারি বলল। রন আবার বলল–আমি ভেবেছিলাম ফ্রেড বা জর্জের মধ্যে কেউ একজন হবে।

রন হ্যারির কপালের দিকে ইঙ্গিত করে বলল।

হ্যারি, এখানেই কি ইউ-নো-হুর…।

হা হ্যারি জবাব দিল–কিন্তু আমার কিছু মনে নেই।

তোমার কি কিছুই মনে নেই? রন আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল।

তীব্র সবুজ আলোর কথা আমার মনে পড়ে। এর বাইরে কিছুই মনে করতে পারি না। হ্যারি জবাব দিল।

ওহ। এই বলে রন বসে পড়ল ও হ্যারিকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণের জন্য। তারপর সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

তোমাদের পরিবারের সবাই কি জাদুকর? হ্যারি রনকে প্রশ্ন করল। রনকে হ্যারির খুব ভাল লেগেছে।

রন জবাব দিল–আমার তাই মনে হয়। মায়ের এক দূরসম্পৰ্কীয় ভাই আছেন যিনি হিসাবরক্ষক। আমরা তাকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা করি না।

তাহলে তুমি অনেক জাদু জানো। হ্যারি মন্তব্য করল।

ওয়েসলি পরিবার পুরনো জাদুকর পরিবারের অন্যতম। ডায়াগন এলির সেই ছেলেটি এ ধরনের মন্তব্য করেছিল।

আমি শুনলাম তুমি মাগলদের সাথে থাকতে গিয়েছিলে। তারা কেমন? রন হ্যারিকে প্রশ্ন করল।

খুবই খারাপ। তবে তাদের সবাই নয়। হ্যারি জবাব দিল। মাগল চেনার জন্য আমার চাচা, চাচী ও চাচাতো ভাইই যথেষ্ট। আমার যদি তিনজন জাদুকর ভাই থাকত।

পাঁচ–রন বলল। যেকোন কারণেই হোক রনকে একটু মনমরা দেখাচ্ছিল। রন বলে চলল–আমাদের পরিবারে আমি ষষ্ঠ ব্যক্তি যে হোগার্টসে যাচ্ছি। তুমি হয়তো বলতে পার বিল আর চার্লি যা রেখে গেছে তার অনেক কিছুই আমি পেয়েছি। বিল ছিল হেডবয়, আর চার্লি কিডিচ দলের অধিনায়ক। এখন পার্সি একজন প্রিফেক্ট। ফ্রেড আর জর্জ অনেক হইচই করে বেড়ায়। তবুও তারা ভালো নম্বর পায়। সবাই মনে করে তারা খুব মজার। প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা আমিও তাদের মত ভালো করব। আমি যদি ভালো করি তাতেও আমার কোন কৃতিত্ব থাকবে না। কারণ এ রকম ফলাফল ওরা সবাই আগে করে গেছে। যার পাঁচ ভাই আছে সে কখনো নতুন কিছু পায় না। আমি বিলের কাছ থেকে তার পুরনো পোশাক, চার্লির কাছ থেকে জাদুদণ্ড এবং পার্সির কাছ থেকে পুরনো ইঁদুর পেয়েছি।

রন তার জ্যাকেটের ভেতর হাত দিয়ে একটা মোটা ধূসর রঙের ইঁদুর বের করল। ইঁদুরটা তখন ঘুমোচ্ছিল। এর নাম স্ক্যাবাস। এটা কোন কাজের নয়। কখনও ঘুম থেকে ওঠে না। পার্সি প্রিফেক্ট হওয়ার পর আমার বাবার কাছ থেকে এক পেঁচা পেয়েছিল। আর আমি পেলাম এই স্কাবার্সকে। রনের কান গোলাপী বর্ণ ধারণ করল। তার মনে হল সে অনেক বেশি কথা বলছে। তাই সে আবার জানালার বাইরে তাকাল। কারো কাছে যদি একটি পেঁচা না থাকে তাহলে তাকে দুঃখিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই–হ্যারির কাছে তাই মনে হলো। একমাস আগেও হ্যারির কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। হ্যারি রনকে জানাল যে তাকে সব সময় ডাডলির পুরনো কাপড় পরতে হয়েছে এবং জন্মদিনে সে কখনো কোন উপহার পায়নি।

হ্যারির কথা শুনে রন খুশি হয়ে উঠল।

হ্যারি রনকে আরও বলল–হ্যাগ্রিডের সাথে সাক্ষাতের আগে বুঝতে পারিনি যে আমাকে জাদুকর হতে হবে। তার সাথে সাক্ষাতের আগে আমি আমার বাবা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।

রন একটি দীর্ঘশ্বাস নিল।

কি ব্যাপার? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তুমি ইউ-নো-হু-এর নাম বললে। আমিও ভেবেছিলাম তোমরা সবাই… রন বলল। তাকে একই সাথে অভিভূত আবার দুঃখিতও মনে হচ্ছিল।

আমি তার নাম উল্লেখ করে বাহাদুরি দেখাতে চাইনি।

হ্যারি বলল আমি মনে করি আমি যে শব্দগুলো উচ্চারণ করেছি সেগুলো তোমার না জানাই ভালো। আমাকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে। আমার মনে হয় আমি ক্লাশের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র হবো?

না, তুমি তা হবে না। রন বলল-এখানে অনেকেই মাগল পরিবার থেকে আসে। তারা অল্প সময়েই সব শিখে ফেলে।

তারা যখন কথা বলছিল ঠিক তখনই ট্রেনটি লন্ডন শহরের বাইরে চলে গেল। তারা জানালা দিয়ে মাঠে গরু–ছাগল–ভেড়া দেখতে লাগল।

ঠিক সাড়ে বারোটার সময় তারা ট্রেনের করিডোর থেকে কথাবার্তা ও হাসির শব্দ শুনতে পেল। তাদের কামরার দরোজা খুলে এক ভদ্রমহিলা এসে হাসি মুখে তার টেনে আনা খাবারের ট্রলির দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–তোমাদের কারো কোন খাবার লাগবে?

হ্যারি সকালে নাশতা করতে পারেনি। তাই সে উঠে দাঁড়ালো। রন বলল তাকে বাইরে যেতে হবে না। তার কাছেই স্যান্ডউইচ আছে।

হ্যারি যখন ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকত তখন তার কাছে কোন টাকা–পয়সা থাকত না। অবশ্য এখন তার পকেট গরম। তার পকেট ভর্তি সোনা ও রূপার মুদ্রা। মহিলাটির ট্রলিতে সব আজব ধরনের খাবার, যা সে জীবনে দেখেনি। সে কোনটাই হারাতে চাইলো না, সবকিছুই অল্প অল্প করে কিনলো এবং মহিলাকে এগারটি সিলভার সিকেল ও সাতটি ব্রোঞ্জ নাটস দিল।

হ্যারি অনেক খাবার দাবার এনে খালি আসনে রাখল।

রন জিজ্ঞেস করল–তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে? কুমড়োর একটি প্যাস্ট্রি মুখে দিতে দিতে হ্যারি বলল–হ্যাঁ আমার খিদে পেয়েছে।

রন প্যাকেট খুলে চারটি স্যান্ডউইচ বের করল। হ্যারিকে বলল, তুমি এখান থেকে কিছু নেবে? অবশ্য স্যান্ডউইচগুলো শুকনো। বুঝতেই পারছো। আমরা পাঁচ ভাই, মা খুব একটা সময় পায় না।

হ্যারি তার প্যাস্ট্রি রনের সামনে রেখে বলল নাও, এখান থেকে নাও। এ পর্যন্ত ভাগাভাগি করে খাবার সুযোগ হ্যারির হয়নি। রনের সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়াতে হ্যারির মনে এক আনন্দময় অনুভূতির সৃষ্টি হলো। রনের সাথে হ্যারি প্যাস্ট্রি ও কেক খেল। স্যান্ডউইচের কথা তারা একেবারেই ভুলে গেল।

চকোলেট ফ্রগের একটি প্যাকেট বের করে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল-এটা কী?

হ্যারি বলে চলল-এগুলি নিশ্চয়ই ব্যাঙ নয়।

হ্যারি যেকোন বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল।

না ব্যাঙ নয়। রন জবাব দিল। দেখো সাথে একটি কার্ড আছে।

কি? হ্যারি প্রশ্ন করল।

তুমি জানো না। রন বল–চকোলেট ফ্রগের ভেতর কার্ড থাকে। এসব কার্ডে বিখ্যাত জাদুকর ও জাদুকরণীদের ছবি থাকে। আমি এ পর্যন্ত পাঁচশ কার্ড সংগ্রহ করেছি, কিন্তু কোনো কার্ডেই এগ্রিপা বা টলেমির ছবি পাইনি।

হ্যারি তার চকোলেট ফ্রগের প্যাকেটটি খুলল। কার্ডে একজন মানুষের ছবি। তার চোখে অর্ধচন্দ্রাকার চশমা। লম্বা বাঁকা নাক। রূপালী চুল, দাঁড়ি ও গোঁফ। ছবির নিচে লেখা

আলবাস ডাম্বলডোর

রন বলল, আমি একটা ফ্রগ চকোলেট নেই, দেখি এগ্রিপা বা টলেমির ছবি পাই কিনা।

হ্যারি পড়তে লাগলো…

আলবাস ডাম্বলডোর হোগার্টস-এর বৰ্তমান অধ্যক্ষ, যাকে বিবেচনা করা হয় এ যুগের শ্রেষ্ঠতম জাদুকর হিসেবে। ১৯৪৫ সালে কালো যাদুকর গ্রিনডে ওয়াল্ডকে পরাজিত করেই ডাম্বলডোর বিখ্যাত হন; ড্রাগন রক্তের ১২টি ব্যবহার উদ্ভব ও সহকর্মী নিকোলাস ফ্লামেলের সাথে আলকেমির উপর কাজ করাও তার অন্যতম কীর্তি। প্রফেসর ডাম্বলডোর উপভোগ করেন চেম্বার মিউজিক ও টেনপিন বোলিং।

হ্যারি এবার কার্ডটি উল্টাল। এবার তাকিয়ে দেখে কার্ডে ডাম্বলডোরের কোন ছবিই নেই।

কই, তিনি তো নেই। হ্যারি অবাক বিস্ময়ে মন্তব্য করল।

তুমি তো আশা করতে পার না তিনি সারাক্ষণ কার্ডের সাথে লেগে থাকবেন। রন বলল–তিনি আবার আসবেন। আমি আবার মর্গানাকে পেয়েছি।… তার ছটা ছবি পেয়েছি।

তুমি কি কার্ড জমাতে চাও?

রনের দৃষ্টি চকোলেট ফ্রগের প্যাকেটগুলোর দিকে।

না–ও না–ও হ্যারি বলল, তুমি তো জান, মাগল জগতে ছবির ভেতর মানুষ স্থায়ীভাবে থাকে।

সত্যিই কি তারা তাই করে? তারা কি একটুও নড়াচড়া করে না। রন আশ্চর্য হয়ে মন্তব্য করল–সত্যিই কী অদ্ভুত!

হ্যারি দেখল যে ডাম্বলডোরের ছবি পুনরায় কার্ডে চলে এসেছে এবং তিনি হ্যারির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বিখ্যাত জাদুকরদের ছবির চেয়ে রন-এর মনোযোগ ছিল খাবারের দিকে। একটু পর হ্যারি কার্ডে শুধু ডাম্বলডোরই নয়–আরো বিখ্যাত জাদুকরদের ছবি দেখল। এরপর হ্যারি বেরটি বোটস-এর বিচিত্র গন্ধের মটরশুটির প্যাকেট খুললো। এ সব বিষয়ে তোমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রন হ্যারিকে সাবধান করে বলল। যখন তারা বলে সকল প্রকার গন্ধ, তার মানে সকল প্রকার গন্ধ–তুমি জান, চকোলেট, পিপারমেন্ট এবং মার্মালেড-এর মত সাধারণ জিনিসে যা পাও, আবার তুমি পালং শাক, কলিজা বা ষাড়ের ভুঁড়ির গন্ধ।

রন একটি সবুজ মটরদানা হাতে নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করল এবং মটরদানায় কামড় বসাল।

তারা বেশ মজা করে খাচ্ছিল। হ্যারি টোস্ট, নারকেল, সেকা মটরশুটি, স্ট্রবেরি, তরকারি, ঘাস, কফি ও সার্দিন খেল। এবং সাহস করে একটি ধূসর রঙের খাবারে এক কামড় দিল যা রন কখনো করবে না, ওটা আসলে ছিল মরিচ।

এবার তারা জানালা দিয়ে দেখল, খেত–খামার নয়, ট্রেনটি বন, আঁকাবাঁকা নদী ও ঘন সবুজ পাহাড় অতিক্রম করছে। তাদের কম্পার্টমেন্টের দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ পেল এবং দরজা টেনে গোলমুখ ছেলেটি ভেতরে ঢুকলো, ওকে হ্যারি পৌনে দশ প্লাটফর্মে দেখেছিল। কাঁদো কাঁদো মুখ তার। বলল, তোমরা কি একটি ব্যাঙ দেখেছো? তারা যখন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না। সে কেঁদে ফেলো, আমি ওটা হারিয়ে ফেলেছি। হ্যারি তাকে সান্ত্বনা দিল–পেয়ে যাবে। ঘাবড়িওনা।

যাহোক, যদি দেখতে পাও, আমাকে জানিও বলে ছেলেটি চলে গেল। একটু পর আবার সে ফিরে এল। এবার সাথে একটি মেয়ে। তার গায়ে হোগার্টসের ইউনিফর্ম। তোমরা কি কেউ একটা ব্যাঙ দেখেছো, নেভিল হারিয়েছে। মেয়েটি বলল।

আমরা আগেই ওকে জানিয়েছি–আমরা দেখিনি। রন বলল। রনের হাতে জাদুদণ্ড।

একি, তুমি কি ম্যাজিক দেখাবে? রনের হাতে জাদুকাঠি দেখে মেয়েটি বলল।

দেখি কি ম্যাজিক করছো, বলে মেয়েটি বসে পড়লো।

রন একটু ভয়ই পেয়ে গেল, তারপর বলল, ঠিক আছে। কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে শুরু করলো সানসাইন, ডেইসিস, বাটার মেলো টান দিস স্টুপিড, ফ্যাট র‍্যাট ইয়েলো। বলে সে জাদুকাঠিটি ঘুরালো। কিন্তু কিছুই হলো না। ইঁদুরটা ধুসরই থেকে গেল এবং ওটা তখনও ঘুমাচ্ছিল।

আমি রন ওয়েসলি। রন মৃদুস্বরে বলল।

আমি হ্যারি পটার। হ্যারি বলল।

তুমি কি সত্যিই হ্যারি পটার? অবাক হয়ে হারমিওন প্রশ্ন করল। তারপর হারমিওন বলে চলল–আমি তোমার সবকিছুই জানি। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আমি কিছু বই পাই। মডার্ন ম্যাজিকাল হিস্ট্রি, দি রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দি ডার্ক আর্টস এবং গ্রেট উইজার্ডিং ইভেন্টস অফ দি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বইগুলোতে তোমার নাম উল্লেখ আছে।

সত্যিই? বিস্ময়ের সাথে হ্যারি প্রশ্ন করে।

আশ্চর্য, তুমি কিছুই জান না। হারমিওন বলল–আমি যদি তোমার জায়গায় হতাম তাহলে আমি সবকিছু খুঁজে বের করে ফেলতাম। আচ্ছা, তোমরা কি কেউ জানো তোমরা কোন হাউজে থাকবে? আমি গ্রিফিল্ডর হাউজে থাকতে চাই। আমার মনে হচ্ছে ওটা ভাল হবে। আজ আমি যাচ্ছি। নেভিলের ব্যাঙ খুঁজতে হবে। আর তোমরা জামা–কাপড় পালটে নাও আমরা শিগগিরই পৌঁছে যাব।

যে ছেলেটি ব্যাঙের খোঁজে এসেছিল তাকে নিয়ে হারমিওন বিদায় নিল।

আমি যে হাউজে থাকি না কেন আমি চাই যেন এই মেয়েটি সেখানে না থাকে। একথা বলে রন তার জাদুদণ্ড ট্রাংকে ভরল।

তোমার অন্য ভাইরা কোন হাউজে আছে? হ্যারি জানতে চাইল। গ্রিফিল্ডর হাউজ। রন জবাব দিল। রনের চেহারা একটু বিবর্ণ হলো। তবুও সে বলে চলল–বাবা ও মা এই হাউজে ছিলেন। আমি যদি এই হাউজে থাকতে না পারি তাহলে বাবা–মা কী ভাববেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। হাউজ হিসেবে ব্যাভেনক্লও খারাপ নয়। কিন্তু ভেবে দেখ, তারা যদি আমাকে স্লিদারিন হাউজে রেখে দেয়।

এই হাউজেই… ইউ নো হু ছিল।

হ্যারি ভাবছিল স্কুল ত্যাগ করার পর জাদুকররা কী করে।

রন জানাল–ড্রাগনশাস্ত্রে অধ্যয়নের জন্য চার্লি রোমানিয়া গিয়েছে এবং গ্রিংগটসের প্রস্তুতি নেবার জন্য বিল আফ্রিকায় গেছে। তুমি কি গ্রিংগটসের নাম শুনেছ? ডেইলি প্রফেটে এর ওপর অনেক লেখালেখি হয়েছে। মাগলদের কাছে সে পত্রিকাটা পাবে না। কেউ একবার ভল্ট ভেঙ্গে ডাকাতির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি।

হ্যারি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সত্যিই? এরপর কি ঘটেছিল?

কিছুই নয়, এই জন্যই তো বড় খবর হয়েছিল সেই ঘটনা। রন বলল–আমার বাবার ধারণা ওটা ছিল কোন কালো জাদুকরের কাজ। কিন্তু ওরা মনে করে না যে, কেউ সেখান থেকে কিছু নিয়ে যেতে পেরেছে। এগুলো খুবই খারাপ জিনিস। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সকলেই শঙ্কিত হয় এবং এর সাথে যদি ইউ নো হু-এর হাত পেছনে থাকে, তা হলে তো কথাই নেই। যদিও সে জেনেছে এসব জাদু জীবনের বিষয়। কিন্তু ভোলডেমর্ট নামটি তেমন তাকে অস্বস্তিতে ফেলে না বা তাকে ভয় পাইয়ে দেয় না।

কিডিচ খেলা সম্পর্কে তোমার কি কোন ধারণা আছে? রন হ্যারিকে প্রশ্ন করে।

এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই। হ্যারি জবাব দিল।

তুমি কি বললে নাম শোননি? বিস্ময়ের সাথে রন প্রশ্ন করে-এটা তো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলা।

তারপর রন কিডিচ খেলার বিভিন্ন নিয়মকানুন সম্পর্কে হ্যারিকে বলল। তারা যখন গল্প করছিল তখন তাদের কামরার দরোজা খুলে গেল। এবার কামরায় ব্যাঙ হারানো ছেলে নেভিল নয়, হারমিওন গ্রেঞ্জার। তিনটি বালক তাদের কামরায় প্রবেশ করল। হ্যারি মাঝখানে বিষণ্ন মুখের বালকটিকে মুহূর্তেই চিনতে পারল। তাকে মাদাম মালকিনের পোশাকের দোকানে দেখেছিল। ডায়াগন এলির চেয়ে এখন বেশি আগ্রহ নিয়ে সে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল।

এটা কি সত্য? ছেলেটি বলল–সবাই বলাবলি করছিল এই কামরায় হ্যারি পটার আছে। তাহলে তুমিই সেই হ্যারি পটার?

হ্যাঁ হ্যারি জবাব দিল। হ্যারি অন্য দুই ছেলের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই খুব মোটা ও তাদের দুজনকেই সংকীর্ণ মনা মনে হলো। তারা দুজনেই বিষণ্ন মুখের বালকটির দুপাশে এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল, যেন তারা ওর বডিগার্ড।

এরা দুজন হলো ক্ৰেব ও গয়েল। বিষণ্ণ মুখের ছেলেটি বলল আমার নাম ম্যালফয়–ড্রেকো ম্যালফয়।

রন কাশি দিল। ড্রেকো ম্যালফয় তার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার নামটি কি কৌতুককর মনে হয়। তুমি কে সেটা জিজ্ঞাসা করার কোন প্রয়োজন নেই। আমার বাবা আমাকে বলেছেন ওয়েসলি পরিবারের সদস্যদের মাথার চুল লাল এবং তাদের পরিবারে অনেক বেশি ছেলেমেয়ে।

সে হ্যারির দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

পটার, তুমি অল্পদিনেই বুঝতে পারবে যে কিছু জাদুকর পরিবার অন্য পরিবার থেকে ভালো। তুমি খারাপ লোকের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। আমি তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি।

হ্যারির সাথে করমর্দনের জন্য সে তার হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু হ্যারি সাড়া দিল না।

ধন্যবাদ, কে ভালো কে মন্দ সেটা আমিই বলতে পারব। শীতলভাবে সে কথাগুলি বলল।

ড্রেকো ম্যালফয়ের চেহারা লাল না হলেও তার চেহারায় একটা গোলাপী আভা দেখা গেল।

আমি যদি তুমি হতাম তাহলে আমি আরো সতর্ক থাকতাম। সে আস্তে আস্তে বলল–তুমি যদি আর একটু নম্র না হও তাহলে তোমাকেও তোমার বাবা–মার পথে যেতে হবে। তারা বুঝতে পারেনি কোন জিনিসটি তাদের জন্য কল্যাণকর ছিল। তুমি যদি ওয়েসলির মত মাস্তান আর হ্যাগ্রিডের সাথে মেলামেশা কর, তাহলে তোমার ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো যাবে না।

হ্যারি এবং রন দুজনেই দাঁড়াল। ওয়েসলির চেহারা তার চুলের মত লাল হয়ে উঠল।

রন বলল–কথাটা আবার বলতো।

তোমরা কি আমাদের সাথে মারামারি করতে চাও? ম্যালফয় ধমকের সুরে বলল।

যদি তোমরা এক্ষুণি এখান থেকে বিদেয় না হও। হ্যারি খুব কড়াভাবে বলল। একটু বেশি কড়াভাবেই। কারণ ওর সাথে অপর দুজন ক্রেবে আর গয়েল ওদের উডয়ের চেয়ে গায়ে–গতরে বড়সড় ছিল।

আমাদের এখান থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমাদের খাবার সব শেষ হয়ে গেছে এবং মনে হচ্ছে তোমাদের কাছে এখনও কিছু খাবার আছে।

রনের কাছে রাখা চকোলেট ফ্রগের দিকে গয়েল এগুল। রন লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। গয়েলকে স্পর্শ করার আগেই বিকট শব্দ করে গয়েল আর্তনাদ করে উঠল।

স্ক্যাবার্স, রনের ইঁদুরটি তার আঙুলের ডগায় ঝুলছিল। ইঁদুরটি তার ছোট ধারাল দাঁত গয়েলের আঙুলে বসিয়ে দিয়েছে। ক্রেবে আর ম্যালফয় পেছনে সরে দাঁড়াল। স্কাবার্সের কামড়ে গয়েল হাউ–মাউ করছিল। গয়েল ইঁদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত মুরাতে লাগলো। এক সময় ইঁদুরটা ছুটে গিয়ে জানালায় আঘাত করলো। এরপর তারা তিনজনই ছুটে পালালো। হতে পারে তারা ভেবেছিল ঘরে বোধহয় আরো অনেক ইঁদুর আছে। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ঘটনার এক সেকেন্ড পরই হারমিওন গ্রেঞ্জার কামরায় প্রবেশ করল।

এখানে এতক্ষণ কী ঘটলো? মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মিষ্টি দেখে হারমিওন প্রশ্ন করল। রন লেজ ধরে টেনে স্ক্যাবার্সকে হাতে তুলে নিল।

আমার মনে হচ্ছে সে আঘাত পেয়েছে। রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল। সে স্ক্যাবার্সের দিকে তাকাল। তারপর বলল–না, না–আমার বিশ্বাস হয় না… সে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

আসলে সে ঘুমিয়েই পড়েছিল।

তোমার সাথে ম্যালফয়ের এর আগে কখনও দেখা হয়েছে?

হ্যারি তাকে বলল, ডায়গন এ্যালিতে তাদের দেখা হওয়ার বিষয়।

আমি এই পরিবারের কথা শুনেছি। রন খুব গুরুগম্ভীর ভাবে বলল। ইউ-নো-হু অদৃশ্য হয়ে যাবার পর যারা আমাদের সাথে প্রথমে এসেছিলেন ওর মধ্যে ওরাও ছিল। ওরা বলেছিল ওদের ওপর জাদু করা হয়েছিল। আমার বাবা অবশ্য এ গল্প বিশ্বাস করেন না। কালো জাদুর দিকে যেতে ম্যালফয়ের বাবার অজুহাত বের করতে কোন রকম অসুবিধে হয় না।

রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বলল–আমরা কি কোনভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।

তোমাদের উচিত তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নেয়া। আমি ট্রেনের চালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন–আমরা গন্তব্যে এসে গেছি প্রায়। তোমরা তো মারামারি করছিলে এখানে, করছিলে কিনা? আমাদের সবার নামার আগে তোমরা যদি সেখানে নাম, তোমাদের বিপদ হতে পারে।

রন জবাব দিল–স্ক্যাবার্স মারামারি করেছে। আমরা করিনি। আমরা এখন পোশাক পরিবর্তন করব। তুমি কি একটু বাইরে যাবে?

হারমিওন বলল–ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। আমি এখানে এসেছি, কারণ ছোট ছেলেমেয়েদের মত এখানকার লোকজন করিডোরে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর তুমি কি জানো তোমার নাকে ময়লা লেগেছে।

রন হারমিওনের যাবার দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। মেঘলা আকাশের নিচে পাহাড় ও বন দেখা যাচ্ছে। মনে হলো ট্রেনের গতি কমে আসছে।

হ্যারি ও রন তাদের জ্যাকেট খুলে হোগার্টসের জন্য কালো পোশাক পরে নিল।

ট্রেন থেকে একটি ঘোষণা এলো–আমরা পাঁচ মিনিটের ভেতর হোগার্টস পৌঁছব। তোমাদের মালামাল ট্রেনেই রেখে দিও! মালামালগুলি পৃথকভাবে হোগার্টস স্কুলে পাঠানো হবে।

ট্রেনের গতি কমল। এক সময় ট্রেন থামল। নামার জন্য সবাই দরোজায় ভিড় করছে। প্ল্যাটফর্মে বেশ ঠাণ্ডা। হ্যারি হঠাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল প্রথম বর্ষের ছাত্র যারা তারা ডানদিকে এসো। হ্যারিও এদিকে এসো। এটা ছিল হ্যাগ্রিডের কণ্ঠস্বর।

হ্যাগ্রিড বললেন–যারা প্রথম বর্ষের ছাত্র তারা আমাকে অনুসরণ কর প্রথম বর্ষের আরও কেউ আছে? সাবধানে পা ফেলো। আমাকে অনুসরণ করো।

পা পিছলিয়ে ও হোঁচট খেতে খেতে তারা হ্যাগ্রিডকে অনুসরণ করে খাড়া ও সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে আগে বাড়ল। দুপাশেই এত অন্ধকার ছিল যে হ্যারি ভাবল এখানে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। যাবার পথে কেউ তেমন কোন কথা বলল না। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমরা সবাই প্রথম বারের মতো হোগার্টস জাদুবিদ্যায় স্কুলে এসেছে।

হঠাৎ জোরে উ–উ–উ–ধ্বনি শোনা গেল।

সংকীর্ণ পথটি যেখানে গিয়ে থামল সেখানে সামনে একটি বড় লেক।

লেকের দুপাশে পাহাড়। আকাশে তারা। কাছাকাছি কয়েকটি দুর্গ আছে বলে মনে হলো।

হ্যাগ্রিড এক সারি নৌকা দেখিয়ে বললেন একটা নৌকায় চারজনের বেশি উঠবে না।

সবাই ঠিকমতো উঠল কিনা হ্যাগ্রিড তা ভাল করে দেখে নিলেন।

অনেকগুলো ছোট ছোট নৌকা এগিয়ে যেতে থাকল। লেকের পানি স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ। সবাই চুপ করে আছে। নৌকাগুলো দুর্গের কাছাকাছি এল।

হ্যাগ্রিড চিৎকার করে বলল–তোমরা সবাই মাথা নিচু কর।

তারপর একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গ। মনে হলো দুর্গের নিচ দিয়ে নৌকা চলছে।

শেষ পর্যন্ত মাটির নিচে বন্দরের মত একটা স্থানে পৌঁছালো। সম্পূর্ণ জায়গাটাতে নুড়ি–পাথর ছড়ানো।

সবাই নৌকা থেকে নামছে কিনা হ্যাগ্রিড দাঁড়িয়ে দেখছিলো। নেভিলকে দেখে হ্যাগ্রিড জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তোমার ব্যাঙ? নেভিল ব্যাঙটা দেখে আনন্দে বলে উঠলো, ট্রেভর! ট্রেভর তার ব্যাঙটির নাম।

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে তারা ওপরে উঠতে থাকলো। পাথুরে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে ওক গাছের দরোজা। হ্যাগ্রিড বললেন, সবাই ঠিকমত এসেছে, আর তুমি তোমার ব্যাঙ পেয়েছ। তিনি তার বিশাল মুষ্টি দিয়ে দরজায় তিনবার আঘাত করলেন।

🔴 সেই হ্যাট

মুহূর্তেই দরোজা খুলে গেল। লম্বা, কালো চুলের এক মহিলা পান্নার মত সবুজ রঙের পোশাক পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চাহনি খুব কড়া। হ্যারি ভাবল, এ মহিলাকে পেরিয়ে সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।

হ্যাগ্রিড বললেন, অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, এরা প্রথম বর্ষের ছাত্র।

ধন্যবাদ হ্যাগ্রিড। আমি ওদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি।

ম্যাকগোনাগল সবাইকে হল ঘরে নিয়ে গেলেন। হল ঘরটি বিশাল। পাথরের দেয়ালে মশালের আলো। ছাঁদ অনেক উঁচুতে।

তারা সবাই অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলকে অনুসরণ করলো। পাথরের মেঝেতে নানা রকম চিত্র আঁকা। হ্যারি ডানদিকের দরোজার ওপাশ থেকে শত শত লোকের কণ্ঠ শুনতে পেল–স্কুলের বাকি অংশটুকু নিশ্চয়ই এখানে কিন্তু অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদেরকে হল ঘরের মধ্যে একটা খালি ছোট কামরায় নিয়ে গেলেন। তারা সবাই পরস্পরের গা ঘেঁষে কোনমতে সেখানে দাঁড়ালো, সাধারণত এতক্ষণ তাদের দাঁড়ানোর কথা নয়। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে।

ম্যাকগোনাগল বললেন–তোমাদের সবাইকে হোগার্টসে স্বাগত জানাচ্ছি। টার্ম শুরুর ভোজসভা শিগগিরই শুরু হবে। গ্রেট হলে আসন গ্রহণ করার আগেই তোমাদের কে কোন হাউজে যাবে তা বণ্টন করা হবে। এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হাউজটাই হবে তোমাদের পরিবার। তোমরা হাউজের ডর্মিটরিতে থাকবে। অবসর সময় কমনরুমে কাটাবে।

এখানে চারটা হাউজ আছে–গ্রিফিল্ডর, হাফলপাফ, র‍্যাভেন ক্ল ও স্লিদারিন। প্রত্যেকটা হাউজের ম্যাজিকের ইতিহাস আছে। হাউজে থাকার ব্যাপারে কিছু নিয়ম–কানুন আছে। অনিয়ম করলে পয়েন্ট কাটা যাবে। বছরের শেষে হাউজ-কাপ দেয়া হয়। যে হাউজ সবচে বেশি পয়েন্ট পাবে সে হাউজই কাপ পাবে। হাউজ কাপ পাওয়া একটা সম্মানের ব্যাপার।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্কুলের সামনে বাছাই অনুষ্ঠান হবে, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল নেভিলের জামা ও রনের নাকের দিকে লক্ষ্য করলেন। হ্যারিকে খুব নার্ভাস দেখাছিল। সে যথাসম্ভব তার চুল ঠিক করে নিলো।

তোমরা শান্তভাবে অপেক্ষা কর। আমি সময়মতো ফিরে আসবো। এই বলে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বিদায় নিলেন।

তারা কিসের ভিত্তিতে আমাদের হাউজ ভাগ করে দেবেন? রন জানতে চাইল।

আমার মনে হয় তারা কোন একটা পরীক্ষা নেবেন। ফ্রেড বলছিল এই পরীক্ষা বেশ কষ্টকর। ফ্রেড বোধহয় ঠাট্টা করেছে। হ্যারির বুক কাঁপছে। আবার পরীক্ষা দিতে হবে। কিসের পরীক্ষা!

হ্যারির বুক ভীষণভাবে কেঁপে উঠলো। পরীক্ষা? স্কুলের সবার সামনে। সে তো এখন পর্যন্ত কোন জাদু জানে না। তাকে কি করতে হবে? এই সময় যে এই ধরনের কিছু হবে, আসার আগে সে ভাবেনি।

কেউ বিশেষ কোন কথা বলছে না। শুধু হারমিওন ফিস ফিস করে নিজের জাদুর ক্ষমতার কথা বলল।

হ্যারি চারিদিকে দেখল যে প্রত্যেকের চেহারায় একটা আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠেছে।

তারপর হঠাৎ কিছু একটা ঘটলো, হ্যারি লাফ দিয়ে এক ফুট ওপরে উঠলো–তার পেছনের কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো। প্রায় বিশটা ভূত পেছনের দেয়াল থেকে স্রোতের মত আসছে। দেখতে মুক্তোর মত সাদা ও কিছুটা স্বচ্ছ। তারা একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে ভেসে বেড়ালো। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের দিকে তারা খুব একটা তাকালো না। একজন মোটা সন্ন্যাসীর মতো ভূত বলছে–ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ। আমার মনে হয় ওকে আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিত। আরেকজন বলছে—না না। তাকে অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর দেয়া যায় না।

একটা ভূত হঠাৎ করে ছাত্রদের দেখে বলল, এখানে তোমরা কী করছ?

কেউ জবাব দিল না।

মোটা সন্ন্যাসী বলল-এরা নতুন ছাত্র। একটু পরে এদের বাছাই পর্ব শুরু হবে।

কয়েকজন নীরবে সম্মতি জানাল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ফিরে এসে বললেন-এখন অন্যসব কাজ বন্ধ। এখন বাছাই পর্ব শুরু হবে।

এরপর ভূতগুলো পেছনের দেয়াল দিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

যাবার আগে একটা ভূত বলল–আশা করি, তোমাদের সাথে হাফলপাফে দেখা হবে। আমি ওই হাউজের সদস্য ছিলাম।

সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াও এবং আমাকে অনুসরণ কর। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নির্দেশ দিলেন।

পায়ে ব্যথার কারণে হ্যারি খুব দ্রুত হাঁটতে পারছিল না। তার সামনে ছিল বালু রঙের চুলের একটি ছেলে, আর তার পেছনে ছিল রন। তারা কামরা থেকে বের হয়ে হল ঘর পার হয়ে গ্রেট হলে প্রবেশ করল।

জায়গাটা খুবই মনোরম। হ্যারি এ ধরনের অপূর্ব সুন্দর জায়গা কল্পনা করতেও পারে না। চারটা লম্বা টেবিলের ওপর হাজার হাজার মোমবাতি মৃদু বাতাসে জ্বলছে। মঞ্চে একটা লম্বা টেবিল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলসহ শিক্ষকগণ এই টেবিলটাতে বসলেন। তাদের দিকে যে শত শত মুখ তাকিয়ে ছিল, তাদের দেখে মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল মোমবাতির সামনে ক্ষণপ্রভা লণ্ঠন। ছাত্রদের মাঝে দুএক ভূতকেও দেখা যাচ্ছিল। সামনের চেহারাগুলো দেখার জন্য হ্যারি ওপরে তাকাল। ওপরে সে কালো ভেলভেটের সিলিং ও তারা দেখতে পেল। হারমিওন হ্যারির কানে কানে বলল, হোগার্টস, এ হিস্টরি–বইতে আমি পড়েছি, বাইরের আকাশের মতই এটা আকর্ষণীয়। এখানে কোন ছাদ আছে এবং এই গ্রেট হলটা স্বর্গের কোন স্থান নয়। এটা একেবারেই মনে হয় না।

হ্যারি নিচে তাকিয়ে দেখলো অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটা চার–পায়া টুল তাদের সামনে রাখলেন। টুলের ওপর ছিল জাদুকরের একটা চোখা হ্যাট। হ্যাটটা খুবই পুরনো ও জরাজীর্ণ। আন্ট পেতুনিয়া হলে এটাকে কোনদিন বাড়িতে ঢুকতে দিতেন না। একটু পরে এই হ্যাটটা গান গাইতে শুরু করল। ছাত্রদের মাঝখানে এখানে সেখানে ভূত ঘোরাফেরা করছিল।

হে তুমি হয়তো ভাবনি আমিও সুন্দর 
শুধু চোখের দেখা দিয়ে করো না বিচার
যদি আমার চেয়ে চৌকস কোনো হ্যাট 
দেখাতে পারো তুমি; আমি নিজেই, 
নিজেকে গিলে খাবো। 
তুমি তোমার টুপিকে কালো রাখতে পারো 
তোমার উঁচু হ্যাট মসৃণ ও লম্বা 
কিন্তু আমার জন্যে আছে হোগার্টসের সর্টিং হ্যাট
এবং আমি সবাইকে তা পরাতে পারি 
তোমার মাথায় কিছুই নেই গোপন
সর্টিং হ্যাট দেখতে পায় না কিছু 
অতএব আমাকে পরীক্ষা করো, বলে দেবো 
কোথায় তুমি যেতে চাও? 
হতে পারো তুমি গ্রিফিল্ডরের বাসিন্দা 
যেখানে হৃদয়ে বাস করে সাহস
তাদের সাহস, স্নায়ু ও মর্যাদা 
গ্রিফিল্ডরদের করে তোলে মহীয়ান 
হতে পারো তুমি হাফলপাফের বাসিন্দা
যেখানে তারা ন্যায়বান ও অনুগত 
আর ধৈর্যশীল হাফলপাফেরা হচ্ছে সৎ 
এবং পরিশ্রমে অকাতর। 
অথবা বিজ্ঞ পুরনো র‍্যাভেন ক্লর বাসিন্দা 
যদি থেকে থাকে তোমার তৈরি মন 
যেখানে ধীমান ও শিক্ষিতেরা সহযাত্রী খুঁজে পাবে 
কিংবা হতে পারো বাসিন্দা স্লিদারিনের 
যেখানে খুঁজে পাবে তুমি প্রকৃত বন্ধুকে 
ধূর্ত লোকেরা উদ্দেশ্য হাসিল করতে 
বেছে নেয় যেকোন উপায়। 
অতএব আমাকে ভয় পেও না, করো না হৈচৈ 
(আমার কেউ না থাকলেও) তুমি রয়েছ 
ঠিক নিরাপদ হাতে, যে কারণে আমি থিংকিং ক্যাপ।

হ্যাটের গান শুনে হলভর্তি সবাই আনন্দে করতালি ও শীস দিয়ে উঠল। হ্যাট সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে চুপ হয়ে গেল।

এই হ্যাট নিয়ে কি আমাদেরকেও পরীক্ষা দিতে হবে। রন হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল।

হ্যারি খুব নিস্পৃহভাবে মুচকি হেসে বলল–জাদু শেখার চেয়ে হ্যাট নিয়ে নাড়াচাড়া করাও অনেক ভালো।

হ্যাটটাকে দেখে হ্যারি বুঝতে পারল যে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই হ্যারি হ্যাটটার কাছে যেতে সাহস পেল না।

এবার অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল পার্চমেন্টের একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।

ম্যাকগোনাগল বললেন–আমি যখন তোমাদের রোল কল করব তখন তোমরা এই হ্যাটটা পরে টুলের ওপর বসবে।

গোলাপী বর্ণের ও বাদামী চুলের একটা মেয়ে হ্যাট পরল। পরার সাথে সাথেই হ্যাটটা চিৎকার করে উঠল–হাফল পাফ।

ডানদিকের টেবিলের সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল। হান্না হালপাফের টেবিলে গিয়ে বসল। হ্যারি দেখল আগে দেখা সেই ভূতটাও আনন্দ প্রকাশ করছে।

এরপর ডাকা হল–বোনস, সুজান। 

হালপাফ আবার হ্যাটটা চিৎকার করল। সুজান হাননার পাশে বসল।

বুট, টেরি।

এবার হ্যাটটা চিৎকার করল–র‍্যাভেন ক্ল।

বাঁ দিকের দ্বিতীয় টেবিলের সবাই করতালি দিল। টেরি র‍্যাভেন ক্লর জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে বসল।

ম্যান্ডি ও ব্রকলহার্স্ট র‍্যাভেন ক্ল হাউজে গেল। তবে ল্যাভেন্ডার ব্রাউন গেল গ্রিফিল্ডর হাউজে। বাঁ দিকে দূরের টেবিলটা যেন আনন্দে বিস্ফোরিত হল। হ্যারি দেখতে পাচ্ছিল রনের যমজ দু ভাই বিদ্রূপ করে শব্দ করছে।

মিলিসেন্ট বালসট্রোড স্লিদারিন হাউজের সদস্য হয়ে গেল। হ্যারি ভাবছিল তার ভাগ্যে স্লিদারিন হাউজ পড়বে। হ্যারির মনে হলো ওদের বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তার কল্পনাও হতে পারে।

হ্যারির এখন নিজেকে অসুস্থ মনে হতে লাগলো। মনে পড়ল তার স্কুলে খেলার জন্য যখন কোন দলে তাকে বেছে নেয়া হত, সব সময় তাকে সবার শেষে বেছে নেয়া হত। সে যে খারাপ খেলতো সে কারণে নয়, তারা বরং ডাডলিকে বোঝাতে চাইতো না যে, তারা হ্যারিকে পছন্দ করে।

ফিনচ, ফ্লেচলি, জাস্টিন

তার ভাগ্যে হাফলপাফ হাউজ পড়ল।

হ্যারি লক্ষ্য করল কারো কারো নাম ডাকতে হ্যাটটার তেমন কোন সময়ই লাগছে না। অথচ কারো কারো জন্য অনেক সময় নিচ্ছে।

হ্যারির পাশে দাঁড়ানো বেলেচুলের ছেলেটি সিমাস ফিনিংগাম টুলের ওপর বসল। এবার হ্যাটটি ঘোষণা দিল–গ্রিফিল্ডর।

গ্রেঞ্জার, হারমিও।

হারমিওন দৌড়ে গিয়ে টুলে বসল। মাথায় হ্যাট লাগাল। এবার আওয়াজ এল–গ্রিফিল্ডর।

হ্যারির মনে একটি দুর্ভাবনার উদয় হলো। আসলে যখন কেউ খুব নার্ভাস থাকে তখন তার মনে নানা দুর্ভাবনা হয়। যদি তার নাম একেবারেই না ডাকা হয়!

যদি এমন হয় যে সে হ্যাট মাথায় দিয়ে টুলের ওপর বসে আছে দীর্ঘক্ষণ কিন্তু হ্যাট কোন কিছু বলছে না। যদি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যাটটা খুলে নিয়ে হ্যারিকে বলেন–নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে, তোমার আর ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। তুমি ট্রেনে ফেরত চলে যাও।

ব্যাঙ হারানো ছেলেটা নেভিল লংবটমকে যখন ডাকা হলো, টুলে যাবার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। দীর্ঘ বিরতির পর হ্যাট ঘোষণা করল গ্রিফিল্ডর। অনেক হাসি–ঠাট্টার ভেতর দিয়ে নেভিলকে ফিরে যেতে হলো।

নাম ডাকা হলে ম্যালফয় আগে বাড়ল। মাথায় হ্যাট লাগাবার সাথে সাথেই ঘোষণা এল–স্লিদারিন।

খুশি মনে ম্যালফয় তার বন্ধু ক্রেব ও গয়েলের কাছে গেল।

আর বেশি নাম ডাকতে বাকি নেই।

তারপর ডাকা হলো মুন…নট….. পার্কিনসন যমজ বোন, পাতিল ও পাতিল-এরপর পার্ক, স্যালি, অ্যানাকে। প্রায় শেষের দিকে দু একজনের আগে ডাকা হলো হ্যারি পটারকে। পটার, হ্যারি? যেই হ্যারি এগিয়ে গেল অমনি গুঞ্জন শুরু হল

পটার, তিনি কি ঠিক তা-ই বলেছেন?

হ্যারি পটার?

হ্যাট পরার আগে হ্যারি দেখলো সবাই তাকে ভাল করে দেখার জন্য উঁচু হয়ে তাকাচ্ছে। পরের মুহূর্তে সে হ্যাটের ভেতরের কালো রং দেখছে। হাম, তার কানে এল। কঠিন। খুব কঠিন। অনেক সাহস। মনটাও খারাপ নয়। প্রতিভাও আছে–কিছু করার আগ্রহও আছে।

হ্যারি টুলের কোণা শক্ত করে ধরে উচ্চারণ করল–না, স্লিদারিন নয়….. স্লিদারিন নয়।

স্বরটি তাকে বলল–তুমি তাহলে স্লিদারিন হাউজে যেতে চাও না। তুমি ভালো করে ভেবে দেখ। স্লিদারিন হাউজ তোমাকে সাহায্য করবে। স্লিদারিন হাউজ তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি স্লিদারিন হাউজে তুমি একেবারেই যেতে না চাও তাহলে তোমাকে গ্রিফিল্ডর হাউজে দেয়া হবে।

হ্যাটের কাছ থেকে ঘোষণা শুনে হ্যারি মাথা থেকে হ্যাটটা নামাল। তারপর ধীরে ধীরে গ্রিফিল্ডরের টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। স্লিদারিন হাউজের বদলে গ্রিফিল্ডর হাউজ পাওয়ায় হ্যারি বেশ স্বস্তি বোধ করছে।

প্রিফেক্ট পার্সি উঠে দাঁড়াল ও শক্ত হাতে হ্যারির সাথে করমর্দন করল। ওয়েসলি পরিবারের যমজ দুভাই অন্যদের সাথে চিৎকার করে উঠল। হ্যারি পটারকে আমরা পেয়েছি। হ্যারি পটারকে আমরা পেয়েছি। আগে দেখা ভূতটার উল্টো দিকে হ্যারি বসল। ভূতটি মৃদুভাবে হ্যারির কাঁধে চাপড় দিল।

হ্যারি এখন উঁচু টেবিলটা ভালভাবে দেখতে পারছে। হ্যারি হ্যাগ্রিডের কাছাকাছি বসল। হ্যাগ্রিড বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হ্যারিকে অভিনন্দন জানাল। একটি সোনার চেয়ারে বসে আছেন আলবাস ডাম্বলডোর। হ্যারি তাকে চিনতে পারল। আরো কয়েকটা মুখ হ্যারির পরিচিত যেমন অধ্যাপক কুইরেল।

হাউজ বাছাইয়ের জন্য আর মাত্র তিনজন বাকি। তারপিন, লিসা গেল র‍্যাভেন ক্ল হাউজে! তারপর রনের পালা। রনের মুখ শুকিয়ে সবুজ হয়ে গেল। ওর জন্য হ্যারি টেবিলের তলায় ফিঙ্গার ক্রস করল। হ্যাট ঘোষণা দিল–গ্রিফিল্ডর।

আনন্দে হ্যারি অন্যদের সাথে মিলে হাততালি দিল। রন হ্যারির পাশের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লো।

শাবাশ রন। চমৎকার। হ্যারির পাশে পার্সি উইসলি হর্ষধ্বনি করল। জেবনী ব্লেইজ গেল স্লিদারিন হাউজে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল রোল কলের কাগজ গুটিয়ে হ্যাট তুলে নিয়ে ঘোষণা দিলেন–বাছাই পর্ব শেষ।

হ্যারি তার স্বর্ণের থালার প্রতি দৃষ্টি দিল। সে এই প্রথম অনুভব করল যে সে খুব ক্ষুধার্ত। সে কদুর প্যাস্ট্রি তুলে নিল। আঃ কী মজা।

আলবাস ডাম্বলডোর উঠে দাঁড়ালেন। দুই হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন নবীন ছাত্রগণ। তোমাদেরকে স্বাগত জানাই। এই হোগার্টসে তোমরা স্বাগত। আমাদের খাওয়ার পর্ব শুরু হওয়ার আগে আমি চারটি শব্দ উচ্চারণ করব। সেগুলি হলো–নিটউইট! ব্লুবার! অডমেন্ট! টুইক। ধন্যবাদ।

তিনি বসে পড়লেন। সবাই করতালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করলো। হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না-এখন কী করবে।

উনি কি পাগল। হ্যারি পার্সিকে জিজ্ঞেস করল।

পার্সি বলল–কী বলছ তুমি। তিনি তো এক অসামান্য প্রতিভা। তিনি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর। একজন অসাধারণ ব্যক্তি। অবশ্য অসাধারণ ব্যক্তিরাই এক আধটু পাগল হয়। তোমাকে আলু দেব, হ্যারি।

হ্যারির খিদে পেয়েছে। সামনে খাবারের পাহাড়। খাবারে কী নেই রোস্ট, চিকেন, ল্যাম্ব চপ, সসেজ, শূকরের মাংস, আলু সেদ্ধ, পুডিং, আরো নানা রকমের সস।

ডার্সলি পরিবারে হ্যারিকে অনাহারে থাকতে হয়নি। তবে সে কখনোই পেট পুরে বা ইচ্ছেমত খেতে পায়নি। তার পছন্দের খাবার তার কাছ থেকে সব সময় ডাডলি কেড়ে নিত। এই মুহূর্তে হ্যারির খুব খিদে পেয়েছে। সে একটা প্লেটে সব খাবারই অল্প অল্প করে নিয়ে খেতে শুরু করলো। পাশ থেকে ভূত তাকে লক্ষ্য করছিল।

ভূতটা বলল-এগুলো খুব সুস্বাদু খাবার।

তুমি খাবে না। হ্যারি ভূতকে বলল।

আমি প্রায় চারশ বছর কিছুই খাইনি। ভূতটি জবাব দিল। আমার এখন খাবার প্রয়োজন নেই। তবে সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? আমি তো এখনও আমার পরিচয় দিইনি। আমার নাম স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি পর্পিংটন। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের আবাসিক ভূত।

আমি তোমাকে চিনি। হঠাৎ করে রন বলে উঠল–আমার ভাই তোমার কথা বলেছে, তুমি তো মুণ্ডহীন গলা।

আমাকে স্যার নিকোলাস দ্য মিমসি বলে ডাকলে আমি খুশি হব। ভূত বলল।

মুণ্ডহীন? কীভাবে তুমি মুণ্ডহীন হলে? বেলেচুলের সিম্মাস ফিননিগান জিজ্ঞেস করলো।

ভূতটাকে খুব বিব্রত মনে হলো। কারণ প্রশ্নটা তার পছন্দ হয়নি।

এভাবেই–সে রেগে বলল। সে তার বাম কান টান দিয়ে পুরো মাখাঁটি নিচে নামিয়ে ঘাড়ের সাথে ঝুলিয়ে রাখল। মনে হলো কেউ যেন তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিকোলাস কিছুক্ষণ পর তার মাথাকে ঘাড়ের সাথে সংযুক্ত করল। একটু কেশে বলল–গ্রিফিন্ডারের নবীন ছাত্ররা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ব্যাপারে তোমরা আমাদের সাহায্য করবে

হ্যারি এবার স্লিদারিন টেবিলের দিকে তাকাল সেখানেও একটা ভূত বসে আছে। ভয়ঙ্কর চেহারা। সারা পোশাকে রূপালী রক্ত।

ওর জামায় রক্ত কেন?–সিমাস জিজ্ঞেস করলো।

প্রায় মুণ্ডহীন ভূতটা বলল–আমি তো তাকে জিজ্ঞেস করিনি।

সবাই পেট পুরে খেল তারপর অবশিষ্ট খাদ্য প্লেট থেকে উধাও হয়ে গেল। প্লেটগুলো আবার ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরেই টেবিলে পুডিং দেখা গেল। সব ধরনের ও সব স্বাদের আইসক্রিম ও উপস্থিত। তারপর এল আপেল, পাই, চকোলেট, জেলি, বাদাম, স্ট্রবেরি, চালের পুডিং…. যখন একটা খাবার নেবার জন্য হ্যারি হাত বাড়াল তখন তাদের পরিবারের বিষয়ে কথা উঠল।

এরপর চললো নানা বিষয়ে কথাবার্তা। মাগল পরিবারের সব দুষ্কর্মের কথা। নেভিল এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দিল। হ্যারির ঘুম পাচ্ছে। সে উঁচু টেবিলের দিকে তাকাল। অধ্যাপক মাকগোনাগল ডাম্বলডোরের সাথে কথা বলছেন। অধ্যাপক কুইরেলের মাথায় একটা অদ্ভুত পাগড়ি। অধ্যাপক কুইরেল কথা বলছেন চকচকে কালো চুলের এক শিক্ষকের সাথে। শিক্ষকটার লম্বা বাঁকানো নাক ও গায়ের রঙটা হলুদাভ। হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটলো। বাঁকানো নাক শিক্ষকটা কুইরেলের পাগড়ির পেছন থেকে হ্যারির চোখাচুখি হলেন–তিনি হ্যারির কপালের দিকে তাকালেন। সাথে সাথেই হ্যারি তার কপালের দাগে তীব্র ব্যথা ও গরম অনুভব করতে লাগল।

আ…. উ….

পার্সি প্রশ্ন করল–কি ব্যাপার, তোমার কী হয়েছে?

না–কিছুনা হ্যারি জবাব দিল।

ব্যথাটা যত তাড়াতাড়ি এসেছিল, ঠিক তত তাড়াতাড়ি চলে গেল।

অধ্যাপক কুইরেল যে শিক্ষকের সাথে কথা বলছেন তিনি কে? হ্যারি পার্সিকে প্রশ্ন করে।

ওহ, তুমি তাহলে অধ্যাপক কুইরেলকে আগে থেকেই চেনো? পার্সি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

পার্সি বলে চলল–তিনি প্রফেসর স্নেইপ, তিনি তরল পানীয় ও ওষুধ বিষয়ে পড়ান।

অবশেষে পুডিংও অদৃশ্য হয়ে গেল। অধ্যাপক ডাম্বলডোর আবার দাঁড়ালেন। হলরুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা। তিনি বললেন–তোমাদের কাছে আমার কিছু বলার আছে। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জানানো যাচ্ছে যে মাঠের জঙ্গলে যাওয়া তোমাদের নিষেধ। সিনিয়র ছাত্ররাও একথাটি মনে রাখলে ভালো করবে।

ডাম্বলডোরের দৃষ্টি হঠাৎ করে উইসলি যমজ ভাইদের ওপর পড়ল।

তিনি বললেন–আমাদের কেয়ারটেকার মি. ফিলচ একটা সংবাদ তোমাকে জানাবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। দু ক্লাসের মাঝখানের বিরতিতে করিডোরে জাদুবিদ্যার কোন অনুশীলন চলবে না। টার্মের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিভিচ খেলার অনুশীলন হবে। যারা এ খেলায় অংশগ্রহণ করতে চায় তারা তাদের হাউজের মাধ্যমে মাদাম হুচের সাথে যোগাযোগ করবে।

তোমাদেরকে আরেকটি কথাও আমাকে জানাতে হচ্ছে, চতুর্থতলার ডানদিকের করিডোরটি তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে তাদের পরিণাম হবে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।

হ্যারি হাসল, কিন্তু তার সাথে আর কেউ হাসল না।

তিনি আসলে সত্যি কথা বলছেন না, ভয় দেখাচ্ছেন। হ্যারি পার্সিকে বলল।

তিনি সত্যি কথাই বলে থাকেন। পার্সি জবাব দিল–তিনি যখনই কোন কিছু আমাদের নিষেধ করেন তার কারণও জানিয়ে দেন। সবাই জানে বনে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। আমি মনে করি তিনি এ তথ্যটি প্রিফেক্টদের জানাতে পারতেন।

ডাম্বলডোর এবার তার জাদুদণ্ডে মোচড় দিলেন। একটি সোনালী রিন উড়ে গেল। টেবিলের ওপর সাপের মত উড়তে উড়তে সে কতগুলো শব্দ লিখে ফেলল–

হোগার্টস হোগার্টস হোগি ওয়ার্টি হোগার্টস 
দয়া করে আমাদের কিছু শেখাও 
আমরা বুড়ো বা টেকো মাথা হই 
কিংবা ইস্পাত দৃঢ় হাঁটুর তরুণ
আমাদের মাথায় আছে কিছু কৌতূহলী জিনিস 
এখন সেগুলো খালি, বাতাসভরা 
কিছু মরা মাছি, কিছু পেজা তুলা 
মূল্যবান কিছু আমাদের শেখাও 
মনে করিয়ে দাও, যা আমরা ভুলে গেছি 
যা উত্তম তাই তুমি করো
বাকিটা আমাদের জন্যে রেখে দাও 
এবং মাথার ঘিলু পচে না যাওয়া তক 
আমরা শিখতে থাকবো।

সবাই বার বার এ গান গাইতে লাগল। শেষ দিকটা যেন শব যাত্রার সঙ্গীতের মত। ডাম্বলডোর জাদুদণ্ড ঘোরালেন। আবার হর্ষধ্বনি।

তিনি বললেন-এখন শোবার সময়। তোমরা ঘুমোতে যাও।

সবাই গ্রেট হলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। হ্যারি খুব ক্লান্ত। সে খুব বেশি খেয়েছে। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। তাই চারপাশের কথা তার কানে আসছে না। সিঁড়ির দুপাশে বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ছে না। এর পর কিছু বেলুন উড়ল। কিছু হাঁটার ছড়ি আকাশে উড়ল। ব্যারনের কথা শোনা গেল। করিডোরের শেষে একটা মোটা মহিলার ছবি দেখা গেল। গোলাপী রঙের পোশাক। ছবিটা বলল–তোমার পাসওয়ার্ড জানাও।

পার্সি বলল–ক্যাপুট ড্রাকোনিস।

সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা এগিয়ে গেলে দেখা গেল দেয়ালে একটা গোল ছিদ্র।

ওরা ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ল। আর এটাই নাকি কমনরুম। বাঃ বেশ আরামের। বেশ কয়েকটা আরাম চেয়ার রয়েছে।

পার্সি মেয়েদের ডর্মিটরি যাবার দরোজাটা দেখিয়ে দিল। ছেলেদের দরোজা পৃথক। একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে তারা ওপরে উঠল। সুন্দর শোবার ঘর। লাল ভেলভেটের পর্দা। কয়েকটা পোস্টার ঝুলছে। শোবার পাজামা পরে তারা বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

হ্যারি একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। তাই সে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগল। স্বপ্নে দেখল, সে অধ্যাপক কুইরেলের পাগড়ি পরেছে এবং পাগড়ি তার সাথে কথা বলছে, তাকে বলছে সে যেন এক্ষুণি স্লিারিনে বদলি হয়, কারণ এটাই তার নিয়তি। হ্যারি পাগড়িকে বলল, সে শ্লিদারিনে বদলি হতে চায় না। পাগড়িটা ক্রমশই ভারি হয়ে উঠছে, সে ওটা খুলে ফেলতে চাইলো, কিন্তু সেটা খুব শক্ত হয়ে আঁকড়ে আছে। ব্যথাও দিচ্ছে তাকে। তার সাথে কথা বলছে। ম্যালফয় হাসছে। হঠাৎ এক লম্বা নাকওয়ালা শিক্ষক–ক্ষেইপ হয়ে গেল। স্নেইপ হাসছে কখনও উঁচু কখনও নিচু স্বরে তীব্র সবুজ আলোর ঝলক! হ্যারি জেগে উঠলো, সে ঘামছে ও কাঁপছে।

একটু পর হ্যারি অন্যদিকে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে ওঠার পর হ্যারি আগের স্বপ্নের সবকিছুই ভুলে গেল।

🔴 ওষুধের ওস্তাদ  

ওইদিকে তাকাও।

কোনদিকে?

লম্বা লাল চুল ছেলেটার পরের ছেলেটা।

চশমা পরা?

ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছ কি?

ওর কপালের দাগটা দেখেছ কি?

হ্যারি পরের দিন ডরমিটরি থেকে বের হলেই চারদিকে এ রকম ফিসফিস, গুঞ্জন। ক্লাসরুমের বাইরেও লোকজন পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে ওকে দেখে বা হ্যারি যখন করিডোরে হেঁটে যায় তখন লোকেরা ওকে ভাল করে দেখার জন্য দ্বিতীয়বার ফিরে আসে। এসব হ্যারির ভালো লাগে না। হ্যারি লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে চায়।

হোগার্টসে একশ চল্লিশটা সিঁড়ি আছে–কোনটা চওড়া, কোনটা খাড়া, কোনটা সরু, কোনটা অস্থায়ী কাঠের। কিছু সিঁড়ি শুক্রবার দিন অন্য স্থানে নিয়ে যায়। কিছু সিঁড়ি আর মাঝপথে মাঝামাঝি গিয়ে শেষ হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন এগুলো পার হতে হবে লাফ দিয়ে। কিছু দরোজা আছে নম্রভাবে কথা না বললে বা যথাস্থানে হালকাভাবে টোকা না দিলে খুলবে না। কিছু স্থান দরোজার মত মনে হয়, কিন্তু আসলে দরোজা নয়–শক্ত দেয়াল। এখানে কোন কিছু মনে রাখা কঠিন, কোন কিছু স্থির নয়, সব সময় স্থানের পরিবর্তন ঘটছে। মানুষের প্রতিকৃতিগুলোরও পরিবর্তন ঘটছে, এক ফ্রেমের ছবি থেকে অন্য ছবির ফ্রেমে চলে যাচ্ছে। হ্যারির ধারণা তা হলে নিশ্চয়ই অস্ত্রাগারে রাখা কোটগুলোও নিশ্চয়ই হেঁটে বেড়ায়।

ভূতেরাও কোন রকম সাহায্য করে না। কেউ কোন দরোজা খুলে কোথাও যাবে, হঠাৎ করে অপরদিক থেকে ভূতেরা সেই দরোজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চমকে দেয়। এদের মধ্যে মুণ্ডুহীন নিক ব্যতিক্রম, খুশি মনে পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু পিভস তার চিরাচরিত অভ্যাস মত আড়ালে থেকে কিছু ফেলে তার উপস্থিতি জাহির করে, কেউ যদি ক্লাসে যেতে দেরি করে ফেলে তাকে দুটো তালাবদ্ধ দরজা ও গোলমেলে সিঁড়ি পার হতে যেটুকু সময় লাগে তার চেয়ে বেশি দেরি করিয়ে দেবে ক্লাসে যেতে। সে কারো মাথায় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট ফেলবে, পায়ের তলা থেকে কম্বল টেনে নেবে, চক ছুঁড়ে মারবে, চমকে দেয়ার জন্য দেখা না দিয়ে কারো পেছনে এসে দাঁড়াবে, পেছন থেকে নাক চেপে ধরে বলবে, কেমন লাগছে এখন।

পিভসের চেয়ে আরো বেশি খারাপ হলো কেয়ারটেকার আরগুস ফিলচ। প্রথম দিন সকালে হ্যারি ও রন ওর ধারে–কাছে না গিয়ে ভিন্ন পথে গেল। তারা দুর্ভাগ্যক্রমে ভুল করে তৃতীয় তলার নিষিদ্ধ করিডোরের প্রবেশ পথ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফিলচের বিশ্বাসই হয়নি যে ওরা পদ্ধ হারিয়ে ওই পথে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে ভাবল ওরা ইচ্ছে করেই এটা করছে এবং এখানে তাদের আটকে রাখার ভয় দেখাল।

প্রফেসর কুইরেল সে সময় যদি ওই পথ দিয়ে না যেতেন তা হলে নিশ্চয়ই তাদের ফিলচের হাতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো।

ফিলচের একটা বিড়াল ছিল। বিড়ালটার নাম মিসেস নরিস। ধূলো রঙের গোঁফধারী বিড়ালটা ছিল অনেকটা মনিব ফিচের মত। বিড়ালটা যেন এখানকার নিয়মরক্ষক। একটু এদিক–ওদিক হলেই বিড়ালটা ফিলচকে ডেকে আনে। যারা ভুল করে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হয়। সকলে তাকে এত ঘৃণা করে যে সুযোগ পেলেই নরিসকে লাথি লাগায়।

বুধবার মাঝ রাতে দুরবী এর সাহায্যে নানা গ্রহ–নক্ষত্রের আসা–যাওয়া দেখানো হলো। অধ্যাপক স্পাউট সপ্তাহে তিনবার অদ্ভুত সব উদ্ভিদের কিভাবে যত্ন নিতে হয় তা পড়াতেন।

সবচে বিরক্তিকর ক্লাস ছিল জাদুর ইতিহাস। এটাই একমাত্র ক্লাস যা নিতেন এক ভূত–শিক্ষক। বৃদ্ধ প্রফেসর বিনস শিক্ষকদের স্টাফ রুমের ফায়ার স্পেস-এর সামনে অনেক সময় ঘুমিয়ে পড়তেন আবার পরদিন সকালে তার শরীরটা সেখানে রেখেই ক্লাস নিতে চলে যেতেন।

অধ্যাপক ফ্লিটউহক ছিলেন বশীকরণ বিদ্যার শিক্ষক। তিনি ক্লাসে অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে মনোমুগ্ধকর গল্প শোনাতেন। আকারে ছোটখাটো, একগাদা বই এর ওপর দাঁড়িয়ে তাকে টেবিল থেকে উঁচু হতে হতো। হাজিরা খাতায় হ্যারির নাম ডাকতে গিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে নিজেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন তিনি।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটু অন্য ধরনের। মেজাজ কড়া হলেও তিনি মানুষ হিসেবে ভালো। ছাত্ররা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। তিনি বলেন যে শরীর বদল অথবা অন্যরূপ ধারণ করা সবচে জটিল জাদুবিদ্যা।

তিনি আরও বলতেন, আমার ক্লাসে কোন উল্টা–পাল্টা করবে না। করলে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আর ফিরে আসতে পারবে না।

একটু পরে তিনি তার টেবিলটাকে বাচ্চা শূকরে রূপান্তরিত করলেন। কিছুক্ষণ পর আবার তা টেবিল হয়ে গেল। সকল আসবাবপত্রই মাঝে মাঝে একদল পণ্ড হয়ে যায়। একদিন ছাত্রদের দেশলাই দিয়ে বলা হল–কাঠিকে সূচ বানাও। একমাত্র হারমিওন গ্রেঞ্জারই সফল হয়। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ওদের দেখালেন কিভাবে কাঠিটি ধাতব পদার্থে পরিণত হলো এবং সূচালো হলো।

যে ক্লাসটা তাদের সবচে ভালো লাগতো সেটা ছিল কালো জাদু টোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। মাঝে মাঝে হাসি–ঠাট্টা হয়। সারা ক্লাসে রসুনের গন্ধ। রোমানিয়া থেকে রক্তচোষা এসেছে এবং তার পাগড়ির ভেতর থেকে এই গন্ধ আসে। পাগড়ির ভেতরের রসুন নাকি অধ্যাপক কুইরেলকে নানা রকম বিপদ–আপদ থেকে রক্ষা করে। তাকে এই পাগড়িটা দিয়েছে আফ্রিকার কোন এক রাজপুত্র।

হ্যারি এই ভেবে আশ্বস্ত যে সে পড়াশোনায় খুব একটা পেছনে পড়ে নেই। মাগল পরিবার থেকেও অনেক ছেলে এখানে এসেছে। তারই মত। ডাইনি জাদুকর সম্পর্কে তাদের অনেকেরই সামান্যতম ধারণা নেই। এমন কি রনের মাথাতেও অনেক কিছু আসে না।

শুক্রবার দিনটা কারি ও রনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওইদিন তারা সঠিক পথে গ্রেট হলে এসে নাশতা করত।

পিরিজে চিনি ঢালতে ঢালতে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল–আজ আমাদের কি কাজ?

স্লিদারিনদের সাথে দ্বিগুণ ওষুধের উপাদান মেশানো রন বলল। গেইপ ছিলেন স্লিদারিন হাউজের প্রধান। সবাই বলে তিনি নাকি তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেন। আমরা দেখবো এটা সত্যি কিনা।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল যদি আমাদের পক্ষে থাকতেন। হ্যারি বলল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ছিলেন গ্রিফিল্ডর হাউজের প্রধান। তা সত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের গাদাগাদা হোমটাস্ক দিতে কার্পণ্য করতেন না।

ডাক আসার সময় একশ পেঁচাকে গ্রেট হলে প্রবেশ করতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের মালিকদের খুঁজে নিয়ে চিঠি বিলি করলো। কিছু কিছু পারসেল ছিল।

হেডউইগ এ পর্যন্ত হ্যারির জন্য কোন চিঠি আনেনি। হেডউইগ খুবই অলস। তবে চিঠি আসলে সে নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। তার কাজ একটিই, সেটা হলো ঘুমোবার আগে তার কানের লতি ছুঁয়ে আদর করা ও শুভরাত্রি বলে পেঁচাঁদের থাকার জায়গায় যাওয়া।

অবাক কাণ্ড। আজ সকালে হেডউইগ হ্যারির জন্য একটা চিঠি টেবিলে রাখল। হ্যারি বিস্মিত হয়ে ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে। চিঠিতে লেখা আছে–

প্রিয় হ্যারি, 
আমি জানি, তুমি প্রতি শুক্রবার বিকেলে বাইরে যাও। তুমি কি বিকেল তিনটায় আমার সাথে এক কাপ চা পান করতে আসতে পারো? আমি জানতে চাই ডর্মিটরিতে তোমার প্রথম সপ্তাহ কেমন কাটল? অপর পৃষ্ঠায় জবাব লিখে হেডউইগ মারফত পাঠিয়ে দিও। 
ইতি
হ্যাগ্রিড

হ্যারি রনের কাছ থেকে পালকের কলম নিয়ে লিখল–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেখা হবে। সে চিঠিটি হেডউইগের কাছে দিল। হেডউইগ চিঠি নিয়ে শো করে উড়ে চলে গেল।

হ্যারিও হ্যাগ্রিডের সাথে দেখা করার জন্য উৎসুক ছিল। কারণ ওষুধ তৈরির উপকরণের ক্লাস হ্যারির সবচে বিরক্তিকর মনে হত। কোর্সের প্রথম দিকেই হ্যারি বুঝতে পেরেছিল যে, স্নেইপ তাকে অপছন্দ করেন না শুধু, মৃণাও করেন।

ওষুধ ডোজের ক্লাসগুলো হতো নিচে বন্দিশালার মত একটা কক্ষে। এই কক্ষটা অনেক বেশি ঠাণ্ডা ছিল। শেইপ হাজিরা খাতা নিয়ে নাম ডেকে ক্লাস শুরু করতেন। তিনি জারি পটারের নাম এভাবে ডাকলেন–হ্যারি পটার… আমাদের নতুন বিখ্যাত ব্যক্তি।

হ্যারির অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে ম্যালফয় ক্রেব ও গয়েল খুব আনন্দ পেত। নামডাকা শেষ হলে স্নেইপ ক্লাসের দিকে তাকালেন।

তার চোখও হ্যাগ্রিডের চোখের মত কালো। কিন্তু সে চোখে হ্যাগ্রিডের চোখের উষ্ণতা নেই। তার চোখ দুটি শীতল ও শূন্য। তার চোখ দেখলে গভীর সুড়ঙ্গের কথা মনে পড়ে। স্নেইপের ক্লাস ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনত। এজন্য ক্লাসে কোন গোলমালও হত না। তিনি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তার ক্লাসকে প্রাণবন্ত রাখতে পারতেন।

হ্যারি পটারকে স্নেইপ হঠাৎ করে প্রশ্ন করে বসলেন–আচ্ছা হ্যারি বল তো–আমরা যদি অ্যাসফোডেল পাউডারের রুটের সাথে তিক্ত গুল্মরস মিশিয়ে দিই তাহলে আমরা কী পাব?

হ্যারি বলল–আমি ঠিক বলতে পারব না। স্নেইপ হ্যারিকে কটাক্ষ করে বললেন–তু, তু–খ্যাতিই সবকিছু নয়।

হারমিওন হাত তুললেও তিনি সেদিকে নজর দিলেন না।

স্নেইপ এবার বললেন–আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যাক। আমি যদি বলি আমাকে একটা বিজোয়ার দেখাও তাহলে তুমি কি করবে? হারমিওন হাত তুলল। বিজোয়ার সম্পর্কে হ্যারির বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

হ্যারি জবাব দিল–আমি জানি না স্যার।

ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল হাসল। হ্যারি নিশ্চিত ম্যালফয়, ক্রেব বা গয়েল–ওদের কারোরই ওই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।

স্নেইপ মন্তব্য করলেন–পটার আমার মনে হয়, তুমি ক্লাসে আসার আগে বই খুলে দেখনি।

হ্যারি স্নেইপের চোখের দিকে তাকাল। তারপর মনে মনে বলল ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকার সময়ও আমি বইপত্র দেখেছি। অধ্যাপক স্নেইপ কি মনে করেন যে One Thousand Magical Herbs and Fungi–র সবকিছুই আমার মুখস্থ থাকবে।

হারমিওন আবার হাত তুললেও স্নেইপ সেদিকে মনোযোগ দিলেন না।

এভাবে আরো প্রশ্ন করে স্নেইপ হ্যারিকে বিব্রত করলেন। অবশেষে অধ্যাপক স্নেইপের ক্লাস শেষ হল। হ্যারি পটারের মন এমনিতেই ভালো ছিল না, কারণ সেসনের প্রথম সপ্তাহেই গ্রিফিল্ডর হাউজের দু নম্বর কাটা গেল। আর হ্যারি গ্রিফিল্ডর হাউজের সদস্য। পাঁচটা বাজার তিন মিনিট আগে তারা গ্রিডের ঘরের দিকে রওনা হলো। নিষিদ্ধ বনের পাশে একটা কাঠের বাড়ি ছিল। দেখতে কুঁড়েঘরের মত। সেটাই হ্যাগ্রিডের আবাসস্থল।

তারা যখন দরোজায় করাঘাত করল তখন ভেতর থেকে ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা গেল। একটু পর শোনা গেল হ্যাগ্রিডের কণ্ঠস্বর ব্যাক ক্যাগে, ব্যাক।

দরোজার ফাঁক দিয়ে হ্যাগ্রিডের বিরাটকায় চুলভর্তি মুখ দেখা গেল। দরজা খুলতে খুলতে হ্যারি ও রনকে দেখে হ্যাগ্রিড বলল–দাঁড়াও।

হ্যাগ্রিড একটা বিরাট কালো বোর হাউন্ড কুকুরের শিকল ধরে রেখে ওদের ভেতরে ঢুকতে বললেন।

ভেতরে একটামাত্র ঘর। এক কোণায় বিছানা। আমার কেতলিতে পানি ফুটে ধোয়া বেরুচ্ছে। কুকুরটার নাম ফ্যাংগ।

কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে হ্যাগ্রিড হ্যারি ও রনকে বললেন–আরাম করে বসো। ফ্যাংগকে যত হিংস্র মনে হয় আসলে সে তত হিংস্র নয়।

হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-এই হচ্ছে রন।

হ্যাগ্রিড তখন সেদ্ধ পানি একটা বড় টি-পটে-ঢালছিলেন এবং প্লেটে রক কেক সাজাচ্ছিলেন।

রক কেকে কামড় দিতে গিয়ে তাদের অবস্থা কাহিল। তবে হ্যারি আর রন এমন ভাব দেখাল যে তারা বেশ মজা করে রক কেক খাচ্ছে। তারা তাদের লেখাপড়া সম্পর্কে হ্যাগ্রিডকে জালাল। ফ্যাংগ হ্যারির হাটুর ওপর যাথা রেখে হ্যারির কাপড় শুকতে লাগল।

কথা প্রসঙ্গে ফিলচের কথা আসলো। হ্যারিরাই আসলে তার বিষয়ে কথাটা বলল। হ্যাগ্রিড ফিলচকে বোকা বৃদ্ধ বলায় হ্যারি আর রন উডয়েই খুশি হলো।

ফিলচের বিড়াল নরিস সম্পর্কে হাহ্যাগ্রিড বললেন–আমার কুকুর ফ্যাংগের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেব। শুধু তোমাদের কেন ওর বিড়ালটা আমাকেও অনুসরণ করে। ফিলচ–ই তাকে এই কাজে লাগিয়েছে।

হ্যারি হ্যাগ্রিডকে জানাল যে অধ্যাপক স্নেইপ তাকে ঘৃণা করেন। রন বলল–দুঃখ করে লাভ নেই। অধ্যাপক স্নেইপ কাউকেই পছন্দ করেন না।

বাজে কথা। হ্যাগ্রিড মন্তব্য করেন সে তোমাকে ঘৃণা করবে কেন?

হ্যারির কাছে মনে হলো হ্যাগ্রিড তার কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

রনের দিকে তাকিয়ে হ্যাগ্রিন্ড বললেন–তোমার ভাই চার্লি কেমন আছে। তাকে আমার খুব ভালো লাগে।

এরপর হ্যাগ্রিড রনের সাথে তাদের পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ করলেন। হ্যারির টেবিল থাকা ডেইলি প্রফেট পত্রিকার একটা কাটিং চোখে পড়ল :

গ্রিংগটস–সর্বশেষ বার্তা

গ্রিংগটসে ডাকাতির বিষয়টি নিয়ে ৩১শে জুলাই থেকে তদন্ত চলছে। মনে করা হচ্ছে এটি কালো জাদুকর ও ডাইনিদের কাজ। 
গ্রিংগটসের গবলিনরা দাবি করছে সেখান থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। ভল্টগুলো এইদিনই খালি করা হয়েছিল। 
কিন্তু সেখানে কি ছিল এ ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারব না। তোমাদের মঙ্গলের জন্য এ ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো–গবলিনদের একজন মুখপাত্র জানান।

হ্যারির মনে পড়ল–ট্রেনে তাকে রন বলেছিল যে গ্রিংগটসে ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কোন তারিখে হয়েছিল-এটা সে উল্লেখ করতে পারেনি। হ্যাগ্রিডকে হ্যারি বলল যেদিন গ্রিংগটসে ডাকাতি হয় সেদিনটা ছিল আমার জন্মদিন। আমরা যখন সেখানে ছিলাম হয়ত তখনই ঘটনাটা ঘটে। হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি তুমি ঠিকই বলেছ। এই বলে হ্যাগ্রিড আরেকটা রক কেক হ্যারির দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

হ্যারি পত্রিকার কাটিংটা আরেকবার পড়ল। ভল্টটা ওইদিনই খালি করা হয়েছিল যেদিন গ্রিগেটস থেকে হ্যারির জন্য টাকা তোলা হয়। হ্যারি আর রন যখন রাতের খাবার জন্য দুর্গে আসছিল তখন তাদের পকেট ছিল হ্যাগ্রিডের দেওয়া বক কেকে ভর্তি। তারা হ্যাগ্রিডকে না বলতে পারেনি।

হ্যারির মনে হলো এতদিনে লেখাপড়ায় যতটুকু এগুনো দরকার ছিল ততটুকু সে পারেনি। তার এটাও মনে হলো সেই সম্পর্কে হ্যাগ্রিড অনেক কিছু জানেন কিন্তু তাকে কিছু বলেননি।




চতুর্থ  পর্ব 

হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং

🔴 মধ্যরাতের মল্লযুদ্ধ

হ্যারি কখনো ভাবতে পারেনি যে, ডাডলির চেয়েও কোন খারাপ ছেলের সাথে তার দেখা হবে। কিন্তু তাই হলো। ছেলেটির নাম ম্যালফয়। গ্রিফিল্ডর ও স্লিদারিন হাউজের প্রথম বর্ষের ছাত্ররা শুধুমাত্র ওষুধ তৈরির ক্লাস করতেই এক সাথে মিলিত হতো।

ওই ক্লাস ছাড়া অন্য কোন ক্লাসে ম্যালফয়ের সাথে দেখা হতো না। বৃহস্পতিবার থেকে ফ্লাইং শেখানো হবে। গ্রিফিল্ডর ও স্লিদারিন হাউজের ছাত্রদেরকে একসাথে ওড়া শেখানো হবে জেনে হ্যারি আক্ষেপ করে বলল ম্যালফয়ের সামনে আমাকে ঝাড়ু লাঠির ওপর বোকা বানাবার জন্যই এটা করা হয়েছে।

উড়তে শেখার অনুশীলন নিয়ে হ্যারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

রন বলল–তুমি এখনই সব কিছু বলতে পার না, ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা দেখে নিজেই হয়তো অবাক হবে। ম্যালফয় দেখাতে চায় যে, কিডিচ খেলায় সে কতখানি দক্ষ। আসলে সে যতটা বলে ততটা সে নয়।

ম্যালফয় ওড়ার বিষয়ে তার দক্ষতা নিয়ে অনেক কথা বলত। সে এটাও জোর দিয়ে বলত যে, প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে হাউজ টিমে কিডিট খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয় না। সে নিজের সম্পর্কে গল্প করতো, কীভাবে খাগলরা তার কাছ থেকে অল্পের জন্য হেলিকপ্টারে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। তার গল্পের শেষটা সব সময় এই রকমই হয়–অল্পের জন্য…।

শুধু ম্যালফয়ই নয়। সিমাস ফিনিগানও এ ধরনের বাড়িয়ে কথা বলত। সে দাবি করত যে ছোটবেলায় ঝাড়ুর সওয়ার হয়ে সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত। এমন কী রনও দাবি করত যে, সে উড়তে গিয়ে তার ভাই চার্লির ঝাড়ুর সাথে প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল। জাদুকর পরিবার থেকে যারা এসেছে তারা প্রায় সবাই কিভিচ খেলার ব্যাপারে আলোচনা করত।

এ নিয়ে ডীন টমাসের সাথে রনের তর্ক হয়ে গেছে। বিতর্কের বিষয় ছিল ফুটবল। রন বুঝে উঠতে পারে না কেবল একটি বল নিয়ে খেলায় কীভাবে এত আনন্দের হতে পারে, যেখানে ওড়ার কোন সুযোগ নেই।

নেভিল কখনও ঝাড়ুর ওপর সওয়ার হয়নি কারণ ওর নানী কখনো ওকে ওটার ধারে কাছে যেতে দেয়নি। কারণ, সে ইতোমধ্যে মাটিতেই খেলতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। নেভিলের মত ওড়ার ব্যাপারে হারমিওন-এরও সাহস কম, এটা এমন একটা জিনিস যা বই পড়ে শেখা যায় না।

বৃহস্পতিবার সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় হারমিওন লাইব্রেরি থেকে সগ্রহ করা কিডিচ থ্রু এইজেস বই থেকে জানা ওড়ার বিষয়ে নানা জ্ঞান দেওয়া শুরু করে। নেভিল তার পেছন থেকে হারমিওনের দিকে ঝুঁকে গভীর আগ্রহে তার কথা শোনে। অন্যদের শোনার কোন আগ্রহ ছিল না। বরং ডার্ক চলে আসার পর তার বক্তৃতা থেকে সবাই যেন রেহাই পায়।

হ্যাগ্রিডের সাথে সাক্ষাতের পর হ্যারির নামে কোন চিঠি আসেনি-এটা ম্যালফয় লক্ষ্য করেছে। এসব বিষয় সে খেয়াল করে বেশি। ম্যালফয়ের ঈগলপেঁচা তার জন্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে। ম্যালফয় ঝাঁপিয়ে পড়ে তা স্লিদারিন হাউজের টেবিলের ওপর খোলে। একটি পেঁচা নেভিলের নানীর বাড়ি থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো।

সে উত্তেজনায় দ্রুত প্যাকেটটি খুলল। এটা ছিল মার্বেল আকারের একটা কাঁচ। মনে হলো কাঁচের ভেতর ধুয়া।

এটা একটা স্মারক। সে ব্যাখ্যা করল। আমার নানী জানেন যে আমি অনেক কিছুই ভুলে যাই। তুমি যদি কিছু ভুলে যাও এই কাঁচটা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে। শক্ত করে ধরে এটার দিকে তাকিয়ে থাক। এটা যদি লাল হয়ে যায় তাহলে তুমি বুঝবে তুমি হয়ত কিছু ভুলে গেছ। স্মারকটা হঠাৎ লাল হয়ে উঠল, এর অর্থ আমি নিশ্চয়ই কিছু ভুলে গেছি।

নেভিল ভাবতে লাগলো এমন কিছু কি আছে যা সে ভুলে গেছে। সে সময় ম্যালফয় তার গ্রিফিল্ডর হাউজের টেবিলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে নেভিলের হাত থেকে স্মারকটা ছিনিয়ে নিল। হ্যারি আর রন লাফ দিয়ে ম্যালফয়ের ওপর চড়াও হলো। তারা ভাবছিল ম্যালফয়কে একহাত দেখিয়ে দেবে। ঠিক এই সময় অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি জানতে চাইলেন–কী ব্যাপার, এখানে গণ্ডগোল কিসের?

প্রফেসর, ম্যালফয় আমার স্মারক নিয়ে নিয়েছে। ম্যালফয় তাড়াতাড়ি স্মারকটা টেবিলের ওপর রেখে দিল।

ঠাট্টা করছিলাম। এই বলে সে ক্রেব আর গয়েলকে নিয়ে সরে গেল।

***

তখন বিকেল সাড়ে তিনটা। প্রথম উড়ান শিক্ষা শুরু হবে। হ্যারি, রন ও অন্যরা মাঠে গেছে। সবুজ দুর্বাঘাস বাতাসে হেলে পড়েছে।

স্লিদারিন হাউজের ছাত্ররা ইতোমধ্যে এসে গেছে। কুড়িটা ঝাড়ু মাঠে সারি করে সাজানো। হ্যারি শুনেছে ফ্রেন্ড আর জর্জ এই ঝাড়ি নিয়ে অনেক অভিযোগ করেছে। এগুলো নাকি বেশি উপরে উঠলে কাঁপতে থাকে। আর বাঁদিকে ঘুরে যায়।

তাদের শিক্ষক মাদাম হুচ ক্লাসে প্রবেশ করলেন। তার চুল ছোট ও ধূসর রঙের। চোখ বাজপাখির চোখের মত হলুদ।

তিনি এসেই চিৎকার করে বললেন তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবাই ঝাড়ুর পাশে দাঁড়াও তাড়াতাড়ি চলে এসো।

হ্যারি তার ঝাড়ুর দিকে তাকাল। ঝাড়ুটি পুরনো এবং কিছু কাঠি বাঁকা হয়ে নড়ে গেছে।

মাদাম হুচ এবার নির্দেশ দিলেন–ডান হাত সামনের দিকে ঝাড়ুর ওপর রাখ। এবার বল–আপ।

হ্যারির ঝাড়ুটা তার হাতে লাফিয়ে উঠল। হারমিওনেরটা মাঠের ওপর গড়িয়ে পড়ল। নেভিল এক চুল পরিমাণ নড়তে পারল না। ওর হাত কাঁপছে। ওর মাথায় ভয়ের ছাপ। ও মাটি থেকে উপরে উঠতে ভয় পাচ্ছে। মাদাম হুচ দেখালেন কিভাবে ঝাড়ুর ওপর চড়তে হয়। তিনি ম্যালফয়কে ধমক দিলেন–তুমি কি সারাজীবন ভুল করবে?

এই কথাটা শুনে হ্যারি ও রন দারুণ খুশি হলো যে, ম্যালফয় সব সময়ই ভুল করছে।

মাদাম হুচ বললেন–আমি বাঁশি বাজাবার সাথে সাথে তোমরা লাফ দেবে। ঝাড়ু সোজা রাখবে। কয়েক ফুট ওঠার পর সামনের দিকে ঝুঁকবে। তারপর নিচে নেমে আসবে। তোমরা প্রস্তুত হও। আমি এখন বাঁশি বাজাচ্ছি। তিন……..দুই……..

এক বলা বাকি। নেভিল আগেই লাফ দিল। মাটি থেকে উপরে উঠার পর সে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ল। সে একটু বেশিই উপরে উঠেছে কারণ সে মাটিতে জোরে ধাক্কা দিয়েছিল।

মাদাম হুচ চিৎকার করলেন–কামব্যাক মাই বয়। কিন্তু নেভিল সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হ্যারি লক্ষ্য করল যে, নেভিলের চেহারা একেবারে ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। ঝড়ির পাশে থেকে সে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। নেভিল যখন মাটিতে পড়লো তখন ধুম করে শব্দ হলো।

নেভিলের কবজি ভেঙে গেছে। সে উপুড় হয়ে একটা ঘাসের পে শুয়ে পড়ল। তার ঝাড়ু এখনও ঊর্ধ্বমুখী। ঝাড়ুটা নিষিদ্ধ বনের দিকে যেতে যেতে এক সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। মাদাম হুচ নেভিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। দুজনেরই মুখ ফ্যাকাসে, সাদা।

হ্যারি শুনতে পেল, মাদাম হুচ বলছেন–কজি ভেঙে গেছে। কাম অন বয়। দাঁড়াও। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাদাম হুচ এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এর ভেতর তোমরা এক পাও নড়বে না। যার যার ঝাড়ু যেখানে ছিল সেখানে ঠিকমত রাখবে আর তা না করলে তোমাদের কিডিচ খেলার আগেই হোগার্টস ছেড়ে যেতে হবে।

নেভিলকে বললেন–আমার সাথে এসো।

নেভিলের দুচোখেই অশ্রু। কবজি চেপে ধরে টলতে টলতে সে আগে বাড়ল। ওরা চলে যাবার সাথে সাথেই ম্যালফয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তোমরা কি এই থল থলে মাংস পিণ্ডটির চেহারা দেখেছো?

স্লিদারিন হাউজের অন্যান্যরা নেভিলকে তামাশা করা শুরু করল। চুপ করো ম্যালফয়। পার্বতি পাতিল ধমক দিল।

লংবটমের জন্য তোমার এত দরদ? স্লিদারিন হাউজের এক কর্কশ চেহারার ছাত্রী প্যানসি পার্কিনসন বলল। পার্বতি, আমি কখনো ভাবতে পারিনি তুমি হিঁচকানে শিশুদের এত পছন্দ কর।

দেখো। মাটি থেকে একটা জিনিস উঠিয়ে ম্যালফয় বলল—

এক ফালতু জিনিস, লংবটমের নানী তাকে এটাই পাঠিয়েছে।

স্মারকটা সূর্যের আলোতে চকচক করে উঠল।

ম্যালফয়, ওটা এদিকে দাও। হ্যারি গম্ভীর কণ্ঠে ম্যালফয়কে বলল।

কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য সবাই একেবারে চুপ।

ম্যালফয় দুষ্ট হাসি হেসে বলল-এটা আমি কোথাও রাখবো, সেখান থেকে লংকটমকে নিতে হবে–গাছের ওপর হলে কেমন হয়?

ওটা এদিকে দাও। হ্যারি চিৎকার করে উঠল। ম্যালফয় তার ঝড় নিয়ে উড়তে শুরু করল। মিথ্যে বলেনি, সে ভালো উড়তে পারে। ম্যালফয় একটা ওক গাছের চূড়ায় উঠে হ্যারির উদ্দেশ্যে বলল-এসো। এখান থেকে নিয়ে যাও।

হ্যারি তার ঝাড়ুটা হাতে তুলে নিলো।

না, না। হারমিওন গ্রেঞ্জার চিৎকার করে উঠল–মাদাম হুচ বলে গিয়েছেন আমরা যেন একটুও না নড়ি। তুমি আমাদের সবাইকে বিপদে ফেলবে।

কিন্তু হ্যারি তার কথা শুনল না। মাথায় তার রক্ত চড়েছে। সে তার ঝাড়ুতে চড়ে মাটিতে ধাক্কা দিল। আর সাথে সাথে সে উড়তে লাগল। বাতাসে তার চুল উড়ছে! পোশাক উলটে যাচ্ছে। তার কাছে খুব অবাকই লাগলো। না শিখেই সে কোনো বিদ্যা রপ্ত করতে পারে। তার কাছে ওড়াটা অত্যন্ত সহজ মনে হলো। নিচে মেয়েদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। রনের উল্লাস হ্যারির দৃষ্টি এড়াল না।

হ্যারি তার ঝাড়ু ঘুরিয়ে মধ্য আকাশে ম্যালফয়ের দিকে অগ্রসর হলো। ম্যালফয় স্তম্ভিত হয়ে গেল।

এবার দাও, নইলে আমি তোমাকে ওই ঝাড়ু থেকে ফেলে দেবো। হ্যারি বলল।

এতো সহজ। ম্যালফয় বলল, কিন্তু তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। হ্যারি জানে এখন কী করতে হবে। দুহাতে নিজের ঝড় শক্ত করে ধরে হ্যারি বর্শার মত তীব্র বেগে ম্যালফয়ের দিকে ছুটল। বিপদ বুঝে ম্যালফয় সরে গেল। নিচে করতালির শব্দ শোনা গেল।

হ্যারি বলল-এখানে তো তোমার বন্ধু ক্রেব আর গয়েল নেই।

ম্যালফয়ের মনেও একই চিন্তা।

চেষ্টা করে দেখো, নিতে পারো কিনা। এই বলে ম্যালফয় কাঁচের গোলকটা শূন্যে ছুঁড়ে দিল।

হ্যারি প্রথমে ওপরে উঠল। পরে নিচে নামতে লাগল। সে ঝুঁকে ঝাড়ুর মুখ ঘুরিয়ে দিল। তার ঝাড়ু দ্রুতবেগে নিচে নামতে লাগল। হ্যারি মাটি থেকে ঠিক এক ফুট উঁচু থেকে গোলকটা ধরে ফেলল। তার মুঠোর ভেতর কাঁচের গোলকটা নিয়ে হ্যারি মাটিতে নামল।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ছুটে এসে চিৎকার করে বললেন—

হ্যারি পটার।

ম্যাকগোনাগল বললেন–তুমি কোন সাহসে এত ওপরে উঠলে। আর একটু হলেই তো ঘাড় ভেঙে যেত। তিনি রাগে কাঁপছিলেন।

এটা তার দোষ নয়…

চুপ কর, মিস পাতিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন।

কিন্তু ম্যালফয়।

আর বলতে হবে না। মি. উইসলি ও পটার এখন আমাকে অনুসরণ কর। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল আদেশ দিলেন।

হ্যারি দেখল–ম্যালফয়, ক্রেব ও গয়েল বিজয়ের হাসি হাসছে।

হ্যারি বুঝতে পারল এখন সে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি। তার মনে ভয় যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য হ্যারি কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ম্যাকগোনাগল তার কথায় কান দিলেন না। তিনি হন হন করে সামনে এগিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে তাল রাখার জন্য হ্যারিকে রীতিমত দৌড়াতে হলো। হ্যারি ভাবতে লাগল, তাকে বের করে দেয়া হলে সে কোন মুখে আবার ডার্সলি পরিবারে ফিরে যাবে।

ম্যাকগোনাগল দরোজা খুলে করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলেন। হ্যারিও উদ্বিগ্ন মনে তাকে অনুসরণ করছে। কোথায় যাচ্ছে তারা! হ্যারি ভাবল, তিনি হয়ত অধ্যাপক ডাম্বলডোরের কাছে যাবেন। হ্যারি হগ্রিডের কথা ভাবল। হ্যাগ্রিন্ডকেও তো হোগার্টস থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তবে তার গেমকিপারের চাকরিটা ছিল। হ্যাগ্রিডের সহকারী হিসেবে তাকে রেখে দেয়া যেতে পারে।

ম্যাকগোনাগল একটা ক্লাস রুমের বাইরে দাঁড়ালেন। তিনি দরোজা খুলে মুখটা ক্লাস রুমের ভেতরে গলিয়ে বললেন–অধ্যাপক ফ্লিটউইক আমাকে মাফ করবেন। আপনি কি এক মুহূর্তের জন্য উডকে দিতে পারেন।

উড কেন? হ্যারি অবাক হয়ে ভাবল–উড কি কোন বেত নাকি যা তার ওপর প্রয়োগ করা হবে।

দেখা গেল উড একজন মানুষ। সে ফিফথ ইয়ারের ছাত্র। সে কিছু না জেনেই ক্লাস থেকে বাইরে এলো। ম্যাকগোনাগল দুজনকেই বললেন তোমরা দুজনেই আমার পেছন পেছন এসো।

তারা করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। উড কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে হ্যারির দিকে তাকাল।

এখানেই বলে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তাদেরকে একটা ক্লাসরুমে নিয়ে গেলেন। ক্লাসে কেউ ছিল না। কেবল পিভিস ব্ল্যাকবোর্ডে বাজে কিছু লিখছিল। পিভিস, এখান থেকে যাও। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল কড়া নির্দেশ দিলেন। পিভিস তার চকটি ফেলে দিল। বেশ জোরে শব্দ হলো। তারপর অভিশাপ দিতে দিতে পিভিস ক্লাসরুম ত্যাগ করল। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ঠাস করে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে দুই বালকের দিকে তাকালেন।

ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন-এই হচ্ছে অলিভার উড। উড–তোমার জন্য আমি একজন পেয়েছি।

উডের মুখে ধাঁধা থেকে খুশির রেখা।

উড এবার জিজ্ঞেস করল–প্রফেসর আপনি কি সত্যিই বলছেন?

অবশই। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জোর দিয়ে বললেন, ছেলেটা খুবই ভাল। আমি এর মত আর কাউকে দেখিনি।

এবার তিনি হ্যারির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন–তুমি কি এই প্রথম ঝাড়ুর ওপর উড়লে? হ্যারি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকালো।

হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারল না তাকে নিয়ে কী করা হবে। তবে এতটুকু সে বুঝতে পারল যে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না। সে তার পায়ে শক্তি পেতে শুরু করল।

হ্যারি পঞ্চান্ন ফুট ওপর থেকে নিচে ড্রাইভ দিয়ে একটা জিনিস ধরেছে। ম্যাকগোনাগল উডকে বললেন। তার গায়ে একটুও আচড় লাগেনি। এটা চার্লি উইসলিও করতে পারত না। উডের কাছে মনে হল তার স্বপ্ন যেন এখনই সফল হতে যাচ্ছে।

তার চোখমুখে আনন্দের ঝিলিক। একই সঙ্গে উত্তেজনা। জিজ্ঞেস করল, হ্যারি তুমি কি কখনও কিডিচ খেলা দেখেছো?

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ব্যাখ্যা করে বললেন–উড, গ্রিফিল্ডর হাউজের অধিনায়ক।

তার শারীরিক গঠনও একজন সিকারের মতই। হ্যারির চারদিকে হেঁটে ও হ্যারির দিকে তাকিয়ে উড এই মন্তব্য করল। হালকা… গতিসম্পন্ন। প্রফেসর, তাকে একটি সুন্দর ঝাড়ু দিতে হবে–নিম্বাস ২০০০ অথবা ক্লীনসুইপ সাত।

আমি অধ্যাপক ডাম্বলডোরের সাথে কথা বলব। আমরা দেখি প্রথম বর্ষের জন্য নিয়মকানুন কিছু শিথিল করা যায় কিনা। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন। গতবারের চেয়ে আমরা ভাল দল চাই।

স্লিদারিনদের কাছে গত ম্যাচে হেরে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ লজ্জায় সিভিরাস স্নেইপের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি!

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যারি, আমি শুনতে চাই তুমি এখানে ভালো প্রশিক্ষণ নিচ্ছ। আমি শুনতে চাই তুমি প্রশিক্ষণকালে পরিশ্রম করছো, আর ভিন্ন কিছু শুনলে তোমার শাস্তির বিষয়ে আমার মত পরিবর্তন করতে পারি বলে মুচকি হাসলেন।

তারপর তিনি বললেন–তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই গর্ব করতেন। তিনি একজন উঁচুমানের কিডিচ খেলোয়াড় ছিলেন।

***

রন তার স্টিক অ্যান্ড কিডনি পাই অর্ধেক মুখে পুরেছে, কিন্তু সে খেতে ভুলে গেল। সিকার? সে বলল, কিন্তু প্রথম বর্ষের কেউ তো হতে পারে না, কখনোই না, তুমি সবচেয়ে ছোট, এর আগে…তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছো।

মধ্যাহ্নভোজের সময় ম্যাকগোনাগলের সাথে মাঠ থেকে যাওয়ার পর কি কি ঘটেছে এই মাত্র হ্যারি বলে শেষ করেছে।

হ্যারি বলল–শতাব্দীর মধ্যে এটাই প্রথম। উড আমাকে তাই বলল।

এ খবর শুনে রন এত অবাক ও অভিভূত হল যে, সে হ্যারির দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

হ্যারি রনকে বলল–আগামী সপ্তাহ থেকে আমার প্রশিক্ষণ শুরু হবে। তুমি কাউকে বলো না কিন্তু, কারণ উড চায় না কেউ এটা জানুক।

ঠিক এই সময় ফ্রেড আর জর্জ উইসলি হলঘরে প্রবেশ করল। হ্যারিকে দেখে জর্জ নিচু কণ্ঠে বলল–শাবাশ! উড আমাদেরকে সব বলেছে। আমরাও এই টিমে আছি।

ফ্রেড বলল-এবার আমরা নিশ্চিতভাবে কিডিচ কাপ জিতব। চার্লি চলে যাবার পর আমরা কখনো এ খেলায় জিততে পারিনি। তবে এ বছর আমাদের দল অনেক শক্তিশালী। হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই ভালো খেলবে। তোমার কথা বলতে গিয়ে উড যেন লাফাচ্ছিল।

যাহোক, আমাদের যেতে হবে। স্কুল থেকে বেরুবার জন্য লী জর্ডান একটি নতুন গোপন পথ বের করেছে।

ফ্রেড ও জর্জ যাবার পরপরই ম্যালফয়, ক্রেব আর গয়েল এসে উপস্থিত হলো।

তারা হ্যারিকে বলল-এখানকার খাবার কি শেষ, মি. পটার? তুমি কোন ট্রেনে আবার মাগলদের কাছে ফিরে যাচ্ছ?

হ্যারি খুব শীতল কণ্ঠে বলল–বেশ সাহস দেখছি তো এখন, মাটিতে ফিরে এসেছ বলে। সাথে ক্ষুদে বন্ধুদেরও দেখছি।

উঁচু টেবিলে শিক্ষকরা বসে থাকায় আঙ্গুল বাঁকানো বা ভয় দেখানো, ক্রেব এবং গয়েলের একটু–আধটু বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু ঘটেনি।

ম্যালফয় হ্যারিকে বলল–সুযোগ পাওয়া মাত্রই আমি বদলা নেব। তুমি যদি চাও আজ রাতেই জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ হতে পারে, শুধু জাদুদণ্ড। শারীরিক নয়। কী, এ ব্যাপারে কথা বলছ না যে, তুমি কি জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানো না?

অবশ্যই সে জানে। রন জবাব দিল–আমি ওর দ্বিতীয় হবো। তোমার সাথে কে থাকবে?

ম্যালফয় ক্রেব ও গয়েলের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ক্রেব সে বলল, মাঝরাতে ঠিক আছে? ট্রফি রুমেই দেখা হবে। ওটা তালা লাগানো থাকে না।

ওরা চলে গেলে হ্যারি রনকে জিজ্ঞেস করল–জাদুকরদের মল্লযুদ্ধ জিনিসটা কী? আর দ্বিতীয় বলতেই বা কী বোঝায়? রন বলল–তুমি যদি মল্লযুদ্ধে মারা যাও তাহলে আমি তোমার দায়িত্ব নেব। যিনি এই দায়িত্বটা নেন তাকেই দ্বিতীয় বলা হয়।

রন আরো বলল–আসল জাদুকর যখন মল্লযুদ্ধে অংশ নেয় তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা যায়। তোমার আর ম্যালফয়ের মধ্যে কেউই এতটা দক্ষ হওনি যে কেউ কারো ক্ষতি করতে পারবে। আমি নিশ্চিত যে ম্যালফয় ভেবেছিল তুমি তার মল্লযুদ্ধের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে।

আমি যদি জাদুদণ্ড ব্যবহার করি আর দেখা গেল কিছুই ঘটেনি তাহলে কী হবে? হ্যারি জানতে চাইল।

তাহলে তুমি তার নাকে জোরে একটা ঘুষি মারবে। রন বলল।

এক্সকিউজ মি। হ্যারি আর রন তাকিয়ে দেখল যে হারমিওন গ্রেঞ্জার এসেছে। রন মন্তব্য করল-এখানে কেউ শান্তিতে খেতেও পারবে না নাকি?

রনের কথার পাত্তা না দিয়ে হারমিওন হ্যারিকে বলল–আমি তোমার আর ম্যালফয়ের কথা আড়ি পেতে না শুনে পারলাম না।

না শুনলেও পারতে? রন বলল।

হামিওন রনের কথার উত্তর না দিয়ে হ্যারিকে বলল–মধ্যরাতে তোমার স্কুলে ঘুরে বেড়ানো ঠিক হবে না। ভেবে দেখো, তুমি যদি ধরা পড়ো, ধরা পড়বেই, তাহলে গ্রিফিল্ডর হাউজের পয়েন্ট কাটা যাবে। হ্যারি, মাঝে মাঝে তোমাকে আমার খুব স্বার্থপর মনে হয়।

এটা তোমার দেখার বিষয় নয়। হ্যারি মন্তব্য করল।

বিদায়। বলে রন বিদায় নিল।

***

নেভিল এখনও হাসপাতালে।

সব দিনই এক রকম। হ্যারি ভাবলো, দিনটি ভালভাবে শেষ হয়েছে বলা যাবে না। ডীন ও সিমাস ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। নেভিল হাসপাতাল থেকে ফিরে আসেনি। হ্যারি বিছানায় জেগে সময় কাটালো।

রন আস্তে আস্তে হ্যারির কাছে এসে কানে কানে বলল–রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। চলো যাওয়া যাক।

ড্রেসিং গাউন পরে জাদুদণ্ড হাতে নিয়ে তারা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে কমনরুমে এসে পৌঁছল। হঠাৎ সামনের চেয়ার থেকে কে যেন বলে উঠল হ্যারি, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না–তুমি এসব কাজে যাচ্ছ।

হালকা আলোতে হারমিওন গ্রেঞ্জারকে দেখা গেল। গায়ে গোলাপী রঙের গাউন।

রন চিৎকার করে বলল–তুমি এখানে? যাও শুতে যাও।

হারমিওন বলল–আমি তোমার ভাই পার্সিকে আভাস দিয়েছি। সে তো এখানকার প্রিফেক্ট। সে তোমাদের এসব কাজ বন্ধ করবে।

কেউ যে কারো কাজে এতটা হস্তক্ষেপ করতে পারে-এটা হ্যারি ভাবতেই পারে না।

চলে এসো। হ্যারি রনকে বলল। সেই মোটা মহিলার ছবিটি সরিয়ে গর্ত দিয়ে ওপরে উঠে গেল।

হারমিওনও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। মোটা মহিলার ছবিটি সরিয়ে সে–ও রনকে অনুসরণ করল।

হারমিওন ওদের পেছনে পেছনে এসে রুক্ষ কণ্ঠে বলল–গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য কি তোমাদের একটুও দরদ নেই? তোমরা কি কেবল নিজের স্বার্থই দেখবে? আমি চাই না স্লিদারিন হাউজ হাউজকাপ জয় করুক। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কানে গেলে তোমরা সব পয়েন্ট খোয়াবে।

এখান থেকে ভাগো। রন হারমিওনকে ধমক দিল।

ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। হারমিওন বলল–আমি যে তোমাদেরকে সতর্ক করেছি-এ কথাটি মনে রেখে বিশেষ করে যখন তুমি কাল বিকেলে বাড়িতে ফেরত যাবার জন্য ট্রেনে উঠবে।

ওদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবার জন্য হারমিওন মোটা মহিলার প্রতিকৃতির দিকে তাকাল। না, সেখানে কোন প্রতিকৃতি নেই। মোটা মহিলা রাতে ভ্রমণের জন্য বাইরে গেছে। হারমিওন বের হওয়ার কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।

আমি এখন কী করব? হারমিওন উৎকণ্ঠার সাথে বলল।

রন বলল–সেটা তোমার ব্যাপার। আমাদের এক্ষুণি যেতে হবে। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তোমাদের সাথে আমিও যাব। হারমিওন বলল।

না, তুমি আসবে না। রনের দৃঢ় নিষেধাজ্ঞা।

হারমিওন বলল–তোমরা কি চাও আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আর ফিল আমাকে পাকড়াও করুক। যদি তিনি আমাদের তিনজনকে এক সঙ্গে পান আমি সত্যি কথাটাই বলব। আমি বলব, আমি তোমাদের থামাবার চেষ্টা করছিলাম আর তুমিও আমাকে সমর্থন করতে পার।

চুপ! তোমরা দুজনেই চুপ কর। হ্যারি বলল–আমি যেন কিসের আওয়াজ পাচ্ছি।

শ্বাস–প্রশ্বাস নেয়ার শব্দ।

মিসেস নরিস? বিস্ময়ের সাথে রন উচ্চারণ করল।

আসলে এটা মিসেস নরিস নন। নেভিল। সে মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিল। তার কাছে গেলেই সে ঘুম থেকে উঠে পড়ল।

হায় ঈশ্বর। তোমরা এখানে। আমি কয়েক ঘণ্টা ধরে এখানে আটকে আছি। বিছানায় যাবার নতুন পাসওয়ার্ডটি এখন মনে করতে পারছি না।

তোমার স্বর নিচুতে রাখো, নেভিল। নতুন পাসওয়ার্ড হল–পিগ আউট। তবে এতে এখন কোন কাজ হবে না, কারণ মোটা মহিলাটা কোথায় যেন গেছে।

তোমার হাতের অবস্থা এখন কেমন। হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

ভাল। হাত দেখিয়ে নেভিল বলল–মাদাম পমফ্রে এক মিনিটের ভেতরই সব সারিয়ে দিয়েছেন।

ভালো কথা। হ্যারি বলল–নেভিল, আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে। তোমার সাথে পরে দেখা হবে। নেভিল বলল–আমাকে তোমরা একা ফেলে যেও না। আমার এখানে একা থাকতে ভাল লাগছে না।

রন ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর ক্রুদ্ধভাবে নেভিল ও হারমিওন দুজনের দিকেই তাকাল।

রন বলল–তোমাদের দুজনের যে কেউ একজন যদি আমাদের ধরিয়ে দাও তাহলে তোমাদের খবর আছে। বোগিস কুইরেল আমাদের যে অভিশাপ শিখিয়েছেন আমি তোমাদের ওপর সেই অভিশাপ দেব।

হারমিওন তার মুখ খুলল। কীভাবে অভিশাপ দিতে হয়-এটাই বোধ হয় সে রনকে বলতে চাচ্ছিল। হ্যারি তাকে ফিস ফিস করে চুপ করতে বলল। তারপর সবাইকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।

তারা করিডোর ধরে এগোতে লাগলো। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। প্রতি মুহূর্তেই হ্যারি আশঙ্কা করছে ফিলচ অথবা মিসেস নরিসের সাথে দেখা হয়ে যাবে। তার ভাগ্য ভালো–তার আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। তারা চার তলায় যাবার সিঁড়িতে এল। এবার পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে কোন শব্দ না করে তারা আগে বাড়তে লাগল। তাদের লক্ষ্য ট্রফি হাউজ।

ম্যালফয় আর ক্রেব তখনও এসে পৌঁছায়নি। ট্রফি হাউজের শোকেসের স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচের ওপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। ট্রফি হাউজের রূপা বা সোনার কাপ, শিলড, প্লেট ও মূর্তি অন্ধকারেও চক চক করছে। ওরা দেয়াল ঘেঁষে এগুতে লাগল। তাদের চোখ দুটি দরোজারই ওপরে। পাছে ম্যালফয় এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে সেই আশঙ্কায় হ্যারি তার জাদুদণ্ড বের করলো। সময় বয়ে চলল। কিন্তু ম্যালফয়ের দেখা নেই। হয়ত এমনও হতে পারে সে ভয় পেয়ে গেছে।

একটু পরে পাশের কক্ষে একটা শব্দ শোনা গেল। তারা সতর্ক হলো। হ্যারি যখন তার জাদুদণ্ড ঘোরাল তখন কয়েকটা শব্দ তার কানে ভেসে এল। না এটা মালফয়ের কণ্ঠস্বর নয়।

আরে এ যে ফিলচ। তিনি নরিসের সাথে কথা বলছেন। ওরা একটু এগিয়ে দেখল পোশাকের গ্যালারি। দৌড় দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নেভিল রনের কোমর জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ালো। নেভিল দেখল–ফিলচ ট্রফি রুমে প্রবেশ করেছেন।

হ্যারি আর রন শুনতে পেল ফিলচ বলছে–তারা কাছাকাছি কোথাও আছে। হয়ত তারা লুকিয়ে।

এই দিকে। হ্যারি উল্টোদিকে ছুটলো এবং ভীত–সন্ত্রস্ত হয়ে তারা একটি লম্বা গ্যালারি নিঃশব্দে পার হতে লাগল। গ্যালারিতে ছিল অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র। তারা বুঝতে পারল, ফিলচ নেভিলের কাছাকাছি চলে গেছেন।

বিভিন্ন ধরনের আওয়াজে দুর্গের সবাই জেগে গেছে।

পালাও বলে হ্যারি দৌড় দিল। তারা চারজন নিচের দিকে দৌড়াতে লাগল। মি. ফিলচ ওদের পেছনে আসছেন কিনা–পেছন ফিরে সেটা দেখার অবকাশ তাদের নেই। একটা দরোজা দিয়ে বেরিয়ে তারা একের পর এক করিডোর পার হল। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে হ্যারি। তারা কোথায় যাচ্ছে–কেউই জানে না। এরপর ওরা পেল দেয়াল ঢাকা একটি বড় পর্দা এবং ওটা সরিয়ে ওরা পেল একটি গুপ্তপথ। এই পথ দিয়ে তারা বশীকরণ ক্লাসরুমের কাছে এলো। তাদের পরিচিত বশীকরণ ক্লাসরুম থেকে ট্রফি রুমের ব্যবধান কয়েক মাইল।

মনে হচ্ছে তার নাগালের বাইরে চলে এসেছি–ক্লান্ত–শ্রান্ত হ্যারি ঠাপ্তা দেয়ালে হেলান দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল। নেভিল কুঁজো হয়ে দুহাঁটুতে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল ও তার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ছিলো।

হারমিওন বলল–আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলাম।

আমাদেরকে খুব দ্রুতই গ্রিফিল্ডর টাওয়ারে পৌঁছতে হবে। রন শান্ত কণ্ঠে বলল।

হারমিওন–তুমি কি এখন বুঝতে পেরেছে যে, এটা ম্যালফয়ের চালাকি। সে কখনোই মল্লযুদ্ধ করার জন্য তোমার কাছে আসবে না। যেভাবেই হোক ফিল খবর পেয়েছেন ট্রফি রুমে কেউ আসবে। হয়ত ম্যালফয়ই তাকে সব বলে দিয়েছে।

হ্যারি ভাবল, হারমিওনই বোধহয় ঠিক। তবে তার কাছে হ্যারি নিজের ভুলের কথা স্বীকার করবে না।

চলো, যাওয়া যাক। হ্যারি বলল।

তখন তারা দশ–বারো পাও অতিক্রম করেনি, একটা দরোজা খোলার আওয়াজ পেল। দৃশ্য দেখে তারা অবাক। পিভিস বেরিয়ে আসছেন ক্লাস রুম থেকে।

তোমাদের তো ডরমিটরিতে থাকার কথা। এই মধ্যরাতে তোমরা বাইরে কেন। পিভস প্রশ্ন করল।

পিভস দয়া করে চুপ কর। তুমি দেখছি আমাদের বিপদে ফেলবে।

পিভস হো হো করে হেসে উঠলো। মধ্যরাতে ঘুরে বেড়ানো? তু, তু, তু। নটি, নটি, ইউ উইল গেট কটি

না ধরা পড়বো না দয়া করে পথ ছাড় পিভস।

আমি ফিলচকে বলব। আমার বলা উচিত। পিস বলল। তার চোখে দুষ্টুমির হাসি। তোমাদের মঙ্গলের জন্যই এটা বলা উচিত।

পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াও। রন ধমকের সুরে বলল। মানছি এটা আমাদের ভুল হয়েছে।

যেসব ছাত্র বিছানায় নেই। পিভস চিৎকার করে বলল–যেসব ছাত্র বিছানায় নেই তারা নিচে বশীকরণ ক্লাসের সামনে করিডোরে।

পিভসের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে জীবন বাঁচাতে তারা বশীকরণ ক্লাসের করিডোরের শেষ প্রান্তে উধ্বশ্বাসে দৌড়ালো। সেখানে তারা একটি দরোজা খোলার চেষ্টা করলো। না, বন্ধু, খোলা যাচ্ছে না। এই হলো আমাদের পরিণতি। রন কাদো কাঁদো কন্ঠে বলল।

দরোজা ধাক্কা দিয়েও খুলতে না পেরে রন বলল, আমাদের আর কোন উপায় নেই। আমরা শেষ হয়ে গেছি।

তারা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পিভসের চিৎকার শুনে ফিলচ ছুটে আসছেন।

এখান থেকে যেতে হবে। হারমিওন বলল। সে হ্যারির হাত থেকে জাদুদণ্ডটি নিয়ে তালাটিতে ছোঁয়ালো, তারপর ফিসফিস করে বলল আলোহেমোরা।

তালায় ক্লিক করে আওয়াজ হলো এবং দরোজাটা খুলে গেল। তারা ভেতরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে কান পেতে রইল। তাদের কানে ভেসে এলো–ওরা কোনদিকে গেছে, পিভস। আমাকে তাড়াতাড়ি বল। ফিলচ পিভসকে জিজ্ঞেস করছে।

আগে বল প্লিজ। ঝামেলা করো না পিভস, বল ওরা কোন দিকে গেছে?

আমি কিছুই বলব না! হা হা হা! আমি বলেছি যতক্ষণ তুমি ভালভাবে প্লিজ না বলবে আমি কিছুই বলব না। হা হা হা!

বল, প্লিজ।

ঠিক আছে–প্লিজ

তারা শুনতে পেল পিভস হুস করে উধাও হয়ে যাচ্ছে আর ফিলচ তাকে অভিশাপ দিচ্ছে।

হ্যারি ফিসফিস করে বলল–তিনি হয়তো মনে করছেন দরোজাটা বন্ধ। তাই এখানে কেউ আসেনি। মনে হচ্ছে আমরা এখন নিরাপদ। নেভিল বেরিয়ে এসো।

নেভিল হ্যারির গাউনের আস্তিন ধরে টানছে।

কী?

হ্যারি চারদিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হল সে এখন একটা দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি! খুবই বাজে কাজ করেছে সে আজ। তার আজকের কাজ আগের সব কিছু অতিক্রম করেছে।

হ্যারি যা ভেবেছিল আসলে ঘটনা তা ছিল না। তারা কোন ঘরের ভেতরে নয়। ছিল একটা করিডোরে। এটা তৃতীয় তলার নিষিদ্ধ করিডোর। এখন ওরা বুঝতে পারে, এটা কেন নিষিদ্ধ। তাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল একটা দানবীয় কুকুরের চোখের ওপর। কুকুরটা এতো বড় যে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত পুরো জায়গা সে দখল করে রেখেছে। কুকুরটার তিনটি মাথা, তিনটা নাক, তিনটা মুখ। তার মুখের লালা গড়িয়ে পড়ছে পিচ্ছিল রশির ওপর। কুকুরটা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তার দুটো চোখই তাদের ওপর নিবদ্ধ। হ্যারি উপলব্ধি করল কেন তারা এখনো মারা যায়নি, হঠাৎ এসে পড়ায় কুকুরটা তাদের দেখে অবাক হয়েছে। অবাকের পালা শেষ করে কুকুরটি আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে উঠল। কুকুরের বজ্র নিনাদের অর্থ কী তা বুঝতে হ্যারি বা তার সঙ্গীদের স্বাকি রইল না। হ্যারি দরোজা খোলার জন্য হাতল মোচড়াতে লাগলো।

এখন হ্যারিকে দুটো বিকল্পের একটাকে বেছে নিতে হবে, হয় মৃত্যু নয় ফিলচ। সে বেছে নিল ফিলচকে!

তারা পেছন দিকে হটে এসে করিডোরে ফিরে এল। হ্যারি দরোজাটা সজোরে বন্ধ করে দ্রুতবেগে নিচে করিডোরে নামল। ফিলচ নিশ্চয়ই তাদের কোথাও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কারণ, তারা ফিরে আসার পথে কোথাও ফিলচকে দেখেনি। এটা এখন তাদের জন্য বড় বিষয় নয়, তাদের এখন একমাত্র চেষ্টা দানব থেকে বাঁচা–তাই দানব থেকে দূরত্ব বাড়াতে তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো। আট তলায় সেই মোটা মহিলার প্রতিকৃতির সামনে না আসা পর্যন্ত তারা তাদের দৌড় থামায়নি।

তাদের কাধ থেকে পড়ে যাওয়া ঝুলন্ত ড্রেসিং গাউন এবং ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে মহিলাটা প্রশ্ন করলেন-এত রাতে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?

তেমন কিছু না–পিগ স্নাউট, পিগ আউট। হ্যারি উচ্চারণ করল। হ্যারির জবাবের সাথে সাথেই ছবিটি তাদের দিকে এগিয়ে এল এবং যাওয়ার পথ ছেড়ে দিল। তারা কমনরুমে প্রবেশ করে ধপাস করে আরাম কেদারায় বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ নিরব ছিল, কোন কথা বলেনি, দেখে মনে হলো নেভিলের এমন অবস্থা হয়েছে যে, সে বোধ হয় আর কথা বলতে পারবে না

এ রকম একটা জিনিসকে তারা স্কুলে আটকিয়ে রেখেছে কেন? রন বলল কুকুরের ব্যায়ামের প্রয়োজন হয়, এরও প্রয়োজন হতে পারে। এতক্ষণে হারমিওনের শ্বাস–প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল এবং মেজাজও। হারমিওন ওদের থামিয়ে বলল–তোমরা কি কেউ ভাল করে দেখেছো? তোমরা কি লক্ষ্য করেছিলে কুকুরটা কিসের ওপর দাঁড়িয়েছিল?

মেঝের ওপর? হ্যারি বলল–আমি তার পায়ের দিকে তাকাইনি। আমার চোখ ছিল তার মাথার ওপর।

না, মেঝের ওপর নয়। কুকুরটা দাঁড়িয়েছিল একটা গোপন দরোজার ওপর। এটা স্পষ্ট যে কুকুরটা কোন কিছু পাহারা দিচ্ছিল। হারমিওন দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে এ কথা বলল।

বলল–আজ আমরা সবাই মারা পড়তে পারতাম। অথবা ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হতে পারতাম। আশা করি তোমরা নিশ্চয়ই এখন নিজেদের ভাগ্যের জন্য খুশি, এখন তোমরা যদি কিছু না মনে কর আমি ঘুমুতে যাই।

হা করে রন হারমিওনের দিকে তাকিয়ে রইল।

না, আমরা কিছু মনে করবো না। বন বলল–তুমি কি মনে কর আমরা তোমাকে জোর করে আমাদের সাথে নিয়ে গেছি।

কিন্তু হারমিওন হ্যারিকে চিন্তার জন্য একটা কিছু দিয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে হ্যারি ভাবতে লাগল–কুকুরটা নিশ্চয়ই কিছু পাহারা দিচ্ছে… হগ্রিড় একবার বলেছিলো পৃথিবীতে গ্রিংগটস হলো কোন কিছু নিরাপদে রাখার জন্য সব থেকে নিরাপদ জায়গা এবং তার চেয়েও নিরাপদ হোগার্টস।

এইখানে কি ৭১৩ নম্বর ভল্টের ছোট্ট প্যাকেটটা পাওয়া যাবে?

🔴 হ্যালোইন

পরদিন সকালে যখন হ্যারি এবং রনকে হোগার্টসেই দেখতে পেল, ম্যালফয় নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার ধারণা ছিল হ্যারি আর রন মরে ভূত হয়ে গেছে। ক্লান্ত দেখালেও তারা বেশ উফুল্ল ছিল।

হ্যারি আর রন সেই তিনমুখো কুকুরের সাথে দেখা হওয়াটাকে একটা দারুণ অভিযান হিসেবে ভাবতে শুরু করলো এবং আবার সেখানে যাওয়ার কথা মাথায় রাখলো।

এর মধ্যে হ্যারি রনকে সেই প্যাকেটের মনে করিয়ে দিল যেটা সম্ভবত গ্রিংগটস থেকে হোগার্টসে পাঠানো হয়েছে। তারা দুজন ভাবছিল এত কড়া প্রহরার প্রয়োজন কী।

এটা হয়ত খুব মূল্যবান অথবা খুব বিপজ্জনক কিছু। রন মন্তব্য করল।

বা দুটাই, হ্যারি বলল।

শুধু তারা নিশ্চিত যেটা জানতে পারল, সেটা হলো যে, রহস্যজনক বস্তুগুলোর দৈর্ঘ্য দুই ইঞ্চি। অন্য কোন সূত্র ছাড়া প্যাকেটের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করাও সম্ভব হলো না। নেভিল বা হারমিওন কুকুর অথবা গোপন দরজার ভেতরে কী আছে–সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করেনি।

হারমিওন কয়েকদিন ধরে ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছে। এতে রন বা হ্যারির বরং লাভ, কারণ হারমিওন সব সময় তার কর্তৃত্ব ফলাতে চায় যা তাদের পছন্দ নয়। ওদের এখন একমাত্র লক্ষ্য ম্যালফয়কে এক হাত দেখিয়ে দেয়া, এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই ডাকযোগে সে সুযোগ এসে গেল।

যখন পেঁচারা এসে গ্রেট হলে প্রবেশ করল তখন সবাই তাকিয়েছিল একটা প্যাকেটের দিকে যেটি ছুটি পেঁচা বয়ে নিয়ে এসেছে। যখন পেঁচারা প্যাকেটটা হ্যারির ঠিক সামনে ফেলল তখন সত্যি সে অবাক হলো। পেঁচাগুলো বাইরে চলে গেলে হ্যারি দেখল প্যাকেটের ওপর একটা চিঠি। হ্যারি চিঠিটা খুলল। চিঠিটা এসেছে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগলের কাছ থেকে আনন্দের সংবাদ নিয়ে। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল লিখেছেন

পার্সেলটা টেবিলের ওপর খুল না। 
এর ভেতর আছে নতুন নিম্বাস–২০০০। 
আমি চাই না অন্য কেউ জানুক তুমি একটা নতুন ঝাড়ু পেয়েছ। 
আজ রাতে অলিভার উড তোমার সাথে দেখা করবে–কিভিচ খেলার মাঠে। 
ঠিক সাতটায়–তোমার প্রশিক্ষণের জন্য। 
–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল

নিজের আনন্দ গোপন করতে হ্যারির কষ্ট হচ্ছিল। তাই সে চিঠিটা রনকে পড়তে দিল।

রন বলল–নিম্বাস ২০০০! আমি তো এ ধরনের ঝাড়ু এখন পর্যন্ত স্পর্শই করিনি।

তারা হলের বাইরে এসে দেখে ওপরে সিঁড়ি আটকে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেব আর গয়েল। ম্যালফয় হ্যারির হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। আরে এটা তো একটা ঝাড়ু। এই বলে দ্বেষ ও হিংসাভরা দৃষ্টিতে ম্যালফয় ঝাড়ুটা হ্যারির দিকে ছুঁড়ে মারল আর বলল প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য তো ঝাড়ু নিষিদ্ধ।

রন আর চুপ থাকতে পারল না। বলল-এটা তো পুরনো ঝাড়ু নয়, নিম্বাস–২০০০। ম্যালফয় তুমি বলেছিলে যে, তোমার কাছে একটি কমেন্ট ২৬০ আছে?

রন হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল–কমেট দেখতে বড়। কিন্তু নিশ্বাসের সাথে কমেন্টের কোন তুলনাই হয় না।

এটা পেয়ে তোমাদের কোন লাভ নেই। এর হাতলের অর্ধেক তোমরা ব্যবহারই করতে পারবে না। ম্যালফয় মন্তব্য করল।

রন জবাব দেয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক ফ্লিটউইক। তিনি বললেন–কী ব্যাপার। তোমরা কী নিয়ে ঝগড়া করছ।

হ্যারিকে একটি ঝাড়ু পাঠানো হয়েছে। ম্যালফয় বলল।

আমি তা জানি। ফ্লিটউইক বললেন–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারির ব্যাপারে আমাকে সবকিছু জানিয়েছেন। এটা কোন মডেল?

নিম্বাস ২০০০, স্যার। ম্যালফয়ের আতঙ্ক দেখে অনেক কষ্টে হাসি চেপে হ্যারি জবাব দিল। আর এটা পাবার জন্য আমি ম্যালফয়কে ধন্যবাদ দিতে চাই।

ম্যালফয়ের হতাশা দেখে হ্যারি আর রন খুব খুশি। হাসতে হাসতে ওরা ওপরে উঠতে লাগল।

মর্মর পাথরের সিঁড়ির ওপরে উঠে হ্যারি বলল–সে যদি নেভিলের স্মারকটি চুরি না করতো, আমি আজকে এখানে থাকতে পারতাম না।

তুমি কি মনে কর-এটা তোমার আইন ভাঙার পুরস্কার? পেছন থেকে হারমিওনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

আমি ভেবেছি তুমি আমাদের সাথে কথা বলবে না? হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকিয়ে বলল।

আমাদের সাথে কথা না বলার অভ্যাসটা তুমি চালিয়ে যাও। রন মন্তব্য করল।

বিরক্ত হয়ে হারমিওন উঠে চলে গেল।

ওইদিন নানাবিধ ঝামেলা হ্যারির পড়াশোনায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটালো। তার বড় চিন্তা ডর্মিটরির কোন জায়গাটিতে সে তার নতুন ঝাড়ুটা রাখবে। সে রাতে হ্যারি কিছুই খেল না। ঝাড়ুর প্যাকেট খোলার জন্য সে আর রন ওপরে গেল। খোলার পর দেখা গেল–চিকন চকচকে ঝাড়ু। মেহগনি কাঠের হাতল। ঝাড়ুর গায়ে সোনালী হরফে লেখা–নিম্বাস ২০০০।

চমৎকার। রন মন্তব্য করল। সন্ধ্যা সাতটা বাজার কিছু আগেই হ্যারি দুর্গ ছেড়ে কিডিচ মাঠের দিকে রওনা হলো। এর আগে সে কখনও স্টেডিয়ামে আসেনি। একশর মত আসন। খেলা বা অনুশীলনের জন্য যথেষ্ট।

উড তখনও আসেনি। হ্যারির ওড়ার ইচ্ছে হলো। সে মাটিতে লাথি দিয়ে ঝাড়ু নিয়ে উড়ে চলল। বারবার গোলপোস্টের ভেতর দিয়ে ঢোকা আবার বেরিয়ে আসা। হ্যারির দারুন মজা লাগছে। তার সামান্য স্পর্শে নিম্বাস ২০০০ অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করছে।

হায় পটার, এদিকে এসো। অলিভার উড এসে গেছে।

তার হাতে কাঠের একটা বড় বাক্স। হ্যারি উডের পাশে দাঁড়াল।

চমৎকার। ঊড মন্তব্য করল। হ্যারি, আমি দেখতে পাচ্ছি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল যা বলেছিলেন… একেবারে খাঁটি। আজ আমি তোমাকে কিডিচ খেলার নিয়মকানুন সম্পর্কে কিছু বলব। তারপর তুমি সপ্তাহে তিনদিন খেলা অনুশীলন করবে। উড বাক্সটা খুলল। বাক্সের ভেতর বিভিন্ন আকারের চারটা বল। অলিভার ঊড় এবার তাকে খেলাটা বোঝালেন। বললেন–খেলাটা একটু কঠিন। প্রত্যেক দলে সাতজন খেলোয়াড় থাকবে। তাদের মধ্যে তিনজন হবে চেজার বা ধাওয়াকারী।

তিনজন চেজার? হ্যারি প্রশ্ন করল।

উড এবার ফুটবল আকৃতির একটা উজ্জ্বল লাল বল বের করল।

উড এবার ব্যাখ্যা করল-এই বলটার নাম কুয়াফল।

চেজারগণ কুয়াফল পরস্পরের মাঝে হস্তান্তর করে এবং গর্তে ফেলে গোল করার চেষ্টা করে।

উড আরো ব্যাখ্যা করল–প্রতিটা দলে একজন খেলোয়াড় থাকে যার নাম কীপার। কীপারের দায়িত্ব হলো গোল ঠেকালো। আমি গ্রিফিল্ডর হাউজের কিপার।

এ খেলায় তাহলে তিনজন চেজার ও একজন কীপার থাকে। তারা কুয়াল নিয়ে খেলা করে। হ্যারি খেলার বিস্তারিত নিয়মকানুন আগ্রহের সাথে জানার চেষ্টা করলো।

এবার আমি তোমাকে দেখাবো কীভাবে খেলতে হয়। উড বলল এটা হাতে নাও।

উড হ্যারিকে তিনটা ছোট ব্যাট ও একই রকম দুটো বল দিলেন। বল দুটো কালো রঙের এবং কুয়াফলে থেকে একটু ছোট। বল দুটোর নাম ব্লুজার। এবার দাঁড়িয়ে থাকো। উড হ্যারিকে নির্দেশ দিল।

হঠাৎ করে কালো ব্লুজারটা ওপরে উঠে হ্যারির মুখের কাছে চলে এলো। হ্যারি ব্যাট দিয়ে সরিয়ে দিল যাতে বলটি তার মাকে আঘাত না করে। এটা ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে উডের কাছে চলে গেল। উড ব্লুজারটা ঠেকিয়ে গর্তে পাঠিয়ে দিল।

খেলা নিয়ে হ্যারিকে উড কয়েকটা প্রশ্ন করল। হ্যারি প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিল।

চমৎকার। উড মন্তব্য করল।

হ্যারি উডকে প্রশ্ন করল–আচ্ছা ব্লুজারদের হাতে কখনও কি কেউ মারা গেছে?

হোগার্টসে কখনও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সর্বোচ্চ যেটা হয়েছে সেটা হলো কারো কারো দাঁত ভেঙেছে। এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটেনি। এবার শোন, এই দলের সর্বশেষ ব্যক্তি হলো সিকার–সেটা হচ্ছো তুমি। অবশ্য কুয়াফল বা ব্লুজার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

যতক্ষণ না তারা আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়।

তোমার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। উড বলল–ব্লুজারদের ঠেকাতে দুই উইসলি যমজ ভাই–ই যথেষ্ট। তারা নিজেরাই একটা ব্লুজার জুটি। এরপর উড বাক্স থেকে চতুর্থ এবং শেষ বলটা বের করল। কুয়াফল এবং ব্লুজারের তুলনায় এটা ছিল আরো ছোট এবং বড় একটা কাঠবাদামের সমান। এটা ছিল উজ্জ্বল সোনালী রঙের, ছোট একটু গোলাপী পাখা।

বলগুলো হাতে নিয়ে উড বলল-এটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এ বলটার গতি এত বেশি যে এটা ধরাই মুশকিল। আর সিকারের দায়িত্ব হল বলগুলো ধা। সিকার যদি এ বলটা ধরতে পারে তাহলে তার দল অতিরিক্ত ১৫০ পয়েন্ট পাবে।

আর কোন প্রশ্ন আছে? উড হ্যারির কাছে জানতে চায়।

হ্যারি মাথা নাড়ল। তার কী করণীয় এটা সে বুঝতে পেরেছে।

আমরা এখনও স্নিচ বল নিয়ে খেলিনি। বলগুলো বাক্সে রাখতে রাখতে উড বলল-এত অন্ধকারে বল হারিয়ে যেতে পারে।

উড তার পকেট থেকে গলফ বলের একটা সাধারণ ব্যাগ বের করল। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল উড চারদিকে জোরে জোরে বলগুলো ছুঁড়ে মারছে আর হ্যারি তা লুফে নিচ্ছে।

হ্যারি প্রতিটা বল লুফে নিল। উড খুব খুশি। আধঘণ্টা পর যখন সত্যি সত্যিই অন্ধকার নেমে এল, তখন তারা অনুশীলন বন্ধ করল।

এবার কিডিচ কাপ আমরা পাব। খুশি মনে উড মন্তব্য করল। দুর্গে ফেরার পথে উড বলল–তুমি যদি চার্লস উইসলির চেয়ে ভালো খেল, আমি অবাক হব না। সে হয়ত ইংল্যান্ডের পক্ষ হয়েই খেলতে পারত যদি সে ড্রাগনের পেছনে না ছুটত।

হ্যারি এখন খুবই ব্যস্ত। একদিকে কিন্ডিচ খেলার জন্য সপ্তাহে তিনবার অনুশীলন। অন্যদিকে হোমওয়ার্ক তো আছেই। হ্যারি ভাবতে লাগল সে হোগার্টসে এসেছে মাত্র দুমাস হলো। এর ভেতরই সে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রিভেটড্রাইভের তুলনায় দুর্গটি তার কাছে অনেক আপন মনে হচ্ছে। লেখাপড়া গোড়াতে কঠিন মনে হলেও এখন খুব উৎসাই বোধ করছে।

ঘুম ভাঙলো সুস্বাদু খাবারের গন্ধে। হ্যারির মনে হলো, হ্যালোইন ব্যাপারটা বোঝা দরকার। অধ্যাপক ফ্লিটউইক ঘোষণা দিলেন, এখন ছাত্ররা জিনিসপত্র আকাশে ওড়াতে পারবে। এজন্য তিনি ছাত্রদের জোড়ায় জোড়ায় বসিয়ে দিলেন। হ্যারির জুটি হলো সিমাস ফিনিগান। নেভিলের ব্যাঙ একটি ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছিল। রানের জুটি হলো হারমিওল গ্রেপ্পার। রন অথবা হারমিওন কেউ এতে অখুশি কিনা তা বোঝা যাচ্ছিল না। যেদিন থেকে হ্যারি ডাকে ঝাড়ু পেল সেদিন থেকেই হারমিওন হ্যারি ও ব্রনের সাথে কথা বলে না।

অধ্যাপক ফিটউইক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন-একটা কথা মনে রেখো। কথাটি হলো–সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক, মনে রেখো সুইশ অ্যান্ড ফ্লিক। এ মন্ত্র উচ্চারণ করো। কখনো ভুল করে উচ্চারণ করবে না। মনে রেখো–ভুল করে জাদুকর বারুফিয়ে একবার স এর বদলে ফ উচ্চারণ করেছিল, তারপর সে নিজেকে আবিষ্কার করলো মেঝেতে। তার বুকের ওপর একটা মহিষ।

এটা ছিল বেশ কঠিন! হ্যারি ও সিমাস বার কয়েক সুইশ এন্ড ফ্লিক করলো একটা পালক আকাশের দিকে পাঠানোর জন্য। কিন্তু এটা টেবিলের ওপর থেকে আর আকাশের দিকে উঠলো না। সিমাস ধৈর্য হারিয়ে জাদু কাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে পালকটাতে আগুন ধরিয়ে দিল আর হ্যারিকে তার টুপি দিয়ে সেই আগুন নিভাতে হলো।

পাশের টেবিলে রন তেমন সুবিধে করতে পারছিল না। রন তার লম্বা হাত ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল–উইংগার্ডিয়াম লেভিওসা।

হারমিওন বলল–ভুল হলো। তুমি ভুল উচ্চারণ করেছ।

এতই যদি জানো তাহলে তুমি নিজেই উচ্চারণ কর। হারমিওনের উদ্দেশ্যে রন বলল।

হারমিওন তার গাউনের আস্তিন গুটালো, এবং জাদুর দণ্ডটা ঘোরাল। তারপর উচ্চারণ করল–উইং–গার–ডিয়াম লেভি–ও–সা। এরপর পালকটা টেবিল থেকে ওপরদিকে উঠতে লাগলো এবং তাদের মাথারও চার ফুট ওপরে উঠলো। অধ্যাপক ফ্লিটউইক করতালি দিয়ে উঠলেন এবং হারমিওনের প্রশংসা করলেন।

ক্লাসশেষে রনের মেজাজ খুব খারাপ।

জনাকীর্ণ করিডোর অতিক্রম করতে করতে রন হ্যারিকে বলল-এটা কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে কেউই হারমিওনকে সহ্য করতে পারে না। সত্যি বলতে কী সে সবার জন্য একটা দুঃস্বপ্ন।

মনে হলো কেউ যেন হ্যারির পিঠ ছুঁয়েছে। হ্যারি তাকিয়ে দেখে হারমিওন। হারমিওনের চোখে অশ্রু দেখে হ্যারি সত্যিই অবাক হলো।

মনে হয় সে তোমার কথা শুনতে পেয়েছে। হ্যারি রনকে বলল।

তাতে কী হয়েছে? রন একথা বললেও খুব অস্বস্তিবোধ করছিল। একটু থেমে বলল–সে এখন বুঝতে পেরেছে তার কোন বন্ধু নেই।

পরবর্তী ক্লাসে হারমিওন এল না। বিকেলেও কোথাও তাকে দেখা গেল না। হ্যালোইন ভোজে যোগদানের জন্যে গ্রেট হলে যাবার পথে হ্যারি আর রন শুনতে পেল যে পার্বতী পাতিল তার বন্ধু ল্যাভেঞ্জারকে বলছে, হারমিওন মেয়েদের টয়লেটে গিয়ে কাঁদছে এবং সে চাইছে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। একথা শুনে রনের খুব খারাপ লাগতে লাগল। পরে যখন তারা গ্রেট হলে প্রবেশ করলো, সেখানকার চোখ ধাঁধানে সাজসজ্জায় ও হইচইয়ে তারা হারমিওনের কথা একেবারেই ভুলে গেল।

হাজার খানেক জীবন্ত বাদুর সিলিং ও দেয়াল ধরে এদিক–ওদিক ঊড়ছিল। আরো হাজার খানেক বার টেবিলের সামান্য ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে মোমবাতিগুলো কুমড়োর খোলে বসিয়ে দিল। ছাত্রদের টার্মের প্রথম দিকের ভোজসভা বলে সোনালী থালায় খাদ্য পরিবেশিত হলো।

হ্যারি যখন তার প্লেটে আলু তুলে নিচ্ছিল ঠিক তখন প্রায় দৌড়ে অধ্যাপক কুইরেল গ্রেট হলে প্রবেশ করলেন। তার পাগড়ি বিপর্যস্ত। সবাই অবাক হয়ে দেখল তিনি ডাম্বলডোরের চেয়ারের দিকে যাচ্ছেন। টেবিলের কাছে গিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন–ট্রল, সেই বিরাট জল্পটা… বন্দিশালা… আমার ধারণা ছিল আপনি সব জানেন। তারপর তিনি মুৰ্ছা খেয়ে মরার মত মেঝের ওপর পড়ে গেলেন।

চারদিকে শোরগোল পরে গেল, কোণ থেকে অধ্যাপক ডাম্বলডোর তার জাদুদণ্ড ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেন।

প্রিফেক্টগণ। ডাম্বলডোর নির্দেশ দিলেন, এখনই তোমরা হাউজের সকলকে নিয়ে ডর্মিটরিতে ফিরে যাও।

পার্সি কাছেই ছিল।

পার্সি বলল–তোমরা সবাই আমাকে অনুসরণ কর। প্রথম বর্ষের সব ছাত্র আমার পেছনে এসো। আমার পেছন পেছন এলে তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। ট্রল তোমাদের কিছু করতে পারবে না। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা একাট্টা হয়ে আমার পেছনে পেছনে এসো। সরে দাঁড়ান, প্রথম বর্ষের ছাত্ররা আসছে। আমি একজন প্রিফেক্ট।

হ্যারি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলো, ট্রল এলো কি করে?

আমাকে এ প্রশ্ন করো না। মনে হয় তারা সবাই বুন্ধু। রন বলল। হয়ত হ্যালোইন ভোজসভায় মজা করার জন্য পিভস এটা করেছে।

তারা বিভিন্ন গ্রুপের ছাত্রদের পার হয়ে গেল যারা ঊর্ধ্বশ্বাসে বিভিন্ন দিকে ছুটছে। তারা যখন হাফলপাফ হাউজের উদভ্রান্ত ছাত্রদের ভিড় অতিম করছিল তখন হ্যারি হঠাৎ করেই রনের হাত চেপে ধরলো।

আমি কিন্তু ভাবছি হারমিওনের কথা। হ্যারি বলল।

তার সম্পর্কে কী ভাবছো? রন জানতে চাইল।

ট্রলের বিষয়ে সে জানে না।

রন ঠোঁটে কামড় দিল।

ঠিক আছে। রন বলল–পার্সি আমাদেরকে না দেখে ফেললেই হলো।

তারা হাফল পাফ হাউজের ছাত্রদের দলের ভেতরে মিশে গেল। সেখান থেকে সটকে পড়ে একটি নির্জন করিডোরের দিকে অগ্রসর হলো। আরেকটু এগিয়েই তারা মহিলা টয়লেটের কাছাকাছি এলো। পেছন দিকে তারা দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পেল।

পার্সি। নিচু কণ্ঠে রন উচ্চারণ করল।

তারা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল–পার্সি নয়, স্নেইপ।

স্নেইপ করিডোরে তৃতীয় তলার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

হ্যারির নাকে এক ধরনের বাজে গন্ধ এলো। অনেকটা ভেজা, স্যাঁতসেতে অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের গন্ধ। একটু পরেই মনে হলো কে যেন আসছে। পদশব্দ, দৈত্যের পদশব্দের মত। অতিকায় জীবটি ঘরে ঢুকল। বারো ফুট লম্বা। গায়ের চামড়া অন্যরকম। গ্রানাইট পাথরের মতো গায়ের রঙ। মাথায় টাক। অনেকটা নারকেলের মত। হাতে একটা বিশাল কাঠের ডাণ্ডা। দরোজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকলো ট্রল।

হ্যারি বলল চাবিটা তালার মধ্যেই আছে। আমরা তো ট্রলকে আটকে রাখতে পারি।

চমৎকার। রন মন্তব্য করল–চলো তাই করি। তারা দুজন আগে বাড়ল। তারা মনে মনে প্রার্থনা করছিল যেন ট্রল তাদের দিকে অগ্রসর না হয়। তাদের প্রার্থনায় কাজ হলো। হ্যারি লাফ দিয়ে কোনমতে তালা ও চাবি হাতের নাগালে পেল। তারপর তালা লাগিয়ে ট্রলকে বন্দি করে ফেলল।

সাফল্যের আনন্দে তারা যখন ফিরে আসছিল ঠিক তখনই তারা শুনলো একটা বিকট আর্তনাদ। যে ঘরে তারা ট্রলকে বন্দি করেছে, সেখান থেকেই শব্দটা আসছে।

ওটা তো মেয়েদের টয়লেট। হ্যারি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।

আরে এ তো হারমিওন। বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে তারা একসাথে চিৎকার করে উঠল।

তারা যে কাজটি করতে চাইল সেটা করা ছাড়া তাদের অন্য কোন উপায় ছিল না। তারা আবার দরোজার কাছে গেল। ভয় ও আশঙ্কা নিয়ে দরোজার তালাটি খুলেই দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

হারমিওন গ্রেঞ্জার বিপরীত দিকের দেয়ালে ভয়ে কুঁচকে গেছে। মুৰ্ছা যাবার উপক্রম। দৈত্যটি তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তাকে বিভ্রান্ত কর। রনের উদ্দেশ্যে হ্যারি কলল। তারপর হ্যারি একটি ট্যাপ থেকে ট্রলের চোখে অনবন্ত পানি ছুঁড়তে লাগল।

হারমিওনের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ট্রল। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল আওয়াজটি কোত্থেকে আসছে। তার ছোট চোখ দুটি হ্যারির ওপর পড়ল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মুগুরটা হাতে নিয়ে ট্রল হ্যারির দিকে অগ্রসর হলো।

ঘরের অপর প্রান্ত থেকে রন একটা ধাতব পাইপ ছুঁড়ে মারল। ট্রলের ঘাড়ে পাইপটা লাগলেও তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলো না।

তবে তার বিকট চিৎকার শোনা গেল। সে হ্যারিকে পালাবার সুযোগ দিয়ে তার বিশ্রী মুখটা রনের দিকে বাড়িয়ে দিল।

চলে এসো। দৌড়, দৌড় দাও। হারমিওনের উদ্দেশ্যে হ্যারি চিৎকার করল। কিন্তু হারমিওন নড়তে পারছে না। সে দেয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভয়ে তার মুখ হা হয়ে আছে।

এরপর হ্যারি যে কাজটা করল তা একদিকে যেমন সাহসের অপরদিকে বোকামির। সে এক লাফ দিয়ে ট্রলের পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরল। এবার ট্রল আর নড়তে পারছে না। হ্যারি তার জাদুদণ্ড তার একটা নাকের ফুটোয় সোজা ঢুকিয়ে দিল।

যন্ত্রণায় ট্রল আর্তনাদ করে উঠল। সে তার মুগুরটা ঘোরানো শুরু করলো, এবং হ্যারি আশঙ্কা করছে যেকোন সময় এটা তার মাথা দু ভাগ করে দেবে।

হারমিওন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। রন তার নিজের জাদুদণ্ডটা নিয়ে কি করবে প্রথমে ভেবে পাচ্ছিল না, পরে উচ্চারণ করলো, উইনগারডিয়াম লেভিওসা?

মুগুরটা হঠাৎ ট্রলের হাত থেকে ছুটে ওপরে ওঠা শুরু করলো এবং ফিরে এসে ট্রলের মাথায় পড়লো। তীব্র আঘাতে ট্রল মাটিতে পড়ে গেল।

হ্যারি উঠে দাঁড়ালো। সে কাঁপছে, কোন শ্বাসও নিতে পারছে না।

হঠাৎ দরোজা বন্ধ হবার আওয়াজ শোনা গেল। পদশব্দও শোনা গেল। তারা তিনজন মাথা উঁচু করে তাকাল। তারা বুঝতে পারল না তারা কোন্ চক্রের ভেতর জড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য নিচতলায় কেউ না কেউ তাদের হৈচৈ এবং জন্তুটার গর্জন শুনেছে।

একটু পরই ঘরে প্রবেশ করলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। তার পেছন পেছন এসেছেন স্নেইপ ও অধ্যাপক কুইরেল। কুইরেল এক নজর ট্রলের দিকে তাকালেন। মৃদু আর্তনাদ করে দুহাতে কান চেপে টয়লেটে বসে পড়লেন। স্নেইপ মাথা ঝুঁকিয়ে ট্রলকে দেখতে লাগলেন। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল হ্যারি আর রনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। হ্যারি কখনও তাঁকে এত ক্ষুদ্ধ দেখেনি। তার ঠোঁট বিবর্ণ, সাদী। হ্যারি ভাবল গ্রিফিল্ডর হাউজের জন্য যে পঞ্চাশ পয়েন্ট পাওয়ার কথা ছিল তা আর পাওয়া যাবে না।

তোমরা নিজেদের কি ভাব? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল খুব রেগেমেগে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন। হ্যারি রনের দিকে তাকাল। রনের হাতে তখন ওর জাদুদণ্ড। ম্যাকগোনাগল বললেন–তোমাদের ভাগ্য ভালো, তোমরা মারা যাওনি। তোমরা ডর্মিটরির বাইরে কেন এসেছিলে?

স্নেইপ তীব্র দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে তাকালেন। হ্যারি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারির মনে হচ্ছিল রনের জাদুদণ্ডটা নামিয়ে রাখা উচিত। শিক্ষকদের সামনে ওভাবে হাতে রাখা ঠিক নয়।

একটু পরে পেছনের অন্ধকারের মধ্য থেকে মৃদু শব্দ শোনা গেল। ম্যাকগোনাগল দয়া করে একটু শুনুন। ওরা আমাকে খুঁজছিল।

মিস গ্রেঞ্জার?

হারমিওন অবশেষে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে।

আমি ট্রলের সন্ধান করছিলাম। কারণ, আমার ধারণা ছিল আমি একাই তার সাথে লড়তে পারব। আমি তাদের ওপর অনেক পড়াশোনা করেছি।

রন তার জাদুদণ্ড নামিয়ে রাখল। হারমিওন কীভাবে শিক্ষকের সামনে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে?

আমি ভেবেছিলাম আমি ট্রলকে আটকাতে পারবো। কারণ, এই জন্তুটা সম্পর্কে অনেক বই পড়েছি। তারা যদি আমাকে খুঁজে না পেত, তাহলে এতক্ষণে আমি মারাই যেতাম। হ্যারি তার জাদুদণ্ডটা ট্রলের নাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর রন ট্রলের মুগুর দিয়েই ওর মাথায় আঘাত করেছে। তারা কোন সময় পায়নি অন্য কাউকে ডাকার।

ও–তা হলে তুমি–ই… প্রফেসর ম্যাকগোনাগল তাঁদের তিনজনের মুখ পরখ করে বললেন। মিস গ্রেঞ্জার তুমি তো এক ভীষণ বোকার মত কাজ করেছো। তুমি কী করে ভাবলে যে তুমি এই পাহাড়ি জন্তুটিকে আটকাতে পারবে।

হারমিওন তার শিক্ষকের কাছে একটা জলজ্যান্ত মিথ্যা বলল।

🔴 কিডিচ

নভেম্বর আসার সাথে সাথেই শীতের প্রকোপও বেড়ে গেল। স্কুলের চারপাশের পাহাড়গুলো বরফ জমে ধূসর রং ধারণ করেছে এবং খালের জল জমে ঠাণ্ডা ইস্পাতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকালে খেলার মাঠে বরফ জমে। ওপরের জানালা দিয়ে দেখা যায় হ্যাগ্রিড চামড়ার ওভারকোট, খরগোশের চামড়ার হাতের দস্তানা এবং চামড়ার ভারি জুতা পরে বরফ গলাবার ঝাড়ু দিয়ে কিডিচ খেলার মাঠের বরফ পরিষ্কার করছেন।

কিডিচ খেলার মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রথমবারের মত হ্যারি মাছ খেলবে। তার এক সপ্তাহ অনুশীলন শেষ। শনিবার হ্যারি প্রথমবারের মত ম্যাচ খেলবে। গ্রিফিল্ডর বনাম স্লিদারিন। হ্যারির কিডিচ খেলাটা গোপনই রাখা হয়েছে, এটা উডই চেয়েছিল। কেউ তেমন তাকে খেলতে দেখেনি। উড চেয়েছে হ্যারি হবে তাদের গোপন অস্ত্র, তার বিষয়ে অন্য কাউকে জানানো হবে না। কিন্তু যে করেই হোক সে যে সিকার হিসেবে খেলবে অন্যরা এটা জেনে গেছে এবং এই বিষয় নিয়ে কথাবার্তাও হচ্ছে। কেউ বলছে ও খুব ভাল করবে আবার কেউ কেউ বলছে ওর জন্য ম্যাট্রেস নিয়ে আসতে হবে। কারণ সে ধপাস করে পড়ে যাবে।

আসলে খুবই ভাল হয়েছে যে হ্যারি ও হারমিওন, ওরা এখন বন্ধু। হ্যারি চিন্তাই করতে পারে না হারমিওনের সাহায্য ছাড়া কিভাবে সে তার এত হোমওয়ার্ক করবে। হারমিওন হ্যারিকে কিডিচ থ্রু এইজেস নামে একটা চমৎকার বই পড়ার জন্য ধার দিয়েছে। হ্যারি বইটা থেকে জেনেছে কিডিচ খেলায় সাতশ ধরনের ফাউল হয় এবং ১৪৭৩ সালের বিশ্বকাপে এর সব ধরনের ফাউলই হয়েছিল।

জন্তুটির ঘটনার পর থেকে হারমিওন এবং রন আইন–কানুন মেনে চলার ব্যাপারে একটু শিথিল। হ্যারির প্রথম কিডিচ খেলার আগের দিন, ক্লাসের অবসরে তারা তিনজন স্কুলের প্রাঙ্গণে যায়। শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হারমিওন জাদু করে উজ্জ্বল নীল আগুনের সৃষ্টি করলো, যা একটা জ্যামের বোতলে করেও বহন করা যায়। তারা আগুনের দিকে পেছন ফিরে শরীরটাকে গরম করছিল। স্নেইপ তাদের কাছ দিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাচ্ছিলেন। আগুন জ্বালাটা নিয়মসিদ্ধ নয়। তিনি যেন আগুন না দেখতে পান সে জন্য তারা তাদের পেছন দিয়ে আগুন আড়াল করে রাখলো। ওদের মুখ ও ভাবসাব দেখে স্নেইপের সন্দেহ হয়েছে। নিশ্চয়ই কিছু গলদ আছে। তিনি আবার ফিরে এসে ওদের দিকে ভালভাবে তাকালেন। কিন্তু তিনি কোন আগুন দেখতে পাননি। কিছু না পেয়ে একটা অজুহাত তিনি খুঁজতে লাগলেন।

তোমার হাতে কি, মি. পটার?

এটা কিডিচ থ্রু এইজেস, হ্যারি বইটি দেখাল।

লাইব্রেরির বই স্কুলের বাইরে নেয়া নিষেধ। বইটা আমাকে দাও। গ্রিফিল্ডরের পাঁচ পয়েন্ট কাটা গেল।

স্নেইপ খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেলে হ্যারি রেগে গিয়ে বলল, এই নিয়ম খেয়ালখুশি মতো তার তৈরি। তাঁর পায়ে কী হয়েছে?

জানি না, তবে তাঁর পায়ের তীব্র ব্যথায় তিনি কষ্ট পেলে খুশি হবো, রন তিক্তস্বরে বলল।

সেদিন সন্ধ্যায় গ্রিফিল্ডরের কমনরুমে বেশ শোরগোল হচ্ছিল। হ্যারি, রন ও হারমিওন একটি জানালার কাছের টেবিলে বসলো। হারমিওন হ্যারি ও রনের বশীকরণ বিদ্যার হোমওয়ার্ক দেখে দিচ্ছিল। হারমিওন কখনো তার খাতা থেকে ওদের ঢুকতে দেয় না, বলতো এতে তোমরা কিছু শিখবে না। হারমিওন ওদের হোমওয়ার্ক পড়ে সংশোধন করে দিত এবং এর ফলে তাদের উত্তর সঠিক হতো।

হ্যারি কিডিচ থ্রু এইজেস বইটা ফিরে পাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়লো। স্নেইপকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে। সে যাবে তার কাছে এবং সোজাসুজি বলবে বইটা তার দরকার। হারমিওন ও রনকে বলল ওই কথাটা। তারা দুজনেই বলল, তুমিই যাও। আমরা না। সে শিক্ষকদের কামরায় গিয়ে দরজায় টোকা দিল। কোন শব্দ নেই। আবার দিল। কেউ নেই। স্নেইপতো বইটা ওখানে রেখেও যেতে পারেন। দেখা যাক ভাগ্য পরীক্ষা করে। সে দরোজাটা ধাক্কা দিয়ে ফাঁক করলো এবং এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখল।

স্নেইপ ও ফিলচ ভেতরে, মাত্র ওরা দুজন। স্নেইপের আলখেল্লা তার হাটুর ওপর তোলা, এক পা রক্তাক্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত। আর ফিলচ তার পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে।

স্নেইপ বলছিলেন, কিভাবে একজন লোক তিন মাথার চোখের প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারে?

হ্যারি সন্তর্পণে ভেতরে প্রবেশ করে দরোজা সাবধানে বন্ধ করতে যাচ্ছিল।

পটার।

স্নেইপ বিরক্তিতে তার মুখ বাঁকালেন এবং দ্রুত তার আলখেল্লা টেনে পা ঢেকে দিলেন।

আমি কি আমার বইটা ফেরত পেতে পারি।

বেরিয়ে যাও। বের হয়ে যাও।

হ্যারি দ্রুত বের হয়ে গেল যেন স্নেইপ আবার কোন পয়েন্ট কাটার সময় না পান। সে দৌড়ে ওপরে চলে গেল। খুবই সাবধানে ফিস ফিস করে রন ও হারমিওনকে সব কথা খুলে বলল।

এর অর্থ বুঝতে পারছো? কোন শ্বাস না নিয়েই সে বলল। স্নেইপ হ্যালোইনের রাতে তিন মাথা কুকুরকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতে চেয়েছিলেন। সেদিনই, যে সময় আমরা ওঁকে দেখেছিলাম ওইদিকে যাচ্ছিলেন। তিন মাথা কুকুর যা পাহারা দিচ্ছে সেটার প্রতি নজর তার। সেদিন ট্রল নামক পাহাড়ি জন্তুটিকে তিনি ছেড়ে দিয়ে সবার দৃষ্টি ওইদিকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।

হারমিওনের চোখ বড় হলো।

না–তিনি এটা করবেন না। যদিও তিনি খুব একটা ভাল লোক নন, কিন্তু ডাম্বলডোরের জিনিস চুরি করবেন বা চুরির চেষ্টা করবেন, তা হতে পারে না।

তুমি মনে করতে পারো সব শিক্ষক একেবারে দেবতা। আমার হ্যারির কথাই সঠিক মনে হচ্ছে। রন বলল।

পরেরদিন সকালটা ছিল উজ্জ্বল এবং শীতল। গ্রেট হল সসেজ ভাজার গন্ধে ম ম করছে এবং সবাই খেলাটা কেমন হবে–সেই আলোচনায় ব্যস্ত।

তোমার কিছু নাস্তা খেয়ে নেয়া দরকার।

না আমি কিছু খাব না।

কমপক্ষে টোস্ট নাও। হারমিওন বলল।

আমার কোন ক্ষিদে নাই।

হ্যারির সেদিনের খেলার চিন্তায় ক্ষুধা উধাও। সিমাস অনুরোধ করল, হ্যারি তোমাকে খেতে হবে। খেলার জন্য তোমার শক্তির দরকার।

হ্যারি সিমাসের দিকে তাকাল, দেখল, সে সসেজের ওপর কেচাপ ঢালছে, বলল ধন্যবাদ সিমাস।

সকাল এগারটার মধ্যে সবাই স্কুল মাঠে চলে এসেছে। কিডিচ পিচের চারদিকে বসার স্থানে জায়গা করে নিচ্ছে। অনেক ছাত্রের হাতে বায়নোকুলার। বসার স্থান যদিও ধাপে ধাপে ওপরের দিকে উঠেছে তবুও অনেক সময় দেখা যায় না ঠিক কি ঘটছে।

নেভিল, সিমাস ও ওয়েস্ট হামের ডীন বসেছিল একেবারে ওপরের সারিতে। রন ও হারমিওনও তাদের সাথে যোগ দিল যেন সেখান থেকে তাদের দলকে সাপোর্ট করা যায়। হ্যারি অবাকই হলো, ওদের বড় বড় ব্যানারের মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে গেছে। ওতে লেখা আছে পটার ফর প্রেসিডেন্ট এবং লেখাটার নিচে গ্রিফিল্ডারের প্রতীক সিংহ এঁকেছে ভীন। ডীন একজন ভাল আঁকিয়ে। এরপর হারমিওন ব্যানারগুলো যাদু করে নানা রঙে ভরে দিল।

হ্যারি প্রসাধন কক্ষে অন্য খেলোয়াড়দের সাথে জার্সি পরে নিল। তাদের জার্সির রঙ লাল, আর স্লিদারিন হাউজের জার্সির রঙ সবুজ।

উড গলা পরিষ্কার করে সবাইকে নীরব থাকতে বলল।

তারপর সে খেলোয়াড়দের উদ্দেশে প্রশ্ন করল–তোমরা সবাই প্রস্তুত তো?

মেয়েরা তোমরা তো প্রস্তুত। চেজার মিস অ্যাঞ্জেলিনা জনসন জানতে চাইল।

আমার মনে হয় মেয়েরাও প্রস্তুত। উড় মন্তব্য করল।

সেই বড় একজন। ফ্রেড উইসলি বলল।

সেই একজনের জন্য আমরা সবাই প্রতীক্ষা করছি। জর্জ বলল।

অলিভারের ভাষণ আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। হ্যারির উদ্দেশ্যে ফ্রেড বলল। গত বছর আমরা দলে ছিলাম।

তোমরা দুজন চুপ করো। উড ধমক দিল।

গুডলাক। উড খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বলল।

খেলার প্রস্তুতি নিয়ে হ্যারি, ফ্রেড ও জর্জের অনুসরণ করল। হ্যারির মনে আশংকা ছিল–খেলার সময় তার হাঁটু তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মাদাম তুচ হলেন এ খেলার রেফারি। তিনি ঝাড়ু হাতে নিয়ে মাঠে উপস্থিত হলেন। তার দুদিকে দুদল দাঁড়াল।

তিনি খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে বললেন–আমি তোমাদের কাছ থেকে একটি স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন খেলা দেখতে চাই।

মাদাম হুচ খেলার সূচনা করলেন–তোমরা তোমাদের ঝাড়ুর ওপর উঠে পড়ো।

হ্যারি নিম্বাস ২০০০ ঝাড়ুর ওপর উঠল।

মাদাম হুচ তার রূপালী বাঁশি বাজালেন।

পনেরটা ঝাড়ুকে ওপরে উঠতে দেখা গেল।

গ্রিফিল্ডর হাউজের অ্যাঞ্জেলিনা জনসনের হাতে কুয়াফল।

দেখতে সুন্দর এই মেয়েটি ভাল ধাওয়া করতে পারে…

উইসলি যমজ ভাইদের একজন লী জর্ডান খেলার ধারা বিবরণী দিচ্ছিল।

জর্ডান?

তার ওপর সবসময় নজর রাখছিলেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল।

দুঃখিত প্রফেসর।

এবার পরিষ্কার পাস দেয়া হলো এলিসিয়াস্পিনেটকে। সে উডের প্রিয় ছাত্রী। গত বছর সে রিজার্ভে ছিল। বল আবার জনসনের কাছে। না না। এবার বল স্লিদারিন হাউজের দখলে। বলটা চলে গেছে ওদের অধিনায়ক মার্কাস ফ্রিন্টের কাছে। ঈগলের মত উড়ে চলেছে সে। এই বুঝি সে স্কোর করবে। না হলো না। গ্রিফিল্ডর হাউজের কিপার উড় ঝাঁপ দিয়ে বলটি ধরে ফেলেছে। চেজার কেটি বেল এগিয়ে যাচ্ছে। বল অবার অ্যাঞ্জেলিনার হাতে। স্লিদারিন হাউজের কিপার ব্লেচলি ঝাঁপ দিল। না বলটি সে ধরতে পারেনি। গ্রিফিল্ডর হাউজ স্কোরটি করল।

চারদিকে বিপুল হর্ষধ্বনি।

আনন্দে হ্যাগ্রিড রন ও হারমিওনকে জড়িয়ে ধরলেন।

অ্যাঞ্জেলিনা স্কোর করার পর থেকেই হ্যারি মিচের ওপর নজর রাখছিল। হ্যারি বল নিয়ে তীরবেগে এগোচ্ছে। একজন ব্লুজার বাধা হয়ে পঁড়ালেও মাথা নত করে হ্যারি তা এড়িয়ে গেল। কেউ তাকে রুখতে পারছে না। কি করবে চেজারও বুঝে উঠতে পারছে না।

ওরা মাঝ শূন্যে উড়ছে।

হ্যারি অবশ্য হিগসের চেয়েও দ্রুতগামী।

বল এবার গোলার মত ছুটে আসছে।

ধাম।

গ্রিফিল্ডর হাউজ চিৎকার করে উঠল—ফাউল।

মাদাম হুচ শটের নির্দেশ দিলেন।

স্নিচ আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। গ্যালারির মধ্য থেকে টমাস চিৎকার করে উঠল–তাকে লাল কার্ড দেখানো হোক।

রন বলল-এটা তো ফুটবল খেলা নয়। এখানে লালকার্ডের কোন নিয়ম নেই।

হ্যাগ্রিড বললেন–খেলার তো কিছু নিয়ম–কানুন আছে। ফ্লিন্ট হ্যারিকে আকাশে ধাক্কা দিয়েছে। লি জর্ডান বলল-এটা খুব খারাপ। এক ধরনের ধোকাবাজি।

ম্যাকগোনাগল জর্ডানকে ধমক দিলেন।

জর্ডান বলল–ওটা তো ফাউল ছিল। তিনি নিরপেক্ষ হতে পারছিলেন না।

অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–জর্ডান, আমি তোমাকে আবার হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।

খেলা জমে উঠল। হ্যারি একজন ব্লুজারকে কাটিয়ে গেল। ঝাড়ুর আঘাত থেকে রুজারের মাথাটা কোনভাবে বেঁচে গেল। হ্যারিও কিছুটা আঘাত পেয়েছে। এই রকম ঘটনা আবারও ঘটল। হ্যারির ঝাড়ু নিম্বাস ২০০০ খুব স্বাভাবিকভাবেই আকাশে উড়ছে। এবার বল গ্রিফিল্ডারদের গোলপোস্টে। হ্যারি কিপার উডকে সতর্ক করে দিল। ওরা একটু আঁকা বাকাভাবে উড়ছে। দারুন শব্দ হচ্ছে।

জর্ডান খেলার ধারাভাষ্য বর্ণনা করে চলেছে।

খেলার ভেতর কেউ লক্ষ্য করল না যে, হ্যারির ঝাড়ু অদ্ভুত আচরণ করছে। ঝাড়ুটা তাকে ধীরে ধীরে খেলার বাইরে ওপর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ঠিক বুঝতে পারছি না, হ্যারি কী করছে। বাইনোকুলার দিয়ে খেলা দেখতে দেখতে হ্যাগ্রিড এই মন্তব্য করলেন।

হ্যাগ্রিড বলে চললেন–আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে হ্যারি ঝড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা তো কখনোই হতে পারে না। একমাত্র শক্তিশালী জাদু ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।

এবার সবার নজর হ্যারির ওপর পড়ল। দেখা গেল তার ঝাড়ু কোন কাজ করছে না। মাঝে মাঝে ঝাঁকুনিতে হ্যারির ঝাড়ুর শলা পড়ে যাচ্ছে। সে কোনমতে একহাতে ঝাড়ুটা ধরে রেখেছে।

কোন কিছু কি ঘটেছে? সিমাস প্রশ্ন করল।

হারমিওন হ্যাগ্রিডের কাছ থেকে বাইনোকুলারটি নিয়ে খেলা দেখতে লাগল। তার দৃষ্টি হ্যারির ওপর না পড়ে পড়ল জনতার ওপর। হতাশ কণ্ঠে রন জিজ্ঞেস করল–তুমি এখন কী করতে চাচেছা?

আমি জানি এটা স্নেইপের কারসাজি।

রন বাইনোকুলার হাতে নিয়ে দেখল, তারা যেখানে বসেছিল ঠিক তার বিপরীত দিকে অধ্যাপক স্নেইপ দাঁড়িয়ে আছেন। আর তার দৃষ্টি হ্যারির ওপর নিবদ্ধ। তিনি অনর্গল কথা বলে চলেছেন।

সে ঝাড়ুর ওপর জাদুবিদ্যা খাটাচ্ছে। আমরা এখন কী করব? হারমিওন বলে উঠল।

আমরা তাহলে কী করতে পারি।

সেটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।

রন কিছু বলার আগেই হারমিওন অদৃশ্য হয়ে গেল। রন বাইনোকুলার নিয়ে আবার হ্যারির দিকে তাকাল। তার ঝুড়িটা এত কাপছিল যে এটার ওপর বসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। উইসলি যমজভাই ওপরে উড়ে গিয়ে হ্যারিকে নিরাপদে ঝড়ির ওপর আনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। যতবারই তারা হ্যারির কাছাকাছি গেছে ততবারই ঝাড়ু ওপরে উঠে তাদের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। তারা নিচে নেমে চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। তাদের প্রত্যাশা ছিল হ্যারি নিচে নামলে তারা তাকে ধরে ফেলবে। এই সুযোগে মার্কাস ফ্লিন্ট কুয়াফলটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে পাঁচ বার স্কোর করে ফেলল।

হারমিওন, এখানে চলে এসো। রন বেপরোয়া হয়ে তাকে ডাকল। স্নেইপ যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন হারমিওন দৌড়ে গিয়ে তার পেছনের সারিতে দাঁড়াল। স্নেইপের কাছে গিয়ে সে তার জাদুদ বের করল, কয়েকটা নির্বাচিত শব্দ উচ্চারণ করল, উজ্জ্বল নীল শিখা তার জাদুদণ্ড থেকে বেরিয়ে স্নেইপের পোশাক স্পর্শ করল।

সমস্ত ঘটনা ঘটতে তিরিশ সেকেন্ডের বেশি সময় নিল না। সেই বুঝতে পারলেন তার জামায় আগুন লেগেছে। তিনি চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন। হারমিওন আবার জাদুদণ্ডে ফুঁ দিল। পকেট থেকে একটা ছোট পাত্র বের করে সব আগুন পাত্রের ভেতর ঢোকাল। পাত্রটি নিয়ে সে এমনভাবে উধাও হল যে, তাকে খুঁজে বের করা স্নেইপের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হলো না। এতক্ষণে শূন্যে হ্যারি নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। ঝাড়ুর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ফিরে এল।

নেভিল এবার তাকিয়ে দেখ। রন বলল। নেতি প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে হাগ্রিডের জ্যাকেটে মুখ রেখে কাঁদছিল।

হ্যারি এবার দ্রুতগতিতে ভূমির দিকে এগোচ্ছে।

দর্শকরা দেখল–হ্যারি তার দুহাত মুখের ওপর রাখল। মনে হলো সে অসুস্থ। সে চারদিকে আঘাত করল। এরপর কাশল। সোনা জাতীয় একটা বস্তু তার হাতে এসে পড়ল।

আমি এবার স্নিচকে হাতে পেয়েছি। বস্তুটা মাথার ওপর তুলে হ্যারি চিৎকার করে উঠল। খেলাটা বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে শেষ হলো।

সে তো এটা লুফে নেয়নি। সে তা বলতে গেলে এটা গিলে ফেলেছে। বিশ মিনিট ধরে ফ্লিন্ট এ নিয়ে খুব হইচই করল। এতে কোন ফল হলো না। কারণ হ্যারি কোন নিয়ম ভঙ্গ করেনি। আর লী জর্ডানও তার ধারাভাষ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। খেলাশেষে গ্রিফিল্ডর হাউজ পেল ১৭০ পয়েন্ট আর স্লিদারিন হাউজ পেল মাত্র আট পয়েন্ট। হ্যারি এসবের কোন খবর পায়নি।

বিকেল বেলা হ্যাগ্রিড, হ্যারি, রন আর হারমিওনকে চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।

রন বলল-এসব কিছুর জন্য স্নেইপই দায়ী। হারমিওন আর আমি দেখলাম তিনি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন আর তাঁর দৃষ্টি তোমার ওপর নিবদ্ধ।

যতসব বাজে কথা। হ্যাগ্রিড বললেন।

হ্যারি, রন ও হারমিওন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল তারা স্নেইপ সম্পর্কে কী বলবে। হ্যারি সত্য কথা বলাটাই ঠিক মনে করল আমি তাঁর সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছি। হ্যারি হাগ্রিডের উদ্দেশে বলল–তিনি হ্যালোইনে তিন মাথাওয়ালা কুকুরটাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কুকুরটা তাকে কামড় দেয়। আমার ধারণা তিনি সবকিছুই চুরি করতে চেয়েছিলেন যা কুকুরটা পাহারা দিচ্ছিল।

হ্যাগ্রিড হ্যারিকে প্রশ্ন করলেন–তুমি কি ফ্লাফি সম্পর্কে কিছু জানো?

ফ্লাফি? হ্যারি অবাক হয়ে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে।

ফ্লাফি হল সেই কুকুরটার নাম। আমি এ কুকুরটা একজন গ্রীক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে ডাম্বলডোরকে দিয়েছি।

তারপর? হ্যারি জানতে চাইল।

আর জিজ্ঞেস করো না। এটা অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়।

এবার হারমিওন চিৎকার করে জানতে চাইল–তাহলে তিনি কেন হ্যারিকে খুন করতে চাইবেন?

হ্যাগ্রিড রেগে গিয়ে বললেন–তোমরা ভুল করছ। আমি জানি না, হ্যারির ঝাড়ু কেন এমন করল। কিন্তু স্নেইপ কখনোই তার একজন ছাত্রকে খুন করবেন না। তোমরা তিনজনের এমন ভাবাই উচিত নয়। তোমরা কুকুরটার কথা ভুলে যাও। কুকুরটা কী পাহারা দিচ্ছে সেটা নিয়ে তোমাদের মাথাব্যথার কোন কারণ নেই। এটা ডাম্বলডোর আর নিকোলাস ফ্লামেলের ব্যাপার। ওহ তাই হ্যারি বলল। তাহলে নিকোলাস ফ্লামেল নামক কেউ এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।

এখানে ফ্লামেল নামে কেউ আছেন কি? হ্যাগ্রিডের মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন