কবিতাসমগ্র
তসলিমা নাসরিন
তসলিমা নাসরিন
কসুম কুসুম জীবনে দাড়িয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রতিবাদে যারা গলা ফাটায়, অচিরেই তারা হয়ে ওঠে হাস্যকর। তসলিমা নাসরিনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। নারীর যথার্থ স্বাধীনতার দাবিতে তিনি সম্পূর্ণ ঝাপিয়েছেন। মেধা নিয়ে, শিল্প নিয়ে, হিংস্র শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি আঙুল তুলবার সাহস নিয়ে। আর রক্তাক্ত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, শেষ পর্যন্ত জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিতও হয়েছেন। ক্রমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তসলিমা নাসরিন আজ শ্রদ্ধেয়, সাহসী, প্রখর এক নারী। এই তসলিমার সাহিত্যজীবনের শুরু কবিতা রচনায়। কবিতাই তার প্রথম ভালবাসা। ব্যতিক্রমী এক যুবতীর নানারকম আগুনের ভেতর দিয়ে ক্রমশ পরিণত বয়সে পৌঁছে যাওয়ার ইতিহাসই যেন ধরা পড়েছে অজস্র কবিতায়। ‘তসলিমা নাসরিনের কবিতাসমগ্র’ যেন তারই ঝঞায় ভরা জীবনের রাগ, ঘৃণা, ভালবাসা, স্বপ্নেরই বড় খােলাখুলি প্রকাশ। শুরুর কাব্যগ্রন্থ “শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’-তেই যেমন উদ্ভাসিত তার আকুলিবিকুলি শরীর-তৃষ্ণার ইনসােমনিয়ায় অনন্ত সময় ধরে তুমি জেগে আছাে একা/ আমার মফিয়া নাও/ ঘুমাও মানিকসােনা ঘুমাও ঘুমাও’– তেমনই নিপীড়িত নারীদের পক্ষে সাহসী শ্লোক— যুদ্ধে বীরাঙ্গনা নারী স্বাধীন স্বদেশে তার পেলাে না। সমাজ/ তার তাে গর্বিত কণ্ঠে ধর্ষিতা হবার গল্প শােনানাের কথা। প্রেম ও প্রতিবাদ—দু’ক্ষেত্রেই অনন্য তসলিমা। আপাতত শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘কিছুক্ষণ থাকো’-তে ভালবাসার জন্য লিখেছেন—“তােমার স্পর্শে যদি এ শরীর জাগে,/ তুমি যে হও সে হও, কোনও দ্বিধা নেই, শােব।'—আর পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ নারীর গলায় বলেছেন—বােকারা এখন চুষতে থাক যার যার দ্বিগ্বিজয়ী অঙ্গ... শত সহস্র বছর তুমি ভাল ছিলে মেয়ে, এবার একটু মন্দ হও'। মার-খাওয়া মানুষের মতােই তসলিমার চিৎকার একটু বেশি, কিন্তু এই নির্বাসিত কবি যখন স্বদেশে ফিরতে না-পারার যন্ত্রণায় লেখেন—‘মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে ক'ফোটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের, যেন গােলপুকুরপাড়ের বাড়ির টিনের চালে একবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে’– পাঠক নিশ্চিত আক্রান্ত হবেন এক অভূতপূর্ব আবেগে। জীবন আর কবিতা কবে যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তসলিমার।