পদ্মাপাড় - জসীমউদ্দিন


পদ্মাপাড় - জসীমউদ্দিন 

🔷 আমার খোদারে দেখিয়াছি আমি 🔷

.

আমার খোদারে দেখিয়াছি আমি

গরীবের কুঁড়ে ঘরে,

দীন দুঃখীর নয়নের জল

যেথায় অঝোরে ঝরে।

অথ্যাচারীর পীড়নের ঘায়,

কত ব্যথাতুর কাদে নিরালায়;

তাদের অশ্রু গড়ায়ে পড়িছে

খোদার মাটির পরে।


তাইত আমরা পড়িনে নামাজ

একা ঘরে নির্জনে,

লোকালয়ে মোরা মসজিদ গড়ি

সব ভাই একাসনে;


জায়নামাজের পাটি আমাদের,

আকাশের চেয়ে বিসতৃত ঢের,

তাই ত আকাশ লুটায়েছে ছের

দুনিয়া মসজিদ ঘরে।

.

🔷 ও তোর নাম শুনিয়ারে 🔷

.

ও তোর নাম শুনিয়ারে,

ও তোর রূপ দেখিয়ারে,

ও তোর ডাক শুনিয়ারে,

ও তোর ভাব জানিয়ারে,

সোনা, আমার মন ত

না রয় ঘরেরে।


সাগরে উঠিয়া ঢেউ কূলে আইসা পড়ে,

কূল নাই, কিনারা নাই কুল-কলঙ্কিনীর তরে;

কান্দিয়া কান্দাব বন্ধু! এমন দোসর নাই,

আমি সাজায়ে ব্যথার চিতা নিজ হাতে জ্বালাইরে।


তুমিত জানিতে বন্ধু প্রেমের কত জ্বালা,

তবে কেন পরিলে গলে আমার ফুলের মালা;

তবে কেন কদম্বতলে বাঁশরী বাজালে,

কিবা অপরাধে বন্ধু, অবলা বধিলে।

.

🔷 ও বাজান চল যাই চল 🔷

.

ও বাজান, চল, যাই চল

মাঠে লাঙল বাইতে,

গরুর কাঁধে লাঙল দিয়া

ঠেলতে ঠেলতে ঠেলতে।

মোরা লাঙল খুঁড়ে ফসল আনি

পাতাল পাথার হইতে,

সব দুনিয়ার আহার জোগাই

সেই না ফসল হইতে,

আর আমরা কেন খাইতে না পাই

পারো কি কেউ কইতে।


বউ দিয়াছে গলায় দড়ি সাতদিন না খাইতে,

ভুখের জ্বালা সইতে, কবরখানায় রইতে;

এবার লাঙর দিয়ে খুঁড়ি মাটি তারি দেখা পাইতে।

মোরা, মাঠ চিরি ভাই! লাঙল দিয়ে,

মোদের বুক চেরা তার চাইতে,

মাঠ চিরিলে ফসল ফলে,

ও ফসল ফলে না বুক হইতে।

এবার মাটি খুঁড়বরে ভাই, ফসল নাহি পাইতে,

ও মাটি খুঁড়ে দেখব আর কতদূর কবরখানায় যাইতে।

.

🔷 ও বাবু সেলাম বারে বার 🔷

.

ও বাবু সেলাম বারে বার,

আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু,

বাড়ি পদ্মা পার।

মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা

পঙ্কি বেইচা খাই-

মোদের সুখের সীমা নাই,

সাপের মাথার মণি লয়ে মোরা

করি যে কারবার।


এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি মোরা

আরেক ঘাটে খাই,

মোদের বাড়ি ঘর নাই;

সব দুনিয়া বাড়ি মোদের

সকল মানুষ ভাই;

মোরা, সেই ভায়েরে তালাশ করি আজি

ফিরি দ্বারে দ্বারে;

বাবু সেলাম বারে বার।

.

🔷 কে যাসরে রঙিলা মাঝি 🔷

.

কে যাসরে রঙিলা মাঝি! সামের আকাশরে দিয়া;

আমার বাজানরে বলিস খবর নাইওরের লাগিয়ারে।

অভাগিনীর বুকের নিশ্বাস পালে নাও ভরিয়া,

ছয়মাসের পন্থ যাইবা একদন্ডে উড়িয়া;

গলুইতে লিখিলাম লেখন সিন্তার সিন্দুর দিয়া,

আমার বাপের দেশে দিয়া আইস গিয়ারে।


পরবাসে পাঠাইল বাজান যারে সঁইপা দিয়া,

সে যে শিশিরের গয়না দিল দূর্বাশীষে নিয়া;

কুয়াশার শাড়ী দিল বাতাসে ভরিয়া

অঙ্গে না পরিতে তাহা গেল যে উড়িয়ারে।


সাগরের ফেনায় পতি বানল বাসর-ঘর,

দুস্কের দাগাতে তাহা দাপায় জনমভর;

অবলা ভাঁরাইল যে সে কাঞ্চা পিতল দিয়া,

এমন ঠকের ঘরে রহি কি করিয়ারে।


পরের ছেলের সঙ্গে বাজান আমায় দিল বিয়া,

জনমের মত গেল বনবাস দিয়া;

একদিনের তরে আইসা না গ্যাল দেখিয়া,

এবার জুড়াইব মনের দুস্কু সায়রে ডুবিয়ারে।

.

🔷 সোনার বরনী কন্যা 🔷

.

সোনার বরণী কন্যা সাজে নানা রঙ্গে,

কালো মেঘ যেন সাজিলরে।

সিনান করিতে কন্যা হেলে দুলে যায়,

নদীর ঘাটেতে এসে ইতি উতি চায়।

বাতাসে উড়িছে শাড়ী, ঘুরাইয়া চোখ,

শাসাইল তারে করি কৃত্রিম রোখ।

হলুদ মাখিয়া কন্যা নামে যমুনায়,

অঙ্গ হলুদ হইয়া জলে ভাইসা যায়।

ডুবাইয়া দেহ জলে থাকে চুপ করে,

জল ছুঁড়ে মারে কভু আকাশের পরে।

খাড়ু জলে নাইমা কন্যা খাড়ুমাঞ্জন করে,

আকাশের রামধনু হেলেঢুলে পড়ে।


তারপরে বাহু দুটি মেলে জলধারে,

ঘুরাইল ফিরাইল কত লীলাভরে।

বাহু দুটি মাজে কন্যা অতি কৌতুহলে,

খসিয়া পড়িছে রূপ সোনালিয়া জলে।

অঞ্জলি পরি জল অধরে ছুঁড়িছে,

জলন্ত অঙ্গার হতে ফুলকি উড়িছে।

খুলিয়া কুন্তলভার ছড়াইল জলে,

আকাশ নামিল যেন সমুদ্দুরের কোলে।

দু-হাত বিধায়ে চুলে যত মাঞ্জন করে,

মেঘেতে বিজলী যেন ফেরে লীলাভরে।

গলা জলে নেমে কন্যা গলা মাঞ্জন করে,

ঢেউগুলি টলমল মালার ফুলের

কর্ণফুলের ভূষণ লয়ে কোন ঢেউ

খোঁপার কুসুম লোভে কেউ হাসে গায়

সিনান করিয়া কন্যা উঠে জল হতে,

তরল লাবনী ধারা ঝরে অঙ্গ স্রোতে।

.

🔺সমাপ্ত 🔻

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন