হৃদপিণ্ড ফেরত দাও
ফরহাদ মজহার
স্মৃতির আম্মা, জগৎতারিনী জননী, আমি তোমার দ্বারে হাজির
তোমার আঁচলেই গচ্ছিত আমার শেষ রাতের প্রত্যাবর্তন
শহরে রেস্তোরাঁর চুল্লিগুলো নিভে গিয়েছে অনেক আগেই
বাড়তি তরকারিগুলো তুলে রাখা হয়েছে ফ্রিজে। কুকুরগুলো
সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষার পর ফেলে দেওয়া হাড়মাংসের আশায়
লেজ নাড়ছে বৃষ্টিতে। আমি শ্রাবণের রাতে ফিরে এসেছি জননী
কোথায় যাব আর? এখন ভাঙা ঘরে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে
এসেছি তোমার কাছেই। আমার হৃদপিণ্ডটি ফেরত দাও, মা জননী।
হ্যাঁ, দেখেছি সর্বস্বান্ত মাতালকে, সদর রাস্তার ক্ষীণকটি ল্যাম্পপোস্ট
জড়িয়ে ধরে আছে। রোজ কেয়ামতের আগে এই তার শেষ লভ্য নারী
সাপের মতো শীর্ণ তার শরীর, যেন এই মাত্র পুরুষ সরিসৃপ খোলস বদলালো।
উন্নয়নের চোটে লুট হয়ে যাওয়া ধর্ষিত ব্যাংকগুলো ভূতের মতো দাঁড়ানো
তাদের ভল্টে বাসা বেঁধেছে ইঁদুরদের গভর্নর। নিজ নিজ আবাসগুলো
পেয়ে যাছে সকলেই, ঠিকানাগুলো পরিষ্কার, শুধু আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি
ঘরছাড়া উন্মূল উদ্বাস্তু নাম-সাকিনবিহীন। আম্মা, প্লিজ, হৃদপিণ্ড ফেরত দাও।
এই নাও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট। আমার শহীদ হওয়া লাশের হাড়গোড়
এই নাও আমার বাহাদুর আইডেন্টিটি কার্ড, সেখানে কি আমার নাম নেই?
আমি কি আমার বাবার নাম ভুল লিখেছি? কোথাও কি বানান ভুল হলো?
কিন্তু তুমি জানো কোথা থেকে পেয়েছ এই বীজ। হে জননী, সাক্ষী হও
বল, কেন তাকে জন্ম দিয়েছিলে? কেন আমাকে খুইয়ে ফেলেছ রাস্তায়?
কেন আমি দ্বিতীয়বার শহীদ হলাম? কেন নিজের গুম হওয়া লাশ আমাকে
নিজেই বহন করতে হচ্ছে? কেন আমার বক্ষভেদ করে গুলি? কেন পুলিশ?
কেন হাতুড়ি? কেন হেলমেট? আম্মা, প্লিজ আম্মা, হৃদপিণ্ড ফেরত দাও।
স্মৃতির জননী, কীভাবে এখন বাড়ি যাবো? কে বহন করবে ইতিহাসের কফিন?
কে এই দুঃসময়ে বেওয়ারিশ লাশের ভাড়া খাটবে? দোকানপাট বেচাকেনা বন্ধ
লকডাউন। শেষ রাতে পুরা শহর মনে হচ্ছে যুদ্ধে বিধ্বস্ত নগরী। শুধু আমি
বৃষ্টিতে হাঁটছি। আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে স্মৃতি। বিষন্ন চাঁদ
আটকে গিয়েছে মাকড়সার জালে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। আমি
একটি নক্ষত্র লক্ষ্য করে গন্তব্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আকাশ
পুলিশের বেনজির গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে আছে। নভোমণ্ডলে ছোট ছোট গর্ত
সেখান থেকে ঝরছে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত। আম্মা, হৃদপিণ্ড ফিরিয়ে দে, আমি মরব।