চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় [সম্পূর্ণ বই] [৮ম-৯বম পর্ব]


আট
 মাঝ-রাত্রে শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল। কি একটা শব্দ হচ্ছে ঘন বনের মধ্যে, কি একটা কান্ড কোথায় ঘটচে বনে। আলভারেজও বিছানায় উঠে বসেচে। দু’জনেই কান-খাড়া করে শুনলে— বড় অদ্ভুত ব্যাপার! কি হচ্ছে বাইরে?

 শঙ্কর তাড়াতাড়ি টর্চ্চ জ্বেলে বাইরে আসছিল, আলভারেজ বারণ করলে। বল্লে—এসব অজানা জঙ্গলে রাত্রিবেলা ওরকম

চাঁদের পাহাড় (page 119 crop).jpg

তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে যেও না। তোমাকে অনেকবার সতর্ক করে দিয়েচি। বিনা বন্দুকেই বা যাচ্চ কোথায়?

 তাঁবুর বাইরে রাত্রি ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু’জনেই টর্চ্চ ফেলে দেখলে—

 বন্য-জন্তুর দল গাছ-পালা ভেঙ্গে ঊর্দ্ধশ্বাসে উন্মত্তের মত দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পশ্চিমের সেই ভীষণ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে, পুবদিকের পাহাড়টার দিকে চলেচে! হায়েনা, বেবুন, বুনো মহিষ। দুটো চিতাবাঘ তো ওদের গা ঘেঁষে ছুটে পালালো। আরও আসচে… দলে দলে আসচে… ধাড়ী ও মাদী কলোবাস বাঁদর দলে দলে ছানাপোনা নিয়ে ছুটেচে। সবাই যেন কোনো আকস্মিক বিপদের মুখ থেকে প্রাণের ভয়ে ছুটচে! আর সঙ্গে সঙ্গে দূরে কোথায় একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে— চাপা, গম্ভীর, মেঘগর্জ্জনের মতো শব্দটা, কিংবা দূরে কোথাও হাজারটা জয়ঢাক যেন এক সঙ্গে বাজচে!

 ব্যাপার কী! দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে চাইলে। দু’জনেই অবাক। আলভারেজ বল্লে— শঙ্কর, আগুনটা ভালো করে জ্বালো, নয়তো বন্যজন্তুর দল আমাদের তাঁবুসুদ্ধ ভেঙে মাড়িয়ে চলে যাবে।

 জন্তুদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলল যে! মাথার ওপরেও পাখির দল বাসা ছেড়ে পালাচ্চে। প্রকান্ড একটা স্প্রিংবক হরিণের দল ওদের দশ গজের মধ্যে এসে পড়ল।

 কিন্তু ওরা দু’জনে তখন এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েচে ব্যাপার দেখে যে, এত কাছে পেয়েও গুলি করতে ভুলে গেল। এমন ধরনের দৃশ্য ওরা জীবনে কখনো দেখেনি!

 শঙ্কর আলভারেজকে কি একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তারপরেই— প্রলয় ঘটল। অন্ততঃ শঙ্করের তো তাই বলে মনে হলো। সমস্ত পৃথিবীটা দুলে এমন কেঁপে উঠল যে, ওরা দু’জনেই টলে পড়ে গেল মাটীতে, সঙ্গে সঙ্গে হাজারটা বাজ যেন নিকটেই কোথাও পড়ল। মাটী যেন চিরে ফেঁড়ে গেল— আকাশটাও যেন সেই সঙ্গে ফাটলো।

 আলভারেজ মাটী থেকে উঠবার চেষ্টা করতে করতে বল্লে— ভূমিকম্প!

 কিন্তু পরক্ষণেই তারা দেখে বিস্মিত হোল, রাত্রির অমন ঘুটঘুটে অন্ধকার হঠাৎ দূর হয়ে, পঞ্চাশহাজার বাতির এমন বিজলি আলো জ্বলে উঠল কোথা থেকে?

 তারপর তাদের নজরে পড়ল, দূরের সেই পাহাড়ের চূড়াটার দিকে। সেখানে যেন একটা প্রকান্ড অগ্নিলীলা শুরু হয়েচে। রাঙা হয়ে উঠেচে সমস্ত দিগন্ত সেই প্রলয়ের আলোয়, আগুন-রাঙা মেঘ ফুঁসিয়ে উঠেচে পাহাড়ের চূড়ো থেকে দু-হাজার, আড়াই হাজার ফুট পর্য্যন্ত উঁচুতে— সঙ্গে সঙ্গে কি বিশ্রী নিঃশ্বাস রোধকারী গন্ধকের উত্‍কট গন্ধ বাতাসে!

 আলভারেজ সেদিকে চেয়ে ভয়ে বিস্ময়ে বলে উঠল— আগ্নেয়গিরি! সান্টা আনা গ্রাৎ‌সিয়া ডা কর্ডোভা!

 কি অদ্ভুত ধরনের ভীষণ সুন্দর দৃশ্য! কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলে না ওরা খানিকক্ষণ। লক্ষটা তুবড়ি এক সঙ্গে জ্বলচে, লক্ষটা রঙমশালে যেন এক সঙ্গে আগুন দিয়েছে, শঙ্করের মনে হল। রাঙা আগুনের মেঘ মাঝে মাঝে নীচু হয়ে যায়, হঠাৎ যেমন আগুনে ধুনো পড়লে দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে, অমনি দপ্‌ করে হাজার ফুট ঠেলে ওঠে। আর সেই সঙ্গে হাজারটা বোমাফাটার আওয়াজ।  এদিকে পৃথিবী এমন কাঁপচে যে, দাঁড়িয়ে থাকা যায় না— কেবল টলে টলে পড়তে হয়। শঙ্কর তো টলতে টলতে তাঁবুর মধ্যে ঢুকলো। ঢুকে দেখে একটা ছোট কুকুর ছানার মত জীব তার বিছানায় এক সঙ্গে গুটিসুটি হয়ে ভয়ে কাঁপচে। শঙ্করের টর্চ্চের আলোয় সেটা থতমত খেয়ে আলোর দিকে চেয়ে রইল, আর তার চোখ দুটো মণির মতো জ্বলতে লাগলো।

 আলভারেজ তাঁবুতে ঢুকে দেখে বল্লে— নেকড়ে বাঘের ছানা। রেখে দাও, আমাদের আশ্রয় নিয়েচে যখন প্রাণের ভয়ে।

 ওরা কেউ এর আগে প্রজ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি দেখেনি, তা থেকে যে বিপদ আসতে পারে তা ওদের জানা নেই— কিন্তু আলভারেজের কথা ভালো করে শেষ হতে না হতে, হঠাৎ কি প্রচন্ড ভারী জিনিসের পতনের শব্দে ওরা আবার তাঁবুর বাইরে গিয়ে যখন দেখলে যে, একখানা পনেরো সের ওজনের জ্বলন্ত কয়লার মতো রাঙা পাথর অদূরে একটা ঝোপের ওপর এসে পড়েচে— সঙ্গে সঙ্গে ঝোপটাও জ্বলে উঠেচে। তখন আলভারেজ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বল্লে— পালাও, পালাও; শঙ্কর, তাঁবু ওঠাও— শীগগির—

 ওরা তাঁবু ওঠাতে ওঠাতে আরও দু-পাঁচখানা আগুনরাঙা জ্বলন্ত ভারী পাথর এদিক ওদিক সশব্দে পড়লো। নিঃশ্বাস তো এদিকে বন্ধ হয়ে আসে, এমনি ঘন গন্ধকের ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়েচে।

 দৌড়… দৌড়… দৌড়। দু-ঘন্টা ধরে ওরা জিনিসপত্র কতক টেনে হিঁচড়ে, কতক বয়ে নিয়ে পুবদিকের সেই পাহাড়ের নিচে গিয়ে পৌঁছুলো। সেখানে পর্য্যন্ত গন্ধকের গন্ধ বাতাসে। আধঘন্টা পরে সেখানেও পাথর পড়তে সুরু করলে। ওরা পাহাড়ের উপর উঠল, সেই ভীষণ জঙ্গল আর রাত্রির অন্ধকার ঠেলে। ভোর যখন হোল, তখন আড়াই হাজার ফুট উঠে পাহাড়ের ঢালুতে বড় একটা গাছের তলায়, দু’জনেই হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লো।

 সূর্য্য ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে অগ্ন্যুৎপাতের সে ভীষণ সৌন্দর্য্য অনেকখানি কমে গেল, কিন্তু শব্দ ও পাথর পড়া যেন বাড়লো। এবার শুধু পাথর নয়, তার সঙ্গে খুব মিহি ধূসর বর্ণের ছাই আকাশ থেকে পড়চে… গাছপালা লতাপাতার ওপর দেখতে দেখতে পাৎলা একপুর ছাই জমে গেল।

 সারাদিন সমানভাবে অগ্নিলীলা চললো— আবার রাত্রি এল। নিম্নের উপত্যকা ভূমির অত বড় হেমলক গাছের জঙ্গল দাবানলে ও প্রস্তর বর্ষণে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল। রাত্রিতে আবার সেই ভীষণ সৌন্দর্য্য, কতদূর পর্য্যন্ত বন ও আকাশ, কতদূরের দিগন্ত লাল হয়ে উঠেচে পর্ব্বতের অগ্নি-কটাহের আগুনে— তখন পাথর পড়াটা একটু কেবল কমেচে। কিন্তু সেই রাঙা আগুনভরা বাষ্পের মেঘ তখনো সেই রকমই দীপ্ত হয়ে উঠেচে।

 রাত দুপুরের পরে একটা বিরাট বিস্ফোরণের শব্দে ওদের তন্দ্রা ছুটে গেল— ওরা সভয়ে চেয়ে দেখলে জ্বলন্ত পাহাড়ের চূড়ার মুণ্ডটা উড়ে গিয়েচে— নীচের উপত্যকাতে ছাই, আগুন ও জ্বলন্ত পাথর ছড়িয়ে পড়ে অবশিষ্ট জঙ্গলটাকেও ঢাকা দিলে। আলভারেজ পাথরের ঘায়ে আহত হোল। ওদের তাঁবুর কাপড়ে আগুন ধরে গেল। পেছনের একটা উঁচু গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল পাথরের চোট খেয়ে।

 শঙ্কর ভাবছিল— এই জনহীন আরণ্য অঞ্চলে এত বড় একটা প্রাকৃতিক বিপর্য্যয় যে ঘটে গেল, তা কেউ দেখতেও পেতো না, যদি তারা না থাকতো। সভ্য জগৎ জানেও না, আফ্রিকার গহন অরণ্যের এ আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব। কেউ বল্লেও বিশ্বাস করবে না হয়তো।

 সকালে বেশ স্পষ্ট দেখা গেল, মোমবাতি হাওয়ার মুখে জ্বলে গিয়ে যেমন মাথার দিকে অসমান খাঁজের সৃষ্টি করে, পাহাড়ের চূড়াটার তেমনি চেহারা হয়েচে। কুলফি বরফটাতে ঠিক যেন কে আর একটা কামড় বসিয়েচে।

 আলভারেজ ম্যাপ দেখে বল্লে— এটা আগ্নেয়গিরি বলে ম্যাপে দেওয়া নেই। সম্ভবতঃ বহু বৎসর পরে এই এর প্রথম অগ্ন্যুৎপাত। কিন্তু এর যে নাম ম্যাপে দেওয়া আছে, তা খুব অর্থপূর্ণ।

 শঙ্কর বল্লে— কি নাম?

 আলভারেজ বল্লে— এর নাম লেখা আছে ‘ওলডোনিও লেঙ্গাই’— প্রাচীন জুলু ভাষায় এর মানে ‘অগ্নিদেবের শয্যা’। নামটা দেখে মনে হয়, এ অঞ্চলের প্রাচীন লোকদের কাছে এ পাহাড়ের আগ্নেয় প্রকৃতি অজ্ঞাত ছিল না। বোধহয় তারপর দু'একশো বছর কিংবা তারও বেশীকাল এটা চুপচাপ ছিল।

 ভারতবর্ষের ছেলে শঙ্করের দুই হাত আপনাআপনি প্রণামের ভঙ্গিতে ললাট স্পর্শ করলে। প্রণাম, হে রুদ্রদেব, প্রণাম। আপনার তান্ডব দেখবার সুযোগ দিয়েচেন, এজন্যে প্রণাম গ্রহণ করুন, হে দেবতা। আপনার এ রূপের কাছে শত হীরকখনি তুচ্ছ হয়ে যায়, আমার সমস্ত কষ্ট সার্থক হোল।











নয়

 আগ্নেয় পর্ব্বতের অত কাছে বাস করা আলভারেজ উচিত বিবেচনা করলে না। ওলডোনিও লেঙ্গাই পাহাড়ের ধূমায়িত শিখরদেশের সান্নিধ্য পরিত্যাগ করে, তারা আরও পশ্চিম ঘেঁসে চলতে লাগল। সেদিকের গহণ অরণ্যে আগুনের আঁচটীও লাগেনি, বর্ষার জলে সে অরণ্য আরও নিবিড় হয়ে উঠেচে, ছোট ছোট গাছপালার ও লতাঝোপের সমাবেশে। ছোট বড় কত ঝরণাধারা ও পার্ব্বত্য-নদী বয়ে চলচে - তাদের মধ্যে একটাও আলভারেজের পূর্ব্ব পরিচিত নয়।

 এইবার এক জায়গায় ওরা এসে উপস্থিত হোল, যেখানে চারিদিকেই চূণাপাথর ও গ্রানাইটের ছোট বড় পাহাড় ও প্রত্যেক পাহাড়ের গায়েই নানা আকারের গুহা। স্থানটার প্রাকৃতিক দৃশ্য রিখটারসভেল্ডের সাধারণ দৃশ্য থেকে একটু অন্য রকম। এখানে বন তত ঘন নয়, কিন্তু খুব বড় বড় গাছ চারিদিকে, আর যেখানে সেখানে পাহাড় ও গুহা।

 একটা উঁচু ঢিবির মত গ্রানাইটের পাহাড়ের ওপর ওরা তাঁবু ফেলে রইল। এখানে এসে পর্য্যন্ত শঙ্করের মনে হয়েচে জায়গাটা ভাল নয়। কি একটা অস্বস্তি, মনের মধ্যে কি একটা আসন্ন বিপদের আশঙ্কা, তা সে না ভাল করে নিজে বুঝতে, না পারে আলভারেজকে বোঝাতে।

 একদিন আলভারেজ বল্লে - সব মিথ্যে শঙ্কর, আমরা এখনও বনের মধ্যে ঘুরচি। আজ সেই গাছটা আবার দেখেচি, সেই D. A. লেখা। অথচ তোমার মনে আছে, আমারা যতদূর সম্ভব পশ্চিমদিক ঘেঁসে চলেচি পনেরো দিন। কি করে আমরা আবার সেই গাছের কাছে আসতে পারি?

 শঙ্কর বল্লে - তবে এখন কি উপায়?

 — উপায় আছে। আজ রাত্রে একটা বড় গাছের মাথায় উঠে নক্ষত্র দেখে দিকনির্ণয় করতে হবে। তুমি তাঁবুতে থেকো।

 শঙ্কর একটা কথা বুঝতে পারছিল না। তারা যদি চক্রাকারে ঘুরচে, তবে এই অনুচ্চ শৈলমালা ও গুহার দেশে কি করে এল? এ অঞ্চলে তো কখনো আসে-নি বলেই মনে হয়। আলভারেজ এর উত্তরে বল্লে, গাছটাতে নাম খোদাই দেখে সে আর কখনো তার পূর্ব্বে আসবার চেষ্টা করে নি। পূর্ব্ব দিকে মাইল দুই এলেই এই স্থানটাতেই ওরা পৌঁছতো।

 সে রাত্রে শঙ্কর একা তাঁবুতে বসে বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাজসিংহ' পড়ছিল। এই একখানা বই সে দেশ থেকে আসবার সময় সঙ্গে করে আনে, এবং বহুবার পড়লেও সময় পেলেই আবার পড়ে।

 কতদূরে ভারতবর্ষ, তার মধ্যে চিতোর, মেওয়ার, মোগল-রাজপুতের বিবাদ! এই অজানা মহাদেশের অজানা মহা অরণ্যানীর মধ্যে বসে সে সব যেন অবাস্তব বলে মনে হয়।  তাঁবুর বাইরে হঠাৎ যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শঙ্কর প্রথমটা ভাবলে, আলভারেজ গাছ থেকে নেমে ফিরে আসচে বোধ হয় - কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হোল, এ মানুষের স্বাভাবিক পায়ের শব্দ নয়, কেউ দুপায়ে থলে জড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাটীতে পা ঘেঁসে ঘেঁসে টেনে টেনে চললে যেন এমন ধরণের শব্দ হওয়া সম্ভব। আলভারেজের উইনচেষ্টার রিপিটারটা হাতের কাছেই ছিল, ও সেটা তাঁবুর দরজার দিকে বাগিয়ে বসলো। বাইরে পদশব্দটা একবার থেমে গেল - পরেই আবার তাঁবুর দক্ষিণ পাশ থেকে বাঁদিকে এল। একটা কোনো বড় প্রাণীর যেন ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল - ঠিক এই রকমই। শঙ্কর একটু ভয় খেয়ে সংযম হারিয়ে ফেলে রাইফেল ছুঁড়ে বসলো। একবার...দুবার -

 সঙ্গে সঙ্গে মিনিট দুই পরে দূরের গাছের মাথা থেকে প্রত্যুত্তরে দুবার রিভলবারের আওয়াজ পাওয়া গেল। আলভারেজ মনে ভেবেচে, শঙ্করের কোনো বিপদ উপস্থিত, নতুবা রাত্রে খামোকা বন্দুক ছুঁড়বে কেন? বোধ হয় সে তাড়াতাড়ি নেমেই আসচে।

 এদিকে চারিদিক বন্দুকের আওয়াজে জানোয়ারটা বোধ হয় পালিয়েচে, আর তার সাড়াশব্দ নেই। শঙ্কর টর্চ্চ জ্বেলে তাঁবুর বাইরে এসে ভাবলে, আলভারেজকে সঙ্কেতে গাছ থেকে নামতে বারণ করবে, এমন সময় কিছুদূরে বনের মধ্যে হঠাৎ আবার দু’বার পিস্তলের আওয়াজ এবং সেই সঙ্গে একটা অস্পষ্ট চিত্‍কার শুনতে পাওয়া গেল।

 শঙ্কর পিস্তলের আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটে গেল। কিছুদূরে গিয়েই দেখলে বনের মধ্যে একটা বড় গাছের তলায় আলভারেজ শুয়ে। টর্চ্চের আলোয় তাকে দেখে শঙ্কর শিউরে উঠল ভয়ে বিস্ময়ে— তার সর্ব্বশরীর রক্তমাখা, মাথাটা বাকী শরীরের সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক কোণের সৃষ্টি করেচে। গায়ের কোটটা ছিন্নভিন্ন।

 শঙ্কর তাড়াতাড়ি ওর পাশে গিয়ে বসে ওর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলে। ডাকলে— আলভারেজ! আলভারেজ!

 আলভারেজের সাড়া নেই। তার ঠোঁট দুটো একবার যেন নড়ে উঠল, কি যেন বলতে গেল। সে শঙ্করের দিকে চেয়েই আছে, অথচ সে চোখে যেন দৃষ্টি নেই; অথবা কেমন যেন নিস্পৃহ, উদাস দৃষ্টি।

 শঙ্কর ওকে বহন করে তাঁবুতে নিয়ে এল। মুখে জল দিল, তারপর গায়ের কোটটা খুলতে গিয়ে দেখে, গলার নিচে কাঁধের দিকের খানিকটা জায়গার মাংস কে যেন ছিঁড়ে নিয়েচে! সারা পিঠটারও সেই অবস্থা। কোন এক অসাধারণ বলশালী জন্তু, তীক্ষ্ণধার নখে বা দন্তে পিঠখানা চিরে ফালা ফালা করেচে।

 পাশেই নরম মাটীতে কোনো এক জন্তুর পায়ের দাগ—

 তিনটা মাত্র আঙুল সে পায়ে।

 সারারাত্রি সেই ভাবেই কাটল, আলভারেজের সাড়া নেই, সংজ্ঞা নেই। সকাল হবার সঙ্গে হঠাৎ যেন তার চেতনা ফিরে এল। শঙ্করের দিকে বিস্ময়ের ও অচেনার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে, যেন এর আগে সে কখনো শঙ্করকে দেখেনি। তারপর আবার চোখ বুঁজল। দুপুরের পর খুব সম্ভবতঃ নিজের মাতৃভাষায় কী সব বকতে সুরু করল, শঙ্কর এক বর্ণও বুঝতে পারলে না। বৈকালের দিকে সে হঠাৎ শঙ্করের দিকে চাইলে। চাইবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের মনে হোল, সে ওকে চিনতে পেরেচে। এইবার ইংরাজীতে বল্লে— শঙ্কর! এখনো বসে আছ? তাঁবু ওঠাও, চল যাই— তারপর অপ্রকৃতিস্থের মতো নির্দ্দেশহীন ভঙ্গিতে হাত তুলে বল্লে— রাজার ঐশ্বর্য লুকোনো রয়েচে ঐ পাহাড়ের গুহার মধ্যে— তুমি দেখতে পাচ্চ না— আমি দেখতে পাচ্চি। চল আমরা যাই— তাঁবু ওঠাও— দেরী কোরো না…

 এই আলভারেজের শেষ কথা।

চাঁদের পাহাড়122.jpg

 তারপর কতক্ষণ শঙ্কর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সন্ধ্যা হোল, একটু একটু করে সমগ্র বনানী ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল।

 শঙ্করের তখন চমক ভাঙল। সে তাড়াতাড়ি উঠে আগে আগুন জ্বাললে, তারপর দুটো রাইফেলে টোটা ভরে, তাঁবুর দোরের দিকে বন্দুকের নল বাগিয়ে, আলভারেজের মৃতদেহের পাশে একখানা সতরঞ্জির ওপর বসে রইল।  তারপর সে রাত্রে আবার নামলো তেমনি ভীষণ বর্ষা। তাঁবুর কাপড় ফুঁড়ে জল পড়ে জিনিসপত্র ভিজে গেল। শঙ্কর তখন কিন্তু এমন হয়ে গিয়েচে যে, তার কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। এই ক’মাসে সে আলভারেজকে সত্যিই ভালোবেসে ছিল, তার নির্ভীকতা, তার সংকল্পে অটলতা, তার পরিশ্রম করবার অসাধারণ শক্তি, তার বীরত্ব— শঙ্করকে মুগ্ধ করেছিল। সে আলভারেজকে নিজের পিতার মতো ভালোবাসতো। আলভারেজও তাকে তেমনি স্নেহের চোখেই দেখতো।

 কিন্তু এসবের চেয়েও শঙ্করের মনে হচ্চে বেশী যে, আলভারেজ মারা গেল শেষকালে সেই অজ্ঞাত জানোয়ারটারই হাতে। ঠিক জিম কার্টারের মতোই।

 রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে তার মন ভয়ে আকুল হয়ে উঠল। সম্মুখে ভীষণ অজানা মৃত্যুদূত— ঘোর রহস্যময় তার অস্তিত্ব। কখন সে আসবে, কখন বা যাবে, কেউ তার সন্ধান দিতে পারবে না। ঘুমে ঢুলে না পড়ে শঙ্কর মনের বলে জেগে বসে রইল সারা রাত।

 ওঃ, সে কি ভীষণ রাত্রি! যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ও রাত্রির কথা সে ভুলবে না। গাছে গাছে, ডালে ডালে, হাজার ধারায় বৃষ্টি পতনের শব্দ ও একটানা ঝড়ের শব্দে অরণ্যানীর অন্য সকল নৈশ শব্দ আজ ডুবিয়ে দিয়েচে, পাহাড়ের উপর বড় গাছ মড় মড় করে ভেঙে পড়চে। এই ভয়ঙ্কর রাত্রিতে সে একা এই ভীষণ অরণ্যানীর মধ্যে! কালো গাছের গুঁড়িগুলো যেন প্রেতের মতো দেখাচ্চে, অত বড় ঝড় বৃষ্টিতেও জোনাকির ঝাঁক জ্বলচে। সম্মুখে বন্ধুর মৃতদেহ। ভয় পেলে চলবে না! সাহস আনতেই হবে, নতুবা ভয়েই সে মারা যাবে। সাহস আনবার প্রাণপণ চেষ্টায় সে রাইফেল দুটীর দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলে। একটা উইনচেষ্টার, অপরটী ম্যানলিকার - দুটোরই ম্যাগাজিনে টোটা ভর্ত্তি। এমন কোনো শরীরধারী জীব নেই, যে এই দুই শক্তিশালী অতি ভয়ানক মারণাস্ত্রকে উপেক্ষা করে আজ রাত্রে অক্ষতদেহে তাঁবুতে ঢুকতে পারে।

 ভয় ও বিপদ মানুষকে সাহসী করে। শঙ্কর সারারাত সজাগ পাহারা দিল। পরদিন সকালে আলভারেজের মৃতদেহ সে একটা বড় গাছের তলায় সমাধিস্থ করলে এবং দুখানা গাছের ডাল ক্রুশের আকারে শক্ত লতা দিয়ে বেঁধে সমাধির ওপর তা পুঁতে দিলে।

 আলভারেজের কাগজপত্রের মধ্যে ওপর্টো খনি বিদ্যালয়ের একটা ডিপ্লোমা ছিল ওর নামে। তাদের শেষ পরীক্ষায় আলভারেজ সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েচে। ওর কথাবার্ত্তায় অনেক সময়ই শঙ্করের সন্দেহ হোত যে, সে নিতান্ত মূর্খ, ভাগ্যানেষী, ভবঘুরে নয়।

 লোকালয় থেকে বহুদূরে এই জনহীন, গহণ অরণ্যে ক্লান্ত আলভারেজের রত্নানুসন্ধান শেষ হোল। তার মত লোকেরা রত্নের কাঙাল নয়, বিপদের নেশায় পথে পথে ঘুরে বেড়ানোই তাদের জীবনের পরম আনন্দ, কুবেরের ভাণ্ডারও তাকে এক জায়গায় চিরকাল আটকে রাখতে পারতো না।

 দুঃসাহসিক ভবঘুরের উপযুক্ত সমাধি বটে। অরণ্যের

বনস্পতিদল ছায়া দেবে সমাধির ওপর। সিংহ, গরিলা, হায়েনা সজাগ রাত্রি যাপন করবে, আর সবারই ওপরে, সবাইকে ছাপিয়ে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতমালা অদূরে দাঁড়িয়ে মেঘলোকে মাথা তুলে খাড়া পাহারা রাখবে চিরযুগ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন