হিজল জোবায়ের এর কবিতা


বিটাধারী
কথা কও, শব্দে আইসো
বিটাধারী অয়ি অধ্বনিন
জন্মেও নড়ে না যা— ডিম
কথা কও, শব্দে আইসো
শনৈঃ শনৈঃ ঐ—
বেগে বাড়ে নদী
জন্মেও নড়ে না যা— ডিম
জল ছিল মাতা আর
তুমি ছিলে ধ্যানরত প্রলয়ের জলে সমাসীন
আমার শরীরে যদি এতোকাল থেকেছো শায়িত
তোমার সমাধি আমি—
এসেছি সেখান থেকে ছিলাম না যেখানে কখনো
অথচ সেখানে আজও আমাকেই পাবে বর্তমান
আলোর অনেক দাগ তারও নিচে ঘন অন্ধকার
আলোর ওপরে আলো ক্রমাগত করে আরোহণ
সমাহিত হলে ধ্যানী, ধ্যানরত শরীরে আমার
সবুজ তুঁতের গাছ, পোকা খায় পাতার শরীর
ঘাস ওড়ে, পাতা ওড়ে
মাটিতে যাচ্ছে ঢুকে ঘাসের শিকড়
ঐরাবতের শুঁড়ে
ভর করে যায় উড়ে
মনোবিকলন আ রে মনোবিকলকন
গোধুমে গোধিকা চলে
উঁকি মারে ঘড়িয়ালে
গোচরীভূত
আমারও তো জিগমিষা
কুয়াশায় ভাসা ভাসা
অবিকশিত
আর আমি তোমাকে এবার বিদায় জানাতে চাই।
ঝরা পাতায় মোচড়াচ্ছে মৃত্যুকাতর খরিশের লেজ।
আমাদের মাঝখানে নদীর প্রস্থ মেলে ধরা
মেছোগন্ধ, জলজ বাতাস
ডিমভর্তি পেট নিয়ে  লাফাচ্ছে—
শৈবালে ছাওয়া অন্ধ সবুজ মাছ
ডিম্বিনী মা, পোনাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘জল’ নামক অপর মায়ের কাছে
জল ছিল মাতা আ রে
তুমি ছিলে বিটাধারী
অয়ি অধ্বনিন
জন্মেও নড়িলো না ডিম
কথা কও, শব্দে আইসো


উত্তরায়ণ
স্তূপীকৃত লাল বারুদের অঞ্চল
পার হয়ে এলে অগ্নিগর্ভ কুয়া,
অনাবৃষ্টির মাঠজুড়ে বায়ুকল—
বৃথাই ঘুরছে প্রান্তর-পোড়া রোদে
অর্ধেক গৃহী অর্ধেক যাযাবর
দুইভাগ ঋতু অতীত-বর্তমান
পাথরের নিচে চাপানো গণকবর
মরে ঘাস বিনা সালোকসংশ্লেষণে
সূর্যের আলো রজ্জুর মতো করে—
পাথর খামচে ধরেছে পূর্বাপর,
উত্তাপে কতো করতল গ’লে পড়ে
অর্ধেক গৃহী অর্ধেক যাযাবর
কর্কটরেখা অভিমুখী মেঘে মেঘে—
উত্তরায়ণ, সূর্যের ঢলে পড়া,
মাটি সরে গ্যাছে পাহাড়ের নিচ থেকে
ধোপাখানা থেকে অনুচ্চে ডাকে কারা—
মদে ঢুলুঢুলু অর্শরোগীরা গিয়ে
গোল হয়ে বসে অশ্বত্থের নিচে
তর্কশাস্ত্র বিষয়ক কথকতা,
রাত বেড়ে ওঠে কুয়াশায় ভিজে ভিজে
মগডালে-বাসা-নিশাচর-পাখালির—
নির্দোষ ডিম পাথরে আছড়ে পড়ে,
প্রতিহননের মহামারী ভর করে
অর্ধেক গৃহী অর্ধেক যাযাবরে
নদীহত্যার যুগ পার হয়ে দূরে
টায়ার পোড়ানো লাল-ব্রিজ পিছে ফেলে
আফিম-ভর্তি ট্রাক চলে গ্যাছে ঠিকই
বর্ডার-ঘেঁষা চামড়ার বন্দরে
রাত বাড়ে আর আলোচনা বেড়ে চলে
দুঃস্বপ্নের পবিত্রতাকে ঘিরে;
হালাল-সাবান-ফ্যাক্টরি নির্গত
সাবানের ফেনা বাতাসে বাতাসে ওড়ে—
ভোর ফোটে আর রাত শেষ হয় ভোরে
ফাটে বুদ্বুদ নির্বাক চিৎকারে
বুদ্বুদ-ফাটা-শব্দটি ছিল সুর
বর্ণিল হয়ে ফেটে পড়বার আগে
বধির শুনেছে, গেয়ে শুনিয়েছে মূক
কানারাই ছিল দলের অগ্রভাগে


দুলছিল নৌকা বস্তুত নিশ্চল
কাঁপছে নদীর জল
দুলছিল নৌকা
বস্তুত নিশ্চল।
নৌকা-বোঝাই ফুল,
একপাশে মশলা;
আর ছিল চুপচাপ ভারবাহী গর্দভ।
গর্ভ থেকেই তো আমরা পরস্পর
বাক্যবিহীন, মূক!
ঢেউ আসে ঢেউ যায়
শূন্যে সে জন্মায়
শূন্যে মরণ হয়
এই মরা সন্ধ্যায়
পাক খেয়ে বিস্তর পরচুলা উড়ছে;
জ্বলছে বনান্তে ফসফরাসের ফুল
নাম জানা নাই তার;
আমরা পরস্পর জন্ম থেকেই মূক।
রাত্রিও নিশ্চুপ।
বাদবাকি আর-সব স্বেচ্ছা-সমর্পণ
কেন্দ্রাভিমুখ; সেই ফুল ঘিরে দীর্ঘ
সেজদাতে মগ্ন!
লাশ ভেসে যায় লাশ
ঘাস, পাতা, নিঃশ্বাস
কাঁপছে নদীর জল
দুলছিল নৌকা
বস্তুত নিশ্চল।

রাস্তাফারি
উলঙ্গ এক শ্বেতাঙ্গ এক
বারবারিয়ান, গাইতেছে গান
রাস্তাফারি রাস্তাফারি
স্ট্রবেরি ফল স্ট্রবেরি ফল
আয় জিহোভার জিভের আগায়,
অর্কিডের এক বন জেগেছে
ইথিওপিয়ায় ইথিওপিয়ায়
উলঙ্গ এক শ্বেতাঙ্গিনী
কৃষ্ণে মাতেন বনমালিনী
রাস্তাফারি রাস্তাফারি
গমের দানা ধুম তা না না
সাঁইজি আমার মন মানে না
পোড়াজমিন বাড়ির পাশে
ছোট্ট দেওরা হাল জুইড়াছে
রাস্তাফারি রাস্তাফারি
ও নওফিয়া বাতিল জমি
কেসুর খুঁড়ে আনবো আমি
আমার ভেড়া দেইখা রাখো
রাস্তাফারি রাস্তাফারি
শ্বেতাঙ্গিনী ও বোষ্টমি
একতারাতে কৃষ্ণ নমিঃ
পায়ে করো রাস্তা ফেরি
গাইতেছো গান গুরুর বাখান
রাস্তাফারি রাস্তাফারি


বউ কথা কও
হলুদ পাখি
বউ কথা কও
ডাকে।
কাকে?
রোদগলা এই
অথৈ দুপুর,
গমকভর্তি
কান্নার সুর
যেই শুনেছে
তাকে।
থোকায় থোকায়
ঝোলে নিমফল
ঘোড়ানিম গাছ
দোলে নিমফল
করাতি কাট
কাঠ পাবি কাঠ
ঘোড়ানিম গাছ-
টাকে।
বউ কথা কও
ডাকে।
বিশাল আকাশ
একটু দেখায়
পাতার ফাঁকে
ফাঁকে।
মরা খালের
ঘোলা পানি
সাঁকোর ছায়া
দোলা পানি
ঢোলকলমির—
ঝোপের আড়ায়
শুকনা মরা
ঢোঁড়া সাপের
খোলস উড়তে
থাকে।
ইতল বিতল
বাতাস উতল
ছাইয়ে মাজা
কাঁসা পিতল
থালা বাটি
উঠান-জোড়া
অমনি পড়ে
থাকে।
বউ কথা কও
ডাকে।


অসুখ
শল্যবিদের হাতে তোমার গর্ভফুলের ভার
তুলে দিলাম পেটেই-মরা নষ্ট-ছেলেটাকে
হিসাব-মতে হেকিমখানার নির্জলা ঔষুধে
জহরতের বিষ মেশালাম কালো গাইয়ের দুধে
সর পড়েছে দুধটুকু খাও কানা বিলাই ও রে
আম্মা খোঁজে কুমারী মেয়ে শহরে-বন্দরে
ও বড়বউ বাদ্য বাজে ঢোল-সানাইয়ের সুর
কচি কলাগাছ কাটে কেউ অজন্মার দুপুর
তিনচালা এই ভিটার পিছেই ছাইয়ের নিচে চাপা
দিবো তোকে সঙ্গে ছেলে না-কাটা তোর ফুল
গোবর ফুঁড়ে পদ্ম জাগে চম্পা ও সাত ভাই
চারকোণা ঝরকাতে বসে ডাকতেছে বিলাই
সর পড়েছে দুধটুকু খাও কানা বিলাই ও রে


সমর
ধানের মঞ্জুরি আর ঠাণ্ডা বাতাসভর্তি এক ঋতুতে—
আমরা শুরু করেছিলাম,
আমরা আমাদের সবচেয়ে বলবান পশুর রক্ত উৎসর্গ করেছি
পবিত্র পাথরের উদ্দেশ্যে।
তুমি এলেই তবু এতোটা জলোচ্ছ্বাস,
তোমাকে অনুসরণ করেই আসে ঘূর্ণি
কালো কৌপীন ফুলে এলোমেলো বাতাস!
বাগানে প্লবগ, এঁটো কলা; প্লেগের প্রাদুর্ভাব
কুমারপাড়ার উপরে জ্বলছে পোড়ানো মাটির চাঁদ
ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ধানক্ষেত চিরে ছুটে গ্যাছে নীলগাই
তাকে আমি হত্যা করিনি।
অবধ্য সে।
আমার অবাধ্য হাত,
সমরসজ্জার শরীর ফিরিয়ে নিয়েছি কতোবার;
নীরবতায় আমি করেছি আমার সীমানা নির্ধারণ


এপিটাফ
আমাকে পাবে না পশ্চাৎপদতায়—
বুলেটে বিদ্ধ করেছি আমরা ঘাস-কাটা খরগোশ
সবুজ ঘাস-কাটা খরগোশ
দূরে— সরোবরে
আলো কাঁপছিল অনুকম্পার মতো
লালে লেপটানো আয়তক্ষেত্র
আশৈশবের মাঠে
শশক লাফায় সবুজ ঘাসের ভিড়ে
আমরা করেছি বুলেটে বিদ্ধ ঘাস-কাটা খরগোশ
অবাক পূর্ণিমাতে
লাশ উড়ে যায় কফিনের ডালা খুলে
অবাক পূর্ণিমাতে
জোছনায় জ্বলে জ্বলে,
তোমার রক্ত আরও উজ্জ্বল
আরও পবিত্র হবে
আমরা করেছি বুলেটে বিদ্ধ ঘাস-কাটা খরগোশ
মৃত্যুর হাতে তুলে দেয়া হলো অনেক জীবন
শত ভাই-বোন;
তবু তো মৃত্যু লোকালয়ে আসা ছাড়েনি
পরিসমাপ্তিহীন—
শোকতপ্তরা ভিড় জমিয়েছে বেওয়ারিশ লাশ ঘিরে
তোমার জন্য ভালোবাসা,
তাদের জন্য—
যারা ফিরিয়েছ মুখ
একে অপরের থেকে
আমিই তোমার মৃত্যুদিনের প্রথম আহাজারি
কোনো একদিন একটা সফেদ পাখি
আকাশে উড়তে উড়তে উড়তে
নীলরঙা হয়ে গেলো
বিষে নীল হয়ে গেলো
আমরা করেছি বুলেটে বিদ্ধ ঘাস-কাটা খরগোশ
অবাক পূর্ণিমাতে
চণ্ডাল বোনে পাখির পালকে
উষ্ণ উত্তরীয়
অবাক পূর্ণিমাতে
পিতলের পাতে মোড়া গম্বুজ থেকে
ছিটকে বেরনো আলো মিশে গেলো
আকাশের নাভিমূলে
মানুষ ডুবছে, মানুষই ডুবছে পাথরের দেয়ালে
পাথরে পাথরে রচিত হচ্ছে পাহাড়ের এপিটাফ


বিষদাঁত
উড়ে যায় মাঠ-পোড়া প্রান্তরের ঘাস
ধূমল বাতাসে ভাসা তীব্র হরিয়াল;
শ্রান্ত, আনত ঘোড়ার মতন আকাশ—
থেকে নামো, হে মন্থর সোনালী বিকাল
গভীর বনের পথে দ্বিধাতে আড়াল—
অদেখার সাথে দেখা হলো অনায়াস,
কিছু কথা, নীরবতা, বাকিটা খেয়াল
ঝিম-ধরা, স্বর-ভাঙা পাখির কোরাস
গারো পাহাড়ের খরা-কবলিত গ্রামে
আমার বিপন্ন মুখ হলুদ পাতায়—
ছেয়ে গেছে; অস্তরাগ— সন্ধ্যা নামে ক্রমে
আগুন জ্বালিয়ে যায় নিদাঘ চিতায়
বিষ-মোক্ষণের দিনে— বাতাসে বেহাগ
হারিয়েছি বিষদাঁত, ছোবলের দাগ।


লীলা
সূর্যগলা অপরাহ্ণের নদী—
তাকিয়ে দেখলে ঢেউ
সূর্য ডুবলো আর—
এখন জাগছে চাঁদ
ঘাসের ভিতরে জোড়াসাপ লীলায় মেতেছে।
একদিন তুমি, তরঙ্গায়িত শস্যক্ষেতের হাওয়া-বাতাসে পুষ্ট, ব্যাধি ও জরায় উপনীত। জোড়াসাপ তোমার গর্ভমূল বেড়িয়ে শুয়ে থাকা। তুমি বসে আছো কুণ্ডলী পাকানো বাতাসের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ, পরিচর্যাহীন ক্যাকটাসের মতন বিদীর্ণ।
অতীতকে তুমি ফেলে এসেছো,
আর ভবিষ্যৎ সেখানে পৌঁছাতে পারনি,
পারবে না কোনোদিন;
যেখানে তুমি সেখানে বর্তমান
তোমার ভিতরে আমি— আমার ভিতরে জোড়াসাপ লীলায় মেতেছে


হিজল জোবায়ের / কবিতাভাবনা
বিশ্বগ্রামের ধারণাকে আমি এভাবে দেখি যে, এটা একটা শরীরের অঙ্গসংগঠনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে। একটা শরীর যদি টোটালিটির ধারণা হয়, তো দুনিয়া তাই, আর এখানে একেকটা ভূখণ্ড তার আত্মপরিচয় নিয়ে এই টোটালিটির সাথে অনিবার্যতার মাধ্যমে স্বীয় আত্ম-মর্যাদা বজায় রেখে যুক্ত, শরীরে যে বিন্যাসে প্রত্যকেটা অঙ্গ যুক্ত। কেউ কারো অলটারনেট না, দেখতে ছোটো বড় কিন্তু প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ। হাতের কাজ হাত করছে, মাথার কাজ মাথা, পায়ের কাজ পা, পায়ের কোন দরকার নাই মাথা হবার চেষ্টা করার। তো, এই যে গ্লোবালাইজেশন করে করে যারা নিজেদের বিশ্ব-নাগরিক ভাবে, তারা যদি এভাবে না দেখে মাথাকেই বা পা-কেই সারা শরীর ভেবে বসে, আর নিজে পা বা মাথা হবার চেষ্টায় রত হয় তাদের জন্য আমার দুঃখ। এটা আসলে সামগ্রিক সিস্টেমটাকেই একটা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। এটা দিনশেষে নিজের কাজ বা অর্জন বা পরিচয় হিসেবে কোনো অবস্থানই তৈরি করে না।
তো, আমি আসলে প্রথমত বাংলা কবিতাটা লিখতে চাই। সমকালীন প্রেক্ষাপটে, বিগত কালের প্রেক্ষাপটে সবভাবেই আজকের জন্য নিজেদের কবিতাটা কেমন হতে পারে সম্ভাব্য সব উপায়ে তা খুঁজে দেখতে চাই। এটা করতে যেয়ে আমাকে কোন সংকীর্ণতায় পৌছাতে হবে বলেও আমি মনে করি না, কারণ শরীরের পুরোটার সাথে সংযুক্ত থেকেও হাত শেষমেশ হাতই থাকে, এটা সেরকম।
আমার পেছনের সকল কালের বিবেচনা থেকেই আমি আমাদের কবিতার মূল পরিচয়, উৎকর্ষ, প্রবণতা, ভাষা, সুর, নার্ভে সবকিছুকেই নানাভাবে খতিয়ে দেখতে চাই, এবং আজকের দিনের কবিতার একটা পাটাতন নির্মাণ হোক সেইসকল বিবেচনা থেকে, সেটেই আমার একান্ত চাওয়া। এটা এক সমন্বয়।
আমার কাছে গত দীর্ঘ একটা সময় ধরে নিজেদের কবিতার বাইরে ইউরোপীয় কবিতা লেখার যে চল তৈরি হয়েছে সেটা ফাঁপা লাগতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। এর ভাষা, এর সুর, চিন্তাপদ্ধতি কিছুই আমাদের না, আমরা এটা বিলঙ করি না। এটা এক ধরনের হীনম্মন্যতাই মনে হয় শেষমেশ আমার। বুঝতে পারি না কিন্তু আসলে বিষম বিশ্বায়নের ধারণার দ্বারা তৈরিকৃত একটা হ্যাঙওভার এটা। এটা বলে পশ্চিম, শহুরে জীবন, প্রযুক্তি ইত্যাদি বেটার। পুঁজিবাদ, কনজিউমারিজম বিস্তৃত করার একটা রাজনীতিই এর সাথে যুক্ত।
আজকের এই বাস্তবতায় শিল্প-সাহিত্য রচনা নির্দোষ কোন বিষয় নয়। কখনোই ছিল না। সমাজ বাস্তবতার সাথে এর প্রত্যক্ষ যোগ আছে। আমি হয়তো জানি না আমি কোন দলের হয়ে ভুলভাবে, আমারই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছি। নিজের অবস্থানটাকে তাই বারবার প্রশ্ন করা দরকার, সন্দেহ করা দরকার। সেই প্রশ্ন আমি সবসময় আমার মধ্যে জাগরুক রেখে গতিশীল থাকতে চাই। বিশ্বায়নের নামে একধরনের সর্বগ্রাসী মেরুকরণকে আমি রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি জীব কী জড়ের অস্তিত্বের, বৈচিত্র্যের ন্যায্যতার কারণেই কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নই।
এই কথাগুলো আসলে এভাবে বলায় লাভ নেই, এর প্রত্যেক চাবিশব্দ আর বাক্য নিয়েই দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ আছে। তবু চাবিশব্দগুলিকেই আপাত নিদর্শন হিসেবে রেখে যাওয়া। আমি শুরুর কথাতেই ফিরি- ‘দেহভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড’। এই কথাটাকেই আমি আসলে বুঝে নিতে চাচ্ছি আমার মতো করে।
এটা সেই পুরাতন কথা, আর পুরাতন বলেই একে বারবার বুঝে নিতে চাই। গ্রীক কবি জর্জ সেফেরিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসের ভাস্কর্যগুলি সম্পর্কে, আর তিনি বলেছিলেন- এইসব ভাস্কর্য প্রাণহীন বা পুরাতন নয়, আমরাই এদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ভাষা ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি।
এই যোগাযোগহীনতার সুতাগুলি পুনরাবিষ্কারের সময় আজ আমাদের বাংলা কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে। একে গড্ডলিকা প্রবাহে মেতে অগ্রাহ্য করবার অবকাশ নেই।


কাজী নাসির মামুন / হিজল জোবায়ের-এর কবিতার পাঠ-প্রতিক্রিয়া
নতুন কবিতা পড়লাম। সঙ্গে কবিতাভাবনা। কবি হিজল জোবায়ের। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আদিম পুস্তকে এইরূপে লেখা হয়েছিল । নামকরনের সঙ্গে তার কাব্যের আদিমগন্ধী ভাব ও ভাষার সাদৃশ্য আছে। চিন্তাকে তিনি প্রকরণের মায়াজালে আটকাতে চেয়েছেন এই কাব্যগ্রন্থে। তার চিন্তার দার্শনিক সারবত্তা প্রাচীন রহস্যের রেশ রেখে যায়। আর কবিতাভাবনায় তিনি নিজে বলেছেন : ‘আমি আসলে প্রথমত বাংলা কবিতা লিখতে চাই।’ এই বাংলা কবিতা লেখার একটা অনুসন্ধানী দৃষ্টিকোণ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়। এই অনুসন্ধান আসলে নিরীক্ষার নামান্তর। তাই প্রথম কাব্যগ্রন্থে তার ভাষাভঙ্গিতে কিছুটা আরোপন লক্ষণীয়। স্ফূর্ততার চেয়ে নির্মিতির কৌশল তার কাব্যে গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। কিন্তু নির্মিতিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে যতটা শাসন প্রয়োজন সেই দিকটায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে কিছুটা শিথিলতা আছে। ফলে কোনো কোনো কবিতা অকারণে প্রগল্ভ হয়েছে। কবিতাভাবনায় তিনি বলেছেন : ‘এটা একটা সমন্বয়’। এই সমন্বয় প্রচেষ্টা উত্তর-উপনিবেশিক আমলের কাব্যচেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি তিনি আঁচ করতে পেরেছেন। এই সমন্বয় নিশ্চয়ই ব্যক্তির সঙ্গে দেশ ও জাতীয়তার এবং দেশ ও জাতীয়তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার। অর্থাৎ দেশজ উপকরণের সঙ্গে বৈশ্বিক উপাদানের সংমিশ্রণে একটি সমন্বয়বাদী প্রকরণ তিনি তালাশ করছেন। বলা বাহুল্য, এই তালাশ তার জন্য অভিনব হলেও বাংলাদেশের কবিতায় একেবারে নতুন প্রচেষ্টা ভাবা যাবে না। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, কামরুজ্জামান কামু এবং এরকম আরও অগ্রজ কবিগণ সেই প্রচেষ্টাকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়েছেন। স্বকীয়তা নির্মাণে হিজল জোবায়েরের জন্য তাই একটু সতর্ক পদক্ষেপ জরুরি মনে করি। ‘মশলা বন’ কিংবা ‘আফিম’ ইত্যাকার শব্দ উৎপল থেকে শুরু করে মাসুদ খান হয়ে মজনু শাহ পর্যন্ত এত বিস্তারিত যে, এসব শব্দ ব্যবহারে এই তরুণ কবি টেকনিক্যালি আরও সূক্ষ্ম হবেন আশা করি।
নতুন কবি হিসেবে স্বকীয়তার জন্য কিছুটা সময়তো লাগবেই। আর স্বকীয়তার শাণিত ইঙ্গিত তার কবিতায় আছে বলেই এই কথাগুলি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। নিজস্বতার প্রকরণগুণে তার কবিতাকে পরিণতির দিকে টেনে নিতে হবে, সেজন্যে তাকে ভাবতে হবে। বাইবেল থেকে আহরিত কিছু শব্দের সংশ্লেষ যে-অনুষঙ্গকে ইঙ্গিত করে, আমাদের কালচারাল পেরিফেরিতে সে-সবের খুব বেশি আনাগোনা নাই। ‘ইউরোপিয় কবিতা লেখার যে চল’ তার কাছে সেটা ‘ফাঁপা লাগতে শুরু করেছে।’ আর এরই ভারে তিনি কিছুটা আক্রান্ত হয়েছেন মনে হয়।
হিজলের কবিতায় বাংলা ভাষার আদিম, কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার সমন্বিত রেশ পাওয়া যায়। নামকরনের সঙ্গে তার কাব্যের ভাষা ও বিষয়ের সাদৃশ্য আছে। আছে দার্শনিক সারবত্তা, একথা আগেই বলেছি। কিন্তু একইসঙ্গে মনে হয়েছে তা যেন কখনও কখনও সুদূরের বিষয় হয়ে থাকছে। বাংলার সহজিয়া ভাবদর্শন তার কবিতায় আরও গভীর পরিচর্যা পেতে পারতো। রূপকথার পরিবেশ তার কবিতায় ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভাসিত। তার কবিতায় তাই ফ্যান্টাসির ঘোর কার্যকর থাকে। যদি বলি এই দূরত্ব নির্মাণই তার স্বকীয়তাকে কিছুটা স্পষ্ট করে তুলেছে। শাণিত করে তুলেছে তার কাব্যের শক্তিমত্তার দিকটিও। আমার পাঠানুভূতিকে এভাবেই প্রকাশ করতে পারি আমি। তবে তার ‘সমন্বয়’ বোধের সঙ্গে এখানে কিছুটা বিরোধ ঘটে গেছে বলে মনে হয়। আমি বিশ্বাস করি আজকের কবি কেবলি মৃত্তিকা-সংলগ্ন নন, নন শুধু ভূমিকেন্দ্রিক কেউ। মেট্রোপলিটান মেগা সিটিতে বাস করেও তিনি ভাবতে পারেন দেশ ও দশের কথা। ভাবতে পারেন ‘কেউ কারো অলটারনেট না, দেখতে ছোট-বড়, কিন্তু প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ।’ এই ‘প্রত্যেকে’র জায়গায় ‘স্বদেশ’কে প্রতিস্থাপন করলেই তার স্বাদেশিকতা উপলব্ধিতে আসে। হিজল জোবায়ের সেইদিকে যাত্রা শুরু করছেন বলে মনে হয়।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের বাইরে যে দশটি কবিতা আমি পাঠ করলাম, সেখানে হিজল জোবায়ের আরও সংহত, পরিণত। শক্ত গাঁথুনির উপর তার কবিতা দানা বেঁধে উঠেছে। নির্মাণ কৌশলে ধ্যানস্থ হলেও এখানে কবি আরও বেশি স্বতস্ফূর্ত। অক্ষরবৃত্তের কাব্যিক ব্যঞ্জনায় তার কবিতার দিকে তিনি আমাদের লোলুপ করে তুলেছেন :
উড়ে যায় মাঠ-পোড়া প্রান্তরের ঘাস
ধূমল বাতাসে ভাসা তীব্র হরিয়াল;
শ্রান্ত আনত ঘোড়ার মতন আকাশ-
থেকে নামো, হে মন্থর সোনালি বিকাল
(বিষদাঁত)
‘হলুদ পাখি’, ‘অথৈ দুপুর’, ‘নিম ফল’, বা ‘ঘোড়া নিমগাছ’, ‘ধানের মঞ্জরি আর ঠা-া বাতাসভর্তি এক ঋতু’, ‘কাঁসা পিতল থালা বাটি’, কচি কলাগাছ’, ‘সানাইয়ের ঢোল সুর’, ‘নৌকা-বোঝাই ফুল’ ইত্যাকার অনুষঙ্গ তার কবিতায় বাংলাদেশকে মুখ্য করে তোলে। ক্রমশ তিনি দেশ-সংলগ্ন হয়ে উঠছেন ঠিক এভাবেই। তার ‘সমন্বয়’ ভাবনায় আমূল ঢুকে যাচ্ছে স্বদেশ। ভাষার বিবেচনায় তা সবসময় অবশ্য সমসাময়িক নয়। আগের মতোই আদিম, কথ্য ও আঞ্চলিকের সংমিশ্রণে একটু রহস্যাশ্রয়ী এবং সেই অর্থে একটু দূরবর্তীতো বটেই :
কথা কও, শব্দে আইসো
বিটাধারী অয়ি অধ্বনিন
(বিটাধারী)
বাংলা ভাষার এই ¯œায়বকি দ্যোতনাকে আশ্রয় করেই তিনি থেমে থাকেননি। অক্ষরবৃত্ত ছাড়াও ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তের পারঙ্গমতা যাচাই করেছেন তার কবিতায় :
বুদ্বুদ-ফাটা / শব্দটি ছিল / সুর
বর্ণিল হয়ে / ফেটে পড়বার / আগে
বধির শুনেছে ,/ গেয়ে শুনিয়েছে / মূক
কানারাই ছিল / দলের অগ্র /ভাগে
কিন্তু একই কবিতায় পূর্ববর্তী একটি স্তবকের এই পর্ববিন্যাসের হেরফের আছে। বোঝা যায় প্রকরণের দৃঢ়তাকে নিজের মুঠোয় নিতে হিজল জোবায়ের নিরন্তর পরিচর্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন। নিতে চাচ্ছেন ভাষার দখল, ছন্দের স্বাধীনতা। তাই তার কবিতার অন্তর্জাল নির্মাণে তিনি হয়ে উঠছেন অন্যরকম কবি। কোথাও কোনো ¯ূ’’লতা বা তারল্য দিয়ে তিনি তার কবিতাকে খেলো করে ফেলেননি। তবে বাংলা কবিতার মূলধারা ভারতচন্দ্রের পর থেকে কিছুটা ইউরোপঘেঁষা প্রকরণে আত্মস্থ হয়ে উঠেছে। ফলে, বাংলা কবিতা লিখতে গিয়ে কোন ধারাবাহিকতা অনুসরণযোগ্য হবে সেটি বিবেচনায় নিলে পরিণতির দিকে তার কবিতা একদিন সমন্বয় প্রচেষ্টায় ভাস্বর হয়ে উঠবে, আশা করা যায়। চমৎকার কিছু কবিতা উপহার দেওয়ার জন্য হিজলকে অভিনন্দিত করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন