চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় [সম্পূর্ণ বই] [১০ম- ১৪তম পর্ব]

  1.  চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় [সম্পূর্ণ বই] [১ম-৭ম পর্ব]
  2. চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় [সম্পূর্ণ বই] [৮ম-৯বম পর্ব]

দশ

সে দিন সে রাত্রিও কেটে গেল। শঙ্কর এখন দুঃসাহসে মরীয়া হয়ে উঠেচে। যদি তাকে প্রাণ নিয়ে এ ভীষণ অরণ্য থেকে উদ্ধার পেতে হয়, তবে তাকে ভয় পেলে চলবে না। দুদিন সে কোথাও না গিয়ে তাঁবুতে বসে মন স্থির করে ভাববার চেষ্টা করলে, সে এখন কি করবে। হঠাৎ তার মনে হোল, আলভারেজের সেই কথাটা - সলসবেরি...এখান থেকে পূব-দক্ষিণ কোণে আন্দাজ ছশো মাইল...

সলসবেরি।...দক্ষিণ রোডেশিয়ার রাজধাণী সলসবেরি। যে করে হোক, পৌঁছুতেই হবে তাকে সলসবেরিতে। সে এখনও অনেকদিন বাঁচবে, তার জন্মকোষ্ঠীতে লেখা আছে। এ জায়গায় বেঘোরে সে মরবে না।

চাঁদের পাহাড়122.jpg

শঙ্কর ম্যাপগুলো খুব ভালো করে দেখলে। পর্টুগিজ গবর্ণমেণ্টের ফরেষ্ট সার্ভের ম্যাপ, ১৮৭৩ সালের রয়েল মেরিন সার্ভের তৈরী উপকূলের ম্যাপ, ভ্রমণকারী স্যার ফিলিপো ডি ফিলিপির ম্যাপ, এ বাদে আলভারেজের হাতে আঁকা ও জিম কার্টারের সইযুক্ত একখানা জীর্ণ, বিবর্ণ খসড়া নক্সা। আলভারেজ বেঁচে থাকতে সে এই সব ম্যাপ বুঝতে একবারও ভাল করে চেষ্টা করেনি, এখন এদের বোঝার ওপর তার জীবন মরণ নির্ভর করচে। সলসবেরির সোজা রাস্তা বার করতে হবে। এ স্থান থেকে তার অবস্থিতি রিন্দুর দিক নির্ণয় করতে হবে, রিখটারসভেল্ড অরণ্যের এ গোলোক ধাঁধা থেকে তাকে উদ্ধার পেতে হবে - সবই এই ম্যাপগুলির সাহায্যে।

অনেক দেখবার শুনবার পরে ও বুঝতে পারলে এই অরণ্য ও পর্ব্বতমালার সম্বন্ধে কোনো ম্যাপেই বিশেষ কিছুই দেওয়া নেই - এক আলভারেজের ও জিম কার্টারের খসড়া ম্যাপখানা ছাড়া। তাও এত সংক্ষিপ্ত এবং তাতে এত সাঙ্কেতিক ও গুপ্তচিহ্ন ব্যবহার করা হয়েচে যে, শঙ্করের পক্ষে তা প্রায় দুর্ব্বোধ্য। কারণ এদের সব সময়েই ভয় ছিল যে ম্যাপ অপরের হাতে পড়লে, পাছে আর কেউ এসে ওদের ধণে ভাগ বসায়।

চতুর্থ দিন শঙ্কর সে স্থান ত্যাগ করে আন্দাজ মত পূবদিকে রওনা হোল। যাবার আগে কিছু বনের ফুলের মালা গেঁথে আলভারেজের সমাধির ওপর অর্পণ করলে।

‘বুশ ক্র্যাফট’ বলে একটা জিনিষ আছে। সুবিস্তীর্ণ, বিজন, গহন অরণ্যানীর মধ্যে ভ্রমণ করবার সময়ে এ বিদ্যা জানা না থাকলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আলভারেজের সঙ্গে এতদিন ঘোরাঘুরি করার ফলে, শঙ্কর কিছু কিছু ‘বুশ ক্র্যাফট’ শিখে নিয়েছিল, তবুও তার মনে সন্দেহ হোল যে, এই বন একা পাড়ি দেবার যোগ্যতা সে কি অর্জ্জন করেচে? শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে তাকে চলতে হবে, ভাগ্য ভাল হয় বন পার হতে পারবে, ভাগ্য প্রসন্ন না হয় - মৃত্যু।

দুটো তিনটে ছোট পাহাড় সে পার হয়ে চলল। বন কখনো গভীর,কখনো পাতলা। কিন্তু বৃহৎ বৃহৎ বনস্পতির আর শেষ নেই। শঙ্করের জানা ছিল যে, দীর্ঘ এলিফ্যাণ্ট ঘাসের জঙ্গল এলে বুঝতে হবে যে বনের প্রান্তসীমায় পৌছানো গিয়েচে। কারণ গভীর জঙ্গলে কখনো এলিফ্যাণ্ট বা টুসক্ ঘাস জন্মায় না। এলিফ্যাণ্ট ঘাসের চিহ্ন নেই কোনোদিকে - শুধুই বনস্পতি আর নীচু বনঝোপ।

প্রথম দিন শেষ হোল এক নিবিড়তর অরণ্যের মধ্যে। শঙ্কর জিনিসপত্র প্রায় সবই ফেলে দিয়ে এসেছিল, কেবল আলভারেজের মানলিকার রাইফেলটা, অনেকগুলো টোটা, জলের বোতল, টর্চ্চ, ম্যাপগুলো, কম্পাস, ঘড়ি, একখানা কম্বল ও সামান্য কিছু ঔষধ সঙ্গে নিয়েছিল — আর নিয়েছিল একটা দড়ির দোলনা। তাঁবুটা যদিও খুব হালকা ছিল, কিন্তু তা সে বয়ে আনা অসম্ভব বিবেচনায় ফেলেই এসেচে।

দুটো গাছের ডালে মাটী থেকে অনেকটা উঁচুতে সে দড়ির দোলনা টাঙালে এবং হিংস্র জন্তুর ভয়ে গাছতলায় আগুন জ্বালালে। দোলনায় শুয়ে বন্দুক হাতে জেগে রইল কারণ ঘুম অসম্ভব একে ভয়ানক মশা, তার ওপর সন্ধ্যার পর থেকে গাছতলার কিছুদূর দিয়ে একটা চিতাবাঘ যাতায়াত সুরু করলে। গভীর অন্ধকারে তার চোখ জ্বলে যেন দুটো আগুনের ভাঁটা, শঙ্কর টর্চ্চের আলো ফেলে, পালিয়ে যায়, আবার আধঘণ্টা পরে ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে। শঙ্করের ভয় হোল, ঘুমিয়ে পড়লে হয়তো বা লাফ দিয়ে দোলনায় উঠে আক্রমণ করবে। চিতাবাঘ অতি ধূর্ত্ত জানোয়ার। কাজেই সারারাত্রি শঙ্কর চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। তার ওপর চারিধারে নানা বন্য-জন্তুর রব। একবার একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ কাছেই কোথাও একদল বালকবালিকার খিলখিল হাসির রবে তন্দ্রা ছুটে গিয়ে ও চমকে জেগে উঠল। ছেলেমেয়েরা হাসে কোথায়? এই জনমানবহীন অরণ্যে বালকবালিকাদের যাতায়াত করা বা এত রাত্রে হাসা উচিত নয় তো? পরক্ষণেই তার মনে পড়ল একজাতীয় বেবুনের ডাক ঠিক ছেলেপুলের হাসির মত শোনায়, আলভারেজ একবার গল্প করেছিল। প্রভাতে সে গাছ থেকে নেমে রওনা হোল। বৈমানিকরা যাকে বলেন 'ফ্লাইঙ্গি ব্লাইণ্ড' - সে সেইভাবে বনের মধ্য দিয়ে চলচে, সম্পুর্ণ ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে, দু চোখ বুঁজে। এই দুদিন চলেই সে সম্পূর্ণভাবে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েচে - আর তার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম জ্ঞান নেই। সে বুঝলে কোনো মহারণ্যে দিক ঠিক রেখে চলা কি কঠিন ব্যাপার। তোমার চারিপাশে সব সময়েই গাছে গুঁড়ি, অগণিত, অজস্র, তার লেখাজোখা নেই। তোমার মাথার ওপর সব সময় ডালপালা লতাপাতায় চন্দ্রাতপ। নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য্য দৃষ্টিগোচর হয় না। সূর্য্যের আলোও কম, সব সময়েই যেন গোধূলি। ক্রোশের পর ক্রোশ যাও, ঐ একই ব্যাপার। এদিক কম্পাস অকেজো, কি করে দিক ঠিক রাখা যায়?

চাঁদের পাহাড়122.jpg

পঞ্চম দিনে একটা পাহাড়ের তলায় এসে সে বিশ্রামের জন্যে থামল। কাছেই একটা প্রকাণ্ড গুহার মুখ, একটা ক্ষীণ জলস্রোত গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে এঁকে বেঁকে অদৃশ্য হয়েচে।

অতবড় গুহা কখনো না দেখার দরুণ, একটা কৌতূহলের বশবর্ত্তী হয়েই সে জিনিষপত্র বাইরে রেখে গুহার মধ্যে ঢুকলো। গুহার মুখে খানিকটা আলো - ভেতরে বড় অন্ধকার, টর্চ্চ জ্বেলে সন্তর্পনে অগ্রসর হয়ে, সে ক্রমশঃ এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছুলো, যেখানে ডাইনে বাঁয়ে আর দুটো মুখ। ওপরের দিকে টর্চ্চ উঠিয়ে দেখলে, ছাদটা অনেকটা উচুঁ। সাদা শক্ত নুনের মত ক্যালসিয়াম কার্ব্বোনেটের সরু মোটা ঝুরি ছাদ থেকে ঝাড় লণ্ঠনের মত ঝুলচে।

গুহার দেওয়ালগুলো ভিজে, গা বেয়ে অনেক জায়গায় জল খুব ক্ষীণধারায় ঝরে পড়চে। শঙ্কর ডাইনের গুহায় ঢুকলো, সেটা ঢুকবার সময় সরু, কিন্তু ক্রমশঃ প্রশস্ত হয়ে গিয়েচে। পায়ে পাথর নয়, ভিজে মাটী। টর্চ্চের আলোয় ওর মনে হোল, গুহাটা ত্রিভুজাকৃতি। ত্রিভূজের ভূমির এক কোণে আর একটা গুহামুখ। সেটা দিয়ে ঢুকে শঙ্কর দেখলে সে যেন দুধারে পাথরের উঁচু দেওয়াল-ওয়ালা একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে এসেচে। গলিটা আঁকা বাঁকা, একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে সাপের মত এঁকে বেঁকে চলেচে - শঙ্কর অনেক দূর চলে গেল গলিটা ধরে।

ঘন্টা দুই এতে কাটলো। তারপর সে ভাবলে, এবার ফেরা যাক। কিন্তু ফিরতে গিয়ে সে আর কিছুতেই সেই ত্রিভুজাকৃতি গুহাটা খুঁজে পেল না। কেন, এই তো সেই গুহা থেকেই এই সরু গুহাটা বেরিয়েচে, সরু গুহা তো শেষ হয়েই গেল - তবে সে ত্রিভুজ গুহা কৈ?

অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে শঙ্করের হঠাৎ কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হোল। সে গুহার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেনি তো? সর্ব্বনাশ।

সে বসে আতঙ্গঙ্ক দূর করবার চেষ্টা করলে, ভাবলে - না ভয় পেলে তার চলবে না। স্থির বুদ্ধি ভিন্ন এ বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় নেই। মনে পড়ল, আলভারেজ তাকে বলে দিয়েছিল, অপরচিত স্থানে বেশীদূর অগ্রসর হবার সময়ে পথের পাশে সে যে কোন চিহ্ন রেখে যায়, যাতে আবার সেই চিহ্ন ধরে ফিরতে পারে। এ উপদেশ সে ভুলে গিয়েছিল। এখন উপায়?

টর্চ্চের আলো জ্বালতে তার আর ভরসা হচ্ছে না। যদি ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়, তবে নিরুপায়। গুহার মধ্যে অন্ধকার সূচীভেদ্য। সেই দুর্ণিবীক্ষ্য অন্ধকারে এক পা অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। পথ খুঁজে বার করা তো দূরের কথা।

সারাদিন কেটে গেল - ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা। এদিকে টর্চ্চের আলো রাঙা হয়ে আসচে ক্রমশঃ। ভীষণ গুমট গরম গুহার মধ্যে তা' ছাড়া পানীয় জল নেই। পাথরের দেওয়াল বেয়ে যে জল চুঁয়ে পড়চে, তা' আস্বাদ কষা, ক্ষার, ঈষৎ লোনা। তার পরিমাণও বেশী নয়। জিব দিয়ে চেটে খেতে হয় দেওয়ালের গা থেকে।

বাইরে অন্ধকার হয়েচে নিশ্চয়ই, সাড়ে সাতটা বাজলো। আটটা, নটা, দশটা। তখনও শঙ্কর পথ হাতড়াচ্চে। টর্চ্চের পুরোণো ব্যাটারি জ্বলচে সমানে বেলা তিনটে থেকে, এইবার সে এত ক্ষীণ হয়ে এসেচে যে, শঙ্কর ভয়ে আরও উন্মাদের মত হয়ে উঠল। এই আলো যতক্ষণ, তার প্রাণের ভরসাও ততক্ষণ - নতুবা এই রৌরব নরকের মত মহা অন্ধকারে পথ খুঁজে পাবার কোনো আশা নেই - স্বয়ং আলভারেজও পারতো না।

টর্চ্চ নিবিয়ে, ও চুপ করে একখানা পাথরের ওপর বসে রইল। এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতেও পারতো, যদি আলো থাকতো - কিন্তু অন্ধকারে সে কি করবে এখন? একবার ভাবলে, রাত্রিটা কাটুক না, দেখা যাবে এখন। পরক্ষণেই মনে হোল - তাতে আর কি সুবিধে হবে? এখানে দিন রাত্রি সমান। অন্ধকারেই সে দেওয়াল ধরে ধরে চলতে লাগলো। হায়, হায়, কেন গুহায় ঢুকবার সময় দুটো নতুন ব্যাটারি সঙ্গে নেয় নি! অন্ততঃ একটা দেশলাই।

ঘড়ি হিসেবে সকাল হোল। গুহার চির অন্ধকারে আলো জ্বললো না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শরীর অবসন্ন হয়ে আসচে ওর। বোধ হয়, এই গুহার অন্ধকারে ওর সমাধি অদৃষ্টে লেখা আছে, দিনের আলো আর দেখতে হবে না। আলভারেজের বলি গ্রহণ করে আফ্রিকার রক্ততৃষ্ণা মেটেনি, তাকেও চাই।

তিন দিন তিন রাত্রি কেটে গেল। শঙ্কর জুতোর সুকতোলা চিবিয়ে খেয়েচে, একটা আরসুলা কি ইঁদুর, কি কাঁকড়াবিছে - কোনো জীব নেই গুহার মধ্যে যে সে ধরে খায়। মাথা ক্রমশঃ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আসচে, তার জ্ঞান নেই সে কি করচে বা তার কি ঘটচে - কেবল এইটুকু মাত্র জ্ঞান রয়েচে যে, তাকে এ গুহা থেকে যে করে হোক বেরুতেই হবে, দিনের আলোর মুখ দেখতেই হবে। তাই সে অবসন্ন নির্জ্জীব দেহেও অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েই বেড়াচ্ছে, হয়ত মরণের পূর্ব্ব মুহূর্ত্ত পর্যন্ত্য ওইরকমই হাতড়াবে।

একবার সে অবসন্ন দেহে ঘুমিয়ে পড়লো। কতক্ষণ পরে সে জেগে উঠল, তা সে জানে না; দিন, রাত্রি, ঘণ্টা, ঘড়ি, দণ্ড, পল মুছে গিয়েচে এই ঘোর অন্ধকারে। হয়তো বা তার চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েচে, কে জানে?

ঘুমুবার পরে সে যেন একটু বল পেল। আবার উঠল, আবার চলল, আলভারেজের শিষ্য সে, নিশ্চেষ্ট ভাবে হাত পা কোলে করে বসে কখনই মরবে না।...সে পথ খুঁজবে, খুঁজবে, যতক্ষণ বেঁচে আছে।

আশ্চর্য্য, সে নদীটাই বা কোথায় গেল?...গুহার মধ্যে গোলোকধাঁধাঁয় ঘুরবার সময়ে জলধারাকে সে কোথায় হারিয়ে ফেলেচে। নদী দেখতে পেলে হয় তো উদ্ধার পাওয়াও যেতে পারে, কারণ তার এক মুখ যেদিকেই থাক, একটা মুখ আছে গুহার বাইরে। কিন্তু নদী তো দূরের কথা, একটা অতি ক্ষীণ জলধারার সঙ্গেও আজ তিন দিন পরিচয় নেই! জল অভাবে শঙ্কর মরতে বসেচে, কষা, লোনা, বিস্বাদ জল চেটে চেটে তার জিব ফুলে উঠেচে, তৃষ্ণা তাতে বেড়েচে ছাড়া কমে নি।

পাথরের দেওয়াল হাতড়ে শঙ্কর খুঁজতে লাগলো, ভিজে দেওয়ালের গায়ে কোথাও শেওলা জন্মেছে কি না - খেয়ে প্রাণ বাঁচাবে। না তাও নেই! পাথরের দেওয়াল সর্ব্বত্র অনাবৃত - মাঝে মাঝে ক্যালসিয়াম কার্ব্বোনেটের পাতলা সর পড়েচে, একটা ব্যাঙের ছাতা, কি শেওলাজাতীয় উদ্ভিদও নেই। সূর্য্যের আলোর অভাবে উদ্ভিদ এখানে বাঁচতে পারে না।

আরও একদিন কেটে রাত এল। এত ঘোরাঘুরি করেও কিছু সুবিধে হচ্চে বলে তো বোধ হয় না। ওর মনে হতাশা ঘনিয়ে এসেচে। আরও সে কি চলবে, কতক্ষণ চলবে? এতে কোন ফল নেই, এ চলার শেষ নেই। কোথায় সে চলচে এই গাঢ় নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারে, এই ভয়ানক নিস্তব্ধতার মধ্যে! উঃ কি ভয়ানক অন্ধকার আর কি ভয়ানক নিস্তব্ধতা! পৃথিবী যেন মরে গিয়েচে, সৃষ্টিশেষের প্রলয়ে সোমসূর্য্য নিবে গিয়েচে, সেই মৃত পৃথিবীর জনহীন, শব্দহীন, সময়হীন, শ্মশানে সেই একমাত্র প্রাণী বেঁচে আছে।

আর বেশীক্ষণ এ-রকম থাকলে সে ঠিক পাগল হয়ে যাবে।




এগারো

শঙ্কর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধ হয়, কিম্বা হয়তো অজ্ঞান হয়েই পড়ে থাকবে। মোটের ওপর যখন আবার জ্ঞান ফিরে এল, তখন ঘড়িতে বারোটা—সম্ভবতঃ রাত বারোটাই হবে। ও উঠে আবার চলতে সুরু করলে। এক জায়গায় তার সামনে একটা পাথরের দেওয়াল পড়লো—তার রাস্তা যেন আট্‌কে রেখেচে। টর্চ্চের রাঙা আলো একটিবার মাত্র জ্বালিয়ে সে দেখলে, যে দেওয়াল ধরে সে এতক্ষণ যাচ্ছিল, তারই সঙ্গে সমকোণ করে এ দেওয়ালটা আড়াআড়ি ভাবে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ সে কাণখাড়া করলে...অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন ক্ষীণ জলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না?...

হাঁ...ঠিক জলের শব্দই বটে...কুলু কুলু, কুলু কুলু; ঝরণা ধারার শব্দ—যেন পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে বেধে জল বইচে কোথাও। ভাল করে শুনে ওর মনে হোল, জলের শব্দটা হচ্চে এই পাথরের দেওয়ালের ওপারে। দেওয়ালে কাণ পেতে শুনে ওর ধারণা আরও বদ্ধমূল হোল। দেওয়াল ফুঁড়ে যাবার উপযুক্ত ফাঁক আছে কিনা, টর্চ্চের রাঙা আলোয় অনুসন্ধান করতে করতে এক জায়গায় খুব নীচু ও সংকীর্ণ প্রাকৃতিক রন্ধ দেখতে পেলে। সেখান দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটা গিয়ে হাতে জল ঠেকলো। সন্তর্পণে ওপরের দিকে হাত দিয়ে বুঝলো, সেখানটাতে দাঁড়ানো যেতে পারে। দাঁড়িয়ে ওঠে ঘন অন্ধকারের মধ্যে কয়েক পা যেতেই, স্রোতযুক্ত বরফের মত ঠাণ্ডা জলে পায়ের পাতা ডুবে গেল।...

ঘন অন্ধকারের মধ্যেই নীচু হয়ে, ও প্রাণ ভরে ঠাণ্ডা জল পান করে নিলে। তারপর টর্চ্চের ক্ষীণ আলোয় জলের স্রোতের গতি লক্ষ্য করলে। এ ধরণের নির্ঝরের স্রোতের উজান দিকে গুহার মুখ সাধারণতঃ হয় না। টর্চ্চ নিবিয়ে সেই মহা নিবিড় অন্ধকারে পায়ে পায়ে জলের ধারা অনুভব করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে চললো। নির্ঝর চলেচে এঁকে বেঁকে, কখনও ডাইনে, কখনও বায়ে। এক জায়গায় যেন সেটা তিন চারটে ছোট বড় ধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়ে এদিক ওদিক চলে গিয়েচে, ওর মনে হোল।

সেখানে এসে সে দিশাহারা হয়ে পড়ল। টর্চ্চ জ্বেলে দেখলে স্রোত নানামুখী। আলভারেজের কথা মনে পড়লো, পথে চিহ্ন রেখে না গেলে, এখানে এবার গোল পাকিয়ে যাবার সম্ভাবনা।

নীচু হয়ে চিহ্ন রেখে যাওয়ার উপযোগী কিছু খুঁজতে গিয়ে দেখলে, স্বচ্ছ, নির্ম্মল জলধারার এপারে ওপারে দুপারেই একধরণের পাথরের নুড়ি বিস্তর পড়ে আছে। সেই ধরণের পাথরের নুড়ির ওপর দিয়েও প্রধান জলধারা বয়ে চলেচে।  অনেকগুলো নুড়ি পকেটে নিয়ে, সে প্রত্যেক শাখাটা শেষ পর্য্যন্ত পরীক্ষা করবে ভেবে, দুটো নুড়ি ধারার পাশে রাখতে রাখতে গেল। একটা স্রোত থেকে খানিকদূর গিয়ে আবার অনেকগুলো ফেকড়ি বেরিয়েচে। প্রত্যেক সংযোগস্থলে ও নুড়ি সাজিয়ে একটা 'S' অক্ষর তৈরী করে রাখলে।

অনেকগুলো স্রোতশাখা আবার ঘুরে শঙ্কর যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই যেন ঘুরে গেল। পথে চিহ্ন না রেখে গিয়েই শঙ্করের মাথা গোলমাল হয়ে যাবার যোগাড় হোল। একবার শঙ্করের পায়ে খুব ঠাণ্ডা কি ঠেকতেই, সে আলো জ্বেলে দেখলে, জলের ধারে এক প্রকাণ্ডকায় অজগর পাইথন কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। পাইথন ওর স্পর্শে আলস্য পরিত্যাগ করে মাথাটা উঠিয়ে কড়ির দানার মত চোখে চাইতেই টর্চ্চের আলোয় দিশাহারা হয়ে গেল - নতুবা শঙ্করের প্রাণ সংশয় হয়ে উঠতো। শঙ্কর জানে অজগর সর্প অতি ভয়ানক জন্তু - বাঘ সিংহের মুখ থেকেও হয়তো পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে, অজগর সর্পের নাগপাশ থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। একটীবার লেজ ছুঁড়ে পা জড়িয়ে ধরলে আর দেখতে হোত না।

এবার অন্ধকারে চলতে ওর ভয়ানক ভয় করছিল। কি জানি, আবার কোথায় কোন পাইথন সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে! দুটো তিনটা স্রোতশাখা পরীক্ষা করে দেখবার পরে ও তার কৃত চিহ্নের সাহায্যে পুনরায় সংযোগ স্থলে ফিরে এল। প্রধান সংযোগ স্থলে ও নুড়ি দিয়ে একটা ক্রুশচিহ্ন করে রেখে গিয়েছিল। এবার ওরই মধ্যে যেটাকে প্রধান বলে মনে হোল, সেটা ধরে চলতে গিয়ে দেখলে সেও সোজামুখে যায় নি। তারও নানা ফেকড়ি বেরিয়েচে, কিছুদূর গিয়েই। এক এক জায়গায় গুহার ছাদ এত নীচু হয়ে নেমে এসেচে যে কুঁজো হয়ে, কোথাও বা মাজা দুমড়ে, অশীতিপর বৃদ্ধের ভঙ্গিতে চলতে হয়।

হঠাৎ একজায়গায় টর্চ্চ জ্বেলে সেই অতি ক্ষীণ আলোতেও শঙ্কর বুঝতে পারলে, গুহাটা সেখানে ত্রিভুজাকৃতি - সেই ত্রিভুজ গুহা, যাকে খুঁজে বার না করতে পেরে, মৃত্যুর দ্বার পর্য্যন্ত যেতে হয়েছিল। একটু পরেই দেখলে বহুদূরে যেন অন্ধকারের ফ্রেমে আটা কয়েকটী নক্ষত্র জ্বলচে। গুহার মুখ। এবার আর ভয় নেই। এ-যাত্রার মত সে বেঁচে গেল।

চাঁদের পাহাড়122.jpg

শঙ্কর যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন রাত তিনটে। সেখানটায় গাছপালা কিছু কম, মাথার ওপর নক্ষত্রভরা আকাশ দেখা যায়। রৌরবের মহা অন্ধকার থেকে বার হয়ে এসে রাত্রির নক্ষত্রলোকিত স্বচ্ছ অন্ধকার তার কাছে দীপালোক-খচিত নগরপথের মত মনে হোল। প্রাণভরে সে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলে, এ অপ্রত্যাশিত মুক্তির জন্যে।

ভোর হোল। সূর্য্যের আলো গাছের ডালে ডালে ফুটলো। শঙ্কর ভাবলে এ অমঙ্গলজ়নক স্থানে আর একদণ্ড ও সে থাকবে না। পকেটে একখানা পাথরের নুড়ি তখনও ছিল, ফেলে না দিয়ে গুহার বিপদের স্মারক স্বরূপ সেখানা সে কাছে রেখে দিলে।

পরদিন এলিফ্যাণ্ট ঘাস দেখা গেল বনের মধ্যে, সেদিনই সন্ধ্যার পূর্ব্বে অরণ্য শেষ হয়ে খোলা জায়গা দেখা দিল। রাত্রে শঙ্কর অনেকক্ষণ বসে ম্যাপ দেখলে। সামনে যে মুক্ত প্রান্তরবৎ দেশ পড়লো, এথান থেকে এটা প্রায় তিনশো মাইল বিস্তৃত, একেবারে জ্যাম্বেসী নদীর তীর পর্য্যন্ত। এই তিনশো মাইলের খানিকটা পড়েচে বিখ্যাত কালাহারি মরুভূমির মধ্যে, প্রায় ১৭৫ মাইল, অতি ভীষণ, জনমানবহীন, জলহীন, পথহীন মরুভূমি। মিলিটারি ম্যাপ থেকে আলভারেজ নোট করেচে যে, এই অঞ্চলের উত্তরপূর্ব্ব কোণ লক্ষ্য করে একটি বিশেষ পথ ধরে না গেলে, মাঝামাঝি পার হতে যাওয়ার মানেই মৃত্যু। ম্যাপে এর নাম দিয়েচে 'তৃষ্ণার দেশ' (Thirstland Trek)। রোডেসিয়া পৌছুতে পারলে যাজ্যা অনেকটা সহজ হয়ে উঠবে, কারণ সে সব স্থানে মানুষ আছে।

শঙ্কর এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিলে। পথের এই ভয়ানক় অবস্থা জেনে-শুনেও সে দমে গেল না, হাত-পা-হারা হয়ে পড়লো না। এই পথে আলভারেজ একা গিয়ে সলসবেরি থেক়ে টোটা ও খাবার কিনে আনবে বলেছিল। বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ যা পারবে বলে স্থির করেছিল, সে তা থেকে পিছিয়ে যাবে?  কিন্তু সাহস ও নির্ভীকতা এক জিনিস, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পুর্ণ অন্য জিনিস। ম্যাপ দেখে গন্তব্যস্থানের দিক্ নির্ণয় করার ক্ষমতা শঙ্করের ছিল না। সে দেখলে ম্যাপের সে কিছুই বোঝে না। মিলিটারি ম্যাপগুলোতে দুটো মরূমধ্যস্থ কূপের অবস্থান-স্থানের ল্যাটিচিউড্ লঙ্গিচিউড্ দেওয়া আছে, “ম্যাগনেটিক্ নর্থ” আর “ট্রু নর্থ” ঘটিত কি একটা গোলমেলে অঙ্ক কসে বার করতো আলভারেজ, শঙ্কর দেখেচে কিন্তু শিখে নেয়নি।

সুতরাং অদৃষ্টের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কি? অদৃষ্টের উপর নির্ভর করেই শঙ্কব় এই দুস্তর মরুভূমিতে পাড়ি দিতে প্রস্তুত হোল। ফলে, দুদিন যেতে না যেতেই শঙ্কর সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত হয়ে পড়লো। ম্যাপ দৃষ্টে যে কোনো অভিজ্ঞ লোক যে জলাশয় চোখ বুঁজে খুঁজে বার করতে পারতো - শঙ্কর তার তিন মাইল উত্তর দিয়ে চলে গেল, অথচ তখন তার জল ফুরিয়ে এসেচে, নতুন পানীয় জল সংগ্রহ করে না নিলে জীবন বিপদাপন্ন হবে।

প্রথমতঃ শুধু প্রান্তর আর পাহাড়, ক্যাকটাস্ ও ইউফোর্বিয়ার বন, মাঝে মাঝে গ্রানাইটের স্তূপ। তারপর কি ভীষণ কষ্টের সে পথ চলা। খাদ্য নেই, জল নেই, পথ ঠিক নেই, মানুষের মুখ দেখা নেই। দিনের পর দিন শুধু সুদূর, শূন্য, দিগ্বলয় লক্ষ্য করে সে হতাশ পথ-যাত্রা - মাথার ওপর আগুনের মত সূর্য্য, পায়ের নীচে বালি পাথর যেন জ্বলন্ত অঙ্গার সূর্য্য উঠচে, অস্ত যাচ্ছে- নক্ষত্র উঠচে, চাঁদ উঠচে- আবার অস্ত যাচ্চে। মরুভূমির গিরগিটি একঘেয়ে সুরে ডাকচে, ঝিঁ ঝিঁ ডাকচে- সন্ধ্যায়, গভীর নিশীথে।

মাইল-লেখা পাথর নেই, কত মাইল অতিক্রম করা হোল তার হিসেব নেই। খাদ্য দু-একটা পাখী, কখনো বা মরুভূমির বুজার্ড শকুনি, যার মাংস জঠর ও বিস্বাদ। এমন-কি একদিন একটা পাহাড়ী বিষাক্ত কাঁকড়া বিছে, যার দংশনে মৃত্যু- তাও যেন পরম সুখাদ্য, মিললে মহা সৌভাগ্য।

দুদিন ঘোর তৃষ্ণায় কষ্ট পাবার পরে, পাহাড়ের ফাটলে একটা জলাশয় পাওয়া গেল। কিন্তু জলের চেহারা লাল, কতকগুলো কি পোকা ভাসচে জলে- ডাঙায় একটা কি জন্তু মরে পচে ঢোল হয়ে আছে। সেই জলই আকণ্ঠ পান করে শঙ্কর প্রাণ বাঁচালে।

দিনের পর দিন কাটচে, মাস গেল, কি সপ্তাহ গেল, কি বছর গেল, হিসেব নেই। শঙ্কর রোগা হয়ে গিয়েচে শুকিয়ে। কোথায় চলেচে তার কিছুই ঠিক নেই — শুধু সামনের দিকে যেতে হবে এই সে জানে। সামনের দিকেই ভারতবর্ষ — বাংলা দেশ।

তারপর পড়লো আসল মরু, কালাহারি মরুভূমির এক অংশ। দূর থেকে তার চেহারা দেখে শঙ্কর ভয়ে শিউরে উঠলো। মানুষে কি করে পার হতে পারে এই অগ্নিদগ্ধ প্রান্তর! শুধুই বালির পাহাড়, তাম্রাভ কটা বালির সমুদ্র। ধূ ধূ করে যেন জ্বলচে দুপুরের রোদে। মরুর কিনারায় প্রথম দিনেই ছায়ায় ১২৭ ডিগ্রী উত্তাপ উঠল থার্ম্মোমিটারে।

ম্যাপে বার বার লিখে দিয়েচে উত্তর-পূর্ব্ব কোণ ঘেঁসে ছাড়া কেউ এই মরুভূমি মাঝামাঝি পার হতে যাবে না। গেলেই মৃত্যু, কারণ সেখানে জল একদম নেই। জল যে উত্তর-পূর্ব্ব ধারে আছে তাও নয়, তবে ত্রিশ মাইল, সত্তর মাইল ও নব্বুই মাইল ব্যবধানে তিনটী স্বাভাবিক উণুই আছে- যাতে জল পাওয়া যায়। ঐ উণুইগুলি প্রায়ই পাহাড়ের ফাটলে, খুঁজে বার করা বড়ই কঠিন। এইজন্যে মিলিটারী ম্যাপে ওদের অবস্থান স্থানের অক্ষ ও দ্রাঘিমা দেওয়া আছে।

শঙ্কর ভাবলে, ওসব বার করতে পারবো না! সেক্সটাণ্ট আছে, নক্ষত্রের চার্ট আছে কিন্তু তাদের ব্যবহার সে জানে না। যা হয় হবে, ভগবান ভরসা। তবে যতদূর সম্ভব উত্তর-পূর্ব্ব কোণ ঘেসে যাবার চেষ্টা সে করলে।

তৃতীয় দিনে নিতান্ত দৈববলে সে একটা উণুই দেখতে পেল। জল কাদাগোলা, আগুনের মত গরম, কিন্তু তাই তখন অমৃতের মত দুর্লভ। মরুভূমি ক্রমে ঘোরতর হয়ে উঠলো। কোন প্রকার জীবের বা উদ্ভিদের চিহ্ন ক্রমশঃ লুপ্ত হয়ে গেল। আগে রাত্রে আলো জ্বাললে দু-একটা কীটপতঙ্গ আলোয় আকৃষ্ট হয়ে আসতো, ক্রমে তাও আর আসে না।

দিনে উত্তাপ যেমন ভীষণ, রাত্রে তেমনি শীত। শেষ রাত্রে শীতে হাত-পা জমে যায় এমন অবস্থা, অথচ ক্রমশঃ আগুন জ্বালবার উপায় গেল, কারণ জ্বালানি কাঠ একেবারেই নেই। কয়েক দিনের মধ্যে সঞ্চিত জল গেল ফুরিয়ে। সে সুবিস্তীর্ণ বালুকা সমুদ্রে একটী পরিচিত বালুকণা খুঁজে বার করা যতদূর অসম্ভব, তার চেয়ে অসম্ভব ক্ষুদ্র এক হাত-দুই ব্যাসবিশিষ্ট জলের উণুই বার করা।

সেদিন সন্ধ্যার সময় তৃষ্ণার কষ্টে শঙ্কর উন্মত্তপ্রায় হয়ে উঠল। এতক্ষণে শঙ্কর বুঝেচে যে, এ ভীষণ মরুভূমি একা পার হওয়ার চেষ্টা করা আত্মহত্যার সামিল। সে এমন জায়গায় এসে পড়েচে, যেখান থেকে ফিরবার উপায়ও নেই।

একটা উঁচু বালিয়াড়ির ওপর উঠে সে দেখলে, চারিধারে শুধুই কটা বালির পাহাড়, পূর্ব্বদিকে ক্রমশঃ উঁচু হয়ে গিয়েচে। পশ্চিমে সূর্য্য ডুবে গেলেও সারা আকাশ সূর্য্যাস্তের আভায় লাল। কিছুদূরে একটা ছোট ঢিবির মত পাহাড় এবং দূর থেকে মনে হোল একটা গুহাও আছে। এ ধরণের গ্রানাইটের ছোট ঢিবি এদেশে সর্ব্বত্র- ট্রান্সভাল ও রোডেসিয়ায় এদের নাম “Kopje” অর্থাৎ ক্ষুদ্র পাহাড়। রাত্রে শীতের হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে শঙ্কর সেই গুহায় আশ্রয় নিলে।

এইখানে এক ব্যাপার ঘটল।

গুহার মধ্যে ঢুকে শঙ্কর টর্চ্চ জ্বেলে (নতুন ব্যাটারি তার কাছে ডজন দুই ছিল) দেখলে গুহাটা ছোট, মেজেটাতে ছোট ছোট পাথর ছড়ানো, বেশ একটা ছোটখাটো ঘরের মত। গুহার এক কোণে ওর চোখ পড়তেই অবাক হয়ে রইল। একটা ছোট্ট কাঠের পিপে! এখানে কি করে এল কাঠের পিপে!

এগিয়ে দুপা গিয়েই সে চমকে উঠল। গুহার দেওয়ালের ধার ঘেসে শায়িত অবস্থায় একটা সাদা নরকঙ্কাল, তার মুণ্ডটা দেওয়ালের দিকে ফেরানো। কঙ্কালের আশে পাশে কালো কালো থলে ছেড়ার মত জিনিষ, বোধ হয় সেগুলো পশমের কোটের অংশ। দুখানা বুট জুতো কঙ্কালের গায়ে এখনও লাগানো। একপেশে একটা মরচে-পড়া বন্দুক।

পিপেটার পাশে একটা ছিপি-আঁটা বোতল। বোতলের মধ্যে একখানা কাগজ। ছিপিটা খুলে কাগজখানা বার করে দেখলে, তাতে ইংরিজিতে কি লেখা আছে।

পিপেটাতে কি আছে দেখবার জন্যে যেমন সে সেটা নাড়াতে গিয়েচে, অমনি পিপের নীচে থেকে একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে ওর শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। নিমেষের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড সাপ মাটী থেকে হাত তিনেক উঁচু হয়ে ঠেলে উঠল। বোধ হয়, ছোবল মারবার আগে সাপটা এক

চাঁদের পাহাড় (page 154 crop).jpg

সেকেণ্ড দেরী করেছিল। সেই এক সেকেণ্ডের দেরী করার জন্যে শঙ্করের প্রাণ রক্ষা হোল। পরমুহূর্ত্তেই শঙ্করের .৪৫ অটোমেটিক কোল্ট গর্জ্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ বিষধর 'স্যাণ্ড ভাইপার' এর মাথাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে, রক্ত-মাংস খানিকটা পিপের গায়, খানিকটা পাথরের দেওয়ালে ছিটকে লাগলো। আলভারেজ ওকে শিখিয়েছিল, পথে সর্ব্বদা হাতিয়ার তৈরী রাখবে। এ উপদেশ অনেকবার তার প্রাণ বাঁচিয়েচে।
অদ্ভূত পরিত্রাণ! সব দিক থেকেই। পিপেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল, সেটাতে অল্প একটু জল তখনও আছে। খুব কালো শিউ গোলার মত রং বটে, তবুও জল। ছোট পিপেটা উঁচু করে তুলে ধরে, পিপের ছিপি খুলে ঢক ঢক করে শঙ্কর সেই দুর্গন্ধ কালো কালির মত জল আকণ্ঠ পান করলে। তারপর সে টর্চ্চের আলোতে সাপটা পরীক্ষা করলে। পুরো পাঁচ হাত লম্বা সাপটা, মোটাও বেশ। এ ধরণের সাপ মরুভূমির বালির মধ্যে শরীর লুকিয়ে শুধু মুণ্ডটা ওপরে তুলে থাকে- অতি মারাত্মক রকমের বিষাক্ত সর্প।

এইবার বোতলের মধ্যের কাগজখানা খুলে মন দিয়ে পড়লে। যে ছোট্ট পেন্সিল দিয়ে এটা লেখা হয়েচে- বোতলের মধ্যে সেটাও পাওয়া গেল। কাগজখানাতে লেখা আছে... “আমার মৃত্যু নিকট। আজিই আমার শেষ রাত্রি। যদি আমার মরণের পরে, কেঊ এই ভয়ঙ্কর মরুভূমির পথে যেতে যেতে এই গুহাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তবে সম্ভবতঃ এই কাগজ তাঁর হাতে পড়বে।  আমার গাধাটা দিন দুই আগে মরুভূমির মধ্যে মারা গিয়েচে। এক পিপে জল তার পিঠে ছিল, সেটা আমি এই গুহার মধ্যে নিয়ে এসে রেখে দিয়েচি, যদিও জ্বরে আমার শরীর অবসন্ন। মাথা তুলবার শক্তি নেই। তার ওপর অনাহারে শরীর আগে থেকেই দুর্ব্বল।

আমার বয়স ২৬ বৎসর। আমার নাম আত্তিলিও গাত্তি। ফ্লোরেন্সের গাত্তি বংশে আমার জন্ম। বিখ্যাত নাবিক রিওলিনো কাভালকান্তি গাত্তি- যিনি লেপাণ্টোর যুদ্ধে তুর্কীদের সঙ্গে লড়েছিলেন, তিনি আমার একজন পূর্ব্বপুরুষ।

রোম ও পিসা বিশব্বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত ভবঘুরে হয়ে গেলাম সমুদ্রের নেশায়,— যা আমাদের বংশগত নেশা। ডাচ ইণ্ডিজ যাবার পথে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে জাহাজ ডুবি হোল।

আমরা সাতজন লোক অতিকষ্টে ডাঙা পেলাম। ঘোর জঙ্গলময় অঞ্চল আফ্রিকার এই পশ্চিম উপকূল। জঙ্গলের মধ্যে শেফুজাতির একগ্রামে আমরা আশ্রয় নিই এবং প্রায় দুমাস সেখানে থাকি। এখানেই দৈবাৎ এক অদ্ভূত হীরার খনির গল্প শুনলাম। পূর্ব্বদিকে এক প্রকাণ্ড পর্ব্বত ও ভীষণ আরণ্য অঞ্চলে নাকি এই হীরার খনি অবস্থিত।

আমরা সাতজন ঠিক করলাম এই হীরার খনি যে করে হোক, বার করতে হবেই। আমাকে ওরা দলের অধিনায়ক করলে- তারপর আমরা দুর্গম জঙ্গল ঠেলে চললাম সেই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত পার্ব্বত্য অঞ্চলে। সে গ্রামের কোন লোক পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজী হোল না। তারা বলে, তারা কখনও সে জায়গায় যায় নি, কোথায় তা জানে না, বিশেষতঃ এক উপদেবতা নাকি সে বনের রক্ষক। সেখান থেকে হীরা নিয়ে কেউ আসতে পারবে না।

আমরা দমবার পাত্র নই। পথে যেতে যেতে ঘোর কষ্টে বেঘোরে দু'জন সঙ্গী মারা গেল। বাকী চারজন আর অগ্রসর হতে চায় না। আমি দলের অধ্যক্ষ, গাত্তি বংশে আমার জন্ম, পিছু হটতে জানি না। যতক্ষণ প্রাণ আছে, এগিয়ে যেতে হবে এই জানি। আমি ফিরতে চাইলাম না।

শরীর ভেঙ্গে পড়তে চাইচে। আজ রাত্রেই আসবে সে নিরবয়ব মৃত্যুদূত! বড় সুন্দর আমাদের ছোট্ট হ্রদ সেরিনো লাগ্রানো, ওরই তীরে আমার পৈতৃক প্রাসাদ, কাষ্টোলি রিওলিনি। এতদূর থেকেও আমি সেরিনো লাগ্রানোর তীরবর্ত্তী কমলালেবুর বাগানের লেবুফুলের সুগন্ধ পাচ্ছি। ছোট্ট যে গির্জ্জাটী পাহাড়ের নীচেই, তার রূপোর ঘন্টার মিষ্টি আওয়াজ পাচ্ছি।

না, এসব কি আবোল তাবোল লিখচি জ্বরের ঘোরে। আসল কথাটা বলি। কতক্ষণই বা আর লিখবো?

আমরা সে পর্ব্বতমালা, সে মহাদুর্গম অরণ্যে গিয়েছিলাম। সে খনি বার করেছিলাম। যে নদীর তীরে হীরা পাওয়া যায়, এক বিশাল ও অতি ভয়ানক গুহার মধ্যে সে নদীর উৎপত্তি স্থান। আমিই সেই গুহার মধ্যে ঢুকে এবং নদীর জলের তীরে ও জলের মধ্যে পাথরের নুড়ির মত অজস্র হীরা ছড়ানো দেখতে পাই। প্রত্যেক নুড়িটী টেট্রাহেড্রন ক্রিষ্ট্যাল, স্বচ্ছ ও হরিদ্রাভ; লণ্ডন ও আমষ্টার্ডামের বাজারে এমন হীরা নেই।

এই অরণ্য ও পর্ব্বতের সে উপদেবতাকে আমি এই গুহার মধ্যে দেখেচি- ধূনোর কাঠের মশালের আলোয়, দূর থেকে আবছায়া ভাবে। সত্যি ভীষণ তার চেহারা! জ্বলন্ত মশাল হাতে ছিল বলেই সেদিন আমার কাছে সে ঘেসেনি। এই গুহাতেই সে সম্ভবতঃ বাস করে। হীরার খনির সে রক্ষক, এই প্রবাদের সৃষ্টি সেই জন্যেই বোধ হয় হয়েচে।

কিন্তু কি কুক্ষণেই হীরার সন্ধান পেয়েছিলাম এবং কি কুক্ষণেই সঙ্গীদের কাছে তা প্রকাশ করেছিলাম। ওদের নিয়ে আবার যখন সে গুহায় ঢুকি, হীরার খনি খুঁজে পেলাম না। একে ঘোর অন্ধকার, মশালের আলোয় সে অন্ধকার দূর হয় না, তার ওপরে বহুমুখী নদী, কোন স্রোতটার ধারা হীরার রাশির ওপর দিয়ে বইচে, কিছুতেই বার করতে পারলাম না আর।

আমার সঙ্গীরা বব্বর, জাহাজের খালাসী। ভাবলে, ওদের ফাঁকি দিলাম বুঝি। আমি একা নেবো এই বুঝি আমার মতলব। ওরা কি ষড়যন্ত্র আঁটলে জানিনে, পরদিন সন্ধ্যাবেলা চারজনা মিলে অতর্কিতে ছুরি খুলে আমায় আক্রমণ করলে। কিন্তু তারা জানতো না আমাকে, আত্তিলিও গাত্তিকে। আমার ধমনীতে উষ্ণ রক্ত বইচে, আমার পূর্ব্বপুরুষ রিওলিনি কাভাল কান্তি গাত্তির, যিনি লেপাণ্টোর যুদ্ধে ওরকম বহু বর্ব্বরকে নরকে পাঠিয়েছিলেন। সাণ্টা কাটালিনার সামরিক বিদ্যালয়ে যখন আমি ছাত্র, আমাদের অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ Fencer এণ্টোনিও ড্রেফুসকে ছোরার ডুয়েলে জখম করি। আমার ছোরার আঘাতে ওরা দু'জন মরে গেল, দু'জন সাংঘাতিক ঘায়েল হোল, নিজেও আমি চোট পেলাম ওদের হাতে। আহত বদমাইস দুটোও সেই রাত্রে ভবলীলা শেষ করল। ভেবে দেখলাম এখন এই গুহার গোলক ধাঁধাঁর ভেতর থেকে খনি খুঁজে হয়তো বার করতে পারব না। তাছাড়া আমি সাংঘাতিক আহত, আমার সভ্যজগতে পৌঁছুতেই হবে। পূর্ব্বদিকের পথে ডাচ্ উপনিবেশে পৌঁছুবো বলে রওনা হয়েছিলুম। কিন্তু এ পর্য্যন্ত এসে আর অগ্রসর হতে পারলুম না। ওরা তলপেটে ছুরি মেরেছে, সেই ক্ষতস্থান উঠল বিষিয়ে। সেই সঙ্গে জ্বর। মানুষের কি লোভ তাই ভাবি। কেন ওরা আমাকে মারলে? ওরা আমার সঙ্গী, একবারও তো ওদের ফাঁকি দেওয়ার কথা আমার মনে আসে নি।

জগতের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ হীরক খনির মালিক আমি, কারণ নিজের প্রাণ-বিপন্ন করে তা আমি আবিষ্কার করেচি। যিনি আমার এ লেখা পড়ে বুঝতে পারবেন, তিনি নিশ্চয়ই সভ্য মানুষ ও খৃষ্টান। তাঁর প্রতি আমার অনুরোধ, আমাকে তিনি যেন খৃষ্টানের উপযুক্ত কবর দেন। এই অনুগ্রহের বদলে ঐ খনির স্বত্ব আমি তাঁকে দিলাম। রাণী শেবার ধণভাণ্ডারও এ খনির কাছে কিছু নয়!

প্রাণ গেল, যাক্, কি করবো? কিন্তু কি ভয়ানক মরুভূমি এ! একটা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক পর্য্যন্ত নেই কোনোদিকে! এমন সব জায়গাও থাকে পৃথিবীতে! আমার আজ কেবলই মনে হচ্চে, পপলার ঘেরা সেরিনো লাগ্রানো হ্রদ আর দেখবো না, তার ধারে যে চতুর্দ্দশ শতাব্দির গির্জ্জাটা, তার সেই বড় রূপোর ঘণ্টার পবিত্র ধ্বনি, পাহাড়ের ওপরে আমাদের যে প্রাচীন প্রাসাদ কাষ্টেলি রিওলিনি, মূরদের দুর্গের মত দেখায়...দূরে আমব্রিয়ার সবুজ মাঠ ও দ্রাক্ষাক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে ছোট্ট ডোরা নদী বয়ে যাচ্ছে...যাক্, আবার কি প্রলাপ বকচি।

গুহার দুয়ারে বসে আকাশের অগণিত তারা প্রাণভরে দেখচি শেষ বারের জন্যে।...সাধু ফ্রাঙ্কোর সেই সৌর স্তোত্র মনে পড়চেঃ- স্তুত হোন্ প্রভু মোর, পবন সঞ্চার তরে, স্থির বায়ু তরে, ভগিনী মেদিনী তরে, নীল মেঘ তরে, আকাশের তরে, সুদিন কুদিন তরে, দেহের মরণ তরে।

আর একটা কথা। আমার দুই পায়ে জুতার মধ্যে পাঁচখানা বড় হীরা লুকানো আছে, তোমায় তা দিলাম হে অজানা পথিক বন্ধু। আমার শেষ অনুরোধটি ভুলো না। জননী মেরী তোমার মঙ্গল করুন।

কম্যাণ্ডার আত্তিলিও গাত্তি
১৮৮০ সাল। সম্ভবতঃ মার্চ্চ মাস।
চাঁদের পাহাড়122.jpg

হতভাগ্য যুবক!

তার মৃত্যুর পরে সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর চলে গিয়েচে, এই ত্রিশ বৎসরের মধ্যে এ পথে হয়তো কেই যায় নি, গেলেও গুহাটার মধ্যে ঢোকেনি। এতকাল পরে তার চিঠিখানা মানুষের হাতে পড়লো।

আশ্চর্য্য এই যে কাঠের পিপেটাতে ত্রিশবছর পরেও জল ছিল কি করে?

কিন্তু কাগজখানা পড়েই শঙ্করের মনে হোল, এই লেখায় বর্ণিত ঐটেই সেই গুহা- সে নিজে যেখানে পথ হারিয়ে মারা যেতে বসেছিল! তারপরে সে কৌতূহলের সঙ্গে কঙ্কালের পায়ের জুতো টান দিয়ে খসাতেই পাঁচখানা বড় বড় পাথর বেরিয়ে পড়লো। এ অবিকল সেই পাথরের নুড়ির মত, যা এক পকেট কুড়িয়ে অন্ধকারে গুহার মধ্যে সে পথে চিহ্ন করেছিল এবং যার একখানা তার কাছে রয়েচে। এ পাথরের নুড়ি তো রাশি রাশি সে দেখেচে গুহার মধ্যের সেই অন্ধকারময়ী নদীর জলস্রোতের নীচে, তার দুই তীরে! কে জানতো যে হীরার খনি খুঁজতে সে ও আলভারেজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে, ছ’মাস ধরে রিখটারসভেল্ড পার্ব্বত্য অঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে হয়রাণ হয়ে গিয়েচে— এমন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে সে সেখানে গিয়ে পড়বে! হীরা যে এমন রাশি রাশি পড়ে থাকে পাথরের নুড়ির মতো— তাই বা কে ভেবেছিল! আগে এ সব জানা থাকলে, পাথরের নুড়ি সে দু-পকেট ভরে কুড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসতো!

কিন্তু তার চেয়েও খারাপ কাজ হয়ে গিয়েচে যে, সে রত্নখনির গুহা যে কোথায়, কোন্ দিকে তার কোনো নক্সা করে আনে নি বা সেখানে কোনো চিহ্ন রেখে আসে নি, যাতে আবার তাকে খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। সেই সুবিস্তীর্ণ পর্ব্বত ও অরণ্য অঞ্চলের কোন্ জায়গায় সেই গুহাটা দৈবাৎ সে দেখেছিল, তাকি তার ঠিক আছে, না ভবিষ্যতে সে আবার সে জায়গা বার করতে পারবে? এ যুবকও তো কোনো নক্সা করেনি, কিন্তু সাংঘাতিক আহত হয়েছিল রত্নখনি আবিষ্কার করার পরেই, এর ভুল হওয়া খুব স্বাভাবিক। হয়তো এ যা বার করতে পারতো নক্সা না দেখে— সে তা পারবে না।

হঠাৎ আলভারেজের মৃত্যুর পূর্ব্বের কথা শঙ্করের মনে পড়ল। সে বলেছিল— চল যাই, শঙ্কর, গুহার মধ্যে রাজার ভান্ডার লুকোনো আছে! তুমি দেখতে পাচ্চ না, আমি দেখতে পাচ্চি।  শঙ্কর গুহার মধ্যেই সেই নরকঙ্কালটা সমাধিস্থ করলে। পিঁপেটা ভেঙে ফেলে তারই দু’খানা কাঠে মরচে পড়া পেরেক ঠুকে ক্রুশ তৈরি করলে ও সমাধির ওপর সেই ক্রুশটা পুঁতলে। এ ছাড়া খৃস্টধর্মাচারীকে সমাধিস্থ করবার অন্য কোনো রীতি তার জানা নেই। তারপরে সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলে, এই মৃত যুবকের আত্মার শান্তির জন্য।

এসব শেষ করতে সারাদিনটা কেটে গেল। রাত্রে বিশ্রাম করে পরদিন আবার সে রওনা হল। কঙ্কালের চিঠিখানা ও হীরেগুলি যত্ন করে সঙ্গে নিল।

তবে তার মনে হল, এই অভিশপ্ত হীরের খনির সন্ধানে যে গিয়েছে, সে আর ফেরেনি। আত্তিলিও গাত্তি ও তার সঙ্গীরা মরেছে, জিম কার্টার মরেছে, আলভারেজ মরেছে। এর আগেই বা কত লোক মরেছে তার ঠিক কি? এইবার তার পালা। এই মরুভূমিতেই তার শেষ, এই বীর ইটালিয়ান যুবকের মতো।




তেরো

দুপুরের রোদে যখন দিক-দিগন্তে আগুন জ্বলে উঠ্‌লো, একটা ছোট্ট পাথরের ঢিবির আড়ালে সে আশ্রয় নিলে। ১৩৫° ডিগ্রী উত্তাপ উঠেচে তাপমান যন্ত্রে, রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে এ উত্তাপে পথহাঁটা চলে না। যদি সে কোনরকমে এই ভয়ানক মরুভূমির হাত এড়াতে পারতো, তবে হয়তো জীবন্ত অবস্থায় মানুষের আবাসে পৌঁছুতেও পারতো। সে ভয় করে শুধু এই মরুভূমি, সে জানে কালাহারী মরু বড় বড় সিংহের বিচরণভূমি। তার হাতে রাইফেল আছে—রাতদুপুরেও একা যত বড় সিংহই হোক, সম্মুখীন হতে সে ভয় করে না—কিন্তু ভয় হয় তৃষ্ণা রাক্ষসীকে। তার হাত থেকে পরিত্রাণ নেই। দুপুরে সে দু’বার মরীচিকা দেখলে। এতদিন মরুপথে আসতেও এ আশ্চর্য্য নৈসর্গিক দৃশ্য দেখেনি, বইয়েই পড়েছিল মরীচিকার কথা। একবার উত্তর পূর্ব্ব কোণে, একবার দক্ষিণ পূর্ব্ব কোণে, দুই মরীচিকাই কিন্তু প্রায় এক রকম—অর্থাত্‍ একটা বড় গম্বুজওয়ালা মসজিদ বা গির্জ্জা, চারপাশে খর্জ্জুরকুঞ্জ, সামনে বিস্তৃত জলাশয়। উত্তরপূর্ব্ব কোণের মরীচিকাটা বেশী স্পষ্ট।

সন্ধ্যার দিকে দূরদিগন্তে মেঘমালার মত পর্ব্বতমালা দেখা গেল। শঙ্কর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলে না। পূর্ব্বদিকে একটাই মাত্র বড় পর্ব্বত, এখান থেকে দেখা পাওয়া সম্ভব, দক্ষিণ রোডেসিয়ার প্রান্তবর্ত্তী চিমানিমানি পর্ব্বতমালা। তাহোলে কি বুঝতে হবে যে, সে বিশাল কালাহারি পদব্রজে পার হয়ে প্রায় শেষ করতে চলেচে? না এ-ও মরীচিকা?

কিন্তু রাত দশটা পর্য্যন্ত পথ চলেও জ্যোত্‍স্নারাত্রে সে দূর পর্ব্বতের সীমারেখা তেমনি স্পষ্ট দেখতে পেল। অসংখ্য ধন্যবাদ হে ভগবান, মরীচিকা নয় তবে। জ্যোত্‍স্নারাত্রে কেউ কখনো মরীচিকা দেখেনি।

তবে কি প্রাণের আশা আছে? আজ পৃথিবীর বৃহত্তম রত্নখনির মালিক সে। নিজের পরিশ্রমে ও দুঃসাহসের বলে সে তার স্বত্ব অর্জ্জন করেচে। দরিদ্র বাংলা মায়ের বুকে সে যদি আজ বেঁচে ফেরে!

দু’দিনের দিন বিকেলে সে এসে পর্ব্বতের নিচে পৌঁছলো। তখন সে দেখলে, পর্ব্বত পার হওয়া ছাড়া ওপারে যাওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই। নইলে পঁচিশ মাইল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পর্ব্বতের দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে আসতে হবে। মরুভূমির মধ্যে সে আর কিছুতেই যেতে রাজি নয়। সে পাহাড় পার হয়েই যাবে।

এইখানে সে প্রকান্ড একটা ভুল করলে। সে ভুলে গেল যে সাড়ে বারো হাজার ফুট একটা পর্ব্বতমালা ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। রিখটারসভেল্ড পার হওয়ার মতোই শক্ত। তার চেয়েও শক্ত, কারণ সেখানে আলভারেজ ছিল। এখানে সে একা।  শঙ্কর ব্যাপারের গুরুত্বটা তেমন বুঝতে পারলে না, ফলে চিমানিমানি পর্ব্বত উত্তীর্ণ হতে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসলো, ভীষণ প্রজ্বলন্ত কালাহারি পার হতে গিয়েও সে এমন ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়নি।

চিমানিমানি পর্ব্বতে জঙ্গল খুব বেশি ঘন নয়। শঙ্কর প্রথম দিন অনেকটা উঠলো— তারপর একটা জায়গায় গিয়ে পড়লো, সেখান থেকে কোনো দিকে যাবার উপায় নেই। কোন পথটা দিয়ে উঠেছিল, সেটাও আর খুঁজে পেলে না— তার মনে হোল, সে সমতলভূমির যে জায়গা দিয়ে উঠেছিল, তার ত্রিশ ডিগ্রী দক্ষিণে চলে এসেচে। কেন যে এমন হোল, এর কারণ কিছুতেই সে বার করতে পারলে না। কোথা দিয়ে কোথায় চলে গেল, কখনো উঠচে, কখনো নামচে, সূর্য্য দেখে দিক ঠিক করে নিচ্চে, কিন্তু সাত আট মাইল পাহাড় উত্তীর্ণ হতে এতদিন লাগচে কেন?

তৃতীয় দিনে আর একটা নতুন বিপদ ঘটল। তার আগের দিন একখানা আলগা পাথর গড়িয়ে তার পায়ে চোট লেগেছিল। তখন তত কিছু হয়নি, পরদিন সকালে আর সে শয্যা ছেড়ে উঠতে পারে না। হাঁটু ফুলেচে, বেদনাও খুব। দুর্গম পথে নামা-ওঠা করা এ অবস্থায় অসম্ভব। পাহাড়ের একটা ঝরনা থেকে ওঠবার সময় জল সংগ্রহ করে এনেছিল, তাই একটু একটু করে খেয়ে চালাচ্চে। পায়ের বেদনা কমে না যাওয়া পর্য্যন্ত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। বেশীদূর যাওয়া চলবে না। সামান্য একটু-আধটু চলাফেরা করতেই হবে খাদ্য ও জলের চেষ্টায়, ভাগ্যে পাহাড়ের এই স্থানটা যেন খানিকটা সমতলভূমির মতো, তাই রক্ষে।

এই সব অবস্থায়, এই মনুষ্যবাসহীন পাহাড়ে বিপদ তো পদে পদেই। একা এ পাহাড় টপকাতে গেলে যে কোনো ইউরোপীয় পর্যটকেরও ঠিক এইরকম বিপদ ঘটতে পারতো।

শঙ্কর আর পারে না। ওর হৃত্‍‌পিন্ডে কি একটা রোগ হয়েচে, একটু হাঁটলেই ধড়াস ধড়াস করে হৃত্‍‌পিন্ডটা পাঁজরায় ধাক্কা মারে। অমানুষিক পথশ্রমে, দুর্ভাবনায়, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে, কখনও বা অনাহারের কষ্টে, ওর শরীরে কিছু নেই।

চারদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা অবসন্ন দেহে সে একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিলে। খাদ্য নেই কাল থেকে। রাইফেল সঙ্গে আছে, কিন্তু একটা বন্য জন্তুর দেখা নেই। দুপুরে একটা হরিণকে চরতে দেখে ভরসা হয়েছিল, কিন্তু রাইফেলটা তখন ছিল পঞ্চাশ গজ তফাতে একটা গাছে ঠেস দেওয়া, আনতে গিয়ে হরিণটা পালিয়ে গেল। জল খুব সামান্যই আছে চামড়ার বোতলে। এ অবস্থায় নেমে সে ঝরণা থেকে জল আনবেই বা কি করে? হাঁটুটা আরও ফুলেচে। বেদনা এত বেশী যে একটু চলাফেরা করলেই মাথার শির পর্য্যন্ত ছিঁড়ে পড়ে যন্ত্রণায়।

পরিষ্কার আকাশতলে আর্দ্রতাশূন্য বায়ুমন্ডলের গুণে অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্চে। দিকচক্রবালে মেঘলা করে ঘিরেচে নীল পর্ব্বতমালা দূরে দূরে। দক্ষিণ-পশ্চিমে দিগন্ত বিস্তীর্ণ কালাহারী। দক্ষিণে ওয়াহকুক পর্ব্বত, তারও অনেক পিছনে মেঘের মত দৃশ্যমান পল ক্রুগার পর্ব্বতমালা— সলস্‌বেরির দিকে কিছু দেখা যায় না, চিমানিমানি পর্ব্বতের এক উচ্চতর শৃঙ্গ সেদিকে দৃষ্টি আটকেচে।

আজ দুপুর থেকে ওর মাথার উপর শকুনির দল উড়চে। এতদিন এত বিপদেও শঙ্করের যা হয়নি, আজ শকুনির দল মাথার উপর উড়তে দেখে সত্যই ওর ভয় হয়েচে। ওরা তাহোলে কি বুঝেচে যে শিকার জুটবার বেশী দেরী নেই?

সন্ধ্যার কিছু পরে কি একটা শব্দ শুনে চেয়ে দেখলে, পাশেই এক শিলাখন্ডের আড়ালে একটা ধূসর রঙের নেকড়ে বাঘ— নেকড়ের লম্বা ছুঁচালো কাণ দুটো খাড়া হয়ে আছে, সাদা সাদা দাঁতের উপর দিয়ে রাঙা জিভটা অনেকখানি বার হয়ে লকলক করচে। চোখে চোখ পড়তেই সেটা চট করে পাথরের আড়াল থেকে সরে দূরে পালালো।

নেকড়ে বাঘটাও তাহোলে কি বুঝেছে? পশুরা নাকি আগে থেকে অনেক কথা জানতে পারে।

হাড়ভাঙ্গা শীত পড়লো রাত্রে। ও কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বাললে। অগ্নিকুন্ডের আলো যতটুকু পড়েছে তার বাইরে ঘন অন্ধকার।

কি একটা জন্তু এসে অগ্নিকুন্ড থেকে কিছুদূরে অন্ধকারে দেহ মিশিয়ে চুপ করে বসলো। কোয়োট, বন্যকুকুর জাতীয় জন্তু। ক্রমে আর একটা, আর দুটো, আর তিনটে। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে দশ-পনেরোটা এসে জমা হোল। অন্ধকারে তার চারিধার ঘিরে নিঃশব্দে অসীম ধৈর্য্যের সঙ্গে যেন কিসের প্রতীক্ষা করচে।

কি সব অমঙ্গল জনক দৃশ্য!

ভয়ে ওর গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। সত্যিই কি এতদিনে তারও মৃত্যু ঘনিয়ে এসেচে?

এতদিন পরে এল তাহোলে! সে-ও পারলে না রিখটার্সভেল্ড থেকে হীরে নিয়ে পালিয়ে যেতে!

উঃ, আজ কত টাকার মালিক সে। হীরের খনি বাদ যাক, তার সঙ্গে যে ছ’খানা হীরে রয়েচে, তার দাম অন্ততঃ দু-তিন লক্ষ টাকা নিশ্চয়ই হবে। তার গরিব গ্রামে, গরিব বাপ মায়ের বাড়ী যদি সে এই টাকা নিয়ে গিয়ে উঠতে পারতো… কত গরীবের চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারতো, গ্রামের কত দরিদ্র কুমারীকে বিবাহের যৌতুক দিয়ে ভালো পাত্রে বিবাহ দিত, কত সহায়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শেষ ক’টা দিন নিশ্চিন্ত করে তুলতে পারতো…

কিন্তু সে সব ভেবে কি হবে, যা হবার নয়? তার চেয়ে এই অপূর্ব্ব রাত্রির নক্ষত্রালোকিত আকাশের শোভা, এই বিশাল পর্ব্বত ও মরুভূমির নিস্তব্ধ গম্ভীর রূপ, মৃত্যুর আগে শঙ্করও চায় চোখ ভরে দেখতে, সেই ইটালিয়ান যুবক গাত্তির মত। ওরা যে অদৃষ্টের এক অদৃশ্য তারে গাঁথা সবাই — আত্তিলিও গাত্তি ও তার সঙ্গীরা, জিম কার্টার, আলভারেজ, শঙ্কর।

রাত গভীর হয়েচে। কি ভীষণ শীত! একবার সে চেয়ে দেখলে, কোয়োটগুলো এরি মধ্যে কখন আরও কাছে সরে এসেচে। অন্ধকারের মধ্যে আলো পড়ে তাদের চোখগুলো জ্বলচে। শঙ্কর একখানা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারতেই ওরা সব দূরে সরে গেল, কিন্তু কি নিঃশব্দ ওদের গতিবিধি আর কি অসীম তাদের ধৈর্য্য! শঙ্করের মনে হোল, এরা জানে শিকার ওদের হাতের মুঠোয়, হাতছাড়া হবার কোনো উপায় নেই।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যাবেলার সেই ধূসর নেকড়ে বাঘটাও দু-দুবার এসে অন্ধকারে কোয়োটদের পিছনে বসে দেখে গিয়েচে।

একটুও ঘুমুতে ভরসা হল না ওর। কি জানি, কোয়োট আর নেকড়ের দল হয়তো তাহোলে জীবন্তই তাকে ছিঁড়ে খাবে মৃত মনে করে। অবসন্ন, ক্লান্ত দেহে জেগেই বসে থাকতে হবে তাকে। ঘুমে চোখ ঢুলে আসলেও উপায় নেই। মাঝে মাঝে কোয়োটগুলো এগিয়ে এসে বসে, ও জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারতেই সরে যায়। দু-একটা হায়েনাও এসে ওদের দলে যোগ দিয়েচে, হায়েনাদের চোখগুলো অন্ধকারে কি ভীষণ জ্বলে!

কি ভয়ানক অবস্থাতে সে পড়েচে! জনবিরল বর্ব্বর দেশের জনশূন্য পর্ব্বতের সাড়ে তিন হাজার ফুট উপরে সে চলৎশক্তি হীন অবস্থায় বসে… গভীর রাত, ঘোর অন্ধকার… সামান্য আগুন জ্বলচে। মাথার ওপর জলকণাশূন্য স্তব্ধ বায়ুমন্ডলের গুণে আকাশের অগণ্য তারা জ্বলজ্বল করচে যেন ইলেকট্রিক আলোর মত… নীচে তার চারিধার ঘিরে অন্ধকারে মাংসলোলুপ নীরব নেকড়ে, কোয়োট, হায়েনার দল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার এটাও মনে হোল, বাংলার পাড়াগাঁয়ে ম্যালেরিয়ায় ধুঁকে সে মরচে না। এ মৃত্যু বীরের মৃত্যু! পদব্রজে কালাহারি মরুভূমি পার হয়েচে সে— একা। মরে গিয়ে চিমানিমানি পর্ব্বতের শিলায় নাম খুদে রেখে যাবে। সে একজন বিশিষ্ট ভ্রমণকারী ও আবিষ্কারক। অত বড় হীরের খনি সেই তো খুঁজে বার করেছে! আলভারেজ মারা যাওয়ার পরে সেই বিশাল অরণ্য ও পার্ব্বত্য অঞ্চলের গোলকধাঁধা থেকে সে তো একাই বার হতে পেরে এতদূর এসেচে! এখন সে নিরুপায়, অসুস্থ, চলত্‍শক্তি রহিত। তবুও সে যুঝচে, ভয় তো পায়নি, সাহস তো হারায়নি। কাপুরুষ, ভীরু নয় সে। জীবন-মৃত্যু তো অদৃষ্টের খেলা। না বাঁচলে তার দোষ কি?

চাঁদের পাহাড়183.jpg

দীর্ঘ রাত্রি কেটে গিয়ে পুবদিক ফরসা হোল। সঙ্গে সঙ্গে বন্য জন্তুর দল কোথায় পালালো। বেলা বাড়চে, আবার নির্ম্মম সূর্য্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে সুরু করেচে দিকবিদিক। সঙ্গে সঙ্গে শকুনির দল কোথা থেকে এসে হাজির। কেউ মাথার ওপর ঘুরচে, কেউ বা দূরে দূরে গাছের ডালে কি পাথরের ওপরে বসে খুব ধীরভাবে প্রতীক্ষা করচে। ওরা যেন বলচে— কোথায় যাবে বাছাধন? যে কদিন লাফালাফি করবে, করে নাও। আমরা বসি, এমন কিছু তাড়াতাড়ি নেই আমাদের।

শঙ্করের খিদে নেই। খাবার ইচ্ছেও নেই। তবুও সে গুলি করে একটা শকুনি মারলে। রৌদ্র ভীষণ চড়েচে, আগুন-তাতা পাথরের গায়ে পা রাখা যায় না। এ পর্ব্বতও মরুভূমির সামিল, খাদ্য এখানে মেলে না, জলও না। সে মরা শকুনিটা নিয়ে এসে আগুন জ্বেলে ঝলসাতে বসলো। এর আগে মরুভূমির মধ্যেও সে শকুনির মাংস খেয়েচে। এরাই এখন প্রাণ ধারণের একমাত্র উপায়, আজ ও খাচ্চে ওদের, কাল ওরা খাবে ওকে। শকুনিগুলো এসে আবার মাথার উপর জুটেচে।

তার নিজের ছায়া পড়েচে পাথরের গায়ে, সে নির্জ্জন স্থানে শঙ্করের উদ্ভ্রান্ত মনে ছায়াটা যেন একজন সঙ্গী মনে হোল। বোধহয়, ওর মাথা খারাপ হয়ে আসচে। কারণ বেঘোর অবস্থায়, ও কত বার নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো, কতবার পরক্ষণের সচেতন মুহূর্ত্তে নিজের ভুল বুঝে নিজেকে সামলে নিলে।

সে পাগল হয়ে যাচ্চে নাকি? জ্বর হয়নি তো? তার মাথার মধ্যে ক্রমশঃ গোলমাল হয়ে যাচ্চে সব। আলভারেজ… হীরের খনি… পাহাড়, পাহাড়, বালির সমুদ্র… আত্তিলিও গাত্তি। কাল রাত্রে ঘুম হয়নি … আবার রাত আসচে, সে একটু ঘুমিয়ে নেবে।

কিসের শব্দে ওর তন্দ্রা ছুটে গেল। একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ আসচে কোনদিক থেকে? কোন পরিচিত শব্দের মত নয়। কিসের শব্দ? কোনদিক থেকে শব্দটা আসচে তাও বোঝা যায় না। কিন্তু ক্রমশঃ কাছে আসচে সেটা।

হঠাৎ আকাশের দিকে শঙ্করের চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তার মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দ করে কী একটা জিনিস যাচ্চে। ওই কি এরোপ্লেন? সে বইয়ে ছবি দেখেছে বটে।

এরোপ্লেন যখন ঠিক মাথার ওপর এল, শঙ্কর চীৎকার করলে, কাপড় ওড়ালে, গাছের ডাল ভেঙে নাড়লে, কিন্তু কিছুতেই পাইলটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে না। দেখতে দেখতে এরোপ্লেনখানা সুদূরে ভায়োলেট রঙের পল ক্রুগার পর্ব্বতমালার মাথার ওপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

হয়তো আরও এরোপ্লেন যাবে এ পথ দিয়ে। কী আশ্চর্য্য দেখতে এই এরোপ্লেন জিনিসটা। ভারতবর্ষে থাকতে সে একখানাও দেখেনি।

শঙ্কর ভাবলে আগুন জ্বালিয়ে কাঁচা ডাল পাতা দিয়ে সে যথেষ্ট ধোঁয়া করবে। যদি আবার এ পথে যায়, পাইলটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে ধোঁয়া দেখে। একটা সুবিধে হয়েচে, এরোপ্লেনের ঐ বিকট আওয়াজে শকুনির দল কোনদিকে ভেগেচে যেন।

সেদিন কাটল। দিন কেটে রাত্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের দুর্ভোগ হল সুরু। আবার গত রাত্রির পুনরাবৃত্তি। সেই কোয়োটের দল আবার এল। আগুনের চারধারে তারা আবার তাকে ঘিরে বসলো। নেকড়ে বাঘটা সন্ধ্যা না হতেই দূর থেকে একবার দেখে গেল। গভীর রাত্রে আর একবার এল।

কিসে এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়? আওয়াজ করতে ভরসা হয় না— টোটা মাত্র দুটী বাকী। টোটা ফুরিয়ে গেলে তাকে অনাহারে মরতে হবে। মরতে তো হবেই, তবে দু’দিন আগে আর পিছে; যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

কিন্তু আওয়াজ তাকে করতেই হোল। গভীর রাত্রে হায়েনাগুলো এসে কোয়োটদের সাহস বাড়িয়ে দিলে। তারা আরও এগিয়ে সরে এসে তাকে চারি ধার থেকে ঘিরলে। পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মারলে আর ভয় পায় না।

একবার একটু তন্দ্রামত এসেছিল— বসে বসেই ঢুলে পড়েছিল। পর মুহূর্ত্তে সজাগ হয়ে উঠে দেখলে, নেকড়ে বাঘটা অন্ধকার থেকে পা টিপে টিপে তার অত্যন্ত কাছে এসে পড়েচে। ওর ভয় হোল, হয়তো ওটা ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়ের চোটে একবার গুলি ছুঁড়লে। আরেকবার শেষ রাত্রের দিকে ঠিক এ রকমই হোল। কোয়োটগুলোর ধৈর্য্য অসীম, সেগুলো চুপ করে বসে থাকে মাত্র, কিছু বলে না! কিন্তু নেকড়ে বাঘটা ফাঁক খুঁজচে।

রাত ফর্সা হবার সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো অন্তর্হিত হয়ে গেল কোয়োট, হায়েনা ও নেকড়ের দল। সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও আগুনের ধারে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।

একটা কিসের শব্দে শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল।

খানিকটা আগে খুব বড় একটা আওয়াজ হয়েচে কোনো কিছুর। শঙ্করের কাণে তার রেশ এখনও লেগে আছে।

কেউ কি বন্দুকের আওয়াজ করেচে? কিন্তু তা অসম্ভব, এই দুর্গম পর্ব্বতের পথে কোন মানুষ আসবে?

একটী মাত্র টোটা অবশিষ্ট আছে। শঙ্কর ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে, সেটা খরচ করে একটা আওয়াজ করলে। যা থাকে কপালে, মরেচেই তো। উত্তরে দু’বার বন্দুকের আওয়াজ হোল।

আনন্দে ও উত্তেজনায় শঙ্কর ভুলে গেল যে তার পা খোঁড়া, ভুলে গেল যে সে একটানা বেশীদূর যেতে পারে না। তার আর টোটা নেই, সে আর বন্দুকের আওয়াজ করতে পারলে না কিন্তু প্রাণপণে চীৎকার করতে লাগলো। গাছের ডাল ভেঙে নাড়তে লাগলো, আগুন জ্বালবার কাঠকুটোর সন্ধানে চারিদিকে আকুল-দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে লাগলো।

চাঁদের পাহাড়183.jpg

ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক জরীপ করবার দল, কিম্বার্লি থেকে কেপটাউন যাবার পথে, চিমানিমানি পর্ব্বতের নীচে কালাহারি মরুভূমির উত্তর-পূর্ব্ব কোণে তাঁবু ফেলেছিল। সঙ্গে সাতখানা ডবল টায়ার ক্যাটারপিলার চাকা বসানো মোটর গাড়ী, এদের দলে নিগ্রো কুলী ও চাকর-বাকর বাদে ন’জন ইউরোপীয়। জন চারেক হরিণ শিকার করতে উঠেছিল চিমানিমানি পর্ব্বতের প্রথম ও নিম্নতম থাকটাতে।

হঠাৎ এ জনহীন অরণ্যপ্রদেশে সভ্য রাইফেলের আওয়াজে ওরা বিস্মিত হয়ে উঠল। কিন্তু ওদের পুনরায় আওয়াজের প্রত্যুত্তর না পেয়ে ইতস্ততঃ খুঁজতে বেরিয়ে দেখতে পেলে, সামনে একটা অপেক্ষাকৃত উচ্চতর চূড়া থেকে, এক জীর্ণ ও কঙ্কালসার কোটরগতচক্ষু প্রেতমূর্ত্তি উন্মাদের মত হাত-পা নেড়ে তাদের কি বোঝাবার চেষ্টা করচে। তার পরনে ছিন্নভিন্ন অতি মলিন ইউরোপীয় পরিচ্ছদ।

ওরা ছুটে গেল। শঙ্কর আবোল-তাবোল কি বকল, ওরা ভালো বুঝতে পারলে না। যত্ন করে নামিয়ে পাহাড়ের নীচে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল। ওর জিনিসপত্রও নামিয়ে আনা হয়েছিল। ওকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হোল।

কিন্তু এই ধাক্কায় শঙ্করকে বেশ ভুগতে হোল। ক্রমাগত অনাহারে, কষ্টে, উদ্বেগে, অখাদ্য-কুখাদ্য ভক্ষণের ফলে, তার শরীর খুব যখম হয়েছিল, সেই রাত্রেই তার বেজায় জ্বর এল।

চাঁদের পাহাড়122.jpg

জ্বরে সে অঘোর অচৈতন্য হয়ে পড়লো, কখন যে মোটর গাড়ী ওখান থেকে ছাড়লো, কখন যে তারা সলস্‌বেরীতে পৌঁছলো, শঙ্করের কিছুই খেয়াল নেই। সেই অবস্থায় পনেরো দিন সে সলস্‌বেরীর হাসপাতালে কাটিয়ে দিল। তারপর ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে, মাসখানেক পরে একদিন সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরের রাজপথে এসে দাঁড়ালো।
চাঁদের পাহাড় (page 45 crop).jpg

চোদ্দ

সলস্‌বেরী! কত দিনের স্বপ্ন!...

আজ সে সত্যিই বড় একটা ইউরোপীয় ধরনের শহরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। বড় বড় বাড়ী, ব্যাঙ্ক, হোটেল, দোকান, পিচঢালা চওড়া রাস্তা, একপাশ দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রাম চলচে, জুলু রিকসাওয়ালা রিকসা টানচে, কাগজওয়ালা কাগজ বিক্রী করচে। সবই যেন নতুন, যেন এসব দৃশ্য জীবনে কখনো সে দেখেনি।

লোকালয়ে তো এসেচে, কিন্তু সে একেবারে কপর্দ্দকশূন্য। এক পেয়ালা চা খাবার পয়সাও তার নেই। কাছে একটা ভারতীয় দোকান দেখে তার বড় আনন্দ হোল। কতদিন যেন দেখেনি স্বদেশবাসীর মুখ। দোকানদার মেমন মুসলমান, সাবান ও গন্ধদ্রব্যের পাইকারী বিক্রেতা। খুব বড় দোকান। শঙ্করকে দেখেই সে বুঝলে এ দুঃস্থ ও বিপদগ্রস্ত। নিজে দু’টাকা সাহায্য করলে ও একজন বড় ভারতীয় সওদাগরের সঙ্গে দেখা করতে বলে দিলে।

টাকা দুটী পকেটে নিয়ে শঙ্কর আবার পথে এসে দাঁড়ালো। আসবার সময় বলে এল— অসীম ধন্যবাদ টাকা দুটীর জন্যে। এ আমি আপনার কাছে ধার নিলাম, আমার হাতে পয়সা এলে আপনাকে কিন্তু এ টাকা নিতে হবে। সামনেই একটা ভারতীয় রেষ্টুরেণ্ট। সে ভাল কিছু খাবার লোভ সম্বরণ করতে পারলে না, কতদিন সভ্য খাদ্য মুখে দেয়নি! সেখানে ঢুকে এক টাকার পুরী, কচুরী, হালুয়া, মাংসের চপ, কেক পেট ভরে খেল। সেই সঙ্গে দু-তিন পেয়ালা কফি।

চায়ের টেবিলে একখানা পুরনো কাগজের দিকে তার নজর পড়লো। তাতে একটা জায়গায় বড় বড় অক্ষরের হেড লাইনে লেখা আছেঃ—

National Park Survey Party’s Singular Experience
A lonely Indian found in the desert
Dying of thirst and exhaustion
His strange story

শঙ্কর দেখলে, তার একটা ফটোও কাগজে ছাপা হয়েচে। তার মুখে সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা গল্পও দেওয়া হয়েচে। এ রকম গল্প সে কারো কাছে করে নি।

খবরের কাগজখানার নাম ‘সলস্‌বেরী ডেলি ক্রনিকল’। সে খবরের কাগজের আপিসে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে। তার চারিপাশে ভিড় জমে গেল। ওকে খুঁজে বার করবার জন্যে রিপোর্টারের দল অনেক চেষ্টা করেছিল জানা গেল। সেখানে চিমানিমানি পর্ব্বতে পা-ভে পড়ে থাকার গল্প বলে ও ফটো তুলতে দিয়ে শঙ্কর পঞ্চাশ টাকা পেলে। ও থেকে সে আগে সেই সহৃদয় মুসলমান দোকানদারের টাকা দুটী দিয়ে এল।

ওদের দৃষ্ট আগ্নেয়গিরিটার সম্বন্ধে সে কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখলে। তাতে আগ্নেয়গিরিটার নামকরণ করলে— মাউন্ট আলভারেজ। তবে মধ্য আফ্রিকার অরণ্যে লুকানো এত বড় একটা আস্ত জীবন্ত আগ্নেয়গিরির এই গল্প কেউ বিশ্বাস করলে, কেউ করলে না। অবিশ্যি রত্নের গুহার বাষ্পও সে কাউকে জানতে দেয়নি। দিলে দলে দলে লোক ছুটবে ওর সন্ধানে।

তারপরে একটা বইয়ের দোকানে গিয়ে সে এক রাশ ইংরেজী বই ও মাসিক পত্রিকা কিনলে। বই পড়েনি কতকাল! সন্ধ্যায় একটা সিনেমায় ছবি দেখলে। কতকাল পরে, রাত্রে হোটেলের ভাল বিছানায় ইলেকট্রিক আলোর তলায় শুয়ে বই পড়তে পড়তে সে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে নীচের প্রিন্স আলবার্ট ভিক্টর স্ট্রীটের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ট্রাম যাচ্ছে নীচে দিয়ে, জুলু রিকসাওয়ালা রিকসা চালিয়ে নিয়ে যাচ্চে, ভারতীয় কফিখানায় ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজচে, মাঝে মাঝে দু' চারখানা মোটরও যাচ্চে।...এর সঙ্গে মনে হোল আর একটা ছবি— সামনে আগুনের কুণ্ড, কিছুদূরে বৃত্তাকারে ঘিরে বসে আছে কোয়োট্ ও হায়েনার দল। ওদের পিছনে নেকড়েটার দুটো গোল গোল চোখ আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে অন্ধকারের মধ্যে।

কোনটা স্বপ্ন?...চিমানিমানি পর্ব্বতে যাপিত সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি, না আজকের এই রাত্রি?

ইতিমধ্যে সলস্‌বেরীতে শঙ্কর একজন বিখ্যাত লোক হয়ে গেল। রিপোর্টারের ভিড়ে তার হোটেলের হল সব সময় ভর্ত্তি। খবরের কাগজের লোক আসে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ছাপবার কণ্ট্রাক্ট করতে, কেউ আসে ফটো নিতে।

আত্তিলিও গাত্তির কথা সে ইটালিয়ান কনসাল জেনারেলকে জানালে। তাঁর আপিসের পুরোণো কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেল, আত্তিলিও গাত্তি নামে একজন সম্ভ্রান্ত ইটালিয়ান যুবক ১৮৭৯ সালের আগস্ট মাসে পর্টুগীজ পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে জাহাজ ডুবি হবার পর নামে। তারপর যুবকটীর আর কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি। তার আত্মীয়-স্বজন ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোক। ১৮৯০-৯৫ সাল পর্য্যন্ত তারা তাদের নিরুদ্দিষ্ট আত্মীয়ের সন্ধানের জন্যে পূর্ব্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকার কনসুলেট আপিসকে জ্বালিয়ে খেয়েছিল, পুরস্কার ঘোষণা করাও হয়েছিল তার সন্ধানের জন্যে। ১৮৯৫ সাল থেকে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল।

পূর্ব্বোক্ত মুসলমান দোকানদারটীর সাহায্যে সে ব্ল্যাকমুন ষ্ট্রীটের বড় জহুরী রাইডাল ও মর্স‌বির দোকানে চারখানা পাথর সাড়ে বত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রী করলে। বাকী দু’খানার দর আরও বেশী উঠেছিল, কিন্তু শঙ্কর সে দু’খানা পাথর তার মাকে দেখাবার জন্যে দেশে নিয়ে যেতে চায়। এখন বিক্রী করবার তার ইচ্ছে নেই।

8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg
8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg
নীল সমুদ্র!……

বম্বেগামী জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে পর্টুগীজ পূর্ব্ব-আফ্রিকার বেইরা বন্দরের নারিকেল বনশ্যাম তীরভূমিকে মিলিয়ে যেতে দেখতে দেখতে, শঙ্কর ভাবছিল তার জীবনের এই এ্যাডভেঞ্চারের কথা। এই তো জীবন, এই ভাবেই তো জীবনকে ভোগ করতে চেয়েছিল সে। মানুষের আয়ু মানুষের জীবনের ভুল মাপকাটি। দশ বৎসরের জীবন উপভোগ করেচে সে এই দেড় বছরে। আজ সে শুধু একজন ভবঘুরে পথিক নয়, একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির সহ-আবিষ্কারক। মাউন্ট আলভারেজকে সে জগতে প্রসিদ্ধ করবে। দূরে ভারত মহাসমুদ্রের পারে জননী জন্মভূমি পূণ্যভূমি ভারতবর্ষের জন্য এখন মন তার চঞ্চল হয়ে উঠেচে। তার মনটী উত্‍সুক হয়ে আছে, কবে দূর থেকে বোম্বাইয়ের রাজাবাঈ টাওয়ারের উঁচু চূড়োটা মাতৃভূমির উপকূলের সান্নিধ্য ঘোষণা করবে… তারপর বাউল কীর্ত্তনগান মুখরিত বাংলাদেশের প্রান্তে তাদের শ্যামল ছোট্টপল্লী… সামনে আসচে বসন্তকাল… পল্লীপথে যখন একদিন সজনে ফুলের দল পথ বিছিয়ে পড়ে থাকবে, বৌ-কথা-ক ডাকবে ওদের বকুল গাছটায়… নদীর ঘাটে লাগবে গিয়ে ওর ডিঙি।

বিদায়! আলভারেজ বন্ধু!… স্বদেশে ফিরে যাওয়ার এই আনন্দের মুহূর্ত্তে তোমার কথাই আজ মনে হচ্চে। তুমি সেই দলের মানুষ, সারা আকাশ যাদের ঘরের ছাদ, সারা পৃথিবী যাদের পায়ে চলার পথ। আশীর্ব্বাদ কোরো তোমার মহারণ্যের

নির্জ্জন সমাধি থেকে, যেন তোমার মতো হতে পারি জীবনে, অমনি সুখ-দুঃখে নিস্পৃহ, অমনি নির্ভীক।
বিদায়! বন্ধু আত্তিলিও গাত্তি! অনেক জন্মের বন্ধু ছিলে তুমি।

তোমরা সবাই মিলে শিখিয়েছ চীন দেশে প্রচলিত সেই প্রাচীন ছড়াটঈর সত্যতা—

ছাদের আলসের দিব্যি চৌরস একখানা টালি হয়ে অনড় অবস্থায় সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকার চেয়ে স্ফটিক প্রস্তর হয়ে ভেঙে যাওয়াও ভালো, ভেঙে যাওয়াও ভালো, ভেঙে যাওয়াও ভালো।

8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg 8-Point-Star black.svg
আবার তাকে আফ্রিকায় ফিরতে হবে। এখন জন্মভূমির টান বড় টান। জন্মভূমির কোলে এখন সে কিছুদিন কাটাবে। তারপর দেশেই সে কোম্পানী গঠন করবার চেষ্টা করবে— আবার সুদূর রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতে ফিরবে রত্নখনির পুনর্ব্বার অনুসন্ধানে— খুঁজে সে বার করবেই…

ততদিন — বিদায়!

—শেষ—

পরিশিষ্ট

সল্‌স্‌বেরি থাকতে সে সাউথ রোডেসিয়ান মিউজিয়ামের কিউরেটর প্রসিদ্ধ জবতত্ত্ববিদ্‌ ডাঃ ফিট্‌জেরাল্ডের সঙ্গে দেখা করেছিল, বিশেষ করে বুনিপের কথাটা তাঁকে বলবার জন্যে। দেশে ফিরে আসবার কিছুদিন পরে ডাঃ ফিট্‌জেরাল্ডএর কাছ থেকে নিম্নলিখিত পত্রখানা পায়।

The South Rhodesian Museum
Salisbury, Rhodesia
South Africa 
January 12,1911
Dear Mr. Chowdhury,

I am writing this letter to fulfil my promise to you to let you know what I thought about your report of a strange three toed monster in the wilds of the Richtersveldt Mountains. On looking up my files I find other similar accounts by explorers who had been to the region before you, specially by Sir Robert McCulloch, the famous naturalist, whose report has not yet been published, owing to his sudden and untimely death last year. On thinking the matter over, I am inclined to belive that the monster you saw was nothing more than a species of anthropoid ape, closely related to the gorilla, but much bigger in size and more savage than the specimens found in the Ruwenzori and Virunga Mountains. This species is becoming rarer and rarer every day, and such numbers as do exist are not easily to be got at on account of their shyness and the habit of hiding themselves in the depths of the high-altitude rain forests of the Richtersveldt. It is only the very fortunate traveller who gets glimpses of them, and I should think that in meeting them he runs risks proportionate to his good luck.

Congratulating you on both your luck and pluck.

I remain,
Yours sincerely
J.G. Fitzgerald


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন