ডাল্টন সৌভাত হীরা জন্ম ২৫ জানুয়ারি, গোপালগঞ্জ। পড়াশোনা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর। পেশা : শিক্ষকতা ও গবেষণা। |
আব্বা
আমার আব্বা শেষ রাতে মারা যান,
মরণ শোকর জমা রেখে ধলসায়।
ধলসার কালে গাঙ আসমান ফের,
পয়গাম-ব্যথা পেয়ে কাঁদে মোনাজাতে।
আমার আব্বা শেষ রাতে মারা যান,
ব্রাহ্মী লতারা খবর পেয়েছে তার?
গুমট কান্না মক্তবে জমা দিয়ে—
কবরে কবরে বুনেছি লতানো ঘাস।
খবর পেয়েছ অঘা সর্দার তুমি?
ফেরত দিয়ো না বেতনীতে মোড়া ঢাল!
আব্বা জেনেছে সেইখানে নাই বাঁশ
আর বেতে মোড়া বিকট কাইজা কোনো।
গেরস্ত বউ ফিরেত আসে না নয়া
প্রেমিকের কাছে। সব শুধু চলে যায়।
আমার আব্বা শেষ রাতে মারা যান
ঝুল বারান্দা, তিন তালা ঘর সব
এক সাথে কাঁদে, পাখালের মতো ধীর
পাখনায় বলে, তুমি এথা চলে আস।
“এখানে সবাই পাখির ডানায় পাখির
মতো ওড়ে;
এখানে সবাই, বাসন্তী পূজা ,ঢাকের বেদনায়
বিসর্জনের মন্ত্র জপে মিশে যায়
আলেয়ায়।”
আমার আব্বা শেষ রাতে মারা যান
কালো নৌকায় শেষ রাত আসে গ্রামে
চলুন চলুন, দেরি হয়ে গেল, বেশ।
দেরি ও দেরিতে,কালো কব্বর তাই
আব্বাকে নিয়া, দুরের মোকামে যায়।
ঘুঙুর
তুমি আর বেজো না ঘুঙুর।
সবশান্ত বাইজির বেণিতে মাখানো আতর
আর দৌড় ঝাপানো পুষ্পগন্ধ্যা;
বাবুদের হাত জুড়ে ডাগর-ডাগর প্রেম!
তার মতো তুমি বেজো না ঘুঙুর!
চিনে রেখেছি শহরের ছোট ছোট গলির
মতো, গলির গায়ে পশলা ক্ষতর মতো দুঃখসমূহ।
মনে রেখো, দুঃখ ফেরি করা আমিও মুহাজির এক। সীমার হতে রাজি সামান্য সীমানার তরে!
তুমি আর দুঃখের মতো করে, একটু একটু বেজো
না ঘুঙুর!
আজ আমি আমার সুখ বদলিতে তোমাকে বাজাব।
নরম গোলাপ জলে, আলভরা ডাগর বাবুর
কোঁখে—
তুমি আর বেজো না ঘুঙুর।
এসো, আফলা ক্ষেতের প্রথম শস্যের মতো
তোমাকে বাজাই।
আমি আজ দারুণ এক ওস্তাগর হয়েছি।
চুল থেকে, নখ থেকে মুখ থেকে বিরহ নিয়ে
বানিয়েছি বিষণ্ন সেতার একট! বিষাদী আচকানে রেখেছি ভাঁজ; সেখানে নাচবে
বয়স্ক মোহিনী বাই, তুহশারি তালে।
তোমাকে বাজাব বলে ঘুঙুর, তোমাকে
সাজাব বলে ঘুঙুর
আজ আমি বাইজির পায়ের তলে হয়েছি
পাথুরে মেঝে।
তোমাকে বাজাব বলে ঘুঙুর; প্রেয়সীর
পায়ের তলে আমিও গেরস্ত শস্যক্ষেত।
সৎকার
যেখানে আমার চিতা হবে, তার পাশে যেন থাকে একটা মহানিমের গাছ। মহানিম পাতাগুলো পালক খসা পাখির মতো একটু করে খালের জলে গিয়ে পড়ে। তারপরে একটু সাঁতরায়। যেন জল ছলকে ভিজিয়ে দিতে পারে আমার নাম লেখা ফলক। তাতে আমার চান করা হয়ে যাবে প্রতিদিন। চিতার পাশে একটু বাড়ন্ত বনজ থাকলে ভালো হয়। তাতে ছায়া হবে। শীতের দিনে ঠিক পশমের মতো টেনে নেব ওমে।
আমার মা যখন ঘোর প্রদীপে সন্ধ্যা দিতে আসবেন
সমাধিতে তখন যেন পুত্রস্নেহে মহানিমের দিকে
একবার, আরেকবার তাকান। মা, অনেক শক্ত মনের মানুষ; উনি ঠিক পুজো টুজো দিয়ে যাবেন। হয়তো একটু কাঁদবেন, তারপর, ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে কান্না থামাবার! তবে কোনো ঘুণাক্ষরে ঢাকা থেকে আমার কবি বন্ধুরা সেখানে গেলে, আমাকে একটু কবিতা শোনাবেন দয়া করে। মহানিমের একঘেয়ে কবিতা শুনে বড় বীতশ্রদ্ধ আমি। আর কবিদের নতুন চুলোচুলির কেচ্ছা শুনতেও ভালো লাগবে। জানেন তো, ওখানে পেপারে গসিপ আর্টিকেল থাকে না।
আর পারলে না দেখার
ভান করে একটু নিভিয়ে
দেবেন চিতার
আগুন।
গোপালগঞ্জ
ওখানে আমার আড়ে কেউ নাই।
যারা ছিল, চলে গেছে গোরে, কাতরানিতে।
আমাদের ঝুল বারান্দায়ালা ঘর।
সেইখানে তপড়ানো কই মাছের মতো আমি।
আমি, আমি, আমি; মধুমতির ঢেউয়ের পরে
ছোটখাল, আর কচ্ছপের ডিমের মতো শাদা, শাদা
ছোট ,ছোট আমি।
বাঁশের কা’লিতে ঢোড়া ধাঙ্গর সর্দার!
বেতনীর ঢালে তবু অজস্র পাওনা।
সেইসব পাওনা পেয়ে পোষা, পোষা, গেরস্ত মতন
আমি।
আমি এখন বাচাড়ির সর্দার।
কালো ধবল আন্ধারে হ্যাচাক হাতে
করে আসে আয়েতালি দারোগা।
কিংবা মধুমতি গাঙে পোষা জলের ডাকাত।
ডাল্টন মরে যাও
ডাল্টন মরে যাও্; এক্ষণি মরো ওস্তাদ!
এখনো মরো নি? বাঁচছ কেন বলো?
মরে গেছে সব জগডুমুর; সন্ত
হয়ে মরেছে সে শেয়াল, কালান্তক
যক্ষায়। আহত নিঃশ্বাস ধার করে
সঙ্গমে শুয়েছে ময়ূর; শুধু পাও নি
তুমি কিছু শেষে! কাষ্ঠল গুনে গুনে
মরেছ; আবার মরো। নীল চোখা সে
সাপেরা মরণ শেখাক বন্দরে এসে।
ডাল্টন মরে যাও, স্বাদী জগডুমুর!
মৃত্যুর চে দীর্ঘ কোনো চোখ নেই যে!
জেনেছে তা আগে দীর্ঘাক্ষর মদিরা।
ব্যাধী
এই বনভূমে অধিকার তোমার;
নৈধরা ও ব্যাধ, ও ব্যাধ!
বদলি বেদনার চৌফাঁটা, চোরাকাঁটা; পায়ে
পায়ে, মনে মনে
ফুটে আমাকে বানিয়েছে বনভূম! সেইখানে তোমারে
অধিকার দিলাম।
নিকেশ মনে শিকার কর, শিকার কর এইবার।
চৌকস আলোর মতো আহলাদি হয়ে মেরে ফেল, মেরে
ফেল হরিদ্রা হরিণী শাবক।
নিধার ও ব্যাধ! ও ব্যাধ! এই
বনভূমে তব অধিকার।
আমিতো মুনিই বটে! সন্তের মতো সান্ত্বনা খুঁজে খুঁজে
হয়রান। আমাকে নিজহাতে বাঁধ বনভূমে। তারপর বিঁধে মার ত্রিফলা চতক।
আমিওতো চাতকীনি, তীরে বেঁধা সেই।
বাড়ি
মানুষ বাড়ি খোঁজে; আমি বাড়ি ছেড়ে পালাই। মনে
হয় কার্সড প্রাচীন ইহুদীর মতো ঘুরঘুর করতে হবে
পৃথিবীর বিভিন্ন পাড়া। কিন্তু নিঃশ্বাসের সহবাসে আমি বাড়ি ফিরতে চাই। আমাদের শহরের
য়্যংলো পাড়ার এক বুড়ো সারাজীবন রয়ে গেলো
বাড়িতে। বলত, ‘দ্যাটস জেসাস হোম’; তখন সমস্ত
নমঃশুদ্র কালো কালো চাষা দেশ ছাড়ে। কেন ছাড়ে?
তাহদের কি যীশু নাই?
সাহেব বলেন, ‘দৌড়ান। আয়্যাম কার্সড। জেসাস! ইজন্ট দ্যাট মাই হোম?
আমি দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফাই। বলি, ‘বাড়ি
ফিরতে চাই। বাড়ি চিনতে চাই।’
সুখলেখা দাস
কেউতো ভাঙেনি রোজা, এখনো এখনো
কিন্তু তার আগে ভেঙে গেছে এক নদী।
ঘাসের চিকন ফুল,কালো জল মেখে
চলে গেছে এক নারী,আযানের মতো
করুণ,আরো করুণ সুর হয়ে নায়ে।
দুরের সে গঞ্জ থেকে আসে সদাগর
কেনে হাঁসের নোলক,ও পুঁথির শোলক।
নগদ মুল্যেই কেনে দরুদ বাতাস।
কেনে
অচেনা রোজার দিনে, সুখলেখা দাস।
তোমাদের জন্য অভিশাপ
আমার কান্নাকে যারা বোঝেনি, ভেবেছে
এ ভীষণ অট্টহাস্য; বিউগল য্যানো
মাংস খুবলে-খাওয়া পচিত কুষ্ঠ রোগ....
তাদের জন্যই করুণা করি,প্রিয়তম
বলি তাদের হাতে ও পায়ে কুষ্ঠ হোক
শিরা ও স্নায়ু ফেটে কান্না আসুক
রোম, ও আয়তন নিচু-গ্রামে কাঁদুক
কাঁদতে কাঁদতে অগ্রিম ভাঁড়ের মতো
তোমাদের লোক হাসানোর অভিশাপ
দিলাম...তোমরা অট্টহাস্যে ক্রন্দনা হও।
আমি বিউগল বাজাবো ও কান্না শুনব
তোমাদের জন্য অভিশাপ! প্রিয়তম।