খাটুলি
একলা হােথায় বসে আছে, কেই বা জানে ওকে—
আপন-ভােলা সহজ তৃপ্তি রয়েছে ওর চোখে।
খাটুলিটা বাইরে এনে আঙিনাটার কোণে
টানছে তামাক বসে আপন-মনে।
মাথার উপর বটের ছায়া, পিছন দিকে নদী
বইছে নিরবধি।
আয়ােজনের বালাই নেইকো ঘরে,
আমের কাঠের নড়্ নড়ে এক তক্তপােষের ’পরে
মাঝখানেতে আছে কেবল পাতা
বিধবা তার মেয়ের হাতের শেলাই-করা কাঁথা।
নাৎনি গেছে, রাখে তারি পােষা ময়নাটাকে—
তেমনি কচি গলায় ওকে ‘দাদু’ ব’লেই ডাকে।
ছেলের গাঁথা ঘরের দেয়াল, চিহ্ন আছে তারি
রঙিন মাটি দিয়ে আঁকা সিপাই সারি সারি।
সেই ছেলেটাই তালুকদারের সর্দারি পক্ষ পয়ে
জেলখানাতে মরছে পচে দাঙ্গা করতে যেয়ে।
দুঃখ অনেক পেয়েছে ও, হয়তাে ডুবছে নােয়,
হয়তাে ক্ষতি হয়ে গেছে তিসির বেচা-কেনায়।
বাইরে দারিদ্র্যের
কাটা-ছেঁড়ার আঁচড় লাগে ঢের,
তবুও তার ভিতর-মনে দাগ পড়ে না বেশি,
প্রাণটা যেমন কঠিন তেমনি কঠিন মাংসপেশী ।
হয়তো গােরু বেচতে হবে মেয়ের বিয়ের দায়ে,
মাসে দুবার ম্যালেরিয়া কাঁপন লাগায় গায়ে,
ডাগর ছেলে চাকরি করতে গঙ্গাপারের দেশে
হয়তাে হঠাৎ মারা গেছে ঐ বছরের শেষে—
শুকনাে করুণ চক্ষু দুটো তুলে উপর-পানে
কার খেলা এই দুঃখসুখের, কী ভাবলে সেই জানে।
বিচ্ছেদ নেই খাটুনিতে, শশাকের পায় না ফাঁক—
ভাবতে পারে স্পষ্ট ক’রে নেইকো এমন বাক্।
জমিদারের কাছারিতে নালিশ করতে এসে
কী বলবে যে কেমন ক’রে পায় না ভেবে শেষে।
খাটুলিতে এসে বসে যখনি পায় ছুটি,
ভাব্নাগুলাে ধোঁওয়ায় মেলায়, ধোঁওয়ায় ওঠে ফুটি।
ওর যে আছে খোলা আকাশ, ওর যে মাথার কাছে
শিষ দিয়ে যায় বুলবুলিরা আলােছায়ার নাচে,
নদীর ধারে মেঠো পথে টাট্টু চলে ছুটে,
চক্ষু ভােলায় ক্ষেতের ফসল রঙের হরির-লুটে—
জন্মমরণ ব্যেপে আছে এরা প্রাণের ধন
অতি সহজ বলেই তাহা জানে না ওর মন।
জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪
আলমােড়া