সাং নালিহুরী
.
নিজ নামে ডাক দিলে কেঁপে ওঠে অতলান্ত পথের গরিমা। যা কিছু জন্মে পাওয়া…যা কিছু নালিহুরী…যা কিছু নিজনাম…নিজদেশ…নিজস্ব নিয়ম…জেগে ওঠে নিজ কোলাহল।
মানুষ কেবলি হাঁটে সীমাবদ্ধ জলে। যদিও বা কেউ কেউ হেঁটে আসে গ্রিস। আরো দূর ছুঁয়ে আসে মাথুউজেলা গাছের বয়স। আমাজান হ্রদের শরীর। অতঃপর স্ট্রবেরি ক্ষেতের পাশে একটু জিরিয়ে নিয়ে যদি বা কেউ নিদ্রামগ্ন হয়, ঠিক তখনি তার নিজনামে ডেকে ওঠে কেউ।
মানুষ কেবলি ভুলে নিজ সাং, নিজস্ব আয়াত। তারপর ঘুরেফিরে পঞ্চনদী— নিজের নিকটে এসে ধরা পড়ে যথার্থ নিয়মে। আজ এ-ভোরবেলায় এ বড়ো সত্য বাণী ভাবিলো ইরমে।
আঁতুড়ভয়
.
জন্মের আগেই জন্ম হলো ভয়। তাবিজ-কবজ দিয়ে সাজানো পুলি। ভাঙা লাঙ্গল আর ছেঁড়া জাল, ধোঁয়ার কুণ্ডলী হাসে দরজার কাছে। কান্নার কাছেই ছিলো পিতার আজান।
ছিলাম পরীর ডানা কেনো পিতা ঝরালে পালক —
ভুলেও থাকিনি একা। শিশু ছিলে— টাকরা-টুকরি যদি নেয় তুলে! বটের গভীর কাছে যে শিশুরা প্রেতের দোসর, শীতের হাওর জুড়ে মক্কল আগুন— ছিলো সব নিরাপদ দূরে।
রাত হলে বুড়ো সুরে হুতুম! হুতুম!! আগুনে দিয়েছে মা শস্যদানা আর সালন হলুদ। তবু ভয় যদি পায় প্রেতিনীর ছায়া!
পূর্ণিমা উঠানে মধ্যরাতে আলো খুঁড়ে একপাল অশরীরী ভেড়া। পুবের টিনের চালে ঢিল পড়ে, গাবগাছ দোষের প্রাচীর। এই ভয় ছিলো মাগো যদি পায় অশুভ আছর! পিতার বাজার থেকে কালিবাউশ হলো না কিনা। শেওড়া গাছের ভূত যদি সাথে আসে? কাটা হলো তেঁতুলের প্রাচীন ছায়া।
কী করে ফেরাবে মা গো! নই শিশু, ঝরে গেছে পরীদের ডানা। শানেবান্ধা ক্ষত নিয়ে সপ্তডিঙ্গা নগরে ভাসে।
স্বল্প মাত্রার দীর্ঘশ্বাস
.
শৈশবে ফুটবলে হেড দেবার মতো আলোতে হেড দিলাম পড়ে গেলাম অন্ধকারে। কনি আঙুলে নাচাতে নাচাতে অন্ধকার ফেটে পড়লো নগ্ন ত্বকে। মাতৃ জরায়ুতে হেড দেবার প্রথম হাতেখড়ি।
আমার ব্যারাম হতো— নগ্ন হতাম। বাড়ির মহিলারা আমার নুনুতে খেলা করতে করতে— সোনামণি ঘুম যাও, চাঁদ মামা টিপ দেবে কপালে, জুলেখা বাদশার মেয়ে তার ভারি অহঙ্কার— কোরাস গাইতো। আমার নগ্নতা বড়ো পবিত্র ছিলো। বড়ো অবাধ্য সুন্দর ছিলো আমার পুরুষাঙ্গ।
অমোঘ বিশ্বাসে আমার বাড়তি চামড়া যেদিন কর্তন হলো— এখনো অনুভবে হাত রাখি— বুঝি না উৎসবে কী নৃশংস উল্লাস ছিলো! সেদিন রক্তকে বড়ো ভয়, বড়ো ঘৃণা, বড়ো ভালো লেগেছিলো। কিশোরীরা হাসছিলো, রক্ত ঝরছিলো আমার শরমিন্দা ত্বকে।
এখনও তো কর্তনমুক্ত রক্ত ঝরে। আমি আলোতে হেড দিতে যেয়ে পড়ে যাই অন্ধকারে। অন্ধকারে বড়ো ভয়, বড়ো আনন্দ হয়। আমি নগ্ন হই। একদিন মায়ের কাছে আমার এই নগ্নতা বড়ো পবিত্র ছিলো।
টোটকা
.
খাওয়ালো কে গো বালক— চিনিপড়া, পানপড়া? টোটকা ধরেছে বুঝি? পাকস্থলিতে জমে চুল-নখ। ভিটার গভীরে পোঁতে মাদুলি শিকড়। মনে হয় মেরেছে বাণ অলীক নগর।
এই যদি ভুল হয়— তবে কি হয়েছে চুরি আলোর লকার? নামধরা দিতে পারি। নখ দর্পণে বলা যাবে কে সে— যে নেয় প্রাণের বরজ?
উপরি-হাওয়ার দোষে যদি এই হয়— ঝাড় দেবো। ভয় নেই। জীন হলে তপ্ত তেলে ভিজাবো মরিচ। স্থির হও। নাকের ভেতর ফুঁড়ে পালাবে আছর।
তবে বলি এইবার শোনোমনো দিয়া— চুরি নয়। বাণ নয়। টোটকা উপরি-হাওয়া ভিড়েনি কাছে। সব পথ আলো নয়। বজরা বেঁধেছি মা গো অন্ধকার ঘাটে।
তুকতাক
.
একদামে কিনেছি রুপার মতো একরঙা যুবতী হাঁস। রাঙিয়ে আবীর ছেড়ে দেবো হাওর-বিলে। সঙ্গে বালা মসিবত যতো অশুভ আছর।
কালো শিঙ-মাগুরে বেঁধেছি কবজ উজান জলে। বিফলে বাঁধবো তাগা কাকপক্ষীর নখে। বৃক্ষের পাতায়।
সন্ধ্যা নির্জনে নতুন শাড়ির সুতো আর লিকলিকে চুলের গোছা চুরি করে দিতে হবে ফুঁ। তার নামে পাঠাবো চালান। তুকতাক বিরনি চাল বাটি আর ক্ষুর চালান নিমেষে উড়িয়ে দেবো সফল আশায়।
হাটবারে তেমুখো পথে ভাঙবো যুবতী হাঁড়ি, আগুনে পুড়াবো মরিচ পুরনো চালের ছন শস্যের বাকল।
এতো ইবাদত বিফলে গেলে হবো বিবস্ত্র অমাবশ্যার তুমুল রাতে। জীনদীঘি মন্থনে তুলে আনবো মূলশুদ্ধ প্রাচীন শালুক। সদ্য শ্মশানপোড়া মাথার খুলি। উপেক্ষায় মায়াবী শতেক স্বর নিঃশ্বাস বন্ধে দৌড়ে যাবো নগ্ন প্রেমিক। পেছনে তাকালে জানি করুণ মরণ।
ভয় নেই। ফেরাতে তার মুখ হবে বশীকরণের সফল প্রয়োগ।
রূপকথা
.
ঘুমের ভেতর কে পরালো স্বর্ণের অঙ্গুরি? মধুমালা! মধুমালা!! বেআকুল মদন। সজাগ কুমার তুমি অঙ্গুরি খোয়া গেছে বোয়ালের পেটে।
ছিলে তুমি কিচ্ছার না বোঝা পাঠক। এখন তোমাকে দেখি তুমি সেই হাঁস। ধুশ শালা! স্বর্ণ ডিমের খবর কেনো যে রাখো!
ঘুমের ভেতর কে পরালো স্বর্ণের অঙ্গুরি? যে পরালো সে কি তোর ডাল নুন বোঝে? ধুশ শালা! কেনো গেলি শানেবান্ধা ঘাটে!
ইরম যখন ইরমকথা কয়
আমি মণিপুরী কৃষাণীর চাষের কৌশল দেখে হেঁটে গেছি পাড়ায় পাড়ায়। আমার কবিতা তাই ফর্সা উরুতে লাগা মণিপুরী রমণীর মায়াবতী পেঁক। থকথকে লুদ।
মায়ের হাতে যে নারিকেলের পাতা ছিঁড়ে তৈরি করা শলাকার ঝাড়ু, ভাদ্রের উঠান জুড়ে গোবরের লেপামোছা— শুকাতে দেবেন ধান। সেই ঝাড়ুর আগায় লেগে থাকা গোবরের ফুল। তার স্পর্শে আমার কবিতার শব্দরাজি নতুন ধানের সাথে মায়ের নিকানো উঠানে কেবলি আজ গড়াগড়ি যায়।
প্রতি ভোরে বুবু তার স্নেহময়ী হাতে তৈরি করে গোবরের চটা। তা জ্বালিয়ে প্রতিবেলা ভাত নয় রান্না হয় আমার পদ্যের চিত্রল শরীর। আর সন্ধ্যাবেলা বাবা তার আদরের গরুগুলো যাতে শান্তিতে ঘুমায় মশা তাড়াতে তাই পঁচা খড় দিয়ে তৈরি করেন ধোঁয়ার কুণ্ডলী— এই ধোঁয়াময় স্নেহ আর অস্পষ্ট নির্ভরতা আমার কবিতা।
সেই খালপাড়। বেদেনির হাঁটা। প্রবাহিত নদী। কিশোরীর শ্যামল হাতের নানারঙা কাচ। যে বেজনী পরিয়ে দেয় একান্ত নিয়মে, বিশেষ কৌশলে— সেই কমনীয় হাতে কেঁপে কেঁপে উঠে যাওয়া কাচের ধরন, সে আমার নিজস্ব নিয়মে পাওয়া কবিতার ভাষা।
শীতরাতে নাড়ার আগুনে যে শিশু তাপায় আরাম, মাখে নির্ভরতার ওম— আমার কবিতা সেই অগ্নিময় কেঁপে ওঠা শিশুর কম্পন। অনাদরে বেড়ে ওঠা প্রকৃত জীবন। আর চা কুড়ানি শ্যামাঙ্গী মেয়ে, যে তার বেতের ঝুড়িতে ভরে জীবন সুন্দর— সে আমার শব্দকল্প ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না!
ইরম যখন ইরমকথা কয় না
.
মাঠে মাঠে হলুদ আগুন। ও রাই, তুমি আমার দেশের খবর জানো?
যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি কলার বাগান। সুপারির চারা। নারিকেলের বিনাশী সবুজ। জলপাই-কাঁঠালের ছায়াঘেরা কোনো এক আম আর জামের বাগানে যেই ভেসে আসে দোয়েলের শিস— কৃষ্ণচূড়া সেই সুখে আরো বেশি অগ্নিরাঙা হয়। জারুলের ছায়ায় যবে ডেকে ওঠে বসন্ত কোকিল, ফুটে ওঠে শিমুলের অনন্ত আগুন। উজারু লতার ফাঁকে ফুটে আছে লাজুক লতার বনেলা সুন্দর। তার পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত খাল— কখনো বা নদী—তার স্নেহময়ী লুদে এতসব পাতিহাঁস জলকেলি করে, নৃত্য করে প্রিয় তার হাঁসিনীর তরে! তাদের উচ্ছ্বাসে যেন বা ধ্বনিত হয় সন্ধ্যাকালীন ঘরে ফেরা কিশোরীর থৈ থৈ ডাক। আর মাঠভর্তি ফসলের আশ্চর্য দুলুনি— সে আমার দেশ ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না!
বটগাছের ছায়া মাথায় ধরে যে মা ছেলেকে পাঠায় দূরের নগরে, তার পাশ ঘেঁষে তুমি ফোট অনন্ত উজ্জ্বল। ও রাই, তুমি আমার মায়ের খবর জানো?
সুরের দয়াল
.
এ মনে যা কিছু কথা, সকলি গেয়ে যাবো— এরকম দিব্যি ছিল, কণ্ঠে যদি সুর খুঁজে পাই। এ গলায় আজন্ম খরা, হাতের ছোঁয়ায় বাজে না দোতারা কোনো, নিজের জবান তাই মাঝেমধ্যে পরপর লাগে।…চারপাশে সুর বাজে— বুঝি না তাদের মান কী ভাবে আগলে নিতে হয়, তবু বড়ো মন কাঁদে সুর সুর করে।
আমার মুর্শিদ নাই, নাই কোনো উস্তাদ ফকির— অবিশ্বাসে নাড়া বাঁধা হয়নি এখনো। ধার করে লেখা হল পরের পয়ার।…এসব পদের মাঝে দোতারার ভাষা আমি দেখে যেতে চাই, কিন্তু এসবের কদর আমি খুব করি নাই, যদিও ঢোলের ধ্বনি রক্তে এসে জাগায় উত্তাপ!…এ হাত মন্দিরা হলে বটের ছায়ায় বসে করা যেত তোমার কীর্তন, তোমার মায়াবী রূপ গেয়ে গেয়ে জীবন জুড়াত— কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে সুর হতো দয়ালু আমার।
পড়শিনী
.
এই যে কালিজিরার আইল দিয়ে খয়েরি বাছুরটিরে দৌড়ে নিয়ে যাও, আমি তার ঘাসফুলগুলো তুলে নিয়ে আসি। আমাদের হাঁসগুলো তোমাদের পুকুরেই থাকে। তোমাদের রাতাটিও দাপিয়ে বেড়ায় আমাদের বয়েসী উঠান। আমাদের দুধসাদা মুরগিটা মাঝেমধ্যে হয়ে যায় হাওয়া। খয়েরি বকনাটিকে গোসল করিয়ে দেই আর ভাবিজ্জতুমি আজ গোসল করতে আসবে তো শানবাঁধানো ঘাটে! তোমাদের বাইর বাড়ির বাতি আলো দিয়ে ফর্সা করে আমাদের পথ। শিস দিয়ে ফিরে আসি বাড়ি। কসম, তুমিই আমার ফিরতি বাতাস যাকে আমি বুকে ভরে রাখি।
লালখাতা
.
লালরঙ্গা খাতাগুলো একদিন ভরে যাবে তোমার হাসিতে…লাল লাল ফুুলগুলো কাগুজে হবে না আরজ্জতোমার দোপাট্টা ছিঁড়ে করে দিও রঙ্গিন ঝালর…পবিত্র এ বুস্তানিতে বেঁধে রেখো সেই সে-কিতাবজ্জযেখানে রহিবে ফুটে বিবাহ শাড়ির রঙ, রক্তজবা মনের আদর…আমি-তো যাবোই জানি তোমাকে উছিলা করে নৈঋতে উজানেজ্জতোমার দোকানে আছে কতোশতো ঋণ…কতোশতো মনোবাঞ্ছা বাকির নোটিশ…শোধ-তো হবে না জানি, তবুও আবার গিয়ে হতে চাবো কীর্তনিয়া, হতে চাবো তোমার গদিতে-বসা বাঁধালোক মাহিনা বিহীনজ্জদিও তুমি অধমেরে খাতালেখা-কাজজ্জলাল লাল খাতাগুলো সুদাসলে ভরে যাবে কীর্তনে বিলাপে…আমাকে পাঠিও তুমি বাকিপড়া দিন।
বেয়ারিং চিঠি
.
কে আর লিখবে বলো চিঠি প্রযত্নে তোমার!
আলইর দোকানে কি আজও পাওয়া যায় ভুলো না আমায়? এমন রঙ্গিন পাতা— কী করে পাঠাই আর সদ্যজাগা মন!
আজও কি কামালপুরে শব্দ ওঠে তোমার নামের? যে-পিওন দ্রুত তালে টুকে যায় কর্তব্যের ঢেউ— সে কি জানে, তোমার হাতের লেখা ঝলকে ওঠে সহসা সকালে?
ডাকঘরে বেলা যায়। বাইন্যার দোকানে কি সেই গহনা-পুস্তক আজও প্রহর ঘনায়? এতো নক্সা, এতো সোনালি চন্দন— ডাকের অপেক্ষা করে স্বর্ণের দোকানে কেনো দুপুর কাটাই!
লাইনে দাঁড়িয়ে আছি— ও পিওন, একবার নাম ধরে ডাকো, বলো ঠিকানা-সাকিন, বলো— এসেছে বেয়ারিং চিঠি! ডাকমাসুল দিতে গিয়ে জেব থেকে বের করে আনি হরিণ যুগল!
বি. দ্র : সোভিয়েত পত্রিকা কেটে যে তোমাকে করে দিতো অনিন্দ্য মলাট— তার বই কেনো আজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়!
সাধুসঙ্গ
.
কতো না সাধুর হাটে ঘুরেফিরে আজ— তোমার ঘরেতে আমি বারোমাস সাধুসঙ্গ যাচি। সেবা গ্রহণের কালে এ-দিলে নেমেছে শান্তি বারেবারে— তুমি ছাড়া কে আমাকে সাধুসঙ্গে ডাকে? কে আমাকে জলসেবা দেয় সন্ধ্যা নেমে এলে? অধিবাসে শান্ত হলে মন, তোমার নামের গীত রাত্রি ফুঁড়ে ভোর ডেকে আনে। এতো যে ভোরের টান, বাল্যসেবা, এতো যে কাতর— তোমার ছোঁয়াছে জলে স্নানসিদ্ধ হলে— পূর্ণসেবা কেনো এতো পরিতৃপ্তি আনে?
বংশের দোকান
.
দিবারাত্রি খোলা রাখি বংশের দোকান।
মুনাফা করি না কোনো, দোকানি হয়েছি শুধু তোমার করুণা পাবো, তাই এই তেজারতি, তাই এই আড়তি আমার!
এ-জীবনে হায় বাকি চাহিয়া অনেক লজ্জা জমা করিয়াছি, তবু তোমার অপেক্ষা করে আগলে রাখি বংশের গদি, ঋণের আড়ত। ফতুর হয়েছে যারা ঘুরেফিরে বাজারে-টাউনে, তাদের নিকটে গিয়ে বাড়িয়েছি আরো আরো কারবারি দেনা, ইরাদা আমার!
পাইকারিতে ধরে না মন, গোষ্ঠীপ্রীতি রক্তে মিশে রয়। শরমিন্দা এ-আমি তবুও খোলা রাখি বংশের গদি, তোমার তরিকা।
কবিবংশ
.
আদিপুস্তকোত্তর ১লা কুলজি
লিখিয়াছি কবিবংশ আদি সে-কিতাব, তবুও তো ধরে রাখি অতৃৃপ্তি অভাব। বংশ বংশ করি বেশ কেটে গেলো কাল, রক্তে জাগে সেই ভাষা যাবনী মিশাল। শ্রীকর নন্দীর বাণী দেশী ভাষা কহে, কবি শেখর এ-বংশে লৌকিক বিছারে। বঙ্গবাণী নাম ধরি আব্দুল হাকিম, ভাষাবংশে আদিগুরু আমি সে তো হীন। কী প্রকারে তার নামে প্রণামিব হায়, আতারে-পাতারে খুঁজি মনে ন জুয়ায়। সেই তো হয়েছে শুরু আমাদের দিন, ভুসুকুপা তস্য গুরু বাঙ্গালী প্রাচীন। আরো এক বংশবাতি সগীরের নামে, বৃন্দাবন দাস নমি চৈতন্য প্রচারে। বড়ুচণ্ডীদাস ভনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মুকুন্দ রামের নামে পরাই চন্দন। রামাই পণ্ডিত রচে পাঁচালি সঙ্গীত, প্রভুর চরণে মজে নিজ মত্ত চিত। সেই যে বাঁধিল গীত কানা হরিদত্ত, এ-মূর্খ রচিবে কী যে ভবেতে প্রমত্ত। বিজয় গুপ্তের নামে বংশবাতি পায়, ইরম মাগিছে দয়া বংশগরিমায়।
পরিশিষ্ট প্রণাম : প্রণামে-সুনামে গড়ি শব্দ-বাক্য-মিথ, পয়ারে-খেয়ালে শুধু গাই বংশগীত। অন্ধকার যুগে বাঁধি গয়েবি কামোদ, পটমঞ্জরীতে সঁপি সেই সুদবোধ। আমি যে বাঁধিবো তাল কুলিন রাগিনী, ভূর্জপত্রে নতজানু দয়া কী মাগিনী! তুমি কন্যা বেঁধো সুর মর্জি যদি হয়, এই বংশে জেগে থাকে চর্যাবিনিশ্চয়।
কবিবংশ
.
২য় ও সর্বশেষ কুলজি
সেই কবে ভাববশে ভুলিয়াছি ধাম, বিপ্রদাশ পিপিলাই ধরিয়াছি নাম। জয়দেব হয়ে রচি গোবিন্দের গীত, ছিটিয়েছি পুষ্পঢেউ কামের কিরিচ। রচিয়াছি চম্পূকাব্য কোনো এক কালে, বন্দনা করেছি কতো আনে আর বানে। আমিও শ্রীহট্টে জন্মে রাধারূপ ধরি, কবেই ছেড়েছি বাড়ি শব্দ শব্দ জপি। জৈন্তা পাহাড়ে ইরম দেখিয়াছি রূপ, বামেতে বন্ধুবাড়ি ডানেতে অসুখ। তবুও আলোর ডাক তবুও স্বপন, শ্রীহট্টে জন্মিয়া ভ্রমি বিস্তীর্ণ ভুবন। রচিতে প্রেমের শ্লোক তুচ্ছ করি কাম, বলেছি সহস্র বার নারীকে প্রণাম। জমিয়েছি দূরবাসে একজন্ম ঋণ, অকূল পাথারে ভাসি দলহারা মীন। সন্ধ্যাভাষা ভুলি নাই গুহ্য অন্তমিল, আমারও রক্তে ছোটে চর্যার হরিণ।
মোনাজাত : তুমি পুত্র কবিবংশের লোক…ধরিও বংশের খুঁটি— জন্মভিটা যেন আর না থাকে বিরান। তোমার তরিকা যেন সত্য হয় প্রেম— দ্বিধাহীন করে যেও বংশের বয়ান…পুত্র তুমি, পিতা তুমি, তুমি বংশের মান— তোমাকে স্বাগত বলি, জানাই সেলাম!
বন্দনা
.
প্রথমে বন্দনা করি গ্রাম নালিহুরী। ছাড়িয়াছি তার মায়া যেন কাটাঘুড়ি ॥ পরেতে বন্দনা করি আকাশ পাতাল। পিতামাতা দেশ ছাড়া হয়েছি মাতাল ॥ পুবেতে বন্দনা করি নাম তার মনু। এমনি নদীর রূপ উছলে ওঠা তনু ॥ উত্তরে বন্দনা করি শ্রীহট্ট নগর। সে তো থাকে মন মাঝে অনন্ত অনড় ॥ পশ্চিমে বন্দনা করি লেখাবিল নাম। এ-জীবন তার তরে তুলেছি নিলাম ॥ দক্ষিণে বন্দনা করি নাম শ্রীমঙ্গল। দেখিয়াছি টিলারূপ কুহকী জঙ্গল ॥ মৌলভীবাজার-কথা কী কহিবো আর। সে তো জানি প্রাণসখা বন্দনা অপার ॥ চারদিক বন্দি শেষে মন করি স্থির। ধরিয়াছে এই দেহ দেশের জিকির ॥ বন্দনা করিয়া সারা মধ্যে করি ভর। আসো গো কবির সখা বৈদেশ নগর ॥ ভিনবাসে ঘুরিফিরি তিষ্ঠ ক্ষণকাল। পয়ারে মজেছে মন বাসনা বেহাল ॥ পদ্য বাঁধি গদ্য বাঁধি সুরকানা আমি। ইরম হয়েছে ফানা জানে অন্তর্যামী ॥
ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ
.
তুমি কোন মুল্লুকের মৌলভী গো? তোমার আলখাল্লায় লেগে আছে সিঁদুরের দাগ, তোমার সফেদ পাঞ্জাবীতে ধূপধুনি আতরের ঘ্রাণ, তোমার গলায় ওঠে কীর্তন জিকির, তুমিও পীরের দেশে পীর হয়ে কাটিয়েছো দিন, তুমিও বৈষ্ণব হয়ে বৈষ্ণবীর খুঁজে গাঁয়ে গাঁয়ে গেয়ে গেছো বেদনার গীত, তুমি দেখি ধরে আছো নানা কিসিমের বেশ, নানা উপাধি, তুমি কি গো এই গাঁয়ে পরদেশী পীর? পরদেশী সন্নাসী ফকির? তোমার দোতারা কার ইবাদতি করে গো হযরত? তোমার তসবিদানা কোন মন্ত্র জপে? মন্দির মসজিদে তুমি করো যাতায়াত, আজান ও উলুধ্বনি একি কণ্ঠে ধরো, এ কোন দেশের মুসল্লি গো তুমি? তোমার দেশের নদী ধরে বুঝি আল্লার জিকির, ধরে বুঝি দেবতার স্তুতি?
তোমাকে দেখেই আমি বুঝে গেছি—এ এক এমনি দেশ, এমনি তার রীতি, একই নদী ভরে ওঠে পানি ও জলেতে, এক জলসা রাঙ্গা হয় আদাবে সালামে!
রোল কল
.
: মুজিব ইরম? : উপস্থিত!
কে আমারে ডাক পাড়ে, কে আমারে নাম ধরে রোল কল করে? আমি তো পরীক্ষা ফেল, লাস্টবেঞ্চ, দেরি করা লোক…রেজিস্টারে কাটা নাম কেনো তবে বারবার উচ্চারিত হয়, কেনো তবে বারবার মনে পড়ে রোল নং, অস্তিত্ব আমার! এত যে তুলেছি হাত, দূর থেকে, এত যে বাড়াই গলা— আছি, তুমি কি শুনিতে পাও ওহে শিক্ষিকা আমার?
আমি তো আউট পড়া লোক, সেই কবে রোল নং ভুল করিয়াছি, হাজিরা খাতার নাম ভুল করিয়াছি।
জাতক
.
কতো না ঘুরেছি পথ ছদ্মবেশে, দেশে দেশে, নগরে নগরে…এই ভেক, এই মিছা আবরণ খুলে ফেলো…এই নামে ডাকো তুমি ডাকিবার ইচ্ছা যদি হয়…তুমি তো ডেকেছো কতো মায়াময় নামে…কতো রূপে হয়েছি হাজির…কতো নামে সাড়া দিতে হয়েছি অধীর…আমাকেও ডাকো তুমি নকলী অভিধায়…মনে লজ্জা পাই…আমাকেও দেখে কেউ বাস করি বৈদেশ নগর…আমাকেও দেয় খোঁটা— সোনা ছেড়ে খাদ বাছি, ছেড়ে আসি বাস্তুভিটা, ছেড়ে আসি ঘর…এত এত ডাকনাম, এত এত রূপে ডাকাডাকি…ইতা আমি লিখে রাখি তেমনি আবার— আর কোনো নাম নাই লেখা এই বুকে, আমিও সিলট্যা লোক জানে সর্বলোকে!
কীর্তনিয়া
.
মিনতি রাখো গো তুমি, আমারেও নিও তোমার কীর্তনিয়ার দলে…তুমি ছাড়া কে আর বুঝবে বলো অধমের মন…ভাঙ্গাচোরা তাল, ভাঙ্গা গলা, ভাঙ্গা গীতি, সুরকানার কদর…তোমার বাজুতে শুধু দিনমান রেখো তুমি…বিবাগী মন্দিরা হয়ে তোমার দেহেতে আমি মিশে যেতে চাই গো অধম ভেকের ফকির…শুধু তোমার দলের গুণে যদি মায়া পাই…যদি লোকে বলে আমিও সুরের লোক, কীর্তনিয়া, তোমার ছায়ায়…এই ভাবে তোমার চরণ পাশে, দেহতলে, মাটিতে লুটাবো মন ঘরকানা এই ছদ্ম কবিয়াল…আমাকে রাখো গো তুমি সুরের দয়ায়।
বৈদেশী
.
হঠাৎ টুটেছে নিদ্রা রাত্রি কতো দূর, নিজেই পেঁতেছি ফাঁদ নিজেই বিভোর। যদি না কপাল ফাটা রেজারতি রয়, নিজ দেশ রাখি বুঝি পরদেশী হয়! পরবাসী পরবাসী কান্দে তনুমন, হেলায় ভুলেছো পথ কহে গুরুজন। এমত বংশের লোক ডেকে কয় ওরে, ‘যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে’! আমি কী ফিরিবো আর নাই কোনো পথ, উজাইয়ের মাছ আমি পুষেছি অপথ!
কুক্ষণে ধরেছি মায়া বিদেশ বিভ্রম, পয়ার প্রবন্ধ রচে মুজিব ইরম।
আমার নাম মুজিব ইরম
আমি একটি ছবি বলবো
.
শুকিয়েছে জল। হাওরের তল। পানাদের দল। ঘাসের মহল। খালে খালে হিম। বেদনা অসীম। কাকচক্ষু জল। ফর্সা করা তল। ভাঙ্গাচুরা নাও। পড়ে আছে তাও। পাখি দুই বক। কাদা থকথক। ধরে খায় মাছ। দূরে এক গাছ। বসে দুই পাখি। মেলে ধরে আঁখি। দেখে খলখল। মাছ চলাচল। চায় নিতে শোধ। মিঠামিঠা রোদ। গায়ে মাখে চাষি। শীত অবিনাশী। খালবিলে ধান। মুখে তার গান। এই ছবি আঁকি। রোদ দেয় ফাঁকি। জানাশোনা কম। এঁকেছি ইরম।
লীলাসূত্র
.
শব্দ বড়ো যাদু জানে যাদু জানে গো!
দিবস-রজনী আমি ফানা হয়ে থাকি। আসবে বলে আমার কুঞ্জে কান্না ফেরি করি। নৌকাবিলাসে হঠাৎ মত্ত হয়ে দেখি, বিরহে কেটেছে দিন শব্দ শব্দ জপি! আর কি হবে না নদী জলে টলমল? আর কি হবে না লীলা বন্ধু-সহচর? তাহাকে দেখিতে মন রজনী পোহায়, না-জানি কার কুঞ্জে থেকে আমাকে কাঁদায়!
তোমাকেই নিত্য জপে নির্ধনিয়ার ধন, ইরম করিছে সঙ্গি রজনী-রোদন।
সাং নালিহুরী
.
আদি গ্রন্থ থেকে ঝরে পড়া ২য় অংশ
শুরুতেই বলি, বিশ্বাস করুন, যা লিখেছি তা কোনো না কোনো ভাবে মুদ্রিত হয়েছে আমারই জন্মে-পাওয়া গ্রামে।
এই যে সাকিন, পরে আছি অস্থায়ী নিবাস, খোদার দোহাই, বিশ্বাস করুন, তা ভুল করে মুদ্রিত হয়েছে আমার গতরে। আমি তো একটা নামই মুখস্ত করি, বর্ণনা করি তার অসীম মাহাত্ম্য।
বিশ্বাস করুন আর নাই বা করুন, এ ইরম নালিহুরী ছাড়া আর যায়নি কোথাও কোনো কাল।